সমান্তর



পাপিয়া জেরীন
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

বাতাসে বারিন্দার দিকের কপাট ঠাস্ ঠাস্ কইরা একবার খুলতেছে আরেকবার বন্ধ হইতেছে। মনি উইঠা বসে। পাশে তারেক শোয়া, গভীর ঘুমে সে—তারপরও বুকের উঠানামা আর চোখের পাতা দেইখা বোঝা যায় যে স্বপ্নটা সে দেখতেছে সেইটা অস্বস্তিকর। মনি আস্তে তারেকের গায়ে হাত রাখে, অমনেই তারেক স্থির হয়া যায়। আহা! বেচারা ঘুমাইতেছে শিশুর মতো। মনি খাট থিকা সাবধানে নামে।তারেকরে না জাগানোই ভালো। গত দশ পনের দিন ধইরা রাতে একটুও ঘুমায় না সে। প্রায় একমাস ধইরা তার মনে হইতেছে কেউ তারে ফলো করে, এমনকি তার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট কেউ একটা খাতার মইধ্যে টুইকা রাখতেছে। মনি এমন অদ্ভুত কথা জীবনেও শোনে নাই। গত পরশু রাতে তারেক স্বপ্নে দেখছে—একজন মানুষ হুবহু তার নিজের মতোই। সে নাকি তারেকরে বলছে, তোমার শেষদৃশ্যটা মর্মান্তিক, কিন্তু কেমনে মরবা তা জানি না। সিঁড়ি থিকা পইড়াও মরতে পারো, ঠাডা পইরাও মরতে পারো। তুমি কোনডা চাও?

মনির হাত পা ঠান্ডা হয়া আসে এইসব শোনার পর।
অথচ এই তারেক এমন ছিল না কোনোদিন। একটা সময় ছিল, সে পুরাটা কলাভবন জমায়া রাখত। ক্লাস থিকা বাইর হইয়াই মনি দেখত, তারেকরে ঘিরা মেয়েরা বইসা আছে। একের পর এক মেয়ে গিয়া তারেকের হাত ধরতেছে, আর তারেক সেই মেয়ের সম্পর্কে আজগুবি সব কথা বইলা যাইতেছে চোখ বন্ধ কইরা। মনির খুব রাগ হইত তখন। মনে হইত, মেয়েগো হাত ধরনের জন্য কত রকম ধান্দা করে ছেলেমানুষ। কিন্তু দুইদিন না যাইতেই মনি গিয়া দাঁড়ায় তারেকের পাশে :
— হাই তারেক ভাইয়া! আমি মনি, ৩৭ ব্যাচ। আমার হাতটা একটু দেইখা দেন না!
— আমি তো হাত দেখি না। আপনি আমার কব্জি বরাবর দুইহাত শক্ত করে ধরবেন। আমি আপনার বিষয়ে যা দেখতে পাব, তা বলব।আমি কিন্তু অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ আলাদা করতে পারি না। যেসব দৃশ্য আসে তাই বলি।
— অনেক শক্ত করে ধরা লাগব?
— হু, শরীরের সব শক্তি দিয়ে। এইতো!
মনি, আপনার স্বামী একজন লেখক। আপনি অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে তর তর করে উঠে যাচ্ছেন ছাদে। আপনার স্বামী ছাদে বসে কিছু লিখছে, আবার কলম দিয়ে কাটছে। মনি সাবধান! আপনি সন্তানসম্ভবা। আপনার প্রথম একটা মিসক্যারেজ হয়েছে। আপনি আবারও পড়ে যেতে পারেন। প্লিজ সাবধানে...
— আপনে কী বলেন এইসব! আমি অবিবাহিত। আজাইরা প্যাঁচালের জায়গা পান না?
— জানি না, মনি। এইসব মনে হলো আমার। আরেকটা বিষয়। খুবই আশ্চর্যের বিষয়! আপনার সাথে আমার বিয়ে।
— ধুর মিয়া। সবাইরে এইসব বলেন, না? মাইয়া পটানি?

মনির কথা শুইনা তারেক সেইদিন হা হয়া গেছিল। মনির স্পষ্ট মনে আছে ,ঐদিনও তারেকের চিকন নাকটা চিকচিক করতেছিল ঘামে। বিয়ার পরে মনি খেয়াল করল—শুধু নাক মুখ না, তারেকের সারাটা শরীর ঘামে। আর সেইটা ঘুমের মইধ্যেই বেশি।

চা খাওয়া দরকার। এই শরীর নিয়া অন্ধকার সিঁড়ি বাইতে ইচ্ছা করে না মনির, যদিও প্রত্যেকটা স্টেপ তারা গোণা। প্রায় একশো বছরের পুরানা বাড়ি, তার দাদা-শ্বশুরের আব্বার আমলের। অন্ধকার সিঁড়ির বাঁকের দেওয়ালে ছোট ছোট চিলমন্ রাখার খোপ। সন্ধ্যার আগেই চিমনী ঝকঝকা কইরা মুইছা বাত্তি দেওয়া হইত সেই খোপগুলিতে । মনি এ গল্প শুনছে আসমা খালার কাছে। আসমা খালা আসলে তারেকের দূর সম্পর্কের ফুপু, কিন্তু তারেক ছোটবেলা থিকা তারে খালা ডাকে। মনি দশমিনিট ধইরা দাঁড়ায়া আছে বারিন্দায়, আসমা খালারে আশেপাশে কোথাও দেখা যাইতেছে না। আকাশ কালো হইয়া রইছে, ঝড় উঠব মনে হয়। ঝড় উঠলে আবার আসমা খালা পাগল হয়া দৌড়ায়া আসব। জানালা দরজা আটকায়া ঘরের মইধ্যে বইসা দোয়াকালাম আর কান্দাকাটি শুরু কইরা দিব।একবার এমন ঘটনা, মনি তখন নতুন বউ। সিজন মতো ঝড়বাদলা। উঠান ভইরা বড় বড় আম পইড়া ভইরা যাইতেছে। মনি আম টোকাইতে বাইর হইব, অমনি আসমা খালার চিৎকার :
— নতুন বউ! কই যাও? আমি জানি কই যাও তুমি! ভুলেও ওদিকে যাইও না।
— খালা, কত্ত আম!
— বউ, এই বাড়িতে ঠাডা পইড়া জোড়া মানুষ মরছে। তোমার শউর-শাউরী। তুমি জানো হেই কথা?

মনি আসলেই জানত না, তারেক একবারও বলে নাই তারে। তবে তারেক বিজলী চমকাইলে ভয় পায় সেইটা সে জানে। একবার বৃষ্টির দিনে প্রান্তিকে বইসা আছিল তারা দুইজন। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে সে মাথা নিচা কইরা মনির পেটের কাছে আইসা জড়ায়ে ধরছিল। অদ্ভুত শিহরণ হইছিল মনির। তারেকরে তখন মনে হইতেছিল ছয় সাত বছরের বাচ্চা।

গল্পের এইখানে লেখা স্টপ কইরা শাহেদ বইসা আছে। গল্পটা বিয়োগান্তক, এইটা সহ্য করতে পারবে না মিলি। মিলি তার বউ, আর মিলির সমস্যা হইল—তার লেখক স্বামীর গল্প-উপন্যাসে হ্যাপি এন্ডিং থাকা লাগব। তা না হইলে পাণ্ডুলিপি, স্ক্রিপ্ট সব ছিঁড়া কুটিকুটি করা তার অভ্যাস। ভাগ্য ভালো সে জাইগা নাই, নইলে এতক্ষণে এই দুই পৃষ্ঠা লেখার সাথে সাথে ছোঁ মাইরা নিয়া যাইত। তারপর শুরু হইয়া যাইত নাচ। এইখানে এমন ক্যান, শুরুটা এমন হইলে ভালো হইত....ঘ্যান ঘ্যান। শাহেদ যতটা গল্প লিখছে, সবগুলিই এডিট কইরা নতুন প্লটে আনতে হইছে, তার একটাই কারণ হইল মিলি।

— শাহেদ, শুনছো! শাহেদ!
— ওহ্ মিলি। কী হইছে?
— আমারে পানি দাও।ওহ্! গলা শুকায়ে কাঠ হয়ে গেছে।
— কী হইছে বলো।
— খারাপ স্বপ্ন দেখছি। আমি এই বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকব না। এটা একটা হন্টেড প্লেস।
— এত নির্জন সুন্দর বাড়ি কই পাবা তুমি? লেখালেখির জন্য এমন একটা জায়গা কত খুঁজছি জানো? আমি তো বাড়িটা কেনার কথা ভাবতেছি।
— তুমি থাইকো এখানে একা একা। ভূতের গল্প লেইখো।
— মিলি, মাই হরর কুইন! ভূতের গল্প তুমিই লেখো। আমি নতুন গল্পে হাত দিছি। কিন্তু একটা কথা, গল্পের নায়ক শেষদৃশ্যে মারা যাবে। কাহিনী এইটাই ডিমান্ড করে সোনা! প্লিজ আমার কথাটা শোনো।
— মানে? কী বলতে চাও তুমি শাহেদ! তোমার মনে নাই, তুমি প্রমিজ করছো আমারে! মনে নাই ‘ঘাত’ উপন্যাসের সময়ে আমার মিসক্যরেজ হইল! তুমি কী চাও আাসলে? আবারও এমন কিছু ঘটুক?
— ঐটা একটা কোইন্সিডেন্স, মিলি!
— কোনো কোইন্সিডেন্স না। আমি আবারও কনসিভ করছি। এতো বড়ো কোইন্সিড্যান্স আমার লাগবে না। দেখি কী লিখছো!
— এই নেও। ছিঁড়বা না প্লিজ। মাথা ঠান্ডা রাখো।
— বাহ্! নায়কের নাম দেখতেছি তারেক। ক্যান, আর নাম নাই?
— ইয়ে, নামে আপত্তি থাকলে চেঞ্জ করা যাবে, সমস্যা নাই। ও, ভালো কথা… মা তারেকরে দিয়া গাছের শফেদা পাঠাইছে। ও আসছিলো অাধঘণ্টা আগে।
— আসছিল মানে? তুমি ডাকো নাই ক্যান আমারে!
— আজব, তুমি ঘুমাইতেছিলা তখন। আমি তারপরও তারে বসতে বলছি। সে বলল পরে আসবে।তুমি নাকি তারে বলছো, বেত্থুন খাবা। সে কারওয়ানবাজারে যাবে বলল বেত্থুনের খোঁজে। যাক্, আমাদের বাচ্চা খুব লাকি, এমন একটা মামা পাইতেছে। তারেক ভাই তোমার আপন ভাই হইলে কী যে করত সেইটাই ভবতেছি।
— তোমার সমস্যা কী? তারেকরে কি আমি জীবনে অাপন ভাই ছাড়া আর কিছু ভাবছি? আমার বাপ তো তার নিজের বোনের ছেলেরে নিয়া আসছিল পালতে। সে তো আমাদের আপনই।
— ওকে বাদ দেও। লেখার বিষয়ে কথা বলো।
— না, লেখার বিষয়ে কথা হবে না। তারেকরে নিয়া সমস্যা কী তোমার? তোমারে আগেই বলছি, তারেক আমারে পাঁচ থিকা ছয়বার সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থিকা ফিরায়া আনছে।
— এইজন্যে তারে তাবিজ বানায়া রাখতে হবে? আমাদের হানিমুনেও সে উপস্থিত ছিল।
— অসম্ভব, সে যায় নাই। আমি জানি।
— আমি তারে দেখছি সী বীচে, মিলি! আমি অন্ধ না।ওকে এসব নিয়া কথা বলতে চাই না আমি। তুমি গল্পে ফোকাস করো।
— গল্পটার শুরুটা ভালো। মনে হইতেছে তারেক ও মনি এ বাসায়, আমাদের এই দোতলা রুমটাতেই আছে। গল্পের নায়িকা আমার মতোই প্রেগনেন্ট। গল্পের শুরুতে যদি লোকেশনটা বলে দিতা দারুণ হইত...
পুরান ঢাকার বানিয়ানগরে একটা বাড়ি, যার ওউনার থাকে কানাডায়। বাড়ির উঠানে তিনটা আমগাছ আর ঠিক মাঝখানে বিশাল এক বান্দর লাঠি গাছ। পলকা হাওয়ায় হলুদ ফুলের পাপড়ি উইড়া আসে দোতালার বারান্দায়...
— বাহ্! সুন্দর! তুমিই লেখো মিলি। ভালো হইতেছে।

মিলি খুব হাসতেছে। শাহেদ অবাক হইয়া তাকায়ে আছে মিলির দিকে। হঠাৎ অচেনা লাগতেছে মিলিরে, সে তো এত হাসে না! হাসতে হাসতে খাটে একদম শুয়া পড়ল সে। শরীরে দুলুনী আর চোখে পানি। শাহেদ বোকা বোকা একটা হাসি দিয়া ভাবতেছে, এমন হাসির কী কারণ হইতে পারে!

রাত তিনটা চল্লিশ। শাহেদ টেবিলে বইসা লিখতেছে। হঠাৎ মনে হইল তার পিঠের উপর কেউ নিঃশ্বাস ফেলতেছে। মিলি খাটে শোয়া বেঘোর ঘুমে। শাহেদ ভালো কইরা জানে, তার পেছনে কেউ দাঁড়ায়া নাই। তবু সে একবার পেছনে তাকায়। কেউ না, সব মনের ভুল। সে লিখতে শুরু করে।

তারেকরে ট্রাঙ্কুয়ালাইজার দিয়া ঘুম পাড়ায়া রাখা হইছে। মনির খালু হেদায়েতউল্লাহ গম্ভীর ভঙ্গিতে কথা বইলা যাইতেছে। উনি একজন সাইক্রিয়াটিস্ট।।
— মা মনি, একদম টেনশন করবা না। সব ঠিক হয়ে যাবে। পর্যাপ্ত ঘুম দরকার ওর।
— খালুজান, তারেক কি সিজোফ্রেনিক?
— না রে, মা। তারেক কিশোর বয়সে তার বাবা-মা দুইজনকে হারায়। তাদের মৃত্যুটাও খুব প্যথেটিক ছিল। দাদা ও ফুপুর কাছে মানুষ হয়েছে সে। তার ফুপু একজন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মহিলা, তারেকের ছোট বেলাটা সে স্পয়েল করেছে ভয় দেখায়ে দেখায়ে। এটা বিষয় না, মা। তারেকের ভেতরে মৃত্যুভয়ের শিকড় ছিল আগে থেকেই। দাদার মৃত্যুর পর সে হোস্টেলে হোস্টেলে ছিল বেশি। এ বাড়িতে থাকা হয়েছে কম। কিন্তু বিয়ের পর তোমরা যখন এ বাড়িতে আসলে ওর মৃত্যুভয়টা আবারও... বুঝলে তো?
— এখন কী করা যায়! কী করতে পারি আমি?
— সবচে ভালো হয়, তোমরা আপাতত অন্য কোথাও শিফট্ করো। দুঃসহ স্মৃতি মানুষকে অনেকভাবে তাড়িত করে, মা! ভূতের ভয়ের চেয়েও এটি মারাত্মক।
— কিন্তু, খালুজান... এত সুন্দর বাড়ি। আমি এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না।
— আচ্ছা, আপাতত তুমি টেনশন কমাও। নিজের ও শিশুটার কথাও তো ভাবতে হবে।
— জ্বী জ্বী।
— এইবার আমি যাই মা, কোনো সমস্যা হলে আমাকে কল করো।
— জ্বী খালুজান।

সকাল নয়টা। তারেক ঘুম থেকে উইঠা নাস্তা করতেছে। টোস্টেড ব্রেড গলায় আটকায়ে গেছে একবার। মনি যত্ন কইরা ওর মুখে স্যুপ তুইলা দিতেছে। তারেকরে খুব চিন্তিত মনে হইতেছে...

— মনি, এইটা কোনো রিয়েল ওয়ার্ল্ড না। আমরা একচুয়েলি একটা গল্পের দুইটা চরিত্র। মজার বিষয় হইল একজন গল্পকার আমাদের নিয়া এই গল্পটা লিখতেছে ঠিক এই বাড়িতে বইসা।
— কী বলো এইসব! মাথা ঠিক আছে?
— একদম ঠিক। গল্পকার চাইতেছে গল্পের নায়ক, মানে আমাকে মাইরা ফেলতে। কিন্তু তার বউ আবার সেইটা চায় না। এই বাড়িতে দুইটা প্যরালাল জোন তৈরি হইছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হইল, এই সমান্তরে তুমি আর লেখকের বউ কনস্ট্যান্ট মোডে। তুমি কিংবা সেই মহিলাই পারো আমারে বাঁচাইতে।
— তারেক, চুপ করো তুমি। আমরা এক সপ্তাহের মইধ্যে এই বাড়ি ছাইড়া চইলা যাব।
— আমরা জীবনেও এই বাড়ি ছাইড়া যাইতে পারব না। আমরা আটকা পইড়া গেছি মনি। আমরা এই গল্পে বন্দি। এই যে জানালা দিয়া আকাশ দেখতেছো... এর বাইরে আমাদের জন্য কিছু নাই।
— আর আমার খালুজান যে আইসা তোমারে চিকিৎসা দিয়া গেল, সেইটা কী। কোনখান থিকা আসলো সে? আজাইরা কথা বলবা না।
— গল্পের প্রয়োজনেই খালুজানকে আনা হইছে।
— হু,আজাইরা।
— মনি, আমারে মেরে ফেলবে সে। তুমি বাঁচাও প্লিজ। তুমি পারবা, আমি জানি!

মনি তারেকরে বুকে চাইপা ধরে। সে কী করবে বুঝতে পারে না।

...এইটুক লেখার পর শাহেদের চোখ ঘুমে জড়ায়া আসতেছে। তার চোখের পাতা পাথরের মতো ভার হয়া আসতেছে। লেখা বন্ধ করে সে। খাটে গিয়া শরীর মেইলা দিবে, এমন সময় মিলি চিৎকার দিয়া ওঠে :
— কে আপনি? আপনি আমার বিছানায় কী করেন? একদম কাছে আসবেন না।.... শাহেদ! শাহেদ!
— মিলি! কী হইছে তোমার? মিলি।

অাতঙ্কে মিলি খাট থিকা ধপ কইরা নামে। সিঁড়ি দিয়া নামতে যাবে এমন সময় জড়ায়া ধরে শাহেদ। মিলি শাহেদরে ঝটকা মাইরা ফালায়া সিঁড়ি দিয়া নামতে নামতে দেখে, শেষ ধাপে শাহেদ বইসা আছে একটা মেয়েরে কোলে নিয়া, মেয়েটার মুখ দেখা যাইতেছে না। মিলি দেখে মেয়েটার শরীরের নিচের অংশ রক্তে ভাইসা যাইতেছে। মিলি প্রচণ্ড ব্যথায় সিঁড়িতে বইসা পড়ে।সে অবাক হয়া চাইয়া দেখে, দুইটা শাহেদ সিঁড়ির দুইপ্রান্তে হাউমাউ কইরা কানতেছে।
— মিলি! মিলি! কী হইছে তোমার। তুমি দৌড় দিলা কী মনে কইরা?
— শাহেদ, আমার কী হইছে? আমি উল্টা পাল্টা দেখতেছি। ঐটা স্বপ্ন ছিল কিনা জানি না।
— আমারে বলো! কী হইছে?
— একটা অপরিচিত লোক আমার খাটে বইসা ছিল।আমাকে জড়ায়া ধরতে চেষ্টা করতেছিল।
— আরে বোকা! আমিই ছিলাম ঐটা।
— উহ্ শাহেদ! প্রচণ্ড ব্যথা আমার। তুমি প্লিজ আম্মারে ফোন দেও। আমারে হসপিটালে নিয়া চলো।

ভোরবেলা মিলি একটা পুত্রসন্তান জন্ম দেয়। বাচ্চাটা মাত্র আটাইশ সপ্তাহের। ওর ফুসফুসে একটু জটিলতা, এইজন্য ইনকিউবেটরে রাখা হইছে। ডাক্তার বলছে ভয়ের কিছু নাই, জাস্ট কয়েকটা দিন অবর্জারভেশনে রাখা... এই আরকি।

(আট বছর পর একদিন)
বানিয়া নগর, কাঠের পোল লেনের বাড়িটা শাহেদ খুব অল্প দামে কিনে নিছে। এটারে এখন আর ভূতুইড়া বাড়ি মনে হয় না। শাহেদ ও মিলির আজকে বিয়ে-দিবস। ওদের একমাত্র ছেলে মনন.... তার মা-বাবার পক্ষ থেকে কেক কাটতেছে। বাইরে ভীষণ বৃষ্টি। শাহেদ আর মিলি ছাদে যাবে, বৃষ্টিতে ভিজবে। মননের খুব ইচ্ছা করতেছে তাদের সাথে ভিজতে কিন্তু মিলি কিছুতেই রাজি হইতেছে না।

   

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

  • Font increase
  • Font Decrease

মানবিকভাবে বিপর্যস্ত গাজ়ার ঘটনাবলি ইসরায়েল সম্পর্কে কয়েকটি মারাত্মক বিষয় উন্মোচিত করেছে। কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন সম্পর্কেও গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বিশ্ববাসীকে। যেমন: ১. গণহত্যা কাকে বলে, ২. নব্য-বর্ণবাদের স্বরূপ কেমন, ৩. জাতিগত হিংসার নৃশংস চেহারা কত ভয়াবহ।

এইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে, বাস্তব গবেষণাগার ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায়, যেখানে প্রশ্নগুলোর ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস‘ বা ‘মডেল টেস্ট‘ করছে, ইসরায়েল। রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের ইসরায়েলি পাইলট প্রজেক্ট তথাকথিক মুক্ত-গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিকারহীনভাবে দেখছে। আরব তথা মুসলিম বিশ্বও এত বড় একটি গণহত্যার বিষয়ে নির্বিকার। 

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা‘ (প্রকাশক: শিশুকানন/রকমারি) শিরোনামে আমার প্রকাশিত বইটিতে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পটভূমিতে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি ও জায়নবাদী নীতির ঐতিহাসিক ধারাক্রমের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সময়ে গণ-নিষ্ক্রমণের ছবিটা বাস্তবে আসলে কেমন হয় আর প্রতিশোধজনিত হিংসার কারণে জাতি, বা রাষ্ট্র, বা তার ধ্বজাধারীরা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, এসব কথাও আলোচিত হয়েছে।

বাস্তবে ইসরায়েলের হিংস্রতা কল্পনার দানবকেও হার মানিয়ে গেছে। ‘গাজায় গণহত্যা বন্ধ হবে‘, মানবিক বিশ্বের এমন শুভ-আশাকে দুরাশায় পর্যবসিত করেছে, ইসরায়েল। গত অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে নিহত হয়েছেন মোট ৩২ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৭৪ হাজার ২শ ৯৮ জন। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমায় গড়ে নিহত হচ্ছেন ১০০ জন এবং আহত হচ্ছেন ১৫০ ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী। ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় বাড়িঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার ২২ লাখ বাসিন্দার ৮৫ শতাংশ।

গাজায় ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন’ সংঘাতকে 'যুদ্ধ' বলা হচ্ছে। আসলে তা মোটেও ‘যুদ্ধ’ নয়, স্রেফ ‘গণহত্যা’। যুদ্ধে সৈন্য মারা যায়। সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাজায় মরছে সাধারণ মানুষ, জনতা। জনতাকে বেপরোয়া হত্যা করা যুদ্ধ নয়, নগ্ন গণহত্যা। যুদ্ধের ছদ্মাবরণে গণহত্যায় মেতে গত ৭৫ বছর ইসরাইল নব্য-বর্ণবাদী আগ্রাসন, জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ফিলিস্তিনে, যার সর্বসাম্প্রতিক হিংস্রতম পর্যায় চলছে গাজায়। সেখানে অসুস্থ রোগী, ডাক্তার, শিশু, বৃদ্ধ, নারী, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। খ্রিস্টানদের বড়দিনে এবং মুসলমানদের  রমজান মাসের পবিত্রতাকেও পরোয়া করা হচ্ছে না। রমজানে গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশেও বাধা দিচ্ছে, জায়নবাদী ইসরায়েলি বাহিনী। বুলেটের আঘাতে আর খাদ্য, পথ্য ও ঔষধের অভাবে মরছে মানুষ গাজা উপত্যকায়।

বিশ্বের ইতিহাসে, সভ্যতার পথ-পরিক্রমায়, এমনকী, যুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরেও যা ঘটেনি কোনোদিনও, তেমন অকল্পনীয়, অভাবনীয় ও অদৃশ্যপূর্ব বর্বরতা-নারকীয়তা প্রদর্শন করছে ইসরায়েল। জীবিত মানুষদের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের পর লাশের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়েছে। এতদিন ইসরাইলি নৃশংসতা ছিল জীবিত গাজাবাসীর ওপর। এবার তা-ও অতিক্রম করেছে। কমপক্ষে চারটি মৃতদেহ ও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়ে তা থেঁতলে দিয়েছে।

বীভৎস, ন্যক্কারজনক এই ঘটনা ঘটছে মুসলিমদের ঘরের ভিতরে, চোখের সামনে। চারপাশে মুসলিম দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর, ইরান, ইরাক, কাতার, তুরস্কসহ আরও কত দেশ। তারা কীভাবে এই নৃশংসতাকে সহ্য করছে!

সহ্য করছে, রাজনৈতিক স্বার্থগত কারণে। অধিকাংশ আরব দেশই স্বৈরশাসকের কব্জায় রয়েছে, যারা টিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার ইচ্ছায়। মার্কিন-ইসরায়েল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস ও শক্তি আরব দেশগুলোর নেই। অনুগত দাসের মতো তারা মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গণহত্যার দর্শক হয়ে আছে। আরব দেশগুলোর এই হলো বাস্তবচিত্র।

তুরস্ককে বেশ সাহসী ও উদ্যোগী মনে করা হলেও বাস্তবে তুরস্ক কৌশলজনক অবস্থানে থেকে ‘না ধরি মাছ, না ছুঁই পানি‘ নীতিতে নিজেকে নিরাপদ রাখছে। নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায় না তুরস্ক। 

বাদ থাকে ইরান। ইরান ও তার সহযোগী সিরিয়া, লেবানন ও ইয়ামেনের কিছু গ্রুপ মাঝে মাঝে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান নিজে মাঠে নামছে না। নানা গ্রুপকে কাজে লাগাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ-ইসরায়েল সমর্থনের বিপরীতে রাশিয়া ও চীন সুস্পষ্ট কোনো ভূমিকা নিয়ে সংঘাতের অবসানে কাজ করছে না। তারা নিজ নিজ স্বার্থ ও কৌশলের আলোকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বড় ও শক্তিশালী দেশ দুটি ফিলিস্তিনে গণহত্যার ঘটনায় মোটেও কাতর হচ্ছে না এবং বাস্তবক্ষেত্রে ইসরায়েলকে বিন্দুমাত্রও অসন্তুষ্ট করছে না।

বস্তুতপক্ষে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর অংশ হলেও মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি জাতি (আরব, তুর্কি, ইরানি) আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোর নেতৃত্বে আসীন হওয়ার জন্য  পারস্পরিক লড়াইয়ে লিপ্ত। এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ঐক্য ও সংহতিতে ক্ষয় ধরিয়ে দিয়েছে, যার ফায়দা লুটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে এবং পশ্চিমাদের দোসর ইসরায়েল একতরফাভাবে ফিলিস্তিনে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার মাধ্যমে। আর  অধিকাংশ আরব দেশই অবৈধ শাসকের অধীনে থাকায় বৈধতার অভাবের জন্য কোনো পদক্ষেপ তো দূরের বিষয়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোর গলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। 

রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে দুর্বলতা। ফিলিস্তিন নিয়ে বিশ্বের সকল মুসলমানের মধ্যেই তীব্র ‘আবেগ‘ আছে, কিন্তু ‘অনুধ্যান‘ নেই। 'অনুধ্যান' শব্দটি আমি এখানে খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি, যার অর্থ: সর্বদা চিন্তা বা স্মরণ, শুভচিন্তা, নিরন্তর চিন্তা, অনুচিন্তন, সর্বদা স্মরণ, সর্বদা ধ্যান করা। অনুধ্যান শব্দে অর্থ ও প্রতিশব্দগুলো ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হচ্ছে না। চিন্তা ও গবেষণায় ফিলিস্তিনের ঘটনাবলি এবং সেখানকার গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ ও জাতিগত হিংসার জায়নবাদী চক্রান্তের বিষয়গুলো উন্মোচিত করা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। ফিলিস্তিন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও অনুধ্যান বাড়ছে না।

বরং আমজনতা ও নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিন প্রশ্নে কাজে লাগিয়েছে আবেগকে। প্রচণ্ড আবেগে মিছিল, সমাবেশ, দোয়া করার পর অনেক দিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুপ মেরে থাকাই হলো নির্মম বাস্তবতা। এমনটি কতটুকু সঠিক, তা চিন্তার বিষয়। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনে সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুচিন্তিত কার্যক্রমের দ্বারা ইসরায়েল যা করে চলেছে, তা ধারাবাহিক গবেষণা-অধ্যয়নের পথে গভীরভাবে অনুধ্যান ও আত্মস্থ করাই ছিল জরুরি। তাহলেই আবেগ আর যুক্তির সমন্বয়ে বিপন্ন-নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং জায়নবাদী, বর্ণবাদী ইসরায়েলের জাতিগত হিংসা ও গণহত্যার অর্থবহ প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করা সম্ভব হবে।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;