সংসদ সদস্য না, আমি আপনাদের মিয়া ভাই: ফারুক
‘সারেং বৌ’, ‘নয়নমনি’সহ দুই শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন দেশীয় চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত অভিনেতা ফারুক। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছেন, আজীবন সম্মাননাও পেয়েছেন। এবার হয়েছেন সংসদ সদস্য। বার্তা২৪-এর সঙ্গে নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন গুণী এই মানুষ।
সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম কী অনুভূতি হয়েছিল?
আকবর হোসেন পাঠান ফারুক: পাস করার আগে আমরা যে খাটা-খাটুনি করেছি তাতে আনন্দ পাওয়াটা স্বাভাবিক। এই আসনে আমাদের স্বাধীনতার পক্ষের যে নৌকা, তা ছিলো না প্রায় ১৭-১৮ বছর। এ কারণে অঞ্চলটির মানুষগুলোর চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্খা, মনের ভাষা ছিলো আমার মতোই। ১৮ বছর ধরে এই জায়গায় আওয়ামী লীগ না থাকলেও অনেক এমপি ছিলেন। কিন্তু তারা পুরো এলাকাটি কখনও ঘুরে দেখেননি। আমার এলাকার মানুষই আমাকে বললো, আপনি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যান। আমরা ভোট দেবো। তাদের মন্তব্য ছিল, পাস করার পর এমপিরা আর কেউ কোনো খোঁজ নেয়নি। এটা জেনে তাদের বলেছিলাম, আপনারা এবার ভোট অন্তত দিয়েন। আমি নিজেই আপনাদের কাছে ভোট চাইতে এসেছি। তারা আমাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন কখনও অস্বীকার করতে পারবো না। মাঝে মধ্যে ভাবি, একটা সময় চলে যেতে হবে। কিন্তু মানুষ আমাকে কতোটা ভালোবাসে জানতে পারতাম না। চলচ্চিত্র থেকে আমাকে অনেকেই ভালোবাসেন। নির্বাচনে নামার পর মনে হয়েছে, চলচ্চিত্রের ইমেজটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। মানুষ চলচ্চিত্রের মতো করে আমাকে দেখেছেন, বিশ্বাস রেখেছেন। মানুষগুলো ভেবেছেন, তারা নৌকার একজন মাঝি পেয়েছে।
ঢাকা-১৭ আসন থেকে আপনি সংসদ সদস্য হয়েছেন। সেখানে আপনার চ্যালেঞ্জ কোথায় দেখছেন?
ফারুক: পৃথিবীর প্রতিটি জায়গাতেই চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ঢাকা-১৭ আসন বলে নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গায় যারাই ভোটের মাধ্যমে পাস করেছেন, তারা কিন্তু একটি কমিটমেন্টের মধ্যে থাকেন বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, এই এই কাজ করবো। যেসব দিকে খামতি থাকে সেগুলো বলে থাকেন তারা, সেটা ধরে রাখতে পারাই চ্যালেঞ্জ। প্রতিটি মুহূর্তকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। আমি একজন মানুষ, মানুষেরই ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি। এই কারণেই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। আর চ্যালেঞ্জ যখন থাকে তখন মানুষ একটু সজাগ থাকে। আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই।
স্কুলে পড়ার সময় রাজনীতির সঙ্গে জড়ান আপনি। ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্র রাজনীতির স্মৃতিগুলো নিশ্চয়ই মনে পড়ে…
ফারুক: অবশ্যই মনে পড়ে। আমার তো মনে হয়, এই তো গতকালেরই কথা! কারণ যারা মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মী তারা কখনও এটা ভুলতে পারবে না। আমরা ছিলাম সেই মাঠপর্যায়ের কর্মী। রাজনীতিতে আমার জড়ানোর শুরুটা হয়েছিলো গান, নাচ, কবিতা পাঠ ও দেশ সম্পর্কে জানার মধ্য দিয়ে। মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পর পুরোপুরি জড়িয়ে যাই। তখন বাঙালিরা বাংলায় কথা বলতে পারতো না। রেশন কার্ড নিয়ে লাইনের পর লাইন দাঁড়িয়ে থেকে চাল আনতে হতো। প্রচুর জমি থাকলেও তার ব্যবহার করা যেতো না। বিভিন্ন কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের আটকে রাখতো। এসব জিনিস নিয়ে সোচ্চার হওয়ার সময় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। আমরা যেসব সময় পার করেছি তা ছিলো খুব কঠিন। এখনও যে বেঁচে আছি এটি অনেক বড় ব্যাপার।
সারাজীবন চলচ্চিত্রে যে মেধা ও শ্রম দিয়েছেন, যে কষ্ট করেছেন, সেজন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন। এবার রাজনীতির ময়দানে সংসদ সদস্য হলেন। কোন অর্জনকে এগিয়ে রাখবেন?
ফারুক: সংসদের জন্য তো আমি নতুন একজন মানুষ। তবে এটুকু বুঝি সংসদ এমন একটি জায়গা যেখান থেকে সম্পূর্ণ দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। সংসদ এমন একটি জায়গা যেখানে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার কথা বলা যায়। এখান থেকে যখন স্বাধীনতার কথা বলবো সেটি সারাবাংলা জানবে। আমার আসনের কী কী চাই বা কী কী পেলাম তা আনন্দ নিয়ে বলতে পারবো। আমি দেশকে ভালোবাসি, এটুকুই বলতে চাই।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যত ছবি হয়েছে দেশে, সেগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন?
ফারুক: নাহ। মুক্তিযুদ্ধের ওপর ছবি নির্মিত হয়েছে হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি। কিন্তু এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে লাখ লাখ ছবি হতে পারে। চলচ্চিত্র ব্যাপারটি অনেক বড়। স্বাধীনতা নিয়ে কতো লাখ লাখ ছবি নির্মাণ করা যায় তা কল্পনাও করা যেতে পারে না।
আপনার দীর্ঘ কর্মজীবনের বড় একটা অংশ কেটেছে এফডিসিতে। কিন্তু এখন এর সোনালি সময় নেই। এফডিসির দিন ফেরাতে এই স্পটের উন্নয়নে কী কী করা উচিত বলে মনে করেন?
ফারুক: এফডিসিতে আমরা যেই সময় পার করেছি সেটিকে বলা হয় স্বর্ণযুগ। তখনকার দিনগুলো ছিলো ভরা নদীর স্রোতের মতো। পরিচালক কিংবা অভিনেতা থেকে পরিচালক হয়েছেন যারা, সবার মধ্যে ছবি তৈরির আগ্রহ অনেক বেশি ছিলো। ভালো চিত্রনাট্যকার ছিলো, গীতিকার-সুরকার ছিলো। সবকিছু মিলিয়ে তখনকার সময়টাতে গল্প সুন্দর হয়েছে, ছবির মেকিং ভালো ছিলো, অ্যানালগ সিস্টেমে তৈরি হতো সব। তখনকার অনেক পরিচালক মারা গেছেন। অনেকে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। যার ফলে একটা শূন্যতা তৈরি হয়। আমি বলবো, যারা চলে গেছেন তাদের দায়িত্ব ছিলো কিছু একটা রেখে যাওয়া। হুট করেই একটা বড় শূন্যতা তৈরি হয়ে যায়। আমি অভিনয় ছেড়েছি ৩০ বছর, চিন্তা করা যায়? ৩০ বছর আগে এক টগবগে যুবক ছিলাম, এই যে আমাকে ধরে রাখবে কে? ধরে রাখার মানুষটা কই? আমরাই আমাদের ক্ষতি করছি। এই চলচ্চিত্রের ক্ষতি দিয়ে কিন্তু অনেক কিছু বোঝানো যায়।
বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালে যখন এফডিসি তৈরি করেন, তিনি কিন্তু অনেকদূর নিয়ে ভেবেছিলেন। তিনি মন্ত্রী ছিলেন, তিনি এটি না করলেও পারতেন। তিনি কিন্তু পেটপুরে খেতে পারতেন। কিন্তু তিনি এটি চাননি। তার বক্তৃতায় পাওয়া যায় একটি কথা, আমার মানুষের অধিকার। হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না, তবুও তিনি বলে যেতেন আমার মানুষ। এটি তিনি প্রমাণও করে দিয়েছেন। তার মতোই তার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনিও এফডিসির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এই যে, আমজাদ হোসেনের কথাই ধরে নেওয়া যাক। তার চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা করেছেন। তাকে আমাদের চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের কথা তুলে ধরলে তিনি বলেন, ‘আমার মন্ত্রীরা কাজ করে যাচ্ছেন।’ আমার মনে হয় চলচ্চিত্রবান্ধব সরকার এসেছে। এবার যদি না হয় আর কখনও ঠিক হবে না। এফডিসির কোন কোন জায়গায় ত্রুটি রয়েছে তা বের করতে হবে। এফডিসিতে এমনও অনেক মেশিন আছে যা মুম্বাইয়েও নেই।
অ্যানালগ সিস্টেম বন্ধ হয়ে এখন শুরু হয়েছে ডিজিটাল সিস্টেম। এর মাধ্যমে অনেক চুরি বন্ধ করা যায়। কিন্তু চলচ্চিত্র বানাতে গেলে প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। তাই আমাদের ছবি বানাতে গেলে ডিজিটাল সিস্টেমে কিছু প্রশিক্ষণ নেওয়া দরকার ছিলো, যা নেওয়া হয়নি। ডিজিটালের একটি ফর্ম্যাট আমাদের নেই। সেটি হলো প্রজেক্টর মেশিন। এটি যদি হয় তাহলে ধীরে ধীরে ইন্ডাস্ট্রি বদলাবে। আর প্রজেক্টর একটি ছোটখাট মেশিন এটি কেনো হতে পারবে না? আমি মনে করি এটা হবে ইনশাল্লাহ। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো গল্প, যেটি এখন রাতারাতি সাজিয়ে ফেলা হয়। মানুষ ভিসিআর দেখে বলতো গল্পটা লেখো। এমন করলে হবে না।
আপনি চলচ্চিত্রের মানুষ। তাই আপনি সংসদ সদস্য হওয়ায় চলচ্চিত্র শিল্পীরা আশাবাদী। সংসদ সদস্য হিসেবে চলচ্চিত্র পরিবারের জন্য কী কী করতে চান?
ফারুক: আমি চলচ্চিত্রের মানুষ, এটা কখনও অস্বীকার করতে পারবো না। সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে সিনেমার মানুষদের বলছি, আমাকে সংসদ সদস্য বলবেন না। এই পদবী শুনলে কেমন জানি পর হয়ে যাই! আমি আপনাদের মিয়া ভাই। দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে। জনগণ আমাকে ভোট দিয়েছেন। এর যে সম্মান ও অধিকার তা আমাকে দেখতেই হবে। ঢাকা-১৭ আসনের বাসিন্দারা যেভাবে তাদের জন্য কাজ করার জন্য বলতে পারে, একইভাবে চলচ্চিত্রের মানুষদেরও আমার কাছে প্রত্যাশা থাকতে পারে। আমি চুল থেকে নিয়ে পা পর্যন্ত নায়ক ফারুক। এর মধ্যে এসে জড়ো হলো একটা রাজনীতি। রাজনীতির মধ্য দিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছি, এখন চলচ্চিত্রের সুবিধা-অসুবিধার কথা অবশ্যই বলতে পারি। আমার এলাকা আর দেশের কথাও বলতে পারি। তবে দলের চিন্তা-ভাবনাকে প্রাধান্য দেবো। এরপর যা বলার বলবো। আওয়ামী লীগ দেশ স্বাধীন করায় নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা সঠিক পথে হাঁটে। আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উন্নয়ন, হোক সেটি চলচ্চিত্র বা অন্যান্য ক্ষেত্রে।
নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে কিছু বলুন।
ফারুক: আমাদের ছেলেমেয়েরা সবাই নতুন প্রজন্মের, তারা প্রথমত জানেই না এই দেশ কীভাবে হলো। তাই তাদের প্রথম কাজ হবে এই দেশের গৌরবময় ইতিহাস জানার চেষ্টা করা। মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব- এই ব্যাপারগুলো হাজার বছর পর্যন্ত বলে যেতে হবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন সব জানতে পারে। জাতির পিতা কী করে গেছেন তা জানা দরকার সবার। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে দাঁড়িয়ে যেন নতুন প্রজন্ম মাথা উঁচু করে বলতে পারে আমি বাংলাদেশের। সেজন্য নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে বলবো। আমি মনে করি, এই দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিশ্বাস করেন এমন প্রত্যেককে এই দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে। কারণ আমাদের জাতির পিতা কিছু করার আগেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের ইতিহাসকে ধামাচাপা দেওয়ার যেই চেষ্টা করা হয়েছে তা থেকে উঠে আসা কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার। এখন আমাদের বারবার বলতে হয় মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে হয়েছে।
ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?
ফারুক: বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাই ভবিষ্যতের কথায় যদি আসি তাহলে সোনার বাংলা গড়তে চাই। বলতে চাই, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন করবেন, এটি দেখতে চাই।