পৃথিবীর অনন্যতা



ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী

  • Font increase
  • Font Decrease

গোল্ডিলক্সের নামে একটি জনপ্রিয় কাহিনী প্রচলিত আছে। গোল্ডিলক্স নামের এক উচ্ছ্বল স্বর্ণকেশী কিশোরী পথ হারিয়ে বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে একটা বাড়ি দেখতে পায় কাউকে না পেয়ে সে ঐ বাড়িটিতে ঢুকে পড়ে। সে দেখে সেখানে সব জিনিসই তিনটি তিনটি করে সাজানো সেখানে তিনটে চেয়ার আছে (যার একটি খুব শক্ত, একটি খুব নরম, আরেকটা একদম ঠিকঠিক), তিনটে বিছানা আছে (যার একটি খুব শক্ত, একটি খুব নরম, একটি একদম ঠিক আরামের বিছানা), তিন রকম খাবার আছে (একটি খুব গরম, একটি খুব ঠান্ডা, একটি একদম ঠিক) গোল্ডিলক্স ঠিক সেই চেয়ারটিতে বসে যেটি একদম ঠিক আরামদায়ক, সেই খাবারটি খায় যা ঠিক নাতিশীতোষ্ণ, সেই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে যা একদম ঠিক মনের মতো ঘুম হঠাৎ করে ভেঙে গেলে সে উঠে দেখে তার দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছে একটি দশাসই বাবা-ভালুক, মিষ্টি চোখে তাকিয়ে আছে একজন মাঝারি মা-ভালুক এবং বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে আছে একটি বাচ্চা-ভালুক এই দেখে গোল্ডিলক্স পড়িমরি করে ছুটে পালায়

সবকিছু ঠিকঠাক পাওয়ার ব্যাপারটা সেই থেকে ‘গোল্ডিলক্স শর্ত’ বলে চালু হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য এই গোল্ডিলক্সের ব্যাপারটা আরো বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তার কারণ পৃথিবীতে আমাদের বসবাসের ব্যাপারটা অনেকগুলো ঠিকঠিক ঘটনার সময়োপযোগী সমাপতন না ঘটলে সম্ভব ছিল না। অবশ্য আমরা সেটা বলতেই পারি। কারণ তেমনটি না হলে পৃথিবীতে এই কথা বলার মতো কেউ থাকতই না। আমরা পৃথিবীতে থাকতে পারছি কেননা এখানকার পরিবেশ ও অন্যান্য ভৌত শর্তাদি আমাদের থাকার জন্য খুব উপযোগী। সত্যি বলতে কি, পৃথিবীর জল-ডাঙ্গা-আকাশ আমাদের জন্য এমন এক সুন্দর পরিবেশ তৈরি করেছে যে তা খুব সূক্ষ্ম কিছু ব্যালান্সের ওপর নির্ভর করে। এছাড়াও তার ভূগাঠনিক প্রক্রিয়াদি এবং গ্রহগত পরিবেশ মোটের ওপর প্রাণ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এমনটি না হলে প্রাণের উদ্ভব হলেও মানুষ সভ্যতার পত্তন করতে পারত কিনা সন্দেহ। এমন সিদ্ধান্তের কারণ অন্যান্য বাহ্যগ্রহে এমন প্রাণ সহায়ক উপাদানের সমাবেশ হয়েছে বলে মনে হলেও আমাদের নাক্ষত্রিক মহল্লায় ধীমান সত্তার কোনো সুনির্দিষ্ট খোঁজ নেই। কাজেই অনুকূল শর্ত থাকাটাই শেষ কথা নয়। আরো কিছু বাধা আছে।

এই কথাই বলা হয়েছে ‘রেয়ার আর্থ’ অনুকল্পে। নানাবিধ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক, মহাজাগতিক, ভূগাঠনিক, গ্রহগত, প্রাণ ও ভূ-রাসায়নিক প্রপঞ্চ পর্যালোচনা করে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে পৃথিবী এবং তাতে মানুষের সভ্যতা সৃষ্টি একটি অতি বিরল ঘটনা। তা যেন শ্রেষ্ঠ কবিতার মতো, যা বিতরিত হবার জিনিস নয়। পৃথিবীর চিহ্নিত করে রাখার মতো অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলো–

পৃথিবীর একটি দীর্ঘমেয়াদী কার্বনডাই-অক্সাইড-সিলিকেট চক্র চালু আছে; গ্রহটির ভর যথেষ্ট যাতে করে এটি একটি বায়ুমণ্ডল ধরে রাখতে পেরেছে এবং এর অভ্যন্তরে টেকটনিক সক্রিয়তা অক্ষুণ্ণ আছে; এর জলবায়ু বরফাচ্ছাদিত পৃথিবী (স্নোবল) আর উষ্ণ পৃথিবীর (গ্রিনহাউজ) মধ্যে দোলাচল করে; এর প্রাণজগতের ইতিহাসে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণের মতো একটি ঘটনা ঘটেছে; পৃথিবী নামক গ্রহটির কক্ষীয় অবস্থা এবং সুস্থিতি; এর গ্রহগত প্রতিবেশ (চাঁদের মতো ভারী উপগ্রহ, মঙ্গল ও শুক্র গ্রহের উপস্থিতি, বৃহস্পতির মতো গ্যাস-দানবের উপস্থিতির ফলে ধূমকেতুরা পৃথিবী থেকে দূরে থাকে); সৌর প্রতিবেশ (সূর্য কোনো তারাস্তবকের সদস্য নয়); সূর্য থেকে ঠিকঠিক দূরত্ব (প্রাণবান্ধব কক্ষপথ); বামন নক্ষত্রের পাশে জন্ম (সুদীর্ঘকাল প্রায়-সমান হারে নম্র-বিকিরণ লাভ); গ্রহটির বিশিষ্ট এবং নিজস্ব ভূজৈবরসায়ন (বায়োজিওকেমিস্ট্রি)  এবং আন্তঃমিথোজীবিতা (এন্ডোসিমবায়োসিস) (যার ফল হলো নীল-সবুজ শৈবাল, বাতাবরণে অক্সিজেন বিপ্লব, একাধিক বিপাকীয় প্রক্রিয়ার উপস্থিতি, যৌনতা) ইত্যাদি। এই প্রপঞ্চগুলির একত্র সমাবেশ পৃথিবীকে অনন্য করে তুলেছে। এগুলোর অনুপস্থিতিতে সভ্যতার উদ্ভব সংশয়াকুল হতো। এখানেই পৃথিবীর বিরলতা।

আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার সূচনা গ্যালিলেও’র (১৫৬৪-১৬৪২) হাত ধরে, তাঁর দুরবিনে চোখ রেখে, শুরু হয় ১৬১০ সালে। কিন্তু তার আগেই আধুনিক চিন্তাধারার বীজ রোপিত হয়। বলতে গেলে সেই বীজ রোপণের সালটা ১৫৪৩ অব্দ এবং কাজটা শুরু করেছিলেন প্রুশিয়ার পোলিশ বংশে জন্ম নেওয়া নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)অন দ্য রেভোল্যুশনস অব দ্য সেলেশ্চিয়াল স্ফিয়ার্স’ গ্রন্থে কোপার্নিকাস এক যুগান্তকারী ধারণা প্রদান করেন। দীর্ঘদিন থেকে জানা ছিল পৃথিবী স্থির এবং সূর্যসহ অন্য সবকিছু একে ঘিরেই ঘুরছে। পৃথিবীকেন্দ্রিক এই ধারণা সুপ্রাচীন। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে এই ধারণার এক গাণিতিক মডেল দেন ক্লডিয়াস টলেমি (১০০-১৭০) তাঁর পূর্বসূরীরা জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে যা কিছু জানতেন তার এক সংশ্লেষণ টলেমি তার ‘আলমাজেস্ট’ গ্রন্থে উপস্থাপন করেন। তিনি এই পৃথিবীকেন্দ্রিক ধারণার একটি গাণিতিক মডেলও স্থাপন করেন। মনে রাখতে হবে, সেই সময়ে টেলিস্কোপ ছিল না। খালি চোখে মনোযোগী পর্যবেক্ষকরা যা দেখেছেন তারই ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কাজেই তাঁদের খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু টলেমির বইটি একটানা চোদ্দশত বছর এই মডেলকে প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করতে সাহায্য করেছিলকিন্তু টলেমির মডেলে সংশোধন প্রয়োজন ছিল। মুসলিম বিশ্বের অনেক জ্যোতির্বিদই সেটার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু কোপার্নিকাস একটা চমৎকার সহজ গাণিতিক মডেল উপস্থাপনের মাধ্যমে দেখালেন যে, ‘পৃথিবী কেন্দ্রে আছে’ এটা না ভেবে সূর্যকে কেন্দ্রে ভেবে নিলে গ্রহ-তারাদের গতি ব্যাখ্যা করা সহজ হয়এই সহজ কল্পনাটি একদিকে যেমন যুগান্ত সৃষ্টি করে, অপরদিকে তেমনি প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হয়।

কোপার্নিকাসের এই কাজটি শুধু ওখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটা একটা নীতিতে পর্যবসিত হয়- কোপার্নিকাসের নীতি। এই নীতি অনুযায়ী পৃথিবী কোনো কিছুর কেন্দ্রে নেই, এমনকি কোনো বিশেষ অবস্থানেও নেই, কোনো বিশেষ গুণের অধিকারীও নয়। এই মাঝারিত্ব বা মিডিওক্রিটি বিজ্ঞানে অনেক নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করেছে। এই নীতির সম্প্রসারণ মহাবিশ্বের সার্থক মডেল সৃষ্টিতেও কাজে লাগে। মহাবিশ্বকে দিকনিরপেক্ষ ও সমসত্ত্ব ধরে নেয়া হয়। এভাবে ভাবা হয়- আমরা পৃথিবী থেকে গ্যালাক্সিকে যেভাবে দেখছি, গ্যালাক্সির অন্য জায়গা থেকেও গ্যালাক্সিকে প্রায় অনুরূপ দেখা যাবে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি থেকে মহাবিশ্বকে যেমন দেখায়, স্থানীয় পার্থক্য বাদ দিলে অন্য গ্যালাক্সি থেকেও মহাবিশ্বকে মোটের ওপর তেমনই দেখাবে। এটাই মহাজাগতিক নীতি বা কসমোলজিক্যাল প্রিন্সিপ্‌ল। এই নীতির জন্যই আমরা পুরো মহাবিশ্ব নিয়ে মডেল তৈরি করতে পারি। কম্পিউটার সিমুলেশন করে ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ গণনা করতে পারি। মহাবিশ্বের নানান প্যারামিটার গণনা করতে পারি। পর্যবেক্ষণের সাথে মিলাতে পারি। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটি করতে না পারলে মহাবিশ্ব সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ভাবনাচিন্তা পূর্ণাঙ্গ হতো না। আর এই কাজটির পেছেনে আছে ঐ নীতি- আমরা মাঝারি, অন্যরা যেমন আমরাও তেমন। অন্য যেকোনো জায়গায় গেলে, আমাদের মতো গ্রহ ও পরিবেশ ঠিক ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে।

কিন্তু ইদানীংকালের পর্যবেক্ষণ এটা ঠিক সমর্থন করছে না। আমরা জেনেছি, সূর্য বামন নক্ষত্র হলেও গ্যালাক্সির অধিকাংশ নক্ষত্র সূর্যের তুলনায় ছোট। পাথুরে গ্রহ হলেই প্রাণবান্ধব হয় না। বাহ্যগ্রহ মানেই প্রাণবান্ধব এবং পৃথিবীসদৃশ নয়। মূলত বেশিরভাগ বাহ্যগ্রহই ‘হট জুপিটার’। অর্থাৎ এইসব বাহ্যগ্রহের বেশিরভাগেরই ভর বৃহস্পতি গ্রহের মতো বিশাল (বা তারও বেশি) এবং এদের অবস্থিতি তাদের নক্ষত্রের খুব কাছে (বুধগ্রহ যেমন সূর্যের খুব কাছে)। আগে মনে করা হতো, নক্ষত্রের অত্যন্ত নিকটে খুব বড় গ্রহ থাকতে পারে না। কিন্তু বাহ্যগ্রহদের ভর ও নক্ষত্র থেকে তাদের দূরত্ব পর্যালোচনা করে দেখা যায় ‘হট জুপিটার’ই সংখ্যায় বেশি।

মহাবিশ্বের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার একটু এদিকওদিক হলেই এখানে প্রাণই সৃষ্টি হতো না, বুদ্ধিমত্তা তো দূর কি বাত! বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড যদি মহাজাগতিক ধ্রুবক শাসিত হয়, যদি এর স্থানিক জ্যামিতি সমতল হয়, যদি এর বস্তু-ঘনত্ব ২৫% এর কম হয়, তাহলে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এর পরিণতি উন্মুক্ত হবে। অর্থাৎ মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারিত হতেই থাকবে। এই প্রসারণ ত্বরিৎ হারে হতে পারে। যেটা ১৯৯৮ সালের গবেষণায় একাধিক জ্যোতির্বিদ দেখিয়েছেন। এই ত্বরণ ধ্রুব থাকতে পারে, কমে যেতে পারে, বেড়ে যেতে পারে। কোনটা হবে সেটা এখনই আমরা জানি না।

উন্মুক্ত এবং ত্বরিৎ প্রসারমান বিশ্বে পর্যাপ্ত দীর্ঘকাল পর আর কোনো কাঠামোই থাকে না। গ্যালাক্সি বিলুপ্ত হয়ে যায়, সব তারা নিভে যায়, কৃষ্ণবিবরগুলি হকিং বিকিরণ দিয়ে উবে যায়। এ অবস্থায় মহাবিশ্বে থাকে শুধু কিছু ব্যাপ্ত গ্যাস আর মৌলিক কণার সমাহার। কোনো কাঠামো নেই, কোনো শক্তির উৎস নেই–শুধুই পরিব্যাপ্ত ও অত্যন্ত হাল্কা গ্যাস। এই অবস্থা গ্যাসের প্রচলিত গতিতত্ত্ব অনুযায়ী তাপীয় সুস্থিতির (থার্মাল ইকুইলিব্রিয়াম) সমতুল্য। তাপীয় সুস্থিতি বা ইকুইলিব্রিয়ামে থাকলে কোনো ব্যবস্থার আর কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়, কারণ ঐ অবস্থায় সিস্টেমের এনট্রপি বা বিশৃঙ্খলার মাত্রা সর্বোচ্চ থাকে। ‘তাপীয় সুস্থিতির’ অন্য অর্থ ‘মৃতবৎ অবস্থা’কোনো সিস্টেমের সকল উপাংশ যদি পরস্পরের সাথে একই তাপমাত্রায় থাকে, অর্থাৎ থার্মাল ইকুইলিব্রিয়ামে থাকে, তাহলে তাপের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। কাজেই শক্তির রূপান্তরও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে ভৌত পরিবর্তন থেমে যায়। একটি জীবন্ত কোষ সবসময়েই তার বাইরের পরিবেশের সাথে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। এই নন-ইকুইলিব্রিয়ামই প্রাণের লক্ষণ। কোষ যখন মারা যায় তখন বাইরের সাথে তার ইকুইলিব্রিয়াম ফিরে আসে।

অবশ্য এই ‘গোল্ডিলক্সীয়’ চিন্তাটার একটা স্ট্যাটিস্টিক্যাল দিক আছে। আমরা ঠিক এই প্রেক্ষাপট থেকে, এই কোণ থেকে, এই সময়ে, এভাবে দেখছি বলেই আমরা বিরল হব? নাকি এটা আমাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গির ওপরও নির্ভর করে? আমরা যা সব টুল দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছি তারা কি ঝোঁকমুক্ত? আনবায়াসড? কতখানি ঝোঁকমুক্ত? যেমন দূরের নক্ষত্রের হেলদোল থেকে বাহ্যগ্রহ নির্ণয়ের প্রক্রিয়ায় একটা ঝোঁক আছে। ঐ বাহ্যগ্রহ(গুলো) ভারী হলে তবেই তারা ঐ নক্ষত্রে পর্যবেক্ষণযোগ্য হেলদোল সৃষ্টি করবে। এই কারণেই আমাদের খুঁজে পাওয়া বেশিরভাগ বাহ্যগ্রহই ভারী। একাধিক টেকনিকের ব্যবহার, যন্ত্রপাতির সূক্ষ্মতা বৃদ্ধি এই ঝোঁকমুক্তি ত্বরান্বিত করবে। আরেকটা জিনিস ভাবা দরকার। ধরা যাক, মিরপুর স্টেডিয়ামে সাকিব আল হাসানের খেলা হচ্ছে। আমি ঐদিনই দেখতে গেলাম। কারণ আমার অমুক বন্ধুর ঐ কাজটি ঐ দিনই পড়ে গেলে, সে আমাকে ঐ দিনই টিকিট সাধে। আমিও গেলাম, ঠিক ঐ সময়ে ঐ জায়গাতেই ছিলাম। আর তখনই সাকিব ছয় পেটাল, আর বলটা আমি ধরে ফেললাম! এখানে আমি ভাবতেই পারি আমি ‘স্পেশাল’। কিন্তু ঐখানে ঐ সময়ে কেউ না কেউ থাকতই। যেই থাকুক না কেন, সে ক্যাচটা ধরত এবং ভাবত সে ‘স্পেশাল’। কাজেই এই বিশেষত্ব কিন্তু কেবল ঘটনাচক্রের সমাপতন। এটাও একটা ভ্রান্তিমূলক বিশেষত্ব আরোপ করে।

এইসব বিষয়ে সতর্ক থেকেও এটুকু বলা যায়, আমরা কোনো কিছুর কেন্দ্রে না থেকেও যথেষ্ট বিরল। অনন্যসাধারণ না হয়েও সাধারণের ঊর্ধ্বে, যা সুলভ নয়। বিশ্বজগতে আমাদের অবস্থান সবদিক দিয়েই একদম ঠিক। আমরা বিশেষ কিছু নই, আমরা কোনোকিছুর কেন্দ্রেও নেই। এমন গোল্ডিলক্স সময়ে একটি গোল্ডিলক্স জগৎ খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখানে সবকিছুই একদম ঠিক ঠিক।

   

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

  • Font increase
  • Font Decrease

মানবিকভাবে বিপর্যস্ত গাজ়ার ঘটনাবলি ইসরায়েল সম্পর্কে কয়েকটি মারাত্মক বিষয় উন্মোচিত করেছে। কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন সম্পর্কেও গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বিশ্ববাসীকে। যেমন: ১. গণহত্যা কাকে বলে, ২. নব্য-বর্ণবাদের স্বরূপ কেমন, ৩. জাতিগত হিংসার নৃশংস চেহারা কত ভয়াবহ।

এইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে, বাস্তব গবেষণাগার ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায়, যেখানে প্রশ্নগুলোর ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস‘ বা ‘মডেল টেস্ট‘ করছে, ইসরায়েল। রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের ইসরায়েলি পাইলট প্রজেক্ট তথাকথিক মুক্ত-গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিকারহীনভাবে দেখছে। আরব তথা মুসলিম বিশ্বও এত বড় একটি গণহত্যার বিষয়ে নির্বিকার। 

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা‘ (প্রকাশক: শিশুকানন/রকমারি) শিরোনামে আমার প্রকাশিত বইটিতে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পটভূমিতে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি ও জায়নবাদী নীতির ঐতিহাসিক ধারাক্রমের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সময়ে গণ-নিষ্ক্রমণের ছবিটা বাস্তবে আসলে কেমন হয় আর প্রতিশোধজনিত হিংসার কারণে জাতি, বা রাষ্ট্র, বা তার ধ্বজাধারীরা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, এসব কথাও আলোচিত হয়েছে।

বাস্তবে ইসরায়েলের হিংস্রতা কল্পনার দানবকেও হার মানিয়ে গেছে। ‘গাজায় গণহত্যা বন্ধ হবে‘, মানবিক বিশ্বের এমন শুভ-আশাকে দুরাশায় পর্যবসিত করেছে, ইসরায়েল। গত অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে নিহত হয়েছেন মোট ৩২ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৭৪ হাজার ২শ ৯৮ জন। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমায় গড়ে নিহত হচ্ছেন ১০০ জন এবং আহত হচ্ছেন ১৫০ ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী। ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় বাড়িঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার ২২ লাখ বাসিন্দার ৮৫ শতাংশ।

গাজায় ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন’ সংঘাতকে 'যুদ্ধ' বলা হচ্ছে। আসলে তা মোটেও ‘যুদ্ধ’ নয়, স্রেফ ‘গণহত্যা’। যুদ্ধে সৈন্য মারা যায়। সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাজায় মরছে সাধারণ মানুষ, জনতা। জনতাকে বেপরোয়া হত্যা করা যুদ্ধ নয়, নগ্ন গণহত্যা। যুদ্ধের ছদ্মাবরণে গণহত্যায় মেতে গত ৭৫ বছর ইসরাইল নব্য-বর্ণবাদী আগ্রাসন, জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ফিলিস্তিনে, যার সর্বসাম্প্রতিক হিংস্রতম পর্যায় চলছে গাজায়। সেখানে অসুস্থ রোগী, ডাক্তার, শিশু, বৃদ্ধ, নারী, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। খ্রিস্টানদের বড়দিনে এবং মুসলমানদের  রমজান মাসের পবিত্রতাকেও পরোয়া করা হচ্ছে না। রমজানে গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশেও বাধা দিচ্ছে, জায়নবাদী ইসরায়েলি বাহিনী। বুলেটের আঘাতে আর খাদ্য, পথ্য ও ঔষধের অভাবে মরছে মানুষ গাজা উপত্যকায়।

বিশ্বের ইতিহাসে, সভ্যতার পথ-পরিক্রমায়, এমনকী, যুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরেও যা ঘটেনি কোনোদিনও, তেমন অকল্পনীয়, অভাবনীয় ও অদৃশ্যপূর্ব বর্বরতা-নারকীয়তা প্রদর্শন করছে ইসরায়েল। জীবিত মানুষদের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের পর লাশের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়েছে। এতদিন ইসরাইলি নৃশংসতা ছিল জীবিত গাজাবাসীর ওপর। এবার তা-ও অতিক্রম করেছে। কমপক্ষে চারটি মৃতদেহ ও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়ে তা থেঁতলে দিয়েছে।

বীভৎস, ন্যক্কারজনক এই ঘটনা ঘটছে মুসলিমদের ঘরের ভিতরে, চোখের সামনে। চারপাশে মুসলিম দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর, ইরান, ইরাক, কাতার, তুরস্কসহ আরও কত দেশ। তারা কীভাবে এই নৃশংসতাকে সহ্য করছে!

সহ্য করছে, রাজনৈতিক স্বার্থগত কারণে। অধিকাংশ আরব দেশই স্বৈরশাসকের কব্জায় রয়েছে, যারা টিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার ইচ্ছায়। মার্কিন-ইসরায়েল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস ও শক্তি আরব দেশগুলোর নেই। অনুগত দাসের মতো তারা মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গণহত্যার দর্শক হয়ে আছে। আরব দেশগুলোর এই হলো বাস্তবচিত্র।

তুরস্ককে বেশ সাহসী ও উদ্যোগী মনে করা হলেও বাস্তবে তুরস্ক কৌশলজনক অবস্থানে থেকে ‘না ধরি মাছ, না ছুঁই পানি‘ নীতিতে নিজেকে নিরাপদ রাখছে। নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায় না তুরস্ক। 

বাদ থাকে ইরান। ইরান ও তার সহযোগী সিরিয়া, লেবানন ও ইয়ামেনের কিছু গ্রুপ মাঝে মাঝে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান নিজে মাঠে নামছে না। নানা গ্রুপকে কাজে লাগাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ-ইসরায়েল সমর্থনের বিপরীতে রাশিয়া ও চীন সুস্পষ্ট কোনো ভূমিকা নিয়ে সংঘাতের অবসানে কাজ করছে না। তারা নিজ নিজ স্বার্থ ও কৌশলের আলোকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বড় ও শক্তিশালী দেশ দুটি ফিলিস্তিনে গণহত্যার ঘটনায় মোটেও কাতর হচ্ছে না এবং বাস্তবক্ষেত্রে ইসরায়েলকে বিন্দুমাত্রও অসন্তুষ্ট করছে না।

বস্তুতপক্ষে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর অংশ হলেও মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি জাতি (আরব, তুর্কি, ইরানি) আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোর নেতৃত্বে আসীন হওয়ার জন্য  পারস্পরিক লড়াইয়ে লিপ্ত। এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ঐক্য ও সংহতিতে ক্ষয় ধরিয়ে দিয়েছে, যার ফায়দা লুটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে এবং পশ্চিমাদের দোসর ইসরায়েল একতরফাভাবে ফিলিস্তিনে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার মাধ্যমে। আর  অধিকাংশ আরব দেশই অবৈধ শাসকের অধীনে থাকায় বৈধতার অভাবের জন্য কোনো পদক্ষেপ তো দূরের বিষয়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোর গলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। 

রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে দুর্বলতা। ফিলিস্তিন নিয়ে বিশ্বের সকল মুসলমানের মধ্যেই তীব্র ‘আবেগ‘ আছে, কিন্তু ‘অনুধ্যান‘ নেই। 'অনুধ্যান' শব্দটি আমি এখানে খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি, যার অর্থ: সর্বদা চিন্তা বা স্মরণ, শুভচিন্তা, নিরন্তর চিন্তা, অনুচিন্তন, সর্বদা স্মরণ, সর্বদা ধ্যান করা। অনুধ্যান শব্দে অর্থ ও প্রতিশব্দগুলো ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হচ্ছে না। চিন্তা ও গবেষণায় ফিলিস্তিনের ঘটনাবলি এবং সেখানকার গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ ও জাতিগত হিংসার জায়নবাদী চক্রান্তের বিষয়গুলো উন্মোচিত করা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। ফিলিস্তিন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও অনুধ্যান বাড়ছে না।

বরং আমজনতা ও নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিন প্রশ্নে কাজে লাগিয়েছে আবেগকে। প্রচণ্ড আবেগে মিছিল, সমাবেশ, দোয়া করার পর অনেক দিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুপ মেরে থাকাই হলো নির্মম বাস্তবতা। এমনটি কতটুকু সঠিক, তা চিন্তার বিষয়। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনে সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুচিন্তিত কার্যক্রমের দ্বারা ইসরায়েল যা করে চলেছে, তা ধারাবাহিক গবেষণা-অধ্যয়নের পথে গভীরভাবে অনুধ্যান ও আত্মস্থ করাই ছিল জরুরি। তাহলেই আবেগ আর যুক্তির সমন্বয়ে বিপন্ন-নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং জায়নবাদী, বর্ণবাদী ইসরায়েলের জাতিগত হিংসা ও গণহত্যার অর্থবহ প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করা সম্ভব হবে।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;