দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন : কারণ, ফলাফল ও ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস



শেহজাদ আমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
চাকরির সন্ধানে এভাবেই গলায় প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা

চাকরির সন্ধানে এভাবেই গলায় প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা

  • Font increase
  • Font Decrease

কখনো কখনো একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মহা-বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা মেটাতেই সমস্যায় পড়ে দেশের মানুষ। ভেঙে পড়ে অর্থনৈতিক খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আমাদের বাংলা ভূখণ্ডও যেমন দেখেছে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ বা ‘পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ’। তেমনি পশ্চিমা বিশ্বও ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছিল গত শতকের ত্রিশের দশকে, যা ইতিহাসে ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা ‘মহামন্দা’ নামে পরিচিত। পূর্বের দেশগুলোর মঙ্গা বা দুর্ভিক্ষের চেয়ে পশ্চিমের এই অর্থনৈতিক মহামন্দার প্রেক্ষাপট হয়তো বেশ ভিন্ন। কিন্তু, সেই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সংঘটিত হয়েছিল, এর তুলনীয় বিপর্যয় খুব কমই দেখেছে বিশ্ব।

এই মন্দায় নানারকম সমস্যা তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রের সকল স্থানীয় এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়। বেকার হয়ে পড়েন কোটি কোটি আমেরিকান। ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা মেক্সিকান শরণার্থীদের একাংশ নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন।

শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই ধ্বংসাত্মক প্রভাব বিস্তার করেনি এই মহামন্দা। তৎকালীন মার্কিন রাজনৈতিক আবহাওয়াও পাল্টে দেয় এটি। ব্যর্থতার দায়ভার কাঁধে নিয়ে বিদায় নিতে হয় ক্ষমতাসীন রিপাবলিকানদের। স্বাভাবিকভাবেই তারা আবার নির্বাচিত হতে পারেননি। ক্ষমতায় আসে ডেমোক্রেটরা। আর এসেই অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে কোমর বেঁধে নেমে পড়তে হয় তাদের।

যেভাবে শুরু এই বিপর্যয়ের

১৯২০ সালের পর ব্যাপক পরিবর্তন আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে। তখন দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে দেশটির অর্থনীতি। বড় শহরগুলোতে গড়ে ওঠে ব্যক্তিগত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং বড় কলকারখানা।

একই সময় মার্কিন প্রশাসন কৃষি এবং রেলখাতেও উন্নয়নের কাজ শুরু করেছিল। যার ফলে লক্ষ লক্ষ নাগরিকের স্থায়ী কর্মসংস্থান তৈরি হয়। বেড়ে যেতে থাকে তাদের আয়। নতুন নতুন কলকারখানার সঙ্গে তৈরি হয় উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, কর্পোরেট অফিস এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

কর্মসংস্থানের অভাব না থাকায় প্রায় সকল নাগরিকের হাতেই ছিল প্রচুর পরিমাণে অলস টাকা। অর্থ বিনিয়োগ করার আদর্শ জায়গা মনে করে তারা ঝুঁকে পড়েন শেয়ার বাজারে দিকে। কেউ কেউ তো নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে হয়ে ওঠেন স্থায়ী বিনিয়োগকারী। আর দিনে দিনে বাড়তে থাকে এই প্রবণতা।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেই সময় একজন বাবুর্চি থেকে শুরু করে একজন কারখানার মালিক—প্রায় সবাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতেন! নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনে হাজার মানুষের ভিড় ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার।

১৯২৯ সালের আগস্টে এসে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজার অবস্থান করছিল এর শীর্ষবিন্দুতে। ওই বছরের গ্রীষ্মে দেশটির জাতীয় উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে এবং মার্কিন নাগরিকরা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের দিকে মনোনিবেশ করায় কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এবার শেয়ার বাজারে ঢালাও বিনিয়োগের নেতিবাচক রূপটাও ধীরে ধীরে অনুভব করতে থাকেন সবাই।

তখন একদল নাগরিক, ব্যবসার নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেগুলো শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন। এতে করে স্থানীয় ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় তৎকালীন সরকার। সব মিলিয়ে এক ধরনের অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রের বড় শহরগুলোতে। কিন্তু এত শত সমস্যার মাঝে একদিনের জন্যেও কমেনি শেয়ারের দাম!

অতঃপর ১৯২৯ সালের অক্টোবরের শেষদিকে ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। কিছু সংখ্যক ভীতু বিনিয়োগকারী সেই সময় তাদের সব শেয়ার বিক্রি করতে থাকেন। আর তাদের মদদ দিচ্ছিলেন কিছু সংখ্যক অসাধু বিনিয়োগকারী।

শুধুমাত্র ২৪ অক্টোবর একদিনে বিক্রি হয়েছিল প্রায় ১২.৯ মিলিয়ন শেয়ার! আর এটিকে একটি সুযোগ ভেবে লক্ষ লক্ষ লোক ব্যাংক থেকে ঋণ করে শেয়ার কেনেন। গ্রেট ডিপ্রেশনের ইতিহাসে সেদিনটি চিহ্নিত হয়ে আছে ‘কালো বৃহস্পতিবার’ নামে। মূলত সেদিনই অর্থনৈতিক মহামন্দার দিকে প্রথম পা ফেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ফেডারেল রিলিফ জবের প্রত্যাশায় হাজার হাজার বেকার লোক সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে নিউ ইয়র্কের স্টেট লেবার ব্যুরোর সামনে। সময়কাল ১৯৩৩ ◢ 


এর চার দিন পর ২৯ অক্টোবর নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি খায়। সেদিন প্রায় ১৬ মিলিয়ন শেয়ার বিক্রি হয়েছিল। মূলত বিপর্যয় বুঝতে পেরে, একটি মহল চারদিন আগে ক্রয় করা শেয়ারগুলো বিক্রি করতে থাকে।

কিন্তু, সেটি বুঝতে পারেননি মধ্যম ও নিম্ন পর্যায়ের শেয়ারগ্রহীতারা। কম দামে পাওয়ার লোভে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেসব শেয়ার কেনেন তারা। আর এরই মাঝে শুরু হয় দরপতন। হাহাকার নেমে আসে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে। ইতিহাসে ওই দিনটিকে ‘কালো মঙ্গলবার’ হিসেবে উল্লেখ করেন অর্থনীতিবিদরা।

গ্রেট ডিপ্রেশনের ভয়াবহ ছোবল

১৯২৯ সালের অক্টোবরের ওই দুই দিনে প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন নতুন বিনিয়োগকারীরা। আর এর প্রভাব পড়তে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের ছোট-বড় সকল ক্ষেত্রে।

কয়েকদিনের মধ্যে অর্ধেক হ্রাস পায় শিল্পকারখানার উৎপাদন। ব্যবসায় নিশ্চিত ক্ষতি বুঝতে পেরে কর্মী ছাঁটাই শুরু করে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। কোথাও কোথাও গুলিবর্ষণ করে কর্মীদের মেরে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটে। দোকানগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও, ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছিলেন না বিক্রেতারা।

মহামন্দার মোকাবেলায় দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হোভারের প্রশাসন ◢ 


মাত্র এক বছরের মাথাতেই বেকার হয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রের এক কোটি নাগরিক। ১৯৩১ সালে গিয়ে ঠেকে দেড় কোটিতে। রাষ্ট্রপতি হার্বার্ট হোভারের প্রশাসনও এই অবস্থায় দিশেহারা হয়ে যায়। তারা তাদের বেশকিছু বড় প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। যার কারণে বেকার হয় আরো লক্ষ লক্ষ মানুষ। গোটা যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করে। সেই সময় মানুষ অভাবের তাড়নায় নিজেদের ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করতেও ক্রেতা খুঁজতেন। শুধু তাই নয়; অবস্থা এতটাই বেগতিক ছিল যে, কৃষকেরা নিজেদের ফসল সংগ্রহের সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেন! ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কাজ খুঁজতে শুরু করেন তারা।

‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা মহামন্দার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পতন এবং বেকারত্ব বেড়েছে ২৫%। ‘বিষণ্নতা’ দ্রুত ইউরোপ এবং বাকি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসে এটি সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক পতন। গ্রেট ডিপ্রেশন শেষ হয় ১৯৪১ সালে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও বেকারত্বের হার কমে না।

ধনী ও দরিদ্র উভয় দেশসমূহে মহামন্দার প্রভাব ছিল বিধ্বংসী। ব্যক্তিগত আয়, কর, মুনাফা ও মূল্যমানের ব্যাপক পতন ঘটে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও ৫০% কমে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ২৫% বেড়ে যায় এবং কিছু কিছু দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩%।

পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে মহামন্দার প্রভাব তীব্র ছিল, বিশেষ করে ভারী শিল্পের ওপর নির্ভরশীল শহরগুলোতে। অনেক দেশে নির্মাণকাজ একরকম বন্ধই ছিল। ক্ষতির মুখে পড়েছিল কৃষক সম্প্রদায় ও গ্রাম্য এলাকাসমূহ, কারণ শস্যের মূল্য ৬০%-এ নেমে এসেছিল। গুটিকয়েক চাকরির উৎসে অত্যধিক চাহিদার কারণে প্রাথমিক শিল্প, যেমন খনির কাজে চাপ সৃষ্টি হয়।

গ্রেট ডিপ্রেশনের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বেশির ভাগ দেশেই ত্রাণ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় এবং অনেক দেশ রাজনৈতিক বিপ্লবের সম্মুখীন হয়। ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচারী শাসনের কাছে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। বিশেষ করে ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত নাৎসি জার্মানি পাল্টে দেয় ইউরোপীয় রাজনীতির গতিপথ।

যেভাবে মহামন্দা কাটিয়ে উঠল যুক্তরাষ্ট্র

১৯৩৩ সালের মার্চে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ডেমোক্রেট নেতা ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। ডেমোক্রেটরা পরিবর্তনের আশ্বাস দেন, যা মার্কিনিদের আকৃষ্ট করেছিল। তাই নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন ছিল অবশ্যম্ভাবী। আর দায়িত্ব নেওয়ার ১০০ কার্যদিবসের মধ্যে রুজভেল্ট প্রশাসন আশার আলো দেখাতে শুরু করে। নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্ব দূরীকরণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুরু হয়।

মহামন্দা মোকাবেলায় দারুণ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ◢ 


রুজভেল্ট প্রথমেই চারদিনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ দেশের সমস্ত ব্যাংক বন্ধ ঘোষণা করেন। ওই চারদিনের মধ্যে তিনি কংগ্রেসে নতুন আইন পাশ করিয়ে শিল্প, কৃষি ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে গতিশীল করার উদ্যোগ নেন।

পুরোদমে শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর কার্যক্রম। রুজভেল্ট ব্যাংকের নিয়মনীতি পরিবর্তন করেন। নিয়ম করেন শুধুমাত্র আমদানির জন্যই প্রদান করা হবে ঋণ। আর এই শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে থাকে স্থানীয় ব্যাংকগুলো।

বেশ কিছু বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছিল রুজভেল্ট প্রশাসন। প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে নাগরিকদের কর্মক্ষেত্র তৈরি করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। সে প্রকল্পের মধ্যে টেনেসি ভ্যালি অঞ্চলের বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ছিল উল্লেখযোগ্য।

উক্ত প্রকল্পে ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত, স্থায়ীভাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন মার্কিন নাগরিক। শুধুমাত্র একটি প্রকল্পের মাধ্যমেই রুজভেল্ট প্রশাসন অর্ধেক নাগরিকের অবস্থান পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। এছাড়াও ডেমোক্রেটরা নেতৃত্ব কাঁধে নেওয়ার পরের ৩ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি গড়ে বেড়েছিল ৯ শতাংশ।

রুজভেল্ট প্রশাসনের সংস্কারপন্থী মনোভাবের কারণে ১৯৩৮ সাল থেকে আবারও অর্থনৈতিক-উন্নতির দেখা পায় মার্কিনিরা। রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়ে পার্থক্য কমতে থাকে, সেই সাথে মানুষও হয়ে ওঠে সাবলম্বী। ব্যাংকগুলোও আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ায় এবং শেয়ারবাজার আগের অবস্থানে ফিরে যায়।

যদিও সেই সময়ও অর্থনৈতিক মহামন্দা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি দেশটি। কারণ ক্ষতি কাটিয়ে আগের অবস্থানে ফিরে আসতে প্রয়োজন ছিল আরো কিছু সময়ের।

মহামন্দার দুটো তাত্ত্বিক কারণ

মহামন্দার দুটো ধ্রুপদী তত্ত্ব হল কেইনেসিয় (চাহিদা চালিত) এবং অর্থ-কেন্দ্রিক ব্যাখ্যা। এছাড়া বিভিন্ন প্রচলিত তত্ত্ব কেইনেসিয় বা অর্থ-কেন্দ্রিক ব্যাখ্যাকে বর্জন করে থাকে। চাহিদা চালিত তত্ত্বে বলা হয় বাজারের ওপর আস্থা হারানোর ফলে ভোগের পরিমাণ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত ব্যয় কমে যায়। একবার মূল্যহ্রাস পাওয়ার ফলে অনেক মানুষ ধারণা করে নতুন করে বাজারে বিনিয়োগ না করে তারা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। টাকা বিনিয়োগ না করায় মূল্যহ্রাস পেলে তারা লাভবান হয় এবং চাহিদা কমায় স্বল্পমূল্যে অধিক পণ্য ক্রয় করতে পারে। অর্থ-কেন্দ্রিক ব্যাখ্যাকারীরা মনে করেন মহামন্দা সাধারণ দরপতন হিসেবে শুরু হয় কিন্তু অর্থ সরবরাহ সঙ্কুচিত হতে থাকলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকে এবং এই সাধারণ দরপতন মহামন্দার রূপ ধারণ করে।

এই ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনৈতিক ইতিহাসবেত্তাগণ সমানভাবে বিভক্ত। তারা মনে করেন প্রথাগত আর্থিক ব্যাখ্যা অনুসারে মহামন্দার প্রাথমিক কারণ আর্থিক খাতের সাথে সম্পর্কিত, বা প্রথাগত কেইনেসিয় ব্যাখ্যা অনুসারে মহামন্দার প্রাথমিক কারণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যয়, বিশেষ করে বিনিয়োগ সংক্রান্ত ব্যয়ের পতন। বর্তমানে এই বিতর্ক তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় কারণ ঋণ সংকোচন তত্ত্বের কিছু মূলধারার সমর্থন পাওয়া যায় এবং মিল্টন ফ্রিড্ম্যান ও আনা শোয়ার্ট্জ-এর আর্থিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তৈরি হাইপোথিসিসে অ-আর্থিক ব্যাখ্যাও যোগ করা হয়েছে।

ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম-এর আর্থিক সংকোচন এবং ব্যাংকিং পতন রোধ করা উচিত ছিল বলে মনে করেন। যদি ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম তা করতে পারত তাহলে মন্দার প্রভাব আরো কম তীব্র এবং স্বল্পস্থায়ী হতো।

মহামন্দা নিয়ে রচিত সাহিত্যকর্ম

মহামন্দা বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় অনেক সাহিত্যকর্মেই। কারণ সাহিত্যিকগণ এমন একটি যুগকে উপস্থাপন করেন যেখানে মানুষের জীবনের ওপর ক্রিয়াশীল ছিল অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপ। এই বিষয়ের ওপর রচিত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও প্রসিদ্ধ উপন্যাস সম্ভবত ১৯৩৯ সালে জন স্টেইনব্যাকের রচিত ‘দ্য গ্রেপ্স অফ র‍্যাথ’। বইটি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ও পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করে। বইটিতে বর্গাচাষী এক পরিবারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে যারা খরা, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা ও কৃষিজাত শিল্পের পরিবর্তনের ফলে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়।

মহামন্দার সময়কালের ওপর নির্ভর করে রচিত হয়েছে ‘দ্য গ্রেপস অব র‍্যাথ’-এর মতো কিছু কালজয়ী উপন্যাস ◢ 


স্টেইনব্যাকের ‘অফ মাইস অ্যান্ড মেন’ মহামন্দা সময়কালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসিকা। এছাড়া হার্পার লির ‘টু কিল আ মকিংবার্ড’ মহামন্দার প্রেক্ষাপটে রচিত। মার্গারেট অ্যাটউড রচিত বুকার পুরস্কার বিজয়ী ‘দ্য ব্লাইন্ড অ্যাসাসিন’ও কিছুটা মহামন্দার প্রেক্ষাপটে রচিত, যেখানে সুবিধাভোগী সমাজের এক নারী এক মার্ক্সবাদী বিপ্লবীর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যায়।

পুঁজিবাদী ও আধা-পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের রূপ হয় ভিন্ন ভিন্ন। অর্থনৈতিক সংকটে যে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও পড়তে পারে, এর জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ হচ্ছে গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের মহামন্দা। এরপরে, ২০০৮ সালের দিকেও সাব-প্রাইম মর্টগেজের বিপর্যয়ের কারণে সংকটে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। তবে, ত্রিশের দশকের মহামন্দার মতো সংকটে আর পড়তে হয়নি দেশটিকে।

   

ইতিহাসে ২৮ মার্চ: বর্ণবাদের প্রতিবাদে কিংয়ের পক্ষে ২৫ হাজার মানুষ



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

  • Font increase
  • Font Decrease

মানব ইতিহাস আমাদের অতীতের কথা বলে। আজ যা কিছু বর্তমান তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল আমাদের অতীতের কারণেই। সেই অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ছাপ রেখে যায় ইতিহাসের পাতায়।  

আজ ২৮ মার্চ, ২০২৪। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখঅ যাবে, আজকে ঘটেছিল নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। জেনে নেয়া যাক, কি ঘটেছিল আজকের তারিখে!

*মার্টিন লুথার কিং ছিলেন বর্ণবাদের বিপরীত আন্দোলনকারী আফ্রিকান নেতা। ১৯৬৫ সালে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। সেখানে ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ তাকে সমর্থন করে মিছিলে নেমেছিলেন আজকের তারিখে। এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে আলাবামায় জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার তৈরিতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।    

*যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক কেন্দ্রে ১৯৭৯ সালে পানির পাম্প ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে চারপাশে তেজস্ক্রিয় বাষ্প এবং আয়োডিন ছড়াতে শুরু করে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে কর্মরত ৫০০ জন কর্মী এই বাষোপর সংস্পর্শে আসায় শারীরিক সমস্যার আশঙ্কায় ছিল। আমেরিকার জনগণ এই ঘটনায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।  

*১৯৮৬ সালে অ্যাচেসন এবং লিলিয়েনথাল পারমারবিক শক্তি সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা উল্লেখ করেন তারা। ২৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের সেই রিপোর্টটি প্রকাশ করে।

*হিলসবোরো দুর্ঘটনায় প্রায় ১শ লোকের প্রায় গিয়েছিল ১৯৯১ সালে। শেফিল্ডে পিষ্ট হয়ে ৯৬ জন লিভারপুল ফুটবল সমর্থক নিহত হন। এছাড়া আরও দেড় শতাধিক ভক্ত আহত হন। এই বিপর্যয়ে আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট ছিল নিহতদের পরিবার। তাই, আজকের তারিখে তারা রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল।

*১৯৩৬ সালে শুরু হওয়া স্পেনের গৃহযুদ্ধ ১৯৩৯ সালের ২৮ মার্চ শেষ হয়েছিল।

;

তালপাতার পাখায় ঘোরে সংসারের চাকা



মাহবুবা পারভীন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বগুড়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। যা দেখে মনে পড়ে যায় রবী ঠাকুরের কবিতা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’ বলছি বগুড়ার কাহালু উপজেলার আড়োলা গ্রামের কথা। বর্তমানে গ্রামটি তাল পাখার গ্রাম নামে পরিচিত। এই গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা যায় নারী-পুরুষ সবাই তালপাতা দিয়ে পাখা বানানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গরমে তালপাতার পাখার বাতাস গা জুড়িয়ে যায়।

বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পাশাপাশি দুটি গ্রাম। একটির নাম যোগীরভবন, অপরটি আড়োলা আতালপাড়া। ইতোমধ্যে গ্রাম দুটি পাখার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, দুটি গ্রামে একেক পাড়ায় একেক ধরনের পাখা তৈরি হয়। যোগীরভবন গ্রামে নারীরা তৈরি করেন হাতলপাখা বা ডাঁটপাখা। আর আড়োলা আতালপাড়ায় তৈরি হয় ঘোরানো পাখা বা ঘুন্নী পাখা আর পকেট পাখা। পাখা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন দুটি গ্রামের সব নারী। শীতের শেষে বসন্তকালে, অর্থাৎ ফাল্গুন মাস থেকে পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়।

পাখা তৈরিতে ব্যস্ত নারী

গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বাড়ির উঠানে রং তুলির আঁচড়ে ঘুরানো পাখা রাঙিয়ে তুলছেন সখিনা বেগম। রাঙানো পাখা বাঁধায় করছেন গোলজার। বাঁধা হয়ে গেলে পাখাটি বিক্রি করবেন তিনি।

হাতপাখার গ্রামে এবার ২০ লাখ পাখা বিক্রির প্রস্তুতি চলছে। এই পাখা চৈত্র মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত বিক্রি হবে।

গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা অবসর সময়ে পাখা তৈরির কাজ করেন। বংশ পরম্পরায় এই দুই গ্রামের মানুষ তালপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন বলে জানান গ্রামের বাসিন্দারা। গরমে ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে দিন দিন বাড়ছে পাখার চাহিদা, সেই সঙ্গে বাড়ছে পাখা তৈরির কাজের পরিধি।

আড়োলা গ্রামের খন্দকার বলেন, দাদার আমল থেকে তারা তাল পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি তালপাখা তৈরির কাজ করেন তিনি। তার স্ত্রীও সংসারের কাজের ফাঁকে রঙের আচর দিয়ে তাল পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করে থাকেন। আকরাম আকন্দ বলেন, গত বছর তিনি পাখা বিক্রি করে সংসার খরচ বাদে এক লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন। তার মতে গত বছর দুই গ্রাম থেকে ১৫ লাখ তালপাখা বিক্রি হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এবার চাহিদা বাড়ায় ২০ লাখ পাখা বিক্রি হবে বলে তিনি জানান।

জানা যায়, তালগাছের পাতা (স্থানীয় ভাষায় তালের ডাগুর) দিয়ে তিন ধরনের পাখা তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে নাম দেয়া হয়েছে- পকেট পাখা, ঘুরানী পাখা এবং ডাগুর পাখা।

পাখা তৈরিতে তালের পাতা ছাড়াও বাঁশ, সুতা এবং লোহার তার প্রয়োজন হয়। পাখা তৈরির পর বিভিন্ন রঙের আচর দিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। ১০ টাকায় কেনা তাল গাছের একটি পাতা বা ডাগুড় দিয়ে তৈরি হয় বড় পাখা বা ডাগুর পাখা ২টি, ঘুরানী পাখা ৪টি এবং পকেট পাখা ৬টি।

তালপাতার পাখা

পাখা তৈরির কারিগর জানান, বছরের আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয় বাঁশ এবং তালপাতা সংগ্রহের কাজ। এরপর বাঁশ ছোট ছোট আকারে কাটতে হয়। তালপাতাও কেটে পাখা তৈরির উপযোগী করা হয়। ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে পাখা তৈরির কাজ। চৈত্র মাসের শুরু থেকে পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাহারি রঙ করে বিক্রয় উপযোগী করা হয়।

রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, সৈয়দপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা আসেন তালপাখা কিনতে।

যোগীর ভবন গ্রামের মামুনুর রশিদ বলেন, তিনি প্রতি বছর ১৭ থেকে ১৮ হাজার ডাগুর পাখা তৈরি করেন। এই পাখাগুলো বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাখার চাহিদা বেশি বলে জানান মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, একটি তাল পাতা বা ডাগুরের দাম ১০ টাকা হলেও বাঁশ ও রঙের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খরচ বেড়ে গেছে।

আতাইল পাড়া গ্রামের পারভীন, মর্জিনা, সাবিনা, বেবি, সুমি জানান, তারা প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি হাত পাখা তৈরি করে বিক্রি করেন। বছরের ছয় মাস সংসারের কাজের ফাঁকে হাতপাখা তৈরির কাজ করে তারা বাড়তি আয় করছেন। এইসব নারীরা তাদের সৌখিন জিনিস কিনে থাকেন নিজের টাকায়।

পকেট পাখা ১১ টাকা, ঘুরানী পাখা ২০ টাকা এবং ডাগুর পাখা ৩০ টাকা দরে ব্যাপারীরা পাইকারি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা আবার বিভিন্ন মেলা কিংবা হাটে বাজারে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন।

গরমের সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণে হাতপাখার চাহিদা বাড়ছে বলে পাখা কিনতে আসা ব্যাপারী করিম জানান। শহর এবং গ্রামে তীব্র গরম থেকে একটু প্রশান্তি পেতে ধনী-গরিব সবাই হাত পাখার ব্যবহার করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।

;

ইতিহাসে ২৭ মার্চ:স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

  • Font increase
  • Font Decrease

সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের সাথে বছরের পর বছর কেটে যায়। বর্তমান হয় অতীত। তার সাথেই তৈরি হয় ইতিহাসের। মানব সভ্যতায় ঘটে যাওয়া ইতিহাস হয়ে থাকে জাতির কাছে স্মরণীয়। প্রতি বছর যখন ক্যালেন্ডারে একই তারিখগুলো ফিরে আসে, মানুষ পুরনো ঘটনার স্মৃতিচারণ করে।

আজ ২৭ মার্চ, ২০২৪। বিগত বছরগুলোতে এই তারিখে ঘটা অনেক ঘটনা হয়েছে স্মৃতিতে অমলিন। ইতিহাসের পাতায় জুড়ে গেছে নতুন নতুন ঘটনা। চলুন জেনে নিই,আজকের তারিখে কি ঘটেছিল!    

১৯৭৭ সালে স্পেনে টেনেরিফ বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। ডাচ এয়ারলাইনের সেই দুর্ঘটনায় কাউকেই জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। রানওয়েতে দু’টো জেট বিমানের সংঘর্ষে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে উৎপন্ন বিধ্বংসী দাবানলে সর্বমোট ৫৮৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়।

বিশাল এক ঢেউয়ের আঘাতে ১৯৮০ সালে উত্তর সাগরের প্ল্যাটফর্ম ধসে পড়ে। রিগটি ডান্ডি থেকে ২৩৫ মাইল পূর্বে সেই আবাসন প্ল্যাটফর্ম দুর্ঘটনায় ১২৩ জন শ্রমিক মারা যান।

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে কমিউনিটি পার্টির অনেক রাশিয়ান উচ্চতর কর্মকর্তা পরাজিত হন। তৎকালীন সময়ে এই ঘটনাকে একটি বিদ্রোহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।     

১৯৬৩ সালে ব্রিটেনে রেললাইন কম ব্যবহৃত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপুল ক্ষতি হয়। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মোট রেলব্যবস্থার এক-চতুর্থাংশ সেবা কমিয়ে দেওয়া হবে। এই নিয়ে সুদূরপ্রসারী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল ২৭ মার্চ।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

;

আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয় ‘পাক বিধান’



সম্পাদকীয় বিভাগ, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, স্বল্প সময়েই এর প্রবক্তাদের উচ্চাশা কোটি কোটি অধিবাসীদের দুরাশায় পরিণত হয়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়, তা পাকিস্তানি শাসকদের সীমাহীন অবিচার আর দুঃশাসনে এক নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র ধারণ করে। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনিতে মোহিত করা অধুনা পূর্ববঙ্গবাসীর আকাঙ্খা বছর গড়াতেই দুঃস্বপ্নের রূপ নেয়। শুরু হয় নব্যঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকদের কবল থেকে নিজেদের স্বাধিকার আদায়ের প্রাণান্তর চেষ্টা। আমরা জানি, পূর্ববঙ্গের ন্যায্যতা প্রশ্নে উদাসীন পিন্ডির শাসকদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে গড়ে উঠা প্রতিরোধ আন্দোলন ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পায়। ভাষা আন্দোলনে শহিদদের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে বাংলা। ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ‘মুক্তিযুদ্ধে’ ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তে ও দুই লক্ষ নারীদের চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় চূড়ান্ত মুক্তি।

আজ ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে আমরা জানার চেষ্টা করব ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলিতে স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল বাঙালি জাতি কি আত্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামের পথে ধাবিত হয়েছিল। ১০ চৈত্র ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯) কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তাদের সম্পাদকীয় পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে সেই সময়কার দৃশ্যপট। স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ আয়োজনে বার্তা২৪.কম পুনঃপ্রকাশ করছে আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয়।

গত চার মাস ধরিয়া পাকিস্তানে যে তুলকালাম কা- চলিয়াছে নানা জন নানা ভাবে তাহার ব্যাখ্যা করিতে চাহিবেন এটাই স্বাভাবিক। কেহ বলিতেছেন, পাকিস্তান আর একটি বিয়াফ্রা বা ভিয়েৎনাম সৃষ্টি হইতে চলিয়াছে। মৌলানা ভাসানিরও মনে হয় তাহাই অভিমত, তিনি গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়াছেন, বলিয়াছেন, সে মহৎ কর্মে কুড়িলক্ষ পাকিস্তানীর জান কোরবানি করিতে তিনি তৈয়ার। লারকানরি আমুদে-যুবা ভুট্টো ‘প্লেবয়’ হিসাবে খ্যাত হইলেও আগুন লইয়া খেলায় কতখানি মাতিবার সামর্থ্য রাখেন, সে বিষয়ে অনেকেরই বিলক্ষণ সন্দেহ। বিশেষতঃ, পশ্চিম পাকিস্তানে শুধু ফৌজীদের ঘাঁটি নয়, মওদুদি তথা মোল্লাদেরও ছাউনি পড়িয়াছে। শুধু ভুট্টোর ধারণা নাকি পাকিস্তানে ‘বিপ্লব’ চলিয়াছে, এবং এ বিপ্লব যদিও অন্তরে ঐশ্লামিক, লক্ষ্যে-সমাজতান্ত্রিক।

চারিদিকে সকলের মুখে মুখে যখন ‘‘বিপ্লবের’’ ফুলঝুরি, তখন পাক-আইনমন্ত্রী সৈয়দ মহম্মদ জাফর অনায়াসে প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিগুলিকেও আখ্যা দিতে পারিতেন-‘‘বিপ্লব’’। একসঙ্গে শাসনতন্ত্রের নব্বুইটি অনুচ্ছেদের পরিবর্তনের চিন্তা আপাতদৃষ্টিতে নিশ্চয়ই প্রকৃতিতে বিপ্লবাত্মক। ১৯৫৮ সনের অক্টোবরে আয়ুব যখন আচমকা গদীয়ান হন , সে ঘটনা অন্যের চোখে বিশুদ্ধ সামরিক অভ্যুত্থান হইলেও পাকিস্তানে বলা হয় ‘অক্টোবর রিভলিউশন’, আইনমন্ত্রী নির্দ্বিধায় ফেডারেল ব্যবস্থা নামক বিলটির নাম দিতে পারিতেন ‘‘মার্চ রিভলিউশন’’-আয়ুব এক জনমে দুইটি বিপ্লবের কৃতিত্ব লাভ করিতেন!

জাফর সাহেব আয়ুব খাঁর তরফ হইতে যে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা শুনাইয়াছেন তাহার সারমর্মঃ পাকিস্তান এক যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হইবে। সরকার পরিচালনা করিবেন মন্ত্রিসভা; তাহার শীর্ষে থাকিবেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতিও থাকিবেন একজন, তবে তিনি থাকিবেন রবার স্ট্যাম্প মাত্র। তাঁহাকে নির্বাচন করিবেন রাজ্য আইনসভার সদস্যবৃন্দ। অন্যরা সকলে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে নির্বাচিত হইবেন, ইত্যাদি কথাবার্তার ধরণ দেখিয়া মনে হইতে পারে চৌদ্দমাস ধরিয়া বিস্তর কাঠখড় পোড়াইয়া মাথা খাটাইয়া ১৯৬২ সনে আয়ুব যে শাসনতন্ত্র তাঁহার দেশকে উপহার দিয়েছিলেন সেটির খোলনলচে বুঝি সবই পাল্টাইতে চলিয়াছে। বলা হইয়াছে পরিকল্পিত নূতন শাসনতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যÑইহা এককেন্দ্রীয় নয়, ফেডারেল বা যুক্ত রাষ্ট্রীয়; দ্বিতীয়ত ইহাতে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার স্বীকৃত, তৃতীয়ত স্বীকৃত জনসাধারণের ভোটাধিকারের দাবিও।

শেষোক্ত অধিকারটি নিশ্চয়ই পাক নাগরিকদের কাছে মস্ত পাওনা, এক যুগেরও পরে তাঁহারা একটি মৌলিক অধিকার পাইতে চলিতেছেন। এবিষয়ে পুনর্বিবেচনা করিয়া দেখিবার জন্য আয়ুব অবশ্য ১৯৬৩ সনে একটি কমিশন বসাইয়াছিলেন। তাহারাও বলিয়াছিলেন-প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার মানিয়া লওয়া সঙ্গত। আয়ুব তাহাতে রাজী হইতে পারেন নাই, আর একটি কমিটী বসাইয়া সিদ্ধান্তটিকে নিজের পছন্দসই করাইয়া লইয়াছিলেন। আইনমন্ত্রী জাফর বলিয়াছেন-আগামী মাসেই জাতীয় পরিষদে একটি ‘বিল’ আনিয়া সকলকে ভোটের অধিকার দেওয়া হইবে। ‘‘ঠগের বাড়ির নিমন্ত্রণ: না আঁচাইলে বিশ্বাস নাই’Ñতবু মনে হইতেছে নীট লাভ এইটিই।

যুক্তরাষ্ট্রের যে রূপরেখা মিলিয়াছে তাহাতে মনে হয়, খোল নলচে পালটাইলেও কলকেতে সেই পুরনো তামাকই পুড়িবে। নলটি প্রেসিডেন্টের নয়, প্রধানমন্ত্রীর মুখে লাগানো থাকিবে-এই যা। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের ‘এক ইউনিট’ কর্তার ইচ্ছায় অতঃপর দুই হইবে হয়তো কিন্তু জনসাধারণের ইচ্ছা অনুযায়ী ‘বহু’ হইতেছে না। দ্বিতীয়ত কেন্দ্রীয় সংসদে সব ত্যাগের সমনাধিকার , অর্থাৎ চলতি নিয়মই বহাল থাকিবে, আসন জনসংখ্যার অনুপাতে বন্টিত হইতেছে। ফলে পূর্বের উপর পশ্চিমীদের আধিপত্য থাকিয়াই যাইবে।

পাক শাসনতন্ত্রে অমুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার অধিকার নাই, নয়া-শাসনতন্ত্রে বাঙালী মুসলমানের পক্ষে সে সম্ভাবনা সামান্য। সাত কোটি বাঙালীর উপর পাঁচ কোটি পশ্চিম পাকিস্তানীর শাসন শোষণ চলিতেই থাকিবে। বিশেষত, পাক সামরিক বাহিনীতে বা দেশরক্ষা ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি মিলে নাই। পাকিস্তানের সামরিক খরচ বাজেটের শতকরা ষাট ভাগের বেশী সেখানে টাকা দিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানকেও কিন্তু বাহিনীতে তাহার ভূমিকা নামমাত্র। পশ্চিম পাকিস্তান তাহার আসল বল হাতের ওই মুগুরটি হাতছাড়া করিবে কি?

খাঁটাইয়া দেখিলে সন্দেহ থাকে না, আয়ুব স্বায়ত্বশাসনের ধোঁকা দিতেছেন মাত্র। যে আঞ্চলিক স্বাধীনতার কথা জাফর শুনাইয়াছেন, অন্য ভাষায় পুরনো শাসনতন্ত্রেও সে-সব প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের দুই অঙ্গে বৈষম্য তবু বাড়িয়াছে বই কমে নাই। মোটকথা শেখ মুজিবর রহমান যে ছয়দফা চাহিয়াছিলেন তাহার সামান্যই দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাইতেছে। শেখ মুজিবর তাহার ইঙ্গিত পাইয়াই গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফলকে আখ্যা দিয়াছিলেন-শূণ্য। তিনি এবং তাঁহার দল নাকি একটি বিকল্প ফেডারেল শাসনতন্ত্রের খসড়া রচনা করিতেছেন।

আগামী মাসে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে তাহা উত্থাপিত হইবে। তদানুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে গঠিত হইবে চারিটি রাজ্য, পূর্বে একটি। কেন্দ্রীয় আইনসভায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মানিয়া লওয়া হইবে। সরকারী ‘‘বিল’’ এবং এই বেসরকারী ‘‘বিল’’-দুইয়ের ভাগ্যই কিন্তু এখন অবধি অনিশ্চিত। আয়ুবের মতলব নাকি-যাবতীয় পরিবর্তনের প্রস্তুতি আগামী বছর ২৩ মার্চের মধ্যে শেষ করা-এক যুগ পরে প্রেসিডেন্টের তখনই বানপ্রস্থে যাত্রার ইচ্ছা। তাঁহার দ্বিতীয় বাসনা, সব পরিবর্তনই নিয়মতান্ত্রিক পথে হোক। কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করিতেছেন, পাক জাতীয় পরিষদের সম্মতি লইয়া শাসনতন্ত্র সংশোধন সম্ভব নাও হইতে পারে।

দুই পাকিস্তানেরই প্রতিনিধি সংখ্যা সেখানে সমান, সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়ুব কি প্রয়োজনীয় দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পাইবেন? আর মুজিবুরের ‘‘বিল’’ যদি পাস হইয়া যায়, তবে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা কি তাহা মানিয়া লইবেন? সুতরাং লক্ষণ দেখিয়া মনে হয় না পাকিস্তানের সংকট কাটিবার মুখে। বরং মনে হইতেছে, প্রকৃত সংকট ক্রমে আরও ঘনাইয়া আসিতেছে। দিশাহারা আয়ুব পশ্চিম পাকিস্তানে গভর্নর বদল করিয়াছেন, পূর্ব-পাকিস্তানেও মোনেম খাঁর বদলে নূতন গভর্নর নিযুক্ত হইয়াছেন হুদা।

পশ্চিম হইতে পুবে সৈন্য আমদানির কথাও শোনা যাইতেছে। পাকিস্তান কোন্ পথে চলিয়াছে? বিলাতের একটি কাগজ বলিতেছে-বিচ্ছিন্নতার পথে। নূতন শাসনতন্ত্রে জোড়াতালির যতো চেষ্টাই করা হোক, একটি সত্য আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট, ধর্মীয় ঐক্য খানিকদূর অবধি কাজে লাগে, বেশীদূর নয়। যদি তাহা না হইত তবে লাহোর অধিবেশনের আটশ বছর পরে, পাকিস্তান-স্বপ্নের তথাকথিত ঐতিহাসিক জন্মতারিখের দুইদিন আগে পাক নেতাদের এই মেকি ‘ফেডারেল-ইজম’ এর স্তোকবাক্য শুনাইতে হইত না!

প্রকাশকাল: সোমবার ১০ চৈত্র ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯): আনন্দবাজার পত্রিকা

সংগ্রহ: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;