বাবা দিবসে আত্মার অনুসন্ধান
আজ বাবা দিবস। বাবা, বাবা বলে আত্মার অনুসন্ধান করছে পৃথিবীর মানুষ। খুঁজছে শেকড়ের গভীরতম ঠিকানা।
আয়োজন করে দিবস পালনের রেওয়াজ বাড়ছেই। প্রতিদিনই কোনো না কোনো দিবসও থাকছেই। আজ বাবা দিবস তো কাল ভালোবাসা, বন্ধুত্ব- ইত্যাদি দিবসের এন্তার আয়োজনে বছরই পার হয়ে যায়!
আমরা কি দিবসের অন্তর্নিহিত মর্ম অনুভব করি? আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে আমরা কি দিবসের মূল চেতনাকে বড় করতে পারি?
অনেকের আবার বাবা-মায়ের জন্য একটি দিনের বরাদ্দ পছন্দনীয়ও নয়। আসলেই তো, একটি দিন নয়, সারা বছর বাবা আর মায়ের জন্য হওয়াই উচিত।
আধুনিক ক্রিকেটের বরপুত্র শচীন টেন্ডুলকার মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বিত্তবান ছিলেন না বাবা, মোটামুটি সচ্ছল। কলেজে পড়াতেন, থাকতেন ‘সাহিত্য সহবাস’ সমবায় আবাসনে। শচীন যখন প্রচুর উপার্জন করতে শুরু করলেন, সবার আগে ভাবলেন, মা–বাবার কথা।
বিশ্বকাপ চলার সময়ে জীবনাবসান হয় রমেশ টেন্ডুলকারের। সে শোক বহন করেও সেঞ্চুরি করেন শচীন। মা বলেছিলেন, ‘দেশের হয়ে সেঞ্চুরি করো, সেটিই হবে বাবাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য’।
ক্রিকেটার ইরফান-ইউসুফ পাঠানরাও সবার আগে স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করেছেন মা-বাবার। বাবার ঘরটি কেমন হবে ইরফান নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বুঝিয়েছেন নির্মাতাদের। টেস্ট ম্যাচ দেখাতেও নিয়ে গেছেন বাবাকে।
মুনাফ প্যাটেলও দরিদ্র পরিবারের। দাদু থেকে বাবাসহ সব আত্মীয়ের দেখ-ভাল করেছেন, নিজের জীবন যাপনে আড়ম্বর আসতে দেননি।
দরিদ্র কৃতী ছাত্রটিও সাক্ষাৎকারে প্রায়ই বলেন, ‘যদি বড় হতে পারি, প্রথমে কুঁড়েঘর থেকে পাকা বাড়িতে নিয়ে যাবো মা-বাবাকে’।
মুদ্রার উল্টা পিঠও আছে অন্য ধরনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। একসময় অবস্থা ভালো ছিল, নাম-ডাকও ছিল- এমন মানুষ চূড়ান্ত দারিদ্র্যে লাঞ্ছিত হচ্ছেন, এমন ঘটনা কতো! দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক পদক জিতেছেন যিনি, তিনি রিকশা চালিয়ে গ্রাসাচ্ছাদন করছেন- এমনটিও ঘটে আমাদের দেশে বা উপমহাদেশে।
বৃদ্ধাশ্রমে বা অন্যের বাড়িতে কাজ করে শেষ জীবন চালাচ্ছেন অনেক কৃতী মানুষের হতভাগ্য বাবা-মা। সন্তানের জন্য সব কিছু করেছেন, সন্তান সফল হয়েছেন। তিনি আর পেছনে দেখার সুযোগ পান না, সামনেই চলেন। পেছনে পড়ে থাকেন নিঃস্ব মা-বাবা!
এক সময় বড় ব্যবসা ছিল ভারতের গুজরাটের সঙ্কোত সিং বুমরার। ছেলের মৃত্যুর পর প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন, ভেঙে পড়ে ব্যবসাও। এখন বৃদ্ধ বয়সে দিন গুজরান করেন অটো চালিয়ে। অথচ তার দিনগুলো মসৃণভাবে চলতে পারতো। তার পৌত্র ভারতীয় ক্রিকেট তারকা জশপ্রীত বুমরা পিতামহের খবরই নেন না! ঠাকুরদাকে অটো চালনায় রেখে অনেক গুরুতর অন্যায় করে যাচ্ছেন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনালে ‘নো’ বল করে দলকে ডুবিয়েছেন, অনেক বড় ‘নো’। সমালোচনা প্রচুর, কিন্তু ইচ্ছে করে তো করেননি। আমি নিজেই সাম্প্রতিককালে ভারতে গিয়ে সামাজিক মিডিয়ায় এ নিয়ে তীব্র কটাক্ষ দেখেছি।
ভালো-মন্দ মিলেই আমাদের পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্কগুলো চলছে। আনন্দ-বেদনায় বইছে যাপিত জীবন। পেছনে তাকালে দিব্যি বলতে পারি, আমাদের জীবনের শুরুর দিকে একমাত্র মনীষীদের ছাড়া জন্মদিন পালনেরও কোনো রেওয়াজ ছিল না। বাবা-মায়ের নামে বিশেষ দিন উৎসর্গ করা তো অনেক পরের কথা। এখন আমরা জানি, জুন মাসের তৃতীয় রোববার হল ‘ফাদার্স ডে’। জুনের আগের মে আর পরের জুলাই মাসেও থাকে সে দিবসের আবেগ ও উচ্ছ্বাস।
বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি, এ দিনের মন্তব্য ও উপলব্ধিতে মানুষের হাহাকার ও বেদনারাই পুঞ্জিভূত হয়। খুব কাছে ও সব সময় থাকলে যেমন মহার্ঘ্য বস্তুর মর্যাদাও আমরা বুঝি না, মা-বাবার বিষয়টিও তেমনি। তারা না থাকার সময় সন্তানের উপলব্ধি বড্ড বেদনার সঙ্গে শোনা যায়। হায়! তখন আর কিছুই করার থাকে না!
কেন এবং কিভাবে বাবা দিবস- সেটিও অনেকে বুঝতে চান না। দিবসটি পালনের পর বাসায় বা গ্রামের বাড়িতে বাবা ও মায়েরা বছরের বাকি দিনগুলোতে সাধারণ হয়ে যান। ইতিহাসটাও অনেকেই কষ্ট করে জানতে চান না। যার হাত ধরে, যার প্রশ্রয়ে, যার আদরে-শাসনে বড় হয়ে ওঠা- সেই বাবার প্রতি ভালোবাসা জানাতে পুরো একটি দিন!
শুরুটা করেছিলেন ওয়াশিংটনের মেয়ে সোনোরা লুইস স্মার্ট ডড। মাহারা পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে সোনোরাকেও মানুষ করেন তার বাবা। মায়েদের মতো বাবাদেরও যে সংসারে অবদান কম নয়, সেটি বোঝাতেই সনোরা ঠিক করেন- ১৯ জুন বাবার জন্মদিনে ‘ফাদার্স ডে’ পালন করবেন।
১৯১০ সালের ১৯ জুন প্রথমবারের মতো আমেরিকায় বাবা দিবস পালিত হয়। অবশ্য তার আগে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার রবার্ট ওয়েব ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই ফাদার্স ডে পালনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু সে উদ্যোগ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি বলে জুন মাসের তৃতীয় রোববার ফাদার্স ডে হিসেবে ধরা হয়। দিবস যা-ই হোক, প্রতিটি দিনই হোক বাবা দিবস, মা দিবস। বাবা, মা, পুরোটা বছর, সারাটা জীবন তোমাদের জন্যে।