আধুনিক বাংলা কবিতার নাগরিক কণ্ঠস্বর

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কবি শহীদ কাদরী।

কবি শহীদ কাদরী।

'বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা/মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ/কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা/ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ/প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই/কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…'

(সঙ্গতি/শহীদ কাদরী)

তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ মাত্র চারটি। মোট কবিতার সংখ্যা মাত্র ১২৬টি। কাব্যগ্রন্থ তিনটি প্রকাশিত হয়েছে মোটামুটি ৫/৭ বছরের বিরতিতে। শেষটি তিরিশ বছর পর। প্রবাস থেকে লেখা। তবু তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার অপরিহার্য অংশ, নাগরিক কণ্ঠস্বর।

বিজ্ঞাপন

পঞ্চাশ দশকে বহুপ্রজ কাব্য প্রতিভার মিছিলের অনন্য পুরুষ শহীদ কাদরী (১৪ আগস্ট ১৯৪২ - ২৮ আগস্ট ২০১৬), কবিতায় নাগরিক বোধ ও বিষয়ের স্বাতন্ত্রিক উপস্থাপনায় উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্ব। আজ (মঙ্গলবার) তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিিকী।

শহীদ কাদরী তৎকালীন অবিভক্ত ব্রিটিশ বাংলার রাজধানী শহর কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত পার্ক সার্কাস এলাকায় জন্ম নেন এবং কলকাতা শহরেই তার শৈশব কাটান। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের দিকে দশ বছর বয়সে তিনি পরিবারের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন।

বিজ্ঞাপন

যৌবন ও পরিণত বয়সের প্রায় তিন দশক তিনি ঢাকা শহরে অবস্থান করেন এবং ১৯৭৮ সালে আবার দেশান্তরী হয়ে প্রবাসজীবন শুরু করেন। তিনি বার্লিন, লন্ডন, বোস্টন হয়ে অবশেষে মৃত্যুর পূর্ব-পর্যন্ত নিউইয়র্কে বসবাস করেন। এবং ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট নর্থ শোর বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ২০ মিনিটে ৭৪ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


দীর্ঘজীবনে তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা অত্যল্প হলেও সেগুলে পাঠকপ্রিয় ও আলোচিত। উত্তরাধিকার (১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা (১৯৭৪), কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই (১৯৭৮) এবং আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও (২০০৯) ছাড়াও তার দুটি সংকলন হলো: শহীদ কাদরীর কবিতা এবং তোমার জন্যে।


আমুণ্ডু শহরবাসী নাগরিক তিনি। শহরে শহরে কেটেছে তার জীবন। জীবনে ও কবিতায় তার কোনও গ্রাম, গ্রামীণ আবহ বা অনুষঙ্গ ছিল না। এ কারণে শহীদ কাদরী আধুনিক কবিদের মধ্যে নাগরিক-জীবন-সম্পর্কিত শব্দ চয়নের মাধ্যমে বাংলা কবিতায় নাগরিকতা ও আধুনিকতাবোধের সূচনা করতে পেরেছিলেন।

সম্ভবত তিনিই প্রথম আধুনিক নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক অভিব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে কবিতায় রূপ দিয়েছেন। দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্ববোধ এবং প্রকৃতি ও নগর জীবনের অভিব্যক্তি তার কবিতার ভাষা, ভঙ্গি ও বক্তব্যেকে বৈশিষ্ট্যায়িত করেছে। শহর এবং তার সভ্যতার বিকারকে তিনি ব্যবহার করেছেন তার কাব্যে। তার কবিতায় অনুভূতির গভীরতা, চিন্তার সুক্ষ্ণতা ও রূপগত পরিচর্যার পরিচয় সুস্পষ্ট। নাগরিক যন্ত্রণার অভিব্যক্তিকে তিনি প্রেমে ও প্রকৃতিতে প্রযুক্ত করেছেন। নাগরিক অভিজ্ঞানে বৃষ্টিকে বলেছেন সন্ত্রাস আর চেকের বদলে গোলাপকে পাঠিয়েছেন ব্যাঙ্কে।

শহীদ কাদরীর প্রকাশিত মাত্র চারটি গ্রন্থে সন্নিবেশিত কবিতার সংখ্যা ১২২টি। পরবর্তীতে তিনি আরও চারটি কবিতা লিখেন, যার তিনটি ছাপা হয় 'কালি ও কলম' সাহিত্য পত্রিকায় আর একটি অন্য কাগজে। সব মিলিয়ে তার কবিতা সংখ্যা মাত্র ১২৬টি। অতি অল্প লিখেই তিনি বিখ্যাত, আলোচিত ও পাঠকপ্রিয় হয়েছেন।


১৯৭৩ সালে বাংলা কবিতায় অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১১ সালে ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকও পেয়েছেন।


আলাদা কাব্যবৈশিষ্ট্যের জন্য এবং নাগরিক-কাব্যভাষ্য নির্মাণের সফলতার নিরিখে শহীদ কাদরী আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবেন। অনন্য মর্যাদায় তিনি স্থায়ীভাবে রয়ে যাবেন বাংলা কবিতার পাঠকচিত্তে।