রিজিয়া রহমান: রক্তের অক্ষরে জোনাকির আলো



ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর
কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান/ ছবি: সংগৃহীত

কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান/ ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

১.

ময়দান পেরিয়ে অভিজাত ভবানীপুর এলাকা থেকে দক্ষিণ কলকাতার শুরু। ৮০ বছর আগে অবিভক্ত বাংলার সেই বনেদী পাড়ায় জোনাকি নামের একটি শিশুর জন্ম হলো। রাজনৈতিক দোলাচল, দেশবিভাগ ইত্যাদি কারণে শিশুটি সপরিবারে বাংলার পশ্চিমাংশ ছেড়ে চলে আসেন পূর্বাঞ্চলের আজকের বাংলাদেশে। চরম বিরূপতার মধ্যে থেমে থেমে অর্জন করেন উচ্চশিক্ষা। চালিয়ে যান গল্প-উপন্যাস রচনা।

তার হাত দিয়ে বের হয় ‘বং থেকে বাংলা’, ‘শিলায় শিলায় আগুন’, ‘রক্তের অক্ষর’-এর মতো মানুষ ও জীবনের সুগভীর বর্ণনা-সমৃদ্ধ, ঐতিহাসিক-বিন্যাসের আখ্যান। ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অর্জন করেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘একুশে পদক’, ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’সহ অনেক স্বীকৃতি। 

১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বরে জন্ম নিয়ে ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট মৃত্যু হয় যে জোনাকির, তিনি রক্তের অক্ষরের শরীরে জোনাকির মতো আলো ছড়িয়ে বেঁচে থাকবেন বাংলা কথাসাহিত্যে। তার মৃত্যু হলেও তার বইগুলো বেঁচে থাকবে বাংলাসাহিত্যের ভাণ্ডারে ও পাঠকের চিত্তে। অক্ষয় মলাটে লিপিবদ্ধ থাকবে তার নাম, রিজিয়া রহমান।

২.

রিজিয়া রহমান অসামান্য ভাষায় বহুবিধ বিষয়বস্তুর বর্ণনা দিয়েছেন তার রচনাসমূহের প্রতিটি অক্ষরে। শুধু পাঠেই নয়, অনুভূতির গভীরতম মর্মমূলে পৌঁছে যায় সেসব চিত্ররূপ কাহিনীপ্রবাহ। ‘রক্তের অক্ষর’ উপন্যাসে এই লেখকের কৃতিত্বের ছাপ সুস্পষ্ট: 

‘সবাই বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল কয়েকবার দাপাদাপি করে পেটে ছুরির ঘাই খাওয়া ইয়াসমীনের অর্ধনগ্ন দেহটা নিস্পন্দ হয়ে গেল। হীরুর চোখ টকটকে লাল! হাতে রক্তমাখা ছুরি। হীরু বাইরে এলো। 

মেঝেতে পড়ে থাকা ইয়াসমীনের বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে রক্ত মুছে কাগজটা ছুড়ে দিল হীরু কিছুক্ষণের জন্য বজ্রাহত, নির্বাক হয়ে যাওয়া মেয়েদের সামনে।

তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল-দ্যাখ ছিনালেরা! এইবার চক্ষু মেইল্যা দ্যাখ হীরু কী করবার পারে।

পিছিয়ে গেল মেয়েরা। মার খাওয়া পরাজিত পশুর মতো বেদনাহত চোখে ইয়াসমীনের মৃহদেহের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

রক্তমাখা কাগজটা ওদের সামনে। ওরা শুধু কাগজের এক পিঠের রক্ত দেখল। ওরা জানল না কাগজের আরেক পিঠে লেখা সর্বকালীন সত্যের সেই বিখ্যাত বিদগ্ধ উক্তি: ‘ম্যান ইজ বর্ন ফ্রি, বাট এভরি-হোয়্যার ইজ ইন চেইন।’

নিস্তব্ধ বজ্রাহত বাড়িটায় তখন একটি শিশুর স্বাধীন প্রতিবাদের কান্না বেজে উঠল। ফুলমতীর বাচ্চা কাঁদছে প্রবল চিৎকারে।’     

৩.

‘রক্তের অক্ষর’ উপন্যাসে নির্মম মৃত্যুবরণকারী নারী ইয়াসমীন কে? এই প্রশ্ন ও সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করবেই। ১৯৭৮ সালে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত রিজিয়া রহমানের উপন্যাসটি ছিল নারী ও মুক্তিযুদ্ধের মিলিত সংগ্রামের ধারাভাষ্য। 

রেকর্ড রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে যারা সর্বাগ্রে এগিয়ে আসেন, তিনি তাদের অগ্রণী। বিশেষত নারী কথাশিল্পীদের মধ্যে রিজিয়া রহমানের সমকালে রাবেয়া খাতুন (ফেরারী সূর্য, ১৯৭৪ সাল), ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ (বন্দী দিন বন্দী শিবির, ১৯৭৬ সাল), সেলিনা হোসেন (হাঙর নদী গ্রেনেড, ১৯৭৬ সাল) ছাড়া আর কাউকে মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে কথাসাহিত্য চর্চায় এগিয়ে আসতে দেখা যায় নি।

রিজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষর’ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধর্ষিতা, লাঞ্ছিতা বাঙালি নারীদের করুণ জীবনের আখ্যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা ধর্ষিত ও নির্যাতিত লক্ষ লক্ষ নারীকে স্বাধীনতার পর সরকার যে সম্মানসূচক বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত করেছিল, নৃশংস আঘাতে মৃত্যুবরণকারী ইয়াসমীন তাদের অন্যতম।

তৎকালীন সরকার রণাঙ্গণে ও যুদ্ধের সময় নিপীড়িত, নির্যাতিত নারীদের সামাজিক ভাবে পুনর্বাসন, তাদের বিয়ে ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিয়েছিল। এসব রাজনৈতিক উদ্যোগ-আয়োজন সামাজিক বাস্তবতায় বিভিন্ন ঘাত ও প্রতিঘাতের সম্মুখীন হচ্ছিল। যুদ্ধোত্তর সমাজের একটি অংশ বীরাঙ্গনা নারীদের স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করে নি। তাদের পরিবারও এইসব বীর নারীদের ফিরিয়ে নিতে ছিল কুণ্ঠিত। ফলে লাঞ্ছিতা মেয়েদের জায়গা হয়েছিল আশ্রয়কেন্দ্র, পতিতালয় বা অন্য কোথাও। 

রিজিয়া রহমান তার উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে এমনই এক ভাগ্যাহত নারী ইয়াসমীনকে বেছে নিয়েছিলেন। ইয়াসমীন চরিত্রের মধ্য দিয়ে রিজিয়া রহমান তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের একটি ভিন্ন বাস্তবতা, যেখানে এইসব বীরাঙ্গনাদের জীবনকাহিনী বর্ণনার পাশাপাশি অঙ্কিত হয়েছে পতিতাপল্লির অন্ধকারময় বীভৎস জীবনে নারীনির্যাতনের মর্মন্তুদ কাহিনীচিত্র।   

৪.

‘রক্তের অক্ষর’ আবর্তিত হয়েছে ইয়াসমীনের জীবন, সংগ্রাম ও অস্তিত্বের সঙ্কটকে ঘিরে। পটভূমিতে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় কামাল নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পাকিস্তানি সৈন্যরা ইয়াসমীনের বাবা, মা, ভাই, বোনকে হত্যা করে। ইয়াসমীনকে ধরে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। মাসের পর মাসের পাশবিকতায় নিত্য জর্জরিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের শেষে বন্দি জীবন থেকে মুক্তি পায় ইয়াসমীন। অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় মুক্ত স্বদেশে নিপীড়িত ইয়াসমীনের ঠাঁই হয় একটি নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে।

কিন্তু কঠিন বাস্তবতা ইয়াসমীনের পিছু ছাড়ে না। আক্রান্ত ও ক্ষত-বিক্ষত ইয়াসমীনের জীবনকে অন্ধকারের স্তব্ধতায় রেখে আর সব কিছু চলতে থাকে ঠিক আগেরই মতো। পরিবারের সবাই পাকিস্তানি বর্বরদের হাতে নিহত ও ইয়াসমীন নিজে চরম লাঞ্ছিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার যে প্রেমিক সারা জীবন সুখে-দুঃখে ইয়াসমীনের সঙ্গী হওয়ার সঙ্কল্প করেছিল, সে এখন আরেকজনের স্বামী। 

এমনই পরিস্থিতিতে ইয়াসমীন একদিন তার চাচার বাসা খুঁজে পায়। কিন্তু এতদিন পর তাকে দেখে চমকে উঠে চাচা। ইয়াসমীন বুঝতে পারে তাকে আর আগের মতো গ্রহণ করছে না। চাচা ইয়াসমীনকে চাকরি ও অন্যান্য সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও নিজের পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত। 

ক্ষুব্ধ ইয়াসমীন আবার ফিরে আসে তার শেষ ভরসাস্থল পুনর্বাসন কেন্দ্রে। ইয়াসমীনের চাচা তার একটি চাকরির ব্যবস্থা করলেও ইন্টারভিউ বোর্ডে ইয়াসমীনকে সম্মুখীন হতে হয় চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির। সর্বত্র তার বীরাঙ্গনা পরিচয়ই মুখ্য হয়ে উঠে। উচ্চ শিক্ষিত ইয়াসমীনের যোগ্যতার চেয়ে তার লাঞ্ছিতা জীবনের কাহিনীই প্রশ্নকর্তাদের কৌতূহলের বিষয় হয়ে পড়ে। প্রশ্নকর্তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ ইয়াসমীনের বিক্ষুব্ধ উক্তির মাধ্যমে ঔপন্যাসিক নারীর আত্মসম্মানের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত্ব করেন:

‘আমার সম্পর্কে আপনাদের আগ্রহের চেয়ে কৌতূহল বেশি। কারণ আমি সরকারের দেয়া বীরাঙ্গনা খেতাব নিয়ে এসেছি। আপনাদের দৃষ্টি, আপনাদের ভঙ্গি বলে দিচ্ছে যে, আমি সমাজ ছাড়া মানুষ। সরকার বোধ হয় বারাঙ্গনা বলতে ভুলে বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়ে ফেলেছে। ... পাকিস্তানি সৈন্যরা আমার দেহের ক্ষতি করেছে। আর আমার মনের ক্ষতি করছেন আপনারা। আপনাদের মতো মানুষেরা যারা কিছু না হারিয়েও স্বাধীনতার ফল ভোগ করছেন।’

৫.

ইয়াসমীনের সংক্ষুব্ধ বক্তব্যের মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছে তীব্র বিদ্রূপ, ঘৃণা এবং পুরুষশাসিত সমাজে নারীর প্রতি নেতিবাচত দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ। মুক্তিযুদ্ধের বীর নারীদের প্রতি সমাজ ও কতিপয় মানুষের হীন মনোভাবেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ইয়াসমীনের ঘটনায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত ও লাঞ্ছিতরা বীরাঙ্গনা খেতাব পেলেও সামাজিক ক্ষুদ্রতার কারণে কিছু মানুষ তাদেরকে গ্রহণযোগ্যতা ও যথাযথ মূল্যায়ন করে নি। পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয় এবং সমাজের বিভিন্ন পেশায় আসীনরাও দেখাতে পারে নি উদারতা ও সম্মান।

ইয়াসমীনের জীবন-বাস্তবতার কঠিন পরীক্ষার এখানেই শেষ নয়। শারীরিক লাঞ্ছনা ও মানসিক পীড়নের পাশাপাশি তার ওপর নেমে আসে শোষণ ও অবদমন। উপন্যাসের এক পর্যায়ে দেখা যায়, আশ্রয়কেন্দ্র থেকে একজনের সঙ্গে ইয়াসমীনের বিয়ে হলেও তার পেছনে ছিল নোংরা ষড়যন্ত্র, লোভ ও অসাধু মনোভাব। 

অল্প সময়ের মধ্যেই ইয়াসমীন আবিষ্কার করে যে, তার বিবাহিত স্বামীর আসল উদ্দেশ্য দাম্পত্য ও প্রেম নয়, অন্য কিছু। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্কুল পরিস্থিতিতে ইয়াসমীনের দখল হয়ে যাওয়া বাড়িটি উদ্ধার ও ভোগ-দখল করতে এবং ইয়াসমীনের শরীরকে ব্যবহার করে ফায়দা লোটার জন্যই বিয়ে নামক প্রহসন করেছে। প্রতিদিনই নিত্যনতুন পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে ইয়াসমীনকে তার কথিত স্বামী বাধ্য করছে। স্বামীর অত্যাচারে শেষপর্যন্ত ইয়াসমীনের ঠাঁই হয় নিষিদ্ধপল্লী পতিতালয়ের অন্ধকার জগতে। জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে মেনে প্রতিবাদী ইয়াসমীন তারপরেও বলতে থাকে তার ক্ষুব্ধ কথামালা:

‘যুদ্ধ যদি আমাকে বেশ্যাই বানাল, তবে তার ফলভোগ ওই ক্রীম খাওয়া লোকদের করতে দেব না। আমি বেশ্যা। আমি বেশ্যা হয়েই যাব।’ 

৬.

মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত রণাঙ্গণ আর জীবন-যুদ্ধের কঠিন ক্ষেত্র পেরিয়ে পতিতালয়ের অন্ধ-অন্ধকার জগতেই শেষপর্যন্ত ইয়াসমীনের করুণ মৃত্যু ঘটে বেশ্যাপল্লীর পাষণ্ড গুণ্ডার ছুরিকাঘাতে। এইভাবে উপন্যাসের সমাপ্তির মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে মহান মুক্তিযুদ্ধে সব কিছু হারানো এক বীরাঙ্গনা নারীর। 

ইয়াসমীনের মর্মান্তিক মৃত্যু পুরুষশাসিত ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজে নারীর বিপন্ন অস্তিত্বকেই কেবল নির্দেশ করে না, একটি জাতির স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গজনিত ট্র্যাজেডির স্বরূপও উন্মোচিত করে। ব্যক্তির করুণ আখ্যান ও আত্মত্যাগ জাতীয় জীবনকে উজ্জ্বল করলেও সামাজিক অন্ধকার আর ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ ইয়াসমীনের মতো সেইসব উজ্জ্বল মুখচ্ছবিকে ঢেকে দেয়। জীবনের প্রয়োজনে ও জাতীয় তাগিদে এক মহান মানবীর ত্যাগ ও লড়াইয়ের গৌরবকে লুটেরা সমাজ ও স্বার্থান্ধ মানুষ নস্যাৎ করে। যার অবদান হওয়ার কথা কথা ইতিহাসের স্বীকৃতিতে ধন্য এবং তার অবস্থান হওয়ার কথা জাতীয় জীবনের উচ্চতর স্থানে, তাকে যুদ্ধোত্তর সমাজ বাস্তবতা লাগাতার শোষণ ও লাঞ্ছনার পর নৃশংসভাবে হত্যা করে পাঠিয়ে দেয় মৃত্যুর ঠিকানায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ ও মুক্তি সংগ্রামে এদেশের নারী সমাজের একটি ব্যাপক অংশের আত্মত্যাগ ও বীরোচিত ভূমিকা ইতিহাসের গৌরবময় অংশ হলেও সেইসব নির্যাতিতা নারীদের যথাযথ মূল্যায়ন, পুনর্বাসন ও সম্মানজনক স্থান নির্ধারণ করতে ব্যক্তি, সমাজ ও প্রশাসন চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। রিজিয়া রহমান ‘রক্তের অক্ষর’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধে নারীর আত্মত্যাগ, মানবিক বিপর্যয় এবং সেই বিপর্যয়কে কাটিয়ে উঠার ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক ব্যর্থতার প্রকট চিত্রটিই তুলে ধরেছেন ইয়াসমীনের বিয়োগান্ত করুণ পরিণতির আখ্যান নির্মাণের মাধ্যমে।

৭.

শুধু ‘রক্তের অক্ষর’ নয়, রিজিয়া রহমান মুক্তিযুদ্ধকে বার বার এবং বহুমাত্রিকভাবে স্পর্শ করেছেন তার কথাশিল্পের মাধ্যমে। ‘একটি ফুলের জন্য’ উপন্যাসে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সমাজজীবন ও সময়-প্রবাহকে নানামুখী ঘাত-প্রতিঘাতে চিত্রিত করেছেন। তুলে ধরেছেন তৎকালীন সামাজিক বৈষম্যের পাশাপাশি জীবনযুদ্ধে পরাজিত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষোভ, হতাশা ও বঞ্চনার আখ্যান। মনে রাখা দরকার যে, সে সময় সমাজ বাস্তবতা বদলে গিয়েছিল বিপরীত মেরুতে এবং অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই বাস্তব জীবনে নিদারুণ অবহেলা ও করুণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন।

যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা, যারা রণাঙ্গণের কঠিন সমরে হারিয়েছিলেন তাদের হাত, পা এবং হয়েছিলেন পঙ্গু, তাদেরকে বড় গলায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নামে ডাকা হলেও, তাদেরকে যথাযথ সামাজিক সম্মান, স্বীকৃতি দেওয়ার বদলে এক ধরনের অবজ্ঞা ও অবহেলার শিকারে পরিণত করা হয়। বীরাঙ্গনার মতো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারেও সমাজ ছিল কুণ্ঠিত। এইসব বীরদের স্থান হয়েছিল সরকারি হোম-এ। কেউ কেউ জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার তাগিদে রিকশা চালিয়েছেন। অনেকে বেছে নিয়েছিলেন ভিক্ষাবৃত্তি। এমনই ছিল যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অতি নির্মম আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা।

রিজিয়া রহমানের ‘একটি ফুলের জন্য’ উপন্যাসের নায়ক আলফু তেমনই একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে তার একটি পা হারিয়েছে। অন্যদিকে তার সহযোদ্ধা সাজ্জাদ পঙ্গু হয়ে সরকারি হোম-এ আশ্রিত হয়ে থাকে। রণাঙ্গনের আরেক সহযোদ্ধা ফরহাদ একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করে। অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সমীহ করলেও তারা তার মুক্তিযোদ্ধা ইমেজটাকেই বাণিজ্যিক স্বার্থে কাজে লাগাতে চায়। 

এমন বিরূপ পরিস্থিতি ও বাস্তবতা টের পায় উপন্যাসের চরিত্রসমূহ। যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তারা যে কখনো কখনো লৌকিক সম্মানের বাইরে বাস্তবে অবজ্ঞা-অবহেলা ছাড়া কিছুই পাচ্ছেন না, সেটাও অনুভব করেন। ফলে হতাশ ও ক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধারা এক ধরনের অবসাদ ও বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত হন। বঙ্গভবন ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দাওয়াত দেয়া হলেও সেখানে এইসব পঙ্গু বীরযোদ্ধারা যেতে চান না। এই অব্যক্ত বেদনা ও প্রান্তিকীকরণের মনস্তত্ত্ব মূর্ত হয় রিজিয়া রহমানের প্রাঞ্জল ভাষায়:

‘গণ্যমান্য সম্মানী মানুষের ভিড়ের মধ্যে বুকের সেই ভয়টা ওদের প্রত্যেকটা মুহূর্তে সচেতন করে রেখেছে। কি যেন এখানে যে মুখগুলো ওদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে, তাদের দৃষ্টির গভীরেও কি সেই কথাটা লুকানো আছে কিনা, তোমরা পঙ্গু।’

উপন্যাসে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবহেলা এবং তাদের হতাশা ও গ্লানির স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। সমাজে তারা যে অপাংক্তেয় ও করুণার পাত্র, তা-ও পরিস্ফুটিও হয়েছে। বিশেষ বিশেষ দিনে রাষ্ট্র ও সরকার তাদেরকে স্মরণ করলেও তা তাদের কোনও কাজেই আসে না। যে সত্য প্রকাশ পায় উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র পঙ্গু-যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মুনিরের হতাশামিশ্রিত কথায়:

‘ভোর থেকে সবাই সাভারের শহীদ মিনারে ছুটছে। এদেশে মানুষের চেয়ে মিনারের দাম বেশী; মরে গেলেই বোধ হয় দাম বাড়ে।’

যারা জীবন বাজি রেখে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, হারিয়েছিলেন অঙ্গ, সেইসব জীবিত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষোভ, বিদ্রূপ, হতাশার মধ্য দিয়ে যে বাস্তবতার দেখা উপন্যাসে পাওয়া যায়, তা হলো, দেশের বীর ও শ্রেষ্ঠ সন্তানরা রাষ্ট্র ও সমাজে প্রকৃত স্বীকৃতি বঞ্চিত ও চরম অবহেলার শিকার। রিজিয়া রহমান তাদের মর্যাদা না দেওয়ার বেদনাকে শিল্পিত করে তুলেছেন তার লেখায়। উন্মোচিত করেছেন নির্মম সমাজ বাস্তবতার প্রবঞ্চনা ও ব্যর্থতাকেও।

৮.

উপন্যাসের এক প্রান্তে প্রকৃত ও ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলিত পরিস্থিতির পাশাপাশি আরেক প্রান্তে দেখা পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে আরেক নিকৃষ্ট খেলার। যে খেলায় জড়িত অসৎ রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসক ও স্বার্থান্ধ মানুষ। যারা মুক্তিযুদ্ধের মতো মহৎ ও ঐতিহাসিক প্রপঞ্চকেও ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহার করতে পিছপা হয় না।

আখ্যানে এ পর্যায়ে দেখা যায়, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ভব, মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট ও নাম ভাঙিয়ে স্বার্থবাদী মহলের আখের গুছিয়ে নেওয়ার মচ্ছব। একই সঙ্গে স্বাধীনতা বিরোধীদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে পুনর্বাসন ও সামাজিক মর্যাদায় পুনরাধিষ্ঠানের ঘটনা অতি দ্রুততার সঙ্গে ঘটতে থাকে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ রাজনৈতিক ঘুর্ণাবর্তে ও অবক্ষয়ের ফলে বিকৃত ও কোণঠাসা হওয়ার এই চিত্র উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। 

রিজিয়া রহমান সাহসের সঙ্গে এবং শৈল্পিক সুষমায় দেখান যে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ষড়যন্ত্রের ফলে সাধারণ জনমানসে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরির একটা অপচেষ্টা সন্তর্পনে চলছে, তাদেরকে কোণঠাসা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে উপন্যাসে দেখানো হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা ফরহাদের ছোট ভাই আহাদ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান না করেও কৌশলে দ্রুত প্রতিষ্ঠা লাভ করছে। বাংলাদেশের সমাজে এই নেতিবাচক রাজনৈতিক বিবর্তন উন্মোচন করেছেন তিনি পারঙ্গম বর্ণনায়:           

‘ফরহাদের দু’বছরের ছোট আহাদ। মুক্তিযুদ্ধে যায় নি সে। সেই আহাদ স্বাধীনতার পর মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হয়ে গিয়েছিল। অমুক্তিবাহিনী বন্ধুদের নিয়ে সে দল তৈরি করে ফেলেছে। … মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট যোগাড় করেছিল সে। ম্যাট্রিক পাশ আহাদ কি চমৎকারভাবে অন্ধকারের সিঁড়িগুলো টপকে গেলো। ব্যবসা করল। … এখন বিলাতে চাকুরী করে। ফ্ল্যাট কিনেছে।’

কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ভাই ফরহাদ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধকে বিসর্জন দিতে পারে নি বলেই পিছিয়ে পড়ল। এইসব মুক্তিযোদ্ধারা যারা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যুদ্ধে গিয়েছিল, তারাই দেশ ও সমাজ থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছরের মধ্যেই, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ এবং চেতনার বিলুপ্তি ঘটল রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে। উপন্যাসে সেই যুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধবাদীদের উত্থান ও বিকাশের বাস্তবতাকেই রিজিয়া রহমান মূর্ত করেছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মজৈবনিক ধারাক্রমের বর্ণনার মাধ্যমে। 

এক সময় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির চরম শক্তি সঞ্চয়ের ফলে এমন একটি প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মধ্যে তো বটেই, খোদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও উচ্চারিত হতে থাকে যে, কেন তারা যুদ্ধে গিয়েছিল? উপন্যাসে এই আত্মজিজ্ঞাসায় ক্রমাগত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে উপসংহারে একটি আশাবাদী প্রত্যয় তুলে ধরেন রিজিয়া রহমান। কোনও ব্যক্তিগত আকাক্ষা নয়, যুদ্ধ ও ত্যাগ শুধুমাত্র দেশের জন্য, স্বাধীনতার ফুলকে ধরার জন্য। এ চিরায়ত মনোভাব তিনি ব্যক্ত করেন উপন্যাসের শেষ দিকে, মুক্তিযোদ্ধা ফরহাদের কণ্ঠে:

‘আমরা চাই না কোনও বিদেশী ট্যাংকের নীচে আমাদের সে ফুল পিয়ে কলঙ্কিত করা হোক। অনেক দুঃখ নিয়েও অনেক কষ্ট করেও আমরা এই ফুলকে মুক্ত রেখেছি। এ ফুলকে আমরা বাঁচাবোই।’

স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ন রাখতে, স্বাধীনতাকে পেতেই মানুষের যুদ্ধযাত্রা সম্পন্ন হয়। শত ক্ষোভ, যন্ত্রণা ও না-পাওয়ার বেদনাকে ভুলেই বীর যোদ্ধারা স্বাধীনতার ফুলকে ধরে রাখেন। উপন্যাসে রিজিয়া রহমান নৈরাশ্য, অন্ধকার, জীবনযন্ত্রণা ও হতাশার বিরুদ্ধে সন্ধান করেছেন আলোকিত ভবিষ্যতের সোনালী দিনের। ব্যর্থতা, যন্ত্রণা ও পরাজয়ের সর্বগ্রাসী প্রতিষ্ঠার মধ্যেও রিজিয়া রহমান সন্ধান করেছেন আলো ও শ্রশ্রূষা। তার জীবনবাদী মন ও মনন বিপন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিমেয় প্রেমশক্তিতে উত্তরণের শক্তিমত্তাকে আবিষ্কার করেছে।  

৯.

রিজিয়া রহমানের উপন্যাসে প্রত্ন-ঐতিহাসিক আবহ আধুনিক বাংলা উপন্রাসের এক উজ্জ্বল অর্জন। বেলুচিস্তানের পটভূমিতে তার রচিত উপন্যাস ‘শিলায় শিলায় আগুন’ শুধু শক্তিশালী রচনাই নয়, সুগভীর সমীক্ষাও বটে। তিনি প্রত্বতাত্ত্বিকদের মতো ইতিহাস আর ঐতিহ্য খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে এনেছেন তার প্রায় প্রতিটি উপন্যাসে। 

যেমন, ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসটির ব্যাপ্তি বাঙালির জাতি গঠন ও ভাষার বিবর্তণের ইতিহাস। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বং গোত্র থেকে শুরু হয়ে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় পর্যন্ত এই উপন্যাসের বিস্তৃতি। 

আবার নীল বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে খুলনা অঞ্চলের এক বিপ্লবী রহিমউল্লাহর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার বীরত্বগাঁথা নিয়ে লিখেছেন ‘অলিখিত উপাখ্যান’। 

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির সাঁওতাল শ্রমিকদের জীবনচিত্র পর্যবেক্ষণ করে তিনি রচনা করেছেন ‘একাল চিরকাল’। 

‘প্রাচীন নগরীতে যাত্রা’ উপন্যাসে লিখেছেন ঢাকার অতীত ও বর্তমান জীবনযাপন।

চট্টগ্রামে হার্মাদ পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচার এবং পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দখলদারিত্বের চিত্র তুলে ধরেছেন ‘উত্তর পুরুষ’ উপন্যাসে, যেখানে চিত্রিত হয়েছে আরাকান-রাজ-সন্দ-সুধর্মার অত্যাচার, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্ব, পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের গোয়া, হুগলি, চট্টগ্রাম দখলের ইতিহাস।

গভীর মননশীলতায় রিজিয়া রহমান নির্মাণ করেছেন তার লেখালেখির জগৎ। এতো বড় মাপের লেখক শুধু তার সমকালেই নয়, অনাগতকালেও আলো ছিড়াতে থাকবেন। শেষ জীবনে তিনি ছিলেন নিভৃতচারী, এবং অবশেষে জীবনের চেয়ে দূরের ঠিকানায় তিনি চলে গেছেন চিরকালের জন্য। তথাপি পাঠক চিত্তে তিনি জাগ্রত থাকবেন তার অক্ষয় অক্ষরমালায় সজ্জিত গল্প-উপন্যাস, কথাশিল্পের সম্ভারে।

১০.   

খুব কাছ থেকে পর্বতকে বড় ও বিশাল দেখায় না। মনে হয় দেয়াল মাত্র। তেমনি আশেপাশের বড় মাপের মানুষদের বিশালতাও আমরা টের পাই না। শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা অজ্ঞতা বা ক্ষুদ্রতার জন্য নিজস্ব মেধাকে এড়িয়ে যাই। ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমান তেমনি বড় মাপের একজন কথাকার। যদিও আমরা আমাদের কাছের মেধাবীদের বিশালত্ব মূল্যায়ন করতে পারি না। দূরের কেউ হলে, সেটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার বন্যা শুরু হয় সাহিত্যের পাতায়। অথচ বিশ্ব বরেণ্য লেখকদের মতোই তার লেখার মান, তা আমরা মূল্যায়নের আলোয় আনতে পারি নি। 

রিজিয়া রহমান  ভারতের কলকাতার  ভবানীপুরে এক মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তার পৈত্রিক বাড়ি ছিল কলকাতার কাশিপুর থানার নওবাদ গ্রামে। তার পারিবারিক নাম ছিল জোনাকী। তার বাবা আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক ছিলেন একজন চিকিৎসক ও মা মরিয়াম বেগম একজন গৃহিণী। তাদের পরিবার ছিল সংস্কৃতিমনা। তার দাদা মুন্সী আব্দুল খালেকের পড়ালেখার অভ্যাস ছিল। তার ঘরে সেলফ ভর্তি ছিল ইংরেজি আর ফার্সি বই। তার বাবা ছিলেন সঙ্গীত অনুরাগী। তিনি এসরাজ ও বাঁশি বাজাতেন এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতেন।

রিজিয়া রহমানের বাবার চাকরীর কারণে তাদের ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর তারা বাংলাদেশে চলে আসে। দেশে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ফরিদপুরে। সেই সময় শখের বশে কবিতা লিখতেন। তখনই তার লেখালেখির সূচনা হয়।  পরে তিনি কষ্ট করে শিক্ষা জীবন এগিয়ে নেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। 

পুরোটা জীবন তিনি কাটিয়েছেন সাহিত্য সাধনায়। তার প্রচেষ্টায় আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্য ঋদ্ধ হয়েছে। তিনি তার অনন্য সাহিত্য সম্ভারের মধ্যে বেঁচে থাকবেন মৃত্যুর পরেও। নারী, মুক্তিযোদ্ধা, সংগ্রামী মানুষ, প্রান্তিক জনজীবনের কথা যে রক্তের অক্ষরে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, তা জোনাকির আলোর মতো প্রজ্বলিত থাকবে বাংলাদেশের সাহিত্যের আকাশে।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;