দেশীয় টিভি চ্যানেলের সংকট কোথায়!
বাংলাদেশে গত দশ বছরে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা। এতে অভ্যন্তরীণ বিজ্ঞাপনের বাজারে যতোখানি প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে, প্রচারিত অনুষ্ঠানের মানরক্ষার বেলায় ওই প্রতিযোগিতার রেশ কতোখানি পড়েছে- এ প্রশ্ন প্রবল হয়ে উঠেছে টিভি চ্যানেলের সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে।
দেশীয় টিভি চ্যানেলের দর্শক কমে গেছে- এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পরিসংখ্যানও সামনে এসেছে ঘুরেফিরে। দুই ঈদে ‘বিশেষ’ অনুষ্ঠানের মান যাচাই করে এ সমালোচনা আরও জোর পায়।
তবে দেশীয় টিভি চ্যানেলের কপালে যে শুধু সমালোচনাই জুটছে তা তো নয়, প্রশংসাও আছে। গত এক বছরে নতুন হিসেবে সবচেয়ে কম সময়ে আলোচনায় উঠে এসেছে দুরন্ত টিভি। দেশের বাজারে রীতিমতো চ্যানেলটি টেক্কা দিচ্ছে বিদেশী কার্টুনভিত্তিক চ্যানেলগুলোর সঙ্গে। এখন অনেক বাবা-মা-ই বাসায় বিদেশি কার্টুন চ্যানেল বন্ধ রেখে এ শিশুতোষ চ্যানেলটি চালিয়ে দিচ্ছে।
এতে যেটা হয়েছে, বিরাট সংখ্যক মা-বাবা শিশুর চোখের সামনে প্রথম যে স্ক্রিনটি তুলে দিতে পারছেন, তাতে পরিশীলিত বাংলা ভাষাটা আছে- এ নিশ্চয়তা থাকছে। কালচারাল হ্যাজার্ডের আশঙ্কা কমার সামান্য হলেও একটা অবলম্বন তৈরি হয়েছে। সঙ্গে এ উদাহরণও দাঁড়িয়ে গেছে যে, চ্যানেল চালুর পরিকল্পনায় স্পেসিফিকেশন অর্থ্যাৎ আমি নির্দিষ্ট করে কী দেখাতে চাই, কেন দেখাতে চাই জাতীয় প্রশ্নগুলো থাকা জরুরি, ব্যবসা এবং স্বার্থসিদ্ধির পার্সেন্টেজ কমিয়ে এনে। সেটা হলে চ্যানেলের সংখ্যার এই লম্বা তালিকায় শুধু একটা নামই বাড়ে। দর্শক স্বাভাবিকভাবেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
অনুষ্ঠানের ধরণে একটা নির্দিষ্ট অবস্থানে থাকা যে আসলেই কতোটা জরুরী সেটা এর আগেও আমরা দেখেছি। প্রথম সারির সংক্ষিপ্ত তালিকায় উঠে আসতে গানবাংলা চ্যানেলটির খুব বেশি সময় লাগেনি। কারণ পর্দায় কী দেখাবে, সেটা তারা আগেই ঠিক করে রেখেছিলো, তারা জানতো তারা কী করতে যাচ্ছে। দর্শকও নির্দিষ্ট করে জানতো, ওখানে গেলে গান শোনা যায়, দেখা যায়। গান খুঁজতে তাদের হয়রান হতে হয়নি।
দেশীয় টিভি চ্যানেলের কপালে দর্শকশুণ্যতার শনি উপস্থিতির অন্যতম কারণ যদি খুঁজতে যাওয়া হয়, তবে এ অভিযোগ প্রবল আকারে পাওয়া যাবে- বেশিরভাগ চ্যানেলের অভ্যন্তরে গবেষণা শব্দটির অস্তিত্বই নেই। তারা আদতে খুঁজেই দেখে না, একই চ্যানেলে খবর-সিনেমা-নাটক-ফ্যাশন-ট্রাভেলস-গান-নাচসহ যাবতীয় যা কিছু আছে, এতো বিচিত্র অনুষ্ঠানতালিকার ভীড়ে দর্শকের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হচ্ছে কিনা! অর্থ্যাৎ দর্শক হয়রান হচ্ছেন কিনা!
সংবাদভিত্তিক চ্যানেলগুলোরও আলাদা একটা অবস্থান-চাহিদা আছে ড্রইংরুমে-কর্মস্থলে-চা দোকানের আড্ডায়। এ দেশের মানুষ খবর কেনে, জানতে চায়। কিন্তু যারা সরবরাহ করছে, তাদের মধ্যে অসুস্থ ব্যবসায়িক প্রতিযোগির কিংবা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির মানসিকতা চলে এলে কনটেন্টের শরীর থেকে বিশ্বস্ততা শব্দটি ক্রমেই বিলীন হতে থাকে। অথচ দর্শকের চোখের কাছাকাছি পৌঁছুতে সেটাই সবচেয়ে বেশি দরকার।
দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলো যখন মান এবং জনপ্রিয়তার দিক থেকে পড়তি, তখন আরেকটি দিকেও নজর রাখতে হবে, চ্যানেলগুলো দাঁড়িয়ে আছে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। সময় যতো গড়িয়েছে, সংখ্যা যতো বেড়েছে, ততোই এর সঙ্গে প্রচুর সংখ্যক লোকবল জড়িয়ে পড়েছেন। নানান ক্ষেত্র যোগ হয়ে এটি এখন বড় আকারের টিভি ইন্ডাস্ট্রির রূপ নিয়েছে।
নাটকের আলাদা একটা ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয়েছে, যেটা সম্পূর্ণ টিভি চ্যানেল নির্ভর, এবং সেটিকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়া লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অনেক মানুষ কাজ করছেন, কেউ অভিনয়ে, কেউ পরিচালনায়-লেখায়-চিত্র ও শব্দ ধারণে-কারিগরি ও প্রকৌশলগত নানান বিভাগে। বিনোদনের এ ইন্ডাস্ট্রি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত টিভি চ্যানেলগুলোর সঙ্গে। নির্ভরশীলও।
মিউজিক এবং ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যদিও সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে নেই, কিন্তু ছোটপর্দার প্রয়োজনীয়তা এ দুইয়ের ক্ষেত্রেও কম নয়। বিনোদন সেক্টরগুলোর কমার্শিয়াল বেনিফিট অনেকাংশে নির্ভর করে আছে টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর।
খেলা, বিশেষ করে ক্রিকেট, বিগত দশকের তুলনায় বর্তমান সময়ে জনপ্রিয়তা এবং বাণিজ্য দুই দিক থেকেই শীর্ষে আছে। টিভি চ্যানেল যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলো সরাসরি প্রচার করে, সঙ্গে যুক্ত হয় ম্যাচ সংশ্লিষ্ট আনুষাঙ্গিক নানান অনুষ্ঠান, ফলে ওই সময় চ্যানেলগুলো বিরাট সংখ্যক দর্শকের মনোযোগ পায়। তাতে চ্যানেলের জনপ্রিয়তার পাশাপাশি বাণিজ্যিক লাভও অনেক।
এটা যেমন একটা দিক, তেমনি টিভি চ্যানেলে প্রতিটি ম্যাচ সরাসরি প্রচার হচ্ছে বিধায়, খেলার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নানান বাণিজ্য এবং বিজ্ঞাপনের সুবিধা। খেলাধুলার গুরুত্ব সম্প্রসারণে চ্যানেলের এ ভূমিকাটিও অস্বীকার করা যায় না কোনোভাবেই।
বিজ্ঞাপনচিত্রের বাজারও জড়িয়ে আছে এরসঙ্গে। এ সেক্টরেও এখন অনেক মানুষ কাজ করছে, অনেক প্রতিষ্ঠান। আবার দর্শকদের সাংস্কৃতিক মনন গঠনে টিভি চ্যানেলের ভূমিকা-অংশগ্রহণও থাকে অনেকটা। সেটা সরাসরি অর্থনৈতিক মুনাফা এনে দেয় না যদিও, কিন্তু এ ভূমিকাটির গুরুত্ব তাতে কিছুটা কম পড়ে না।
এতো গুরুত্ব এবং প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলো কি তাদের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করছে?বিশেষ করে যখন এতো এতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি?
নানামুখি চ্যালেঞ্জই দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর অন্যতম সংকট। এ চ্যালেঞ্জে উতরে উঠতে না পারা প্রধান ব্যর্থতা। আর এ কারণেই যতো সমালোচনার সৃষ্টি।
টিভি চ্যানেলের বাজারে এখন মনোপলি শব্দটি একেবারেই নেই। দর্শকের কাছে অবারিত সুযোগ। অনুষ্ঠানের মানে তাই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ তো ছিলোই, বিদেশি স্যাটেলাইট চ্যানেল সবার কাছে অ্যাভেইলেবল হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। ইন্টারনেট সুবিধার প্রসার এ চ্যালেঞ্জকে আরও শতগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
এখন প্রত্যেকটি ব্রেনই একেকটি প্রচার মাধ্যম হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে। যে প্রত্যন্ত গ্রামে বসে নতুন কিছু ভাবছে, তার কাছেও চিত্র-শব্দধারণ যন্ত্র আছে, সেও অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হয়ে উঠতে পারে। তার সঙ্গেও প্রতিযোগিতা টিভি চ্যানেলের! দেশীয় চ্যানেলগুলো এ সংকট ফেস করছে। তারাও তাই চেষ্টা করছে অনলাইন মাধ্যমে নিজেদেরকে ছড়িয়ে রাখার।
এক সময় যে বিজ্ঞাপনের বাজার ছিলো সম্পূর্ণ টিভি চ্যানেলের দখলে, সেখানেও ভাগ বসিয়েছে নানা অনলাইন মাধ্যম। পত্রিকা-টিভি-বেতার অ্যাডের চেয়ে ডিজিটাল বা অনলাইন বিজ্ঞাপন বাজারের আকৃতি দ্রুত গতিতে বাড়ছে। যে কোনো পণ্যের প্রসারের ব্যাপার এলেই লোকে এখন আগে ভাবে অনলাইনের কথা। এক্ষেত্রে ফেসবুক, ইউটিউব, নানান জনপ্রিয় ওয়েবসাইট মাধ্যমের অভাব নেই।
ফলে আগামীতে টিভি চ্যানেল বিজ্ঞাপন বাজারে প্রতিযোগিতা করে কতোখানি লাভজনক অবস্থানে থাকতে পারবে সে চিন্তায় কপাল কুঁচকানি তো আছেই। বিশেষ করে যখন বিজ্ঞাপনই এদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর আয়ের প্রধান উৎস।কেবল কনটেন্টের বৈচিত্রই এসব সংকট মোকাবেলার একমাত্র উপায়। প্রতিদিনের অনুষ্ঠান তালিকায় যা থাকছে, তাতে কতোখানি নতুনত্ব আছে, কতোখানি বৈচিত্রপূর্ণ এবং একইসঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য! এ দিকটি নিয়ে ভাবা উচিত।