পাশের বাড়ির মমতাময়ী বড় বোন



প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন

প্রভাষ আমিন

  • Font increase
  • Font Decrease

শেখ হাসিনা আমার প্রিয় চরিত্র। তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে আমার একই সঙ্গে প্রচণ্ড আগ্রহ এবং তীব্র অনীহা রয়েছে। শেখ হাসিনা একজন মানবিক মানুষ, ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। তাই তাঁকে ভালো যেমন বাসি, তেমনি কিছু সমালোচনাও আছে। আমি জানি, খোলা মনে সমালোচনা গ্রহণ করার ঔদার্য্য শেখ হাসিনার আছে। সমালোচনা গ্রহণ করার ব্যাপারে তার সহনশীলতায় আমার আস্থা আছে।

পরিবারের প্রায় সবাইকে হারিয়ে, ১৯ বার হত্যা চেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা আসলে সর্বংসহা। আমাদের এসব সমালোচনা আর কথার বাণ তাঁর অসীম সহ্যক্ষমতার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। তবে তাঁর দলের লোকজনের সহনশীলতা নেই বললেই চলে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেই তারা মামলা ঢুকে দেন, হামলা করেন। যেমন 'শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কটুক্তি' করার অভিযোগে ছাত্রলীগ নেতার দায়ের করা মামলায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম এখন কারাগারে আছেন। এমন উদাহরণ আরো আছে। অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌক্তিক সমালোচনা, এমনকি অযৌক্তিক সমালোচনাও অপরাধ নয়।

বঙ্গবন্ধু আমলে জাসদ নেতারা যে ভাষায় তাঁর সমালোচনা করেছে, এখন তা কল্পনা করতেও ভয় লাগে। শেখ হাসিনা একজন মানুষ। তাঁর ভালো যেমন আছে, মন্দও তেমনি আছে। কারো দৃষ্টিতে ভালো বেশি, কারো দৃষ্টিতে মন্দ। সহনশীলতা শেখ হাসিনার একটি মহৎ গুণ। সেই ভরসায়  তীব্র অনীহা কাটিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহেরই জয় হয়েছে।

শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের পছন্দ করেন, আবার তাদের নানা কাজের, লেখার, বলার হুল ফোটানো সমালোচনাও করেন। এটাকে আমি সবসময় ইতিবাচকভাবেই নেই। তাঁকে সমালোচনা করা যদি আমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হয়, সেটার জবাব দেয়াও তো তাঁর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। তবুও এই সময়ে তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তীব্র অনীহা এসেছে অন্য কারণে। শেখ হাসিনা সুযোগ পেলেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে ভালোবাসেন। দেশের বাইরে গেলে ফিরে এসেই সংবাদ সম্মেলন করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর যে মজার খুনসুটি হয়, তা দারুণ উপভোগ্য। এখন তো সব টেলিভিশন শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করে। তবে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তারপরও টেলিভিশনগুলো প্রতিযোগিতা করে সরাসরি সম্প্রচারে যায়, কারণ শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন একটি খুব দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠান। তখন সব চ্যানেলের টিআরপি থাকে হাই।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127113929.jpg

আমি যখন মাঠের রিপোর্টার ছিলাম, তখন টেলিভিশনের এমন দৌরাত্ম্য ছিল না। তখন উপস্থিত থেকে এবং এখন টেলিভিশনে দেখে যতটা বুঝি, শেখ হাসিনা প্রশ্ন নিতে ভালোবাসেন। তাঁকে কী প্রশ্ন করা যাবে, কী করা যাবে না; তার কোনো পূর্ব নির্ধারিত ফরম্যাট নেই। প্রশ্ন যেমনই হোক তিনি উত্তর দেন দারুণ সপ্রতিভতায়। কখনো কখনো পাল্টা প্রশ্ন করে চমকে দেন প্রশ্নকর্তাকেই।

আগে তাঁর সংবাদ সম্মেলন কাভার করার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ভিন্নমতের সাংবাদিকরাও তাঁর সংবাদ সম্মেলনে যেতে পারেন, প্রশ্ন করতে পারেন। আমাদের সময় সংবাদ সম্মেলনে প্রথম প্রশ্নটি করতেন নিউ নেশনের রিপোর্টার মোজাফফর হোসেন মানিক। প্রয়াত এই সাংবাদিক প্রথম প্রশ্নটিই একটু খোঁচা মেরে করতেন। শেখ হাসিনাও পাল্টা খোঁচা দিতেন। একবার এক সাংবাদিক বললেন, আপা, মানিক ভাইয়ের বাড়ি তো গোপালগঞ্জে। জবাবে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘গোপালগঞ্জে কি রাজাকার নাই?’ তখন দৈনিক দিনকালের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন কাভার করতে যেতেন মোখলেসুর রহমান চৌধুরী, যিনি পরে রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদের প্রেস সচিব হিসেবে আলোচিত হয়েছিলেন। মোখলেস ভাই সবসময় শ্রীলঙ্কার পত্রিকা দ্যা আইল্যান্ড-এর বাংলাদেশ সংবাদদাতা হিসেবে পরিচয় দিতেন। আর শেখ হাসিনা বলতেন, ‘আরে আগে বাংলাদেশেরটা বলেন।’ মোখলেস ভাই কাচুমাচু করে দিনকালের পরিচয় দিলেই শেখ হাসিনা জিজ্ঞেস করতেন, দিনকাল কেমন চলছে?

প্রস্তুতি না নিয়ে শেখ হসিনার সংবাদ সম্মেলনে গেলে খবর আছে। কদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নিয়ে জানতে চাইলেন। জবাবে শেখ হাসিনা পাল্টা প্রশ্ন করলেন, মাতারবাড়িটা কোথায়? দেখা গেল উপস্থিত সাংবাদিকদের কেউই মাতারবাড়ি চেনেন না। কিন্তু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে তাদের অনেক উদ্বেগ! সব মিলিয়ে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন সবসময়ই দারুণ উপভোগ্য অভিজ্ঞতা হতো সাংবাদিকদের জন্য। এই সংবাদ সম্মেলনকে ঘিরেই ছিল আমার অনীহা। সাম্প্রতিক কয়েকটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা পেশাগত পরিচয় ভুলে এমনভাবে প্রশ্ন করেছেন, যা আসলে প্রশ্ন নয়, অন্ধ দলীয় আনুগত্যের প্রকাশ। দলীয় নেতাকর্মীদের উপস্থিতি আর করতালির শব্দ শুনে মনে হয় না, এটি সংবাদ সম্মেলন।  

সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনের কারণে সাধারণ সাংবাদিকদের সম্পর্কে ধারণাটাই হয়েছে নেতিবাচক। তাই আমার শঙ্কা, শেখ হাসিনা সম্পর্কে লিখলেই সেই পারসেপশনের কবলে পড়তে হবে। কারণ সত্যি কথা লিখলেও তা তাঁর প্রশংসাসূচকই হবে। আমি দলনিরপেক্ষ, তবে আদর্শ নিরপেক্ষ নই। আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদার, গণতান্ত্রিক, উন্নত, সমৃদ্ধশালী, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই। আর এটাও জানি, এই লক্ষ্য অর্জনে এখনও শেষ আশ্রয় শেখ হাসিনাই। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের অনেক কাজের সমালোচনা করলেও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমি ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার অনুরাগী। অনেক ভেবে দেখলাম, আমি কখনো রাজনীতি করবো না, সাংবাদিক নেতাও হবো না, কোনো পোস্টিংএ আগ্রহ নেই, কোনো পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, টেলিভিশনের মালিক হতে চাইবো না; তাই আশা করি যাই লিখি, তা ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে লিখতে পারবো। প্রশংসাসূচক লিখলেও, তা কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশায় নয়, সেটা নিশ্চিত। নিজের কাছে এটা নিশ্চিত হওয়ার পর শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখার ঝূঁকিটা আমি নিয়েছি।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127204460.jpg

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দু’জন মানুষের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১০ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার প্রতীক্ষায় তখন গোটা জাতি। তিনি এসে শুরু করেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজ। কিন্তু ৭৫এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশে শুরু হয় পাকিস্তানীকরণ। স্বাধীনতা বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়ে যান। রাজনীতি ঢুকে পড়ে ক্যান্টনমেন্টে। এই সময় ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৪ বছর। আওয়ামী লীগের মত বড়, কোন্দল কবলিত এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সরকারি নিষ্পেষণে ধ্বংসপ্রায় একটি দলের সভাপতির দায়িত্ব নেয়াটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। শেখ হাসিনা সেই দায়িত্ব কতটা পালন করতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় ছিল অনেকেরই। দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবেই শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। যারা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছেন, তাদেরও ধারণা ছিল, শেখ হাসিনাকে সামনে রেখে তারাই দল চালাবেন। কিন্তু শেখ হাসিনা সবাইকে চমকে দিয়েছেন। টানা ৩৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব শুধু পালনই করেননি; আওয়ামী লীগকে তুলে এনেছেন অন্যরকম উচ্চতায়।

এখন শুধু দল নয়, দেশ, এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও অনেকের আগ্রহের কেন্দ্রে শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন, তখন আমি স্কুলের ছাত্র। তখন থেকেই রাজনীতির ব্যাপারে আমার আগ্রহ। তাই শেখ হাসিনাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি, আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতি মুগ্ধতা বেড়েছে।

শেখ হাসিনা যে এখনও বেঁচে আছেন, এটা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশে থাকলে, সেদিনই পরিবারের আর সবার সঙ্গে নিহত হতে পারতেন। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বেঁচে যাওয়াটা তো অলৌকিক।

১৯৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন, তখন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন জার্মানিতে। রাষ্ট্রপতির কন্যা থেকে হঠাৎ বনে যান অসহায়, এতিম। আগের দিন যারা মাথায় তুলে রেখেছিল, পরদিন তারাই মুখ ঘুরিয়ে নেন। দুই সন্তান আর ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে যাপন করেন উদ্বাস্তু জীবন। সেই উদ্বাস্তু জীবন থেকে কীভাবে শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যতম সেরা নেতায় পরিণত হলেন, তা নিয়ে একটি অসাধারণ সিনেমা হতে পারে। সেই চিত্রনাট্যে পদে পদে ষড়যন্ত্র, পদে পদে ঝুঁকি, অসম সাহসিকতা, দেশপ্রেম সবকিছুর অনবদ্য সব গল্প থাকবে।

সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো শেখ কামালই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরসূরী হতেন। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাই শেখ হাসিনাকে রাজনীতিতে টেনে এনেছে। সাদা চোখে দেখলে শেখ হাসিনা উত্তরাধিকার সূত্রেই রাজনীতিতে এসেছেন। তবে ভুলে গেলে চলবে না তিনি ছাত্রজীবনেই ছাত্রলীগের মাঠের কর্মী ছিলেন। বড় সন্তান হিসেবে কাছ থেকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দেখেছেন তাঁর মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দৃঢ়তা। বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন রাজনীতির দীক্ষা আর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন শত কষ্ট সয়েও আদর্শে অবিচল থাকার শিক্ষা।

শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন, তখন চলছে জিয়াউর রহমানের শাসন, যিনি ক্যান্টনমেন্টে বসে গণতন্ত্র চর্চা করছিলেন। কিন্তু একবছরের মাথায় জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর নানা নাটকীয়তা পেরিয়ে ক্ষমতায় আসেন আরেক সেনা প্রধান এইচ এম এরশাদ। তিনিও তার পুর্বসূরীকে অনুসরণ করে গণতন্ত্র চর্চা করেন ক্যান্টনমেন্টে বসেই। এরশাদের টানা নয় বছরের স্বৈরশাসনের সময়ে শেখ হাসিনা গণতন্ত্র মুক্তির আন্দোলন করে গেছেন রাজপথে। একই সময়ে বেগম খালেদা জিয়াও হাল ধরেন বিএনপির। রাজপথেই বিকশিত হন দুই নেত্রী। তবে শেখ হাসিনা এই ৩৭ বছরে নিজেকে এবং বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসবেন, ৮১ সালে এটা কেউ ভাবেননি, আমার ধারণা শেখ হাসিনা নিজেও না।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127269863.jpg

শেখ হাসিনার চরিত্রের অনেকগুলো দিক আছে। তিনি আদর্শে অবিচল, প্রয়োজনে ইস্পাতের মত কঠিন। আবার নিমেষেই কুসুমের মত কোমল। ভুতের মত পরিশ্রম করা এবং দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দল এবং দেশ পরিচালনায় তাঁকে অপ্রতিদ্বন্দী করে তুলেছে। সিনেমায় যেমন এক অভিনেতা একাধিক চরিত্রে অভিনয় করে, তেমনি এক শেখ হাসিনায় যেন বাস করে অনেক শেখ হাসিনা। রাজনীতির মাঠের পাকা খেলোয়াড়কেই দেখা যায় ছেলের জন্মদিনে পোলাও রান্না করছেন। নাতির আবদার মেটাতে রীতিমত শঙ্কা নিয়ে মাছ রাধতে বসে যান। গণভবনের পেছনে ব্যাডমিন্টন খেলতে নেমে পড়া শেখ হাসিনার ছবিও ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটানোর ছবিও হুটহাট প্রকাশ হয়ে যায়। সাগরের পাড়ে গিয়ে খালি পায়ে নেমে পড়েন সমুদ্রে। ছোট বোনের সাথে তুষার নিয়ে খেলা করেন।

রাজনীতি করতে গেলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কিছু করতে হয়। ভোটের মাঠে জড়িয়ে ধরতে হয় বস্তির মানুষকেও। কিন্তু শেখ হাসিনা যখন কাউকে জড়িয়ে ধরেন, দেখলেই বোঝা যায়, নিছক রাজনীতি নয়, তাতে মিশে আছে মমতা। নিমতলীর আগুনে সর্বস্ব হারা দুই মেয়েকে বুকে টেনে নেন মায়ের মমতায়। এমনকি জামালপুর থেকে আসা হিজড়াদের জড়িয়ে ধরেন পরম আদরে। হিজড়াদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসার গল্পটাও মজার। গত কোরবানীর ঈদের আগে এক হিজড়া প্রধানমন্ত্রীকে এসএমএস করে বলেছিলেন, তাদের কোরবানী দেয়ার সামর্থ্য নেই। শেখ হাসিনা জামালপুরের জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের জন্য গরু পাঠিয়েছিলেন। সেই কৃতজ্ঞতা জানাতেই তারা ছুটে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। রাজনৈতিক প্রচারের বাইরে কত মেধাবীর পড়ার খরচ জোগান শেখ হাসিনা, তা আড়ালেই রয়ে যায়। রয়ে যায়, কারণ শেখ হাসিনা সেই প্রচারণা চান না। সবাইকে কাছে টেনে নেয়ার, আপন করে নেয়ার এক বিরল ক্ষমতা রয়েছে তার। যারা দুজনকেই দেখেছেন, তারা বলেন, এই গুণটা তিনি বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। এমন আটপৌড়ে ভঙ্গিতে কথা বলেন, বোঝাই যায় সেখানে আন্তরিকতার ছোঁয়া রয়েছে। নেতাকর্মী, শিক্ষক, সাংবাদিক, সংস্কৃতি কর্মী- সবার সঙ্গে তার শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহের সম্পর্ক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যেমন ভোলেন না, তেমনি ভোলেন না তৃণমূলের কর্মীদেরও। সবকিছুর ওপরে তাঁর চরিত্রের যে মানবিক আবেদন, তাই অন্য সবার চেয়ে আলাদা করেছে শেখ হাসিনাকে। সাংবাদিকদের মধ্যে যারা তাঁর সঙ্গে সফর করেছেন, তারা পেয়েছেন, তাঁর এই স্নেহের পরশ। এখন হয়তো আর সম্ভব হয় না। তবে আশি ও নব্বইয়ের দশকে নিজে খোঁজ নিয়ে ডেকে সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের থাকা-খাওয়ার তদারকি করতেন। সুযোগ পেলে পাতে তুলে খাইয়েছেন। যারা একবার এই স্নেহের সন্ধান পেয়েছেন, তারা আর তাঁকে ছেড়ে যেতে পারেন না। তবে শেখ হাসিনার চরিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশ তাঁর অসাধারণ হিউমার আর উইট। বুকে এমন বেদনার মহাসাগর ধারণ করে, জীবন থেকে এতটা রস নিংড়ে নেয়ার ক্ষমতা বুঝি শেখ হাসিনার একার।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127289240.jpg

শেখ হাসিনার জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় আছে। কিন্তু জাতির জনকের কন্যা, নিজেও দীর্ঘসময় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার পরও তিনি যে এতটাই মাটির কাছাকাছি, আমার ধারণা এর কারণ, তাঁর ছেলেবেলো কেটেছে তখনকার অজপাড়াগা টুঙ্গীপাড়ায়। উদার প্রকৃতি আর মধুমতি থেকে উড়ে আসা কোমল বাতাস তার হৃদয়ে এই বাংলার জন্য যে ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে, তা ক্রমশ বেড়েছে, পরিণত হয়েছে এই দেশকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্বে। সেই থেকেই প্রকৃতির প্রতি তাঁর অপার ভালোবাসা, মানুষের জন্য অগাধ দরদ তাঁর মনে। সংসারের বড় সন্তান হিসেবে মায়ের পাশে থেকে দেখেছেন দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ, আর সংসারের জন্য মায়ের কষ্ট। একাত্তরে অবরুদ্ধ বাংলায় মা হয়েছেন। তারপর বছর তিনেকের ‘ভিআইপি’ জীবন। সে ভিআইপি জীবন কেমন, তা এখনও দেখা যায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গেলে। রাষ্ট্রপতির বাসার ড্রইরুম, বেডরুম, ডাইনিং রুমের সঙ্গে আর দশটা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের কোনো তফাত নেই। ৭৫এর পর ৬ বছর উদ্বাস্তু জীবন। ৮১ থেকে রাজনৈতিক জীবন। তাঁর ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনেও রয়েছে নানা বাঁক।

শেখ হাসিনা যখন দায়িত্ব নেন, তখন আওয়ামী লীগ এক কোন্দলকবলিত, ধ্বংসপ্রায় দল। তাঁকে দলের সভানেত্রী করা হয়েছিল ঐক্যের সূত্র হিসেবে। ৭৫এর পর থেকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়ে যান বঙ্গবন্ধু। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে উল্টোপথে। স্বাধীনতাবিরোধীরা হয়ে যান দেশের প্রধানমন্ত্রী। এমন অন্ধকার সময়ে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা শুরু করেন দ্বিমুখী সংগ্রাম। প্রথম কাজ হলো, ধ্বংসস্তুপ থেকে আওয়ামী লীগকে দাড় করানো। দ্বিতীয়ত দেশকে সামরিক ও স্বাধীনতাবিরোধীদের কবল থেকে মুক্ত করা। সমানতালে চলে তার কর্মযজ্ঞ। ৯০এ স্বৈরাচারের পতনের পর ৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে, এমন ধারণাই প্রচলিত ছিল। কিন্তু সব ধারণা পাল্টে দিয়ে জন রায় পায় বিএনপি। পরাজয়ের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু দলীয় নেতাকর্মীদের ভালোবাসার তোড়ে ভেসে যায় সব অভিমান। আওয়ামী লীগের জন্য অনেক করেছেন, তাই আওয়ামী লীগের সামান্য বিচ্যুতিও তাঁকে কষ্ট দেয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে একবার তিনি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলনকে সামনে রেখে একাধিকবার তিনি অবসর নেয়ার আকাঙ্খার কথা বলেছেন। কিন্তু যতই বলুন, এখনও আওয়ামী লীগ তো বটেই, দেশের জন্যও তাঁর বিকল্প নেই। তিনি অনায়াসে স্বীকার করেন, ‘আওয়ামী লীগের সবাইকে কেনা যায়, আমাকে ছাড়া।’ আরেকটা উপলব্ধি তাঁর অসাধারণ, ‘আওয়ামী লীগের নেতারা ওলটপালট করলেও কর্মীরা সবসময় ঠিক থাকে।’ ওয়ান-ইলাভেনের বিপদে বাঘা বাঘা নেতারা নানা মাইনাস তত্ত্বে মেতে উঠলেও কর্মীরাই তাঁকে রক্ষা করেছে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127317935.jpg

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এসেই কাঁধে তুলে নেন ২১ বছরের জঞ্জাল পরিস্কারের দায়িত্ব। প্রথম কাজ জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার বিচারের প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং বিচার শুরু। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে করেন শান্তিচুক্তি। ভারতের সঙ্গে করেন গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে শুরু শেখ হাসিনার নেতৃত্বের উৎকর্ষের চরম প্রকাশ। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর করেন। এরপর শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই দুটি বিচার করে তিনি গোটা জাতিকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতির গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছেন আমাদের। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হয় জাতির অপেক্ষার পাশাপাশি কন্যা হিসেবে তার দায়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো আদর্শের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তার অবিচল আস্থার প্রকাশ।

এই দফায় ভারতের সঙ্গে ৬৮ বছরের সীমান্ত সমস্যা সমাধান করে ছিটমহলবাসীকে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এই দফায় শেখ হাসিনার মূল লক্ষ্য উন্নয়ন। মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের চেতনা উন্নত ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্যেই অবিরাম ছুটে চলা তার। এবং এই ছুটে চলা গোয়ারের মত। পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপোড়েনের পর শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দেন, নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানাবেন। তখন তাঁর মন্ত্রিসভার অনেকেও বিশ্বাস করেননি এটা সম্ভব। কিন্তু পদ্মা সেতু এখন আর কম্পিউটার গ্রাফিক্স নয়, স্বপ্ন নয়; বাস্তবতা। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আমি লিখেছিলাম ‘পদ্মা সেতু: শেখ হাসিনার গোয়ার্তুমির প্রতীক’। আসলেই গোয়ার্তুমি। এই গোয়ার্তুমি করেই তিনি বিদ্যুৎ উৎপাদনকে নিয়ে গেছেন অবিশ্বাস্য জায়গায়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন উপেক্ষা করে কার্যকর করেন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি। তাঁর বক্তৃতায়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর অবয়ব থেকে যে আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ে সেটাই এখন বাংলাদেশের চিত্র। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। যে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে গিয়েছিল, সেই বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসে দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বকে বাংলাদেশ থেকে শিখতে বলে। বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, এগিয়ে যাচ্ছে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার দিকে। দেশের ভালোর জন্য শেখ হাসিনা গোয়ার কিন্তু সবসময় অনঢ় নন। জনগণের দাবির মুখে সরে আসেন আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর স্থাপনের সিদ্ধান্ত থেকে। তবে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে অনঢ় অবস্থান, পরিবেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসার সমান্তরাল নয়। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে হয়তো কম হবে, তবে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবনের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হবে, এটা প্রায় নিশ্চিত। তবুও আমি ধরে নিচ্ছি, সরকারের দাবিই সত্য, ক্ষতি হবে না। তবুও জনগণের আবেগ বিবেচনায় নিয়ে রামপাল প্রকল্প থেকে সরে আসলে তিনি সবার ধন্যবাদ পেতেন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127334995.jpg

শেখ হাসিনা বারবার নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্ট। কিন্তু সেই সমস্যার দায় এখন বাংলাদেশের কাঁধে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পোড়ামাটি নীতিতে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে আসছে। আর শেখ হাসিনা তাদের আগলে রাখছেন মায়ের মমতায়। ১৬ কোটি মানুষের চাপে পিষ্ট বাংলাদেশের ওপর এখন ১০ লাখ রোহিঙ্গার দায়। শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি গলায় যখন গণহত্যা আর জাতি নিধনের কলঙ্ক, তখন শেখ হাসিনাকে মানুষ বলছে ’মাদার অব হিউম্যানিটি’। শুধু আশ্রয় দিয়েই শেখ হাসিনা বসে থাকেননি। রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। জন্মদিনেও তিনি ব্যস্ত জাতিসংঘে। শেখ হাসিনার এই মানবিক নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়েছে বিশ্ব পরিমন্ডলে। আর চাপ বাড়ছে অং সান সু চির ওপর। এর আগে পার্বত্য শান্তি চুক্তি, ছিটমহল সমস্যার সমাধান করেও সবার প্রশংসা পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এবার রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে তাঁর আন্তরিক ও মানবিক উদ্যোগ তাঁকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

নেতৃত্বের, ব্যক্তিত্বের এই চরম উৎকর্ষের সময়েই শেখ হাসিনার ইমেজে লেগেছে সবচেয়ে কলঙ্কের কালি। ৬৯ বছরজুড়েই গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করা আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কলঙ্ক ৫ জানুয়ারি নির্বাচন। এ যেন বিএনপির সমান হওয়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। বিএনপির ঝুলিতে একটা ১৫ ফেব্রুয়ারি আছে, আমাদের কেন ৫ জানুয়ারি থাকবে না? সাম্প্রতিক বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন, আমাদের মনে করিয়ে দেয় জিয়া-এরশাদ আমলের ‘হোন্ডা-গুন্ডা-ডান্ডা, নির্বাচন ঠান্ডা’ তত্ত্ব। এটা দুর্ভাগ্যজনক। ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’র সময়েই দেশে গণতান্ত্রিক স্পেসের সবচেয়ে বড় সঙ্কটের অভিযোগ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়ার শঙ্কা।

তার আমলে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে এখন বাংলাদেশে মানবাধিকার-গণতন্ত্রকে আড়াল করা হচ্ছে। এসবই সত্যি অভিযোগ। তাই মানতে বড় কষ্ট হয়। উন্নয়ন প্রশ্নে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীনকে উদাহরণ টেনে এসব অভিযোগকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক পন্থায় উন্নয়নই টেকসই উন্নয়ন। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রে আমার আস্থা নেই পুরোপুরি। আমি বিশ্বাস করি ন্যায্যতার গণতন্ত্রে। আমি গণতন্ত্রের শেষ কথা মানি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের একটি লাইনকে, ‘আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো, এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি হয় সে, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো।’ গণতন্ত্রের এই চেতনায় বিশ্বাস করেন শেখ হাসিনাও। ২০০৮ সালে নির্বাচনে ভূমিধ্বস জয় পাওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলকে আমি সংখ্যা দিয়ে গুণবো না।’ কিন্তু সেই চেতনা থেকে কি শেখ হাসিনা সরে গেছেন? তবে আরেকটি নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনা বারবার অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আকাঙ্খার কথা বলছেন। বলছেন, 'জনগণ ভোট দিলে ক্ষমতায় আসবো, নইলে নাই'। আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হলেই ৫ জানুয়ারির কলঙ্কের দাগ কিছুটা মুছবে।

দেশ অনেক এগিয়েছে, এগুচ্ছে। উন্নয়ন কাজ হচ্ছে অনেক। এখন শেখ হাসিনাকে নিশ্চিত করতে হবে দুর্নীতিমুক্ত টেকসই উন্নয়ন। নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের অনেকেই জনবিচ্ছিন্ন, কর্মীবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। অনেক এমপি নিজ নিজ এলাকায় একচ্ছত্র্য আধিপত্য কায়েম করেছেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ। আওয়ামী লীগের অনেকেই বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার সত্যিকারের চেতনা ধারণ করে না। দলের দরজা খুলে দেয়ায় বিভিন্ন দল থেকে ক্ষমতালোভী ধান্দাবাজ হাইব্রিডদের ভিড় এখন আওয়ামী লীগে। এখানে শেখ হাসিনাকে শক্ত হতে হবে, নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। এমপি-মন্ত্রীদের পাঠাতে হবে মাটির কাছে, মানুষের কাছে।

ইতিবাচকভাবে নেন, আর নেতিবাচক; শেখ হাসিনা এখন দারুণ পলিটিশিয়ান। নিজের দল তো সামলানই, সামলাতে হয় মহাজোটে থাকা জাতীয় পার্টি, জাসদের অন্তর্দ্বন্দ্বও। আমার তো কেন জানি সন্দেহ হয়, বিএনপির অনেক কলকাঠিও কি শেখ হাসিনা নাড়েন? যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার পেছনেও শেখ হাসিনার কোনো হাত থাকলেও আমি অবাক হবো না। আমরা প্রায়ই শেখ হাসিনাকে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দেই, চাপ দেই। কিন্তু যখন দেখি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনে বেগম খালেদা জিয়া ঘটা করে জন্মদিন পালন করেন, যখন জানি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের হাত আছে; তখন নিজেদের পরামর্শকেই অন্যায় মনে হয়। তবু শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে ফোন করেন, সন্তানের মৃত্যুতে খালেদা জিয়াকে সান্তনা জানাতে ছুটে যান। শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই বিএনপি খারাপ। কিন্তু এটা তো মানতেই হবে দেশের জনগণের একটা বড় অংশ বিএনপিকে ভোট দেয়। সব দলের আদর্শ এক হবে না। তাই বলে তো বিরোধী মতকে ধ্বংস করে দেয়া যাবে না। ভিন্নমতেই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য। বিএনপি অংশ না নিলে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি নেবে না, সেটা তাদের ব্যাপার। তাদের জোর করে আনা যাবে না, এটাও সত্যি। কিন্তু শেখ হাসিনার আন্তরিক ইচ্ছা এবং নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে উদারতা বিএনপির নির্বাচনে আসার পথ সুগম হবে। বিএনপির নির্বাচনে আসাটা তাদের জন্য যেমন ভালো, আওয়ামী লীগের জন্যও ভালো; সবচেয়ে ভালো গণতন্ত্রের জন্য।

আগেই বলেছি, শেখ হাসিনা একসঙ্গে অনেক চরিত্রে অভিনয় করেন। শেখ হাসিনা হলেন বাঙালি মুসলমানের চিরন্তণ চরিত্র। যার দিন শুরু হয় ফজর নামাজ আর কোরান তেলাওয়াত দিয়ে, তাকেই কিনা শুনতে হয় নাস্তিকদের নেত্রীর অভিযোগ। আমি জানি তিনি ধর্মনিরপেক্ষ, সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক; তবুও ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় তাকে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখতে হয়। শত্রু জেনেও হেফাজতে ইসলামকে আস্থায় রাখতে হয়। ’নাস্তিকদের নেত্রী’ এই বদনাম ঘোচাতে মেনে নেন হেফাজতের অনেক অন্যায় আবদারও।

আমি জানি, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে প্রতিদিন এমন অনেক কিছু করতে হয়। দুঃখিনী রাজকন্যা শেখ হাসিনার হয়তো ইচ্ছা করে কবিতার বই পড়তে পড়তে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে; রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে পাখির মত উড়ে বেড়াতে; সেই তাকেই কিনা সারাক্ষণ থাকতে হয় এসএসএফ’এর নিরাপত্তার ঘেরাটোপে!

এত ব্যস্ততার মধ্যেও বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী শেখ হাসিনা বই পড়েন, সাহিত্যের খোঁজ খবর রাখেন। নিজে লেখালেখি করেন। কোনো অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলেই প্রিয় গানে গলা মেলান। প্রিয় শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার জন্মদিনে টেলিভিশনের সরাসরি অনুষ্ঠানে ফোন করে চমকে দেন সবাইকে। চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্রের চিঠির জবাব দেন। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসা মুক্তামনির জন্য চকলেট পাঠান। গণজাগরণ মঞ্চে যেতে চাওয়ার আকুতির কথা বলেন প্রকাশ্যে। সৈয়দ শামসুল হককে দেখতে ছুটে যান হাসপাতালে। কবির শয্যাপার্শ্বে বসেন থাকেন গভীর মমতায়। সৈয়দ হকের মৃত্যুতে স্থগিত করে দেন নিজের জন্মদিনের সব আয়োজন। শহীদ কাদরির মৃত্যুর পর তার শেষ ইচ্ছা পূরণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কবির মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ বা কবি হেলাল হাফিজের অসুস্থতার খবর শুনে তাদের ডেকে এনে পাশে দাড়ান। কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিপদে এমন মমতা নিয়ে পাশে দাড়ান; কৃতজ্ঞ হয়ে যায় সবাই। শেখ হাসিনার যেন একশোটা হাত, হাজারটা চোখ। কোনো কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায় না।

তাঁর বক্তব্যে জীবন সম্পর্কে, চারপাশের মানুষ সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ দেখে আমি চমকে যাই। ছেলেরা শেভ করার সময় কল ছেড়ে রেখে পানির অপচয় করে; এ পর্যবেক্ষণ তো সাহিত্যিকের। শিশুদের শিক্ষা নিয়ে, স্কুলে শিশুদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান চমকে দেয়। ৭০ বছর বয়সেও তিনি এতটা প্রযুক্তিবান্ধব, ভাবলে অবাক হই। মাঝে মাঝে ভাবি, শেখ হাসিনা যদি প্রযুক্তিবান্ধব না হতেন, তাহলে আমরা আরো অনেক পিছিয়ে থাকতাম। আমি বারবার মুগ্ধ হই, অবাক হই; এতটা কষ্ট বুকে চেপেও এমন দৃঢ়তায় একটি দেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়া কীভাবে সম্ভব, কীভাবেই বা সম্ভব সবকিছুর এত খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করা?

শত্রুমিত্র খুব ভালো চেনেন শেখ হাসিনা। এটা চিনেছেন তিনি পরিবারের সবাইকে হারিয়ে। তবুও তিনি বিশ্বাস করেন, ক্ষমা করেছি, কিন্তু ভুলবো না। তাই তো মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্যরা তার দলের এমপি হন; ১৫ আগস্ট যিনি বঙ্গবন্ধুকে পালানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেই কাপুরুষ সেনাপ্রধানও বরিত হন আওয়ামী লীগে। যাদের জন্মই হয়েছিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার জন্য, সেই জাসদ নেতারা তার মন্ত্রিসভায় থাকেন দাপটের সঙ্গে। ১৫ আগস্টের পর যিনি স্বনামে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন, সেই তিনিও শেখ হাসিনার ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ওয়ান ইলাভেনের মাইনাসপন্থিরাও তার চারপাশে ভিড়ে যায় অনায়াসে। শত্রুকে ক্ষমা করে দেয়ার এই মহৎ গুণটিও তিনি পেয়েছেন, তাঁর পিতার কাছ থেকে। শেখ হাসিনা জেনেশুনেই করেন এসব। তিনি জানেন, সুযোগ পেলে তার চারপাশের অনেকেই ছোবল মারার জন্য বিষ সঞ্চয় করছেন, তবুও শত্রুকে অনুগত রাখতে, চোখে চোখে রাখতেই বুঝি ভালো লাগে তার।

আমার এতকিছু ভালো লাগে না। আমার ভালো লাগে শেখ হাসিনাকে। প্রধানমন্ত্রী নয়, বিশ্বনেত্রী নয়, জননেত্রী নয়, গণতন্ত্রের মানসকন্যা নয়; সবসময়ই শেখ হাসিনাকে আমার মনে হয় পাশের বাড়ির মমতাময়ী বড় বোন।

৭২তম জন্মদিনে শেখ হাসিনার জন্য শুভেচ্ছা। দেশের স্বার্থেই তাঁর শতায়ু চাই।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

 

   

বর্জনে অসারের তর্জন গর্জন সার



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের একটা প্রচারণা শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন এটা ছিল কেবল সামাজিক মাধ্যমে। এখন এটা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আগে যদিও ছিল, তবে সেটার প্রভাব এতখানি বিস্তৃত ছিল না।

রুহুল কবির রিজভীর পরনের চাদর ছুড়ে ফেলা এবং এরপর পুড়ানোর ঘটনার পর এখন এটা নিয়ে সরকারের একাধিক মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীও কথা বলেছেন। ঘটনা যখন এত দূর গড়িয়েছে, তখন ধারণা করা যায়, খুব সহসা এটা থামছে না। যদিও শেষ পর্যন্ত এটা চূড়ান্ত বর্জন পর্যন্ত না পৌঁছে বাগযুদ্ধ পর্যন্তই সীমিত থাকবে।

বিএনপি মুখে ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে তাদের এই ভারত-বিরোধিতা চালিয়ে যেতে হয়েছে। দলটির ধারণা এবং প্রচারণা বলছে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেছে ভারত বা ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থনে আওয়ামী লীগ 'যেনতেন উপায়ে' নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে আছে। তাদের ধারণা, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ টিকে আছে মূলত ভারতের সমর্থন ও সহায়তার কারণে। সবশেষ নির্বাচনে পশ্চিমা দেশগুলোর তৎপরতাকে যেভাবে উড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ তাতে বিএনপির এই ধারণা আরও শক্ত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দিয়েও আমেরিকা ও ইইউভুক্ত দেশগুলো যে শেষ পর্যন্ত কঠোর হয়নি, এখানেও রয়েছে ভারতের প্রভাব। বিএনপির এই ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছে একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্য, যেখানে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'গত নির্বাচনে ভারত বাংলাদেশের পাশে ছিল বলে বড় বড় দেশগুলো অশুভ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।’ হাছান মাহমুদ বলেছেন, 'নির্বাচন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ওই সময় ভারত আমাদের পাশে ছিল। ২০১৮ সালে নির্বাচনে ভারত আমাদের সঙ্গে ছিল। এবারও ভারত আমাদের পাশে ছিল ও আছে।’

বিএনপির বিশ্বাস আর মন্ত্রীদের বক্তব্য যখন কাছাকাছি, তখন দলটি এবার কামান দাগাচ্ছে ভারতের দিকেই। নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল করতে এখন সামনে এনেছে ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণা। প্রচারণায় সর্বশক্তি দেওয়ার এ প্রবণতায় মাঝে মাঝে ভ্রম হয়—ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বুঝি বাংলাদেশের ওপরই নির্ভরশীল! অথচ বাস্তবতা ঠিক উল্টো। ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থা আরও ভেঙে পড়ে।

বাজার ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিজের পরনের ভারতীয় পণ্য (চাদর) ছুড়ে ফেলে দিয়ে এরপর নেতাকর্মীদের মাধ্যমে আগুনে পুড়ানোর দুইদিন পর ২২ মার্চ ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'ভারতীয় পণ্য বয়কটের নামে বিএনপি বাজার ব্যবস্থা অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্র করছে।' তিনি বলেন, 'বিএনপি নেতার (রিজভী) শাল ফেলে দিয়ে ভারতীয় পণ্য বয়কটের প্রদর্শন করা পাগলামি। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একটি বড় অংশ আসে ভারত থেকে। বিএনপির এক নেতা (আব্দুল মঈন খান) গণতন্ত্র উদ্ধারে ভারতের সহযোগিতা চায়, আবার আরেক নেতা ভারতের পণ্য বয়কটের ডাক দেয়। আসলে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেরা দিশেহারা হয়ে গেছে।'

ভারত বর্জনের প্রচারণায় যখন সংহতি জানালেন রুহুল কবির রিজভী, এর দিন তিনেক পর কিন্তু বিএনপির ইফতার মাহফিলে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের কূটনীতিকরা। গত ২৪ মার্চ রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে কূটনীতিকদের সম্মানে বিএনপি যে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে তাতে অংশ নেন ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার ড. বিনয় জর্জসহ দেশটির দূতাবাসের আরও কয়েকজন। ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রিজভী ইফতার মাহফিলে না থাকলেও দল কিন্তু এখানে ভারতকে বর্জন করতে পারেনি।

দলের নীতিনির্ধারণীতে রুহুল কবির রিজভী যে অবস্থানেই থাকুন না কেন, তিনি দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব; এবং নিত্যকার সংবাদ সম্মেলনের বেশিরভাগ তিনিই করে থাকেন। তার হঠাৎ ভারত-বিদ্বেষ প্রকাশ্য হলেও এটা নিয়ে দলের মধ্যে যে আলোচনা হয়নি তা এর মধ্যেই প্রকাশিত। যদিও বিএনপির যাবতীয় সিদ্ধান্ত দেশে হয় না, লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নির্দেশনা আসে, এবং সে অনুযায়ী সেটা প্রকাশিত হয়। রিজভীর এই ভারতীয় পণ্য বর্জনে সংহতি প্রকাশ লন্ডন থেকে আসা সিদ্ধান্ত, নাকি রিজভীর একার তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে তার চাদর-নাটক যে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে দেশের রাজনীতিতে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভারত-বিরোধিতা এবং ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিষয়টি কেবল বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গত ১১ মার্চ বিষয়টি তুলেছেন মুশফিকুল ফজল আনসারী। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্বে থাকা মুশফিকুল ফজল আনসারী মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কাছে জানতে চান, ''মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, এই অঞ্চলে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ছে। একতরফা নির্বাচনের পর প্রতিবেশী ভারতে তৈরি পণ্য বর্জনকে উৎসাহিত করছে জনগণ। তাদের সন্দেহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এই পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?" জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, 'এই প্রচারণা সম্পর্কেও আমরা অবহিত। আমি অবশ্যই ভোক্তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না—সেটা বাংলাদেশ হোক বা বিশ্বের অন্য কোথাও। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ককে মূল্যায়ন করি। অবাধ, মুক্ত, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিশ্চিত করাসহ অভিন্ন স্বার্থে দুই দেশের সরকারের সঙ্গেই আমরা অব্যাহতভাবে কাজ করব।' এরপরই রুহুল কবির রিজভীর এই চাদর ছুড়ে ফেলা আর আগুন দেওয়ার ঘটনা। অর্থাৎ নির্বাচনকেন্দ্রিক এই ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচার-প্রচারণা, যেখানে আমাদের অতিপরিচিত 'দেশি পণ্য, কিনে হও ধন্য' স্লোগানের কোনো সম্পর্ক নেই; সব সম্পর্ক, সব বিরোধিতা মূলত রাজনৈতিক। রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়ালের চেষ্টা।

এই যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণা, এটা যদি দেশি পণ্যের প্রসারের উদ্দেশ্যে হতো, তাহলে সমস্যা ছিল না। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আওয়াজ তোলা হয়েছে, এবং সে অনুযায়ী প্রচার-প্রচারণা চলছে। এই প্রচার-প্রচারণা আবার লুফে নিয়েছে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কথা বলছেন, কথা বলছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, কথা বলছেন অন্য মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও। গতকাল বুধবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'বিএনপির এক নেতা (রুহুল কবির রিজভী) চাদর খুলে বলে দিয়েছেন, ভারতের পণ্য ব্যবহার করবেন না। যে নেতারা বলছেন ভারতীয় পণ্য বর্জন করেন, তাদের বউদের কয়খানা ভারতীয় শাড়ি আছে? তারা বউদের কাছ থেকে শাড়িগুলো এনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন? আমি বিএনপি নেতাদের বলব, তাদের বউরা যেন ভারতীয় শাড়ি না পরেন। যেদিন ওগুলো এনে অফিসের সামনে পোড়াবেন, সেদিন বিশ্বাস করব, আপনারা ভারতীয় পণ্য বর্জন করলেন।' আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আরেক বক্তব্যে বলেছেন, 'চিরাচরিত পাকিস্তানি কায়দায় ভারতের বিরোধিতা শুরু করেছে বিএনপি। তারা যখন কোনো রাজনৈতিক ইস্যু না পায়, তখনই এই একটা ইস্যু সামনে নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধুর আমলেও করেছে, এখন শেখ হাসিনার আমলেও তাই করছে।' বলা যায়, রুহুল কবির রিজভীর একটা চাদর কেবল চাদরই থাকল না, এটা রাজনৈতিক অঙ্গনে বাগযুদ্ধের এক প্রপঞ্চ হয়ে গেছে।

মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এভাবে কোনো দেশের পণ্য কি বর্জন করা সম্ভব? আমাদের দেশে কি সম্ভব ভারতের সব পণ্য বর্জনের? যে বিএনপি নেতারা বর্জনের পক্ষে তর্জন গর্জন করছেন তারা কি বাস্তবতা টের পান না? গায়ে থাকা ভারতীয় চাদর যেদিন খুলেছেন সেদিনই কি প্রমাণ হয়নি রুহুল কবির রিজভী ভারতের পণ্যের অন্যতম ভোক্তা? অন্য অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, সামান্য এক উদাহরণ দিলেও বলা যায়—যে সিএনজিচালিত অটোরিকশার দখলে রাজধানীসহ সারাদেশ, সে অটোরিকশাগুলোও আসে ভারত থেকে। ২০০২ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে এই সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়, এবং এর শুরুটা করে বিএনপি সরকারই। মোটরসাইকেলসহ অন্য অনেক যানবাহন, নিত্য ভোগ্যপণ্য, ব্যবহার্য পণ্যের অনেক কিছুতেই আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতাকে অস্বীকার করার উপায় নাই।

আমরা জানি, বিএনপিও জানে এসব; কিন্তু স্বীকার করছে না। নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল করতে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চায় ভারত-বিরোধী প্রচারণাকে। এটাকে কি বলা যায় 'অসারের তর্জন গর্জন সার'? কারণ রাজপথ আর রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতাহীনের গর্জনই বেশি শোনা যায়। বিএনপি এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ হয়ে আছে এই ভারতের পণ্য বর্জনের প্রচার-প্রচারণা বা তর্জন গর্জন দিয়ে।

তবু বলি, এই বাকযুদ্ধে সরকার ও সরকার দল আওয়ামী লীগের বিপুল অংশগ্রহণ জরুরি নয়। জরুরি নয় মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিক বাক্য খরচের। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত অন্তঃসারশূন্য যে প্রচার-প্রচারণা, সেখানে অংশ না নেওয়াটাই হতে পারে যথার্থ সিদ্ধান্ত।

;

সফুরের পুড়ে অঙ্গার হওয়া ও রাষ্ট্রের গভীর ‘ঘুম’



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশে অপঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা যেভাবে প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে, তাতে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি’ চাওয়া প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক নির্মল সেনের সেই আকাঙ্ক্ষা আজ যেন বিদ্রুপ করছে! আমরা কে যে কখন অপঘাতের এই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চলেছি তা বলা কঠিন!

রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহের দীর্ঘ ঔদাসীন্যে যখনই একেকটি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ছুটতে শুরু করে, তখনই তাদের কিঞ্চিৎ নিদ্রাভঙ্গ ঘটে। মিডিয়ার তৎপরতায় তাদের দৌঁড়ঝাঁপ কিছু সময় সমান্তরালে চলতে থাকে। ফের গভীর ঘুমে চলে যান তারা!

হতাশাজনক এই অবস্থায় উপনীত হয়ে প্রতিদিনই আমাদের অপেক্ষা করতে হয়, কোথায় কী ঘটতে চলেছে! সংবাদপত্রের অফিসগুলোতে অপঘাতের মৃত্যুর এই হরহামেশা ব্যাপারটি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কেবল সংখ্যা দিয়ে বিচার করা হয় ঘটনার ভয়াবহতা।

শুনতে খারাপ লাগলেও মানুষের প্রাণের মূল্য আজ এমনি মূল্যহীন হয়ে পড়েছে যে, নিত্যনতুন ঘটনার ডামাডোলে, আজকের ‘ক্রন্দনরোল’ দু’দিন বাদে কোথায় যে অপসৃত হয়ে যাচ্ছে, আমরা কেউ তার খোঁজ রাখি না। বাস্তবতা আমাদের এমন জায়গায় উপনীত করেছে যে, বর্তমানের এই সমাজকে ‘প্রাণহীন’, ‘মূল্যবোধহীন’ বললেও বোধহয় কম বলা হবে।

গেল সোমবার (২৫ মার্চ, ২০২৪) বিকেলে চট্টগ্রামের চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া কালঘর এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগুনে পুড়ে ছফুর নামের সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকের মৃত্যু পাষাণ হৃদয়কেও টলিয়ে দিয়েছে! এ দু’দিন ফেসবুকের পাতায় সফুরের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ছবিটি ঘুরে ফিরে আমাদের দংশন করেছে।

ফায়ার সার্ভিসের বরাতে ঘটনার বিবরণে যা জানা যাচ্ছে, হাইওয়ের গাছবাড়িয়া এলাকায় পুলিশ বালুবাহী একটি ডাম্প ট্রাককে থামার নির্দেশ দিলেও চালক নির্দেশ অমান্য করে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে থাকেন। বেপরোয়া গতির ট্রাকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে ধাক্কা দিলে অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতভাগ্য চালক নিজের সিটে বসেই নির্মম মৃত্যুকে বরণ করেন।

সফুরের মৃত্যুর শোক কেটে উঠতে না উঠতেই গতকাল (২৬ মার্চ, ২০২৪) একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যুর খবর পেলাম আমরা। খবরে প্রকাশ, মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় মঙ্গলবার ভোরে জুড়ীর পূর্ব গোয়ালবাড়ি গ্রামের মখলিছ মিয়ার বাড়িতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ওই পরিবারের ৫ জনের অপমৃত্যু ঘটে।

দুর্ঘটনা ঘটবে, এতে হতাহতও হবেন কেউ না কেউ; কিন্তু চারপাশে অপঘাতে এমন মৃত্যুর মিছিল যে রাষ্ট্রের বিভাগগুলোর ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনার কারণেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যদি পথ দুর্ঘটনার কথাই বলি, তবে বলতে হবে দেশের সড়কগুলো যেন মৃত্যুর ফাঁদ রচনা করে বসে আছে।

সড়কে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে কিন্তু তারও একটা মাত্রা আছে। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার, সংশ্লিষ্ট সবার আইন মানার প্রবণতা আর কর্তৃপক্ষের কঠোর তদারকির মাধ্যমে এই মাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। আমাদের সরকারের বিপুলসংখ্যক কর্মচারী জনগণের করের অর্থে নানা ‘প্রকল্প’ সংক্রান্তে (অভিজ্ঞতা লাভ, কেনাকাটা ইত্যাদি) বিদেশ ভ্রমণ করেন।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করে বিশ্বে যেসব দেশ রোলমডেল হয়েছে, সেসব দেশের অভিজ্ঞতা লাভে আমাদের ‘রাজ কর্মচারীরা’ বিদেশ সফর করেছেন কি না আমাদের জানা নেই, তবে নিশ্চয়ই করবার কথা। যদি এ ধরনের সফরে গিয়েই থাকেন তবে লব্ধ অভিজ্ঞতার কী কাজে লাগানো হয়েছে, তা আমরা জানতে চাই! সড়কে মৃত্যুর এই মিছিল বন্ধে আইনের প্রয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মনোবৃত্তির যে বিরাট পরিবর্তন করা জরুরি আর বাংলাদেশের যে বাস্তবতা তাতে সম্পূর্ণরূপে খোলনলচে বদলে ফেলার বিকল্প কী হতে পারে, তা আমাদের জানা নেই।

তবে যুৎসই একটি শব্দ প্রয়োগ করা যেতেই পারে। তা হচ্ছে, ‘আমূল পরিবর্তন’। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট নেতারা কিংবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট ‘রাজ কর্মচারীরা’ এই রকম পরিবর্তনের প্রয়াস আদৌ কি হতে দেবেন বা ইতোপূর্বে দিয়েছেন! এর সোজাসাপটা উত্তর- ‘না’।

সোশ্যাল মিডিয়ায় গেল দু’দিনের বিস্তর মুক্ত আলোচনায় কেবলমাত্র পরিবহন ও যোগাযোগ খাত নিয়ে নাগরিকেরা যত অভিমত তুলে ধরেছেন, তা বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। তবে যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার ও বর্তমান বাস্তবতা আমাদের কী পরিমাণ ঝুঁকিতে রাখে, তা নিয়ে কিছু মন্তব্য নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। অনেকের অভিমত, গাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাসভর্তি সিলিন্ডারগুলো একেকটি চলন্ত বোমা।

দেশের এই চলন্ত বোমা (মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা ব্যবহার অনুপযোগী) নিয়ে কতসংখ্যক যানবাহন নিত্যদিন চলছে তার হিসাব আমাদের জানা নেই। সড়কে গাড়ির কাগজপত্রের বৈধতা দেখতে যেভাবে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়, ঠিক তেমনি করে সিলিন্ডারের উপযোগিতা দেখার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষের এমন তদারকি চোখে পড়ে না।

কিন্তু বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলবেন। তবে আমরা স্বল্পজ্ঞানে এইটুকু বুঝতে পারি, এই জায়গাটিতে যথেষ্ট উদাসীনতা বিরাজমান এবং আমরা এও শুনি, তদারকি কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে ছাড়পত্র নিতে অসুবিধা হয় না। তার মানে সুশাসনের অভাব দুর্ঘটনা রোধের প্রতিটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিরুদ্ধেই করা যাবে।

আমরা জানি না, সড়কে নাগরিকদের মৃত্যুর এই মিছিল থামাতে রাষ্ট্র আদৌ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না কিংবা ‘কঠোরতর’ পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত কার্যকারিতার মুখ দেখবে কি না! তবে আপাতদৃষ্টিতে তার কোনো সুলক্ষণ চোখে পড়ছে না বিধায় আমাদের দীর্ঘশ্বাস হয়ত আরও দীর্ঘায়িতই হবে।

একইভাবে বলা যায়, অগ্নি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান গেল এক দশকেই আমরা জানতে পারছি, তাতে শিউরে না ওঠার কোনো উপায় নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের তোড়জোড়ে অগণন মানুষের প্রাণহানি ইতিহাসে লেখা হবে না।

সংশ্লিষ্টদের হেলায় বহু প্রাণ ঝরে যাওয়ায় দায়ীদের দায়মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্র হয়ত ক্ষমতাবানদেরই পাশে থাকবে। আর ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ টাইপের কিছু বচন আওড়ে রাজনীতির সরেস মানুষেরা ক্ষমতার মসনদে পালাবদল করবেন!

;

‘মুক্তিযুদ্ধ’র সমাপ্তি টানতে যে কাজ আজও বাকী



অঞ্জনা দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

এই বছরের মার্চের ২৫ তারিখে কাকতালীয় ভাবে মিলে গেল দোল পূর্ণিমা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সাধারণত দোলের দিনে রঙের খেলায় মেতে উঠেন । বোলপুরের শান্তিনিকেতন এই দিনে রঙে রঙে রঙিন হয়ে উঠে। তবে এখন দোল পূর্ণিমার কথা হবে না। শুধু মনে করিয়ে দিতে এসেছি ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাত দশটা থেকে ঢাকার রাস্তায় ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নেমেছিল বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে৷ সেই রাতে বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলেছিল বাংলাদেশের যেসব বড়ো বড়ো শহরে ক্যান্টনমেন্ট ছিল, সেইসব শহরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি রক্তপিপাসু সৈন্যরা। সেই বড়ো দুঃখের দিনের কিছু কথা বলতে এসেছি।

যতদিন বাঙালি জাতি স্মৃতিশক্তি হারাবে না, বিশেষ করে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, যেসব পরিবার স্বজন হারিয়েছেন, যেসব পরিবার থেকে তাঁদের মা-বোনদের এই হায়েনারা ধরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক নির্যাতন করেছিল... হত্যা করেছিল সেইসব পরিবার কোনোদিন ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত একটা দিনকেও ভুলতে পারবেন না। এইসব পরিবারের সদস্যরা ধুঁকে ধুঁকে বেঁচেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। এঁদের সাথে যুক্ত করুন এক কোটি শরণার্থীদের যাঁরা বাধ্য হয়েছিল দেশ ত্যাগ করতে এবং দেশের ভিতরেও কোটি কোটি মানুষ নিজ বাড়িতে থাকতে না পেরে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে বের হতে পারবেন।

পাকিস্তানিরা এই দেশের মুসলমানদের সাচ্চা মুসলমান ভাবত না। তারা এঁদের ভারতের দালাল ভাবত। ওরা আমাদের দেশের মুসলমানদের নিকৃষ্ট ভাবত, আরও একটি কারণে যে তাদের দৃষ্টিতে বাঙালি মুসলিমরা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছে। তাই তাদের এতটুকু কষ্ট হয়নি, খারাপ লাগেনি, পরকালের ভয় হয়নি পাখির মতো গুলি করে মারতে আমাদের ভাইদের, বাবাদের, আমাদের সন্তানদের। এক চুকনগরে কয়েকঘন্টায় দশ সহস্রাধিক বাঙালিকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছে এই জালিমরা।

তখন বিশ্বজুড়ে চলছিল সমাজতান্ত্রিক এবং ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই। তাই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পাশে দাঁড়ালো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন না থাকলে ভারত এতবড়ো ঝুঁকি নিত কি না সন্দেহ আছে। কেননা ঠিক ঐ সময়ে আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক পাতানোর কাজে দূতিয়ালি করছিল পাকিস্তান। চীন ছিল পাকিস্তানের মিত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কও ভালো ছিল। যদিও সাধারণ মার্কিন জনগণ এই জেনোসাইডের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। তাঁদের ছিল ভিয়েতনামের যুদ্ধের নির্মম অভিজ্ঞতা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন ভিয়েতনাম থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজছিল। মার্কিন প্রশাসনের কাজ ছিল তখন কোনো দেশের জনগণ শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে তাঁদের টুঁটি চেপে ধরত। না জানি এখানে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়ে যায়! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও মার্কিন সরকারের এই ভয় ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই বাঙালি মুসলমানদের স্বপ্ন ভঙ্গ হতে শুরু করেছিল। ১৯৪৭ সালের অল্প কিছু সময়ের পর থেকেই বাঙালিরা নানারকম অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিল। তার প্রথম রক্তঝরা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে দিয়ে। '৫২ এর হাত ধরেই আসে একাত্তর।

গভীর শ্রদ্ধা জানাই ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে যেসব নীরিহ বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলেন। সংসদ নির্বাচনে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও পাকিস্তানি জেনারেলরা বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তার বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আমরা জাতিসংঘ থেকে জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি। আরও ৫৩ বৎসর অপেক্ষা করতে হবে? অনেকেই আর্মেনিয়ার উদাহরণ দেখায় ওদের ওপর করা অটোমান সাম্রাজ্যের জেনোসাইডের স্বীকৃতি পেতে, তাও আংশিক, ১০০ বছর লেগেছিল। তাহলে কি আমাদের সেদিকে ঠেলে দিচ্ছে?

আপনারা সোচ্চার হন জাতিসংঘ কর্তৃক আমাদের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে। আমাদের মা-বোনদের ওপর যে নির্মম অত্যাচার করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, আমাদের ত্রিশ লক্ষ শহিদের হত্যা করেছিল, তাঁদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। ওঁরা আমাদের একটা স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। আর আমাদের কর্তব্য হলো যারা একাজ করেছিল তাদের বিচার করা। আর সেটি সম্ভব হবে যখন আমরা জেনোসাইডের স্বীকৃতি পাবো। তাই আসুন আজ থেকে গণহত্যা না বলে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে যা কিছু সংঘটিত করেছে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী, একে আমরা বলব জেনোসাইড। আর একটি কথা আপনাদের সন্তানদের, আপনাদের বংশধরদের বলে যান-কী ঘটেছিল ১৯৭১ সালে এই দেশে। কেননা জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের যুদ্ধে ওদের অংশগ্রহণের প্রয়োজন হবে। সেদিন হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

;

স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের এক অম্লান মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত। এটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচারী শাসনের অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কয়েক দশকের নিপীড়ন, প্রান্তিকতা এবং শোষণের চূড়ান্ত পরিণতি।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে বুঝতে হলে প্রথমেই এর জটিল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বোঝা আবশ্যক। প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একমাত্র ধর্মীয় পরিচয় ছাড়া পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আর কোনো বিষয়ে মিল ছিলনা। যাই হোক, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি এর দুই অংশের মধ্যে ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে বাঙালি জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ জন্ম নেয় ও অসন্তোষ দেখা দেয়।

শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দেয় ও শোষণ ব্যবস্থা কায়েম করে। তাদের সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে আচরণ করে এবং তাদের সম্পদ ও প্রতিনিধিত্বের ন্যায্য অংশ অস্বীকার করে। একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুকে আরোপ করা বাংলাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে আরও বিচ্ছিন্ন করে এবং ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক অধিকারের দাবিতে ক্ষোভ ও বিক্ষোভের জন্ম দেয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও মোহভঙ্গের মধ্যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা ও কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হন। গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ভাষাগত অধিকারের নীতির প্রতি তার অটল অঙ্গীকার বাঙালি জনগণের আকাঙ্ক্ষার সাথে গভীরভাবে অনুরণিত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাঁকে "বঙ্গবন্ধু" উপাধিতে ভূষিত করেছিল।

১৯৬০ এর দশক জুড়ে, বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার ও মর্যাদার জন্য নিরলস সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, একটি ফেডারেল ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন এবং প্রতিনিধিত্বের পক্ষে ছিলেন। যাই হোক, সামরিক ও স্বার্থান্বেষী পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারগুলো বাঙালি জনগণের ন্যায্য দাবির প্রতি উপেক্ষা দেখায় যা তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও ক্ষোভের অনুভূতি তীব্রতর করে।

পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে রাজনৈতিক আলোচনা ও সংলাপে জড়িত থাকার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা বাঙালি জনগণের দাবি মেনে নিতে অনড় এবং অনিচ্ছুক ছিলেন। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি, সম্পদের বৈষম্যমূলক বণ্টন এবং সামরিক শক্তির মাধ্যমে ভিন্নমতকে দমন করা বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে এবং অন্যায়ের বোধকে গভীরতর করে।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে টার্নিং পয়েন্ট আসে যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আওয়ামী লীগকে যে অপ্রতিরোধ্য ম্যান্ডেট দিয়েছিল তা ছিল স্বায়ত্তশাসন ও স্বশাসনের জন্য একটি সুস্পষ্ট ম্যান্ডেট, যেখানে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী, বাঙালি নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে নারাজ ছিলেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার জন্য বিলম্বিত কৌশল ও অপকৌশল অবলম্বন করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দেখা দেয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন ও সহিংসতার মুখে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে বাঙালি জনগণের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য সিদ্ধান্তমূলক অবস্থান নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে জনগণকে ঐক্য, প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার সংগ্রামের আহ্বান জানান।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে এবং ভিন্নমতের যে কোনো চিহ্নকে চূর্ণ করার জন্য অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি নৃশংস গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ এবং নৃশংসতা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ ও আতঙ্কের পথ রেখে যায়, যা বঙ্গবন্ধুকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা, প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে জাগিয়ে তুলেছিল এবং মুক্তির শিখা জ্বালিয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত একটি নতুন জাতির জন্মের দিকে পরিচালিত করে।

বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিছক প্রতীকী বিষয় ছিল না। এটি ছিল অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। এটি নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পথ প্রশস্ত করেছিল, যে সময়ে বাংলাদেশের জনগণ, মুক্তিবাহিনীর (মুক্তিযোদ্ধা) নেতৃত্বে, ভারতীয় যৌথ বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম পরিচালনা করে বিজয় ছিনিয়ে আনে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার এবং তার স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং জাতীয় ঐক্যের মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশীদের ধারাবাহিকভাবে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে যেমনটা ১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোতে ছিল।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অমর ঘটনা। এই ঘোষণা ছিল বাঙালিদের অধিকার, মর্যাদা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার এক সাহসী প্রকাশ। এই ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মই দেননি, বরং একটি নতুন জাতির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

এই ঘোষণা বাঙালিদেরকে একত্রিত করেছিল এবং তাদেরকে তাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই ঘোষণা ছিল একটি নতুন সূচনার প্রতীক, একটি নতুন যুগের সূচনা, যেখানে বাঙালিরা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারবে।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে, আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা কী অর্জন করেছি এবং আমাদের কী অর্জন করতে হবে। এই ঘোষণা আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকার এবং আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা সকলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানায়।

২৬ শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। এটি একটি স্মরণীয় দিন যা আমরা চিরকাল গর্বের সাথে উদযাপন করব। কয়েক দশকের নিপীড়ন ও শোষণের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার অটল সংকল্প, নিরলস নেতৃত্ব, অসীম ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রাম মুক্তির সূচনা করে জন্ম দিয়েছিল এক নতুন জাতির।

ন্যায়বিচার, সাম্য ও গণতন্ত্রের মূলনীতিতে বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার আদর্শের আলোয় আজও বাংলাদেশ তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

;