বুকের পাঁজরে কাশফুল



হাসান অরিন্দম
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

শনিবার সকাল পৌনে দশটার দিকে নাস্তা সেরে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে বারন্দায় বসে খবরের কাগজ উল্টাচ্ছিলাম, কার কাছ থেকে যেন কানে খবর উড়ে এলো টিপু সুলতানকে কাল সন্ধ্যা থেকে কোত্থাও পাওয়া যাচ্ছে না। হতে পারে রাস্তার পথচারীরাই বলা-কওয়া করছিল। ১১ বছরের টিপু সুলতান আমার আপন কেউ নয়, কাজেই উদ্বেগ যতোটা না, কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসা বরং তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। আমি ওকে বোধ হয় প্রায় আট বছর ধরে দেখে আসছি। ওর মায়ের ভাষ্যমতে জন্মের বছর-দুই পরে পায়ে কাঁটা ফুটে গ্যাংগ্রিনের লক্ষণ দেখা দেয়। তখন থেকেই কবিরাজ, ওঝা, হোমিওপ্যাথের পিছনে ছুটে কোনো ফল এলো না। আজকাল গায়ে সারা দিনরাত জ্বর থাকে, খেতে গেলে বমি পায়, প্রায়ই যন্ত্রণায় কাতরায়; তবে কারো প্রতি কোনো অভিযোগ তার নেই। পাড়ার লোকেদের কেউ কেউ বলল ও ছেলের ক্যান্সার, বাঁচবে না বেশি দিন। পরে টিপু সুলতানের যখন সাড়ে দশ বছর বয়সে সার্জারির ডাক্তারের কাছে গেল জবা আর ওর স্বামী, তখন ডাক্তার বলল ছেলেকে বাঁচাতে গেলে পুরো পায়ের পাতাটা কেটে ফেলতে হবে, সেটার আবার বায়োপসি না কি, তাও করা লাগবে। আরো আশঙ্কার কথা এতোদিন কেবল বাম পায়ে ক্ষত রক্ত আর লালচে কষানি ছিল, এখন ডান পায়ের তলায়ও লক্ষণটা দেখা দিয়েছে। যদিওবা এক পায়ে ভর দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে বেশ হাঁটতো এখন লাঠি ছাড়া এক পা-ও এগোতে পারে না। জবা চার-চারটে সন্তানের মা, কাজেই একটাকে নিয়ে তার সারাদিন হা-হুতাশ করে বসে থাকবার ফুরসত নেই। ওদের অকালবৃদ্ধ হাড্ডিসার বাপও বছর দশেক হলো শ্বাসকষ্টের রোগী। দুদিন ভ্যানটা নিয়ে বেরোয় তো তিনদিন ভাঙা চালের দিকে তাকিয়ে ঘরে শুয়ে ‘ও আল্লাহ ও আল্লাহ’ বলে ছালওঠা বুড়ো কুকুরের মতো কাতরায়। কাজেই জবাকে কখনো কখানো জুটমিলে কখনো তামাকের ফ্যাক্টরিতে গতর খাটিয়ে ছেলেমেয়েগুলোর মুখে ভাত জুটাবার ব্যবস্থা করতে হয়। গা-গতর এখনো বেশ আঁটোসাঁটো বলে চকচকে নোট দেখিয়ে অনেক পুরুষই নিভৃতে পাওয়ার ইশারা করলেও জবা আজ অবধি সে-সব ইঙ্গিত পদদলিত করে চলতে পেরেছে। তার নিজেরও আশঙ্কা হয় কবে না আবার সংযমের মিহি সুতোখানা ছিঁড়ে যায়। দুএকবার যে মনে হয়নি গায়ে সুগন্ধীমাখা কোনো পুরুষের ডাকে সাড়া দিয়ে কুড়ি মিনিট জাপ্টাজাপ্টি করে দুতিন শ টাকা আয় করে আনবে—এমনও নয়। ঘরের মিনশের তো শরীরে কিছু নেই আবার তেজের বেলায় ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা। একদিক দিয়ে ভাগ্যটা খানিক ভালো জবার, বড় মেয়ে জুলেখাকে বছর তিনেক আগে এক হোটেল কর্মচারীর সাথে বিয়ে দিয়েছে, সেখানে মেয়েটা দুবেলা খেয়ে মোটা কাপড় পরে দিব্যি দিন পার করে দিচ্ছে, সপ্তাহে কি মাসে জামাই একবার বৌকে পিটালেও সেটা আমলে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না জবা। টিপু সুলতানের মায়ের যখন কোথাও কাজ থাকতো না প্রায়ই আমাদের বাড়িতে এসে ছেলেটাকে বাইরের বারান্দার মেঝেতে শুইয়ে রেখে নিজে যেচে আমার স্ত্রীর কাপড় কাঁচা, ফার্নিচার, গ্রিল, জানালার গ্লাস মোছা—এসব কাজ করে দিতো। তিন বছরের টিপু সুলতান বড় বড় দুটি চোখ নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো। খানিক বাদে ওর মা একটা শুকনো রুটি হাতে দিয়ে গেলে সেটা প্রসন্ন চিত্তে চিবোতে থাকতো। ওর পায়ের রক্ত-কষানি দুএক ফোঁটা মেঝেতে পড়লে যাওয়ার সময় জবা স্যাভলন দিয়ে যত্ন করে পরিষ্কার করে রেখে যেতো।

চারটে সন্তানের মধ্যে ও-ই সবচেয়ে ফরসা গয়ের রঙ আর প্রায় নিখুঁত চেহারা নিয়ে জন্মেছিল। টানা টানা চোখ টিকল নাক দেখলে মনে হতো কোনো অভিজাত ঘরের শিশু, নিশ্চয়ই বড় হয়ে নামকরা কেউ হবে। তাই জবার স্বামী ছেলের রাজপুত্তুরের মতো চেহারা দেখে আকাশ সমান স্বপ্ন নিয়ে নাম রেখেছিল রাজা-বাদশার নামের সাথে মিলিয়ে। কিন্তু তিন বছর না-হতেই পায়ের তলায় পচনের আভাস তাদের হৃৎপিণ্ডকে ক্রমে চুরমার করে দিতে থাকে। ওর পা দেখে বিভিন্ন জন নানান কথা বলতো। জবা লোকের পরামর্শে তার সাধ্যের মধ্যে সবকিছুই করবার চেষ্টা করেছে। কখনো ফকির-কবিরাজ, কখনোবা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। মাঝে মাঝে কিছু উন্নতির লক্ষণ—পায়ের কষানি বন্ধ হওয়া, ঘায়ে টান ধরা দেখে জবার মনে আশার আলো জ্বলতো। কিন্তু আবার হয়তো দুতিন মাস না-যেতেই আগের অবস্থা কিংবা আরো অবনতি।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জন যেদিন দেখলেন ততদিনে টিপু সুলতানের বয়স সাড়ে দশ পেরিয়েছে। ডাক্তার রেগেমেগে বললেন, ‘তোমাদের নিয়ে বড় যন্ত্রণা, এই সাত-আট বছর কী করেছো? এখন ছেলেকে বাঁচাতে হলে দুটো পায়ের পাতাই কেটে ফেলতে হবে। এর মধ্যে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে কিনা সেটাও বায়োপসি করে যাচাই করতে হবে।’

ফিরবার সময় কলা-পাউরুটি কিনে ছেলেকে নিয়ে ঘামের গন্ধঅলা মানুষের ভিড় ঠেলে বাসে উঠে জবা আর ওর স্বামী। টিপু সুলতান সকাল থেকে কিছুই মুখে নেয়নি। বেলা প্রায় দুটো বাজে, কলা-পাউরুটির কিছুই সে স্পর্শ করে না। ছেলের শুষ্ক বিরস মুখের দিকে তাকিয়ে জবা বলে, ‘খা বাবা খা।’

কিছুক্ষণ বাইরে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ টিপু সুলতান হাউমাউ করে কেঁদে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মা, পা ক্যাটে ফেললি আমি হাঁটপো কিরাম করে? আমি আরো ভাবছিলাম পা ভালো হলি আমি ফুটবল খেলতি পারব।’ ছেলের কথা শুনে জবাও চোখের জল আটকাতে পারে না। জবার স্বামী তখন একটা বিড়ি ধরানোর খুব তাগিদ বোধ করলেও ভিড়ের মধ্যে লোকের ধমকের ভয়ে বিড়িতে আগুন জ্বালাতে সাহস হয় না তার।

রাতে বড়বোনের পাশে নড়বড়ে চৌকিতে শুয়ে টিপু সুলতানের ঘুম আসে না। মনে হয় বুকের ভেতর শ্বাসটা কোথায় যেন কুণ্ডলি পাকিয়ে যাচ্ছে। বার বার এপাশ-ওপাশ করতে করতে শুনতে পায়, মেঝেতে শোয়া বাবা-মা তাকে নিয়েই শলাপরামর্শ করছে। এই ছেলে কি তবে ভিক্ষে করে খাবে? অপারেশন করার টাকা কীভাবে জোগাড় করা যায়—এইসব। টিপু সুলতানের কিছুতেই ঘুম আসছিল না। তার কেবলই মনে হচ্ছিল আচ্ছা আজ রাতে সে যদি মরে যেত তো কেমন হতো? বাবামা আর ভাইবোনেরা খুব কাঁদবে তাহলে সকালে? কাল সারাদিন? তারপর আরো কিছুদিন থেকে থেকে—তারপর একদিন কেউ আর কাঁদবে না। কেবল গোরস্থানের পথ ধরে যাওয়ার সময় শিরিষ গাছে নিচে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে মায়ের চোখজোড়া ভিজতে থাকবে বহুকাল। টিপু সুলতান কিছুদিন মক্তবে পড়তে গিয়ে লম্বাটে হুজুরের কাছে শুনেছিল মৃত্যুর পর পাপীদের কী ভয়ঙ্কর শাস্তি ভোগ করতে হয়। দোজখে কেবল সাপবিচ্ছুর দংশন, পায়ে পরানো হবে আগুনের বেড়ি, খেতে হবে কাঁটাগাছ আর রক্ত-পুঁজ। সে হিসেব করে দেখে এই জীবনে তার কিছু পাপ আছে। আব্বার পকেট কিংবা মায়ের কৌটা থেকে না-বলে পয়সা সরিয়ে রেখে সে চকোলেট, আইসক্রিম, চিপস কিনে খেয়েছে। এর-ওর গাছ থেকে কিছু ফল পেড়েছে, চুরি করেছে। ভাইবোনদের সাথে ঝগড়া-মারামারি করেছে। মায়ের কথা শোনেনি ঠিকমতো। এসব পাপের জন্য আল্লাহ কি তাকে দোজখে রাখবেন? তা হোক, পুড়বে না হয় দোজখে কিছুকাল। কিছুদিন পর পাপমুক্ত হতে পারলে তো অনন্ত শান্তির দেখা মিলবে। সেখানে মানুষের খিদে আছে, খাদ্য আছে; কিন্তু মলমুত্রের মতো বিরক্তিকর ব্যাপার নেই। মানুষের রোগ নেই, নেই ডাক্তার। পচা পায়ে যন্ত্রণা নিয়ে আর বাঁচতে ভালো লাগে না। মানুষের দুটো পা-ই যদি না থাকল, ইচ্ছেমতো ছুটতে না পারল, দেখতে না পারল চারপাশ—তার জীবনের কী দাম আছে?

আমি যখন জানলাম টিপু সুলতানকে পাওয়া যাচ্ছে না তখন মনে মনে অনুসন্ধান করতে থাকি ও কীভাবে হারাতে পারে। প্রথমেই আমার মনে হয় নদীর কথা। ওরা যেখানে থাকে তার ষাট-সত্তর গজ দূরেই তো নদী। নদীটা মরা অথচ ওতেই প্রতি বছর দুএকজন লোক ডুবে মরে। ছমাস আগে জুলেখা নামের গর্ভবতী এক যুবতী নির্জন দুপুরে গোসল করতে গিয়ে তলিয়ে যায়। অথচ জুলেখা দিব্যি সাঁতার জানতো—বালিকা বয়স থেকেই এই নদীতেই চিৎসাঁতার ডুবসাঁতার দিয়ে বড় হয়েছে সে। তাই লোকে বলছিল ওসব ভূতের কাণ্ড, গেছো ভূত কিংবা মেছো ভূত ওকে নির্জনে পেয়ে পানিতে চুবিয়ে মেরেছে। একবার মনে হয় ছেলেধরার হাতে পড়লো নাকি টিপু সুলতান? নাকি রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে? তখন মনস্থির করি, বাড়িতে বসে সাত-পাঁচ না ভেবে বরং একবার সরজমিনে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসা যায়, আমার আর বিশেষ কাজ কী। তাছাড়া জবা আমাদের আপনজন বলেই জানে। শহরের শেষ প্রান্তে যেখানে গ্রাম এলাকা শুরু নদীর কাছে টিপু সুলতানদের বাড়িতে পৌঁছে যাই আধ ঘণ্টার মধ্যে। জবা উঠোনে বসে নানান কথা বলতে বলতে কাঁদছে, ওর চোখে জল শুকনোর দাগ। ওর স্বামী লোকজন নিয়ে হন্যে হয়ে রাস্তাঘাটে খোঁড়া ছেলে খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রতিবেশিরা আমাকে জানায় ওরা রাতে ঘুমিয়ে ছিল, ভোর বেলা ঘরের দরজা খোলা দেখে জবার সন্দেহ হয়, এবাড়িতে তার আগে তো কেউ জাগে না। সে তখনই খেয়াল করে টিপু সুলতান বিছানায় নেই। ঘরে নেই, উঠোনে নেই। আম বাগান, নদীর ধার, প্রাইমারি ইস্কুলের মাঠ, বটতলা বাজার কোত্থাও না।

জবা আমাকে দেখেও খানিক নির্বাক ছিল। হঠাৎ সে ফ্যাঁসফেঁসে কণ্ঠে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ‘মামা, আমার টিপুর কাইল অপারেশন হওয়ার কথা ছিল, আইজ ভোরেরতে সে ছেলে উধাও। আমি এখন কী করব কতি পারেন?’ কোন সুবাদে যেন জবা আমাকে ‘মামা’ বলে ডাকে আর ওর ছেলেমেয়েরা ‘ভাইয়া’।

‘তুমি অতো ভেঙে পড়ো না। পা কাটার কথা শুনে মনে হয় ভয় পেয়েছে। কোথাও লুকিয়ে আছে দেখো ঠিকই চলে আসবে। দুটো দিন ধৈর্য্য ধরো।’

আমি নিশ্চিত নই টিপু সুলতান আদৌ ফিরে আসবে কিনা। ও বেঁচে আছে না মরে গিয়েছে, তবু মনগড়া সান্ত্বনা দিই জবাকে।

ও আমার পা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আপনি চিষ্টা করলি পারবেন। আপনি এ এলাকার নামকরা সাংবাদিক—ডিসি এসপি সবার সাথে জানাশুনা। আমার টিপু সুলতান ছাড়া আমি বাঁচপ কীরাম করে মামা?’

২.
আমি অভিজাত হাসপাতালটির ফটক থেকে দ্রুত পদক্ষেপে বেরিয়ে একটা চকচকে ট্যাক্সি ডাক দিই। যুবক ড্রাইভার বাম দিকের গ্লাস নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার কোথায় যাবেন?’
‘দূরে, শহরের বাইরে কোথাও। যাবেন?’
‘যাব, কিন্তু সিটি করপোরেশনের বাইরে গেলে যে ডাবল ভাড়া লাগবে স্যার।’
আমি ‘দেব’ বললে ড্রাইভার দরজা মেলে ধরে, আমি গা এলিয়ে সিটে বসে পড়ি।
গাড়ি বিশ্বরোডের কাছে এলে যুবক বলে, ‘স্যার, টঙ্গির দিকে যাব?’
‘যান। আমরা টঙ্গি, চৌরাস্তা পেরিয়ে ময়মনসিংহ রোড ধরব।’

আজ শুক্রবার আর ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে বলে রাস্তায় জ্যাম বেশ কম। বসুন্ধরার নিউলাইফ হসপিটাল থেকে পঁচিশ মিনিটেই গাড়ি টঙ্গি পেরিয়ে যায়। চৌরাস্তা অতিক্রম করে আরো খানিক বাদে শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে এলে গভীর বিষণ্নতার মধ্যেও মনের উপরিতল খানিকটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। ড্রাইভারকে বলি, ‘আপনার গাড়িতে গান নেই?’
যুবক সসংকোচে বলে, ‘আপনাদের শোনার মতো গান নেই স্যার।’
‘কী বলেন? শুধু নিজের দিকে খেয়াল দিলে হবে—যাত্রীদেরও তো একটা দাবি থাকতে পারে, না?’
‘স্যার, লালনের গান শুনবেন?’
‘শুনব তো, ছাড়েন। তবে যে বললেন সে-রকম গান নেই!’
যুবক ড্রাইভার রিমোট চাপ দিলে কয়েক সেকেন্ড পরে বেজে ওঠে—
বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা/ আর এক কানা মন আমার/ এসব দেখি কানার হাটবাজার।। এক কানা কয় আর এক কানারে/ চল এবার ভব পারে।/ নিজে কানা পথ চেনে না/ পরকে ডাকে বারংবার।। পণ্ডিত কানা অহংকারে/ সাধু কানা অনবিচারে/ মোড়ল কানা চোগলখোরে/ আন্দাজে এক খুঁটি গেড়ে/ জানে না সীমানা কার।

গানটা শুনতে শুনতে আমার মনের উপরিতল আবার বিষণ্ন হয়ে ওঠে। সে-বিষণ্নতা চেতনার গভীরতল, মগজ ও রক্তকণিকায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন আমার মনে হয়—সত্যিই কি পৃথিবী কানার হাটবাজার, আসলে কেউ কিছু জানে না? বস্তুত ওয়েটিং ফর গডো? তাহলে এখন এই ঘূর্ণিঝড়ের পরিস্থিতিতে অগ্রপশ্চাৎ না-ভেবে আমার কী করা উচিৎ? আমি এই গাড়িটাকে আরও ত্রিশ-চল্লিশ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি পথ উত্তর বরাবর নিয়ে যাব। তারপর ড্রাইভারকে পাওনা বুঝে দিয়ে নাম না জানা গ্রামের নির্জনতায় নদীর তীরে নেমে পড়ব। নদীর তীরে কার যেন একটা ডিঙি নৌকা বাঁধা। নৌকার পানি সেচে আমি তাতে উঠে বৈঠা দিয়ে কূলে ধাক্কা দিয়ে ঘোলা জল কেটে নৌকা ছাড়ব। আমি যদিও বলেছি অগ্রপশ্চাৎ ভাবনা বাদ দিয়ে—বস্তুত আমি চেতনে-অবচেতনে দ্রুত অনেককিছু ভেবে তবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি।

কদিন পরপর সামান্য জ্বর আসছিল। প্যারাসিটামল খাই, কিছু দিন ভালো থাকি, আবার জ্বর। পরে আমার ডাক্তার একটি বড় প্রাইভেট হাসপাতালে প্রফেসরের কাছে রেফার করেন। ঢাকাতে অনেক আত্মীয়-স্বজন থাকলেও এই বয়সে কারো বাড়িতে গিয়ে উঠতে মন চায় না। আমি এয়ারপোর্টের কাছে একটা হোটেলে গিয়ে উঠি। দুটো দিন রক্ত, এক্স রে, বোন ম্যারো ইত্যাদি নানার রকম টেস্টের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হলো। ডাক্তার আমাকে স্পষ্ট করে না বললেও আমি বুঝতে পারি তিনি আমাকে যে ধরনের ইনভেস্টিগেশন দিচ্ছেন তাতে তার ধারণা আমি লিম্ফোমার প্যাশেন্ট। আজকে দুপুর আড়াইটাই ব্লাড টেস্ট হাতে পেয়ে আমি নিশ্চিত হই ডাক্তারের আশঙ্কাই সত্যি। ইন্টারনেট ঘেটে বুঝে নিই এটা তৃতীয় স্টেজ। এই পর্যায়ের রোগীর ভালো চিকিৎসা এদেশে নেই। দেশের বাইরে মানে সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক গেলে আমার জমানো টাকা মাসখানেকও টিকবে না। এবছর একমাত্র ছেলেটা আইএসসি পাশ করল। ওর যা রেজাল্ট, আমরা জানি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের যোগ্যতায় চান্স পাবে না। ওর মা তিল তিল করে এতো বছর ধরে ছেলেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবে বলে কুড়ি লাখের মতো টাকা জমিয়েছে। আমার এই অসুখের কথা শুনলে সুহিতা উদ্বিগ্ন হয়ে সব টাকা আমার হাতে তুলে দেবে। প্রেসের ব্যবসায় দীর্ঘদিন লস খেয়ে জেলা শহরে চার কাঠার ওপর পৈতৃক বাড়িটা ছাড়া আর কোনো সম্পত্তি আপাতত আমার নেই। আমার নিজের সম্পাদিত একটি সুপরিচিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল সেটা বন্ধ হয়েছে বছরখানেক। এই বয়সে বাড়িটা বিক্রি করার মতো অবিমৃশ্যকারিতা আমি দেখাতে চাই না। তাছাড়া বাড়ি বেচলেও আমার সুস্থ হবার সম্ভাবনা তেমন নেই, মিথ্যে আশা বুকে নিয়ে অচল গাড়ির পেছনে পয়সা ঢালার মতো স্বার্থপর আমি নই। জ্বর, ওজন কমা, অরুচি, বমিভাব, মাথার ভেতরে চক্কর, বিমর্ষতা—সব লক্ষণই আমি বহন করছি বেশ আগে থেকেই। ফলে রিপোর্ট হাতে পেয়ে আমি অটল সিদ্ধান্ত নিই আমার হেমাটোলোজিস্ট সুরিয়া কান্তি সিনহার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ নয়, এবার বরং নিরুদ্দেশ হই। আজ হোক কাল হোক, সবাইকে তো ত্যাগ করতেই হবে। তখন কেন যেন মাসখানেক আগে হারিয়ে যাওয়া টিপু সুলতানের কোমল মুখটি আমার মনে ভেসে ওঠে।

দুপাশে শাল আর গজারি গাছের সারির ভেতর দিয়ে কালো রঙের এলিয়ন গাড়িটি আশি কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে। আরো মিনিট চল্লিশেক পরে গাড়িটাকে রাস্তার ডান দিকে কোথাও রাখতে বলব। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বড় রাস্তা থেকে নেমে খানিক মেঠো পথ ধরে সন্তর্পণে হেঁটে একটা ছোট নদীর দেখা পাব। নদীর দুপাশে সবুজ ধানক্ষেত। আমি কিছুক্ষণ আনমনে দাঁড়িয়ে থাকব, দেখব শরতের বাতাসে কীভাবে তীক্ষ্ণ সবুজ পাতারা দোল খায়। সেখানে কীভাবে চলে আলোছায়ার খেলা। আশ্চর্য, এই বিকেল বেলা নদীর তীর ও বিস্তৃীর্ণ মাঠ জুড়ে কোনো জনমানুষের টিকি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তবে দৃষ্টিসীমার ভেতর অজস্র পাখি কলকাকলি করে বেড়াচ্ছে। নদীর জলে দেখছি কতক মাছ—চাঁদা, ডানকিনা, তিতপুঁটির ঝাঁক। এমন সময় আমার চোখে পড়বে নদীর কূলে একটা নৌকা বাঁধা। আনাড়ী হাতেও নৌকা বেয়ে ছোট নদীটি পেরুতে দশ মিনিটের বেশি লাগবে না। নদী পেরুতে বৈঠা মেরে আমি ঘেমে উঠব। শার্টের দুটো বোতাম খুলে দিয়ে বাবলা গাছটার তলায় বসে খানিক বাতাস গায়ে মাখব। সে-সময় হঠাৎ ধানখেতের পাশে একটা ঘাসের জমিনে প্রথম একজন মানুষের দেখা পাব। উচ্ছল ছেলেটা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘ভাইয়া, আপনি এখানে?’
আমি অবাক হয়ে বলব, ‘আরে টিপু সুলতান তুই। ওদিকে তোর জন্য কেঁদে কেঁদে তোর মার তো চোখ অন্ধ হতে চলেছে।’ কথা বলতে বলতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে যাব। চেহারার সেই একই আদল। অথচ মুখ জুড়ে কী এক আশ্চর্য আলো ঠিকরে পড়ছে, আলোটা প্রগাঢ় জ্যোৎস্নার মতো।

‘আমি জানি, কিন্তু আমার যে ফেরার উপায় নেই।’ ওর চেহারায় বিষণ্নতা ছায়াপাত করে।

আমি পকেট থেকে চিনে বাদাম আর চিপস বের করব। দুজন মুখোমুখি বসে খুব ধীরে ধীরে খাবো। এক সময় সব অতীত ভুলে ঘাসে মাথা রেখে নীল আলোর আকাশ দেখতে দেখতে, পাখির কিচিরমিচির শুনতে শুনতে আমি আর টিপু সুলতান ঘুমিয়ে পড়ব। টিপু সুলতান এক সময় ঘুম থেকে জেগে উঠবে। জেগে মলিন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখবে একটা কমলা রঙের কাটা ঘুড়ি উঁচু আকাশ থেকে মাটির দিকে পতিত হচ্ছে। ঘুড়ির নেশায় সে লাফ দিয়ে ওটার পিছু নিয়ে দে ছুট। তখনও আমি গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। পাখিদের কলকাকলি তীব্র হয়ে এক সময় আবার চারদিক শুনশান। দিন পেরিয়ে রাত হবে, ঝিঁঝিঁ ডাকবে, শুরু হবে শেয়ালের চিৎকার, বিপণ্ন কণ্ঠে ডাকবে রাতজাগা অচেনা পাখি, তখনও আমার চেতনা ফিরবে না। আমার বুকের উপর দিয়ে অন্ধকারে হেঁটে যাবে কাঁকড়া আর শামুকের ঝাঁক। শেষ রাতে মেঘ গর্জে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে, চারদিকে বৃষ্টির ঝুমঝুম বাতাসের শো শো আওয়াজ। একদিন দুদিন পাঁচ দিন যাবে, বৃষ্টি থামার নাম থাকবে না। সপ্তম দিবসে যখন ক্রন্দনরত আকাশ শান্ত হবে, পৃথিবী ধাতস্থ হবে, ততদিনে প্রায় সমগ্র দেশ প্লাবিত বানের বাঁকা জলে। আমার তন্দ্রাচ্ছন্ন দেহ ডুবে আছে বালু আর জলরাশির ভেতর। প্লাবনজল নেমে গেলে আমি পলির নিচে রোদে-বৃষ্টিতে কুয়াশায়, উত্তাপে-শীতলতায় ক্রমে পঞ্চভূতে বিলীন হতে থাকি। বছর পেরিয়ে আবারো আসবে এমন উজ্জ্বল শরৎ, বাতাসের সাথে খেলবে আজকের মতো সাদা মেঘের দল। তখন আমার পাঁজর ফুড়ে বেরোনো ঘাসগুলো কাশের গাছ হয়ে উঠবে, কতকদিন না যেতেই ওদের যৌবন আসবে। আমার বুকের জমিনে ফোটা কাশফুল গুলো দুলতে থাকবে এমনি মোহময় বাতাসে। সেই অনাগত বিকেলে কম্পমান কাশফুলের ফাঁকে কান পাতলে কেউ হয়তো শুনতে পাবে দূরের কান্নার মতো কোনো অস্ফুট ধ্বনি। হয়তো মানুষের কান্নাই—অনাদিকালের বহু মানুষের!

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;