কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৭)



জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

অই তো যায়, টু আ পেনি

(পূর্ব প্রকাশের পর) আমি যেসব বাড়তি জিনিস কেনাকাটা করেছিলাম সেগুলো বাঁধাছাঁদা করার জন্য বাক্স, দড়ি ইত্যাদি খুঁজে পেতে কী ঝক্কিটাই না পোহাতে হয়েছিল সেই বিকালে আমাদের। আমরা জানতাম না খাবারদাবারের কী অবস্থা হবে, তাই আমরা টিনের মার্জারিন, মাংস ও অন্যান্য জিনিসপত্র কিনে বোঝাই করে ফেলেছিলাম। পিআইএ এবং অতিথিনিবাসের আন্তরিক কর্মচারীদের সহযোগিতায় আমাদেরকে এবং আমাদের অতিরিক্ত ওজনের বাক্সপ্যাটরাদের তারা বিমানবন্দরের পথে রওনা করিয়ে দেয় সময়মতোই, হয়তো একটু আগেভাগেই। বাচ্চারা যথেষ্ট সময় পেয়েছিল ব্যাংকক বিমানবন্দরের বিশাল অপেক্ষাগৃহে হারিয়ে যাওয়ার। একটা বেড়ার ওপর থেকে তিন বছরের এক বাচ্চাকে উদ্ধার করে আনতে গিয়ে আমি শুনতে পাই একজন আমেরিকান ভদ্রলোক তাকে জিজ্ঞেস করছেন সে কোথায় যাচ্ছে। এতগুলো সপ্তাহের ভ্রমণে ছোট্ট এমি একটু বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল।
সে হাসিমুখে উত্তর দিল: “আমি ব্যাংকক যাচ্ছি।”

“না, তুমি ব্যাংককেই আছো। তুমি এখান থেকে কোথায় যাচ্ছো?”

তারপর তিনি পরবর্তী ক্ষুদে স্বর্ণকেশীর দিকে ফিরে একই প্রশ্ন করলেন, যার এর উত্তর জানা ছিল।

“আমরা ঢাকা যাচ্ছি, তারপর সেখান থেকে চিটাগাং।” সে তাকে বলে।

“আপনি কি এদের সঙ্গে সম্পর্কিত?” আমি কাছে গেলে তিনি আমাকে শুধান।

“আমরা সবাই এক সঙ্গেই ভ্রমণ করছি।” আমি ব্যাখ্যা করে বলি।

“ওহ।” তিনি বলেন। “আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভালো লাগল, আমি পাকিস্তানে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত।”

যে-ক্ষমতাই আমাকে এই কথাটি, “হ্যাঁ এবং আমি মিসেস সান্তা ক্লস” (অথবা এরকম মজাদার কিছু একটা) বলা থেকে বিরত রাখে, তাকে আমি ধন্যবাদ দিই, কেননা এই সাদামাটা, মধ্যবিত্ত চেহারার মানুষটি আমার কল্পনার রাষ্ট্রদূতের ধারে কাছেও ছিলেন না। তারপর তিনি দ্রুত কাজে নেমে গেলেন একজন ভালো রাজনীতিবিদের মতো—সবার সঙ্গে হাত মেলান, বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, দ্বিগুণ সংখ্যক নারীদের সঙ্গে ভ্রমণের সৌভাগ্যের জন্য পুরুষদের সঙ্গে ঠাট্টা করেন। তিনি অবশ্য একটা উদ্বেগজনক মন্তব্য করেই আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেন।

“আমি অবাক হচ্ছি যে আপনারা ফেরত যাচ্ছেন। সবাই তো দেখি বেরিয়ে আসার জন্যই অস্থির।”

এবং আমরা সেই দেশে যাওয়ার বিমানেই উঠি যেখান থেকে সবাই বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমাদের সব মালপত্রই বৈধ এবং আমাদের ঢাকায় নামার অনুমতি আছে, এটা শুল্ক কর্মকর্তাদের বোঝাতে বোঝাতে মধ্যরাত হয়ে যায়। বিমানবন্দরের কর্মীদের ধারণা ছিল, কারুরই বুঝি তখন ঢাকা বিমানবন্দরে নামার অনুমতি নেই।

আমরা চমৎকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে উঠি। কিন্তু এতটাই ক্লান্ত যে, তার গরমজলের সৌরভটুকু উপভোগ করতে পারি না। পরেরদিন একটু জরিপ করতে গিয়ে বুঝতে পারি, হোটেলটাকে একটা কবরস্থানের মতো দেখাচ্ছে, যা কিনা সম্প্রতি নানাবিধ কর্মকাণ্ডের একটি জমজমাট কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। দিনের শেষে ঢাকার অপর মিশনারিরা আমাদেরকে নিয়ে যেতে এলে আমরা চাপমুক্ত বোধ করি, এবং চারটা ভিন্ন ভিন্ন বাড়িতে বসে চাটগাঁ যাবার টিকিট ও অনুমতির অপেক্ষা করতে থাকি।

ডা: ওল্‌সেন একটা চিঠি লিখেছিলেন এবং আমাদের সম্ভাব্য ঢাকা আগমনের আগেই সেটা সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ‘প্রিয় বাহিনী’ সম্বোধন করা চিঠিটি অনেক শূন্যস্থান পূরণ ও আমাদের মনে খেলা করে যাওয়া অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল।

১০ই মে ১৯৭১

প্রিয় বাহিনী,

রিড, ডন ও ভিকের তরফ থেকে শুভেচ্ছা। আমরা ভালো আছি, তোমাদের সবার অভাব বোধ করি খুব, তোমাদের কথা ভাবি ও প্রার্থনা করি সবসময়। তোমাদেরকে ছাড়া এখানে ঠিক মন বসছে না আমাদের। আমি চিঠি লিখছি চিটাগাং থেকে। এই প্রথমবার আমি এখানে এতদিন ধরে আছি। রিড তার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে দিয়েছে এবং গুর্‌গানসের বাড়িতে চলে গেছে, যেটা সে অর্ধেক টাকায় ভাড়া নিতে পেরেছে। এটা গুর্‌গানসের নিজের ও তাঁর পরিচিত বিভিন্ন ব্যক্তির রেখে যাওয়া জিনিসপত্রে ঠাসা। আমি রিডের সঙ্গে এই কয়েক ঘণ্টার বন্ধুতা কী উপভোগই না করেছি। সে শহরের চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে সবাইকে উৎসাহ ও উপদেশ দিয়ে এবং একসাথে প্রার্থনা করে কী দারুণ কাজই না করছে। সে বাস্তব উপায়েও নানাভাবে নানান লোককে সাহায্য করে উঠতে পেরেছে।

২১শে এপ্রিল তোমাদের আচমকা বিদায়ের পরপরই আমি আমাদের দেশি সদস্যদের ডাকি। সভার শুরুতে ম্যাথুর ২৮ নম্বর শ্লোকের শেষদিকের সেই অসাধারণ অংশগুলোর উচ্চারণ আমাদের জন্য অনেক অর্থবহ ছিল। আমরা অবস্থার পর্যালোচনা করি এবং কয়েকটি সাময়িক সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখি। সভার সবচেয়ে উৎকণ্ঠাময় মুহূর্তে একটি আকস্মিক কানফাটানো বিস্ফোরণের শব্দ সবাইকে জানালা, দরজা কিংবা খাটের তলার দিকে ধাবিত করে, যদিও সেটা স্রেফ একটা বজ্রপাতের শব্দ ছিল। আমি রোগী দেখে, কর্মচারীদের বুদ্ধি-পরামর্শ এবং রাতের পাহারার সময় বাড়িয়ে দিয়ে দিনটা কাটাই। দিনের অপরভাগে আরো কিছু ঘটনার কারণে রাত সাড়ে নয়টার দিকে একটা সভা ডাকা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছিল বটে। একটা ভয় ছিল যে, হাসপাতালের ধারে কাছেই বেশ বড়সড় যুদ্ধ হতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, হাসপাতালের কর্মচারীদের হেব্রন ও অন্যান্য গ্রামে সরিয়ে নেওয়া হবে।

এপ্রিলের ২২ তারিখ আমরা আগের রাতের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। আমার দুর্ঘটনাটি ঘটে সকাল বেলায়। আমি বেশ জোরেই আমার মোটরসাইকেলটা চালাচ্ছিলাম, গাড়ির মূল কাঠামোটায় হঠাৎ একটা ফাটল দেখা দেয় এবং তা মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যায়। এর পতনের সঙ্গে সঙ্গে আমিও রাস্তায় ছিটকে পড়ি এবং আমার ডান হাতের কনুই ভেঙে যায়। আমি কোনোমতে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছাই, এক্সরে করাই এবং সেটা নিরীক্ষণ করে দেখি যে, হাড়টা বেশ জটিলভাবেই ভেঙেছে, যেটা সারাতে অপারেশন ও কিছু যন্ত্রপাতি লাগানোর প্রয়োজন হবে। ডনের ও আমার দিনের বেলায় অনেক কাজ ছিল, তাই আমরা অপারেশনের সময় নির্ধারণ করি রাত ৮টা। ডন অপারেশনে দারুণ কাজ করেছিল। (আমি আনন্দিত যে, তোমরা তার থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছিলে।) পরের দিনও ছিল খুব ব্যস্ততায় ভরা। আমি ডেমেরলের প্রভাবে ঘুমিয়ে থাকি, তবে মধ্যসকালে আমার মাথা পরিষ্কার হয়ে ওঠে এবং আমি একটু নাড়াচাড়া করতে পারি, পরে তাদের কাজে খানিকটা সাহায্যও করতে পারি। কর্মচারী ও শরণার্থীদের হাসপাতাল প্রাঙ্গণ থেকে সরানোর কাজে ডন প্রায় একজন সেনা অধিনায়কের ভূমিকা পালন করে।

পরের সপ্তাহগুলোতে আমরা কম রোগী দেখেছিলাম, কম অ্যাডভেঞ্চার করেছিলাম এবং তোমাদের মিস করেছিলাম খুব। সব রোগী ছেড়ে দেওয়ার জন্য হাসপাতালটাকে তখন সমাধির মতো মনে হচ্ছিল। আমেরিকান ও পাকিস্তানি কর্মীদের বিদায়ের পর আমরা সশস্ত্র ডাকাতির ভয় পাচ্ছিলাম। আমরা রাতপ্রহরীদের সংখ্যা বাড়িয়ে দিই এবং তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে তুলি। ঈশ্বরের কৃপায় যে-রাত থেকে অই আক্রমণের আশঙ্কা করছিলাম আমরা, ঠিক সে-রাতেই সারারাত বিদ্যুৎ ছিল এবং সেটা পরেও অব্যাহত থাকে।

সম্প্রতি আমরা একটা চোরও ধরি। কর্মচারীরা বিদায় নিয়ে চলে গেলে আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া দরকার হয়ে পড়ে। সে-রাতে আমরা তাদেরকে আমাদের সঙ্গে কেচামের বাড়িতে নিয়ে আসি এবং মিলিটারিদের হাতে তাদেরকে নিরাপদে হস্তান্তর করা পর্যন্ত তারা আমাদের সঙ্গে সেখানেই ছিল। তাদের সেই কৃতজ্ঞতাবোধটুকু দেখার মতো ছিল। আমি যদিও অবিবাহিত জীবনের পক্ষে সাফাই গাইছি না, তবে আমি এই সময়টা ডনের সঙ্গ খুব উপভোগ করেছিলাম। সে একজন নিবন্ধক, ডাক্তার, সেবক, কোষাধ্যক্ষ, হিসাবরক্ষক, অষুধবিদ হিসাবে দারুণ কাজ করেছিল। সে আধ্যাত্মিক সাহায্য, উপদেশ ও শুশ্রূষা প্রদানের কোনো সুযোগ কখনো হাতছাড়া করেনি।

ডন একদিন দুটো ছাড়া-কুকুরকে গুলি করে এক রকম কেলেঙ্কারির জন্ম দেয়। গুলির শব্দে পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজন সব পালিয়ে যায়। তারা ভেবেছিল যুদ্ধ তাদের গ্রামে এসে হাজির হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচজনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল। মে মাসের ৫ তারিখ পাকিস্তানি মিলিটারি হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়। পথে তারা কোনো বাধার সম্মুখেই পড়েনি। তারা এসে গাড়ি থামায় এবং একজন মেজর ও কর্নেল আমাদের সঙ্গে ত্রিশ মিনিটের মতো কথা বলে। সেই সভার সিদ্ধান্তসমূহ ছিল নিম্নরূপ:

• তারা হাসপাতাল দেখে খুশি এবং তারা চায় এটা খোলা এবং চালু থাকুক।

• তারা নিশ্চয়তা দেয় যে, ধর্ম নির্বিশেষে সকল কর্মচারীরই নিরাপত্তার বিধান করবে তারা।

• তারা আমাদের পরামর্শ দেয়, দেশি কর্মীদের ডেকে এনে কাজে লাগিয়ে দিতে।

মে মাসের ৫ তারিখের সেই সভার পরপরই হেব্রন থেকে এক দূত এসে চিঠি দেয় আমাদের, যাতে লেখা ছিল, সেই রাতেই সেখানে সশস্ত্র ডাকাতির শঙ্কা করা হচ্ছে। প্রভুর সাহায্যে সেখানে পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছিল সে-রাতে এবং পরেরদিন সতেরোটি নৌকা দিয়ে তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। একইভাবে আমরা জানতে পারি, আমাদের অপর কর্মচারীরা যারা জঙ্গলের অন্যত্র লুকিয়ে ছিল তারাও ডাকাতির ভয়ে ছিল। আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকেও চলে আসার জন্য বার্তা পাঠিয়ে দিই। প্রভুর সময়বোধ কী চমৎকার! আমাদের লোকদের জন্য অসহনীয় ঝুঁকি ও বিপদের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ামাত্রই মিলিটারির এসে হাজির হওয়া, দারুণ সব আশ্বাস এবং তাদেরকে ফিরিয়ে আনার অনুমতি দেওয়া আমাদের! হেব্রন থেকে আনা সতেরোটি নৌকায় লোক ছিল মোট ১২০ জন, সঙ্গে বেশ কিছু ছাগল, অগুনতি মুরগি আর পর্বতপ্রমাণ বোঁচকাপত্র। মে মাসের ৬ তারিখে ফিরে আসা এই শরণার্থীদের দলটি ছিল একটি অবসন্ন, কিন্তু উল্লসিত বাহিনী।

আমরা তোমাদের ফিরে আসার একটা পরিকল্পনা করেছি। এটা করা খুব সহজ ছিল না, যেহেতু আমরা তোমাদের ভিসার অবস্থা জানি না, এমনকি তোমরা কে কোথায় আছো সেটাও না। মে মাসের ৮ তারিখ আমি কনসাল জেনারেলের সঙ্গে ফোনে কথা বলি। আমি তোমাদের ফিরে আসার যে-সময়সীমা তাঁর কাছে উত্থাপন করি তিনি তা অনুমোদন করেন। তাঁর মন্তব্য অনুযায়ী, তাঁর প্রতিনিধিরা তোমাদের ব্যবহারে খুব মুগ্ধ ছিল। আমি তোমাদের প্রত্যেকের হয়ে একটু করে লজ্জা পাই, তাঁকে তাঁর সদয় বার্তার জন্য ধন্যবাদ দিই এবং বলি, আসলে গাড়িভরা এক চমৎকার মার্কিন প্রতিনিধিদলকে তিনি পাঠিয়েছিলেন আমাদের এখানে। এই পারস্পরিক তোষামোদ পর্বটি যখন বেশ ছেলেমানুষির পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল, তখন আমরা কাজে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবি। তিনি তোমাদেরকে একটা বার্তা পাঠানোর কথা বলেন এবং আমি নিশ্চিত, তোমরা ইতোমধ্যে তোমাদের প্রত্যাবর্তনের একটা সময়সূচি পেয়ে গেছো।

আরও শ’খানেক প্রসঙ্গের বর্নণা দিতে পারতাম আমি, কিন্তু এই চিঠিকে তো এক জায়গায় থামতে হবে। আমরা তিনজন ঈশ্বরের কৃপা ও করুণার সাক্ষ্য দিই। প্রভু কিভাবে আমাদেরকে কঠিন পরিস্থিতিতে শক্তি যুগিয়েছিলেন এবং কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার প্রজ্ঞাও। আজকে একটি সুদূরপ্রসারী অভিঘাতসম্পন্ন জটিল সমস্যা তাৎক্ষণিক সমাধান দাবি করেছিল। আমাদের হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা ও আমি একটি গাড়িতে উঠি, ইঞ্জিন যখন চালু হবার জন্য সময় নিচ্ছিল তখন আমরা একসঙ্গে প্রার্থনা করি, তারপর আমরা রওনা হই। এবং ঈশ্বর আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশার বাইরেও আমাদের হয়ে কাজ করেছিলেন। আমাদের সেই অফিসার বলেন, “ঈশ্বর আমাদের জন্য কী চমৎকার কাজই না করেছেন। আমরা তাঁর দারুণ সহায়তার জন্য, আবার যেন প্রার্থনা করতে এবং তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলে না যাই।” আমরা তোমাদের সেই ভোটের জন্য কৃতজ্ঞ, যা আমাদেরকে ঈশ্বরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এমন এক অভূতপূর্ব সময়ে এখানে থাকার সুযোগ করে দিয়েছিল।

ঈশ্বর তোমাদের প্রত্যেকের মঙ্গল করুন।

যিশুর ভালোবাসায়,

ভিক

জুনের ৩ তারিখের সকালের মধ্যে সবকিছু গোছানো হয়ে যায় এবং আমরা দিনের শেষ বিমানে উঠি, চট্টগ্রামগামী সেই চল্লিশ মিনিটের উড়ানে। আমরা ফোন করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু লাইন কাটা ছিল। আমরা একটা বার্তা পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু সেই টেলিগ্রাম কখনো পৌঁছায়নি। পরিণতিতে, বিমানবন্দরে কেউ আসেনি আমাদের নিতে। ভাগ্যক্রমে পিআইএ তাদের বাস ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল আমাদের, এবং তার ড্রাইভার আমাদেরকে মিশন গেস্টহাউস পর্যন্ত নিয়ে যায়। বাইরের দরজায় শেকল ও তালা লাগানো ছিল, ফলে সে আমাদেরকে একেবারে অফিস পর্যন্ত নিয়ে যায়। দারোয়ান জানায় যে, যার কাছে সবকিছুর চাবি থাকে সেই রিড মিনিখ সকালে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন—বাজে এক রাস্তার পঁয়ষট্টি মাইল দূরত্বে অবস্থিত যা। বাস ড্রাইভার ত্রাণকারীর ভূমিকা পালন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, তাই ঘোষণা দিল, সে আমাদেরকে শহরে পিআইএর অফিসে নিয়ে যাবে এবং সেখানেই আমাদেরকে নেমে যেতে হবে। সেটা ঠিক ছিল। সেই অফিস আমাদের বাসা থেকে দুয়েক মিনিটের পথ মাত্র। একটা তিনচাকার বেবিট্যাক্সিতে চেপে আমরা আমাদের বাসায় যাই। বাঙালিদের মাঝখানে ফিরতে পেরে আমি এতটা উত্তেজিত ছিলাম যে, বারান্দায় এক বৃদ্ধাকে দেখে আমি তাকে আলিঙ্গন করি। পরে আমি ভাবতে থাকি, সে কে ছিল এবং কী করছিল সেখানে।

ততক্ষণে দুপুর হয়ে গেছে এবং আমরা সবাই ক্ষুধার্ত। রিডের কাছে আমাদের বাড়ির চাবিখানাও ছিল, কিন্তু আমার পার্সের ভেতরে একটা বাড়তি চাবি লুকানো ছিল রান্নাঘরের, যেখানে আমরা টিনভর্তি খাবারদাবারগুলো রাখি। কোনার দোকানে রুটি পাওয়া যেত। টিনের মাংসের স্যান্ডউইচ, স্যুপের প্যাকেট, গরম কোক, তা-ও সেই কোনার দোকান থেকেই আনা, দিয়ে সবার মোটামুটি খাওয়া হয়ে যায়। পুরুষেরা একটা বাস ধরে আনে, যেটাতে করে হাসপাতালের কর্মচারীরা মালুমঘাটে চলে যেতে পারবে। দুপুর দুটা নাগাদ ‘বাহিনীটা’ ভেঙে যায় চিরস্থায়ীভাবে।

লিন আর আমি বসার ঘরের মেঝেতে বসে, আমরা-যে ফিরে এসেছি সে-বিষয়ে ধাতস্থ হবার চেষ্টা করি। নিজেদের ঘরে যাবার চাবি ছিল না আমাদের কাছে, তবে আমরা বাড়িতে একা ছিলাম না। জব্বারের বউ ও দুই ছেলে আমাদের কয়েকদিন আগে ফিরেছিল। তারা আমাদের সঙ্গে হাসপাতালে গিয়েছিল আমরা যখন শহর ছাড়ি, এবং সেখান থেকে নৌকা করে হেব্রনের সেই জঙ্গল-কেন্দ্রে পালিয়েছিল, এবং আবারও হাসপাতালে ফিরে এসেছিল যখন ডাকাতির বিপদ দেখা দেয়। এখন তারা আমাদের বাড়িতে ফিরেছে ফের। বৃদ্ধাটি তাদেরই কোনো পরিচিত, যে-এখানে থাকছিল, গ্রাম থেকে বাবা-মায়ের খবর নিয়ে জব্বারের ফিরে না আসা পর্যন্ত।

বাঙালিরা। আমাদের লোক। আমরা বাড়ি ফিরে এসেছি।

কিন্তু তখনও এটি ‘জয় বাংলা’র দেশ হয়ে ওঠেনি। [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৬)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৫)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৪)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৩)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১২)

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;