কবি সুবোধ সরকারের সাক্ষাৎকার



ভূমিকা ও সাক্ষাৎকার: শিমুল সালাহ্উদ্দিন
kobi

kobi

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের পাঠকের সামনে বসলে আমার মনে হয় যেন আমি নিজের সামনে বসেছি।
—সুবোধ সরকার

নিজের শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় বলেছেন, কবিতার গা থেকে সমস্ত গয়না খুলে ফেলতে চান তিনি। সুবোধ সরকারকে বাংলাদেশের মানুষ বেশিরভাগ চেনে মঞ্চে মঞ্চে তুমুল জনপ্রিয় কবিতা ‘শাড়ি’ বা কাল্লু’র কবি হিসেবে। দুই বাংলায়ই আবৃত্তিশিল্পীরা সুবোধ সরকারের অজস্র কবিতা পৌঁছে দিয়েছেন শ্রোতাদের কানে। সুবোধ সরকারের শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকাটি আমার খুব ভালো লেগেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবৃত্তি সংগঠন ধ্বনির পাঠাগারে, সেই ২০০৩/০৪ সালে। সেই প্রথম পরিচয় সুবোধ সরকারের সাথে।

ধ্বনির পাঠাগারে সুবোধ সরকারের দুটি বই ছিল। ‘কাল্লু’ আর ‘আমি কারো অন্ধকার নই’। কাল্লুর ভূমিকায় একটা লাইন খুব তাড়িয়ে ফিরত তখনকার সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ আমাকে—“ওগো মৌলবাদ, তুমি আমাদের গলায় ঝুলে থাকা অ্যালবাট্রস, কবে আমাদের ছেড়ে যাবে?”

প্রায় এক যুগ হয়ে গেল সুবোধ সরকার পড়ছি। বলতে দ্বিধা নেই, ভালোলাগা নিয়েই পড়ছি। তাঁর বেশিরভাগ কবিতা সংবাদমূলক গল্পনির্ভর, খুব সহজে পাঠককের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে সুবোধ সরকারের।

জন্মেছিলেন ১৯৫৮ সালের ২৮ অক্টোবর, কৃষ্ণনগরে। শরণার্থী পরিবারের ছেলে বলেই কি অদ্ভুত এক প্রেম ও সংবেদন আছে সুবোধ সরকারের হৃদয়ে! পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় এই কবি ২০১৩ সালে নিজের রচনাকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ২৮টি। এর মধ্যে আছে—একা নরকগামী (১৯৮৮), রাজনীতি করবেন না (১৯৯৭), ভালো জায়গাটা কোথায় (২০০১), জেরুজালেম থেকে মেদিনীপুর (২০০১), সব রাস্তা রোমে যায় না (২০০১), কাল্লু (২০০৩), মণিপুরের মা (২০০৫), যা উপনিষদ তাই কোরাণ (২০০৬), প্রতিবাদের কবিতা (২০০৭)।

সম্পাদনা করেন সাহিত্যের কাগজ ‘ভাষানগর’। কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের সঙ্গে জুটি বেঁধে কাটিয়েছেন এক প্রেমময় কবিতাজীবন। প্রচণ্ড বিতর্ক ও আক্রমণের শিকার হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলকে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে।

এই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছে কবির সিরিটির বাসায়, কোলকাতার টালিগঞ্জে, ২০১৭ সালের ৩ মার্চ, সকালে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সুবোধদা, আপনার বাড়িতে এলাম, সেটা আমার জন্য একটা বড় অভিজ্ঞতাই বটে। আপনি আমার খুবই প্রিয় কবি। শুধুমাত্র আপনি না, আপনারা দুজনই, যেই অর্থে আমরা দুজন বলি। এবং মল্লিকাদির কবিতা, আপনার কবিতা, আপনারা যখন এখানে দুরন্ত সময় কাটাচ্ছেন, আপনাদের একের পর এক বই বেরুচ্ছে, সেই সময়গুলোতে ঢাকায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। ফলে আমরা আমাদের মতো করে, জাহাঙ্গীরনগরে যে কবিতা-সমাজ ছিল; এক ধরনের যাপন ছিল আমাদের, পঠন ও মিথস্ক্রিয়া ছিল, আমাদের মধ্যে—আপনারা প্রচণ্ড রকমের প্রভাব রেখেছিলেন। আমাদের মনে হতো যে, আমরা কেউ কেউ সুবোধ-মল্লিকা হয়ে উঠব। মল্লিকাদি নাই এখন, এটা ভয়ঙ্কর বেদনার ব্যাপার আমাদের জন্য। দাদা, কেমন আছেন দিয়েই শুরু হোক।

সুবোধ সরকার: যে যেরকমভাবেই থাকুক না কেন, আমি যেরকমভাবেই থাকি না কেন, তুমি যেরকমভাবেই থাকো না কেন, আসলে আমরা কিন্তু সবাই ভালো থাকি, ভালো থাকতেই হয়। মল্লিকা চলে গেছে, এই প্রসঙ্গটা তুমি আবার শুরুতেই তুলে আনলে, কিন্তু তুমি যদি এই প্রশ্নটা মল্লিকাকে করো, মল্লিকাও হয়তো বলবে ভালো আছি। ঠিক সেরকমভাবেই আমাদের কারুর কোনো অধিকার নেই এই পৃথিবীতে বলার যে, পৃথিবী তুমি আমাকে ভালো রাখোনি। বা সমাজ তুমি আমাকে ভালো রাখোনি। এটা বলার কারো অধিকার নেই। আমরা ভালো আছি, আমি তো ভালো আছি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা, আপনার, আপনাদের বইপত্র আমাদের ওখানে, ঢাকায়, অনেক পরে পৌঁছায়—

সুবোধ সরকার: হ্যাঁ, কলকাতার বই তো অনেক দেরিতে যায়, শুনেছি অনেকের কাছেই।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আমাদের বই তো আসেই না! না?

সুবোধ সরকার: আসে না এমন নয়, আমি তো ঢাকা থেকে নিয়মিত বই আনাই। সীমান্ত আর কাঁটাতার বইয়ের আদানপ্রদানকে কঠিন করে দিয়েছে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: হ্যাঁ, ধরেন গত বছরের বই এ বছর পেলাম আমরা। পশ্চিমবঙ্গের বা ভারতের সিনেমা আমাদের ওখানে মুক্তি পায় না, যেমন পায় না বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কলকাতায়। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের বা ভারতের বইপত্র আমাদের ওখানে অনেক দেরিতে যায়। যাদের প্রচণ্ড আগ্রহ আছে তারা ইউটিউবে খুঁজে এখানকার সিনেমাটা দেখে, আমরাও অনেক বেশি খুঁজে পেতে হয়তো মাসে একদিন আজিজে গিয়ে আপনাদের বইটা খুঁজে বের করি। প্রসেসটা অনেক লেন্থি, প্রলম্বিত। আপনার সর্বশেষ কী বই বেরুলো?

সুবোধ সরকার: এই তো কদিন আগেই বেরিয়েছে, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা শেষ হলো, এখানে আমার একটি বই বেরিয়েছে, সিগনেট থেকে, এই বইটির নাম এবার অনেক বড় একটি নাম আমি দিয়েছি। আমি আসলে ছোট ছোট নাম দিই কবিতার বইয়ের। যেমন: ‘ছি’, ‘কাল্লু’—সব ছোট ছোট নাম। কিন্তু এবারের এই বইটির নাম বেশ বড়, সম্ভবত সবচেয়ে বড় নামের বই, ‘তিন মিনিট বাইশ সেকেন্ডে বিপ্লব আসে না’। এই বইটির পরিকল্পনা সম্পূর্ণ অন্যরকমভাবে করা হয়েছিল। আমি নকশাল আন্দোলনের সময়কার ছেলে। আমি যখন স্কুলে যেতাম, কৃষ্ণনগর নামে একটা ছোট্ট শহর, সেখানে নকশাল আন্দোলন বিরাট আকার নিয়েছিল। স্কুলে যেতাম, যাওয়ার সময় ডানদিকে ডেডবডি পড়ে থাকতে দেখেছি, ফেরার সময় হয়তো বামদিকে ডেডবডি পড়ে থাকতে দেখেছি। এর মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছিলাম। এর মধ্যেই বেঁচে ছিলাম। মরেই যেতে পারতাম যে কোনো দিনে। কিন্তু এরপর আরো এরকম নকশাল আন্দোলন, তার পরবর্তী সময়ের অনেক আন্দোলন করে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত অনেক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা এসছি। তো আমার তিনটে দীর্ঘ কবিতা আছে এই বইতে। সেই তিনটে দীর্ঘ কবিতাই হচ্ছে বিভিন্ন সময়ের আন্দোলনের আংশিক সফলতা এবং বৃহত্তর ব্যর্থতা, এগুলোর কথা যেমন আছে, তেমনি স্বপ্ন দেখার কথা আছে। প্রায় আত্মজৈবনিক। কিন্তু সঙ্গে দুটো ছোট কবিতাও আছে। শেষ যে কবিতাটা আছে, সেটা হচ্ছে, ভারতবর্ষ, যে বিষয়টা নিয়ে একেবারে তোলপাড়, ডিমোনিটাইজেশন অর্থাৎ নোট বাতিল—এটা নিয়ে একটা সাংঘাতিক জায়গায় এসে আমরা দাঁড়িয়েছি। গরিবের জন্য একটা অর্থনৈতিক দুর্ভিক্ষ তৈরি করা। কালো টাকা ফিরিয়ে আনা হবে বিদেশ থেকে এটা বলা হয়েছিল, কিন্তু কালো টাকা তো ফেরেনি! তার বদলে সাধারণ গরিব মানুষ না খেতে পেয়ে মরছে। তো আমার ওই শেষ কবিতাটায় একজন বিজন মাহাতো, বিজন মাহাতো হচ্ছে যার কোনো এটিএম কার্ড নেই। সে এক চা-বাগানের ছেলে। সে হতে পারে জঙ্গল-মহলের ছেলে। সে একটা গ্রামের ছেলে। হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি মানুষ ভারতবর্ষে রয়েছে যাদের কোনো এটিএম কার্ড নেই। কোনো কার্ডের অবকাশ নেই।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: কিংবা ব্যাংকে একাউন্ট নেই।

সুবোধ সরকার: অথচ ইন্ডিয়াকে বলা হচ্ছে ডিজিটাইজ করা হবে। এই যে প্যারাডক্স, এই প্যারাডক্সের জায়গা থেকেও একটা কবিতা আছে। সুতরাং এই কবিতাগুলো নিয়ে হচ্ছে তোমার তিন মিনিট বাইশ সেকেন্ডে বিপ্লব আসে না। এটাকে আমি ব্যঙ্গ করেই বলেছি। এত তাড়াতাড়ি বিপ্লব হয় না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, নিয়ে চাপিয়ে দিলাম সাধারণ মানুষের উপরে, জনগণের উপরে এবং বললাম বিপ্লব হয়ে গেছে। অতো সস্তা না। তো সেটাকেই বিদ্রুপ করে লিখেছি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা এখন যে সামাজিক অবস্থা চলছে ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, আমরা জানি আপনি রাজপথের সরব কবি, আপনার কবিতায় সব সময় গণমানুষের বেদনা-ব্যথা-কথাই আসলে উঠে এসেছে। আপনি আর্তের, নিপীড়িতের পাশে দাঁড়িয়েই আসলে কবিতা লেখেন। আপনার শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকা আমাকে সব সময় তাড়িত করে—যে ট্রেনের ওইপারে আরেকটা লোক যে আধখানা রুটি পাবে কি পাবে না সেটা নিয়ে যে আর্টথিংকিং.... ফলে আপনি মানুষের কথা বলেছেন। সেজন্য আপনি বাংলাদেশে, আমি এখানকার কথা জানি না, বাংলাদেশে আপনি সাধারণ মানুষের কাছে ভয়ঙ্করভাবে গৃহীত বলে আমার মনে হয়। আপনার কবিতার আবৃত্তি প্রায় প্রত্যেকটা কবিতার অনুষ্ঠানে হয়। এটাও একটা ব্যাপার। তো মানুষের কথা আপনি বলেছেন, মানবতার গান গেয়েছেন এবং এখনো ডিমোনিটাইজেশনের... সর্বশেষ বইয়ে আপনি কিন্তু ওই ধারাতেই আছেন এবং আপনাদের কবিতা উৎসবের স্লোগান আমার খুব ভালো লেগেছে, ‘তোমাকে নিয়ে বেঁচে রয়েছি কবিতা’।

সুবোধ সরকার: ‘তোমাকে ধরে বেঁচে রয়েছি কবিতা’ এটা বহুদিন আগের কবিতা, লিখেছিলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তিনি উদ্বোধন করছেন এবার পশ্চিমবঙ্গ কবিতা একাডেমির যে কবিতা উৎসব, যেটি আজ থেকে শুরু হবে, আজকে ৩রা মার্চ, বিকেল সাড়ে পাঁচটায় শুরু হবে। সেই কবিতা উৎসবের বলা যেতে পারে থিম লাইন, ট্যাগ লাইন—তোমাকে ধরে বেঁচে রয়েছি কবিতা। এটা আমাদের সবার খুব মনের কথা। আর আজকে কবিতা উৎসব শুরু হবে, খুব ভাল্লাগছে এই মুহূর্তে তুমি এসেছো। দুটো সাদা পায়রা উড়িয়ে দেব, সঙ্গে বেলুন, হ্যাঁ! আর কবিরা, আবৃত্তিশিল্পীরা তারা সব রবীন্দ্রনাথের পায়ে এবং রবীন্দ্রসদনের যে রবীন্দ্রমূর্তি তার পাদদেশ থেকে আমরা একটু হাঁটব। অনেকে, যাদের বয়স হয়ে গেছে তারা হাঁটতে পারবেন না। কিন্তু আমরা ওই একটা প্রতীকে হাঁটা, কবিতার জন্য হাঁটা—সেটার নাম দিয়েছি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতার নামে—‘একটু পা চালিয়ে ভাই’।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা, যে বইটা এবার আপনার বেরুলো, আপনি যার গল্প বললেন আমাদেরকে—এই বইটা নিয়ে আপনি কেমন প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন?

সুবোধ সরকার: কবিতার বইয়ের প্রতিক্রিয়া বা রেসপন্স যা-ই বলি না কেন, খুব সঙ্গে সঙ্গে ঘটে যায় না। সে যত ভালো বই-ই হোক। বা যত খারাপ বই-ই হোক। প্রতিক্রিয়া সব সময় পাওয়া যায় না। একমাত্র কবিতার বইয়ে শুনেছি সাম্প্রতিককালে, ফিডব্যাক পাওয়া যায় একমাত্র শুনেছি যারা ফেসবুকের কবি তারা নাকি পায়। চারশো-পাঁচশো, এক হাজার, দু হাজার, তিন হাজার কেউ কেউ নাকি বলছে এক লাখ দু লাখ লাইক, এসবও নাকি বলে! আমি জানি না। এসব গল্প আমি বলতে পারব না। যারা ফেসবুকের কবি তারা বলতে পারবেন।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: প্রত্যেক কবির তো একান্ত পাঠক থাকে। তাদের ওপর তিনি নির্ভরও করেন। সব সময় তারা প্রশংসাই করবেন এমন নয়।

সুবোধ সরকার: তা ঠিকই। আমি ফেসবুকের কথা বলতে পারব না অতোটা। শুনি চারপাশে। আমারও ফেসবুক একাউন্ট আছে। তোমাদের কথা মাঝে মাঝে জানতে পারি। ফেসবুক না থাকলে অতো জানতে পারতাম না সব সময়। সবই মানছি, তবে কবিতার বই তো, তার গতি, অনেক ধীরে ধীরে সে, পাঠকের কাছে পৌঁছোয়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে মাত্র, এই বইমেলায় মানে একমাস হয়েছে। আর বিক্রি দিয়ে আমি কখনো কোনো বইকে পরিমাপ করি না। তুমি যদি চাও, কালকে আমি যদি বলি আমার তিন হাজার ছাত্রছাত্রী আছে বা আমার দশ হাজার অধ্যাপক বন্ধু আছে, তাদের সবাইকে যদি বাধ্য করি তোমরা আমার বই কিনে নিয়ে যাও, সেই বিক্রিটা কি কোনো রকমভাবে মাপকাঠি হতে পারে!

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এটা কাউন্টেবল বিক্রি না।

সুবোধ সরকার: এই রকম অনেকে করেন। এখানে নতুন কবিদের মধ্যে এধরনের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কবিতার বইকে রাখতে দিতে হয়। খুব গোপন পাঠক একেক করে আসবে, এসে বইটা দেখবে বা বইটার কথা শুনবে, তারপর একটা কপি কিনে নিয়ে যাবে। এটার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, ওই তাড়াহুড়ো করে হইচই করে সব কবিতার বই শেষ হয়ে গেল, আর আমি কিছু সিনেমার লোকজন ধরে এনে সেই বই কিনিয়ে নিলাম বা রাজনীতির লোকদের দিয়ে কিনিয়ে নিলাম বা সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে কবিতার বই চারশো পাঁচশো কপি কিনিয়ে নিলাম আর বললাম বেস্ট সেলার। এটা খুব অশ্লীল। এটা কখনো হোক আমি চাই না। তার একটা প্রবণতা আমি লক্ষ করছি। খুব দুঃখের সেটা। তবে এই প্রবণতাটা বেশিদিন টিকবে না।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এগুলো সব সময়ই থাকে কিন্তু টেকে না। দাদা, প্রতিক্রিয়া বলতে আমি এরকম ব্যাপার জানতে চাইনি।

সুবোধ সরকার: হ্যাঁ এইটুকুনই বলতে পারি, এই বইটি ছাপা হয়ে বেরিয়ে আসার পর আমি নিজে যখন হাতে নিলাম, ভালো লাগল, আর আমার মনে হলো যারা সত্যিকারের পাঠক তারা যদি বইটি সংগ্রহ করেন, পড়েন, আমার নিশ্চয় ভালো লাগবে। তবে এটা তো আর হটকেকের মতো বিক্রি হতে পারে না। টি এস এলিয়টের সেই বিখ্যাত কথা এখনো বিশ্বাস করি, উনি বলেছিলেন, যখন উনি ফেভার এন্ড ফেভারের এডিটর, তখন উনি বলেছিলেন, যদি একটা কবিতার বই একশো কপিও বিক্রি হয়, তো জানবেন সেটা খুবই ভালো। এই যে একশো জনকে কল্পনা করেছিলেন টি এস এলিয়ট, এই একশো জন কিন্তু আসলে এক হাজার জন। এমন এক পাঠকের কথা ভেবেছিলেন, যারা প্রভাব বিস্তার করবে পরবর্তী সময়ে। তো আমার মনে হয় সেদিক থেকে কবিতার বই পশ্চিমবঙ্গে, কলকাতা এবং জেলা শহরগুলোতে, ভারতে কিন্তু কবিতার বই অন্যান্য ভাষাতে খুব একটা বিক্রি হয় না। কিন্তু আমাদের এখানে কবিতার বই, বিশেষ করে চারপাঁচজন কবি তো আছেনই, যাদের বই নিয়মিতভাবে বিক্রি হয়। এডিশন হয়। প্রকাশকরা তাদের বই চেয়ে পান না অনেক সময়। তো আমার মনে হয়, এটা সব ভাষাতেই, কবিতার বইয়ের বিক্রি এতটাই সীমিত, বলা যেতে পারে এতটাই সুসংহত, ভালো না খারাপ সেটা আমি বলতে পারব না। কিন্তু কবিতার বই তো উপন্যাস নয়, কবিতার বই তো সিনেমা নয়; সুতরাং কবিতার বই তার নিজস্ব রকম দিক নিয়ে আছে। আমার ভালো লাগে বরঞ্চ এই দৃশ্য দেখতে, বইমেলায় একটা নতুন সময়ে একটা ছেলে একটা মেয়ে হয়তো দেখা যাবে ঘাসের মধ্যে বসে আছে আমার একটা কবিতার বই খুলে, হয়তো আমি পাশ দিয়ে চলে গেলাম। এই যে দৃশ্যগুলো দেখা যায়, বা কোনো একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে ফুটপাতের ওপর তিনজন তরুণ হয়তো আমার বইটা নিয়ে তর্ক করছে—এর থেকে ভালো দৃশ্য আর কিছুতে হয় না। এই দৃশ্যগুলো যখন দেখতে পাই, মন ভালো হয়ে যায়। এটাই কবিতা, এটাই প্রাপ্তি। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কিছুতে আশা করি না।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা আপনি সনেট লিখেছেন শেক্সপিয়রের চাইতে বেশি।

সুবোধ সরকার: হাহাহা। ওটা মজা করে বলেছিলাম।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার ‘দ্বৈপয়ন হ্রদের ধারে’ পড়েছিলাম আমরা। ওটা মজা করে বলেছিলেন ঠিক আছে। কিন্তু কবিতার প্রকরণ, ছন্দ—মানে এগুলোর যে শাসন, আমার মনে হয়েছে আপনি সব সময় এগুলোকে ভাঙতে চেয়েছেন।

সুবোধ সরকার: হ্যাঁ এটা সত্যি যে আমি একশো পঞ্চান্নটা সনেট লিখে বলেছিলাম যে, কেন একশো পঞ্চান্ন, এর জবাবে বলেছিলাম যে, মহামান্য শেক্সপিয়রকে তো আর কোনোভাবেই হারাতে পারবে না কেউ কোনোদিন, একটা সংখ্যায় যদি হারানো যায়! তাই তো আমি উনার যে সনেট সিকোয়েন্স সেটা একশো চুয়ান্ন, ওয়ান ফিফটি ফোর সনেটস, তো আমি একশো পঞ্চান্নটা লিখে বলেছিলাম যে যাক, এই একটা জায়গায় অন্তত.... সংখ্যা দিয়ে যদি ওঁর ঠোঁটে যদি একটা মুচকি হাসি লাগাতে পারি। তো প্রকরণ একটা বিরাট ব্যাপার। আমি বলি যে প্রত্যেকটা কবিতা তার নিজস্ব বিষয় অনুসারে তার প্রকরণ ঠিক করে নেয়। কিন্তু আমি সেই প্রকরণের বিরুদ্ধে, যে প্রকরণ একবার হাতে এসে গেল এবং সেই একই মডেলে, একই রকমভাবে, একই মিল দিয়ে, একই ছন্দ দিয়ে একটু এদিক-ওদিক করে একই জিনিস লিখে যাওয়ার যে প্রকরণ, সেটাকে আমি সহ্য করতে পারি না। তাই জন্য আমার কবিতার লাইন কখনো এই রকম বড় হয়ে গেছে! কখনো এই রকম হয়েছে। কখনো ভেঙে এই রকমভাবে চলে গেছে। কখনো ছন্দে লিখেছি। কখনো ছন্দে ভেঙেছি। ঘটনাচক্রে ছন্দেই বেশি লিখেছি। আমার সত্তর শতাংশ কবিতাই আমি খুবই প্রথাগত ছন্দে লিখেও তার থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার সম্পর্কে একটা ধরণা আছে এবং সে ধারণাটা কোনো ভুল আমি বলছি না, সেই ধারণাটা অনেকটাই হয়তো সত্যি আবার অনেকটাই সত্যি নয়। সেটা হচ্ছে যে আমি শুধুমাত্র গদ্যেই লিখি। আমি যদি কোনোদিন সামান্য একটুও কাব্যভাষা তৈরি করতে পেরে থাকি, তার জন্য আমি আমার পূর্ববর্তী এবং সমবয়সী এবং পরবর্তী সময়ের তরুণ কবিদের কাছে ঋণী। কেননা আমি বিশ্বাস করি, আমি এখন কবিতা লিখি, আমি শুধুমাত্র যারা আমার আগে লিখেছেন তাদের দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছি আর যারা আমার পরে লিখতে এসেছেন তাদের দ্বারা প্রভাবিত হইনি এটা আমি বিশ্বাস করি না। এটা হচ্ছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। কেউ এগুলোর ডিএনএ টেস্ট করতে পারে না। এর ডিএনএ টেস্ট করা যায় না। খুব কঠিন একটা ব্যাপার। কিন্তু আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে, যে ভাষার মধ্যে আমি আছি, তার প্রবীণ এবং নবীন সমানভাবে আমাকে পাল্টে চলেছে। আমাকে দিচ্ছে। এবং আমি নিচ্ছি তাদের কাছ থেকে। সুতরাং প্রকরণ খুব একটা বড় ব্যাপার। প্রতিটা কবিতা তার নিজস্ব একটা প্রকরণ তৈরি করুক। একই কবির কবিতা একই রকম প্রকরণে যেন না হয়, ভিন্ন রকম প্রকরণ যেন উঠে আসে— বিভিন্ন রকম ব্যাকরণ বিভিন্ন রকম বিন্যাস। সুতরাং কবিতার যে ফরমেট, এই ফরমেট শব্দটা কিন্তু টেকনিক্যাল। সাধারণত সাহিত্যে ব্যবহার করি না আমরা। কিন্তু আমি করি। এই ফরম্যাট যেন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না থাকে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: বৈচিত্র যেন থাকে!

সুবোধ সরকার: তাহলে সেটা যেন মনে হয় কুয়োর জল।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা আপনার ঠিক পেছনে আমাদের একজন কবি কামাল চৌধুরীর বই দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে আপনার বিবেচনা কী?

সুবোধ সরকার: বাংলাদেশের কবিতার একটা বড় জায়গা এখনো পর্যন্ত, এমনকি তরুণ কবিদের মধ্যে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রবণতা রয়েছে। অনেক বেশি বাংলাভাষার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের কবিরা বা কবিতা। আমাদের এখানে ভাষার একটা বিরাট মিশ্রণ চলেছে। এবং যার জন্য এখনকার নবীন কবিদের কবিতায়, হ্যাঁ তাদেরকেই শুধু বলব কেন, আমি আমার কবিতাকেও বলি, যে, একটা মিশেল লক্ষ করা যায়। বিপুল পরিমাণে বাংলা ছাড়াও অন্যান্য শব্দ আমাদের কবিতায়—তা হিন্দিই হোক, উর্দু হোক, ইংরেজি হোক, ফরাসি হোক—এই যে অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ ঢুকে পড়েছে বংলা কবিতায়, এটা সম্ভবত এর আগে কখনো বাংলা কবিতায় এই রকম ঘটনা ঘটেনি। এত অন্য ভাষার শব্দ বাংলা কবিতায় এসে ঢুকে গেছে, তার একটা বড় কারণ হচ্ছে বাংলা ভাষা চিরকালই বাইরের অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ নিয়েছে, যেটাকে লোন ওয়ার্ডস বলে। যেরকম ইংরেজি ভাষাটাই দাঁড়িয়ে আছে লোন ওয়ার্ডসের উপরে। ইংরেজি ভাষাটায় নিজের শব্দ কটা? বেশিরভাগই তো অন্য ভাষা থেকে নিয়ে আসা শব্দ। তো শুধুমাত্র লোন ওয়ার্ডেস ওপর দাঁড়িয়ে আছে ইংরেজি ভাষা। বাংলাভাষারও এখন, বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে, গত তিরিশ বছরে লক্ষ করা যায়, যে, শক্তি-সুনীলের সময়ে যেরকম, বিশেষ করে শক্তিদার তো দেখাই যেত না ইংরেজি শব্দ বা হিন্দি শব্দ বা অন্য কোনো শব্দ। বরঞ্চ তাদের কবিতায় দেখেছিলাম যে, অপ্রচলিত শব্দ বা তৎসম শব্দের বিপুল ব্যবহার। তৎসম শব্দের সঙ্গে একেবারে রাস্তার শব্দ মিশিয়ে দেয়ার খেলা করতেন। এই জিনিসটার বদলে দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের সাম্প্রতিককালের যে লোন ওয়ার্ডস, ম্যাক্স মিডিয়ার যে লোন ওয়ার্ডস, বা ধরা যাক পপুলার মিডিয়ার যে লোন ওয়ার্ডস, তাদের যে শব্দ, দিন প্রতিদিনের যে শব্দ, রাস্তাঘাটের যে শব্দ, সাধারণ মানুষ না জেনে যে সব ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন, যেগুলো প্রায় বাংলা হয়ে গেছে—সেই শব্দের কিন্তু প্রবেশ বিরাটভাবে ঘটে গেছে। হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি—এই তিনটে তো বটেই, তাছাড়াও অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ এসেছে। এই একটা জায়গায় বাংলাদেশের কবিতার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য। হয়তো বাংলাদেশের কবিতার সঙ্গে কিছুটা আরবি শব্দ রয়েছে এবং এখনো রয়েছে, সেই শব্দগুলো হয়তো বোঝা যায় না। যারা জানেন তারা বুঝতে পারেন। কিন্তু বোঝা যায় না। অনেক সময়ই বোঝা যায় না। এই একটা শব্দের প্রয়োগের দিক থেকে বাংলাদেশের কবিতা আর আমাদের কবিতার একটা পরিষ্কার পার্থক্য তৈরি হচ্ছে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সুবোধদা, কবি তো আসলে স্বাধীন। কবি কোনো বাধ মানে না। কবিতার প্রকরণ নিয়ে কথা হচ্ছিল। প্রকরণের ক্ষেত্রেও আসলে সে স্বাধীন। কোনোকিছুর বাধ সে মানতে চায় না। কিন্তু কখনো কখনো সেটা লাগে আবার। ওই যে বলছিলেন কাব্যভাষা তৈরি, সেটার জন্যই, দাদা, আপনি অনেক সামাজিক দায়িত্ব পালন করেও সমাজ-চেতনা আপনার কবিতার মধ্যে যেমন আছে, একইরকমভাবে ব্যক্তি সুবোধ সরকার পশ্চিমবঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। যেমন কবিতা উৎসবের সংগঠক হিসেবে তাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। তো এই ব্যাপারগুলোকে আপনার কবিজীবনের সাথে কিভাবে মেলান?

সুবোধ সরকার: আমি একটা কথা বলি, যখন এই প্রসঙ্গটা উঠল, এই কবিতা উৎসব এত বড় করে কবিতা উৎসব পশ্চিমবঙ্গে কেন, ভারতবর্ষেও হয়নি। এই তিনদিনের যে উৎসব সেই উৎসবটা করছে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ কবিতা একাডেমি। পশ্চিমবঙ্গ কবিতা একাডেমিটা বেশিদিন হয়নি। কবিতা নিয়ে যে পুরো একটা একাডেমি তৈরি করা যায়, এই শব্দটা আমাদের হাতে এনে দিয়েছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। এটা সম্পূর্ণভাবে তাঁর শব্দ, যে কবিতা নিয়ে একটা একাডেমি। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গ কবিতা একাডেমি এই ব্যাপারটা প্রথম তাঁর মাথা থেকে এসেছে। তো এটা একটা বিরাট ব্যাপার। কেননা ভারতবর্ষে কোথাও কবিতা নিয়ে একাডেমি হয়নি। এমনকি পৃথিবীতেও একমাত্র আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহ্যাটনে একটা পোয়েটস হাউজ আছে। দ্য একাডেমি অফ এ্যামেরিকান পোয়েটস। এই ছাড়া তো কোথাও নেই। সেই দিক থেকে আমি বলব যে পশ্চিমবঙ্গ কবিতা একাডেমি একেবারে বলা যেতে পারে দ্য ফার্স্ট অফ ইটস কাইন্ড ইন দ্য কান্ট্রি অর ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। তো সেইদিক থেকে এটা প্রায় পায়োনিয়ারিং একটা কাজ হলো। তো এই যে কবিতা একাডেমি, শুধুমাত্র উৎসব নয়, ভারতের অন্যান্য ভাষার কবিতা অনুবাদ হবে, বাংলা কবিতা অন্যান্য ভাষায় পৌঁছবে, আমাদের দেশের ভেতর থেকে অন্যান্য ভাষার কবিরা যেমন কলকাতায় আসবেন, রাইটারস রেসিডেন্স, পোয়েট রেসিডেন্স হবে। বিদেশ থেকেও কবিরা আসবেন। কবিতা নিয়ে কবিতা ফিল্ম, কবিতা মিউজিক, কবিতা আবৃত্তি, কবিতাকে একেবারে জনপরিসরে পৌঁছে দেবার একটা দায়িত্ব কবিতা একাডেমি পালন করবে। সুতরাং কবিতা একাডেমি মানে শুধুমাত্র পাবলিকেশন্স, বিভিন্ন রকম বই, নতুন ধরনের বই, তরুণ কবিদের বই, প্রবীণ কবিদের সুচিন্তিত নির্বাচিত কবিতা—এইসবই থাকবে। যাতে কবিতার একটা ভুবন তৈরি হবে কবিতা একাডেমিকে ঘিরে। এটাই হচ্ছে স্বপ্ন। সত্যি সত্যি এই স্বপ্ন আমাদের হাতে ধরিয়েছেন তিনি, যিনি আমাদের প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা, উনি স্বপ্নটা দেখছেন। কিন্তু সেই স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করার জন্য সেই কবিতাঅন্তপ্রাণ মানুষগুলো লাগবে।

সুবোধ সরকার: সে তো বটেই। উনি নিজে কবি বলে হয়তো ওঁর মাথাতে এসেছে। এত কাজ এত চাপ এতকিছু করছেন, মানুষকে দু’ টাকা দরে চাল দেয় থেকে শুরু করে এই যে এখন তোলপাড় হচ্ছে বাইপাসের ধারে যে সমস্ত হসপিটালগুলো, যারা কসাইখানাতে পরিণত হয়েছে, মানুষকে ধরে ধরে গলা কাটছে, তাদের যে ঘুঘুর বাসা এটা এই প্রথম কেউ কোনো মুখ্যমন্ত্রী এই রকম কড়া পদক্ষেপ নিলেন, যে, আজকে ঘটনাচক্রে ঐতিহাসিক দিন যে, ক্লিনিক্যাল স্টার্ক বিষয়ক বিল আজকে রাজ্য-সরকার পাশ করাতে চলেছে। আজকে এসেম্বলিতে এটা গৃহীত হবে। এবং সাধারণ মানুষ যাতে সুচিকিৎসা পায়, যাতে গাফিলতিতে তাদের কোনো ক্ষতি না হয় এবং যদি গাফিলতির কারণে কারো মৃত্যু হয় সেক্ষেত্রে দশ লক্ষ টাকা জরিমানা এই বিলে বলা হয়েছে। সুতরাং এই যে জায়গাটা তৈরি হয়েছে এখানে তো কেউ হাত দিতে পারত না। এই প্রথম কোনো মুখ্যমন্ত্রী এখানে হাত দিয়েছেন। এবং এটা হলো সাধারণ মানুষ, রাস্তাঘাটের মানুষ—আমি গত কয়েক দিন ধরে দেখেছি, যেই মানবিক মুখটা তিনি দেখতে চাইছিলেন, এই জন্য তারা মমতা বন্দোপাধ্যায়কে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করছে। এটা তো বাংলাদেশের পক্ষেও খুব উল্লেখযোগ্য ঘটনা, এ কারণে যে আমরা জানি বাইপাসের ধারে বাংলাদেশ থেকে বহু পরিবার চিকিৎসা করাতে আসে। যারা বাংলাদেশ থেকে হয়তো সিঙ্গাপুর যেতে পারেন না, বড় বড় জায়গায় যেতে পারেন না, ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে পারেন না, তারা তো কলকাতাতেই আসেন। আমরা দেখেওছি প্রচুর বাংলাদেশি পরিবার তাদের রোগী নিয়ে এখানে হাসপাতালে রয়েছেন। তো তাদের পক্ষেও এটা খুব ভালো সংবাদ, সুসংবাদ, সারা বাংলাদেশের পক্ষেও ভালো সংবাদ। এখানে যে পরিষেবা দেয়া হচ্ছে, উনি বারবার বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলেছেন, নার্সিংহোমগুলো, হাসপাতালগুলো তো সেবাকেন্দ্র। এগুলো কি কসাইখানা নাকি! মানুষ ঘটিবাটি বিক্রি করে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে, এটা হয় নাকি! এইটা প্রথম উনি একেবারে চেপে ধরেছেন। আমি মনে করি এটাও কবিতার মহত্ম। যে কবিতা মানবিকতার কথা বলে, যে কবিতা মানুষের মুখ নিয়ে ভাবে, মানবিক মুখ নিয়ে ভাবে, সেটাই তো আসলে কবিতা।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা আপনি নকশাল আন্দোলনের কথা বলেছেন, সেই সময়কার মানুষ আপনি। আপনি এখন যে রাজনীতি করছেন বা সামাজিক দায়িত্ব পালন করছেন, একজন কবি এবং একজন রাজনীতিক, তাদের মূল যে উদ্দেশ্য তাতে কি কোনো তফাৎ আছে বলে কি আপনি মনে করেন? আমার মনে হচ্ছে আপনি সেই কেস যাতে কোনো তফাৎ নাই আসলে।

সুবোধ সরকার: আমি মনে করি যে একজন কবি যখন লেখেন, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় মানবিক উপাদানগুলো আছে বলেই তিনি কবিতা লেখেন। যদি সেগুলো না থাকত উনি লিখতেন না। কেন লিখবেন একজন কবি! ধরা যাক শক্তিদার কথা বলি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়—‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও’,—এই কথা যিনি বলতে পারেন, এই ডাক যিনি দিতে পারেন তিনি তো সবচে মানবিক। তো আমি মনে করি সেই একই মানুষ যখন তার সামাজিক ভূমিকা তৈরি হয়, তার সঙ্গে হয়তো কিছুটা রাজনৈতিক ভূমিকাও হয়তো থাকতে পারে। কিন্তু একজন কবির যখন সামাজিক ভূমিকা থাকে, সামাজিক মানুষ আর কবি মানুষ বলে আলাদা দুটো অস্তিত্ব হতে পারে না। আমি মনে করি তিনি তার পরিবারে যেরকম একজন মানুষ, পরিবারের কোনো উদ্বেগ তৈরি হলে তিনি যেমন রাত্রে ঘুমোতে পারেন না, ঠিক তেমনি তার পাশের বাড়িতে, তার পাশের বাড়িতে যদি কোনো অঘটন ঘটে, তিনিও তো সেখানে ঘুমোতে পারবেন না। ঠিক একজন কবি যখন সেই পাশের বাড়িকে নিয়ে একটা কবিতা লিখছেন, একটি ছেলের মুখ হয়তো ভেসে উঠল, আরেকটি মেয়ের মুখ সেই দুঃখের মুহূর্তে ভেসে উঠছে তার কবিতায়, সেটাও তো তার মানবিক ভূমিকা। সুতরাং মানবিক ভূমিকা কবি হিসেবে আলাদা আর সামাজিক মানুষ হিসেবে তার মানবিক ভূমিকা আলাদা এটা হতে পারে না। আমার কাছে দুটো আসলে একটাই, কবিতা।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সুবোধদা এখন যখন একটা নতুন কবিতা পড়েন, তখন আপনার মাথায় কী থাকে? কোন প্রত্যাশা নিয়ে পড়েন?

সুবোধ সরকার: কবিতার কাছে সবচেয়ে বেশি যেটা আশা করি, শিক্ষার্থীর মতো রোজ নিজেকে বলি, আমি তো পঁয়ত্রিশ বছর নিলাম ঊনত্রিশটা কবিতার বই লিখতে। এই পঁয়ত্রিশ বছরে আমি প্রতিদিন সকালবেলায় চরঘণ্টা করে বসেছি। কোনো কোনো দিন লিখতে পেরেছি কোনো কোনো দিন পারিনি। পঁয়ত্রিশ বছরে প্রতিদিন সকালে যদি লিখতে পারতাম তাহলে আমার ঊনত্রিশটা বই না, আশিটা বই হয়ে যেত। তা তো সম্ভব নয়। তো কোনো একটা সকালবেলায় বসে শুধু একটা কবিতা বারবার পড়ে হয়তো ছিঁড়ে ফেলেছি আগের লেখা একটা কবিতা। সেটাও একটা কাজ। ছিঁড়ে ফেলাটাও একটা বিরাট কাজ। ছিঁড়ে না ফেললে নতুন লেখা যায় না। তো আমি নিজেকে রোজই শিক্ষার্থীর মতো একটা কথা বলি, যে, আমি যেমন একজন তরুণ কবির কাছে বা একজন প্রবীণ কবির কাছে আশা করি, যে, তুমি আমাকে অবাক করে দাও, তোমার একটি পঙক্তি যেন আজ সারাদিন আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। আমার মাথা থেকে যেন সেই পঙক্তি বা সেই লাইনটা যেন নামাতে না পারি। সে যেন আমাকে ছায়ার মতো সব সময় ঘিরে রাখে। এটা যেমন আশা করি তেমনি নিজেকেও বলি ধন্য হয়ে যাব যদি একটা লাইন লিখতে পারি, যে লাইনটা আমার একজন পাঠক কাঁধে করে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। এই যে চাওয়া, এই চাওয়াটা কবিতার কাছে চাই। কবিতা তুমি আজকে আমাকে অবাক করে দাও। কেননা চারপাশে এত যখন বিপন্নতা, অসুস্থতা, ব্যাধি, অন্ধকার—এগুলো দেখি তখন তো খুব স্বাভাবিক কারণেই মনটা বিষিয়ে থাকে। তার মাঝখানে যখন কবিতার লাইন উঠে আসে, কবিতার লাইন মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ে, মাথা থেকে হৃদয়ে প্রবেশ করে, তখন মনে হয় ঠিক আছে, আজকের দিনটা আমার ভালো যাবে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সুবোধদা আপনার অনেক সময় নিলাম আমরা। কত কথাই যে বাকি রয়ে গেল! বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য কিছু বলুন। বাংলাদেশে যারা আপনাকে আবৃত্তি করে তাদের ব্যাপারে বলুন।

সুবোধ সরকার: বাংলাদেশের পাঠক টের পাওয়া যায় যখন বাংলাদেশে যাওয়া যায়। আমার সব সময় বাংলাদেশে যেতে খুব ভাল্লাগে। আমন্ত্রণ ছিল ছিল এবারও। পহেলা ফেব্রুয়ারি। এবং বাংলা একাডেমি থেকেও আমন্ত্রণ ছিল। দুটো জায়গায়—কবিতা উৎসব এবং বাংলা একাডেমি দুটো জায়গারই আমন্ত্রণ ছিল। আমি ক্ষমাপ্রার্থী এবার যেতে পারিনি, কলকাতা বইমেলাতে এবার এত বেশি বিদেশি অতিথি, বিশেষ করে আমেরিকার, ইউরোপের কবিরা সব এসেছিলেন, তো তাদেরকে ফেলে আমি যেতে পারলাম না। তাদেরকে নিয়ে যদি চলে যেতে পারতাম খুব ভালো হতো। তা সম্ভব হয়নি। তবে আরেকটা আমন্ত্রণ আমি পেয়েছি, সেটাতে যাব। সেটা হলো এই, ৯ তারিখ। নাইন মার্চ, আমাকে টাঙ্গাইল থেকে, না আমি ভুল বললাম, চট্টগ্রাম থেকে, বেশ একটা বড় সংগঠন আমাকে ডেকেছে। তাদের অনুষ্ঠানে ওখানে থাকতে হবে। আমি যাব, একদিনের জন্য হলেও এবার আমি কথা দিয়েছি, আমি সেখানে যাব। বারবার বাংলাদেশে যেতে ভালো লাগে এই কারণে, বাংলাদেশের পাঠকের সামনে বসলে আমার মনে হয় যেন আমি নিজের সামনে বসেছি। নিজের সামনে বসার তো খুব দরকার। বাংলাদেশের পাঠকের আরেকটা গুণ আছে, আমি দেখেছি, যতবার দেখা হয়েছে, পাঠকের সামনে তো বেশি দেখা হয় না, দেখা হয় কবি বন্ধুদের সঙ্গে। কিন্তু পাঠকের সঙ্গে দেখা হওয়াটাও একজন লেখকের খুব জরুরি। তাতে আমি দেখেছি, বাংলাদেশের পাঠক আমাদের এখানকার পাঠকের চাইতে আরেকটু ক্যান্ডিক, আরেকটু সহজ, আরেকটু স্পষ্ট। আমাকে এরকম বহুজন বলেছে—দাদা আপনার শাড়ি কবিতাটা শুনতে শুনতে একেবারে টায়ার্ড হয়ে গেছি। একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেছি। ওই কবিতাটা আর দেবেন না। এই কথাটা আমাকে এখানে কেউ বলেনি। কিন্তু ওখানে বলেছিল। তারপরে গুজরাটের সময়ে আমি যে আলাদা গোটা একটা বই লিখেছিলাম, সেই কবিতাগুলো আমাকে বহু জায়গায় ছেলেমেয়েরা.... স্মৃতি থেকেও বলে। আমার খুব ভালো লাগে। এবং আমি তো প্রতিষ্ঠিত কবি বা প্রতিষ্ঠিত বাচিক শিল্পীর কথা বলছি না, আমি বলছি একদম সাধারণ পাঠকের কথা। আমি কিন্তু সব সময় সাধারণ পাঠকের দিকে তাকিয়ে থাকি। বাংলাদেশে কিন্তু সাধারণ পাঠক আছে। আমি বলব যে কলকাতা বা কলকাতার আশেপাশে বা পশ্চিমবঙ্গেও পাঠক যথেষ্ট। সব সময় যে পাঠকের সঙ্গে দেখা হয়, তা নয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পাঠক অনেক সময় বলব বলব করে বলতে পারে না। আমাকে বাংলাদেশের দু’একজন বলেছে, দাদা, আপনার এই বইটা ভালো লাগে নাই। আপনি এই রকম কবিতা আর লিখবেন না। এই এই কবিতাটা পড়ে বড্ড দুঃখ পাইছি—এরকম বলে। এই যে এই বলাগুলোর মধ্যে খুব সহজ স্বাভাবিকভাবে বলার একটা প্রবণতা, সেটা কিন্তু বাংলাদেশে পাই, খুব পাই। আমাদের এখানে একটা আর্টিকুলেশন তৈরি করে। যে আর্টিকুলেশনটা একটু সাজিয়ে, একটু ভালো করে, হয়তো একই কথাই বলবে শেষ পর্যন্ত—বড় দুঃখ এই কবিতার বইটিতে রয়েছে আপনার। বিশেষ করে মল্লিকা চলে যাওয়ার পর ওই বইটা যখন লিখেছিলাম—‘একটু আসছি রোরোকে দেখো’ তো সেই বইটা নিয়ে বাংলাদেশের দু’একজন পাঠক আমাকে অমন বলেছিল। তখন খুব অদ্ভুত লেগেছিল। আমি বলেছিলাম, বাহ! এটা তো সত্যি কথা। এটা তো ভেবে দেখার মতো কথা। এটা কিন্তু বাংলাদেশের পাঠক সরাসরি বলতে পারে। এটা আমার খুব ভালো লাগে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা, আমার তো মনে হয় যে কবি কখনো ব্যর্থ হয় না। একটা কবিতা লিখলেও কবি ব্যর্থ হয় না। কিন্তু আমাদের সমাজে সফল কবি ব্যর্থ কবি—এরকম ব্যাপারগুলো আছে। এইটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

সুবোধ সরকার: আমার কাছে মনে হয় পাঠক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমার কাছে একজন কবি গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, কিন্তু যিনি পাঠক, তিনি কিভাবে একটা একটা করে কবিতা পড়ে নিজেকে তৈরি করছেন এবং তার সফলতা বা ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। তিনি পাঠক হিসেবে কী বই লিখবেন, আমি সেই পাঠকের কথা বলছি না। তিনি কি পাঠক হিসেবে টেলিভিশনে এসে বক্তব্য রাখবেন, আমি সেই পাঠকের কথা বলছি না। যে পাঠক গোপন, যে পাঠক নিঃসঙ্গ, যে পাঠক একা—তার পিঠে যখন কোনো কবিতা এসে হাত রাখে; সুন্দরবন, আমাদের এদিককার সুন্দরবনের কথা বলছি, সুন্দরবনের একটা গাছতলায় একটা মেয়ে, কম বয়সী মেয়ে, খুব শীর্ণা হয়ে গেছে, তার মাকে নিয়ে গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে, সে এগিয়ে এসে একটা কবিতা দেখিয়েছিল আমাকে। তারপর মা এগিয়ে এলেন। এগিয়ে এসে বললেন, এই যে কবিতাটা, এই কবিতা আমার মেয়ের জীবন পাল্টে দিয়েছে। তো আমি মা আর মেয়ের দিকে যেভাবে তাকিয়েছিলাম, পৃথিবীতে আর কোনো মানুষের দিকে ওভাবে তাকাতে পারিনি। তাহলে এটা সম্ভব! পাঠক, এই যে পাঠক, একটা কবিতা সে দেখাচ্ছে, দেখিয়ে বলছে, এই কবিতা আমার জীবন পাল্টে দিয়েছে। বলল, জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল। বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে এসেছিল মেয়েটা। ওই কবিতাটাকে অবলম্বন করে। এই যে ‘তোমাকে ধরে বেঁচে রয়েছি কবিতা’ এই পাঠকের জন্য এই কথাটা প্রযোজ্য। যার কাছে কিছু নেই, অসহায় মানুষ, সে একটা কবিতাকে বিশ্বাস করছে। সে একটা কবিতাকে ভালোবাসে। সে ভালোবাসা এমন একটা ভালোবাসা, যে ভালোবাসার ওপর তার জীবন নতুন করে তৈরি হলো। সুতরাং আমার কাছে মনে হয় একজন পাঠক কী নিচ্ছে কবিতার কাছ থেকে সেটা অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পাঠকের জন্যই তো কবিতা। পাঠকই তো ভগবান। পাঠকই তো একটা কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা আপনার কাছে সর্বশেষ প্রশ্ন, সেটা হলো একটা বড় সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের পাঠক শীর্ষেন্দু, সুনীল বা সমরেশকে পড়ছে। অনেক দিন ধরে আপনাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আপনাদের সময়ে আপনি কিংবা ধরেন জয় বা এই সমসাময়িক যারা—আপনি আমাদেরকে বাংলাদেশের পাঠকের জন্য এমন দশজন লেখকের কথা বলবেন আগামী দিনে আগমী পাঁচসাত বছরে যাদেরকে আমরা পড়ব।

সুবোধ সরকার: হা হা। তালিকা করে দেয়া খুব মুশকিল। আমি বিশ্বাস করি কবিতার দিক থেকে অনেকেই রয়েছেন যারা খুবই উল্লেখযোগ্য। আমাদের পরবর্তী সময়েও তরুণ কবিদের মধ্যে অনেকে এসেছেন যারা খুবই ভালো লিখছেন। তবে আমি যেটা বলব, আপনাদের কানে খুব অচেনা লাগবে এরকম চারপাঁচজন নবীন কবির কথা আমি বলব। যারা সত্যি সত্যি খুবই ভালো লিখছেন। নবীন মানে একেবারে এই সময়ের, তরতাজা, কম বয়সী। তোমার থেকেও তরুণতর অনেকে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: বাহ! বলুন। তাদের কথা আমাদের শোনা দরকার।

সুবোধ সরকার: তাদের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি। তারা খুবই ভালো লিখবে আমি বিশ্বাস করি। যেমন জলপাইগুড়ি থেকে লিখছে সুজিৎ দাস। যেমন কলকাতা থেকে কৌশিকী দাসগুপ্ত, এদেরকে আমরা মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার দিয়েছিলাম। তার পরবর্তী সময়ে যেমন ধরা যাক যে অরুণাভ রাহা রায়, তারপর দেবাশীব চট্টোপাধ্যায়। গল্পেও নতুন লিখছে যেমন বিনোদ ঘোষাল—এই রকম নবীন প্রজন্মের দিকে আসলে আমরা তাকিয়ে আছি। আর আমাদের সময়ে বা আমাদের পরবর্তী সময়ের কথা তো সবাই জানে। তাদেরকে সবাই চিনতে পেরে গেছে। খুব দূরে দূরে থাকেন মফস্বল শহরে, প্রত্যন্ত গ্রামে, যেমর পুরুলিয়ার একটা গ্রামে থাকেন শরোদচন্দ্র; খুব ভালো লেখেন বা অভিমন্যু। দেখা যাচ্ছে কবিতা শুধুমাত্র চ্যাটার্জি, মুখার্জি, ভট্টাচার্য, রায়, শুধু এরাই লিখবে না। এটা মনে হয় ঠিক না। এটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটু সহজ করে বলে দিই—বাংলা সাহিত্যে একটা ব্রাহ্মণ্য তন্ত্র আছে। যেমন এক সময় তিন বন্দোপাধ্যায় ছিল। পরবর্তী সময়ে এটা অনেকটাই ভেঙে গেছে। আমরা হয়তো এটা নিয়ে আর ভাবিও না। এটা ভেঙে গেছে বলেই ভারতবর্ষের একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে দলিত সাহিত্য বলে আলাদা কোনো সাহিত্য নেই। সেটা তো আলাদাভাবে লেখা হয়ে গেছে। আমাদের বন্দোপাধ্যায় চট্টোপাধ্যায়রাই তো লিখে গেছেন। সুতরাং সেই দিক থেকে আমি বলব যে নতুন সময়ে যে ছেলেমেয়েরা কবিতা লিখছে তাদের দিকে আমরা তাকিয়ে থাকব।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

সুবোধ সরকার: ধন্যবাদ তোমাকেও, নাও চা মিষ্টি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;