শেখ কামাল : স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নতুন দিনের কাণ্ডারী
শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সন্তান হিসেবে নয়, একজন অসাধারণ ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে শেখ কামাল ভাস্বর তাঁর আপন দ্যুতিতে। মাত্র ২৬ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে ফুটবলসহ ক্রীড়াঙ্গনে এত অসাধারণ অবদান রেখেছিলেন যে, সেই অসামান্য অবদানগুলোই তাঁকে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাব ‘আবাহনী’র প্রতিষ্ঠাতা এই ক্ষণজন্মা ক্রীড়াপ্রেমী মানুষটির ৭০তম জন্মদিবস আজ ৫ আগস্ট।
আবাহনী ফুটবল ক্লাবকে সবাই একনামে চেনেন। ‘শেখ কামাল’ নামটির সাথেও হয়তো পরিচিত বাংলাদেশের অনেকেই। কিন্তু, ক্রীড়াক্ষেত্রে শেখ কামালের অনন্য সাধারণ অবদানের ব্যাপারে জানেন না অনেকেই। যারা জানেন, তাদের জানাও হয়তো বিস্তারিত নয়। শুধু ফুটবল নয়, ক্রীড়াঙ্গনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তিনি রেখেছিলেন উল্লেখ করার মতো অবদান। নিজেও ছিলেন চৌকষ একজন খেলোয়াড়। শেখ কামাল কী ছিলেন আর কী তাঁর অবদান, সেটা জানতে হলে শৈশব থেকেই তাঁর জীবন সম্পর্কে ধারণা পেতে হবে।
খুব ছোটবেলা থেকেই সব ধরনের খেলাধুলায় প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল তাঁর। ঢাকার শাহীন স্কুলে থাকাকালীন স্কুলের প্রতিটি খেলার অপরিহার্য অংশ ছিলেন। তবে, ক্রিকেটটা তাকে টানত সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘদেহী ফাস্ট বোলার ছিলেন, নিখুঁত লাইন-লেন্থ আর প্রচণ্ড গতি দিয়ে খুব সহজেই টালমাটাল করে দিতেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে। অবিভক্ত পাকিস্তানের অন্যতম উদীয়মান পেসার ছিলেন। কিন্তু একমাত্র বাঙালি হবার কারণে এবং শেখ মুজিবের সন্তান হবার অপরাধে জাতীয় পর্যায়ে খেলার সুযোগ হয়নি তাঁর। যেমনটা বঞ্চিত হয়েছিলেন জুয়েল, মুশতাক, রকিবুলের মতো খেলোয়াড়। শহীদ মুশতাকের হাতে গড়া আজাদ বয়েজ ক্লাব তখন কামালদের মতো উঠতি প্রতিভাদের লালনকেন্দ্র। এখানেই শেখ কামাল বেশ কিছুদিন প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন। শুধু খেলাধুলাই নয়, পড়াশোনা, সঙ্গীতচর্চা, অভিনয়, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা থেকে শুরু করে বাংলা সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরবার চেষ্টা—সবখানেই ছিল শেখ কামালের প্রাণবন্ত উপস্থিতি।
ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ভর্তি হলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃত হয় তাঁর কর্মপরিধি। ছায়ানটের সেতারবাদন বিভাগের মেধাবী ছাত্র শেখ কামাল প্রতিষ্ঠা করলেন ঢাকা থিয়েটার। সু-অভিনেতা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যঅঙ্গনে সুপরিচিত ছিলেন তিনি। তবে তাঁর আগ্রহের মূল জায়গা ছিল, অবশ্যই, খেলাধুলা। এসময় বিভিন্ন খেলায় তাঁর অবাধ ও নিপুণ বিচরণ তাঁকে পরিণত করেছিল সত্যিকারের এক অলরাউন্ডারে।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বাসিন্দা শেখ কামাল ছিলেন হলের বাস্কেট বল দলের অধিনায়ক। বাস্কেট বলে অসামান্য দক্ষতা আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় খেলায় তাঁর হলের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রত্বকালীন পুরো সময়। তিনি সলিমুল্লাহ হলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দ্রুততম মানবও হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের বাস্কেট বল খেলোয়াড়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলের ক্রিকেট খেলোয়াড়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ব্যাডমিন্টনে (দ্বৈত) রানার্সআপ ইত্যাদি কৃতিত্বে ছিলেন ভাস্বর। শেখ কামাল এসময় ফুটবলও খেলতেন। তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন ফুটবল খেলোয়াড় সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। শেখ কামাল যেমন ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন, তেমনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৪ সালে বুয়েট মাঠে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ফুটবল দলের মধ্যে এক প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি।
এরইমধ্যে, ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানী সামরিক সরকার নিষিদ্ধ করল রবীন্দ্রসঙ্গীত। এতে সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠল দেশের সকল শ্রেণির মানুষ। শেখ কামালও প্রতিবাদে পালন করলেন অগ্রণী ভূমিকা। রবীন্দ্র সঙ্গীতই হয়ে উঠল তাঁর প্রতিবাদের ভাষা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে যেখানে যখনই সুযোগ পেলেন, তখনই বিশ্বকবির গান গেয়ে অসহিংস প্রতিবাদের অসাধারণ উদাহরণ রেখেছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর দেশপ্রেমিক শেখ কামালও জড়িয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধে। পিতা শেখ মুজিব তখন পাকিস্তানের কারাগারে। পুত্র শেখ কামাল বাঙলা মায়ের সম্ভ্রম রক্ষা করতে ঝাপিয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধে। বন্ধুরাষ্ট্র ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক মরহুম জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এই যোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বিরামহীন ছিল তাঁর কর্মস্পৃহা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে নিজের অসামান্য মেধা আর অক্লান্ত কর্মক্ষমতা নিয়ে পিতার ডানহাত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শেখ কামাল।
শেখ কামালের দুর্নিবার ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের চিত্রটাই পাল্টে দেওয়ার। সেই ইচ্ছে বাস্তবায়নে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই মাঠে নেমে পড়েন তিনি। দেশে ফিরেই আবাহনী সমাজকল্যাণ সংস্থা গড়ে ১৯৭২ সালে সংস্থার নামে কেনা হলো ইকবাল স্পোর্টিং ফুটবল দল। ক্রিকেট আর হকির দল কেনা হল ইস্পাহানী স্পোর্টিংয়েরটা। এগুলোর সমন্বয়ে নতুন যাত্রা শুরু হলো ‘আবাহনী ক্রীড়া চক্র’ নামে একটা ক্লাবের। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি এই খেলাগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন কামাল। স্বপ্ন দেখতেন একদিন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রীড়া অঙ্গনে এক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। সেই লক্ষ্যে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন সবক্ষেত্রেই। উপমহাদেশের মধ্যে প্রথমবারের মতো আধুনিকতার ছোঁয়ায় পাল্টে দিয়েছিলেন সব খেলার খোলনলচে। ক্র্যাক প্লাটুনের বীর যোদ্ধা আবদুল হালিম খান জুয়েলের মতো অসাধারণ সব প্রতিভাগুলো যেন আর হারিয়ে না যায়, সেই লক্ষ্যে ক্রিকেটকে ঢেলে সাজাবার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন কামাল। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্রিকেটারদের খুঁজে বের করে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দিয়ে তৈরি করছিলেন নতুন দিনের জন্য। যাতে করে তাঁরা আইসিসি ট্রফিতে ভালো করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে সক্ষম হয়।
আর ফুটবলে তো রীতিমতো বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন এই দেশপ্রেমিক ক্রীড়া সংগঠক। অসাধারণ ও আধুনিক পরিকল্পনা দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে। সেই ১৯৭৩ সালে আবাহনীর জন্য নিয়ে এসেছিলেন নামি বিদেশি কোচ বিল হার্টকে। তখন ক্লাব তো দূরের কথা, এই উপমহাদেশে কোনো জাতীয় দলেরই বিদেশি কোচ ছিল না। আর তাই তো ১৯৭৪ সালে আবাহনী যখন কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ‘আই এফ এ’ শিল্ড টুর্নামেন্ট খেলতে যায়, তখন আবাহনীর বিদেশি কোচ আর পশ্চিমা বেশভূষা দেখে দারুণ বিস্মিত হয়েছিলেন সেখানকার কর্মকর্তা আর সমর্থকেরা! পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ খেলা আবাহনী ক্রীড়াচক্র দর্শকের অবাক মুগ্ধতা অর্জন করেছিল ছোট ছোট পাসে মাঠজুড়ে চমৎকার ফুটবল দিয়ে। শেখ কামাল আসলেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন পুরো উপমহাদেশের ফুটবলে!
শুধু ফুটবল বা ক্রিকেট নয়, হকিতেও বাংলাদেশকে ভালো একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল ক্ষণজন্মা এই মানুষটির। ১৯৭৫-এ তিনি জীবনসঙ্গিনী করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু অ্যাথলেট, নিপুণ নারী ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামালকে। কিন্তু, সংসার জীবন তাঁরা যাপন করতে পারলেন মাত্র কয়েক মাস। তাঁর অসাধারণ গতিময় ও প্রাণবন্ত জীবন ছিনিয়ে নেয় নির্মম, অপরিণামদর্শী ঘাতকের বুলেট। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্যদের সাথে সপরিবারে নিহত হন তিনি।
মাত্র ২৬ বছর বয়সেই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর অসামান্য অবদান শুধু আফসোসই বাড়িয়ে দিতে পারে দেশের মানুষের। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন নিঃসন্দেহে আরো শক্তিশালী হতো, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও হয়তো থাকত না এরকম সাফল্যের খরা। ক্রিকেটে হয়তো বাংলাদেশ ওয়ানডে ও টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যেত আরো আগেই। ফুটবলের সুদিন হয়তো আর হারাত না। তবে, একজন অসাধারণ ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে শেখ কামাল অনেক প্রজন্ম ধরে খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংগঠকদের প্রেরণার উৎস হয়ে আছেন ও থাকবেন, সেকথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।