বুয়েটকাল [কিস্তি ১]



শাকুর মজিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

শাকুর মজিদের প্রায় সকল লেখাই আত্মজৈবনিক বলে তাঁর দাবি। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৩৬ হলেও ভ্রমণ, আত্মস্মৃতি ও স্মৃতিচারণমূলক বইয়ের সংখ্যা ২৭ টি। যা কিছুই তিনি লিখেন, সবই তাঁর নিজের জীবনের কথা—কখনো নিজের মুখে, কখনো, বিশেষ করে নাটকে তা অপর জনের মুখ দিয়ে বলান। ২০০৮ সালে বেরিয়েছিল ক্যাডেট কলেজ জীবনের প্রথম বছর নিয়ে লেখা আত্মজৈবনিক উপাখ্যান ‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’। এর পর ক্যাডেট কলেজ জীবনের পরবর্তী উপাখ্যান প্রকাশ হয়েছে তাঁর ‘ক্যাডেটের ডায়েরি’তে। ক্যাডেট কলেজ থেকে বেরিয়ে ভর্তি হন বুয়েট—বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সময় ছিলেন সেখানে। এই কালটাকে ধারণ করছেন ‘বুয়েটকাল’ নামক ধারবাহিক আখ্যানে

কেমন করে বুয়েটে গেলাম

আমি কেমন করে আর কিভাবে যে বুয়েটে আর্কিটেকচারে ভর্তি হয়ে গেলাম এটা আমাকে আজও ভাবায়। আমার শখ ছিল মেরিন একডেমিতে ভর্তি হয়ে যাব, বিনা খরচায় দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াব। পানির ওপর ভেসে থাকব দিনের পর দিন। লিখব বসে বসে, আর বৈচিত্রময় ভুবন দেখব। বাবার কাছ থেকে নাবিক জীবনের শোনা গল্পগুলো নিজের করে পাব।

এইচএসসির পর যথারীতি ফরমও আনালাম। নিজে ফিলআপ করে বাবার কাছে দিলাম, যেখানে অভিভাবক সই করবেন। বাবা বলেন—এটা বাদে আর যা ইচ্ছা তুমি পড়তে পারো। কিন্তু যেটা পড়বা, সেটাতেই যেন সবচে ভালো করতে পারো, এটা মনে রাখবা।

মেরিন একাডেমির ফর্ম আর পাঠানো হলো না। বাবার কাছে আম্মা গুনগুন করেন—আমার ছেলে ডাক্তার হলে ভালো।

আমি ডাক্তারি পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি। রিটেন-ভাইবা দুইটাই শেষ। রেজাল্ট হয়নি এখনো। এমন সময় আমার ক্যাডেট কলেজের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও রুমমেট রায়হানের চিঠি। তার বক্তব্য—তাড়াতাড়ি ঢাকায় আয়। আমি আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছি। তোর ফর্মও কিনে রেখেছি দেড়শো টাকা দিয়ে। তোর টাকা দিতে হবে না। তুই এলে একসাথে পড়ব।

বুঝে ফেলেছি। কলেজে আমি অংকে আর টেকনিক্যাল ড্রইংয়ে ভালো নম্বর পেতাম। রায়হানের দাবি, আমি ক্লাস টিচারের চেয়ে সহজে অংক বোঝাতে পারি। ইন্টারমিডিয়েটে সে আমার স্টাডিমেট ছিল। আমরা এক রুমের বাসিন্দা ছিলাম।

রায়হানের চিঠি পেয়ে মেডিকেলের রিটেন দিয়ে আমি সিলেট থেকে বিয়ানীবাজার না গিয়ে ঢাকা চলে আসি, সরাসরি রায়হানের বাসায়। রাতের বাসে করে ফুলবাড়িয়া নেমে বেবিট্যাক্সি ধরে ক্যান্টনমেন্ট, শ্যামলী হাউজিং। হাত থেকে ব্যাগ নামাতে না-নামাতেই রায়হান আমাকে ধরিয়ে দেয় এক গাইড বই। আগের দিন বুয়েটে গিয়ে সে এটা ইশতিয়াক ভাইয়ের (বর্তমানে প্রতীথযশা স্থপতি ইশতিয়াক জহির তিতাশ) কাছ থেকে নিয়ে এসেছে। আজ এগারোটার সময় মিজান ভাই ডিপার্টমেন্টে দেখা করবেন আমাদের সাথে, কোচিং নেবেন।

আমি তেমন কিছুই বুঝতে পারি না। কোচিং কেন নিতে হবে ? রায়হান বলে, আর্কিটেকচার অ্যাডমিশন টেস্টে বিশেষ রকমের ছবি আঁকতে হয়, অয়ান পয়েন্ট পার্স্পেক্টিভ, টু পয়েন্ট পার্স্পেক্টিভ, এসব আছে। ফ্রি হ্যান্ড ড্রইং আছে। তুই তো ফ্রি হ্যান্ডে পাকা, তোর লাগবে না, আমাকে শেখাবি এখন।

আমরা সকাল দশটার দিকে এসে নামি বুয়েটের আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের সামনে। দেখি, দালানটা খুব সুন্দর। নিচতলা ফাঁকা। এখানে কতগুলো খোলা পিলারের গায়ে ঠেস দিয়ে কয়েকজন বসে আছে। ছাত্র-ছাত্রীরা গায়ের সাথে গা লাগিয়ে বসে। অনেকটা ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মতো। আমার মজা লাগে। আড়চোখে তাকাই। পড়েছি আধাসামরিক শৃঙ্খলিত আবাসিক প্রতিষ্ঠান—ক্যাডেট কলেজে। সেখানে মাসে একবার, প্যারেন্টস ডে-তে কিশোরী-তরুণী দেখা যেত। বেশিরভাগই আপা পর্যায়ের। আমরা আরেকটু বড় হয়ে গেলে যাদের দেখতাম তারা ছোট বোন। সুতরাং ইমদাদুল হক মিলন প্র্যাকটিস করার সুযোগ কই?

আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্ট আরো অনেক কারণে ভালো লেগে যায়। এখানে ফোর্থ ইয়ারে পড়ছেন মিজান ভাই, আমাদের কলেজের লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, দেয়াল পত্রিকা প্রতিযোগিতায় আমরা বরাবর ফার্স্ট হতাম তাঁর ইলাস্ট্রেশনের কারণে, বোর্ডেও স্ট্যান্ড করেছিলেন। আছেন আমার নাম মিতা সোহেল, শাকুর ভাই। মেট্রিক-ইন্টার দুই জায়গায় ফার্স্ট হওয়া শাকুর ভাইকে দেখি এখানে। আরো দেখি, বোর্ডে নাইন্থ স্ট্যান্ড করা নাজমুল হাসান, আমার এক ব্যাচ সিনিয়র, সিলেটি ভাই। আছেন আমার আত্মীয় তিতাস (ইশতিয়াক জহির) ভাইও, যার বাবার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমার বাবা আমাকে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন। আমি নানা কারণে পুলক বোধ করি।

একে একে মিজান ভাই আর নাজমুল হাসান ভাইয়ের সামনে খাতা নিয়ে বসি। তাঁরা আমাদেরকে পার্স্পেক্টিভ আঁকার কৌশল শিখিয়ে দেন। নাজমুল হক ভাই আরেকটা পুরনো গাইড হাতে ধরিয়ে দেন। বলেন, নিজে নিজে প্র্যাকটিস করো। ২০০ নম্বরের পরীক্ষা হয়, সাইন্স সাবজেক্টের ১৬০-এ সবাই ১৫০-১৬০ পায়। বাকি ৪০ হচ্ছে জেনারেল নলেজ আর ফ্রিহ্যান্ড ড্রইং। চান্স পেতে হলে ওই জায়গায় বেশি নম্বর পেতে হবে, মাইন্ড ইট। ৩০০০ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট পরীক্ষা দেবে, আর্কিটেকচারে সিট মাত্র ৫০ টা। চান্স পাওয়া টাফ।

আমরা দুইজন অতীব মনোযোগের সাথে তাঁদের কথাবার্তা শুনে, ব্যাগভর্তি নোট-গাইড নিয়ে রায়হানের বাসায় চলে আসি এবং পড়াশোনায় মনোযোগী হই। আমাদের হাতে এক সপ্তাহের মতো সময়। দেখি, রায়হান আমার আগমনের অপেক্ষায় তেমন আগায়নি। আমি সিলেবাস নিয়ে বসে তাকে নিয়ে পড়তে থাকি। আমার তো মেডিকেলেই পড়া হবে, আমার খুব চিন্তা নাই। পরীক্ষা দিতে হচ্ছে রায়হানের জন্য। তাকে পড়াতে গিয়ে যতটুকু পড়ছি তা দিয়েই আমার শেখা। রায়হানের ভরসা, দুজনের ভর্তি পরীক্ষার নাম্বার পাশাপাশি। সিট পাশাপাশিই পড়বে। সুতরাং তার নাকি চিন্তা নাই।

কিন্তু চিন্তায় পড়ল রায়হানই বেশি, পরীক্ষার হলে গিয়ে। বুয়েটের লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ে আমাদের সিট পড়েছে, যথারীতি রোল নাম্বার অনুসারে পর পরই, কিন্তু সেটা পাশাপাশি নয়, সামনে পিছে। একটা ডেস্কে দুইজনের জায়গা, পাশাপাশি দুই চেয়ারে। আমার সামনে রায়হান আর পাশে গোলগাল চেহারার এক শ্যামলা বর্ণের সুকেশিনী। সুকেশিনী বলছি এ কারণে যে, মেয়েটি আসন্ন পরীক্ষার টেনশনকে অতিক্রম করতে না পেরেই কি না মুখটা সারাক্ষণই প্রায় নিচু করে রেখেছিল। তার প্রোফাইলের যা কিছু আমার দেখা—তাতে নাক বরাবর মাথা থেকে ঝুলে থাকা চুলের আশের ফাঁক দিয়ে, তার দৃষ্টিকে আড়াল করে, প্রায় লুকিয়ে যতক্ষণ দেখা যায়, সে এক বা দুই সেকেন্ড কাল বা তারচেয়েও কম সময়। মেয়েটির দীর্ঘ চুল, তার বেশি অংশ পিঠের ওপর ছড়ানো, কিছু অংশ তার ঝুঁকে থাকা মাথার কারণে কানের ওপর দিয়ে লেপ্টে নাকের অর্ধেকটা ঢেকে রেখেছে। পাখার কারণে খানিক বাতাস পেয়ে কিছু চুল সরে গেলে দেখা যায় তার নাকে একটা চমৎকার নাকফুলও আছে। তার চুল থেকে যে গন্ধ আসছে তা কোনো বিশেষ শ্যাম্পুর, বুঝতে পারি না। তবে আমলকি জাতীয় একটা ফলের গন্ধ সেখানে পাই। পরীক্ষায় আসার আগেই সে গোসল করেছে। পুরো চুল শুকায়নি বলেই হয়তো এভাবে মেলে ধরার চেষ্টা।

৩০ নভেম্বর, ১৯৮৪। যথা সময়ে পরীক্ষা শুরু হলে আমি বেশ দ্রুতই লিখিত অংশগুলো শেষ করে ফেলি। শেষে আঁকি ফ্রিহ্যান্ড ড্রইং। আমার ইচ্ছা হয় তাড়াতাড়ি খাতা জমা দিয়ে বলাকায় একটা সিনেমা মারি। সময় শেষ হবার আগে খাতা জমা দিয়ে দেবার পুরানো ফুটানি আমি এখানেও দেখাতে চাই, কিন্তু মন বলে, মেয়েটাকে আরো এক-দুবার দেখি। আমি বসে থাকার কাজ খুঁজি।

তাকালাম তার খাতার দিকে। সে ছবিটা আঁকছে। একজন মালি বাগানে পানি ঢালছে—এটা আমাদের সবার আঁকার বিষয়, এর জন্য নম্বর ২০। আমি যে এবার তার চুলের দিকে না তাকিয়ে আঁকা ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখছি সে টের পেয়েছে বলেই কি না জানি না, দেখি সে হাতটা যথেষ্ট সরিয়ে পেন্সিলের রিটাচিং থামিয়ে বেশ জায়গা করে আমাকে ছবিটা দেখতে দেয়।

আমি দেখি—সে চমৎকার একটা মালির ছবি এঁকেছে। রবীন্দ্রনাথের নাটকে জমিদারদের বাগানবাড়ির মালিরা যেমন থাকে, খালি গা, খালি পা, ধূতি পরা, টিনের কৌটা থেকে পানি ঢালার দৃশ্য। আমার সাথে খানিক চোখোচোখি হতেই আমি চোখের ভাষায় যেন তাকে বললাম—সুন্দর হয়েছে। জবাবে সে হাসল। আমি বুঝলাম, সে বলছে—ধন্যবাদ।

এবার মাথাটা ঘুরিয়ে চোখটা নাড়িয়ে সে আমার খাতার দিকে তাকায়। আমি বুঝলাম, সে বলছে— তোমারটা দেখি ? আমার শেষ হওয়া খাতার যে পাতাটিতে ছবি আঁকা আছে তা বাম পাশে উল্টে রেখে, যেন আমি আমারই অন্য পাতার লেখা চেক করছি এমন একটা ভাবের অভিনয় করতে থাকি, এই ভেবে যেন—সে এটা ভালো করে দেখে। মিনিট খানেক পরে যখন তার দিকে তাকাই, দেখি আমার খাতায় তার চোখ নেই, নিজের খাতায় আঁকাআঁকিতে সে ব্যস্ত।

আমার হাতে এখন কুড়ি মিনিটের মতো সময়। আমার ইচ্ছা, আরো কিছুক্ষণ বসি। আমার মনে হলো, আমার মালিটার চেয়ে ওই মেয়েটার মালি বেশি সুন্দর। আমি এঁকেছি আমাদের ক্যাডেট কলেজের হাউজ গার্ডেনের মালির ছবি। পায়ে কালো বুট, কালো মোজা, খাকির হাফ প্যান্ট, হাতে ভাঁজ করা খাকি শার্ট। আমি রাবার হাতে নেই । আমার মিলিটারি মালিকে বদলে ফেলি। রবীন্দ্রনাথের মালি বানিয়ে ফেলি, বাকি সব কিছু ঠিক থাকে।

সময় প্রায় শেষ। পাঁচ মিনিট আর আছে। দু-একজন খাতা জমা দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি কলম, পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স গুটাই। আমার খাতা ভাঁজ করে হাতে নিয়ে দাঁড়াবার আগে আরেকবার মেয়েটার দিকে তাকাই। সে বুঝে ফেলে, আমি তাকিয়েছি। তারও সব কাজ শেষ। পেন্সিল বক্স গোছানোর আগে তার খাতার সেই পাতাটি তার ডেস্কে এমনি মেলে রাখে যেন আমি দেখতে পাই।

আমি দেখি, সেই পাতায় বাগানে পানি দেয়া যে মালির ছবি সেটা এখন আর রবীন্দ্রনাথের নয়, খোদ কোনো ক্যান্টনমেন্টের সামরিক বড় কর্তার বাগানের মালি, পিটি সু, ফুল প্যান্ট, খাকি শার্ট, প্লাস্টিক পাইপের নল। আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে উঠে পড়ি এবং খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে যাই। টের পাই, মেয়েটি আমার পিছু পিছু আসছে।

লাইব্রেরির বাইরে আমি এসে দাঁড়াই। দেখি মেয়েটি বেরিয়ে আসতেই তার বাবার (বাবাই হবে) পাঞ্জাবীর হাত ধরে ডানে বামে কোথাও না তাকিয়ে লোকটার সাথে হাঁটতে হাঁটতে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।

রায়হান চলে এসেছে আমার পাশে। বলে—চল। আমি আরো দাঁড়াই। রায়হান বলে—কার জন্য অপেক্ষা করিস ? আমি বলি—কিছু না। রায়হান বলে, পরীক্ষা খুব ভালো হয় নি, ম্যাথ্স্ অনেকগুলো ছেড়ে দিসি। মেজাজ ভালো না, এখন কী করবি? আমি বলি, চল—বলাকা ধরি, সিনেমা দেখব।

পনের দিন পর আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আমি গ্রামের বাড়ি চলে যাই। এর মধ্যে মেডিকেলের রেজাল্ট হয়েছে। আমি সলিমুল্লায় চান্স পেয়েছি। কিন্তু পজিশন ৭। ঢাকা মেডিকেলে হয়ে যাবে। আমি ডাক্তার হবার প্রস্তুতি নিতে থাকি। এক বিকেলে গ্রামের বাজারে ডাকপিয়ন আমাকে একটা চিঠি দেয়। লিখেছে আমারই ক্যাডেট কলেজের আরেক বন্ধু—নাভিদ সামাদ। তিন লাইনের চিঠি—‘শাকুর, তুই আর্কিতে চান্স পেয়েছিস। কংগ্রেটস। ৮ তারিখ ভর্তির লাস্ট ডেট। তাড়াতাড়ি আয়। নাভিদ।’

সেদিন ৬ তারিখ। আমি রাতের বাসে চলে আসি ঢাকা। খবর নিয়ে জানলাম রায়হান আইএসএসবি দিতে ক্যান্টনমেন্ট গেছে (অবসরপ্রাপ্ত মেজর রায়হান খলিল এখন জাতিসংঘের লজিস্টিক ম্যানেজার হিসাবে লেবাননে চাকরিরত)। আমি আমার এক আত্মীয়ের বাসায় ভোরবেলা ব্যাগ রেখে নাভিদের বাসায় গিয়ে হাজির হই। নাভিদ তার মায়ের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। বলে, আমাদের ব্যাচের ৩৫ জন আর্কিটেকচারে পরীক্ষা দিয়েছিল আম্মা, মাত্র তিন জন চান্স পেল। শাকুর অনেক লাকি।

নাভিদ নিজে ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে (বর্তমানে আমেরিকার নিউইয়র্কে ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দিয়ে ঔষধ বিপনন ব্যবসার সাথে যুক্ত)। তারপরও আমাকে বলে—আর্কির ব্যাপারই আলাদা, বুয়েট বলে কথা। তুই বরং আজ ভর্তি হয়ে যা।

আমি ভাবি, সেই মেয়েটাও নিশ্চয়ই চান্স পাবে, কী সুন্দর ছবি এঁকেছে!

নাভিদ আমাকে বুয়েটে নিয়ে আসে। হেডস্যারের রুমে গিয়ে একটা ক্যাশ মেমোতে ২০৬ টাকা সোনালি ব্যাংকে জমা দিয়ে এসে রিসিট জমা দিই। মেট্রিক-ইটারমিডিয়েটের সার্টিফিকেট, মার্কশিট এসবের ফটোকপি সবসময় সঙ্গে থাকত। এসব একসেট ফটোকপি করে জমা দিই অফিসে। নাভিদ বলে—তোর ভর্তি হয়ে গেল।

আমি বাইরে এসে নোটিশ বোর্ডে আমার নামও দেখি। আমি বাকি সবার নাম পড়ি। ১৪টা মেয়েও আমাদের সাথে আছে।

সে কি আছে? আমি তো তার নাম জিজ্ঞাসা করিনি। নাম জানি না। আছে তো বটেই!

আমি আমাদের সাথে ভর্তি হতে আসা কাউকেই দেখি না, কাউকে তো চিনিও না। সবাইকে কবে দেখব?
আমি জিজ্ঞেস করি অফিসের একজনকে। তিনি বলেন, আরও ১৩-১৪ মাস পর, ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি নাগাদ ক্লাস শুরু হবে। বাড়ি চলে যান, পেপারে নিউজ পাবেন, চিঠিও যাবে বাড়ির ঠিকানায়।

আমি আমার সতীর্থদের সাথে মিলিত হবার জন্য আরো ১৪ মাস অপেক্ষা করতে থাকি।

১৪ মাস পর ৪৯ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ১৯৮৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আমাদের ক্লাস শুরু হয় বুয়েটে। ১৪ জন মেয়ে, বাকিরা সবাই ছেলে। আমি প্রথম দিনেই সবগুলো মেয়ের দিকে তাকাই। লম্বা চুলের শ্যামলা মেয়ে আছে, কিন্তু গোলগাল চেহারার ছোটমোট কোনো মেয়ে নাই, যার নাকে একটা নাকফুলও ছিল।

কিস্তি ২. মেডিক্যাল হোস্টেলের প্যারাসাইট জীবন

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;