আলো আসে ওখানেও



রেহানা বীথি
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

আতরের কড়া গন্ধটা ঘরময় ছড়ানো। কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠছে ববিতার। মোচড় দিচ্ছে নাভির কাছাকাছি। চোকির ওপর টানটান হয়ে শুয়েছিলো ও। নাভির কাছে মোচড় দিতেই ডানহাতে তলপেটটা চেপে ধরে কুঁকড়ে ফেললো শরীরটা। মাথার কাছের ছোট্ট জানালাটা খোলাই তো আছে, তবু একটুও বাতাস আসছে না কেন? ঘাম চুঁয়ে পড়ছে কানের পাশ দিয়ে বালিশে। উঠে গিয়ে পানি খাবে, না হয় ফ্যানটা চালাবে একটু তার শক্তিও যেন নেই শরীরে।

খুটখুট করে হাসছে বুড়োটা। হামানদিস্তায় পান ছেঁচার মতো একটা শব্দ সেই হাসির। অসহ্য লাগে ববিতার। তাকে নিয়ে মস্করা! এই যে আতরের গন্ধে মোচড় উঠছে তার নাভিতে, তাই নিয়েও মস্করা! শান্তিতে থাকতে দিলো না বুড়োটা তাকে কোনোদিনই। দূর হ, দূর হ! দূর হয় না সহজে। দিনে কিংবা রাতে হানা দেয় যখন তখন ববিতার ঘুপচি ঘরটাতে। আতরের গা গুলানো কড়া গন্ধটা ছড়িয়ে দেয় ঘরময়। সুরমা দেয়া জুলজুলে চোখে শাসনের ভঙ্গিতে তাকায় ববিতার দিকে। ভয় দেখাতে চায়? পাবে না ভয় ববিতা। হাড়কিটকিটে বুড়ো কোথাকার, শাসন করার অধিকার সে পেলো কোত্থেকে!

বহুকষ্টে উঠে ফ্যানটা চালায় ববিতা। গায়ে হাওয়া লাগতেই অনেকটা হালকা লাগলো নিজেকে। ঘরের বাঁদিকে ড্রেনের ঠিক কাছাকাছি গোসলের জায়গা। টিনের বেড়া আর নীল রঙের মোটা পলিথিনে ঢাকা তার আসা যাওয়ার পথটা। সন্ধ্যে হতে দেরি নেই বেশি। গোসল করে নিলো সে। শুধু পেটিকোট আর ব্লাউজ পরেই চলে এলো ঘরে। আতরের গন্ধটা আর নেই এখন। লাল টুকটুকে একটা ফিনফিনে পাতলা শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে বসলো চারকোণার এককোণ ভাঙ্গা আয়নাটার সামনে। মনে হচ্ছে কেউ যেন বালি ঘসে দিয়েছে আয়নাটার ওপর। প্রায় ঝাপসা। তবুও কেমন মায়া ওর এটার ওপর। চাইলেই ফেলে দিয়ে নতুন আয়না কিনতে পারে। কিন্তু... ওই যে, মায়ায় আটকে আছে মন! ঘন কাজল এঁকে নিলো দু'চোখে। গাঢ় লাল লিপস্টিকে ঠোঁটদুটোকে টসটসে করে তুললো। দু'গালেও একটু ছোঁয়ালো সেই লাল। ঠোঁটের ওপরে চন্দ্রবিন্দুর ফোঁটার মতো কালো তিল বসিয়ে ভালো করে আয়নায় দেখলো নিজেকে। চোখে, ঠোঁটে, গালে কামনা উপচে পড়ছে যেন। সারা শরীরে উথাল পাথাল যৌবন। জানে সে, পুরুষের বুকের ভেতর কাঁপন ধরায় তার এই রূপ। তার ঘরের চৌকাঠ ডিঙ্গানো পুরুষের সংখ্যা দেখে ঈর্ষার আগুনে জ্বলে যায় আরতি, বাতাসি, চুমকিরা। বেশ বোঝে সে। ঘনিয়ে আসছে আঁধার। শুরু হয়ে যাবে আনাগোনা রাতের পাখিদের। ঘরের সাথে লাগোয়া একচিলতে বারান্দাটায় গিয়ে বসলো ববিতা। বসে আছে অন্যরাও নিজেদের ঘরের সামনে। খিলখিলিয়ে হাসছে উৎকট প্রসাধনে ঢাকা মুখগুলো।

লাইটপোস্টের আলোটা তেরছাভাবে এসে পড়েছে ববিতার মুখের ওপর। সেই আলোটা ঢেকে দিয়ে একটা লম্বা ছায়া এসে দাঁড়ালো একেবারে ওর পাশটিতে। বললো, যাবি?

হাতে দামি মোবাইল, ভীষণ সভ্য পোশাকের মানুষটাকে দেখে চমকে গেলো ববিতা। গলির মোড়ে দাঁড়ানো লাল টুকটুকে গাড়িটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকেই। এই বস্তিতে এমন গাড়ির মালিক! স্বপ্ন দেখছে না তো! গায়ে চিমটি কেটে দেখবে নাকি? তখনই আবার শুনতে পেলো,

কী রে, যাবি না?

অন্ধকার ঘরটা দামি পারফিউমের সুগন্ধে ভরে গেলো। বাতি জ্বালাতে দেয়নি লোকটা। আঁধারেই অনুভবে আসে, লোকটা কাঙ্গাল। এতকিছু থেকেও নিঃস্ব একেবারে। আলোতে আসুক তার এই নিঃস্বতা হয়তো চায় না সে। তাই আঁধারে এসে আবার মিলিয়ে গেলো আঁধারেই, কে জানে! যাওয়ার আগে ফিসফিসিয়ে শুধু বলে গেলো...... শুনেছিলাম তুই জাদু জানিস। সত্যি, একদম সত্যি!

অবসন্ন শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ববিতা। আজ রাতে আর কেউ পার হোক তার দরজার চৌকাঠ চায়নি সে। কয়েকটা কড়কড়ে হাজার টাকার নোট দিয়ে গেছে আঁধারে মিলিয়ে যাওয়া লোকটা। তাছাড়া শরীরটাও ঝিমিয়ে আছে সেই বিকেল থেকেই। চোখের পাতা ভারি হতে হতে যেন তলিয়ে গেলো কোনো এক অতল গহ্বরে। তলিয়ে যেতে যেতে হাজার প্রজাপতির ভীড়ে খুঁজে পেলো নিজেকে। যেন বকুল বিছানো একটা পথ, যেন জলে ধোয়া ঝকঝকে প্রকৃতি চারপাশে। নাম না জানা কত ফুল, আর অসংখ্য প্রজাপতি। মিলিয়ে যাবো যাবো করেও সূর্যটা রয়েই যাচ্ছে যেন। হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে, ফুলি...........

আতরের গন্ধটা নাকে ধাক্কা দিতেই ফিরে এলো সেই গহ্বর থেকে। বুড়োটা তাকিয়ে আছে সোজা ওর চোখের দিকে। এমন চাবুকের মতো সেই চাহনি, ভেতরটা কাঠ কাঠ হয়ে গেলো ববিতার। তবুও বুঝতে দিলো না বুড়োকে। বুড়োর ওই চাহনিকে তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে এলো। ঘরের পশ্চিমে, যেদিকে একটা কাঠের চেয়ার টেবিল আছে, দাঁড়ালো সেদিকটায় এসে। বুড়ো তাকিয়ে তেমনই।

--- অতো দূরে গেলা ক্যান ফুলি? কাছে আসো, তুমি না বউ আমার!

--- খবরদার কইতাসি, আর একটা কতা না। এক্ষণই বাইরান আমার ঘর থাইকা! পিরিত দেখাবার আইসেন? বুড়া মাইনষের এত পিরিত ক্যান? আমার জীবনডা শ্যাষ কইরাও শান্তি হয় নাই আপনের?

--- আহা, চ্যাতো ক্যান ফুলি? তুমার তো খুশি হওনের কতা, এত বড়লোকের সাতে বিয়া হইসে। কত আরাম আয়েশ তুমার। গয়না শাড়ি ভালো খাওন! কুনুদিন কি ভাববার পারসিলা, এইসব পাইবা? পারো নাই। তবুও পাইসো। পাইয়াও দিগদাড়ি করো। পরপুরুষের লগে রাইত কাটাও? এইডা আমি কেমনে মাইনা লই, কও তুমি?

--- মানতে না পারলে চক্ষু মুইদা থাকেন। কে কইছে আপনেরে দেখতে?

--- বেগানা পুরুষের লগে মেলামেশা ঠিক না ফুলি, আল্লাহ্ নারাজ হয়। দোজখের আগুনে ভাজা ভাজা হইবার চাও? এখনও সময় আছে, শুনো আমার কতা। বিয়ার পর কত হাউস কইরা তুমারে বোরখা বানাইয়া দিলাম, পর্দায় চলাফেরা করবা বইলা। বড় ঘরের বউ ঝি রা সারাক্ষণ পর্দা মাইনা চলে। বাইরের পুরুষের সামনে মুখ দেখানোও তাগো পাপ। আর তুমি কিনা......! যাউগ্গা, কই ফালাইসো সেই বোরখা খান। আবার বানায় লও। এহন তো আমি বানায় দিতে পারবো না। পারলে তোমারে এমুন বেপর্দা চলতে দিই? জোর কইরা আটকাইতাম। কিন্তু আল্লাহ্ আমারে তুইলা নিলো। বড় অসময়ে তুইলা নিলো! তুমার মতো কচি বউরে সাপখোপের মইদ্যে রাইখাই তুইলা নিলো। এই আপসোস আমার কুনুদিন ফুরাইবো না ফুলি! তাই তো ঘুইরা ফিইরা তুমার কাছে আসি। তুমি রাগ হও তাও আসি।

অতৃপ্তিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো বুড়ো। সুরমার আড়ালে একটু বোধহয় নোনাজলও উঁকি দিলো চোখে। দিক, তাতে ফুলির কী! শুধু টাকা পয়সাই সব? গলা পর্যন্ত কবরে যার সেই বুড়ো কিনা বিয়ে করলো চৌদ্দ বছরের ফুলিকে! কী? না, বউ মরেছে।

বুড়া বয়সে বউ তো মরতেই পারে। ছেলে, বৌমা,নাতি, নাতনিতে ভর্তি বাড়িঘর। তারা নাকি কেউ তার যত্ন নিতে পারবে না। বিয়ে করা লাগবেই।

পরনে একটা বেঢপ ঘটিপ্যান্ট আর কোমরের কুঁচি ছিঁড়ে ঝুলতে থাকা একটা চিটচিটে ময়লা জামা গায়ে ফুলি বেগম মায়ের আঙুল ধরে গিয়েছিলো আক্কাস মিয়ার বাড়িতে। সদ্য স্বামী হারানো তার মা কাজের আশায় গিয়েছিলো ওবাড়িতে। পানের রসে টইটুম্বুর মুখে আক্কাস মিয়ার স্ত্রী বলেছিলো, আইচ্ছা রাখলাম তুমারে, তয় মাইয়াডারে সাতে আইনো না। পোলাপান কামের সময় বড় ত্যক্ত করে।

--- বয়স কত তুমার মাইয়ার?

-- ছয়। তয় আম্মা, অরে রাখোনের কুনু জায়গা নাই। খুব ঠাণ্ডা মাইয়া, আপনেরে একটুও ত্যক্ত করবো না।

--- ঠিক আছে, আইনো তাইলে। তয় সাবধান কিন্তু।

তারপর রোজ মায়ের আঙুল ধরে ভোরবেলায় আসে ফুলি। খায় দায়, জামাকাপড়ও জোটে। একমাথা পাটের আঁশের মতো চুলগুলো তেলে চুপচুপে। সুগন্ধী সাবানে গায়ের কালো হয়ে আসা রঙ ধুয়ে মাজা মাজা শ্যামলা রঙটা হাসিমুখে বেরিয়ে পড়ে যেন। নজরে আসতে থাকে তার মায়া মায়া মুখটা। এই মায়াভরা মুখটার কারণেই হোক, আর ছুটে ছুটে এর তার ফাই ফরমাস খাটার কারণেই হোক, প্রিয় হয়ে গেলো সবার কাছে ফুলি বেগম। একে একে আটটি বছর কেটে গেলো তাদের এ বাড়িতে। সরকারের খাস জমির কুঁড়েঘর থেকে উচ্ছেদের পর এ বাড়ির রান্নাঘরের এক কোণায় জায়গা হয়েছিলো তাদের। কৃতজ্ঞতায় মা তার গদ গদ।

মালকিনের মৃত্যুর চল্লিশ দিন পার হতে যত দেরি, তারপরেই বৃদ্ধ আক্কাস মিয়া জেদ ধরে বিয়ে করার। ছেলেদের তো মাথায় হাত, বুড়ো বাপের এ কী ভীমরতি! ফুলি যে ফুলি, যে কিনা বেড়ে উঠলো চোক্ষের সামনে, তার চেয়েও বড় বয়সের নাতি নাতনি আক্কাস মিয়ার, তারে কিনা বিয়া করবার চায় সেই আক্কাস মিয়াই! তাগোরই বাপ! হায় আল্লাহ্!

নাহ্, আল্লাহ্ আক্কাস মিয়ার ছেলেমেয়েদের হাহাকারে সাড়া দেয়ার সুযোগই পায়নি। তার আগেই বাড়ির লাগোয়া দু'কাঠা ভিটে ফুলির নামে লিখে দেয়ায় হাত হয়ে গেলো ফুলির মা।

স্বপ্নেও ভুল করে কখনও চায়নি যা, পেয়ে গেলো। মালকিনের দুই একটা গয়না, সোনালী জরির ঝকমকে বেনারসি আরও কত কী! ফুলি তার রাজরাণী এখন। সুখে তার রাতের ঘুম যায় যায়।

বুড়োর সাদা জোব্বা থেকে আতরের গন্ধটা বাতাসে ভেসে ভেসে যেন ববিতার মাথার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। অসহ্য....অসহ্য! দু'হাতে মাথা চেপে ধরে ধপ করে চেয়ারটায় বসে পড়লো সে। হামানদিস্তায় পান ছেঁচা হাসিটা বেশ কায়দা করে এমন সময়েই হাসলো বুড়ো। এক ঝটকায় উঠে ঘরের বাতিটা জ্বেলে দিলো ববিতা। কেউ নেই। বুক ভরে শ্বাস নিলো ও, আহ্..... আতরের গন্ধটাও নেই! রাত বাকি আছে আরও কিছুটা। বাইরে অন্ধকার এখনও অনেক গাঢ়। নিবিড় এই আঁধারে কিছু মুহূর্ত খুব মিষ্টি পরশ বুলিয়ে দিলো যেন ববিতার চোখে। যদিও মুহূর্তগুলো পেরিয়ে এসেছে অনেকটা সময়। তবুও সেগুলো ভালোলাগার প্রলেপ দিলো ওর বেদনায়। সদ্য পাঁপড়ি মেলা গন্ধরাজের মতো বউটাকে সবসময় চোখে চোখে রাখতো বুড়ো। জড়িয়ে ধরে আদর করতে চাইতো যখন তখন। কিন্তু চাইলেই কি আর হয়? ঝিমিয়ে যাওয়া যৌবন তার কেন যেন জাগতেই চাইতো না! নিষ্ফল চেষ্টার পরিশ্রমে ঘুমে ঢলে পড়তো বুড়ো। দু'হাতের শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে রাখা ফুলি আলগা হয়ে যেতো কখন টেরই পেতো না! চুপিচুপি সেই বাঁধন আরও খানিকটা আলগা করে ফুলি তখন উঠে পড়তো। বুড়োর ঘরের সাথে লাগানো বাথরুমে গিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে ঠান্ডা পানির ধারা বইয়ে দিতো শরীরে। সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে বুড়োর ব্যবহৃত আতরের গন্ধ দূর করার চেষ্টা করতো প্রাণপণে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে গাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো ফুলিও। একদিন কি ভেবে সিঁড়িভেঙ্গে উঠে পড়লো ছাদে। বিশাল ছাদ। আগে কত উঠেছে, কিন্তু বিয়ের পর বুড়োর কড়া বারণ। দীর্ঘ বিরতির পর হঠাৎ ছাদে যেতে কেমন যেন ভয় ভয় করছিলো ফুলির। তারওপর আবার গভীর রাত। বুড়ো টের পেলে কি হবে কে জানে! তবুও উঠে গিয়েছিলো ও। ভীষণ আঁধার চোখে সয়ে যাওয়ার পর তো ফুলি তাজ্জব! তার আগেই কে যেন এসে বসে আছে ছাদে। একটা ছায়া যেন নড়ে উঠলো তার আভাস পেয়ে। ঘুরে এক্কেবারে ফুলির দিকেই তাকালো। আতঙ্কে ছুটে সিঁড়ির দিকে চলে আসতে চাইলো ফুলি, কিন্তু পারলো না। তার আগেই জাপটে ধরলো ফুলিকে সেই ছায়া। চিৎকার করতে চাইলো ফুলি, কিন্তু শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া ফুলির গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই বের হলো না। ছায়াটি ততক্ষণে ওকে ধরে বসিয়ে দিয়ে বললো, এত ভয় পেলে চলে? বলে হাসতে লাগলো।

বুঝলো ফুলি, আক্কাস মিয়ার মেজো নাতি। মেলা বড় পাশ দিবো বইলা যে শহরেই থাকে। ছুটি ছাটায় বাড়িতে আসে। লজ্জায় ফুলি আরও কাঠ হয়ে গেলো।

--- তুমি কি রোজ রাতেই ছাদে আসো?

ফুলি মাথা নাড়ে জোরে জোরে। এই পোরথম, বিশ্বাস করেন বিয়ার পর এই পোরথম!

--- ও আচ্ছা, এত ভয় পাচ্ছো কেন?

--- দোহাই লাগে, আপনের দাদাজানরে কিছু কইয়েন না। আর কুনুদিন আসুম না আমি!

আবার হেসে উঠলো আক্কাস মিয়ার নাতি।

--- বলবো না। কিন্তু কাল রাতে যদি আবার আসো তবে। তা না হলে বলে দিতে পারি!

ধান্দায় পড়ে গেলো ফুলি। এই পোলা তারে রাইতের কালে ছাদে ডাকে ক্যান? ভুল কইরা একদিন নাহয় আইসা পড়সে, তাই বইলা আবার! যদি ধরা পইড়া যায়! কিন্তু..... না আইলে যদি কইয়া দেয়! এই দোটানায় দুলতে দুলতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে চলে আসে। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ে ঘাপটি মেরে। নাহ্, জাগেনি বুড়ো। কিন্তু হৃদয়ে কেমন যেন তোলপাড় হতে থাকে। বাকি রাত দুই চক্ষে আর নামে না ঘুম। বড় অস্থির... বড়ই অস্থির ফুলি আজ। অচেনা..... ভীষণ অচেনা এক ইচ্ছে জেগে উঠছে বুকের ভেতর। এক অজানা কাঁপন টের পাচ্ছে সে। প্রস্ফুটিত যৌবন তার যেন বাঁধন আলগা করে জেগে উঠতে চাইছে ভীষণভাবে। বুড়োর স্পর্শে কোনোদিন এমন হয়নি তো! কিন্তু.... ও যে বুড়ো আক্কাস মিয়ার বিয়ে করা বউ। তবে কেন অন্য কারো ছোঁয়ায় কাঁপছে তার বুক ভালোলাগায়? শরীরে তার এত আবেশ কেন জাগলো ওই ছোঁয়ায়? কী করবে ও এখন? পরপুরুষের কথা ভাবনায় আনাও যে পাপ। কিন্তু শরীর যে চাইছে! অচেনাকে জানার প্রবল ইচ্ছেটাকে কেমন করে চেপে রাখবে ফুলি? অন্ধকার ছাদ যে তাকে ডাকছে বার বার! সেই ডাক উপেক্ষা করার শক্তি আছে কি তার? না নেই। আর কেনই বা উপেক্ষা করবে ফুলি সেই ডাক? যাবে সে। কাল রাতে যাবে সে ছাদের অন্ধকারে।

পরের রাতে গিয়েছিলো ফুলি সেই অন্ধকার ছাদে। মিয়ার নাতি যেন অপেক্ষায় ছিলো ভীষণ। ফুলি যেতেই এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিলো যেন দম আটকে যাবে। যেন তার গরম নিঃশ্বাসে পুড়িয়ে দেবে ফুলিকে। সারাগায়ে গতরাতের সেই অদ্ভুত শিহরণ টের পেয়েছিলো ফুলি। আগে কখনও এমন শিহরণ অনুভবে আসেনি তার। সেই শিহরণে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ফুলি যেন নিজের ভেতর দেখতে পেলো একটা দু'কূল ছাপানো নদী। আর সেই নদীর ছলাৎছল ঢেউয়ে দুলতে দুলতে চলে গেলো সে বহুদূর... বহুদূর! যেন হারিয়ে গেলো।

তারপরে ছুটির প্রায় প্রতিটি রাত ছিলো ওদের হারিয়ে যাওয়ার রাত। হারাতে হারাতে ফুলি শুনতে পেতো সেই যুবকের প্রেমের কথা, ভালোবাসার কথা। হতবাক ফুলি তখন চৌদ্দ ছেড়ে আঠারোয়। তবুও শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা যুবকের কথাগুলো কেমন যেন দুর্বোধ্য লাগতো তার কাছে। কেমন যেন ভয়, তবুও অদ্ভুত এক আবেশ। সেই আবেশের প্রতীক্ষায় থাকতো দু'জনেই সবার অলক্ষে।

এরপরের ঘটনাগুলো ঘটে যায় খুব দ্রুত। যেন স্বপ্ন! এক জ্যোৎস্নারাতে আক্কাস মিয়া এ সংসারের মায়া ছেড়ে, তার টলোমলো যৌবনবতী বউকে ছেড়ে চলে গেলো ওপারে। মিয়াসাহেবের ছেলেরা তাদের বাপের বউটাকে আর স্বীকারই করতে চাইলো না! জোর করে সাদা কাগজে বুড়ো আঙুলের টিপ নিয়ে তাড়িয়ে দিলো ফুলিকে। ফুলির মা বুক চাপড়িয়ে অভিশাপ দিতে দিতে বেরিয়ে এসেছিলো ও বাড়ি থেকে মেয়ের আঙুল ধরে। মিয়ার সেই নাতি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখেছিলো সব। এমন ভাব যেন ফুলিকে সে চেনেই না! কেন যেন একটুও কাঁদেনি ফুলি। শক্তমুখে মায়ের আঙুল ধরে বেরিয়ে এসে হাঁটা দিয়েছিলো অজানার পথে। গাঁয়ের শেষ মাথায় শাপলা বোঝাই দীঘিটার পাড়ে যে বিরাট আমগাছটা, তার নিচে যে মাটির বাড়িটা, সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে একজন জানতে চেয়েছিলো সমাচার। কেঁদেকেটে ফুলির মা বলেছিলো সব। সেই একজনকে ভাই বলেও সম্বোধন করছিলো ফুলির মা। সেই ভাই সব শুনে বললো, শহরে কামের ছড়াছড়ি। মাইয়ারে পাঠাও আমার লগে। হাজার হাজার টাকা কামাইয়া পরে তুমার মাইয়াই লইয়া যাইবো তুমারে। ততদিন তুমি আমাগো বাড়িতেই থাকো, চিন্তার কিসু নাই। কোন দূর সম্পর্কের ভাই, যাকে ফুলি তো দূরের কথা, ফুলির মাও কোনোদিন তাদের খোঁজখবর নিতে দেখেনি। না নিক, এই অসময়ে তাদের পাশে তো দাঁড়াতে চাইছে, কম কী! একেবারে গলে গিয়ে ফুলির মা পাঠিয়ে দিলো মেয়েকে। মায়ের সেই ভাই ফুলিকে শহরে নিয়ে এসে বেঁচে দিলো এই রঙমাখা বস্তিতে। মা তার জানতেই পারলো না, ফুলি তার কখন কখন ববিতা হয়ে গেলো!

এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরেও কেন যেন ভুলতে পারে না ববিতা সেই আঁধার ছাদের শিহরণ। দুখে ভরপুর জীবনে সেটুকুই একটু সুখের স্মৃতি বলেই হয়তো! একথা মনে হতেই আর রাগ থাকে না তাকে কয়েকদিনের আদরে ভরিয়ে দেয়া সেই যুবকের ওপর। কিন্তু বুড়ো আক্কাস মিয়া! বুঝতো না বলে বিয়েটা তখন বড় প্রাপ্তি মনে হয়েছিলো ফুলি আর তার মায়ের। কিন্তু ঠকেছে তো সে বুড়োর কারণেই! দু'কাঠা মাটির লোভে ঠকানো হয়নি তাকে! অবশ্য বউ বলে একটু আধটু ভালোও কি বাসতো বুড়ো তাকে? কে জানে! সবসময় তো চোখে চোখে রেখে জীবন অতীষ্ট করে তুলেছিলো। এখন আবার তার ঘুপচি ঘরে এসে তাকে শাসন করার চেষ্টা! টিপছাপ নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলো যখন, তখন তো কব্বর থেকে একবারও আসেনি সে! এখন আবার শাসন দেখায়! কিসের শাসন! না খেয়ে মরবে নাকি ববিতা? তাছাড়া এখন তো সে ফুলি নয়, ববিতা। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত একটু ঘনালেই কত টাকা আসে তার হাতে! সেই যে বিক্রি হয়ে গেলো ফুলি, তারপর আর যায়নি গাঁয়ে। কোন মুখে যাবে? টাকা পয়সা পাঠিয়েছে মাকে। পরে যখন একটা মোবাইলের মালিক হলো সে, কথাও হতো তখন মায়ের সাথে। তবে খুব কম। মায়ের সেই ভাই ফোন দিতে চাইতো না মাকে, নানান টালবাহানা। খুব কাহিল গলায় কথা বলতো ওর মা। টাকা পেয়েছে কিনা জানতে চাইলে কেমন আমতা আমতা করে বলতো, পেয়েছে।

হঠাৎ একদিন শুনতে পেলো, মরে গেছে ফুলির মা। সেদিন খুব কেঁদেছিলো ফুলি। আর কেউই যে রইলো না তার!

দু'চোখ জ্বালা করে উঠলো ববিতার। বাতিটা নিভিয়ে বিছানার পাশের জানালাটা খুলে দিলো। কোথাও শিউলী ফুটেছে কী? ফোটারই কথা। একটু যেন হিম হিম বাতাসে ভেসে এলো তার সুবাস! দূর্বা ঘাসে জমে কি এখনও শিশির সেই গাঁয়ে? পথের ধারের কলমিঝোপে এখনও ফোটে কি সাদা কিন্তু সাদা নয়, ঠিক বেগুনীও নয় আবার গোলাপীও নয়, এমন কলমি ফুলগুলো?

আহ্..... ধীরে ধীরে বাড়ছে শিউলীর সুবাসটা। গুমোট ঘরটা তার ভরে যাচ্ছে মিষ্টি গন্ধে। বুক ভরে স্বাস নিলো ববিতা। একবার, দুইবার, তিনবার.......

হঠাৎ আবার সেই অনুভূতি। সেই আতরের গন্ধ, সেই মোচড় নাভির চারপাশে। নাহ্, একেবারে পেয়ে বসেছে যেন তাকে গন্ধটা! গা গুলিয়ে ওঠার আগেই বেরিয়ে আসতে হবে ওখান থেকে। আর চায় না পেতে ও সেই গন্ধ, সেই হামানদিস্তায় পানছেঁচা হাসিটাও শুনতে চায় না আর। ওসব ওর অতীত। যে অতীতে ফুলি ছিলো। এখন নেই। এখন ববিতা আছে, আছে রাতের বস্তি, খিলখিল হাসি। এখানেও ভোর আসে, শিউলীর সুবাস আসে, আলো আসে জানালা দিয়ে । ওই যে, একটু একটু ফর্সা হচ্ছে আকাশের পুব দিকটা............

 

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;