ফিলিপিনো পরিচালক লাভ ডায়েজ: এশীয় চলচ্চিত্রের এক অনন্য শিল্পী



সৈয়দ কামরুল হাসান
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব দরবারে এশীয় চলচ্চিত্রের আলোচনায় জাপানের আকিরা কুরোসোয়া ও ভারতের সত্যজিৎ রায়ের নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত। ভারতের মৃণাল সেন ও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তও একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিজয়ী অথবা বিচারকের আসন অলঙ্কৃত করে সুনাম কুড়িয়েছেন। এই অতি-সংক্ষিপ্ত তালিকায় জাপানের অন্তত আরো দুজন পরিচালকের নাম যুক্ত করে নেওয়া যায়। এঁদের একজন টোকিও স্টোরি-খ্যাত ওজু এবং অপরজন কেনজি মিজোগুচি। গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ও ইতিহাসচেতনা-সমৃদ্ধ কুরোসোয়া ও ধ্রুপদী শিল্পগুণসম্পন্ন সত্যজিতের উচ্চতর মান আর যিনি বজায় রাখতে পেরেছেন তিনি সম্ভবত ইরানের আব্বাস কিরোয়াস্তামি। ইরানের বেশ কজন গুণী পরিচালকদের মধ্য থেকে মজিদ মাজেদি ও আসগর ফারহাদির নামও এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা সমীচীন; যদিও মহসিন মাখবালেফ ও তাঁর কন্যা সামিরা মাখবালেফের নাম যোগ করে এই তালিকা আরো দীর্ঘ করা সম্ভব। ওদিকে চীনের চলচ্চিত্রও যে পিছিয়ে নেই তা বিশ্বের নাম-করা চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতে তাদের কৃতিত্ব দেখে সহজে সনাক্ত করা চলে। বিশ্বের তাবত্ চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের স্তম্ভিত করে দিয়ে কান, ভেনিস ও অস্কারে সেরা ছবির পুরস্কার জিতে নেয়—Chen Kaige-এর Farewell My Concubine (1993, Palm De ’or Cannes ), Zhan Immu-এর Raise the Red Lantern(1991, Silver Lion,Venice) এবং Ang Lee-এর Life of Pie (2012, Academy Awards-Best Director) | অতপর এ-কথা বুঝতে আর বাকি থাকে না যে চীনও বিশ্ব চলচ্চিত্রের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে। অতি সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্রও আলোচনায় উঠে এসেছে। তাদের সেরা পরিচালক কিম কাই দুক নানা উৎসবে সেরা পুরস্কার ঝুলিতে পুরে দেশের জন্য মূল্যবান সম্মান বয়ে এনেছেন। সেখানে রয়েছেন আন হুই সহ আরো কজন কুশলী পরিচালক। গত বছর (২০১৯) দক্ষিণ কোরিয়ার নবপ্রজন্মের পরিচালক বং-জুন-হো তাঁর ‘প্যারাসাইট’ ছবির জন্য যুগপৎ কান ও অস্কার জিতে চলচ্চিত্র দুনিয়ায় হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন।

আমার সৌভাগ্য যে, নানা দিক থেকে যোগাড় যন্ত্র করে এই কুশলী শিল্পীদের সেরা কাজগুলি ইতোমধ্যে দেখা হয়েছে, সেই সাথে তাদের চলচ্চিত্র ভাবনার সাথেও খানিকটা পরিচিত হয়েছি। কিছুকাল একরকম হাত গুটিয়ে বসে ছিলাম—লক ডাউন সিচিয়ুয়েশনে অফিস ও অন্যবিধ কাজ ঠিকঠাক রাখতে গিয়ে কখনো হাঁফিয়ে উঠলে ইতিহাস-ভূগোলহীন মালায়লাম কিংবা বলিউড বাদশাদের বর্ণোজ্বল কৃত্রিমতায় নিজেকে সঁপে দিয়ে বিনোদন লাভের চেষ্টা করেছি। কখনো সেসব ছবির একটু-আধটু চেখে ফেলে দিতে হয়েছে! এইরকম একটা অস্থিতিশীল সময়ে অনেকটা অলৌকিকভাবে যেন ফিলিপিনো পরিচালক লাভ ডায়েজের খোঁজ পাই। আমার কাছে তিনি যেন গুপ্তধনে-ঠাসা এক নিখোঁজ দ্বীপ। উপরে উল্লিখিত সেরা ধ্রুপদী চলচ্চিত্রকারদের থেকে অনেক দূরে তাঁর অবস্থান। আমার মনে হয়েছে তাঁর ছবির বিষয়বস্তু, নির্মাণ কৌশল ও বক্তব্য একবারে আলাদা, তিনি পুরোপুরি স্বতন্ত্র এবং বলা যায় চলচ্চিত্রের এক অনন্য শিল্পী।

Lavrente Indico Diaz সংক্ষেপে Lav Diaz- এর জন্ম ১৯৫৮ সালে ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত আলোচিত দ্বীপপুঞ্জ— মিন্দানাওয়ে। সমুদ্র ও পাথুরে পর্বতমালায় ঘেরা বৃষ্টিবিধৌত উর্বর দ্বীপটিতে পাহাড়, সমুদ্র ও অরণ্যের বিরল সম্মিলন ঘটেছে। একইভাবে প্রাচীন লোকবিশ্বাস ও জাতিগোষ্ঠী এবং পরবর্তীতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টীয় ও মুসলিম ধর্মবিশ্বাস প্রভাবিত করেছে এই জনপদ। বর্তমানে মিন্দানাওয়ের জনগোষ্ঠীর প্রায় আড়াই কোটি জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বী। বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ, অস্থিরতা ও সামরিক শাসনের নিষ্পেষণ এই জনপদের শান্ত ও নিরন্তর জীবনপ্রবাহ বারবার ব্যাহত করেছে। সনাতন ধর্মীয় ও শত বছরের লোকবিশ্বাস বারবার বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় অধিবাসীদের মানসগঠন একটা নিজস্ব অদ্ভুত রূপ পরিগ্রহ করেছে। সেই সাথে যোগ হয়েছে সমুদ্রতীরবর্তী মানুষের জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের সাথে খাপ খাওয়ানোর ধৈর্য্য ও বেঁচে-থাকার অপরিসীম আশাবাদ। রাজধানী থেকে অনেক দূরের অনগ্রসর এই জনপদ দেশের মৎস্য, ফলমূল (কলা, আনারস) ও কৃষিপণ্যের বড় যোগানদাতা। এই জনপদে চলচ্চিত্রকার লাভ ডায়েজের জন্ম ও বেড়ে-ওঠা। তাঁর খ্রিস্টীয় ধর্মবিশ্বাসী পিতা গভীর অরণ্যে তাদের বাসস্থান স্থাপন করে অরণ্যের অভ্যন্তরের গ্রামসমূহে ধর্মপ্রচারের কাজে নিয়োজিত হন। লাভ ছোটবেলা থেকে দেখেছিলেন কিভাবে প্রাচীন বিশ্বাস, সংস্কার ও আচার অনুষ্ঠানের সাথে নয়া রীতি ও ব্যবস্থার সংঘাত ঘটে। কিভাবে উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ ও অধিকারবঞ্চিত মানুষ নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। আর কিভাবে প্রকৃতিকে এর অঙ্গীভূত করে নিয়ে গোটা ব্যবস্থা ও মানসগঠন একটা অজানা রহস্যময় আকার পায়—এই মিথস্ক্রিয়া ডায়েজের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রধান ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। এ-কারণে অর্থনীতির উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন ও হারভার্ডের ফেলো হওয়া সত্ত্বেও ছবির কাহিনী ও পটভূমির খোঁজে তিনি বারবার ফিরে গেছেন জাদুবাস্তবতার আবহে-ঢাকা তাঁর শৈশবের স্মৃতিঘেরা সেই জনপদে। এমনকি এখনো মাকিন যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে বসবাস করলেও সময় পেলেই ছুটে যান সূদূর মিন্দানাওয়ে গড়ে-তোলা তাঁর প্রিয় কৃষি খামারে।

লাভ ডায়েজের চলচ্চিত্র নির্মানের শুরু ১৯৯১ সালে। ছোট বড় মিলিয়ে লাভ ডায়েজ পরিচালিত ছবির সংখ্যা—২৫, এর মধ্যে ১৫টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র। সবচেয়ে আলোচিত ও বিশ্ব-চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের কাছে সমাদৃত ছবিগুলির মধ্যে কয়েকটির নাম : Naked under the Moon (1999), Evolution of a Filipino Family(2004), Death in the land of Encantos (2007), Melancholie (2008), Norte, the End of history(2013), From What is Before (2014), A Lullaby to the sorrowful mystery (2016), The woman who left (2016), Season of the Devil (2018), The Halt(2019) | লাভ ডায়েজের ছবি Norte, the End of history ২০১৩ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে UN Certain Regard-সেকশনে প্রদর্শিত হয়। ২০১৪ সালে তাঁর অনবদ্য ছবি—From What is Before—লোকার্ণো উৎসবের সেরা ছবির পুরস্কার জিতে নেয়। ২০১৬ সালে, একই বছরে, তাঁর ২টি ছবি ২টি চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা চলচ্চিত্র হিসাবে পুরস্কৃত হয়। The woman who left—ভেনিসে গোল্ডেন লায়ন এবং A Lullaby to the sorrowful mystery—বার্লিনে গোল্ডেন বিয়ার পায়। ভেনিসের চলচ্চিত্র জুরি কমিটি ও বোদ্ধাগণ তাঁকে: “the ideological father of the New Phillipine” হিসাবে আখ্যায়িত করেন। পরিচালনা ছাড়াও লাভ ডায়েজ একজন চলচ্চিত্র সমালোচক, কবি ও সংগীতকার। এই ডিসেম্বরে লাভ ডায়েজ ৬২ বছরে পা দেবেন। নতুন নতুন ছবি নির্মাণের ভাবনা তাঁকে সক্রিয় ও সদাব্যস্ত রাখছে। তাঁর ভাষায়: “That’s the urgency to me—having the spiritual Journey,doing my cinema, taking care of my kids and my rice field, it’s the same.”

২.
রাজধানী থেকে অনেক দূরের একটি জনপদ, যার এক দিকে সমুদ্র যেখানে প্রায় সারাদিনই মাতাল ক্ষুব্ধ সাগর প্রচণ্ড গর্জনে বারবার এসে আছড়ে পড়ছে কালো শিলীভূত পর্বতমালায়। পাহাড়ের ঢালের অপর পাশটিতে কয়েকটি খাল, নালার দুইধারে ঘন বাঁশঝাড়, আরো নাম-না-জানা গাছপালায় ছাওয়া ঘন অরণ্যবেষ্টিত ছোট্ট জনপদ। সভ্যতার ছোঁওয়া লাগেনি, মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের খুঁটি বসেছে মাত্র, কবে আলো আসবে কেউ জানে না। ভাঙা সেতু যানবাহনের চলাচল অগম্য করে রেখেছে। অরণ্যের জলমগ্ন ফাঁকা জমিগুলিতে মোষের পাল, টোপর মাথায় তাদের তত্ত্বাবধানে ২/১ জনকে চোখে পড়ে। থকথকে কাদায় হঠাৎ ২/১ জন গ্রামবাসি ছপ ছপ শব্দ তুলে এগিয়ে যায়। আর শব্দ বলতে সারাদিন পাখির কিচিরমিচির, অবিরাম কুকুরের ঘেউ ঘেউ, মোরগ-মুরগির খুঁটে খুঁটে খাবার তোলার ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত বিরতিতে ডাক গেরস্থালির আভাস দেয়। নজরে আসে উঁচু উঁচু কাঠের খুঁটির ওপর পাটাতন তুলে এক একটি খড়ে-ছাওয়া ঘরে বসবাসরত মানুষ, কিছু শান্ত স্বল্পবাক মানুষের কষ্টে-সৃষ্টের সংসার। অরণ্যের ফলমূল আহরণ ও পাখি শিকার, সামান্য জমিজিরাতে চাষাবাদ আর খালে-বিলে মাছ ধরা তাদের নিত্য ক্ষুন্নিবৃত্তির উপায়। এই অরণ্যের লতাপাতা তাদের অসুখ-বিসুখের নিদানও। আরো আছে অদৃশ্যে ভক্তি, ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাস, সমুদ্র যে কালো শিলায় এসে মাথা কুটে মরছে সেখানে দেবতার উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য পেশ, যে দুষ্ট আত্মা তাদের যাবতীয় ভোগান্তির কারণ বলে তারা মনে করে, তাকে তাড়ানোর নানা বিচিত্র কলাকৌশল—যার শেকড় শত সহস্র বছর ধরে তাদের বিশ্বাসের গভীরে প্রোথিত। কিন্তু এরই মধ্যে আছে একের জন্যে অন্যের গভীর সহমর্মিতা, জন্ম ও মৃত্যুতে যুথবদ্ধ আনন্দ ও শোকতাপ, জীবনসংগ্রামের লড়াই, শঙ্কা, হতাশা, সরল ঘৃণা, প্রেম ও পাপবোধ। ১৯৭০-৭২ সালে ফিলিপাইনের এমন একটি প্রত্যন্ত জনপদের প্রেক্ষাপটে লাভ ডায়েজের ছবি From What is Before-র গল্প আবর্তিত হয়েছে। সাড়ে ৫ ঘণ্টার দীর্ঘ ছবি। ঠিক প্রচলিত অর্থে নায়ক-নায়িকা নির্ভর কোনো নাটকীয় কাহিনী এতে নেই—এ যেন গোটা একটি জনপদেরই হারিয়ে যাওয়ার গল্প। সেদিক থেকে বলতে গেলে জনপদই এই ছবির মূল চরিত্র। এমনভাবে ছবিতে গোটা জনপদকে তুলে আনা হয়েছে যাতে আছে সমুদ্রের গর্জন, আকাশে মেঘ ডাকছে, সারাদিন টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজছে সবাই, বাঁশঝোপে বইছে হাওয়া—হাওয়ার সরসর শব্দ, কুপির আলোয় স্বল্পালোকিত রাতের গেরস্থালি—পরিচালক অনেকক্ষণ ক্যামেরা ফেলে রাখেন অরণ্যের ঝোপে-ঝাড়ে, কাদাজমা পথে ঘাটে, বৃষ্টিক্লান্ত বিষণ্ন আকাশে! কখন যে সেই জনপদ দর্শকের মনে ধীরে ধীরে জায়গা করে নেয় ঠিক আন্দাজ হয় না, কেননা সময়ের দিকে খেয়াল থাকে না, অনতিবিলম্বে একটা ঘোর গ্রাস করে নেয়। তারপর ধীরে ধীরে পরিচালক গল্পের মোড়ক খোলেন। গ্রামের অধিবাসীরা তাদের বাড়ির লাগোয়া জঙ্গলে বিচিত্র কিন্তু ভয়ঙ্কর কিছুর ডাক শুনতে পায়, আতঙ্কে ভরদুপুরে তারা দরজা জানালার খিল তুলে দেয়। একদিন খবর আসে চারণভূমি থেকে তিনটি মহিষ হারিয়ে গেছে, আরেক দিন হঠাৎ দুপুরবেলায় তিনটি বাড়ি আগুনে ভস্মীভূত হয়। একদিন দেখা যায় অরণ্যের ঢালে মাঝবয়সী অচেনা একটা লোকের লাশ পড়ে আছে, তার ঘাড়ের পেছনে গভীর কাটা দাগ। এইভাবে মানুষের মধ্যে দানা বাঁধে অজানা ভয়; এমনকি তারা ভাবতে শুরু করে এসবকিছু তাদেরই কোনো পূর্বকৃত পাপের ফল কিনা। গ্রামের এক বোন তার প্রতিবন্ধী ছোট বোনকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে—এই প্রতিবন্ধী বোনটিকে ভাবা হতো অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন যার কিনা আছে ঝাড়ফুঁকে ম্যালেরিয়া-হিস্টিরিয়াসহ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষগুলিকে সারিয়ে তোলার ক্ষমতা। প্রতিবন্ধী মেয়েটিকে সেই কাজে লাগানো হয়, দুই বোনের আয়ের উৎসও সেই কাজ। কিন্তু প্রতিবন্ধী বোনটি সবার অলক্ষ্যে এক প্রতিবেশি যুবকের যৌন লালসার শিকার হয়ে একসময় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তার বোনটি তা মানতে পারে না। সে সমুদ্রের যে দেবতার কাছে প্রতিদিন বোনের রোগমুক্তির জন্য প্রার্থণার নৈবেদ্য সাজাত সেই সমুদ্রে বোনকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেয়। ইতোমধ্যে গ্রামে একটি গির্জা বসেছে, যার পাদ্রি এইসব অপচিকিৎসা ও লোকবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারে না, দুই বোন তার সামনেই তাদের আরাধ্য সমুদ্র-দেবতার কাছে আত্মাহুতি দেয়। ওদিকে প্রতিবন্ধী বোনটি যে-যুবকের যৌন লালসার অসহায় শিকার হয়েছিল, সেই যুবকও মানসিক অনুতাপে জর্জরিত হয়ে স্বীকারোক্তির পর ক্রুদ্ধ প্রতিবেশির হাতে নিহত হয়। ভয় ও বিষণ্নতা আরো ভারী হয়ে চেপে বসে গ্রামবাসির পর। একদা গ্রামে সামরিক বাহিনীর একটি ব্যাটেলিয়ন এসে হাজির হয়। কেন্দ্রে মারকোসের সরকার সামরিক আইন জারি করে, গ্রামবাসি ও স্কুল শিক্ষকদের আপত্তির মুখেও স্থানীয় স্কুলে বসে সেনাদের অস্থায়ী ক্যাম্প। গ্রামে সেনারা কারফিউ দেওয়ার ঘোষণা দেয়; তাদের কাছে খবর ছিল: এদিককার জঙ্গলে গেরিলাদলের ঘাঁটি রয়েছে। এক মহিলা সেনা কর্মকর্তাকে কাপড়বিক্রেতার ছদ্মবেশে গ্রামবাসীদের বাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে তন্ন তন্ন করে দেখা হয় কোথাও কোনো ক্লু পাওয়া যায় কিনা। সরল গ্রামবাসির কাছে কিছুই পাওয়া যায় না। কিন্তু একদিন সত্যি একদল সশস্ত্র গেরিলাকে অরণ্যের গহীনে টহলরত দেখা যায়। তারা গ্রামের বাছাই-করা যুবকদের গাছে ঝুলিয়ে নৃশংসভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, পথচারীদেরও নানা জিজ্ঞাসায় আতঙ্কিত করে তুলছে। কিন্তু আরো কোনো এক গভীর অজানা ভয়ের ঘোরে কম্পিত ও আবিষ্ট সে জনপদের কেউ তাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সামরিক বাহিনীর কারফিউ কিংবা গেবিলাদের প্রহরা অনুমোদন করে না। নীরবে বাড়িঘর রেখে তারা দূরের ভিন্ন কোনো জনপদে পালাতে শুরু করে। শুধু থেকে যায় এক প্রাচীন চাষী আর তার ছেলেবেলার বন্ধু একদা শহরবাসি এক কবি—ক্যান্সারের শেষ দিনগুলিতে তার বাসভূমিতে মরার আকাঙ্ক্ষায় যে ফিরে এসেছে। কবির একমাত্র কন্যা শহরবাসি—কবি সারাদিন তার পুরনো টাইপরাইটারে তার জনপদের এই চাপা আতঙ্ক নিয়ে কবিতা রচনায় ব্যপৃত হয়। বন্ধুকে জানায় মৃত্যুর পর তার অন্তিম ইচ্ছার কথা—না, খ্রিস্টীয় কিংবা কোনো নতুন রীতিতে নয়, তার সৎকার যেন করা হয় পূর্বপুরুষের “মালয়” রীতিতে, বস্তুত এ-কারণেই সে ফিরে এসেছে এই মৃত্যু উপত্যকায়। অনতিবিলম্বে কবির মৃত্যু হয়, খবর পেয়ে কবির শহরবাসি মেয়েটি আসে গেরিলাদলের অনুমোদন নিয়ে। বাড়ির পাশের বয়ে-যাওয়া ছোট নদী, যা গিয়েছে সাগরের ঠিকানায়, সেখানে কলার ভেলায় চিতা সাজানো হয়, চিতায় আগুন দেওয়া হয়। আর কেউ নেই কবির শেষযাত্রায়—শুধু তার ছোটবেলার বন্ধু আর মেয়েটি। হু হু আগুনে কবির শবদেহ পোড়ে, ধীরে ধীরে ভেসে যেতে থাকে কলার ভেলাটি। ক্যামেরার চোখ প্যান করে ঘন অরণ্যের মাথায় ঝুলে থাকা মেঘক্লান্ত আকাশে স্থিত হলে আপাতত যবনিকা নেমে আসে, পরদায় ভেসে উঠে ছবির কলাকুশলীদের নাম।

From What is Before সিনেমার একটি দৃশ্য

তিনদিনে একটু একটু করে দেখা সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ ছবি দেখা শেষ হলেও উঠে আসতে ইচ্ছা করে না, মায়া পড়ে থাকে। একেবারে আধুনিক কালে অর্থাৎ ২০১৪ সালে নির্মিত হলেও গল্প তথা জনপদের আবহ ঠিক রাখার জন্য ছবিটি শাদা কালোয় তোলা। সবসময় দেখা গেছে আকাশের একটাই রঙ—বর্ণহীন, মেঘাচ্ছন্ন, ঘোলাটে। বেশির ভাগ সময় জুড়ে বৃষ্টিপাত। কেউই যেন অভিনয় করেনি ছবিতে, গাঁয়ের একেবারে চাষভূষোরা উঠে এসেছে ফ্রেমে। সময় নিয়ে, শ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে কথা বলে ওরা; ক্যামেরা অপেক্ষা করে ততক্ষণ। ছবিতে কোনো যৌনতা নেই, ইঙ্গিতে বোঝানো হয়েছে অবৈধ যৌনতা। সবচেয়ে বড় সাতন্ত্র্য এই ছবিতে কোনো আবহ সংগীত নেই। অরণ্যের নানান আওয়াজ, কুকুরের ঘেউ ঘেউ, মোরগের বাঁক, মুরগি ছানাদের উচ্ছ্বসিত ছুটে চলার আওয়াজ, পাখির কিচিরমিচির, বাঁশবনে রাত্রিভর হাওয়ার চলাচল, পাহাড়ের ঢালে সমুদ্রের ক্রুদ্ধ গর্জন—বাস্তবের সব শব্দ জড়ো করে নিপুণভাবে ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। পরিচালক যেন বলতে চেয়েছেন জীবনের মধ্যেই রয়েছে এর নিজস্ব স্বর ও সুর। এইভাবে জনপদ নিজেই হয়ে উঠেছে এক জীবিত সত্ত্বা, বয়ে-চলা জীবন যার চরিত্র। এক নিরাসক্ত ভঙ্গিতে লাভ ডায়েজ যেন শুধু তাকে তার নিজের মত করে বয়ে যেতে দিয়েছেন ।

ভেনিসে পুরস্কারপ্রাপ্ত তাঁর ২০১৬ সালের ছবি—The woman who left-ও শাদা কালোয় চিত্রায়িত। সেখানেও তা ছিল ছবির গল্পের চাহিদা কিংবা দাবি। সেখানে গল্প অনুসরণ করে ক্যামেরা নেমে গেছে দূর গাঁয়ে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যে আসলে চারপাশের অনুষঙ্গে রয়েছে—এটা বলা যায় তাঁর একটি আবিষ্কার। এই কৌশল মোক্ষমভাবে তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর আরেকটি দুর্দান্ত ছবি Norte, the End of history-তে। ৪ ঘণ্টা ১০ মিনিটে সমাপ্ত ছবিটি যদিও রঙিন, কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসাবে সেখানেও ব্যবহার করা হয়েছে জীবন থেকে নেওয়া শব্দাবলি—রাতে কাজ করে ফেরা শ্রমিকদের পায়ের আওয়াজ, রাত্রির নিঃসঙ্গ পথের কুকুর, তারা ডাকছে; কখনোবা সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ বেলাভূমে এসে আছড়ে পড়ছে। এই ছবিও ফিলিপাইনের জনজীবনের বাস্তবতা, রাজনীতি ও ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত। এখানেও গল্পের প্রেক্ষিত হিসাবে লাভ ডায়েজ বেছে নেন শহরের বাইরে (এমনকি শহরতলীরও নয়) ছিটকে-পড়া ছিন্নভিন্ন মানুষ—আধপেটা খেয়ে হাইওয়ের ধারে গভীর রাতে কোনো রোয়াকে বসে যারা দূর শহরের আলোকমালার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। এক শ্রমিকের পরিবার যার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি দুর্ঘটনায় পতিত হলে তার স্ত্রী, তাদের দুই শিশু সন্তান ও তাদের ওপর নির্ভরশীল স্ত্রীর ছোটবোনসহ গোটা পরিবারটি শোচনীয় অবস্থার মুখোমুখি হয়। বাধ্য হয়ে তারা স্থানীয় মহাজন তথা পেশাদার অর্থলগ্নীকারী এক মহিলার দারস্থ হয় এবং তার কাছে সংসারের প্রয়োজনে ঘরের মালামাল বিক্রি করে দিয়েও বিপুল দেনা অপরিশোধ্য থেকে যায়। এই প্রেক্ষাপটে, এলাকায় বসবাসরত আইনের এক মেধাবী ছাত্রের (যে কিনা আইনের কোর্স শেষ করার ব্যাপারে ইতোমধ্যে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এবং অথলগ্নীকারী পূর্বোক্ত মহিলার কাছে যারও কিছু দেনা আছে) হাতে মহিলা ও তার কন্যা খুন হয়। ঘটনাক্রমে পুলিশ এসে সন্দেহবশত পূর্বোক্ত দুর্ঘটনাকবলিত শ্রমিককে গ্রেফতার করে, পুলিশের ধারণা দেনাপাওনা নিয়ে মহিলার সাথে আগে সংঘটিত এক বচসার জের হিসাবে এই খুন সেই করেছে। মিথ্যা অভিযোগে শ্রমিকের সশ্রম কারাদণ্ড হয়, ওদিকে ছোট দুই শিশু সন্তান ও নিজের বোনকে বাঁচানোর জন্য শ্রমিকের স্ত্রী ফেরি করে বাড়ি বাড়ি সবজি বিক্রি করার কঠোর জীবিকা বেছে নেয়। একদিন জেল থেকে স্বামীকে দেখে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় তারও প্রাণহানি ঘটে। ওদিকে প্রকৃত খুনি আইনের ছাত্রটি তীব্র অপরাধবোধে তাড়িত হয়। ধীরে ধীরে সে মানসিক সুস্থতা হারিয়ে ফেলে। মাত্র ৩/৪টি চরিত্র নিয়ে সাজানো গল্প গোটা মানবজীবনের গভীরে আলো ফেলেছে। অপরাধ, বিচার বিভাগের তদন্তে দুর্বলতা, অপরাধবোধে সংকটাপন্ন মনস্তত্ত্ব নিয়ে অসাধারণ ছবি। মুখ্য চরিত্রটি বারবার দস্তয়েভস্কির “ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট”-এর নায়ক রাসকলনিকভের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু পরিচালক গল্প শেষ করেন না—খুনের মিথ্যা অভিযোগে দণ্ডিত শ্রমিকের কারাগারে দিন কাটে, তার স্ত্রীর বোনটি ছোট ছোট ২টি শিশু নিয়ে নতুন সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, ওদিকে প্রকৃত খুনি আইনের ছাত্রটি স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে ধরা দেয় না, কিন্তু মানসিকভাবে নিজের মধ্যে অপরাধবোধে ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এই গল্পের কোনো পরিণতি কিংবা সমাধান নাই, এমনকি আশুকালে আশা করা যায় এমন কোনো সমাধানের আভাসও নাই ছবির শেষে। বোধ হয় তা দেখানো পরিচালকের অন্বিষ্টও নয়, হয়তো বা তিনি মনে করেন এই গল্পের কোনো সহজ পরিণতি থাকতে পারে না। একজন শিল্পী হিসাবে তিনি শুধু পারস্পেক্টিভটা তুলে ধরতে পারেন। তিনি ছবির নাম দেন ইতিহাসের অন্তিমের ধারাভাষ্য। এই ইতিহাস বলতে হয়তো তিনি তাঁর নিজের দেশের ইতিহাসকেই বুঝিয়েছেন, কিন্তু সিনেমা নির্মাণে তাঁর দক্ষতা ও শক্তি ছবিটিকে যে মাত্রায় উন্নীত করেছে তা বিশ্বমানের।

Norte, the End of history সিনেমার একটি দৃশ্য

লাভ ডায়েজকে আলোচকরা Slow cinema movement-এর অগ্রপথিক বলেছেন। তাঁর কোনো কোনো ছবির দৈর্ঘ্য ১০ ঘণ্টারও বেশি। তার ছবি দেখতে বসে মনে হয় এ-যেন পড়ছি দীর্ঘ কোনো উপন্যাস, কোনো তাড়া নেই—একেকটি ছবি বইয়ের পাতা মুড়ে রাখার মতো, বিরতি দিয়ে দিয়ে ২/৩ দিনে দেখা শেষ হয়। আবার ঠিক তা সিকোয়েল দিয়ে গাঁথা ধারাবাহিক মেজাজেরও নয়। কেননা সবটা মিলে, সবটা জুড়ে তাঁর ছবি। লাভ ডায়েজের ছবি আমাদের অভ্যস্ত চলচ্চিত্র দর্শনে এবং উপভোগে একটা দারুণ ঝাঁকুনি দেয়। কিন্তু আশ্চর্য কুশলতার সাথে তিনি তার দর্শকদের ধরে রাখেন। একেকটি ছবি অন্যটির তুলনায় বিষয়বস্তু ও বক্তব্যে, তার কাব্যিক গভীরতায় কখনো এতটাই বিশিষ্ট যে, তাঁর দীর্ঘ ছবিগুলি জুরিরা দেখেছেন (বলা চলে দেখতে বাধ্য হয়েছেন) ও পুরস্কার প্রদানের স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। হালফিল জমানায় যেখানে দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠেছে ছবির কাহিনী, কি নাটকীয়তায়, কি চোখ ধাঁধানো রঙে, যৌনতায়, ডিজিটাল কারিগরি সম্বল করে যেভাবে দর্শককে দু আড়াই ঘণ্টার প্যাকেজে মুড়ে ফেলা হয়েছে, সেখানে একবিংশ শতকে এসেও লাভ ডায়েজ বলছেন স্থিতধী হতে ; তাঁর মতে ‘ধৈর্য্য’ প্রাচ্যের বৈশিষ্ট্য, তিনি বলছেন—পাশ্চাত্যের সঙ্গে ঠিক এখানে আমাদের তফাতও বটে। ২০১৭ সালে Sight & Sound Magazine-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন: “Art is a commitment to the beauty of the Soul.” আর সব মহান শিল্পীর মতো তিনিও আমাদের জানান “আত্মার সৌন্দর্যই” তাঁর অন্বেষা । আর তাঁর স্থির বিশ্বাস হলো এই অন্বেষণে চাই গভীর অভিনিবেশ ও ধৈর্য্য।

৩.
From What is Before—ছবিটির কাছে আবার ফিরে যাই। যেখানে এক রহস্যময় জনপদে বাস্তবতা ও ফ্যান্টাসি, জীবন ও মৃত্যু, সত্য ও কিংবদন্তী মুখোমুখি হয়েছে। এই ছবি দেখতে গিয়ে বারবার আমার তারাশংকরের “হাঁসুলী বাঁকের উপকথা” উপন্যাসের কথা মনে পড়ছিল। এক অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রাম, যুগ পরিবর্তনের সাথে তাদের অর্থনীতি, আচার অনুষ্ঠান ও বিশ্বাস বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম এবং পরিশেষে তাদের অসহায় আত্মসমর্পণ ও হাঁসুলী নদীর বাঁকে সেই জনপদের বিলুপ্তি নিয়ে এটি বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম সেরা কাজ। উপন্যাসটি নিয়ে ১৯৬২ সালে পশ্চিম বঙ্গের গুণী পরিচালক তপন সিনহা ছবি বানিয়েছিলেন। শাদা কালোয় তোলা ছবিটি দেখতে গিয়ে আমি এর খারাপ প্রিন্টে বিরক্ত হয়েছি বারবার, সংলাপও অস্পষ্ট।

আমার মনে প্রশ্ন জমেছে; আমাদের এখানে (বাংলাদেশে) কি এমন ছবি তৈরি হয়েছে? সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর “কাঁদো নদী কাঁদো” উপন্যাসে বাকাল নদী মরে যায়—জনপদের মানুষ রাতে শুনতে পায় কারুর কান্নার শব্দ, শহীদুল জহিরের “সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো” উপন্যাসে জোছনারাতে খুন সংঘটিত হয় আর ঘুমের মধ্যে এক নারী হেঁটে গিয়ে বিলের পানিতে নগ্ন হয়ে নেমে গোসল করে ফিরে আসে; কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “খোয়াবনামা”র কাৎলাহার বিলের তীরের পাকুড় গাছে আরূঢ় মুন্সীর ইশারায় বিল পাড়ি দেয় গজার মাছের ঝাঁক, তমিজের বাপ বিলের পানিতে দাঁড়িয়ে তা অবলোকন করে রাতভর! এইসব নিয়ে কি তৈরি হয়েছে আমাদের এখানে কোনো ছবি?

আমাদেরও তো গল্প আছে, কিন্তু তা নিয়ে বানাতে হলে চাই লাভ ডায়েজের মত শক্তিমান পরিচালক, চাই প্রয়োজনীয় পৃষ্টপোষক। আর হ্যাঁ সেই সঙ্গে চাই তেমনি রুচিবান দর্শকও!

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;