শিমুল সালাহ্‌উদ্দিনের একগুচ্ছ কবিতা



শিমুল সালাহ্‌উদ্দিন

  • Font increase
  • Font Decrease

দৃশ্যের ভেতরে

এটাই সেইখানটা। এবং আমরা সেখানে। এরই ভেতরে। হাঁটছি। কথা বলছি। ধরে আছি হাতে হাত।

এখানেই সেখানটা, যেখানে সবসময় আসতে চেয়েছো তুমি। এই সোনারঙছটা প্রলেপমাখানো গাছের পাতারা যেনে প্রেমপোস্টকার্ড, উড়ছে তোমার দিকে...

জলপ্রপাত ঝরে চলেছে তার পাশে, সন্দেহ বুকে নেই এমন বিরল আশ্চর্য হরিণেরা চড়ে বেড়াচ্ছে ইতস্তত, জানলা থেকে দেখা দৃশ্যের মতো, শ্লথগতিতে চলা অনেক জানলাওয়ালা যানের একটা জানালা থেকে, ভালো রেজ্যুলেশনের একটা ক্যামেরার পিনহোল থেকে দেখা দৃশ্যের মধ্যেই হাঁটছি আমরা, বলছি নিজেদেরকে, শান্তধীর উচ্চারে, 'এই হচ্ছি আমরা, এখানেই অস্তিত্বমান, এবং আমাদের গলার আওয়াজ এমন, যেন আমরা জানালার অনেক অনেক পেছনে অথবা জানালার ভেতরে...

আমরা জড়িয়ে ধরছি নিজেদের গভীর ভালোবাসায় আর দেখছি অসন্দিগ্ধ হরিণ ছুটে যাচ্ছে তার মায়াবী চোখজোড়া নিয়ে সেই মুহূর্তে। ক্যামেরার নিকষ পিনহোলের ভেতর দিয়ে, বাইনোকুলারের যুগল অন্ধসুড়ঙ্গ পার হওয়া মানবিক চক্ষুযুগল দিয়ে দেখছি যে আমরা পুরোপুরি বন্য, আর উদ্বিগ্ন সেইসব দৃশ্য ও চকচকে নিয়তিনির্ভরতা নিয়ে নীরবতা এলো—প্রকৃতি আর তাদের নিঃশঙ্ক অবয়বের অস্তিত্বের কাছে, দেখছি না হয়তো, আবার যেন দেখছি পেছন ফিরে, যেন মনে হচ্ছে, দূর আমাদের কাছ থেকে অনিমেষনেত্র আন্তরিকতা চেয়ে ফিরে যাচ্ছে সবুজে, সবুজ এবং নির্বিবাদী সোনালী দেহের গাছে...

একটি দৃশ্য এভাবে অন্ধ করে দিতে পারে!

অবাঙমানসগোচর

যে লেখে সে আমি না। যে লেখে সে অন্য কেউ।
অথর্ব কি আর ভাঙতে পেরেছে ভাষার সীমানাদেয়াল
আর তার কাঁটাতার?
কিংবা কলজে ছিঁড়ে আনা নতুনের সংসার?

যে লেখে সে আমি না।

সংসারের গোপন ফাটল দেখতে দেখতে
নদীর কিনারে কেটে যাওয়া ছেলেবেলা দেখেছি।
লড়াই জেতা ষাড়ের পৃষ্ঠকুণ্ডির মতো
মাংসল জলের স্রোত-ঢেউ গুনেছি।
খুঁজেছি আমার আমাকেই দেখবার মতো
কোনো আয়না জলের ভেতর।
খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়েছি,
ভেঙে ফেলেছি।

ভাঙন ভাঙন শব্দে নদীর নিজের শুকিয়েছে জল,
একজন মানুষ নদীর উচ্ছিষ্ট জলে পা ধুয়ে
নদী পার হয়ে গেল

আমি নদীর শুকনো বুকের ভেতরের হাহাকার
আর তার চোখের জল দেখতে পেলাম...

বাবা বসে আছে দাওয়ায়। মা বন্ধ চুলোর সামনে।
আমরা ঘরের মেঝেতে দাগ কেটে খেলছি ষোলগুটি।
রান্না হচ্ছে জল।

লাল ঝুটি বেঁধে খুঁপড়ি গাড়িতে স্কুলে যাচ্ছে বোন,
কাঁদতে কাঁদতে, দেয়া যায়নি টিফিন।

এইভাবে ধীরে ধীরে অযুত নিযুত চষাক্ষেত মুহূর্তের ভীড়ে
লাঙল হাতলে বন্দি হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে আমার অনুভব।
শৈশব।

হাঁটাপথে স্কুলে গেছি।
প্রকাশ্য রাস্তায় বিদ্বানের বেশে
বই পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছি সবুজের পাশে।
চয়নিকার ভেতর থেকে আসা প্রজাপতি রঙ ধরে,
ধরে বখতিয়ার খিলজির লাগাম
শূন্যতার অধিক কল্পলোকে রূপান্তরিত হয়েছি
অজেয় অসীম ক্ষমতার ঘোড়সওয়ারে।

কোথায় যাইনি বলো?
অথচ তোমরা আমাকে ভুল গুনেছো।

আমি স্বীকার করি—যে লেখে সে আমি না।
আমার এসব হতাশ্বাস নাবিকের গান আকণ্ঠ গাইবার কথা নয়।

যে লেখে সে আমি না।
সে প্রেমার কোলে বুভুক্ষ হৃদয় ঠোঁট নিয়ে শুয়ে আছে।
যে লেখে সে কার্জন পার্কের রাস্তায় হেঁটে যাওয়া
বেশ্যার দিকে তাকিয়ে আছে।
নিষ্পলক।
যে লেখে সে গোধূলির সংশ্রবে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়চূড়ায়,
সাগরের ডুবে যাওয়া মধ্যিখানে জলের ওপর
ভেসে থাকা সূর্যচিহ্ন দিগন্তে,

যে লেখে সে আমি না।
সে তো চৌকশ বাক্যের তিরে হাওয়াকেও বিদ্ধ করে,
সে তো উষ্ণতায় হাড়সেদ্ধ করে দেয় সব পঙ্কিলতার।

সে তো কপালের ঘাম মুছে
মানুষের
কাঁধে রাখে হাত।

যে লেখে সে আমি না। যে লেখে সে আমি না।
যে লেখে সে অবাঙমানসগোচর।
রিলকের রাস্তায় দাঁড়ানো প্রেমিক পার্থকে প্রতিদিন দেশলাই দেয়।
নদী-বিচ্ছেদের কাহিনী শোনায়।
পার্থর দিকে তাকিয়ে কালপুরুষের দিকে ধোঁয়া ওড়ায়।
বুক ভরে কুয়াশায় জল চুঁইয়ে পড়া দেখে।

যে লেখে সে আমি না।
সে তো মুখ গুঁজে পড়ে থাকে মিছিলের নীলে,
তোমাদের হাসি গানে।
উৎসবের অরুণাভ নির্জনতায়।

সে তো কাৎরায় কেবল টেবিলে উরুতে ভেজাচোখমুখ গুঁজে।

যে লেখে সে—আমি না। আমি না। যে লেখে তাকে—দেখিনি। দেখিনি।

একায়ন

হাসপাতালের জানালা থেকেও দূর-অন্ধকার আকাশে জ্বলজ্বলে লুব্ধক দেখা যায়—দেখা যায়—ভুলশহরের কবরখানার ভাঙাবেতবেড়া ও গলে পড়া সমাধির সারি—চেহারা ম্লান হয়ে গেছে এমন মানুষের গলিত মুখ, থির তাকিয়ে থাকা চোখ দেখে ফেলবার সম্ভাবনা—দেখা যায় ছত্রাকরঞ্জিত এপিটাফ, জীবনখোদিত দেয়ালে হেলান দেয়া বিস্মৃত সঙ্গমস্মৃতিটিলা... 

নিজের ঘুমন্ত লাশ বহন করতে করতে, নিজেরই অনামা-শরীর থেকে বেরিয়ে আসা পঁচামাংস-গন্ধবুঁদবন্ধনাক ঘষে ঘষে লাল কোরে ফেলে মেশিন-মানুষ যেইভাবে ভাবে, সেইভাব বুঝে নেবার ভানে মনে পড়ে যায় অবেলায়, আমারই মতো পৃথিবীতে আসা সোক্রাতেসকে, মনে হয় হেমলক বরং ছিল ভালো ব্যাজস্তুতিময় এই হাজারো মত ও পথের পৃথিবীর চেয়ে...

সেই মুহূর্তেই ইচ্ছেপূরণের পুরাণমন্ত্র মনে করে দিয়ে একটি তারা খসে যায় দূরের আকাশে—তুমি সাথে সাথে নিজেকে মেরে ফেলার ভাবনার ভেতরেও বলে ওঠো, ‘হে অনন্ত রহস্যের অমর পিতা, সৃজনেরও আদিম জনক ‘ভুলে গেছি যাকে, ভালো রেখো তাকে!’

অথচ তখনও উড়ে চলেছে বাতাসে তোমার একার নিঃসঙ্গ তৃতীয় ডানা, ঈশ্বরের বিপরীতে—ঈশ্বরের মতো শরীকহীন; স্বয়ম্ভূ ও একা...

সংকেত কারখানা

কৃষ্ণতিলে লেখা থাকে যে অপূর্ব মাধুরীসংকেত তা কেবল
প্রেমিকপাঠ্য বলে গোধূলিতে মেশে এসে দিন আর রাত
যেমন শ্মশানে, ছাইভস্মে পড়ে থাকা মৃগনাভী মাড়িয়ে শেকল
জীবনের, মাটির মদিরা মেখে নেয় অনন্তের হাতে রেখে হাত—

সেইভাবে বুকের কিনারে সাড়ে চব্বিশ হরফ লুকিয়েছো ঢেউ
এমন গভীরে যেন কেউ শ্রুতিইতিহাস ঢুঁড়ে পায় না হদিস
অথচ জাগরকাঠি হাতে ছিল, ছিল আত্মবিষধর কেউ
তোমাকে দেখাতে পথ, মানোনি ঈশ্বর তুমি নিজেকে নবিশ!

ছুটেছো দূরের কাছে, বসোনি কাছের ঘাসে মাতাল ঋত্বিক
অন্ধস্কুলের দুয়ারে গিয়ে শেখোনি তো বর্ণান্ধের সংকেত
নিজেকে পুড়িয়ে আমি বীজ আর অনিকেত পাখির খোঁজে
উড়ে উড়ে দেখেছি জীবন ঈশ্বরের অপারগতার ক্লেদ!

জীবনের সুমেধ হিশাব সোজাবাঁকা হৃদয়ের অনেক ভাঙচুর
বুঝেসুঝে আমি পলাতক এক সমুদ্রসাক্ষী বেলাভূমিতে একা
আদিগন্ততক ফাঁকা রেলপথে দাঁড়িয়ে পতপত উড়াচ্ছি পতাকা
আমার এ একক মহড়া গুড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর শেষ জাদুঘর

রূপকথা, কিংবদন্তি
(রূপকথা রূপ ধরে টারজান ডাকে—মনে রেখে)

কোথাও কেউ নেই, কেউ ছিল না কোনোদিন
কেবল একটি পাহাড় আছে,
সোনার পাহাড়...

সোনার পাহাড়ে আমাদের বহুদিন কাটল,
রূপা নেই কাঁসা নেই তামা নেই, মাটি নেই,
শুধুই ঝলমলে সোনা

নারীদের বুক ছিল সোনার গম্বুজ আর
পুরুষের শিশ্ন ছিল সোনার মিনার

সোনায় মোড়ানো সেই ফুলের দল
পদ্ম গোলাপ জুঁই চম্পা চামেলি
টগর শেফালী

তখন
আমাদের গ্রাম ছিল
জানালায় দেখা পাহাড়ের রূপকথা,

আমরা সারারাত স্বপ্ন দেখতাম দিনের,
আর দিনে
রূপকথাগুলো সত্য হয়ে যেত।

ক্ষিদে পেট, ঘুম নাই, তবু সত্যি হতো রূপকথা...

আমাদের সারা গ্রামে দানব ছিল বটে,
তবে দানবেরা ও আদরে কাছে টানত,

আর ছিল অথর্ব রাজা,
রাজকন্যা ছিল, রাজপুত্র ছিল, লড়াই ছিল,
রক্তমাখা বিভৎস কান্না ছিল

তবুও মানুষ জানত কিভাবে হাসতে হয়,
কুশল শুধাতে হয়

একদিন রূপকথাগুলো বড় হলো। আমাদের গ্রামে
কোমল চেহারা স্যুট টাই পরা দানবেরা এলো
তারা ঠেসে দিল মাথার ভেতরে সময়জ্ঞানের বোঝা

আর স্বপ্ন দেখালো সোনার বদলে...

আরো বেড়ে গেল রক্তনদীর স্রোত-ঢেউ-গ্রাস
দৈর্ঘ্য আর প্রস্থে চিড়ে চ্যাপ্টা রূপকথাগুলো
আধুনিক কাব্য হয়ে উঠল...

আর আমাদের ছেড়ে প্রিয় গ্রামখানি
ধীরে ধীরে চলে গেল রোমন্থনের শৈশবে

ওহ!
সোনার পাহাড়টা।

ভয়ার্ততা আর রক্তপ্রেতচ্ছায়া লালমুখে
প্রতিভোরের জানালায় শুভসকাল জানায় আমাদের

ফুরফুরা বাতাস
(ফুরফুরা বাতাসে শুধু চনমনে আনন্দ মাখা থাকে)

তোমার ব্যস্তসমস্ত ব্লাডি, বিরক্তি-আঁকা,
সেইম বোরিং টয়-মার্কা, পুনারাবৃত্তিময়

অফিস, বাসা, ঘুম ও হাসা
নাগরিক দিনযাপনের ভিতর
হঠাৎ হঠাৎ আসে একলালাগার প্রহর

যখন আসে, তখন

জীবন-ফাঁক-ফোকড়ের উদাস জানলা দিয়ে ঢোকা
একটা ফুরফুরা বাতাসের মতো
তোমার জীবনে থাকতে চাই আমি
 
আলতো আলতো করে
ধরি মাছ না ছুঁই পানি করে
না করে শেয়ার
সেইম স্নানাগার
আলনা ও খাট
ড্রয়িং ডাইনিং টেবিল, ভাত
তরকারি বিষয়ক তর্ক,
যৌনবিষয়ক ঝগড়া,
না করে শেয়ার রাত,
না করে শেয়ার ঝঞ্ঝাট

দুইজনের কাছে দুই ফুরফুরা বাতাসের মতো
ওগো ভোমরা, থাকতে চাই কি আমরা?

আহা! একটা ফুরফুরা বাতাসের মতো থাকাথাকি
মনে করায়া দেয় একটা
                               হুড়মুড়ায়া ঢোকা ফুরফুরা বাতাস!

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

   

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

  • Font increase
  • Font Decrease

মানবিকভাবে বিপর্যস্ত গাজ়ার ঘটনাবলি ইসরায়েল সম্পর্কে কয়েকটি মারাত্মক বিষয় উন্মোচিত করেছে। কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন সম্পর্কেও গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বিশ্ববাসীকে। যেমন: ১. গণহত্যা কাকে বলে, ২. নব্য-বর্ণবাদের স্বরূপ কেমন, ৩. জাতিগত হিংসার নৃশংস চেহারা কত ভয়াবহ।

এইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে, বাস্তব গবেষণাগার ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায়, যেখানে প্রশ্নগুলোর ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস‘ বা ‘মডেল টেস্ট‘ করছে, ইসরায়েল। রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের ইসরায়েলি পাইলট প্রজেক্ট তথাকথিক মুক্ত-গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিকারহীনভাবে দেখছে। আরব তথা মুসলিম বিশ্বও এত বড় একটি গণহত্যার বিষয়ে নির্বিকার। 

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা‘ (প্রকাশক: শিশুকানন/রকমারি) শিরোনামে আমার প্রকাশিত বইটিতে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পটভূমিতে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি ও জায়নবাদী নীতির ঐতিহাসিক ধারাক্রমের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সময়ে গণ-নিষ্ক্রমণের ছবিটা বাস্তবে আসলে কেমন হয় আর প্রতিশোধজনিত হিংসার কারণে জাতি, বা রাষ্ট্র, বা তার ধ্বজাধারীরা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, এসব কথাও আলোচিত হয়েছে।

বাস্তবে ইসরায়েলের হিংস্রতা কল্পনার দানবকেও হার মানিয়ে গেছে। ‘গাজায় গণহত্যা বন্ধ হবে‘, মানবিক বিশ্বের এমন শুভ-আশাকে দুরাশায় পর্যবসিত করেছে, ইসরায়েল। গত অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে নিহত হয়েছেন মোট ৩২ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৭৪ হাজার ২শ ৯৮ জন। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমায় গড়ে নিহত হচ্ছেন ১০০ জন এবং আহত হচ্ছেন ১৫০ ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী। ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় বাড়িঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার ২২ লাখ বাসিন্দার ৮৫ শতাংশ।

গাজায় ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন’ সংঘাতকে 'যুদ্ধ' বলা হচ্ছে। আসলে তা মোটেও ‘যুদ্ধ’ নয়, স্রেফ ‘গণহত্যা’। যুদ্ধে সৈন্য মারা যায়। সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাজায় মরছে সাধারণ মানুষ, জনতা। জনতাকে বেপরোয়া হত্যা করা যুদ্ধ নয়, নগ্ন গণহত্যা। যুদ্ধের ছদ্মাবরণে গণহত্যায় মেতে গত ৭৫ বছর ইসরাইল নব্য-বর্ণবাদী আগ্রাসন, জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ফিলিস্তিনে, যার সর্বসাম্প্রতিক হিংস্রতম পর্যায় চলছে গাজায়। সেখানে অসুস্থ রোগী, ডাক্তার, শিশু, বৃদ্ধ, নারী, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। খ্রিস্টানদের বড়দিনে এবং মুসলমানদের  রমজান মাসের পবিত্রতাকেও পরোয়া করা হচ্ছে না। রমজানে গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশেও বাধা দিচ্ছে, জায়নবাদী ইসরায়েলি বাহিনী। বুলেটের আঘাতে আর খাদ্য, পথ্য ও ঔষধের অভাবে মরছে মানুষ গাজা উপত্যকায়।

বিশ্বের ইতিহাসে, সভ্যতার পথ-পরিক্রমায়, এমনকী, যুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরেও যা ঘটেনি কোনোদিনও, তেমন অকল্পনীয়, অভাবনীয় ও অদৃশ্যপূর্ব বর্বরতা-নারকীয়তা প্রদর্শন করছে ইসরায়েল। জীবিত মানুষদের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের পর লাশের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়েছে। এতদিন ইসরাইলি নৃশংসতা ছিল জীবিত গাজাবাসীর ওপর। এবার তা-ও অতিক্রম করেছে। কমপক্ষে চারটি মৃতদেহ ও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়ে তা থেঁতলে দিয়েছে।

বীভৎস, ন্যক্কারজনক এই ঘটনা ঘটছে মুসলিমদের ঘরের ভিতরে, চোখের সামনে। চারপাশে মুসলিম দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর, ইরান, ইরাক, কাতার, তুরস্কসহ আরও কত দেশ। তারা কীভাবে এই নৃশংসতাকে সহ্য করছে!

সহ্য করছে, রাজনৈতিক স্বার্থগত কারণে। অধিকাংশ আরব দেশই স্বৈরশাসকের কব্জায় রয়েছে, যারা টিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার ইচ্ছায়। মার্কিন-ইসরায়েল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস ও শক্তি আরব দেশগুলোর নেই। অনুগত দাসের মতো তারা মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গণহত্যার দর্শক হয়ে আছে। আরব দেশগুলোর এই হলো বাস্তবচিত্র।

তুরস্ককে বেশ সাহসী ও উদ্যোগী মনে করা হলেও বাস্তবে তুরস্ক কৌশলজনক অবস্থানে থেকে ‘না ধরি মাছ, না ছুঁই পানি‘ নীতিতে নিজেকে নিরাপদ রাখছে। নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায় না তুরস্ক। 

বাদ থাকে ইরান। ইরান ও তার সহযোগী সিরিয়া, লেবানন ও ইয়ামেনের কিছু গ্রুপ মাঝে মাঝে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান নিজে মাঠে নামছে না। নানা গ্রুপকে কাজে লাগাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ-ইসরায়েল সমর্থনের বিপরীতে রাশিয়া ও চীন সুস্পষ্ট কোনো ভূমিকা নিয়ে সংঘাতের অবসানে কাজ করছে না। তারা নিজ নিজ স্বার্থ ও কৌশলের আলোকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বড় ও শক্তিশালী দেশ দুটি ফিলিস্তিনে গণহত্যার ঘটনায় মোটেও কাতর হচ্ছে না এবং বাস্তবক্ষেত্রে ইসরায়েলকে বিন্দুমাত্রও অসন্তুষ্ট করছে না।

বস্তুতপক্ষে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর অংশ হলেও মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি জাতি (আরব, তুর্কি, ইরানি) আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোর নেতৃত্বে আসীন হওয়ার জন্য  পারস্পরিক লড়াইয়ে লিপ্ত। এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ঐক্য ও সংহতিতে ক্ষয় ধরিয়ে দিয়েছে, যার ফায়দা লুটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে এবং পশ্চিমাদের দোসর ইসরায়েল একতরফাভাবে ফিলিস্তিনে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার মাধ্যমে। আর  অধিকাংশ আরব দেশই অবৈধ শাসকের অধীনে থাকায় বৈধতার অভাবের জন্য কোনো পদক্ষেপ তো দূরের বিষয়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোর গলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। 

রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে দুর্বলতা। ফিলিস্তিন নিয়ে বিশ্বের সকল মুসলমানের মধ্যেই তীব্র ‘আবেগ‘ আছে, কিন্তু ‘অনুধ্যান‘ নেই। 'অনুধ্যান' শব্দটি আমি এখানে খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি, যার অর্থ: সর্বদা চিন্তা বা স্মরণ, শুভচিন্তা, নিরন্তর চিন্তা, অনুচিন্তন, সর্বদা স্মরণ, সর্বদা ধ্যান করা। অনুধ্যান শব্দে অর্থ ও প্রতিশব্দগুলো ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হচ্ছে না। চিন্তা ও গবেষণায় ফিলিস্তিনের ঘটনাবলি এবং সেখানকার গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ ও জাতিগত হিংসার জায়নবাদী চক্রান্তের বিষয়গুলো উন্মোচিত করা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। ফিলিস্তিন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও অনুধ্যান বাড়ছে না।

বরং আমজনতা ও নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিন প্রশ্নে কাজে লাগিয়েছে আবেগকে। প্রচণ্ড আবেগে মিছিল, সমাবেশ, দোয়া করার পর অনেক দিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুপ মেরে থাকাই হলো নির্মম বাস্তবতা। এমনটি কতটুকু সঠিক, তা চিন্তার বিষয়। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনে সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুচিন্তিত কার্যক্রমের দ্বারা ইসরায়েল যা করে চলেছে, তা ধারাবাহিক গবেষণা-অধ্যয়নের পথে গভীরভাবে অনুধ্যান ও আত্মস্থ করাই ছিল জরুরি। তাহলেই আবেগ আর যুক্তির সমন্বয়ে বিপন্ন-নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং জায়নবাদী, বর্ণবাদী ইসরায়েলের জাতিগত হিংসা ও গণহত্যার অর্থবহ প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করা সম্ভব হবে।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;