কার্যালয়ে বাক্সবন্দী রিজভীর নিত্যনতুন ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’!
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। দীর্ঘদিন ধরে পল্টনে বিএনপির দলীয় কার্যালয় তার আবাসিক ঠিকানা। গ্রেফতার এড়াতে দলীয় কার্যালয়ের ছোট একটি কক্ষে তার দিনযাপন। সেখান থেকেই টেলিভিশনের বাক্সে নিজের আবিষ্কৃত নিত্যনতুন ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ নিয়ে প্রতিদিন হাজির হচ্ছেন তিনি। বিএনপির পল্টন শাখার আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে রিজভীকে নিয়ে বিভিন্ন মহলে তাই সরস আলোচনা।
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না রিজভী। অভিযোগ আছে, বিএনপি যে অংশটি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেন নি তাদের মধ্যে অন্যতম রুহুল কবির রিজভী। নির্বাচনে অংশ না নিলেও থেমে নেই তিনি। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন রিজভী। আর তাই গণমাধ্যমের জন্য নিজের আবিষ্কৃত ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ নিয়ে হাজির হচ্ছেন তিনি। রিজভীর সংবাদ সম্মেলন মানেই নিত্য নতুন তত্ত্ব আর ব্যঞ্জনাময় কাব্যিক কথার ফুলঝুরি। সংবাদ সম্মেলনে বাকপটু রিজভীর কথা শুনে প্রায় সময় প্রশ্ন করতেও ভুলে যান উপস্থিত সাংবাদিকরা। জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ অনেক সাংবাদিকরাও প্রশ্ন করে তাদের নেতাকে (রিজভী)কে চটাতে চান না। বাকপটু রিজভী যাই বলেন; বিনা বাক্য ব্যয়ে তাই প্রচার করেন/লিখে দেন তারা। রিজভীর করা অভিযোগ শিরোনাম হয়ে টেলিভিশন, পত্রিকা, অনলাইন ও মাল্টিমিডিয়াগুলোতে সারাদিন ধরে ভাঙা রেকর্ডের ন্যায় বাজতে থাকে।
আজ সোমবার (১০ ডিসেম্বর) নয়াপল্টনের কার্যালয় থেকে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে রিজভী অভিযোগ করেছেন যে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় বসাতে জেলা প্রশাসকরা ভয়ঙ্কর গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিদিন জেলা প্রশাসকরা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করছেন। ভোট ডাকাতি প্রস্তুতির শলাপরামর্শ করছেন। নির্বাচনে জাল-জোচ্চুরির সব প্রস্তুতি পাকা করছেন। আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি, গতকাল রোববার সব জেলার প্রশাসকরা নিজ নিজ এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ডেকে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে চারটি বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বৈঠকে ডিসিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের যে কোনো মূল্যে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন।’
যদিও সংবাদ সম্মেলনে নিজের অভিযোগের স্বপক্ষে কিংবা বিশ্বস্ত সেই সূত্রের কোন প্রমাণ অবশ্য দেননি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব। সাংবাদিকরাও রিজভীর কাছে প্রমাণ না চেয়ে তার অভিযোগের শিরোনাম লিখে প্রচার করে যাচ্ছেন।
জেলা প্রশাসকদের আগে রিজভীর টার্গেট ছিল ঊধ্বর্তন সচিব ও আমলারা। ২৪ নভেম্বরের দিন রিজভী দিয়েছিলেন ‘অফিসার্স ক্লাব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’। সেদিন তিনি বলেন, ‘সারাদেশে ভোট ইঞ্জিনিয়ারিং করার লক্ষ্যে যে ৬ জন সচিবকে নিয়ে একটি গুপ্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে; সেই কমিটির বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে। আমাদের কাছে বিভিন্ন সূত্রে এই খবর এসেছে। রাত সাড়ে ৭টা থেকে আড়াই ঘণ্টার ওই বৈঠকে সারাদেশে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সেটআপ ও প্ল্যান রিভিউ করা হয়।’
রিজভীর ওই বক্তব্য নিয়ে নানা মহলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। অফিসার্স ক্লাবে যাওয়া সচিবরা বৈঠকের ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানান গণমাধ্যমে। কিন্তু রিজভী হাল ছাড়ার পাত্র নন!
রোববার (৯ ডিসেম্বর) ছিল নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র ৪-১ ভোটে বাতিল করে দেয় নির্বাচন কমিশন। সেটা দেখে নয়াপল্টন থেকে গর্জে ওঠেন রিজভী। ডাকেন জরুরি সংবাদ সম্মেলন। সেখানে অভিযোগ করে বলেন, ‘বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মনোনয়ন অবৈধ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ছিল। নির্বাচন কমিশনে একজন কমিশনারের সঠিক রায়কে উপেক্ষা করে স্বার্থ সন্ধানী প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে বাকি কমিশনাররা বিভক্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ আদেশ দিয়ে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন।’
সংবাদ সম্মেলনে রিজভী মানেই ব্যঞ্জনাময় কথামালা। সিইসির দিকে অভিযোগ করে রিজভী সেদিন বলেন, ‘রিটার্নিং কর্মকর্তার ‘সিংহ আর হরিণ শাবকের পানি ঘোলা করার ঈশপের গল্পের মতো’- আদেশের বিরুদ্ধে আপিল শুনানির রায়ে গোটা দেশবাসী আশা করেছিল— ন্যায়বিচার পাবেন তাদের নেত্রী। কিন্তু কী ভয়াবহ দলদাসত্ব দেখালেন সিইসি কে এম নূরুল হুদা ও তার কয়েকজন কমিশনার ‘
এর আগে যখন ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের সংলাপ হয়েছে তখন রিজভী একদিন বলে ওঠেন, ‘সংলাপে মানুষের মনে যে আশাবাদ জেগে উঠেছিল, সংলাপ শেষে সেই আশার মুকুল ঝরতে শুরু করেছে।’
শুধু সংবাদ সম্মেলনে নয় ঝটিকা মিছিলেও দারুণ পারদর্শী রুহুল কবীর রিজভী। কাকডাকা ভোরে রাজপথ যখন সুনসান তখন তিনি ঝটিকা মিছিলে বেরিয়ে পড়েন। যার অধিকাংশের খবর আগে থেকে গণমাধ্যমে জানানো হয় না। সর্বশেষ রোববার (৯ ডিসেম্বর) বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি ছাত্রদলের ঝটিকা মিছিলে তিনি অংশ নেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে ফাঁকি দিতে দলীয় কার্যালয় থেকে বেরিয়ে তিনি নিজেকে চাদরে মুড়ে মিছিলে অংশ নিয়ে ছবি তুলে আবার কার্যালয়ে ঢুকে যান। মিছিলের ছবি পরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সাংবাদিকদের ই-মেইলে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রিজভীর সঙ্গে তার কিছু কর্মীও দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। কর্মীরা ফ্লোরে ঘুমালেও রিজভীর জন্য খাটের ব্যবস্থা আছে। রিজভীর স্ত্রী আনজুমান আরা আইভি সরকারি চাকরিজীবী। শুক্রবার ছুটির দিন স্বামীর জন্য ভালোমন্দ খাবার রান্না করে নিয়ে আসেন তিনি। এছাড়া বাকী সময় খাবার পাঠিয়ে দেন। দলটির সহআন্তর্জাতিক সম্পাদক ও শিল্পী বেবী নাজনীনও রিজভীর জন্য মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে আসেন। কার্যালয়ের ভেতরেও রান্নার ব্যবস্থা আছে। প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কার্যালয়ে আগত নেতাকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটান রিজভী। ভোররাত পর্যন্ত বই পড়ার চেষ্টা করেন। পরদিন সকালে কিছুটা ঘুমিয়ে নতুন কোন ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন রিজভী।