মধুপ-কাহিনী



রহিমা আখতার কল্পনা
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

বিষয়টা হঠাৎ করেই, বহু বছরের ব্যবধানে আমাকে চমকে দেয়। কিংবা তার চেয়েও বেশি। বলা যায়, আমাকে আমূল নড়িয়ে দেয়। আমার বন্ধু শামীম, শামীম খন্দকার—মাঝখানে ন’বছরের অদর্শন সত্ত্বেও, তার চেহারা সুরতে নয়টি বছরের পরিষ্কার পরিবর্তনের ছাপ বহন করা সত্ত্বেও, কথাটি এমন সহজে বলে, যেন এটি গতকাল বা পরশুর ঘটনা। যেন রোজ আমাদের দেখা হয়। যেন ঘটনাটি ঘটবার পর পুরো ঊনিশটি বছর কেটে যায়নি। প্রসঙ্গটা কিভাবে যেন উঠেছিল মনে নেই। এক পর্যায়ে শামীম বলে
- দোস্ত, সেদিন তোমার পরনের শাড়িটা ছিল সবুজ, খুব তাজা সবুজ।
আমি চমকে যাই—শাড়ির রঙটাও তোমার মনে আছে?
- হ্যাঁ। সবুজ। পাড়টা লাল। এ দু’টো রঙের মিশেল কি ভুলে যাওয়া সম্ভব! বিশেষ করে একজন বাঙালির পক্ষে?

সামান্য ক’টি বাক্য, কয়েকটি মাত্র শব্দ, অথচ কী যে হয়ে যায় আমার ভেতরে। আশ্চর্য, এতগুলো বছরের এত হাজার হাজার দিনের লক্ষ লক্ষ ঘণ্টার দীর্ঘ সময়ে কথাটা একবারও আমি ভাবিনি। কেন ভাবিনি?

আমাদের জাতীয় পতাকার, আমার মাতৃভূমির, আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক লাল-সবুজ কম্বিনেশনের শাড়ি আমার খুব কম বয়স থেকেই পছন্দের। প্রায়ই পরি। এখনো। লাল শাড়ি সবুজ পাড়। সবুজ শাড়ি লাল পাড়। পাড়হীন সবুজ থান অথবা পাড়হীন গাঢ় লালও, সময়ে সময়ে। কিন্তু বহুদিন আগেকার সেই ঘটনাটির সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে মিলে যাওয়া এই প্রতীকী বর্ণ-সমন্বয়টি আমার মনে কখনো উদিত হলো না কেন, সেটাই বিস্ময়ের। শামীম আজ এতদিন পরে কী কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে! আমি কি বাংলাদেশ!

হ্যাঁ, আমি একটা দেশ। বাংলাদেশ। আজ থেকে ঊনিশ বছর আগে, যখন আমার বয়স ছিল চব্বিশ, আর আমি শেষ জুলাইয়ের এক মধ্যদুপুরে স্বাধীন বাংলাদেশেই প্রথমবারের মতো ধর্ষিত হই—তখন আমার পরণে ছিল লাল পাড়ের তাজা কিন্তু গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি। টাঙ্গাইলের তাঁত। আহা, ঐতিহ্য। সেদিনের কোনো কিছুই ভুলে যাবার কথা নয়। আমি ভুলিওনি। কিন্তু শাড়ির রঙ টঙের ব্যাপারটা কেমন যেন আবছা হয়ে এসেছিল স্মৃতিতে। অথবা তেমনভাবে স্মৃতিতে আঁচড়ই কাটেনি বিষয়টা।
- তুই আমার বাড়ি থেকেই গিয়েছিলি।
শামীমের কথায় আমি নিজের মধ্যে ফিরে আসি—হ্যাঁ। তুমি তখন নীলক্ষেত কোয়ার্টারে সাবলেট থেকে ল্যাব এইডে কাজ করো।
- হুঁ। অফিস সেক্রেটারি ছিলাম। কোম্পানি সেক্রেটারিও, সাকুল্যে ওই একটা অফিসই তখন ওদের কোম্পানি ছিল তো।

আমি একবার শামীমের দিকে তাকাই। সেদিনের স্বল্পায়তন প্রতিষ্ঠানটির অফিস সেক্রেটারি শামীম খন্দকারকে আজকের শামীমের ভেতরে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অবশ্য বদলে গেছে প্রতিষ্ঠানটিও, অনেক বড় হয়েছে। তবু সেখানকার ‘চাকুরে’ হিসেবে আজ শামীমের অবস্থান অকল্পনীয়। আজ সে ওরকম ব্যবসার কমপক্ষে বিরাট শেয়ারের মালিক হতে পারে। আমি তার কথার জের ধরি—
- আমি তোমার বাসায় তৈরি হয়ে কোথাও যাব বলে তুমি আধাবেলা ছুটি নিয়েছিলে।
- কারণ আমি জানতাম দিনটা তোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ল্যাব এইড তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত ছোট একটা ডায়াগনোস্টিক সেন্টার। আজকের বিশাল হাসপাতাল-ভবন তখন কল্পনারও বাইরে। তিনতলা ভবনের ওই পরীক্ষাগারে কাজের ব্যস্ততা বলতে গেলে ছিলই না। আমার সব মনে পড়ে। বলি—ওই টেবিলে বসে থেকে তুমি খুব বোর হতে তখন।
- হ্যাঁ। ওটার মালিকের নামও শামীম। ডা. শামীম। নামের সূত্রে খানিকটা সৌহার্দ্য থাকায় শামীম ভাইয়ের অনুমতি পেয়েছিলাম সহজে। কোম্পানি-সচিবের মাছিমারা দায়িত্বের টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছিলাম দুপুর বারোটার পরপরই।
- হুঁ।
- হুঁ মানে কী। তোর জন্যই করেছিলাম সব। অকৃতজ্ঞ।

ওর উষ্মার মুখে আমি আর কোনো শব্দই করি না। আমাদের আড্ডার তৃতীয় সদস্য, শামীমের বান্ধবী নাজনীন আমাদের আলাপচারিতা সবিস্ময়ে শুনছিল, নীরবে। খানিক পরে শামীম আবার সক্ষোভে বলে—আমি জানতাম দিনটা তোর বিশেষ দিন।
- হুঁ।
- আবার হুঁ। আমি কিন্তু জানতাম দোস্ত, সেদিন ঘটবে।

এবার শামীমের উচ্চারণে ক্ষোভ নেই, বরং নির্বিকার সে। কিছুটা কি কৌতুকপ্রবণও? কেন যেন আমার সুক্ষ্ম একটা অপমানবোধ হয়—কী অশ্লীল ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলো শামীম। ‘ঘটবে’। কী ঘটবে ?
- এটা অশ্লীল ইঙ্গিত? যাহ্ শালা। যার জন্য করি চুরি...। কামখান বানাইতে পারলা তোমরা, আমি আন্দাজ করতে পারলে দোষ।
- আবার বাজে কথা?
- কথা যেরকমই হোক, আমি একশো ভাগ সিওর ছিলাম, জানতাম যে ওই দিন অঘটনটা ঘটবেই।
- মাই গড, তুমি এতো নিশ্চিত জানতে ? আমি তো কিছুই জানতাম না। তুমি কী করে...
- ওসব বুঝা যায়, কাঞ্চনমালা।

শামীমের মুখে আমাকে ‘কাঞ্চনমালা’ ডাকতে শুনে আমার কোনো স্মৃতিমেদুরতা তৈরি হয় না, কারো প্রতি ক্ষোভ কিংবা ঘৃণাও না। হাসি পায়। একদা এক যুবক আমার ‘মালা’ নামটিকে অলংকৃত করিয়া কাঞ্চনমালা বলিয়া আহ্বান করিত বটে। সুমিত। সুমিত ফায়জুল্লাহ। কী ছিল তার ঢলোঢলো আবেগ! বাথটাব ভর্তি সুগন্ধি সাবান-ফেনার মতো। কিন্তু শামীম তো মনে হচ্ছে আজ এই বিদঘুটে প্রসঙ্গ—কচলানো থেকে রেহাই দেবে না আমাকে। দেড় হাত দূরত্বে মুখোমুখি বসে সে যেন কোন এক দূরাগত গলায় স্বগতোক্তি করে—
- রওনা দেবার আগে আমার রুমে এসে তুই যত্ন করে গাঢ় লাল টিপটা কপালে দিলি। সঙ্গে ম্যাচ করে লিপস্টিক... টিপটপ ড্রেসআপ...
- তুমি শামীম, মুখস্ত করে রেখেছো ওই সব!
- কেন, অস্বাভাবিক? বলতে চাস তোরও মুখস্ত নেই! মনে পড়ে না এখনো?

আমি জবাব দেই না। চুপ থাকি। একসময় চোখ বুজে মুখটা আকাশমুখো তুলে ধরি। যেন এক্ষুণি আকাশ থেকে বৃষ্টি নামবে, মুখটা ধুইয়ে দেবে। বৃষ্টি নামে না। নাজনীন অধৈর্য হয়ে এসময় বলে—অনেক হয়েছে ভাই। তোমরা এবার দু’জনেই ঊনিশ বছর পেছন থেকে আজকের দিনটাতে ফিরে আসো তো।

হঠাৎ শামীম হাসতে থাকে। আমিও। নাজনীনও। যে যার নিজস্বতায়, আনন্দে, স্বস্তি বা অস্বস্তিতে, অর্থহীনতায় কিছুক্ষণ হাস্য-আক্রান্ত থাকি। এরপর একসময় থিতিয়ে আসে যার যার নিজস্ব অনুভূতি। খানিক আগের ঝলমলে বিকেলটা কেমন যেন বিমর্ষতায় মরে আসতে থাকে। জাতীয় জাদুঘরের ভেতরের পুকুরটা কমলারঙের মিহি সরভাসা পানি বুকে নিয়ে স্থির হয়ে আছে। পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যরশ্মি তির্যকরেখায় পুকুরের পানিতে পড়ে কেমন একটা সব্জে-কমলা রঙ ধরেছে। আমরা তিনজন পুকুরপাড়ের সবুজ মাঠে বসে থেকে নিজেদেরকে চিনতে পারি না। অথচ বহুদিনকার যোগাযোগহীনতাকে দূর করে দেবার জন্যই আমরা খুব উদার প্রকৃতির স্পষ্টতায় খোলা আকাশের নিচে বসেছিলাম; শামীম বারবারই কাছের কোনো চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসবার জন্য পীড়াপীড়ি করা সত্ত্বেও। শুধু তারুণ্যের স্মৃতিমেদুরতার কারণেই এই প্রান্তরবিহার। না হলে বয়স এবং তথাকথিত পদমর্যাদার দৌরাত্ম্যে আমাদের জীবন থেকে সাধারণ দিনযাপনের আনন্দ অন্তর্হিত হয়েছে বহু আগে। আমি চারপাশে চোখ ফেলি। দূরে দূরে ছড়ানো নানান গাছপালা। এ মুহূর্তে এই বৃক্ষমালাদের মতো আমরাও আমাদেরকে অনড় বলে বোধ করি। তিনজনই চুপ করে যাই। যেন আমরা সত্যিই গাছ হয়ে গেছি। ভাষাহীন। গাছগুলো মাটির গভীরে চলে যাওয়া শেকড়ের বন্ধনে আঁটো, তবে এই গাছ তিনটির কাণ্ডগুলো হাঁটু ভেঙে জুবুথুবু হয়ে জমে পড়েছে বুঝি। আমরা মাঠের দুর্বাঘাসের ওপর বসেছিলাম।

একটু দূরে, মাঠের অন্যপাশে কয়েকটি শিশু-কিশোর কল্পিত পীচের দু’প্রান্তে পরপর চার পাঁচটা করে ইট বসিয়ে স্ট্যাম্প বানিয়ে ক্রিকেট খেলছিল। বিপদজনক স্ট্যাম্প, কিন্তু বাচ্চাদের মুখে ভীতি বা দুশ্চিন্তার চিহ্ন নেই। এসময় আমাদের নীরবতার অখণ্ডতায় একটা ঢিল পড়ে। আচমকাই। ওদের একটি বল ব্যাটের আঘাতে উড়ে এসে আমার ঠিক ডান হাঁটুতে লেগেছে। ক্ষুদে খেলোয়ারদের হল্লা উঠলে আমরা আবার ধুলোওড়া বিকেলটাতে ফিরে আসি। আমি বলটা হাতে নিয়ে ওদেরকে হাত ইশারায় ডাকি। খুব দ্বিধার সঙ্গে একজন এগুচ্ছে। হাতে ব্যাট। স্ট্যাম্পের কাছে ব্যাট হাতে আরেকটি ছেলে। তার পাশে বড় জোর ন’দশ বছরের একটি মেয়ে। কী মায়াবী মুখটা তার! খুশির হাসিতে চোখ দুটো বুজে আসার যোগাড়। হাসতে হাসতে ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। তার কথা শুনতে পাচ্ছি—আমাকে তো খেলতে নাও না। এই জন্য। এইজন্য বিচার হইছে।

আগুয়ান ছেলেটি সম্ভবত ‘বিচার’- এর ভয়েই মুখ শুকনো করে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। শামীম গম্ভীর গলায় বলে—কী ঘটনা? ছেলেটি উসখুশ করছে। শামীম আবার বলে—ঘটনাটা কী, বল নিতে এসেছো?
নাজনীন হেসে ফেলে—বেচারা ভয় পেয়েছে। শামীম আবার রহস্য করে আমাকে দেখিয়ে বলে—ভয়ের দেখেছো কী, শোনো ছেলে, এই ম্যাডাম যে খুব রাগী, তা জানো?
ছেলেটি না বোধক মাথা নাড়ে।
- এই রাগী ম্যাডাম যদি সত্যিকার রেগে যায়, তাহলে তোমাদের খেলাটা একদম খেয়ে হজম করে ফেলবে, বুঝলা?
- কী খেয়ে ফেলবে? এতক্ষণে বিস্মিত মুখে কথা ফুটল ছেলেটির।
- তোমাদের খেলাটা।
- খেলা-টা? খেয়ে হজম?
- হ্যাঁ ব্যাট-বল-স্ট্যাম্প সব। বেশি রাগ করলে উনি হাতের কাছে যা-ই পান, তাই খেয়ে ফেলেন।
তারপর আমার দিকে চেয়ে উদাস গলায় বলে—নিজের রাগটা খেতে পারেন না তো! এজন্য।
এবার সম্ভবত কৌতুকটা ধরতে পারল ক্রিকেটার। সে মুচকি হেসে আমার দিকে হাত বাড়াল বলটার জন্য। বলল—আমরা সরি আন্টি। আপনি কিন্তু খুব বেশি রাগ করেন না।

আমরা এবার নিজেরাই হাসতে লাগলাম। ছেলেটা বল হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে ফিরে গেল। অনেকক্ষণ ধরে খেলা বন্ধ রেখে ওদের হাসাহাসিই চলছে, দেখলাম। বিকেলটা ফের তার নিজস্বতা নিয়ে ফিরে এসেছে শাহবাগ অঞ্চলে। আমাদের মধ্যেও কি ফিরে আসে প্রত্যেকের নিজ নিজ দিনরাত, ভিন্ন ভিন্ন জীবনযাপনের অশ্রুত পাঁচালী! কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা, সম্পূর্ণ ভিন্ন তিনটি বাস্তবতার প্রতিনিধি, কিছু কমন বিষয় নিয়ে মামুলি আলোপচারিতায় অংশী হয়ে উঠি। একটু পরেই জাদুঘরের ডেপুটি কিপার ড. নীরু শামসুন্নাহারকে আসতে দেখা যায়। মুখে উজ্জ্বল আভা। তার সম্প্রতি পাওয়া দু’বছর মেয়াদী জাপানের স্কলারশিপসহ ভিসা প্রাপ্তির খবর এবং আগে থেকে জানা তার সদ্যসূচিত সপ্রেম দ্বৈত-জীবনের তথ্য আমাদের দারুণ আনন্দিত করে অথবা নিজেদের কিছু কিছু না-পাওয়ার ক্লেশকে অধিকতর গভীর করে। আমরা তাকে উইশ করি, সঙ্গে থাকা মিষ্টি সকলে মিলে খাই। নিমকিভাজা খাই, বোতলের পানিতে তৃষ্ণা দূর করি। নানান বিষয়ে কথা চলতে থাকে। মিনিট চল্লিশেক পরে নীরু আপা ‘মোশারফ ভাই আমার জন্য অপেক্ষা করতেছে, না হইলে আরো অনেকক্ষণ থাকতাম’ বলে উঠে গেলে আবার তিনজন একা হয়ে পড়ি।

শামীমের বহুদেশ ঘোরার অভিজ্ঞতা আছে। আজ সে নিউইয়র্ক তো পরশু ব্রাসেলস। এক সপ্তাহ পরেই  হয়তো সে ফ্রান্সে, পরের মাসেই থাকতে পারে হংকং। কয়েক মাস ধরে সে বাংলাদেশে আছে। সম্প্রতি সে বিরিশিরিতে বিঘা দশেক জমি কিনেছে। আরো দশ পনের বিঘা কেনার ধান্দায় আছে। আপাতত কিনে ফেলা জমিতে একটা ট্যুরিস্ট-রিসোর্ট আর বৃদ্ধাবাস করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক কাজকর্ম সেরে ফেলেছে। মহাব্যস্ত লোক।

নাজনীনের ব্যাপারটাও জানা গেল। সম্প্রতি নিঃসঙ্গ হয়েছে সে। বিয়ে হয়েছিল পারিবারিকভাবে। ছেলে রূপে গুণে বিদ্যায় ছিল অতুলনীয়। মনকাড়া সুন্দরী নাজনীনও মেধায় নান্দনিকতায় চূড়াস্পর্শী। সোনায় সোহাগা। কিন্তু স্বামীধনের গুণপনার অলিগলিতে বিচরণ করতে নিয়ে সে যখন আবিষ্কার করে যে, প্রতিরাতে স্বামী তাকে কিশোরীসুলভ কিছু ব্রীড়াভাঙার ক্রীড়াশৈলীতে আবিষ্ট রাখবার চেষ্টা করে ঘুম পাড়াতে চায়, অভিযাত্রার প্রান্তদেশে পৌঁছাতে উদ্যোগী হয় না, তখন সে সংশয়ে পড়ে। লোকটি কি শারীরিকভাবে অক্ষম! মগজে কেউটের মতো ফণা তোলা এ প্রশ্নের জবাব কিন্তু সে অচিরেই পেয়ে যায়। দেহ আর মনের বিবাদভঞ্জন হয়—নাহ, অমূলক সন্দেহ। বরং পারঙ্গম স্বামী নিজের দাদীর কাছে শোনা স্বামী-স্ত্রীর মিলন বিষয়ক অব্যর্থ প্রবাদটি তাকে শোনায়—‘মাসে এক, বছরে বারো, এর থাইককা যে যতো কমাইতে পারো।’ নাজনীন বিশ্বাস করেছিল। তীব্র আকাঙ্ক্ষায় জর্জরিত বহু রাতেই সে স্বামীর ঔদাসীন্যে তেমন দোষ দেখেনি। আর দীর্ঘ বিরতিতে যেদিন প্রত্যাশিত সন্তরণ ঘটেছে, সেদিন তার মতো সুখী আর কেউ নয়। ভালোই কাটছিল। মন্দের ভালো। দু’বছর আগে স্বামী যখন উচ্চতর বিদ্যালাভের জন্য ইংল্যান্ড পাড়ি দেয়, তখনই সে প্রথম জানতে পারে যে লোকটি সম্পর্কে তার জানাশোনায় ফাঁক থেকে গেছে। ইংল্যান্ডে সে একা যায়নি। সঙ্গে স্বামীর কৈশোরোত্তীর্ণকাল থেকে সখ্যের সম্পর্কধারিনী একজন দু’সন্তান-শোভিত বিধবা যুবতী মাতাও গিয়েছেন। সন্তানসহ তার ভিসা অবশ্য আলাদাভাবে হয়েছে। তার বাচ্চারা ওখানে পড়াশোনা করতেই যাচ্ছে।

নাজনীনের সঙ্গে তার স্বামীর বিয়েটা ছিল পরিবারের চাপে। এ বিয়ের ফলে তাদের পূর্বসম্পর্কের কোনো বিরতি ঘটেনি। সবকিছু জানাজানি হলে ঘুমন্ত স্বামীর পাশে জেগে কাটানো উপোসী রাতগুলো তার চোখে টেঁটাবিদ্ধ করে বুঝিয়ে দেয় সত্য কী। তারপরও সে চেষ্টা করেছিল। বৃথা। দু’বছর প্রকৃত প্রোষিতভর্তৃকার জীবন কাটানোর পর সম্প্রতি তালাকের নোটিশ এসেছে। যে ফ্ল্যাটটিতে সে এখন বসবাসরত, সেটি দেনমোহরের হিসাবে ফেলে নাজনীনের নামে লিখে দিয়ে স্বেচ্ছায় মুক্তি নিচ্ছে তার প্রবাসী স্বামী। দেনমোহর এবং তিনমাস দশদিনের ইদ্দতকালের খোরপোশের খরচের অন্তত আট ন’ গুণ বেশি হবে ফ্ল্যাটটির দাম। কিন্তু নাজনীন এই প্রাপ্তির হিসাব বুঝিয়ে অনির্বাণ জ্বলতে থাকা মনকে শান্ত করতে পারে না। অপমান। তীব্র অপমান অবিরত দংশনে তাঁকে মৃত্যুমুখী করে ফেলছিল।

এ অবস্থায় শামীম তাকে সঙ্গ দিচ্ছে। অথবা শামীমকে সে। বন্ধু হিসেবে পরস্পর পরস্পরের নির্ভরতা হয়ে উঠছে। ফেরার পথে কলাবাগানে আমার বাড়িতে আমাকে নামিয়ে দিয়ে যায় ওরা। আমার বাচ্চাদের জন্য অনেক খাবার আর গিফট কিনে দিয়েছে শামীম। কিন্তু সময়ের তাড়া বলে ওরা আমার বাড়িতে নামে না, রওনা দেয় উত্তরার দিকে, নাজনীনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। শামীম কিছুদিন ধরে নাজনীনের ফ্ল্যাটে থাকছে। আমি দেখি, আমার বন্ধু শামীম তার বন্ধু নাজনীনকে নিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে জনাকীর্ণ রাজপথে। কিন্তু শামীম কি জানে, কী মারাত্মক একটি জখমের চাপাথাকা মুখ সে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুলে দিয়ে গেছে আজ!

সে দিনটা অন্য দিনগুলো থেকে ভিন্ন ছিল।
গরম কালটা আমার অপছন্দের। কিন্তু শেষ জুলাইয়ের সেই অসহ্য গরমেও নিজেকে আমার ফুরফুরে লাগছিল। আমার বন্ধু... দীর্ঘদিনের বন্ধু, যাকে আমি খুব মামুলি মেয়েদের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবাসি—আজ আমাকে নিভৃতে ডেকেছে। আমরা বহুবছর বন্ধুত্ব রক্ষার দূরত্বে থেকেছি, তার বিভিন্ন নারী বা তরুণী বিষয়ক গল্প, তা প্রেম বা নিছক কামের তাড়নাতেই হোক—আমি শুনেছি। জানি। আমার রক্ষণশীল প্রেমপ্রবণতাও জানে সে। আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে একটা ধুম্রজাল রয়েছে বন্ধুদের মধ্যে। কেউ বলে, আমি সুমিতের পেছনে অর্থহীন মোহে সময় নষ্ট করছি। কেউ বলে সুমিত আমাকে খেলাচ্ছে, লক্ষ্যে পৌঁছামাত্র কেটে পড়বে। বন্ধুরা, বিশেষত মেয়ে বন্ধুরা আমার ব্যাপারে খুবই শংকিত। তারা মনে করে, আমি সুমিত ফায়জুল্লাহর মতো একটা চিহ্নিত প্লেবয়ের পাল্লায় পড়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করতে যাচ্ছি। আমি জানি প্রকৃত সত্য। ভুল শুদ্ধ যা-ই হোক কাজটা আমি করেই বসেছি। সুমিতকে ভালোবেসেছি। বাইরে অবশ্য আমি এর তীব্র বিরোধিতা করি। সুমিতও। সে কী বুঝে আমাদের প্রেমসম্পর্ক হওয়ার সম্ভাবনাকে স্রেফ অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয় জানি না। তবে আমিও ঠিক তারই মতো করে সবকিছু অস্বীকার করি। কারণ সকলের মনোযোগ সরিয়ে দিয়ে আমি ওকে সত্যিকারেরই পেতে চাই। এরপর জানতে পেরে চমকে উঠুক সবাই। তবে মেলামেশার ব্যাপারে আমি খুবই সাবধানী। আগামী মাসে আমার চব্বিশ পূর্ণ হবে। এখনো আমি কোনো পুরুষের শারীরিক সাহচর্যে যাইনি। দীর্ঘ ছ’বছরের বন্ধুত্বে সুমিত পর্যন্ত কাছ ঘেঁষতে পারেনি। কত গান, কত সাংগঠনিক কাজ, ডাকসু সাংস্কৃতিক দলের অনুষ্ঠান আমরা একসঙ্গে অনেকের সাথে করেছি। আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি শুধু দু’জনে, আমি যে চাচাজির বাড়িতে থাকি, সেখানে। কোনো নির্জনতার প্ররোচনাতেই সে বন্য হয়ে ওঠেনি। অথচ কত কথাই ওর লাম্পট্য সম্পর্কে আমি শুনেছি।

সুমিতের আমার সাথে একান্তে দেখা করে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার প্রস্তাবে আমি সানন্দে রাজি হয়েছিলাম। তবে কথাটা যাতে কোনোভাবেই প্রচার না হয় সেদিকে আমরা দু’জনেই সর্তক।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সুমিত অন্য সাবজেক্টের ছাত্র আমাদের ইয়ারেই। তার একাডেমিক রেজাল্ট খুব সাধারণ হলেও সে কোনো বিচারেই সামান্য নয়। সুমিতের বাবা দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী শিক্ষাবিদ। সে নিজে সঙ্গীত-শিল্পী। সম্প্রতি সিনেমার প্লে ব্যাকও শুরু করেছে। আমার অনার্সের রেজাল্ট আশানুরূপ, একই পর্যায়ের রেজাল্ট এমএতেও হবে আশা রাখি। এরপর তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় যোগ দেবার সিদ্ধান্ত পাকা হয়েই আছে। স্বপ্নের জীবন পেয়ে যাব বাস্তবে। কঠিন সংগ্রামের দীর্ঘ জীবন থেকে বিদায়। আমি এখন নিজের উপার্জনে পড়ি। পার্টটাইম কাজ করি দু’টো জাতীয় দৈনিকে। অনেকে ছাত্র পড়াতে বলে। আমার পোষায় না। শিক্ষকতা একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়েই শুরু করব। সুমিত আমার এই ডিটারমিনেশনটা খুব সম্মান করে। সীমাহীন প্রতিকূলতায়ও হাল ছেড়ে না দেবার দৃঢ়তাকে সম্মান করে। আরেকটা ব্যাপারে আমার আশ্চর্য লাগে—ও তার সমস্ত গোপন কথা, লোভ, ঈর্ষা, ভবিষ্যত-ভাবনা এমনকি অপরাধবোধের কথাও আমাকে জানায়। আমি মাঝে মাঝে সংশয়ে পড়ে যাই। ও কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসে ? নাকি এ কেবল কথামালা ? আবার বিভ্রান্ত লাগে—ভালো না বাসলে কেউ কাউকে এত চায়? এত কিছুতে জড়িয়ে নেয়! মাঝে মাঝে আমার সম্পর্কে সুমিত বন্ধুদের কাছে উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করে, যার মর্মার্থ হচ্ছে—আমি একটা খুব অন্যরকম চরিত্র। মামুলি মেয়েদের মাপকাঠিতে আমাকে বিচার করা যাবে না। এগুলো কি স্তুতি? সে চিঠিতেও আমাকে লেখে—কাঞ্চনমালা, আমার প্রতি আপনার কোনো তুচ্ছ অধিকারবোধ নেই বলেই আপনার অধিকার আমার ওপর সবচাইতে বেশি। সম্পর্কের ভেতরকার দাবি মানুষের সম্পর্ককে জীর্ণ করে। আপনাকে এত বেশি ভালো লাগার এটা অনেক বড় কারণ যে আপনি অনাবশ্যক দাবির কথা তুলে আমাদের অসাধারণ সম্পকটা, জীর্ণ করেন না।

হ্যাঁ—আমি হয়তো সুমিতের কথাগুলোর মতোই একটা চরিত্র। আমি এখন পর্যন্ত কিছু চাই না ওর কাছে। সে-ও না। কিন্তু চাওয়া কি নেই, এমনকি দাবি? আমি আপনমনেই হেসে ফেলি। সে-ও তো মুখে কিছু উচ্চারণ করে না। কিন্তু গত মাসখানেক আগে এই প্রথমবারের মতো, ফাঁকা বাড়িতে বড় চাচাজির বেডরুমে আমরা যখন আচার খুঁজছি, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আচমকা একটা চুমু খেয়ে ফেলেছিল সুমিত। দীর্ঘ সময়ের চুমু। আমি আচারের বয়াম রাখবার সেল্ফটাতে খুঁজে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি মাত্র, কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে একহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে মুখটা অন্যহাতে ঘুরিয়ে গ্রাস করতে শুরু করেছে ঠোঁট দুটো। দম আটকে ছটফট  করতে শুরু করার আগে পর্যন্ত ছাড়েনি। আমি ক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম। প্রতিক্রিয়ায় এক সপ্তাহ আর দেখা করিনি। সেও সাহস করে আমার বাসস্থানে আসেনি। একটা চিঠি পেয়েছিলাম সে সময় তার। অনেক কথার সঙ্গে লিখেছিল যে, আমরা দু’জন পরস্পরকে ভালোবাসি আর বিষয়টাও উপভোগ না করার মতো কিছু ছিল না, তবে ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ কী। এ-ও লিখেছিল—এরকম একটা ঘটনার জন্য কান্নাকাটি করাটা কোনো সোলেমানীয় ব্যাপার না। ‘সোলেমানীয়’ কী? কথাটা আমি বুঝতে পারিনি। এবার জিজ্ঞাসা করতে হবে। আরেকটা ভয় হচ্ছে—এবারও কি একবার সেদিনের মতো দুঃসাহস করে ফেলতে পারে সে? ভাবতেই আমার গায়ে শিহরণ বোধ করি। বজ্জাত। এবার ওকে কাছে আসার সুযোগই দেওয়া যাবে না। অবশ্য সে নির্জনতাও আজ পাবে না। আমরা যে বাসায় দেখা করব, সেটা আবৃত্তিকার দম্পতি ফরহাদ-নাবিলার। ফরহাদ ভাই আর নাবিলা আপা দু’জনেই চাকরিজীবী। তাদের বাসায় আমি আসবো জানালে নাবিলা আপু বলেন—
- সুমিতও আসবে শুনলাম?
- হ্যাঁ। কিন্তু আমি তো এখনো তোমাকে সেটা বলিনি। জানলে কিভাবে।
- ফরহাদ বলেছে। আসো দু’জনেই। কিন্তু মালা, যত দ্রুত সম্ভব সম্পর্কটার পরিণতি ঠিক করে ফেলো। সুমিত খুব অস্থির ধরনের ছেলে।
- কী করব?
- কী করব মানে? আমরা কি করেছি, আমি আর ফরহাদ? জগতের আর সব জুটিরা কী করে? বিয়ে করবে। সরাসরি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে বলবে এবার।

নাবিলা আপার কথার যুক্তি আমাকে প্রভাবিত করে। সুমিতের সঙ্গে সম্পর্কটা নিয়ে একমুখী সিদ্ধান্তে স্থির হয়ে আমি তার মুখোমুখি হবার অপেক্ষায় থাকি।

বাজে ধরনের গরম পড়েছিল সেদিন। বকশিবাজার এলাকায় নাবিলা আপার শ্বশুরবাড়ি। বাড়িটায় তিনতলার ছাদে আরেকটা ফ্লোর করে গোটা অর্ধেক অংশ জুড়ে একটা এ্যাপার্টমেন্ট বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি অর্ধেকটা ছাদ যেন স্নিগ্ধ উঠান। চারপাশে টবের বাগান। ফুলের, ফলেরও। কিন্তু এ মুহূর্তে চারতলার কংক্রিটের উঠান রোদে জ্বলছে। দু’জোড়া ক্লান্ত পা দু’টি পরিশ্রান্ত মানুষকে সেই আঙিনাতে এনে পৌঁছায়। সুমিত আর আমি অথবা আমি আর সুমিত। তবু রক্ষা, চলে তো এলাম। স্বস্তি। স্বস্তির কথা ভাবতে না ভাবতেই আমার মাথায় একটা চক্কর দিয়ে উঠল। অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় বিশাল এক তালা।

আমার মনে হলো ক্লান্তি যেন শতগুণ বেড়ে গেছে। ইচ্ছে করছে কয়েক পা পিছিয়ে ছায়াচ্ছন্ন সিঁড়িঘরেই বসে পড়ি। হঠাৎ চোখে পড়ে, তালার আঙ্টায় একটা কাগজ গুঁজে রাখা। দ্রুত ভাঁজ খুলি। নাবিলা আপার লেখা—মালা, দুঃখিত। ভোরবেলা খুব জরুরি খবর পেয়ে নরসিংদী যেতে হচ্ছে। মা অসুস্থ। রাতের আগে ফিরতে পারব না, ওখানে আজ থেকে যেতেও হতে পারে। তোদের বোঝাপড়াটা আরেকদিন হোক। অবশ্যই, আমার বাড়িতেই হোক। দুঃখিত সোনা।

আমি হতাশ হয়ে সুমিতের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হই। তার মুখে চিন্তার ছায়া নেই। এবং অচিরেই পকেট থেকে চাবি বের করে সে গেট খোলে। আমি প্রায় চিৎকার করে উঠতে গিয়ে সতর্ক হই। গলা খাটো করে বলি
- অ্যাই, কিভাবে?
- ফরহাদ ভাই। চিরকুটে লেখা খবরটা সকালে আমাকে জানালে আমি রিকোয়েস্ট করেছিলাম...।
- কী রিকোয়েস্ট?
- বলেছিলাম, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আজকেই কথা বলা খুব জরুরি।
- নাবিলা আপা?
- জেনে থাকতে পারে, না-ও জানতে পারে। এটা তাদের ব্যাপার। আমরা তো আর লুকিয়ে চুরি করতে আসিনি।
- তবু
- তবু কী। খোদ গৃহকর্তাই তো চাবিসহ প্রবেশাধিকার দিয়েছে। নাকি?
- ধূর। কেমন যেন হয়ে গেল না?
- হ্যাঁ। খুবই ‘কেমন’ হয়ে গেল। এসো ভেতরে।

জ্বলতে থাকা দুপুরের ঝাঁজ থেকে স্নিগ্ধ পরিচ্ছন্ন আরামদায়ক ফ্ল্যাটটিতে ঢুকে আমি মুগ্ধ হই। সুমিতও। ঘুরে ঘুরে দ্যাখে ঘরগুলো। বেডরুমটায় ঢুকতে গিয়ে সুমিত একবার পেছনফিরে তাকায়—‘এসো।’ ও সব সময় আমাকে ‘আপনি’ বলে। আমিও। আজকে সেই প্রথম থেকেই ‘তুমি’ বলছে। বিনা কারণেই কেমন একটা ভয় হয় আমার। দ্বিধার সঙ্গে বলি,
- একজনের অনুপস্থিতিতে তার বেডরুমে ঢুকে পড়া উচিত হয়?
- আরে কী মুশকিল। এ বাড়িটা পুরোটাই আজ আমাদের জন্য বরাদ্দ আছে তো।
- তবু
- আবার তবু। বিছানার পাশে ড্রেসিং টেবিলের সেটিংটা দারুণ না?

সত্যিই দারুণ। এ সংসারে অনেক কিছুই দারুণ। কিন্তু আমরা এসব ‘দারুণ গৃহসজ্জা’ কতক্ষণ দেখব? কথা বলা জরুরি। নিজেদের ভবিষ্যত-পরিকল্পনার কথা। হঠাৎ করেই সুমিত আমার কাঁধে হাত রাখে। আমি চমকে উঠি। সে আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করে না। একজন সম্পূর্ণ আলাদা সুমিত আমাকে সর্বাঙ্গে জড়িয়ে ধরে তীব্র চুমু খেতে থাকে। আমার সাধের পাটভাঙ্গা টাঙ্গাইলের শাড়ি, সাথে রঙমেলানো যাবতীয় আবরণ তার কাছে বাহুল্য বলে সে সব সে অপসারণে ব্যস্ত হয়। আমি একটি মরিয়া প্রাণীর মতোই প্রতিরোধ করতে থাকি। আজন্ম যত্ন-লালিত সংস্কার আমাকে আমার সবচাইতে আকাঙ্ক্ষিত মানুষের বিরুদ্ধে প্রায় যুদ্ধে অবতীর্ণ করে। এক সময় সমস্ত শরীরে অনিচ্ছার মুদ্রা নিয়ে বিছানায় আমাকে কুঁকড়ে থাকতে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে সুমিত—এ সবের কী মানে মালা, এটা কী রকম আচরণ?
- এই কথা তো আমি জিজ্ঞেস করব আপনাকে।
-  না, করবে না। এটাই স্বাভাবিক।
- না।
- তাহলে চলো, ফিরি।

সুমিতের ফিরে যাবার প্রস্তাব শুনে আমার অন্তর আর্তনাদ করে ওঠে—ফিরি মানে? আমরা কি এসবের জন্য এসেছিলাম? আমরা কথা বলব না?
- অবশ্যই বলব। অনেক কথা বলার আছে আজ। একটু সহজ হও।

আমি সহজ হবার চেষ্টা করি। সুমিতও অনেকটা শান্ত, আমার অন্তত তাই মনে হয়। অভয় দেবার ভঙ্গিতে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ। এবং আর কিছুক্ষণ পরেই সে সমস্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। তার প্রাণের ‘কাঞ্চনমালা’ এবার তার আগ্রাসী পৌরুষের কাছে সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। এরপর অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সুমিত। কোনো কথা বলে না। আমার ভেতরে অকারণে একটা ভয়-শিরশিরে অনুভূতি হয়। আর এত অসহায় লাগে ! নিজেই বুঝতে পারি না কখন নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করেছি।
- এতে কান্নাকাটির কী হলো...।
আমি আহত বোধ করছি, তবুও বলি—‘সরি।’
- সেদিন একটা চুমু খাওয়ার পরও তুমি কেঁদেছিলে। এসব কী ন্যাকামো। নাকি বুঝাতে চাও এর আগে কেউ তোমাকে চুমুও খায়নি!

সুমিত ব্যঙ্গ করে বললেও কথাটা সত্যি। কিন্তু এ মুহূর্তে তথ্যটা অর্থহীন লাগে, ওকে তা জানিয়ে কী হবে। বরং তার চোখমুখে নির্মমতার অভিব্যক্তি দেখে আমি বিস্মিত হয়ে পড়ি। সুমিতকে আমি চিনতে পারি না। ওর কণ্ঠস্বর, আমার এত প্রিয় কণ্ঠশিল্পীর নিয়মিত রেওয়াজের স্বর এত কর্কশ! আমার কান্নার বেগ দ্বিগুণ হয়ে উঠছে। কিন্তু আমি নিজেকে সামলে নিই। মনে হয় যেন অন্য কেউ আমার গলায় মরিয়া হয়ে বলছে—এসব কী বলেন আপনি।
- হ্যাঁ, ঠিকই তো বলছি। তুমি এত খুকী নাকি। সামান্য একটা চুমুতেও তুমি ক্ষয়ে গিয়েছিলে?

আকাশপাতাল খুঁজেও এ প্রশ্নের জবাব আমি পাই না। কিন্তু ঠেলে ওঠা কান্নার দমকটা এবার আর সামলাতে পারি না আমি। উপুড় হয়ে দু’হাতের ওপর মুখটা রেখে কাঁদতে থাকি। শুধু বেডকভারটাই আমার শরীর ঢেকে রেখেছে। খানিকটা সময় ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে কাটে। আবার সুমিতের গলা শোনা যায়, এবারে অনেকটাই কোমল—‘শোনো।’
আমার অভিমান হয়। হায় আল্লাহ, এরপরও আমার অভিমান হয়! কিন্তু সত্যিই হয়েছে তো। আমি সাড়া দিই না। আমার তলপেটে খুব ব্যথা, দুই উরুর মাঝখানের গহীনে তীব্র জ্বালা। বরফঠান্ডা পানিতে যদি এক্ষুণি গোসল করা যেত! কিন্তু আমি উঠব না। ও বেরিয়ে যাক এ বাড়ি থেকে। তারপর উঠে, অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে ধুয়ে ফেলে দেব সমস্ত ক্লেদ। সুমিত অপরাধী। সুমিত অপরাধী। আমাকে ফাঁদে ফেলে কলঙ্কিত করেছে সে।
- শোনো, মালা। জরুরি কথা আছে।
আমি মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি সে বেশ শান্ত। আমার মনে হয় যেন কিছুটা আপোষের বা অনুতাপের ভাব ফিরে এসেছে তার মধ্যে। আমি চোখভরা পানি নিয়ে ওর দিকে তাকাই। এখন যেভাবেই হোক, আমি তাকে মনস্থির করাব। আমি তাকে সরাসরি জানাব যে আমার পক্ষে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না। আমরা আজ হোক কাল হোক দ্রুত বিয়ে করব। এরকম একটি ঘটনার পর আমার শরীর-মন আর কারো হতে পারে না। ভিতরে ভিতরে ক্ষীণ একটা আশা দৃঢ় হতে থাকে। সুমিত নিজের ভুল বুঝতে পারছে। এমন রক্ষণশীল একটা সমাজে আমার মতো একটা অসহায় নিরুপায় অভিভাবকহীন মেয়েকে পরিকল্পনা করে ঠকাবার মতো হীন সুমিত নিশ্চয় না। আমার স্ট্রাগলকে, আমার মেধাকে সে তো খুবই সম্মান করে। সে তো জানে, একটি সৎ জীবনের আশায় আমি এই প্রতিকূল সমাজের সমস্ত অশুভ নেতিবাচক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছি। ঘটনার আকস্মিকতায় সে হয়তো খানিকটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। সামলে নিচ্ছে এখন। কত দীর্ঘদিন আমরা এক অপরকে জানি।  

ওকে চিনতে এমন ভুল কিছুতেই হতে পারে না। আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাই,
- কী জরুরী কথা?
- মানে... বলছিলাম, তোমার কি শরীর খারাপ?
আমার গলা বুজে আসে। ওর গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে বলতে ইচ্ছে করে—হ্যাঁ গো সোনা, আমার শরীর খারাপ, খুব খারাপ। মনও খারাপ। তুমি আমাকে আগের মতো আদর করে কথা বলো, আমি ঠিক হয়ে যাব।
বলা হয় না। আমি রুদ্ধস্বর চুপ করে থাকি।
- কিছু বলছো না কেন। তোমার পিরিয়ড চলছে এখন?
এবার আমি প্রশ্নটার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারি। আমার ক্ষোভ হয়—‘পিরিয়ড? না, আমার এখন পিরিয়ড চলছে না।’
- তুমি সিওর?
- হ্যাঁ, সিওর। কেন?  
- এদিকে তাকাও। এটা কী!

আমার সবুজ শাড়ির অর্ধেকটা বিছানায়, অর্ধেকটা বিছানার পাশে রাখা ড্রেসিং টেবিলের সীটার-এ। বিছানায় থাকা অংশটুকুতে বেশ অনেকটা রক্ত। তাজা লাল রক্ত সবুজ কাপড়ে পড়ে সামান্য কালচে দেখাচ্ছে। আমার ভেতরে শিরশির করে ওঠে। অস্বাভাবিক লজ্জায় আমার সর্বাঙ্গ ঝিমঝিম করছে। কুমারীর প্রথম সঙ্গম সম্পর্কে আমার পড়াশোনা ছিল। আমার নিজের জীবনে সেই অপূর্ব ঘটনাটি ঘটেছে। শাড়িটা বিছানায় থাকায় তাতে লেগেছে রক্তের ছোপ।
- বলো, কী এটা।
- আপনি বুঝতে পারছেন না?
কথাটা বলতে গিয়ে আবেগে আমার গলা কেঁপে ওঠে।
- নতুন করে বুঝবার আর কী আছে। বলো তো শেষবার তোমার পিরিয়ড হয়েছে কবে?
আমি একটু হিসাব করে জবাব দেই—প্রায় সতের আঠারো দিন আগে।
- মিথ্যা বলো না মালা। আমার কাছে সতী সাজবার কোনো দরকার নেই। এসব কৌশল বিয়ের রাতে স্বামীর সঙ্গে কোরো।
- কীহ্?

আমার এই আহত জিজ্ঞাসা যেন সুমিতকে আরো হিংস্র করে তোলে। হিসহিসিয়ে বলে,
- আজকে তোমার পিরিয়ডের কত দিন? আর এ অবস্থায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে কেন?

আমি হতভম্ব হয়ে সুমিতের দিকে তাকিয়ে থাকি। তার চোখে তীব্র ঘৃণা। আমার সমস্ত স্বপ্নপ্রাসাদ ভেঙে খান খান হয়ে যায়। সুমিতের প্রতিটা কথা ধারাল চাবুক হয়ে আমার সর্বাঙ্গে আঘাত করতে থাকে। আমার মনকে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকে। আমি সহ্য করতে পারি না। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে—তুমি এখান থেকে যাও সুমিত। তুমি আমার জীবন থেকে একেবারে দূর হয়ে যাও। তুমি একটা মেরুদণ্ডহীন কীট। দায়িত্ব নেবার ভয়ে তুমি আমাকে এমন নোংরাভাবে আক্রমণ করছো।

বলতে চাই, কিন্তু আমার জিভ সরে না। আমার কণ্ঠ স্বরহীন। আমি অকল্পনীয় বিস্ময়ে হতবাক। সুমিত বাথরুমে গেলে আমি উঠে দ্রুত আমার বাসি, ক্লেদাক্ত বেশবাস আবার শরীরে উঠাই। অরণ্যে পশুদের আক্রমণে বিধ্বস্ত বনমানুষের মতো বাকল জড়াই গায়ে। সবুজ বাকল। শাড়ির প্যাঁচটা এমনভাবে জড়াই যেন রক্তের দাগগুলো সহজে দেখা না যায়। হায়, আরব সভ্যতার ইতিহাসে প্রসিদ্ধ কুমারী নারীর পবিত্র রক্ত। পাপস্পর্শহীনতার প্রতীক। কান পাতি, বাথরুমে কলকল করে পানি পড়ার শব্দ। আমার জীবনের প্রথম পুরুষ আমাকে বলাৎকার শেষে গোসল করছে। আমি তার জীবনের কততম নারী? এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসার আর কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বাড়ির চাবিটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে অভুক্ত স্নানহীন ধর্ষিতা এক স্বপ্নভুক নারী বেরিয়ে এসেছিলাম সেদিনের পড়ন্ত দুপুরে। পুড়ন্ত দুপুরে। সেই দুপুরের আগুন সমগ্র জীবন ধরে অপমান সাথী করে জ্বলছেই। সেদিনের পর সুমিত নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছিল। আমিও।

আমার জন্মভূমিতে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আমি তখন শিশু। কিন্তু সেদিনের লক্ষ নারীর সম্ভ্রম হারানোর ইতিহাসে পরবর্তীকালে যোগ দেওয়া আমিও যে একজন সৈনিক, আমার গোপন রক্তও যে বাংলাদেশের সবুজ জমিনে মিশে লাল সূর্যটা তৈরি করেছে, কথাটা আমি আজকের আগে একবারও ভাবিনি। আমার বন্ধু শামীম, আমার গভীর গোপন গ্লানির সাক্ষী শামীম আজ কথাটা আমাকে মনে পড়িয়ে দিয়েছে।

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;