রিকশা চালিয়ে সুখী ডিপ্লোমা পাশ তরুণ
ঢাকা: মঙ্গলবার দিবাগত রাত। ঘড়ির কাটায় তখন ১টা ২০ মিনিট। শারীরিক ক্লান্ত নিয়ে শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে মহসীন হল যেতে রিকশা খুঁজছি। যথারীতি এই অল্প দূরত্বের রাস্তায় কেউ যেতে রাজি হল না। মোড়েই দাঁড়ানো এক রিকশাওয়ালাকে অনুরোধ করছিলাম ঠিক ওই সময় সুন্দর মুখশ্রীর হাস্যোজ্জ্বল এক রিকশাওয়ালা এসে পাশে দাঁড়াল।
‘মহসীন হল যাবে কি-না’ জিজ্ঞাসা করতেই –হ্যাঁ-সূচক সম্মতি জানাল অল্প বয়সী এ রিকশাচালক। কথা না বাড়িয়ে রিকশায় উঠে পড়লাম।
বৃষ্টিভেজা ক্যাম্পাসে তখন নিশাচরদের আনাগোনা। দিনের বেলার গাড়ির হর্ন, হকারের ক্যানভাস, ছাত্র-ছাত্রীর পদচারণা- এসব কোলাহল থেকে ক্যাম্পাস তখন মুক্ত। এমন নিরব-শান্ত পরিবেশে আষাঢ়ের হিমেল হাওয়ায় শরীর শীতল হয়; মন দুলে ওঠে।
চারুকলা পার হতেই রিকশাওয়ালা ছেলেটি গুণগুণ করে গান ধরে। মধ্যরাতের মায়াবী পরিবেশে গান ধরায় দারুণ লাগছিল। এর মধ্যে গান থামিয়ে দেয় রিকশা চালক। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠি, ‘দারুণ হচ্ছে, গাও তুমি! সে পেছনে ফিরে তাকিয়ে স্মিত হাসি দেয়। একটু উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করি, ‘মামা তুমি এত রাতে রিকশা চালাও কেন?’ ছেলেটির চটপট উত্তর, ‘মেস ভাড়া দেওয়ার জন্য।’
ছেলেটির পরনে ফুলহাতা চেক শার্ট, কালো ফর্মাল প্যান্ট পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল। পুরো শরীরে একবার চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি কি পড়াশুনা কর?’ সে জবাব দেয়, ‘ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং করেছি। এখন ঢাকায় রিকশা চালাই।’
এবার আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। তারপর পুরোটা পথ যেতে যেতে শুনে নিলাম জেনে নিলাম তার জীবনের ছোট ছোট গল্প ও চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে।
রিকশাওয়ালা ছেলেটির নাম মুসা বিন শরিফ। সবাই ডাকে মুসা নামে। বয়স ২৮। বাড়ি যশোর জেলার কেশবপুরে। বাবা কৃষক, মা গৃহিণী। দুই ভাই বোন তারা। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর জেলার সরকারী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ৪ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা শেষ করেছে। এখন বিএসসিতে ভর্তি হয়ে চাকরির উদ্দেশ্যে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সে ঢাকায় আসে।
মুসাকে জিজ্ঞেস করি, ‘ঢাকায় কোথায় থাক?’ সে বলে, ‘লালবাগের একটা মেসে উঠেছি। ১৮০০ টাকা মেস ভাড়া। ২০০০ টাকায় খাওয়া দাওয়া। প্রথম মাসে বাড়ি থেকে টাকা নিয়েছিলাম। এরপর একটা চাকুরিতে যোগ দেই। বেক্সিমকো গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানে এক মাস চাকরি করি। পরে ভালো না লাগায় ছেড়ে দেই। আসলে চাকরিতে ঢুকেই কেমন যেন পরাধীন পরাধীন লাগে।’
সে আরও বলে, ‘কিছুদিন আগে মীনা বাজারে একটা চাকরি হয়েছিল। ওরা শর্ত দিয়েছে প্রতিদিন দাড়ি শেভ করে কাজে আসতে হবে। এটা কেমন কথা। শুনেই ভালো লাগেনি। তাই চাকরিতে যাই নি। এরমধ্যেই ঢাকায় থাকা খাওয়ার খরচ চালানোর জন্য রিকশা চালানো শুরু করে দেই। এটা নিয়ে কোন লজ্জা লাগেনা আমার। বরং এখন এর মাঝেই স্বাধীনতা খুঁজে পাই। যখন মন চায় তখন রিকশা নিয়ে রাতে বেরিয়ে পড়ি।
আমি বলি, ‘বাবা-মা জানে এই রিকশা চালানোর কথা?’ তার উত্তর, ‘না জানে না। জানলে রাগ করবে তাই আমিও জানাই না। বরং তারা জানে আমি ঢাকায় চাকরি করি। আসলে ঢাকায় আসার পর এখন আমাকে পড়াশুনা ও চাকরি কিছু টানেনা। বরং গান কবিতা, লেখালেখি এগুলার দিকেই বেশি ঝোঁক হয়েছে।
আমি বলি, ‘কি বল? এই ঢাকা ভার্সিটির ছেলেরা একটা চাকরির জন্য পড়াশুনা করতে সারাদিন লাইব্রেরিতে বসে থাকে। কোটা আন্দোলন করছে একটা সরকারি চাকরির আশায়, আর তুমি সরকারি চাকরিও করবে না? সে উত্তর দেয়, চাকরির কথা ভাবলে কেমন জানি পরাধীন মনে হয়। আমি মনে হয় আর কোন দিন চাকরি করব না। সরকারি চাকরি হলেও না।
‘তুমি তো চুরি ছিনতাই করছ না তাহলে রিকশা চালানোর কথা বাসায় বলতে লজ্জা কিসের?’- এ কথার প্রত্যুত্তরে সে বলে, ‘আসলে মামা সমাজের কারণে অনেকেই কিছুই বলা যায় না, করা যায় না। অনেকেই অনেক কিছু মেনে নেয় না। আসলে রিকশা চালানোর কথা শুনলে সমাজ কি বলবে এই ভয়ে তাদের জানাতে পারি না। তবে এখন আশা হল কিছু টাকা হলে ভবিষ্যতে মুদি দোকান দিয়ে ব্যবসা করে খাব।
‘রিকশা চালিয়ে তোমার দিন চলে?’ জানতে চাইলে। মুসা বলে, ‘এই তো গত রাতেও জমা খরচ বাদ দিয়ে ৫০০ টাকা কামাই করছি। রাত ১২ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত লালবাগের আশে পাশেই রিকশা চালাই। ভালোই চলছে।’
জীবন নিয়ে সরল দর্শনে বিশ্বাসী ছেলেটার কথা শুনতে শুনতে অনেক আগেই হলের গেটে এসে পৌঁছে গেছি। হ্যাংলা পাতলা গড়নের মুসার আত্মবিশ্বাসী কথাগুলো শুনে মনের গভীরে কেমন একটা অদ্ভূত অনুভূতি হতে থাকে। ওর থেকে বিদায় নিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হলে ঢুকে যাই। ছেলেটিও রিকশা ঘুরিয়ে যাওয়ার আগে বলে ওঠে, ‘মামা জানেন, আমি একজন সুখী মানুষ। স্বাধীন মানুষ।’