নড়াইল-২ আসনে উভয় পক্ষের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা



আহমেদ শরীফ শুভ
আহমেদ শরীফ শুভ, ছবি: বার্তা২৪.কম

আহমেদ শরীফ শুভ, ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

নড়াইল-২ আসনে ক্রিকেটার মাশরাফির নির্বাচন করার বিষয়টি এবারের সংসদ নির্বাচনে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এটা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা ও বিতর্ক এখন তুঙ্গে। সরকারি শিবির স্বাভাবিকভাবেই এটা নিয়ে উচ্ছ্বসিত আর বিরোধী শিবির নিরুত্তাপ। যারা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি দেখছেন তারা দলীয় লাইন অনুযায়ী মাশরাফির নির্বাচন করা নিয়ে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সে ধরণের অভিমত প্রত্যাশিত। তবে যারা সরাসরি কোনো দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন এবং সবকিছু দলীয় লাভ-ক্ষতির মাপকাঠিতে দেখেন না তাদেরও অনেকেই মাশরাফির এমন সিদ্ধান্তে স্বস্তি পাননি। এই অস্বস্তির পেছনে রাজনৈতিক কারণের চেয়ে মাশরাফির ভাবমূর্তি ও ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কার বিষয়টিই মূখ্য বলে মনে হয়।

নির্বাচনে গেলে মাশরাফির অবিসংবাদিত ভাবমূর্তি কতটুকু অক্ষুন্ন থাকে, নির্বাচনের প্রচারণা ও সংসদীয় কার্যক্রমের ব্যস্ততায় আসন্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউজিল্যান্ড সিরিজ এবং সর্বোপরি বিশ্বকাপে তার কর্তব্যনিষ্ঠা, অনুশীলন ও মনোসংযোগে নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়ে কি-না এসব নিয়ে তার ভক্তকুল অনেকটাই চিন্তিত। আমাদের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনে মাশরাফির মতো সজ্জন, কর্তব্যনিষ্ঠ ও দেশপ্রেমিক মানুষের প্রয়োজন অপরিসীম এটা যেমন সত্য, এ দেশের দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির ঘুণ অনেক সজ্জন ও দেশপ্রেমিক মানুষকেই উল্টো অধপতিত করে ফেলেছে কিংবা স্বেচ্ছা নির্বাচনে পাঠিয়েছে এটাও সত্য। এই প্রতিকূলতায় মাশরাফির মতো নির্বিবাদ আদর্শবাদী ও নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ কিভাবে অভিযোজন করবেন সেই প্রশ্নও থেকে যায়। মাশরাফির ভক্তকূল তথা দেশবাসীর একটি বিরাট অংশ তাই অনেকটাই দ্বিধান্বিত।

তারা মনে করেন, বিশ্বকাপের পর অবসর নিয়ে রাজনীতিতে এলেই মাশরাফি সবচেয়ে ভালো করতেন। তাতে তার ওপর অযাচিত চাপ অনেকটাই কমতো। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ এই মেয়াদে হাতছাড়া হয়ে গেলেও তিনি অন্য কোনো পদে থাকতেই পারতেন। এমনকি টেকনোক্র্যাট কোটায় তার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ তো থেকেই যেত।

তবে এই বিতর্ক এখন অনেকটাই অর্থহীন। বাস্তবতা হলো, মাশরাফি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। তিনি একজন সার্বভৌম মানুষ হিসেবে তার অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছেন। তিনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেছেন নির্বাচনের ডামাডোল, দলীয় আনুগত্য এবং সংসদীয় কার্যক্রম তার ক্যারিয়ারের বাকি দিনগুলোতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। হয়তো তিনি আদর্শিক আনুগত্যের জন্য তার সর্বজনপ্রিয়তা নিয়েও আপোস করতে প্রস্তুত। তিনি যেহেতু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাই ভক্ত ও দেশবাসী হিসেবে তার সিদ্ধান্তের প্রতি আমাদের এখন আস্থা রাখা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এখন একমাত্র প্রশ্ন, এই নিয়ে বিরোধী দল, জোট কিংবা তৃতীয় পক্ষের কোনো করণীয় আছে কিনা? বৃত্তের বাইরে এসে চিন্তা করলে দেখা যাবে, মাশরাফি আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করলেও এক্ষেত্রে বিরোধী দল ও জোটগুলোর একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

এ কথা বলাই বাহুল্য, আসন্ন নির্বাচনে মাশরাফির বিজয় সুনিশ্চিত। সরকারি দলের আনুকূল্য না পেলেও তিনি বিজয়ী হবেন। আর যদি তিনি পরাজিতও হন (যা প্রায় অসম্ভব) তাতেও নির্বাচনের সামগ্রিক ফলাফলের ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করবে না। অর্থাৎ এবারের নির্বাচনে অন্তত এক আসনে সরকারের জয়-পরাজয় নির্ভর করবে না। এই বাস্তবতার বিবেচনায় মাশরাফির আসনে (নড়াইল-২) বিরোধী দল ও জোটগুলো কোনো প্রার্থী না দিয়ে একটি চমক দিতে পারেন। এমনিতেই মাশরাফির বিজয় অবধারিত, এই আসনে প্রার্থী না দিলে বিরোধী দল ও জোটগুলোর তেমন কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাতে বরং সেই দল ও জোটগুলোর এবং সামগ্রিক রাজনীতি লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

মাশরাফির যদিও একটি নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে এবং তিনি একটি রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে নির্বাচন করছেন, তাতে তিনি যে একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক, কর্তব্যনিষ্ঠ, সহজাত নেতৃত্বের গুণাবলীতে ভাস্বর এবং আপাদমস্তুক সজ্জন- এই সত্যটির ব্যত্যয় ঘটেনি। একটি দলের ব্যানারে নির্বাচন করলেও তিনি আসলে আমাদের সবার মাশরাফি। তার বিরুদ্ধে প্রার্থী না দিলে এবং তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে তাকে আমরা সবাই ক্লেইম করতে পারবো। তিনি আওয়ামী লীগের ব্যানারে থাকলেও আমাদের সবার মাশরাফি হয়েই থাকতে পারবেন। আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে কাদা ছোড়াছুড়ির বাইরে থাকতে পারা এক রকম অসম্ভবই বলা চলে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে অন্ততঃ মাশরাফিকে নিয়ে তেমন কাদা ছোড়াছুড়ির সম্ভাবনা থাকবে না। তাকে নির্বাচনী প্রচারণায় মনোনিবেশ করতে না হলে তাহলে তিনি অখণ্ড মনোযোগ নিয়ে আসন্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউজিল্যান্ড সিরিজ এবং সর্বোপরি বিশ্বকাপের অনুশীলন ও অধিনায়কত্বের দিকে নজর দিতে পারবেন। গত ১৭ বছরে মাশরাফি নিজের শরীরের ওপর নজিরবিহীন ঝুঁকি নিয়ে আমাদের অনেক আনন্দের মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন। আমাদের কাছে এতটুকু সম্মান ও ভালোবাসা তার প্রাপ্য হতেই পারে।

কেউ কেউ ভাবতে পারেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন একটি আসন ছেড়ে দেওয়া বিরোধী দলের কাছে অনেক বেশি চাওয়া হয়ে যাবে। বিষয়টি মোটেও তা নয়। এই ছাড় দেওয়া থেকে বিরোধী দল ও জোটগুলোর অনেক কিছু পাওয়ার আছে। মাশরাফির বিরুদ্ধে কোনো প্রার্থী না দিয়ে বিরোধী দল ও জোটগুলো নিজেদের সদ্ভাব ও শুভেচ্ছার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে যা ভবিষ্যতে ইতিবাচক রাজনীতির একটি মাইলফলক হবে। তা ছাড়া তাতে বিরোধী দলের অন্তত একটি আসনের প্রচারণার জন্য অর্থ ও লোকবলের সাশ্রয় হবে। যেহেতু এই আসনটি এমনিতেও তাদের পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, এই সাশ্রয়টুকুও কম কিছু নয়।

মাশরাফিকে মনোনয়ন দেওয়া নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের একটি বড়সড় পয়েন্ট স্কোরিং। আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনের আগেই নড়াইল-২ আসনে ১০ পয়েন্ট স্কোর করে তবে বিরোধী দল ও জোটগুলোর সেখানে কোনো প্রার্থী না দিয়ে অন্তত ২ পয়েন্ট হলেও স্কোর করার সুযোগ এসেছে। একদল যেহেতু রংয়ের টেক্কা দিয়ে ট্রাম্প করেই ফেলেছে অন্য পক্ষের তখন আর সেখানে ওভার ট্রাম্পের সুযোগ নেই। তারা বরং সেখানে একটা কার্ড ফাঁসিয়ে দিয়ে পরবর্তী ট্রাম্পের অপেক্ষা করতে পারে। নড়াইল-২ আসনে মাশরাফি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে সরকার ও বিরোধী দল উভয়েই বিজয়ী হবে। বিজয়ী হবে ইতিবাচক রাজনীতি। বিরোধী দল তাকে এই সম্মানটুকু দিলে তারা নিজেরাই সম্মানিত হবে আর মাশরাফিরও নিশ্চয়ই তা মনে থাকবে। আগামী দিনে দুই শিবিরের দূতিয়ালীতেও তা একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে। নিতান্ত দলান্ধ ছাড়া অন্য সবাই বিরোধী দল ও জোটগুলোর এই সিদ্ধান্তকে শুভেচ্ছা আর সদ্ভাবের স্মারক হিসেবেই দেখবে।

আহমেদ শরীফ শুভ: মেলবোর্ণ প্রবাসী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান, সমাজকর্মী ও ফ্রিল্যান্স কলাম লেখক

   

পুতিন যুগের দীর্ঘসূত্রিতায় আধিপত্য হারাতে পারে পশ্চিম



আসমা ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

করোনা মহামারির পর বিশ্ব অর্থনীতিতে আরও বিপর্যয় ডেকে এনেছিলো রাশিয়া- ইউক্রেন সংঘাত। দুই বছর পার হয়ে তৃতীয় বর্ষে পা দেওয়া এ সংকটের একদিকে ইউক্রেন ও তার পশ্চিমা মিত্ররা, আরেকদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলা এই যুদ্ধ বন্ধে নিষেধাজ্ঞা, সমালোচনা কোনো কিছুতেই কর্ণপাত না করা পুতিন ভূমিধস জয়ের মাধ্যমে পঞ্চমবারের মতো রাশিয়ার ক্ষমতায় এসেছেন। ধারণা করা হচ্ছে পুতিন একাই পাল্টে দিতে পারেন বিশ্বের ভবিষ্যৎ।

নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবারও ক্ষমতায় আসীন ভ্লাদিমির পুতিনের বেশিরভাগ সমালোচকই কারাগারে বন্দি অথবা রহস্যজনক মৃত্যুর স্বীকার। শুধু নিজ দেশেরই নয়; এ নির্বাচনে জয়লাভ এবং রাশিয়ার শাসনে পুতিনের দীর্ঘসূত্রিতা মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে বিশ্ব পরাশক্তিরও। এক্ষেত্রে পশ্চিমারা এবং তাদের সামরিক ও আঞ্চলিক সংগঠনসমূহ ভুগতে পারে নানাবিধ নিরাপত্তা ঝুঁকি কিংবা আধিপত্যহীনতায়। অন্যদিকে চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বেশ কিছু দেশ এগিয়ে আসতে পারে ক্ষমতাযুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে।

পুতিনের হাতে যত সমীকরণ 

সারাবিশ্বের এমন সংঘাত উদ্বেগের মধ্যে ক্রমেই আরও পরাক্রমশালী হয়ে চলেছে পুতিন। বিশ্বের বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক পরিসরে বিরাট রকমের মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারে-এমন অনেক সমীকরণই রয়েছে পুতিনের হাতে। পুতিন বিশ্ব ব্যবস্থায় যেসব মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ক্ষমতার রদবদল এবং প্রাচ্যের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। 

পুতিন প্রভাব টিকিয়ে রাখতে যেসব কৌশল বেশি কার্যকরী ছিল তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ২০২৩ সালের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মস্কো সফর, এবং নিরাপত্তা, শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং বাণিজ্য নিয়ে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে এক ডজন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক নির্ভরতা বাড়ে, পশ্চিমবিরোধী বলয় শক্তিশালী হতে শুরু করে। তাই পুতিনের আবারও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুফল বেশি ভোগ করতে পারে চীন। শুধু পরাশক্তিধর দেশ নয়, পুতিন কৌশলে অপেক্ষাকৃত ছোট দেশগুলোতেও বাড়ছে পুতিনের সমর্থন। সেসব সুযোগ কাজে লাগাতে পারে পুতিন। পুতিনের দীর্ঘসময়ের ক্ষমতা যেসব ক্ষেত্রে প্রভাব রাখতে পারে সেসব বিষয়গুলো হলো:

নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থতা বাড়বে পশ্চিমাদের

চলমান রাশিয়া ইউক্রেন সংঘাতে ন্যাটোর মতো সংগঠনের দুর্বল ভূমিকা ক্রমান্বয়ে আরও দুর্বল হয়েছে। ইউক্রেনে গোলাবারুদ সরবরাহ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপীয় মিত্ররা। যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচন ও রাজনীতির জটিল সমীকরণে তিন-চার মাস ধরে ইউক্রেনে সহায়তা আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের মতো অস্ত্র এবং অত্যাধুনিক এমজিএম-১৪০ আর্মি ট্যাকটিক্যাল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা (এডিএসিএমএস) এখনও হাতে পায়নি ইউক্রেন। জার্মানি টাউরুস ক্ষেপণাস্ত্র দেবে কি না, তাও অনিশ্চিত। ইউরোপীয় মিত্রদের মাঝেও আগের মতো দৃঢ় ঐক্য দেখা যচ্ছে না। ন্যাটো এবং ইইউ এর ব্যর্থতার সুযোগে আরও পরাক্রমশালী হয়ে উঠবে রাশিয়া।

এদিকে ইউক্রেনকে সহায়তা প্রদানে অপারগতার সাথে সাথে তীব্র হচ্ছে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির দীর্ঘসূত্রিতা। যুক্তরাষ্ট্র একদিকে বলছে ফিলিস্তিনের গণহত্যা বন্ধ করতে হবে, অন্যদিকে ইসরায়েলকে দিচ্ছে সামরিক ও কুটনৈতিক সাহায্য। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে বারবার হুশিয়ারি দেওয়া ছাড়া আর তেমন জোরদার কিছু করতে পারছেনা বাইডেন প্রশাসন। ইসরায়েল-হামাস ইস্যুতে ক্রমেই শক্তি হারাচ্ছে পশ্চিমারা,বাড়ছে পশ্চিমাবিরোধী জনমত। আর্থিক সহায়তা প্রদানে পরাশক্তি দেশগুলোর অপারগতা, শক্তিবলয় কাজে লাগিয়েও কোনো সংঘাতের মীমাংসা করতে না পারার ব্যর্থতাসহ আরও অনেক পরাজয় যুক্ত হচ্ছে পশ্চিমাদের ঝুলিতে।

ন্যাটোর ব্যর্থতায় এখন উল্টো দিকে ঘুরেছে পশ্চিমা পরিকল্পনা। বাল্টিক অঞ্চলসহ পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, রুমানিয়ার মতো দেশগুলো রুশ আক্রমণের ভয়ে রয়েছে। শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনে পুতিনের জয় তাদের সেই ভীতিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পশ্চিমাদের আধিপত্য কমবে

পিউ ইন্টারন্যাশনালের এক গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ  অর্থনীতি ও নিরাপত্তার কারণে চীনকে হুমকি মনে করছেন, যেখানে রাশিয়ার প্রতি এমন মনোভাব রাখেন মাত্র ১৭ শতাংশ। কিন্তু সেই রাশিয়ার সাথেই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে চীনের। 

পশ্চিমারা যখন রাশিয়াকে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, চীনের সাথে তখন থেকেই বাড়তে থাকে অর্থনৈতিক সংযোগ। চীনের সাথে বিভিন্নভাবে যুক্ত থাকার ফলে দুই দেশের সম্পর্কও অনেক মজবুত। তাই পুতিনপন্থি চীন ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আধিপত্য নিতে পশ্চিমাদের থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকবে। চীন ইতিমধ্যেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভিন্ন দেশগুলোকে বাণিজ্যিক সুবিধা এবং আর্থিক ঋণ সুবিধা দিয়ে বন্ধত্বপূর্ণ সম্পর্ক মজবুত করেছে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং আঞ্চলিক সংগঠনের আওতায় অনেক দেশের অর্থনীতির চাকাই এখন চীনের নিয়ন্ত্রণে। রাশিয়ার ক্ষমতায় পুতিন থাকা মানে ইউক্রেন ইস্যুতে ধরাশায়ী থাকবে পশ্চিমারা। এদিকে অর্থনীতি,বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং আধিপত্য বিস্তারে এগিয়ে যাবে পুতিনপন্থিরা।

পশ্চিমা বিশ্বের তাত্ত্বিকরা চিন্তিত ইউক্রেনের পুতিনের জয়ের পরের সম্ভাব্য বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে। নিরাপত্তা, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা ইস্যুতে তারা মনে করছেন, ইউক্রেনে পুতিনের জয়ের অর্থ হলো ভারত প্রশান্ত মহাসাগীয় এলাকা, প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা, দক্ষিণ চীন সাগরসহ বিস্তীর্ণ জলসীমায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধির ঘটনা আরও জোরালো হবে।

তাইওয়ান ইস্যুতেও ধাক্কা খেতে পারে পশ্চিমারা

সম্প্রতি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদল ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) প্রার্থী লাই চিং-তে। ডিপিপির সাথে সাথে  যুক্তরাষ্ট্রও  তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে আসছে, করছে বাণিজ্যিক ও সামরিক সহায়তাও। 

অন্যদিকে পুতিনপন্থি চীন তাইওয়ানকে নিজের ভূখন্ডের অংশ মনে করে অনেক আগ থেকেই। তাইওয়ান বিষয়ে চীনের এ দাবি নতুন কিছু নয়। বরং শি জিনপিং এই একত্রীকরণের বিষয়টিকে বর্তমানে একটি লক্ষ্যে পরিণত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র  চায় তাইওয়ানের স্বাধীনতা আর চীন চায় তাইওয়ানকে নিজ ভূখণ্ড করতে। তাইওয়ানের সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক না তা থাকলেও দেশটিকে লাগাতার সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর একটি নথিতে বলা হয়, ২০২৭ সালে তাইওয়ানকে মূল ভূখন্ডের সঙ্গে একত্রীকরণ করতে পারে চীন। এই ধারণা মিলে গেলে ইউক্রেনের মতো পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে তাইওয়ানকেও। সেক্ষেত্রে তাইওয়ানেও যুক্তরাষ্ট্র অপারগতা প্রকাশ পেতে পারে।

এমনিতেই করোনাকালীন সংকট নিয়ে ক্ষোভ এবং সন্দেহ, বাণিজ্য যুদ্ধ, হুয়াওয়ে নিয়ে তদন্ত, পরস্পরের কনস্যুলেট বন্ধ করে দেওয়া, সাংবাদিক বহিষ্কারসহ নানাবিধ ঘটনা নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তাইওয়ান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের এমন হস্তক্ষেপ সম্পর্কের তিক্ততা আরও বাড়াবে। তাই তাইওয়ান ইস্যুতে ক্ষমতা প্রদর্শন ও মিত্রদের নিরাপত্তা রক্ষায় আবারও চীন-রাশিয়ার কাছে ধাক্কা খেতে পারে পশ্চিমারা। 

এশিয়া ও আফ্রিকার ছোট দেশগুলোতেও পুতিন সমর্থন তুঙ্গে

যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিংকট্যাক চ্যাথাম হাউজের ‘আফ্রিকা কর্মসূচি’র পরিচালক ড. অ্যালেক্স ভিনেস মনে করেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের মধ্যে গোটা বিশ্বের শক্তির পুনর্বিন্যাস ঘটে গেছে। তিনি বলেন, ‘এই পরিবর্তন আফ্রিকা জুড়ে বেশি দেখা গেছে। ইউক্রেনে হামলার জন্য রাশিয়ার নিন্দা করে জাতিসংঘে আনা প্রস্তুাবগুলোয় অংশ নেয়নি মহাদেশটির ৫১ শতাংশ দেশ; অথচ স্নায়ুযুদ্ধের আগে এর বিপরীত প্রবণতা দেখা যেত অঞ্চলটিতে।’

রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট মোকাবিলায় এশিয়া ও আফ্রিকার ছোট দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়েছিল রাশিয়া। ২০২৩ সালের রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের সেই রাশিয়া-আফ্রিকা সম্মেলন পুতিনকে সুবিধাজনক অবস্থান দিয়েছিল। এ সম্মেলন ঘিরে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা চাপে থাকা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আফ্রিকার দেশগুলোর সমর্থন ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। আফ্রিকার ছয়টি দরিদ্র দেশকে বিনা মূল্যে খাদ্যশস্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পুতিন। বুরকিনা ফাসো, জিম্বাবুয়ে, মালি, সোমালিয়া, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ও ইরিত্রিয়ায় ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টন খাদ্যশস্য বিনা মূল্যে সরবরাহ করে রাশিয়া। এভাবে এক বছরের বেশি সময় ধরে ইউক্রেনের বন্দরগুলো থেকে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ টন শস্য রপ্তানি করে দেশটি। বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার ক্ষতি এড়াতে ছোট দেশগুলোর সমর্থনও কার্যকর ভূমিকা রেখেছে পুতিনের জন্য। 

এছাড়াও ইসরায়েল-হামাস ইস্যুতেও জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার মামলা করতে দেখা গেছে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতের বিপক্ষে গিয়ে অবস্থান নিয়েছে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে। পশ্চিমারা এশিয়া এবং আফ্রিকার ছোট দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ যে হারিয়েছে এবং তা যে ক্রমান্বয়ে আরও বাড়বে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আরও শক্তিশালী হবে উত্তর কোরিয়া

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সাথে অধিকাংশ দেশের বিচ্ছিন্নতা বাড়লেও উত্তর কোরিয়ার কাছে দেশটির মূল্য ক্রমশ বাড়তে দেখা যাচ্ছে।  রাশিয়া-ইউক্রেন আগ্রাসন শুরুর পর উত্তর কোরিয়া প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছে মস্কোকে। ‘কৌশলগত সহযোগিতার' মাধ্যমে আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে উত্তর কোরিয়া এবং রাশিয়ার সম্পর্ক।

ভ্লাদিভোস্তকের ফার ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আর্তিওম লুকিন সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন, 'ইউক্রেনে মস্কোর বিশেষ সামরিক অভিযান একটি নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সূচনা করেছে, যেখানে ক্রেমলিন এবং উত্তর কোরিয়া ক্রমবর্ধমানভাবে ঘনিষ্ঠ হতে পারে।’

রাশিয়ায় গতবছর জুলাই থেকে ৬ হাজার ৭০০ কন্টেইনার ভর্তি লাখ লাখ গোলা পাঠিয়েছে উত্তর কোরিয়া। 'যুক্তরাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ ও হুমকির' বিরুদ্ধে পুতিনের পাশে থেকে নিজেও সমৃদ্ধ হচ্ছে কিম। ফলে শক্তিমত্তা বাড়া এবং পশ্চিমাবিরোধী আরও আগ্রাসী হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কোরীয় উপদ্বীপে দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের মতো এশীয় মিত্ররাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে; কারণ উত্তর কোরিয়ার মতো পরমাণু শক্তিধর সেখানে লাগাতার অস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে; অর্থাৎ ওই ধরনের কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে বাস্তবিক অর্থে পশ্চিমাদের অবস্থান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অবস্থায় যাবে।

ভারতের সাথে পশ্চিমা সম্পর্কের মোড় ঘুরতে পারে

ভারত ইতিমধ্যেই কানাডার শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যার ঘটনায় কানাডার সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। তার কিছুদিন পর যুক্তরাষ্ট্রও তাদের নাগরিক অপর এক শিখ নেতা হত্যার অভিযোগ তোলে ভারতের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় পশ্চিমাদের দাপট ভেঙে ভারতকে দেখা গিয়েছে খুবই আক্রমণাত্মক ভূমিকায়। এসব সংকটে  ভারতকে একরকম সমীহ করতেই দেখা গেছে পশ্চিমাদের। সরাসরি কানাডাকে সমর্থন দেওয়া থেকে বিরত ছিল কানাডার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে। অন্যদিকে কানাডার যেকোনো পদক্ষেপকে ভেস্তে দেওয়ার ক্ষমতা দেখিয়েছে ভারত।

এছাড়াও এই বছরই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে গিয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে সমর্থন জানায় ভারত। ভারতের সাম্প্রতিক বিভিন্ন আচরণ এবং রুশ বাণিজ্যের নতুন গন্তব্য হওয়ার ঘটনা পাল্টে দিতে পারে ভারত-পশ্চিমা সম্পর্কও। এক্ষেত্রে বাণিজ্য, কুটনীতি, আধিপত্যের প্রতিযোগিতায় রাশিয়া এবং চীনের সাথে সম্পৃক্ততা আরও বাড়তে পারে দেশটির। 

;

জনগণের শেখ মুজিব!



মাহবুব আলম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

একাত্তর সাল। চারদিকে বিক্ষুব্ধ ও আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে তখন। ১৭ মার্চ কয়েকজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে আসেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, 'আমি জন্মদিন পালন করি না। আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালাই না, কেকও কাটি না। এদেশে সাধারণ মানুষের জীবনেরই নিরাপত্তা নাই। আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কী আর মৃত্যুদিনই কী! আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু।'

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গোটা জীবনটাই ছিল সংগ্রামমুখর। স্বাধীনতার আগে তার বহু জন্মদিনই কেটেছে কারাগারের নির্জন কক্ষে, যেখানে ছিল না স্বজনের সাহচর্য, না ছিল জন্মদিনে ভালো-মন্দ খাবারের আয়োজন। বঙ্গবন্ধু কোনোবারই নিজের জন্মদিন আড়ম্বরের সঙ্গে উদযাপন করতেন না।

নিজের ৪৭তম জন্মবার্ষিকী কেটেছে কারাগারের প্রকোষ্ঠে। সেখানে বসে তাঁর লেখা 'কারাগারের রোজনামচা'য় তিনি লিখেছেন, 'আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্টপল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই- বেশি হলে আমার স্ত্রী দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মদিন পালন করছে। বোধহয়, আমি জেলে বন্দী আছি বলেই।'

''আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস'— দেখে হাসলাম। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নূরে আলম- আমার সঙ্গে ২০ সেলে থাকে, কয়েকটা ফুল নিয়ে ঘরে এসে উপস্থিত। আমাকে বলল, এই আমার উপহার, আপনার জন্মদিনে। আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম। তারপর বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার একটা রক্তগোলাপ এবং বাবু সুধাংশু বিমল দত্তও একটি শাদা গোলাপ এবং ডিপিআর বন্দি এমদাদুল্লা সাহেব একটা লাল ডালিয়া আমাকে উপহার দিলেন,'' লিখেছেন বঙ্গবন্ধু। (সূত্র: কারাগারের রোজনামচা)।

বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের ৪ হাজার ৬শ ৮২ দিন কারাগারে কাটিয়েছেন। সময়ের হিসাবে তা প্রায় ১৩ বছর। বঙ্গবন্ধুর ঠিক কতগুলো জন্মদিন কারাগারে কাটিয়েছিলেন, তা জানা নেই। তবে ১৯৬৭ সালের জন্মদিনটি যে তিনি কারাগারে কাটিয়েছিলেন, তা তার ডায়েরির পাতাতেই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। আর কারাগারে থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন কেমনভাবে কাটতো তার বর্ণনা পাওয়া যায় 'কারাগারের রোজনামচায়'।

১৯৬৭ সালে জন্মদিনে কারাগারে বসে লেখা ডায়েরির শেষাংশে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, 'তখন বেলা সাড়ে চারটা বেজে গিয়েছে, বুঝলাম আজ বোধ হয় রেণু ও ছেলে-মেয়েরা দেখা করার অনুমতি পায় নাই। পাঁচটাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন, চলুন আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলে-মেয়েরা এসেছে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওয়ানা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিল। ওকে নিয়ে আমি ঢুকলাম রুমে। ছেলে-মেয়েদের চুমা দিলাম। দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়াছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেল গেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো।'

' …ছয়টা বেজে গিয়াছে, তাড়াতাড়ি রেণুকে ও ছেলে-মেয়েদের বিদায় দিতে হলো। রাসেলও বুঝতে আরম্ভ করেছে, এখন আর আমাকে নিয়ে যেতে চায় না। আমার ছোট্ট মেয়েটা খুব ব্যথা পায় আমাকে ছেড়ে যেতে, ওর মুখ দেখে বুঝতে পারি। ব্যথা আমিও পাই, কিন্তু উপায় নাই। রেণুও বড় চাপা, মুখে কিছুই প্রকাশ করে না। ফিরে এলাম আমার আস্তানায়। ঘরে ঢুকলাম, তালা বন্ধ হয়ে গেল বাইরে থেকে। ভোর বেলা খুলবে।'

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির কাছে একটা চেতনার নাম। একটা আদর্শের নাম। একটা শক্তির নাম। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া ‘খোকা’ একাত্তরের ৭ মার্চে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দেন।

তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেই শক্তি-আদর্শ ধারণ করে মরণপণ যুদ্ধে যায় আপামর বাঙালি। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থেকেও আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার কাছে শক্তিরূপে অবতীর্ণ হন তিনি। তাঁর দেশপ্রেমের সুমহান চেতনায় মুক্ত করে বাংলাদেশকে। আর এখন তাঁরই চেতনায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাঙলা গড়ে প্রত্যয় নিয়ে দিনরাত কাজ করে চলেছেন তাঁরই মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত জন্মভূমিকে সমৃদ্ধ 'সোনার বাংলা'য় রূপান্তরের উদ্যোগ নেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে। কিন্তু তিনি তা সম্পন্ন করে যেতে পারেননি কতিপয় নিকৃষ্ট মানুষের জন্য। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, শহিদের রক্ত বৃথা যায়নি। সত্যি-ই শহিদের রক্ত বৃথা যায়নি। তারই মেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল।

প্রতিবছর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন অর্থাৎ ১৭ মার্চ দেশে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হয়ে থাকে। তিনি শিশুদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। ওইদিনটিতে তিনি আনুষ্ঠানিক জন্মদিন হিসেবে উদযাপন না করে শিশুদের নিয়ে আনন্দঘন সময় কাটাতেন। বাংলাদেশে শিশুর কল্যাণ ও উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট চারটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

এক, শিশু কল্যাণের জন্য মায়েদের সম্পৃক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মা ও শিশুকল্যাণ অধিদপ্তর’। দুই, শিশুর সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘শিশু একাডেমি’। উল্লেখ্য, এ দুটো প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ভাবনা-পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর সব সময়ই ছিল। তিন, শিশুর শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। বাংলাদেশের সে সময়ের সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্তটি ছিল সাহসী ও যুগান্তকারী। চার, ১৯৭৪-এর ২২ জুন শিশু আইন জারি করা হয়। এ আইন শিশু অধিকারের রক্ষাকবচ।

বিশাল হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধু ছিলেন শিশুর মতো সরল। তার এই সারল্যকে কাজে লাগিয়েছে ঘাতকচক্র। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটিশ এমপি জেমস ল্যামন্ড-এর খেদোক্তি ছিল এমন- ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী একজন মহান সন্তানকে হারিয়েছে!’

বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই! তাঁর আদর্শ রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় চেতনা ও আদর্শে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাঙালিকে আর ‘দাবায়া’ রাখতে পারবে না কেউ-ই!

লেখক: সংবাদকর্মী। ই-মেইল: [email protected]

;

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: বাংলার আলোকবর্তিকা



ড. মতিউর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসের পথ ধরে, বিরল ব্যক্তিদের আবির্ভাব ঘটে যাদের উত্তরাধিকার সময়ের পরিক্রমা ছাড়িয়ে, জাতির সম্মিলিত চেতনায় অমলিন ছাপ রেখে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে এমনই এক আলোকবর্তিকা। জাতির প্রতিষ্ঠাতা নেতা হিসেবে, তাঁর জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গি স্বাধীনতা ও স্থিতিস্থাপকতার চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে যা বাঙালির চিরন্তন বৈশিষ্ট্য।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, ব্রিটিশ শাসিত বাংলার টুঙ্গিপাড়া নামক একটি ছোট্ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পরবর্তীতে তার জনগণের জন্য আশা ও মুক্তির প্রতীক হয়ে ওঠেন। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছিল ভূমি, জনগণ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রামের পরিবেশে। ছাত্রজীবনেই তার রাজনৈতিক জাগরণ ঘটে এবং তিনি অবিভক্ত ভারতের অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ শুরু করেন।

বাংলাদেশ যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন শেখ মুজিবুর রহমান একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়বিচারের সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাংলার গরীব, দুঃখী, কৃষক ও শ্রমিকদের অধিকারের জন্য তার লড়াই, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতি অঙ্গীকার, বাঙালির ভাগ্যকে গঠন করবে এমন একটি রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ উপমহাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়। এই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম এবং পরাধীনতা মেনে নেওয়ার অস্বীকৃতি এক উত্তাল সময়ের সূচনা করে, যেখানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা প্রত্যাশী জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হন।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণ হিসাবে চিহ্নিত। তীব্র উত্তেজনার সেই মুহূর্তে, লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে তিনি তাঁর কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুধু একটি রাজনৈতিক বক্তৃতা ছিল না, এটি ছিল একটি জাতির আত্মার অভিব্যক্তি।

তাঁর ভাষণে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এই ভাষণে স্পষ্টভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা না দেওয়া হলেও, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম" এই বাক্যটি ব্যবহার করেছিলেন। এটি ছিল বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতার স্পষ্ট ইঙ্গিত।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভিত্তি স্থাপন করে। তার আবেগপ্রবণ আবেদন, ঐক্য ও প্রতিরোধের আহ্বান, এবং স্বাধীনতার স্পষ্ট ইঙ্গিত বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করে তাদের ভাগ্য নিজেদের হাতে তুলে নিতে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ কেবল বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, বিশ্বের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসেও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবরে ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে "ডকুমেন্টারি হেরিটেজ" (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুধু একটি ভাষণ ছিল না, এটি ছিল একটি জাতির মুক্তিকামনার প্রতীক। এই ভাষণ বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর নির্মম হামলা চালিয়ে গণহত্যার সূচনা করে। এই হামলায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তার হবার একটু আগে ২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর (২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে) তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন।

কারাগারে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন। তাঁর অদম্য সাহস ও দৃঢ় বিশ্বাস বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা যোগায়। মুক্তিযুদ্ধে ৯ মাস ধরে বাঙালি জাতি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অদম্য সাহস, দৃঢ় বিশ্বাস ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে ত্রিশ লক্ষ শহিদের জীবন উতসর্গ, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, জাতি গঠন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কঠিন কাজের সূচনা করে এই প্রত্যাবর্তন।

দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। অবকাঠামো ধ্বংস, অর্থনীতি বিধ্বস্ত, এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত। দেশে ছিল আইনশৃঙ্খলার অভাব, সামাজিক অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। খাদ্য, পানি, বস্ত্র, ওষুধ - প্রাথমিক চাহিদা পূরণের জন্যও লড়াই করতে হচ্ছিল।

প্রতিকূলতার মুখেও বঙ্গবন্ধু হতাশ হননি। তিনি দৃঢ় সংকল্পের সাথে দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন।

বঙ্গবন্ধু জাতির জনক হিসেবে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির উপর গুরুত্বারোপ করেন। দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষার প্রসার, কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল ও স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতির প্রতীক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধু একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ”সোনার বাংলা ” গঠনে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

১৯৭২ সালে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধান কেবল একটি আইনি নথি নয়, এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের প্রতিফলন। একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক এবং সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে তিনি এই সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন যে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ ও অধিকার থাকা উচিত। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির ওপর ভিত্তি করে তিনি এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যেখানে সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন যে বাংলাদেশের বৈচিত্র্যই এর শক্তি। তিনি সব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেন।

বাংলাদেশের সংবিধান একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। সংবিধানে সমাজতান্ত্রিক নীতির উপর ভিত্তি করে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য উল্লেখ করা হয়েছে। রাষ্ট্র সকল ধর্মের প্রতি সমান আচরণ করবে বলে সংবিধানে ঘোষণা করা হয়েছে।

স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতিগুলি দারিদ্র্য বিমোচন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা বৃদ্ধির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। ১৯৭৩ সালের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দীর্ঘ যুদ্ধের ক্ষত মেরামতের জন্য নীতি গ্রহণ ও ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সামাজিক সেবার প্রসারের মাধ্যমে সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।

স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতিগুলি দারিদ্র্য বিমোচন ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। নীতির প্রভাবে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছিল। জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছিল। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারী ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জিত হয়েছিল।

তা সত্ত্বেও, দুর্নীতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের অর্থনীতিকে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত করে। দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা সম্পদের উপর চাপ সৃষ্টি করে।

দুর্ভাগ্যজনক, দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বেদনাদায়ক ঘটনায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। জাতির জনকের এই হত্যাকান্ড বাংলাদেশের হৃদয়ে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করে এবং তরুণ জাতির গতিপথে কালো ছায়া ফেলে।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা। স্বাধীনতার পর, দীর্ঘ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন এবং একটি নতুন জাতি গঠনের কঠিন দায়িত্ব তিনি বহন করেছিলেন। তার অকাল মৃত্যু কেবল তার পরিবারের জন্যই নয়, সমগ্র বাংলাদেশের জন্য এক বেদনাদায়ক ক্ষতি ছিল।

বঙ্গবন্ধু যে নীতি ও আদর্শের জন্য লড়াই করেছিলেন, তা কেবল তার জীবদ্দশায়ই নয়, তার মৃত্যুর পরও অনুপ্রেরণা জোগাতে থাকে। তার ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং আত্মনির্ভরতার নীতি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি দুঃখজনক অধ্যায়। তবুও, তার আদর্শ এবং জাতি গঠনের স্বপ্ন আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার কেবল রাজনীতির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। তার জীবন ও কর্ম আমাদের স্থিতিস্থাপকতা, ত্যাগ এবং জনগণের কল্যাণে নিরন্তর উত্সর্গের মতো মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়।

বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ ছিল সকল ধর্মের প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন এবং সকলের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করার নীতি। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার নীতি। সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত করার নীতি। বাইরের সাহায্যের উপর নির্ভর না করে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর নীতি।

বঙ্গবন্ধু সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও ভেদাভেদ ভুলে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন অদম্য সাহসী, দূরদর্শী এবং কর্মঠ নেতা। তিনি শুধু একজন রাষ্ট্রনায়কই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী।

স্বাধীন বাংলাদেশের নবনির্মাণে তিনি যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে রয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, এবং সকলের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।

বঙ্গবন্ধুর অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে, তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে আমরা সকলে মিলে তাঁর স্বপ্নের “সোনার বাংলা” গড়ে তুলব এই দৃঢ় অঙ্গীকার পুর্নব্যক্ত করি। সর্বকালের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবসে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

;

জন্মতারিখে শ্রদ্ধা জাতির পিতা



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
জন্মতারিখে শ্রদ্ধা জাতির পিতা

জন্মতারিখে শ্রদ্ধা জাতির পিতা

  • Font increase
  • Font Decrease

‘কেউ জন্মগতভাবে মহান, কেউ মহত্বের লক্ষণ নিয়ে জন্মায় আর কেউ স্বীয় প্রচেষ্টায় মহানুভবতা অর্জন করে’—কথাগুলো উইলিয়াম শেকসপিয়রের। উক্তিতে উল্লিখিত মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়। তারাই আদতে মহান, যারা এই উদ্ধৃতির তৃতীয় অংশের। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় নিয়ে ভাবনা নেই, তবে নির্দ্বিধায় বলতে পারি ‘খোকা’ থেকে ‘শেখ সাহেব’ হয়ে বঙ্গবন্ধু এবং অতঃপর বাঙালি জাতির পিতা হয়েছেন তিনি স্বীয় প্রচেষ্টায়, শোষিত জনগণের ভালোবাসায় নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।

বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক নিবিড়ভাবে জড়িয়ে। যখন কথা বলার অধিকারসহ বিবিধ অধিকার নিয়ে কথা বলি-লিখি তখন বায়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, উনসত্তর একাত্তরসহ দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের পথ ধরে স্বাধীনতা অর্জনের প্রক্রিয়াগুলো চেতনার আলোয় আলোকিত করে। দীর্ঘ এই মুক্তির সংগ্রামকে স্বাধীনতায় রূপদান করতে বঙ্গবন্ধুর যে ভূমিকা একজন ‘সৎ লেখক’ হিসেবে, তা অস্বীকার করতে পারি না। কোনো সৎ লেখকের অস্বীকারের উপায়ও নাই।

স্বাধীনভাবে কথা বলা, স্বাধীনভাবে লিখতে পারার সুযোগ সৃষ্টির পথ দেখিয়ে দেওয়ার একজন বংশীবাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে দেখছি। তিনি নিজেকে নিবেদনের মাধ্যমে দেখিয়েছেন সে পথ, তিনি অনুসন্ধান করতে বলেছেন সে পথ। আমরা অনুসন্ধান করেছি, আমরা পেয়েছি। আমাদের এ অনুসন্ধানের নাম মুক্তির সংগ্রাম আর প্রাপ্তিযোগের নাম একাত্তর এবং স্বাধীনতা।

আমাদের লেখালেখি ও স্বীকারোক্তিতে তাঁকে বাদ দেওয়াকে তাই আত্মপ্রতারণা। আশার কথা, আমি আত্মপ্রতারক নই, দেশের উল্লেখের মতো অধিকাংশ সৎ লেখকই আত্মপ্রতারক নন; তাই বঙ্গবন্ধু আমার কাছে, আমাদের কাছে প্রচলিত রাজনৈতিক সমীকরণধর্মী কিংবা বিভাজনের কোনো নেতা নন; প্রকৃতই জাতির পিতা।

রাজনীতি মুজিবকে বঙ্গবন্ধু করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা করেছে। রাজনীতির মাধ্যমে অর্জিত এই অভিধা হলেও স্বীকৃতিতে কোনো রাজনীতি নেই। কারণ, অস্বীকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম-প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করা হয়। শেখ মুজিব বাংলাদেশের জাতির পিতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক—এ স্বীকৃতির মধ্যে রাজনীতি নেই; এটা ইতিহাসের পাঠ, ইতিহাসের দায় শোধ। এই দায়শোধে আমরা যদি অস্বীকার করি তবে আত্মপ্রবঞ্চক হব।

বাংলাদেশের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—সবখানেই অবধারিতভাবে ছিল শেখ মুজিবের উপস্থিতি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পরেও এর স্বীকৃতিতে কারও বাধা ছিল না। কিন্তু পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনার পর শেখ মুজিবকে ইতিহাসের সোনালি অধ্যায় থেকে মুছে দেওয়ার প্রবণতা শুরু হয়। তাকে মুছে ফেলার যে নীলনকশা সম্পাদিত হয় সেটা মূলত রাজনীতির কারণেই হয়েছে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। ওই সময়ে স্বাধীন দেশের পক্ষে আর বড় কোনো রাজনৈতিক দলের দৃশ্যমান অস্তিত্ব না থাকার কারণে দলীয়ভাবে এই কৃতিত্ব তারা দাবি করতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর সেই অবদানকে অস্বীকার করার যে চেষ্টা শুরু হয়েছিল, তা এখনো চলমান। আওয়ামী লীগবিরোধী বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের গঠন বঙ্গবন্ধুর হত্যার কয়েক বছর পর হওয়ার কারণে দেশের জন্মপ্রক্রিয়ায় দলটির কোনো অবদান নেই। অথচ একশ্রেণির রাজনৈতিক কর্মী মুক্তিযুদ্ধের এগারো সেক্টরের মধ্যকার একটা সেক্টর কমান্ডারকে 'স্বাধীনতার ঘোষক' দাবি করে মুক্তিযুদ্ধে দলটির অবদানকে সামনে আনতে মরিয়া। অথচ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পুনঃপাঠ করেন, সেটাও কোনোভাবেই ছাব্বিশ মার্চে নয়, জিয়ার ঘোষণা-পাঠ ছিল সাতাশে মার্চ। জিয়ার এই সাতাশে মার্চের ঘোষণার পুনঃপাঠকেও অস্বীকার করা যাবে না, যেমনটা আলোচনার বাইরে রাখা যাবে না আরও অনেকের মতো আবদুল হান্নানের পাঠকেও।

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আরও ভুল ধারণা, ভুল প্রচারণা আছে আছে, যা সাত মার্চকেন্দ্রিক। বাংলাদেশের অতি-উৎসাহী অনেকেই স্বাধীনতার ঘোষণাসংক্রান্ত ইতিহাসে ভুল করে থাকেন, কিন্তু সাত মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দেননি। এই তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হলে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধকালীন বৈশ্বিক সমর্থন পেত না, এটাকে গৃহযুদ্ধ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে পাকিস্তানসহ তাদের মিত্র দেশগুলো প্রমাণ করে ছাড়ত। এখানে আছে দূরদর্শী এক নেতার চিত্র। উত্তাল রেসকোর্সের স্বাধীনতাকামী লক্ষ বুভুক্ষু জনতার চাওয়ার বিপরীতে ১৯ মিনিটের সেই সে ভাষণ যেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের বার্তাও ছিল প্রকাশ্য, কিন্তু ছিল না বিচ্ছিন্নতাবাদ। সেই ভাষণ এবং দিকনির্দেশনা একটি দেশকে নিয়ে গিয়েছিল মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি মুক্তিযুদ্ধের দিকে। একাত্তরের বাংলাদেশে সেই মহাকাব্য দিয়েছিল মুক্তির পথ। সেই ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে ইতোমধ্যে। বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেয়েছে এ ভাষণ।

সাত মার্চ নিয়ে কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন—“একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য কী দারুণ অপেক্ষা আর উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে, জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’…. শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন…. কে রোধে তাহার বজ্রকন্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর-কবিতাখানি: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।” কবির সে কবিতা ইতিহাসের এক দলিল, এক জীবন্ত সাক্ষী হয়ে সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে অহর্নিশ। জনসমুদ্রের ব্যাকুলতায় কবি যখন লেখেন ‘কখন আসবে কবি’ তখন ভাষণের প্রতি বার্ষিকীতে, প্রতি স্বাধীনতা দিবসে, প্রতি বিজয় দিবসেও টের পাই এক ঠান্ডাস্রোত; যে স্রোতে নিজেকেও হাজির করি রেসকোর্সে। আর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাক্যের প্রতি শব্দে টের পাই উত্তেজনার বারুদ, এই পাঁচ দশকের বেশি সময় পরেও। ‘সেই থেকে স্বাধীনতা আমাদের’—বাক্যে যেন পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার এক ভবিষ্যৎ পাঠ।

বঙ্গবন্ধু সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন তার নেতৃত্বগুণ ও দেশের প্রতি ভালোবাসার কারণে। কিন্তু তার দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের নেতাকর্মীরা তাকে কেবল 'নিজেদের লোক' প্রমাণেই মরিয়া। অথচ তিনি ছিল সারা দেশের নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। যে বা যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক তিনি যেমন তাদের নেতা, যে লোকগুলো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক নন তিনি তাদেরও নেতা। বাংলাদেশের জন্মপ্রক্রিয়ার প্রতি ধাপ যেখানে বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ-তিতিক্ষা আর শ্রমে সিক্ত সেখানে তিনি তো বাংলাদেশের নেতাই।

১৯২০ থেকে ২০২৪; ক্যালেন্ডারের হিসাবে ঠিক একশ চার বছর। অন্য সবার জন্য হিসাবটা ক্যালেন্ডারের হলেও বাংলাদেশি বাঙালিদের জন্য এ হিসাব কেবল ক্যালেন্ডারের নয়; এ হিসাব বাঙালির জাতির পিতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের। এই জন্মতারিখ নিয়ে বাঙালির আবেগ আছে, ঐতিহাসিক মূল্য আছে বাঙালির কাছে। তাই ক্যালেন্ডারের হিসাব স্রেফ ক্যালেন্ডারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বাঙালির আবেগ আর উৎসবে স্থান পেয়েছে।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। এ জন্ম ঐতিহাসিক কোনো জন্ম না হলেও কালক্রমে হয়ে গেছে ইতিহাসের অংশ। পরাধীনতার শৃঙ্খলে হাঁসফাঁস করা বাঙালির মুক্তির দূত হয়ে উঠেছিলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া সেই ‘খোকা’ কিংবা মুজিব। আর দশটা শিশুর মতো জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, এরপর মুক্তির কান্ডারি হয়ে যাওয়া মুজিব হয়ে ওঠেছিলেন সংগ্রামের স্মারক, মুক্তির সাইনবোর্ড। প্রখর মুক্তির চেতনা, দূরদর্শী নেতৃত্বগুণ তাকে নানা আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে সারিতে নিয়ে এসেছে। নেতৃত্ব দিয়েছেন আন্দোলনে, নির্ধারণ করেছেন লক্ষ্য, পরিষ্কার করেছেন উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক জীবনের জেল-জুলুম উপেক্ষা করে লক্ষ্যে থেকেছেন তিনি স্থির, ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে নানা উসকানিতে লক্ষ্যচ্যুত না হয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার পাশাপাশি তিনি দেখিয়েছেন আন্দোলনের সঠিক পথ। তাই বায়ান্ন থেকে একাত্তরের সব পর্যায়েই তিনি থেকেছেন সামনের কাতারে, দিয়েছেন নেতৃত্ব, বাঙালিকে এনে দিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু উপাধি পেয়েছেন তিনি, যথাসময়ে পেয়েছেন জাতির পিতার স্বীকৃতি।

বঙ্গবন্ধুর এই স্বীকৃতি তাকে মহান করেনি, বরং স্বীকৃতি প্রদানে বাঙালি মহান হয়েছে। বাঙালির দায়শোধের এই চেষ্টার বিপরীতে যদিও আছে কলঙ্কের আরেক অধ্যায় যেখানে এই বাঙালির মধ্যে থাকা কিছু আততায়ী রাতের আঁধারে গুলি চালিয়েছে পিতার বুকে। ইতিহাসের এই দুঃখগাথার সঙ্গে জড়িয়ে যেসব বিশ্বাসঘাতক তাদের কয়েকজনকেও আবার এই বাঙালি ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে দিয়েছে প্রাপ্য প্রায়শ্চিত্ত। ওখানে যদিও ক'জন পলাতক তবু একটা অংশ যেখানে শাস্তি পেয়েছে সেখানে অন্তত নিজেকে প্রবোধ দেওয়া বৃথাসম চেষ্টা আমাদের। তবে ওখানে পূর্ণ সন্তুষ্টি নেই, যখন পলাতকদের শাস্তি কার্যকরের দাবিও আছে আমাদের। সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া পলাতকদের দেশে এনে শাস্তি কার্যকরের।

ইতিহাসের স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহে দেশে-দেশে যেমন নায়কের আবির্ভাব হয়, তেমনি পার্শ্বচরিত্রেও থাকে কিছু খলনায়ক। পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনা সেই সব খলনায়কদের সামনে এনেছিল। যাদের শাস্তি কার্যকর হয়েছে তাদের বাইরেও আরও অনেকেই ছিল যাদের বিচারিক আদালতেও তোলা যায়নি মূলত বিচারিক সীমাবদ্ধতার কারণে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আড়ালের অনেক খলনায়ক রাষ্ট্রীয়ভাবে দোষী সাব্যস্ত হয়নি। এ আমাদের সীমাবদ্ধতা। চাইলেও আমরা পারি না এই সীমাবদ্ধতা ঘোচাতে।

আজ বঙ্গবন্ধুর ১০৪তম জন্মবার্ষিকী। আজ জাতীয় শিশু দিবস। শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ১৭ মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস ঘোষণা করে। এদিনে শিশুরা তাকে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি নিজেদের বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শে আলোকিত করার শপথ গ্রহণ করে। সরকারি নানা কর্মসূচির পাশাপাশি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও জাতির পিতার জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উদযাপিত হয়। যে শিশুদের শিক্ষার নিশ্চয়তা দিতে বঙ্গবন্ধু দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণ করেছিলেন, সেই শিশুরা তাদের বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিক উদযাপন করে থাকে।

বঙ্গবন্ধু নিজের জন্মদিন উদযাপন করতেন না, কিন্তু তিনি জানতেন তার জন্মদিন উদযাপিত হয়। কারাগারে বসে লেখা ডায়েরির গ্রন্থিত রূপ ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের ২০৯ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, “আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই–বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই।” তারিখটি ছিল ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ। ওই বইয়ে বঙ্গবন্ধু আরও লেখেন ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস’, নিজেকে কত ক্ষুদ্র করে দেখার প্রয়াস!

টুঙ্গিপাড়ার সেই ছোট্ট খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে জাতির পিতা; শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন এমনই। শিশু থেকে যুবা হয়ে বৃদ্ধ; সবার কাছেই তিনি অনুকরণীয়। জন্মতারিখে শ্রদ্ধা জাতির পিতা।

;