কফি সমাচার
কফি নামটা শুনলেই অনেকের মধ্যে চাঙ্গাভাব চলে আসে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা কিংবা একঘেয়ে ভাব দূর করতে কফির বিকল্প নেই। আর এই কারণেই বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা বাণিজ্য শিল্প হলো কফি। জেগে থাকতে হলে কফি চাই এমনই নিয়ম। অনেকের যেমন দিন শুরু হয় না, তেমনি অনেকের রাতজাগাও অসম্পূর্ণ থেকে যায় কফি ছাড়া।
কফি মূলত একটি ফল। আমরা যে কফি পান করি, তা কফির বীজ বা বিন, গুঁড়ো করেই তবে তৈরি হয় কফি। ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে ডাচ koffie শব্দের মাধ্যমে coffee শব্দটি ইংরেজি ভাষায় গৃহীত হয়। এই ডাচ শব্দটি আবার তুর্কি শব্দ kahve থেকে উদ্ভূত; তুর্কি শব্দটি আরবি qahwa শব্দেরই পরিবর্তিত রূপ। এই শব্দান্তরের ভেতরেই লুকিয়ে আছে কফির বিস্ময়কর ইতিহাস।
কফির আবিষ্কার
কফির আবিষ্কার নিয়ে বেশ কিছু মতবাদ রয়েছে। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গল্পটি একজন মেষ পালককে ঘিরে। নবম শতকে ইথিওপিয়ায় বাস করত খালদি নামের এক দরিদ্র মেষপালক। একদিন খেয়াল করল তার ছাগলগুলো অন্যদিনের চেয়ে আজ একটু বেশি লাফালাফি করছে। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখল লাল জামের মতো একটি ফল খাচ্ছে ছাগলগুলো। ঘটনার বর্ণনাসহ কারণ জানতে ফলগুলো সে নিয়ে যায় মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে। তারপর সেই ইমাম এবং তার ছাত্ররা মিলে এই ফল থেকে তৈরি করে পানীয়, যা আজ কফি হিসেবে পরিচিত।
অন্য আরেকটি মত অনুযায়ী, কফি মূলত ইয়েমেনে আবিষ্কার হয়। সেখানে ঘোতুল আব্দুল নুরুদ্দীন আবুল আল-হাসান আল-সাদিলি নামে একজন সুফি ছিলেন। তিনি একবার ইথিওপিয়া সফর করতে গেলে একটি পাখিকে লাল রঙের একটি ফল খেতে দেখে কৌতূহলবশত নিজেও তা খেয়ে দেখেন। এরপর আগের সেই গল্পের মতোই তিনিও চাঙ্গা অনুভব করেন এবং আবিষ্কার হয় কফির।
বিক্রির দিক থেকে তেলের পরেই রয়েছে কফি
বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়ে থাকে তেল। আর এরপরই যে বস্তু সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় তা হলো কফি। সারা পৃথিবীতে বছর জুড়ে প্রায় ৫০০ বিলিওন কাপ কফি তৈরি হয়। তবে কফিপানের পরিমাণের দিক থেকে আমেরিকানদের ধারেকাছেও কেউ নেই। আমেরিকানরা গড়ে প্রতিদিন ৪০০ মিলিওন বা ৪০ কোটি কাপ কফি পান করে। বছর শেষে যার পরিমাণ প্রায় ১৪৬ বিলিওন। এরমধ্যে শুধু নিউইয়র্ক শহরে সারা পৃথিবীর তুলনায় প্রায় সাত গুণ বেশি কফি পান করা হয়।
পাপের বাহন কফি
কফি আবিষ্কারের পেছনে মুসলমানদের অবদান থাকলেও একটা সময় সৌদি কিংবা মিশরের মতো দেশে ফতোয়া জারি করে কফিপান নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। একই পরিস্থিতি দেখা দেয় ইউরোপেও। ইতালির ভেনিসেও পৌঁছে গিয়েছিল কফি। কিন্তু এই কফি মুসলমানদের আবিষ্কার হওয়ার কারণে এবং রেড ওয়াইনের জায়গা গ্রহণ করে ফেলায় কট্টর ক্যাথলিকেরা একে শয়তানের তিক্ত আবিষ্কার বলে মন্তব্য করেন। যদিও পরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সবখানেই কফি জায়গা করে নেয় সগৌরবে।
সারা বিশ্বে প্রায় ৫০টির মতো দেশ কফি উৎপাদনের সাথে জড়িত। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত আছে প্রায় ৫ কোটি মানুষ। আবিষ্কার অন্যত্র হলেও বর্তমানে সারা বিশ্বে মোট উৎপাদিত কফির ৪০ শতাংশ আসে ব্রাজিল থেকে। বিভিন্ন দেশে ও স্থানে কফি উৎপাদিত হলেও আমেরিকার হাওয়াই-এর কফি সবচেয়ে দামি এবং সর্বোৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
কফির প্রকারভেদ
পৃথিবীব্যাপী যত কফি আছে তাকে মূলত দুইভাগে ভাগ করা যায়—এরাবিকা এবং রোবুস্টা। এরাবিকাই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। রোবুস্টা খুব তিতকুটে হওয়ার ফলে এর চাহিদা খুব বেশি নেই।
তবে পানীয় হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় কফি হলো এসপ্রেসো। “এসপ্রেসো” শব্দের অর্থ আক্ষরিকভাবেই “জোর করে কিছু বের করে দেওয়া!” এটি তৈরি করা হয় ফুটন্ত পানি কফির গুঁড়োর ভেতর দিয়ে চালনা করে। জেনে অবাক হবেন সাধারণ কফির তুলনায় প্রতি একক ঘনত্বে ক্যাফেইন প্রায় তিনগুণ বেশি থাকে এসপ্রেসো কফিতে।
অন্যদিকে ডিকেইফ নামে একধরনের কফি আছে যেটাকে বলা হয় ক্যাফেইনমুক্ত কফি। এই কফি বানানোর সময় বেশি রোস্ট করা হয় বলে অনেক ক্যাফেইন উড়ে যায়।
দামি কফি
দুনিয়ার অন্যতম দামি কফি—“Kopi Luwak”—এর প্রতি আউন্স বীজের দাম ৬০০ ডলার! অবাক হলেন? এখানেই শেষ না। অবাক হওয়ার এখনো অনেক বাকি। সুমাত্রান নামে এক জাতের জংলি বিড়াল আছে যাদের এই কফির বীজগুলো খাওয়ানো হলেও হজম হয় না।
ফলে আংশিক পরিবর্তিত হয়ে বেরিয়ে আসে বিষ্ঠার সাথে। বলা ভালো সুমাত্রান বিড়ালের বিষ্ঠা থেকে উদ্ধারকৃত বীজগুলো থেকেই তৈরি করা হয় পৃথিবীর অন্যতম দামি কফি “Kopi Luwak”।
রোগ মুক্তি এবং আক্রান্ত হওয়ার বাহন কফি
কফি একই সাথে রোগমুক্তির এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণ হতে পারে। কাউকে মেরে ফেলেতে চাইলে তাকে একাধারে প্রায় ১০০ কাপ কফি খাওয়ালেই চলবে। আবার একই সাথে পরিমিত কফি পান হতে পারে আপনার জন্য আশীর্বাদ। এতে যেমন অবসাদ কাটে তেমনি এতে পাওয়া গেছে নারীদের স্কিন ক্যান্সার প্রতিরোধের উপাদান, আছে ডায়াবেটিস টাইপ ২ এবং বয়ঃবৃদ্ধদের আলঝেইমার রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে সক্ষম নানান উপাদান। কফিপানে হৃদপিণ্ডের গতি বৃদ্ধি পায়। এটি শরীরে উদ্যম ও উৎসাহ তৈরি করে।