তামিম: কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে...
এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচের প্রথম ওভারের শেষ দুই বলে দুই উইকেট নেই। ১৬ মাস পর খেলতে নামা মালিঙ্গা পরপর দুই বলে লিটন দাস আর সাকিব আল হাসানকে তুলে নিয়ে কাঁপন ধরিয়ে দেন বাংলাদেশের ড্রেসিং রুমে আর কোটি সমর্থকের হৃদয়ে। লাকমালের করা দ্বিতীয় ওভারের শেষ বলে যখন বা হাতের কব্জিতে চোট নিয়ে মাঠের বাইরে চলে গেলেন দেশের সেরা ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল, বাংলাদেশ তখন বিধ্বস্ত। বুকে হাত দিয়ে বলুন, ৩ রানে কার্যত ৩ উইকেট নেই, এই অবস্থায় আপনি কী ভেবেছিলেন? বাংলাদেশ এমনই, টসে জিতে ব্যাটিং নেয়া ঠিক হয়নি, জয় তো দূরের কথা ১০০ রান করতে পারে কিনা দেখেন- এসবই তো ছিল আলোচনার বিষয়।
কিন্তু মুশফিক জানেন কীভাবে লড়তে হয়, কীভাবে পাথরে ফুল ফুটাতে হয়, কীভাবে ধ্বংসস্তুপ থেকে ফিনিক্স পাখির মত উড়ে যেতে হয়। অথচ পাজরের হাড়ে ব্যথার কারণে এই ম্যাচে তার খেলারই কথা ছিল না। আহত বাঘ মুশফিক তরুণ মোহাম্মদ মিঠুনের সাথে গড়লেন ১৩১ রানের জুটি। ৩ বল বাকি থাকতে আউট হওয়ার আগে করলেন ১৫০ বলে ১৪৪ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। ততক্ষণে বাংলাদেশ ২৬১ রানের নিরাপদ বন্দরে। অবশ্যই এটা মুশফিকের সেরা ইনিংস, বাংলাদেশ ক্রিকেটেরও অন্যতম সেরা ইনিংস।
কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে ইনিংস গড়ার পাশাপাশি রানের চাকা সচল রাখতে হয়, কীভাবে টেলএণ্ডার নিয়ে এন্ড পর্যন্ত যেতে হয়- তার ক্ল্যাসিক উদাহরণ হয়ে থাকবে মুশফিকের এই ইনিংস। স্কোরকার্ডেও লেখা থাকবে ম্যান অব দ্যা ম্যাচ মুশফিকুর রহিম। তবুও এই ম্যাচ মুশফিকের রহিমের লড়াইয়ের গল্প নয়। এ ম্যাচ আবেগের, এ ম্যাচ দেশপ্রেমের, ভালোবাসার, প্রতিশ্রুতির, এ ম্যাচ কান্নার।
ক্রিকেট যখন পেশাদারিত্বের কঠোর খোলসে ঢাকা, ভালোবাসাটা যখন অনেক নিচে প্রায় চাপা পড়ে গেছে; তখনই আরেক বীর পাথর খুঁড়ে বের করে আনলেন ক্রিকেটের প্রতি, দেশের প্রতি ভালোবাসার-আবেগের হারিয়ে যাওয়া সেই ফল্গুধারা। এই বীরের নাম তামিম ইকবাল। এই গল্প শুধু বাংলাদেশ বা এশিয়া কাপের গল্প নয়; এ গল্প ক্রিকেটে আবেগের পুনর্জাগরণের।
দ্বিতীয় ওভারের শেষ বলে বাংলাদেশকে অসহায় অবস্থায় রেখে তামিম যখন 'রিটায়ার্ড হার্ট' হয়ে মাঠের বাইরে গেলেন, তখনও কেউ শেষের কথা ভাবেনি। তামিমকে শুধু মাঠের বাইরে নয়, যেতে হয় হাসপাতালে। পরীক্ষায় দেখা গেল বা হাতের আঙ্গুলের হাড়ে চিড় ধরেছে। এই ম্যাচ তো বটেই বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যানের এশিয়া কাপই শেষ। মাঠের বাইরে থাকতে হবে অন্তত ছয় সপ্তাহ। ব্যান্ডেজ বাধা হাত স্লিঙে ঝুলিয়ে যখন স্টেডিয়ামে ফিরলেন, তখন মুশফিকের লড়াই চলছে। বিষণ্ন দৃষ্টিতে দেখছিলেন খেলা। ৪৭তম ওভারের পঞ্চম বলে মুস্তাফিজ আউট হওয়ার পর সবাই ধরে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের ইনিংস ২২৯ রানেই শেষ।
একটি টিভি চ্যানেল ব্রেকিং নিউজ দিয়ে দিল, 'শ্রীলঙ্কার সামনে জয়ের টার্গেট ২৩০।' টসে জিতে বাংলাদেশের ব্যাটিং নেয়ার পর থেকেই আলোচনা হচ্ছিল, এই ফ্ল্যাট পিচে ২৭০/৭৫এর নিচে নিরাপদ নয়। সেখানে ২২৯ মোটেই ফাইটিং স্কোর নয়। কিন্তু খেলা তখনও শেষ নয়, বাংলাদেশের টুর্নামেন্ট আসলে তখনই শুরু হলো যখন এক হাতে ব্যাট নিয়ে মাঠে নামলেন তামিম ইকবাল। ড্রেসিং রুমে অনেকে না করেছেন, কিন্তু গোয়ার তামিম কারো কথা শোনেননি। প্রথমে বিস্ময় তারপর আবেগের এক ঢেউ খেলে গেল। কোটি মানুষের চোখে জল এনে দিলেন তামিম। লাকমালের করা ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারের শেষ বলে ব্যথা পেয়ে বাইরে গিয়েছিলেন। ফিরলেন সেই লাকমালের ওভারেই। ম্যাচের বয়স তখন ৪৭ ওভার। বাম হাত আড়ালে রেখে কোনোরকমে ডানহাতে ঠেকালেন একটি বল। ব্যস তারপর আর কিছু করতে হয়নি তামিমকে। কিন্তু ঐ একটি বল দলের মধ্যে যে সাহস সঞ্চারিত করেছে, তার কোনো তুলনা নেই। এই সাহসে পাহাড় ডিঙানো যায়, সাগর পেরুনো যায়। সেটাই দেখালেন মুশফিক পরের ১৫ বলে ৩২ রান করে।
ইনিংস শেষে বাংলাদেশের জয় নিয়ে আমার কোনো সংশয় ছিল না। আসলে ভাবনাও ছিল না। একটি ম্যাচের জয়-পরাজয়ে কিচ্ছু যায় আসে না। তামিম জিতে নিয়েছেন কোটি মানুষের হৃদয়। কিন্তু তামিম-মুশফিকের ত্যাগ আর লড়াই বাংলাদেশকে যেখানে নিয়ে গিয়েছে, তার মর্যাদা রাখতে মরিয়া ছিলেন মাশরাফি আর মুস্তাফিজরা। লঙ্কানরা তাই গুটিয়ে গেল মুশফিকের চেয়েও ২০ রান কম, মানে ১২৪ রানে। তামিমের ১ বলের ইনিংস দলে যে অপ্রতিরোধ্য মানসিকতা দিয়েছে, এই বাংলাদেশ কোথায় গিয়ে থামবে আমি জানি না।
এশিয়া কাপের গত তিন আসরে নাকি উদ্বোধনী ম্যাচে যারা জিতেছে, তারাই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সে হিসেবে বাংলাদেশেরই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা। এর আগে দুবার এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠলেও আমাদের স্বপ্ন ছোঁয়ার পথে একবার পাকিস্তান, একবার ভারত বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এবার কি তবে স্বপ্ন ছোঁয়ার পালা? জানি না, আমি জানতেও চাই না। প্রথম ম্যাচেই তামিম যা দিয়েছেন, আমার আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই। তামিমের ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস ৪ বলে অপরাজিত ২!
অনেকে বলছেন, তামিমের মত অভিজ্ঞ ও পেশাদার ক্রিকেটারের এই ছেলেমানুষি করা ঠিক হয়নি। আসলেই ঠিক হয়নি। টুর্নামেন্ট তো বটেই তার ক্যারিয়ারও ঝুঁকির মুখে পড়ে যেতে পারতো। যারা চিন্তা করেন মস্তিষ্ক দিয়ে, সাফল্য মাপেন টাকার অঙ্কে, ক্রিকেটের হিসাব মেলান ল্যাপটপে; তাদের বিবেচনায় তামিম যা করেছেন তা ভুল, তামিম বোকার হদ্দ। কিন্তু আমরা যারা পুরোনো ঘরানার মানুষ; যারা ক্রিকেটকে ভালোবাসি হৃদয় দিয়ে, সাফল্যের আনন্দে কেঁদে বুক ভাসাই; তাদের হৃদয় চিরদিনের জন্য জয় করে নিলেন তামিম। ক্রিকেটের জন্য এই আবেগ, দেশের জন্য এই ভালোবাসা যারা অনুভব করবেন না, তাদের এটা বলে বোঝানো যাবে না।
ভালোবাসলে কবি যেমন দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে লাল কাপড় বাঁধতে পারেন, তেমনি তামিম পারেন ক্যারিয়ারকে এক হাতের মুঠোয় নিয়ে মাঠে নেমে যেতে। ভাবুন একবার, তামিম কিন্তু বা হাতি। সেই বা হাতেই তিনি ব্যথা পেয়েছেন। আরেকটা ছোট ব্যথা বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারতো। ক্রিকেটে পেশাদারিত্ব যত প্রবল হয়েছে, আবেগ-ভালোবাসা তত কমে এসেছে। তবু ক্রিকেট নিয়ে, দেশ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-ভালোবাসা যেমন বেশি; ক্রিকেটারদেরও বেশি। নইলে হাঁটুতে ১১টি সেলাই নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর অমন ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতেন না মাশরাফি।
অবশ্য বাংলাদেশের ক্রিকেট আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে আবেগের ওপর ভর করেই। ২১ বছর আগে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠে আইসিসি ট্রফিতে হল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ থেকে অন্তত একটি পয়েন্ট না পেলে বাংলাদেশ বাদ। হল্যান্ডের দেয়া ১৭২ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ১৫ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ। বারবার বৃষ্টি হানা দিচ্ছিল ম্যাচে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় আবার বৃষ্টি হলে ডিএল মেথডে হেরে যাবে বাংলাদেশ।
বৃষ্টির আগেই খেলা শেষ করার তাড়া। দর্শক, দর্শকরা মাঠে নেমে পড়েন পানি সরাতে। বাংলাদোশের তাড়া ছিল বটে, কিন্তু ভেজা মাঠে রান তোলা ছিল কঠিন। বল জোরে মারলেও যায় না। অধিনায়ক আকরাম খান বিশাল বপুর, মারেনও বিগ হিট। কিন্তু তার সেদিনের অপরাজিত ৬৮ রানের ইনিংসে বাউন্ডারি মারতে পেরেছিলেন মাত্র ৩টি। তার মানে বাকি ৫৪ রান তাকে তুলতে হয়েছে দৌড়ে, জানবাজি রেখে। পারফরম্যান্স আর পরিস্থিতি বিবেচনায় সে ম্যাচ বাংলাদেশের জেতার কথা ছিল না, জিতেছে ভালোবাসার জোরে। বৃষ্টির সাথে দৌড়ে জিতে গিয়েছিলেন আকরাম খান, জিতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। বলা হয়, আকরাম খানে সেই অপরাজিত ৬৮ রানের ইনিংসেই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। সেবার আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ।
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে চমকে দেয় বিশ্বকে। সেই চমকের ধারে পরের বছর আসে টেস্ট স্ট্যাটাস। তারপর ধাপে ধাপে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব শক্তির কাতারে। নিজেদের দিনে যে কাউকে হারাতে পারে বাংলাদেশে। ২১ বছর আগে আকরাম খান যে আবেগে ভর করে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভিত রচনা করেছিলেন, তার ভাতিজা তামিম ইকবাল সেই ভালোবাসায় নতুন মাত্রা যুক্ত করলেন।
তামিম তোমার জন্য ভালোবাসা। তুমি আমাদের সাহসী করেছো। বিনা যুদ্ধে সূচাগ্র মেদিনী না ছাড়ার যে অদম্য মানসিকতা তুমি দেখালে, তা আমাদের অনুপ্রাণিত করবে, বারবার, বহুবার। ক্যারিয়ার বাজি রেখে তোমার এক হাতে ব্যাট করার ভিডিওটি আমি মোবাইলে সেভ করে রেখেছি, যখনই মন খারাপ হবে, অনুপ্রেরণার ঘাটতি হবে; তখন দেখবো; যখন মন ভালো থাকবে, তখনও দেখবো।
তামিম তুমি আবারও সুকান্তের কবিতাকেই সত্য প্রমাণ করলে:
সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়,
জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ