‘আমার সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি, তোমাকে দিলাম’



ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পহেলা আষাঢ়। শুরু হলো জলমগ্ন মেঘ ও বৃষ্টির ঋতু বর্ষার । এমন মায়াবী দিনে মানুষ প্রিয়ার হাতে বরাভয়ের হাত রেখে বলতে চায়: ‘আমার সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি – তোমাকে দিলাম।’ কিন্তু গান, কবিতা, সাহিত্যের মতো বর্ষা নিয়ে এতোটা রোমান্টিক কি আজকাল বাস্তবিকই হওয়া সম্ভব হয়?

আকাশ জুড়ে মেঘের মেলা আর বৃষ্টির নিক্কন এখন সামাজিক জীবনে বিড়ম্বনার সমার্থক হয়েই এসেছে। সাহিত্যের ‘বর্ষাদূত’ হাল আমলে ‘ভীতিরদূত’ও বটে। বর্ষা বর্তমানে এন্তার সমস্যার নামান্তর। যদিও আবহমান বাঙালি জীবনে ঋতুচক্রে বর্ষার গুরুত্ব অনেক। বর্ষায় বাংলার প্রকৃতি অবগাহন করবে সজীব বারিধারায়। কাব্য কথায় এসেছে, ‘আষাঢ়স্য’ প্রথম দিনেই নাকি কদম বনে হলদে-সাদা মঞ্জুরীর উচ্ছ্বাস বইতে শুরু করে। বাংলা প্রকৃতিতে দৃশ্যমান হতে থাকে স্নিগ্ধতার অন্যরকম আবেশ। হাল আমলে সে আবেশ পর্যবসিত হয়েছে বিড়ম্বনায়।

বর্ষা নিয়ে কবিতায় বলা হয়েছে, “মেঘে আঁধার হল দেখে/ ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,/ শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে/ কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।/আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু/শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।/ কালো? তা সে যতই কালো হোক,/ দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।” কবি যে বর্ষাকে মানবীর চিত্রকল্পে ‘কালো হরিণ-চোখ’-এর মায়াময়তায় অংকিত করেছেন, সে বর্ষা এখন চোখ রাঙাচ্ছে নিরাপদ জীবনকে। অতলে তলিয়ে নিয়ে জমা-পানিতে। আমরা সেই পানিকে যথাযথভাবে গ্রহণ ও ব্যবহারের পথ রাখি নি বলেই জীবন নামের পানি হয়েছে কষ্টের কারণ।

প্রচলিত একটি বাংলা জারি গানে আছে: “আইলোরে আষাঢ় মাস /লাগাইলো চারা গাছ/গাছে গাছে ঝগড়া করে/মূল্য বেশি কার?” বর্ষণসিক্ত পরিবেশ বৃক্ষরোপণের উপযুক্ত সময় হিসেবেই বিবেচ্য স্মরণাতীতকাল থেকেই। সারাদেশে বৃক্ষমেলার আয়োজন হয়ে থাকে এ মাসেই। কিন্তু এ কাজটিও আমরা ঠিক ঠিক করছি না। পাহাড়ের গাছ এবং খোদ পাহাড়টিকেই কেটে ফেলছি। ভূমিধ্বস আর পাহাড়ধ্বসে মরছে তাই অসংখ্য মানুষ।

বঙ্গাব্দের অন্যান্য মাসের মতো বর্ষার দুইটি মাস আষাঢ় ও শ্রাবণের নামকরণও হয়েছে তারার নামে। সে তারার নামে মাসগুলো. অথৈ পানি তাদের বৈভব। যে নবধারা জলে- ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’সহ নিসর্গ চেতনা প্রতিটি প্রকৃতি প্রেমিক মনকেই আলোড়িত করার কথা থাকলেও পরিস্থিকিতে আমরা উপভোগের জায়গা থেকে নিয়ে গিয়েছি বিপদের জায়গায়। ‘কালো হরিণ-চোখ’ কিংবা কদম, শাপলা, পদ্ম, চালতা, কেতকী ফুল ফোটার বর্ষার দেখার উপায় নেই জলে আবদ্ধ বিপন্ন নাগরিকের।

অথচ একমাত্র ‘কবি শেখর’ কালিদাসই বর্ষা ঋতুকে নিয়ে কমপক্ষে ত্রিশটি কবিতা লিখেছেন। ‘ছন্দের জাদুকর’ খ্যাত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বর্ষাকেন্দ্রিক কবিতাগুলো হলো ‘বর্ষা’, ‘ইলশে গুঁড়ি’ ও ‘বর্ষা নিমন্ত্রণ’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষাপ্রীতি রীতিমতো প্রবাদতুল্য। এছাড়া আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসীমউদদীন, শক্তিমান কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা প্রমুখ কবি বর্ষাকে তাদের সাহিত্যকর্মে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে।

চিত্রশিল্পীরাও বর্ষাকে ক্যানভাসে আঁকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পটুয়া কামরুল হাসানের ‘বৃষ্টির দিনে খেয়া ঘাট’ শীর্ষক চিত্রকর্মটি আজো অনন্য হিসেবে স্বীকৃত। ফলের সমাহার এ মাসে এসেও লক্ষণীয়। আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, লুকলুকি, জামরুল, লিচু, লটকন - আরও কতো দেশীয় ফল! বিপন্ন নগর জীবনের আক্রান্ত নাগরিকদের পক্ষে বর্ষার নান্দনিক রূপের মতো ফুল-ফলে আমোদিত হওয়াও সম্ভব হয় না। কারণ আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বন্ধুতুল্য-প্রকৃতিকেই শত্রুতে রূপান্তরিত করেছি।

কিভাবে সম্ভব হবে বর্ষার নানা উৎসব উপভোগ করা? যখন জীবনকেই বর্ষার ছন্দময় সময়ে আমরা আক্রান্ত ও বিপদগ্রন্ত দেখতে পাচ্ছি। অথচ বর্ষার আরেক পরিচয় উৎসবের জন্য সুবিদিত। বিশেষ করে ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’, পালনকারীদের কাছে বড়ই আরাধ্য এ ঋতু। কে না জানে এ মাসে রথযাত্রা উৎসব হয়। হিন্দু শাস্ত্র মতে, পুরীর জগন্নাথের স্মরণে এই উৎসব টেনে নিয়ে যায় এবং স্নান করিয়ে ফিরিয়ে আনে। এই প্রত্যাবর্তনই ‘উল্টো-রথযাত্রা’নামে পরিচিত।

এ উপলক্ষে বসে মেলা। গ্রামবাংলায় তো মেলা মানে সার্বজনীন আনন্দ জোয়ার। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক) সর্বশেষ ১৩৯০ বঙ্গাব্দে প্রণীত ‘বাংলাদেশের মেলা’ গ্রন্থে ৬৮টি বর্ষাকালীন মেলার কথা বর্ণিত হয়েছে। এগুলোর মাত্র ১৬টি ছাড়া বাকি ৫২টিই রথযাত্রা কেন্দ্রিক। রথযাত্রা কিংবা উল্টো-রথযাত্রা মেলা সর্বাধিক সংখ্যক বসে ময়মনসিংহ জেলায়, যার সংখ্যা ১৫টি। এছাড়া বসে জামালপুর, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, পাবনা, যশোর, রাজশাহী, ফরিদপুর জেলায়। তবে ঢাকার ধামরাই ও মানিকগঞ্জের রথযাত্রা উৎসবের খ্যাতি দেশজোড়া।

অতএব অফুরন্ত আনন্দ ও উৎসবের বর্ষা উপকারী হলেও ক্রমে ক্রমে আমাদের ব্যবহারিক জীবনের ভুল পদক্ষেপ ও প্রকৃতিবিরোধী অনাচারের কারণে বর্ষার অপকারী নানা দিকও আমাদেরকে অক্টোপাসের মতো চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। সজল বর্ষা প্রকৃতিতে ফুরফুরে আমেজ আনলেও নদীগুলোতে পানি প্রবাহ বেড়ে, শহরে-নগরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে জনজীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। এর দায় বর্ষার না আমাদের? এই পরিস্থিরি জন্য দায়ি কে? প্রকৃতি? নাকি প্রকৃতি বিনাশী মানুষ?

বিদিত যে, বর্ষা পানির সাথে পলি বয়ে এনে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা হিসাবে বাংলাদেশকে বিনির্মিত করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। বর্ষা ঋতুই প্রাণপ্রবাহ জাগিয়েছে সবুজাভ বাংলাদেশের। তাই প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ বর্ষাকে বলেছেন- ‘ধ্যানমগ্ন বাউল, সুখের বাঁশি’। বিদায়ী গ্রীষ্মের পুরোটা জুড়েই যখন ছিল দাবদাহের দাপট, তখন বর্ষাই আনে ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তিরও বারি।’ যখন ‘শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়ায়ে/ঊর্ধ্বমুখে নরনারী।’ বর্ষায় মানুষের প্রাণ জুড়ায়। প্রকৃতি আবার জেগে উঠে।

কিন্তু জলবায়ুগত পরিবর্তনের প্রভাবে এবং আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ-বিরুদ্ধ নানা (অপ)পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; ঋতুর ইতিবাচক দিকের চেয়ে নেতিবাচক ও ক্ষতিকর দিকগুলোই বড় হয়ে উঠছে। বর্ষা হয়েছে ‘কারো জন্য পৌষ মাস, কারো জন্য সর্বনাশ’।

তথাপি বর্ষায়, বিশেষ করে ছুতোর সম্প্রদায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাতদিন কাজ করছে। কাঠের তক্তা ‘রান্দা’ দিচ্ছে, ‘পাতাম’ ঠুকে নৌকা বানাচ্ছে। গলুইওয়ালা নৌকা, কোষা, ডিঙ্গি নৌকা। পানিতে নয়, জলমগ্ন রাস্তাতেও চলছে সেই নৌকা। বর্ষার নতুন পানি পেয়ে সোনা ব্যাঙের দল সমস্বরে গেয়ে উঠছে ‘গ্যাঁকো-গ্যাঁকো’, মাছ শিকারে নামছে পেশাজীবী, সৌখিন মানুষ। উৎফুল্ল ময়ূরের মতোই চিন্তাশীল-ভাবুকেরা মনের পেখম তুলে অনির্বচনীয় অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে।

অনেকেই আনুষ্ঠানিকতায় বর্ষাকে বরণ করেন। অনেকেই, বিশেষত, সর্ব-সাধারণ নগরজীবনে বর্ষার কুপ্রভাব, প্রকোপ ও পানিবন্দিত্ব কাটাতে লড়াই করেন। বর্ষামঙ্গল যেন বাস্তবতা ছেড়ে চলেছে স্মৃতি ও কল্পনার রাজ্যে। অঝোর বৃষ্টিতে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ যেন আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছে চরম দুর্ভোগে।

বর্ষার কষ্টগুলোকে দমন করে নিসর্গময় অনিন্দ্য দিন আর রাত্রিকেই ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রচেষ্টায় নগর জীবনে এমন আনন্দময় বর্ষা আনতে হবে, যার সারাটা দিন ও বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু ফোটাগুলো নিশ্চিন্তে প্রিয়তমের হাতে তুলে দিয়ে মন খুলে বলা যায়: ‘আমার সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি – তোমাকে দিলাম।’

কিংবা বৃষ্টির চিত্রকল্পে খুঁজে পাওয়া যায় প্রিয়জনের নস্টালজিক ইমেজ: 'তোমার শহরে বৃষ্টি এখন, আমার শহরে রোদ/

তোমার দু'চোখে ঝরছে অঝোরে আমার জীবনবোধ'। আসলেই, বর্ষা হলো বাঙালির প্রেম ও প্রকৃতিচেতনার চিরায়ত ধ্বনিমাখা অবিরাম জীবনবোধ।

   

আমার হাতের পাখা যেন তাদের আরাম দিচ্ছে!



মৃত্যুঞ্জয় রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সাতক্ষীরা
ছবি: বার্তা২৪, তালপাতার পাখা বিক্রি করছে পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ

ছবি: বার্তা২৪, তালপাতার পাখা বিক্রি করছে পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ

  • Font increase
  • Font Decrease

আবু বক্কর (৬২)। বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে তিনি এখন পাকা বিক্রেতা। প্রচণ্ড তাপদাহে মানুষ যখন ঠান্ডা বাতাসের প্রশান্তি খুঁজছে, তখন তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে তালপাতার পাখা বিক্রি করছেন।

আবু বক্কর বার্তা২৪.কমকে বলেন, স্ত্রীসহ ছয় মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। তবে মেয়েদের বিয়ে দিতে পেরেছি। কিন্তু বয়সের ভারে ঠিকই আমরা একা থেকে গেলাম। শেষ বয়সে গ্রামে গ্রামে তালপাতা পাখা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। শুধু সংসার না, এই টাকায় আমার পায়ের শিরার ব্যথার ওষুধও কিনতে হয়। একবেলা ওষুধ না খেলে চলতে পারি না।

এদিকে, পুরনো ব্যবসার ঋণের বোঝা আর অন্যদিকে অসুস্থ হয়ে ওষুধসহ সংসারের খরচ। শেষ বয়সে তালপাতার পাখাই আমার একমাত্র জীবনসঙ্গী বলেন আবু বক্কর।

তালপাতার পাখা বিক্রি করছেন আবু বক্কর, ছবি- বার্তা২৪.কম

বুধবার (২৪ এপ্রিল) সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার কলাগাছি গ্রামের কবিগানের অনুষ্ঠানে সরেজমিন দেখা যায়, একপাশে তালপাতার পাখা বিক্রি করতে ব্যস্ত ছোট্ট পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ। এই গরমে যখন তার ঘরে থাকার কথা, তখন সে নানা-নানীর সঙ্গে এসে তালপাতার পাখা বিক্রি করছে। কবিগানে বসে থাকা সব শ্রোতার কাছে গিয়ে বলছে, পাখা লাগবে, পাখা! কথা বলতে চাইলেও এ পাশ ওপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, ক্রেতার কাছে।

এক ফাঁকে তাকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, এই বয়সে পাখা বিক্রি করছো কেন! এ প্রশ্নের উত্তরে বার্তা২৪.কমকে মাহমুদুল্লাহ বলে, প্রচণ্ড গরমে স্কুল ছুটি। তাই, নানা-নানীর সঙ্গে চলে এসেছি মেলায় পাখা বিক্রি করতে। মানুষজন আমার কাছ থেকে যেন বেশি পাখা কেনে (ক্রয়), তাই আমি মেলায় তাদের সঙ্গে এসেছি।

অনেক উৎসাহের সঙ্গে সে বলে, গরমে আমার হাতের পাখায় যেন তাদের আরাম দিচ্ছে! মেলা হলে আমি সেখানে চলে যাই পাখা বিক্রি করতে। ঘোরাঘুরিও হয় আর টাকা ইনকামও হয়। টাকার জন্য বের হয়ে পড়েছি। আমরা পাখা বিক্রি করে পেট চালাই। নানা-নানী বুড়ো হয়ে গেছে। তাই, আমি সঙ্গে এসে তাদের কষ্টটাকে একটু ভাগাভাগি করে নিচ্ছি।

যেখানে প্রচণ্ড তাপে মানুষজন নাজেহাল, সেখানে ছোট্ট মাহমুদুল্লাহ ছুটে চলেছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাখা বিক্রি করতে। ছোট্ট শিশু হলেও গরম যেন তার কাছে কিছু না, পেটের তাগিদে!

আরেক পাখা বিক্রেতা তালা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামের বাসিন্দা ভদ্রকান্ত সরকার (৭০)। ১২-১৪ বছর ধরে এই পেশায় আছেন তিনি।

চলছে তালপাতার পাখার বিকিকিনি, ছবি- বার্তা২৪.কম

শেষ বয়সে পাখা কেন বিক্রি করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বার্তা২৪.কমকে ভদ্রকান্ত বলেন, চাল কিনে খেতে হয়। খুব কষ্টের সংসার! ছেলে-মেয়ে আছে। তারা তাদের মতো কাজ করে খায়। মা বাবার বয়স হয়ে গেলে ছেলে আর আমাদের থাকে না। আমরা বৃদ্ধ বয়সে কেমন আছি, সেটা জানার সুযোগ তাদের থাকে না। শেষজীবনটা এভাবে পাখা বিক্রি করে কাটিয়ে দেবো। কী আর করবো! কপালে যা আছে, শেষপর্যন্ত তাই হবে। কপালে ছিল, এমন বৃদ্ধ বয়সে গ্রামে গ্রামে পাখা বিক্রি করতে হবে!

;

৪ লাখ বছর আগে আদিম মানুষের যাত্রা শুরু



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত, নিউ সায়েন্টিস্ট থেকে

ছবি: সংগৃহীত, নিউ সায়েন্টিস্ট থেকে

  • Font increase
  • Font Decrease

৪ লাখ বছর আগে রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে আদিম মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল বলে নতুন এক গবেষণা থেকে জানা গেছে। এখান থেকে যাত্রা শুরু করে এই গোত্রের মানুষ পরে উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায়।

নতুন এক গবেষণা জানাচ্ছে, সাইবেরিয়ায় নতুন একটি এলাকার সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে ৪ লাখ ১৭ হাজার বছর আগে হোমিনিনস (Hominins) গোত্রের মানুষের উপস্থিতি ছিল। এই গোত্রের মানুষ ডিরিং ইউরিআখ এলাকায় বাস করতেন। সেখান থেকে তারা উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায় বলে জানিয়েছেন চেক প্রজাতন্ত্রের এক গবেষক।

১৬ এপ্রিল চেক অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষক জন জেনসেন এক সংবাদ সম্মেলন করে নতুন এ তথ্য প্রকাশ করেন। গবেষণাবিষয়ক সংবাদ সাময়িকী নিউ সায়েন্সটিস্ট এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে জন জেনসেন বলেন, আমরা আগে যে ধারণা করতাম, তারও আগে থেকে হোমিনিনস গোত্রের মানুষ সাইবেরিয়ার ডিরিং ইউরিআখ এলাকায় বসবাস করতেন। ৪ লাখ ১৭ বছর আগে থেকেই তারা এই এলাকায় বসবাস করতে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের অবস্থান ছিল উত্তর অক্ষাংশে।

তিনি বলেন, আরেকটি আদিম গোত্রের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা আর্কটিক অঞ্চলে বাস করতেন। ৪৫ হাজার বছর আগে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

 

;

উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা



মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা

উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা

  • Font increase
  • Font Decrease

উদাল, সোনালি হলুদ সৌন্দর্যে মুগ্ধতা ছড়ানো মাঝারি সাইজের বৃক্ষ। পত্রঝরা উদাম শরীরে পুরো গাছজুড়ে শুধুই সোনালি হলদে রঙের ফুল। বসন্তে হলদে পাপড়ি ঝরে রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা। প্রকৃতির এক অপর সৌন্দর্য উদাল বৃক্ষ ও তার ফুল।

উদাল আমাদের দেশীয় উদ্ভিদ। এদের প্রিয় আবাস পাহাড়ি এলাকা হলেও আগে সারাদেশেই কমবেশি দেখা যেত। নির্বিচারে গাছ উজাড় হতে থাকায় অন্য গাছের সাথে এ দেশী গাছটিও বিপন্ন। ঢাকার মিরপুর জাতীয় উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, বাংলা একাডেমি, ঢাকার রমনা পার্ক, ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কসহ সমতলের অনেক স্থানে উদাল দেখা যায়। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে বান্দরবান ও কক্সবাজারের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের পাতাঝরা শালবনের স্যাঁতসেঁতে জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে উদাল গাছ দেখা যায়।


উদালের বৈজ্ঞানিক নাম স্টারকুলিয়া ভেলোসা। ইংরেজিতে এটিতে হেয়ারি স্টারকুলিয়া বা এলিফ্যান্ট রোপ ট্রি নামে ডাকা হয়। এ গাছের বাকল থেকে এক প্রকার উন্নতমানের তন্তু পাওয়া যায়। এ তন্তু দিয়ে হাতি বেঁধে রাখার দড়ি বানানো হতো বলেও ইংরেজিতে এমন নামকরণ। আমাদের দেশে স্থানীয়ভাবে এটি চান্দুল নামেও পরিচিত। এই উদ্ভিদ মগ ও মারমাদের কাছে ফিউ বান, গারোদের কাছে উমাক এবং ম্রোদের কাছে নাম সিং নামে পরিচিত।

উদাল ২০ মিটার বা ততোধিক লম্বা হয়। এদের বাকল সাদাটে রঙের। এদের পাতার বোঁটা লম্বা, ফলক বড় ও পাতা খাঁজকাটা, পাতার প্রশাখার আগায় পাতা ঘনবদ্ধ। ফুলগুলি সোনালি হলুদ রঙের, ফুলের ভেতর বেগুনি। এর ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকলেও পাকলে গাঢ় লাল রঙের হয়। বীজের রং কালো। বীজ স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো হওয়ায় কাঠবিড়ালীর প্রিয় খাবার। তবে মানুষও এর ফল খেয়ে থাকে। বাকল থেকে আঁশ পাওয়া যায়। এ আঁশ দিয়ে দড়ি তৈরি হয়। কাঠ বাদামি রঙের, সাধারণত নরম ও হালকা হয়। এই গাছের কাঠ দিয়ে চায়ের বাক্স বানানো হয়।

উদাল ফল খাচ্ছে ইরাবতী কাঠবিড়ালি। ছবি: তবিবুর রহমান

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বার্তা২৪.কম-কে জানান, এ গাছ দেশের বন-জঙ্গলে প্রচুর হতো। এ গাছের পাতার বোঁটা দিয়ে শরবত বানানো হয়। উঁচু গাছ থেকে পাতার বোঁটা সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য হওয়ায় বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হয়। এরপর এর গোড়া থেকে অনেক নতুন নতুন ডালপালা গজালে সেখান থেকে পাতার বোঁটা সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও উদাল গাছ থেকে স্বচ্ছ আঠা পাওয়া যায়। যা দিয়ে কনফেকশনারিসহ নানাবিধ কাজে ব্যবহার করা হয়।

তিনি আরও বলেন, এ উদ্ভিদ বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতির। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ তিনশ উদাল গাছের চারা বিভিন্ন স্কুল কলেজে বিতরণ করেছে। এবারও প্রায় পাঁচশ চারা বিতরণ করা হবে।


ড. জসীম বলেন, উদলের বাকলের শরবত খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে। ফুলের বৃন্ত ছেঁচে জলের সঙ্গে চিনি দিয়ে শরবত করে খেলে প্রস্রাবের সমস্যা ও বাতের ব্যথা দূর হয়। তবে খাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

রাঙ্গামাটি বনবিভাগের এসিএফ তবিবুর রহমান জানান, উদালের বীজের স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো হওয়ায় কাঠবিড়ালির খুব প্রিয়। তবে এ বীজ মানুষও খেয়ে থাকে।

তিনি আরও জানান, ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের তফসিল ৪ অনুযায়ী উদালকে বাংলাদেশের ‘মহাবিপন্ন’ প্রজাতির তালিকাভুক্ত উদ্ভিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

;

বরিশালের শত বছরের ঐতিহ্যের স্মারক শীতলপাটি



এস এল টি তুহিন, করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বরিশাল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের পাটিকররা তাদের নিপুণ হাতের তৈরি শীতলপাটির জন্য বিখ্যাত।

উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের কাজলাকাঠী গ্রাম, রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঠালিয়া, রাজাপুর গ্রাম ও গারুড়িয়া ইউনিয়নের সুখী নীলগঞ্জ ও হেলেঞ্চা গ্রামে এখনো তৈরি হয়, ঐতিহ্যের অনন্য স্মারক দেশ বিখ্যাত শীতলপাটি।

এই উপজেলায় এখন এক হাজারের বেশি পরিবার শীতলপাটি তৈরি করে সংসার চালাচ্ছে।

উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া গ্রামে প্রবেশ করে যতদূর দু’চোখ যায়, দেখা মেলে পাইত্রাগাছের বাগান। গ্রামীণ সড়কের দুই পাশে দেখা মেলে বড় বড় পাইত্রা বা মোর্তাগাছের ঝোপ। বাড়ির আঙিনা, পরিত্যক্ত ফসলি জমি, পুকুর পাড়, সব জায়গাতেই বর্ষজীবী উদ্ভিদ তরতাজা পাইত্রাগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গ্রামীণ জনপদের আভিজাত্যের স্মারক শীতলপাটি তৈরি হয়, এই পাইত্রাগাছের বেতি দিয়ে।

জানা গেছে, এসব গ্রামে পাইত্রাগাছের আবাদ হয়ে আসছে শত শত বছর ধরে। পাটিকরদের পূর্বপুরুষেরা যে পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, আজও সেই পেশা ধরে রেখেছেন বাকেরগঞ্জের পাটিকররা।

এখনো এই সব গ্রামে ‘পাটিকর’ পেশায় টিকে আছে প্রায় এক হাজার পরিবার। আর তাদের সবার পেশাই শীতলপাটি বুনন। ফলে, উপজেলার এসব গ্রাম এখন ‘পাটিকর গ্রাম’ নামে পরিচিত।

সরেজমিন দেখা যায়, কাঁঠালিয়া, রাজাপুর ও গারুড়িয়া ইউনিয়নের সুখী নীলগঞ্জ ও হেলেঞ্চা গ্রামে এখনো গ্রামীণ সড়ক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই ছোট ছোট টিনশেড ও আধাপাকা ঘরগুলোর বারান্দায় নারী-পুরুষ ও শিশুরা মিলে নানান রঙের শীতলপাটি বুনতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

কাঁঠালিয়া গ্রামের সবিতা রানীর পরিবারের সবাই মিলে দিনরাত ব্যস্ত সময় কাটান শীতলপাটি তৈরি করতে। একটু সামনে এগুতেই কথা হয়, প্রিয়লাল পাটিকরের সঙ্গে।

তিনি বলেন, পরিবারের পাঁচ সদস্য মিলে একটি পাটি তৈরি করতে কয়েকদিন চলে যায়। প্রতিজনের দৈনিক মজুরি ১০০ টাকা করেও আসে না। তারপরেও কিছু করার নেই। বাপ-দাদার পেশা হিসেবে এখনো শীতল পাটি বুনে যাচ্ছি। একদিকে, এখন গরম বেড়েছে, অপরদিকে, বৈশাখ মাস চলছে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বৈশাখী মেলায় শীতলপাটির চাহিদা থাকে। তাই, পাইকাররা এসে আমাদের এলাকা থেকে পাটি কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করেন।

স্থানীয় পাটিকররা জানান, এখানকার তৈরি শীতলপাটি আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু প্লাস্টিক পাটির কারণে বাজারে শীতলপাটির চাহিদা কমে গেছে। সে কারণে সরকারিভাবে বিদেশে শীতলপাটি রফতানির কোনো ব্যবস্থা করা হলে পাটিকরদের জীবন-জীবিকা ভালো চলতো।

পাশাপাশি শীতলপাটি টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তারা। নয়ত এই পেশায় টিকে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।

এ বিষয়ে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, উপজেলা প্রশাসন, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাসহ জাইকা সংস্থার মাধ্যমে উপজেলার পাটিকরদের মধ্যে বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ প্রদান অব্যাহত রয়েছে। ফলে, নতুন নতুন ডিজাইনের শীতলপাটি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা তাদের সরকারি বিভিন্ন রকম সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

;