দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান



মহীবুল আজিজ
গ্রাফিক্স: বার্তা২৪.কম

গ্রাফিক্স: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

লুইগি ডাক্তার বলেই যখন সুবর্ণদ্বীপে চিকিৎসা না পেয়ে একজন রোগি মারা পড়ে, তার হতাশা সীমা ছাড়িয়ে যায়। তা-ও আবার সন্তানসম্ভবা মেয়ে। দ্বীপে এমনিতে কোন ডাক্তার কখনও ছিল না কিন্তু রোগশোকের প্রতিষেধে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। লোকেরা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদের মত করে কাজ চালাবার মত করে এক ধরনের চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োগ শিখে নিয়েছিল। অথবা কয়েকজন লোক এই পেশার জায়গাটা পুরোপুরি ফাঁকা দেখে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে চিকিৎসার তৎপরতা শুরু করে দিয়েছিল। কেউ তাদের কাছে জানতে চায় নি, আপনি কোত্থেকে পাশ করেছেন বা আপনার ডিগ্রিটা কোন্ পর্যায়ের? তারা এই কাজ আরম্ভ করবার আগে পান দোকানদার আবদুল গনি হাওলাদারের কাছ থেকে ঔষধ কিনতো। গনির দোকানে বিক্রি হতো পান, সিগ্রেট, কলা, বিস্কিট, চা এবং চার ধরনের প্রয়োজনীয় ঔষধ- প্যারাসিটামল, হিস্টাচিন, এ্যান্টাসিড এবং মেট্রোনিডাজল। গনি নিজে বলে সে অষ্টম শ্রেণি পাশ কিন্তু সেটাও সন্দেহাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এক রোগিকে পেটের গ্যাসের সমস্যায় সে দিয়ে দেয় হিস্টাচিন। ফলে, সে খালি ঘুমায় কিন্তু ঘুমায় পেটের ব্যাথা নিয়ে। শেষে তার প্রায় মরনদশা। বলে, গনি আমারে কী অষুধ দিল চোহে খালি ঘুম আহে। দু’টো ট্যাবলেটের প্রায় একই রকম প্যাকেট হওয়ায় ভুল গনিরই হয়। কিছুকাল পরে দ্বীপে একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা ডাক্তারের আবির্ভাব ঘটে। পুরুষ ডাক্তার পেটের ব্যাথায় এক আশ্চর্য নিরাময়-পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটাতে শুরু করলে তা নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য জেগে ওঠে। ব্যাথার জায়গাটাতে পায়ের গোড়ালি দিয়ে অনেকটা সময় ধরে চেপে ধরে রাখলে ব্যাথা বিদায়। লোকদের অনেকেই বলল, ব্যাথা যাচ্ছে, আবার অনেকেই বলে, ব্যাথা বাড়ছে। এই কমা আর বাড়া নিয়েই তার দিনকাল একরকম কেটে যেতে থাকে। মহিলা ডাক্তার মেয়েদের চিকিৎসায় কী পদ্ধতির আশ্রয় নেয় সেটা জানা দুঃসাধ্য যেহেতু অন্তঃপুরে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণাধীন। তবু যে-জনশ্রুতি অন্তঃপুর থেকে কালক্রমে এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে পড়ে তা থেকে জানা যায়, একধরনের মন্ত্রপূত পানিই মহিলা চিকিৎসকের সর্বরোগহর অবলম্বন। সেক্ষেত্রেও একই কথা প্রয়োজ্য- রোগ ভাল হয় এবং হয় না। এই হওয়া না-হওয়া নিয়ে তারও দিন একরকমভাবে কেটে যায়। 

কিন্তু কারও পক্ষেই আবুল খায়েরের স্ত্রী ফুলবানুকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। গোলাম কবিরের কাছে লক্ষণ জেনে লুইগির ধারণা হয়, ফুলবানু সম্ভবত এ্যাকলেমসিয়া বা প্রি-এ্যাকলেমসিয়ায় মারা গেছে। লুইগির হতাশা এ-কারণেই, ডাক দিলে শোনা যেত এমন দূরত্বে থেকেও সে বাঁচাতে পারে নি একজন মানুষকে। অথচ এটি কোন দুরূহ বা দুশ্চিকিৎস্য রোগ মোটেও ছিল না। সে বাঁচাতে পারে নি মানে তার পক্ষে প্রচেষ্টা নেওয়াই সম্ভব হয় না। মরে গেলেও তারা কখনও একজন পুরুষ ডাক্তারের কাছে মেয়েদের নিয়ে যাবে না। তার সংকট দেখে তার এক প্রতিবেশী খবর দেয় গোলাম কবিরকে। কবির বলল, নিরাময়ে চলো, বিদেশি ডাক্তার দেইখা দিবো নে। একে পুরুষ, তার ওপর বিদেশি, প্রাণ গেলেও তারা আসবে না নিরাময়-কেন্দ্রে। প্রাণই গেল ফুলবানুর। দ্বীপে একজন মহিলা ডাক্তারের অভাব প্রবলভাবে অনুভব করে লুইগি। বিস্তারিত জানিয়ে সে তার সদর দফতরে বার্তা পাঠায়। প্রত্যুত্তরে তারা জানায়, এত-এত মানুষ একটা দেশে, হয়তো পৃথিবীর সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ একটা দেশ অথচ একজন মহিলা ডাক্তার পাওয়া কেন যায় না! একজন স্বদেশি মহিলা ডাক্তারকে সেখানে নিয়োগ দেওয়াটাই সবচেয়ে শ্রেয়। লুইগি তখন চেষ্টা-তদবির চালাতে থাকে একজন মহিলা ডাক্তারের খোঁজে। পরিচিত যারা শহরাঞ্চলে থাকে তাদের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়েও একজন মহিলা ডাক্তার মেলে না। নিমরাজি একজনকে পাওয়া যায় যিনি তাঁর জেলা-সদর ছেড়ে হলেও ছোট্ট থানাটিতে আসতে আগ্রহী কিন্তু তাঁর ব্যাংকার স্বামীর উপযুক্ত চাকরি দ্বীপটিতে না-থাকায় তিনি নিরুপায়। যদি দ্বীপে সেই ব্যাংকের একটি শাখা খোলা যায় এবং সেখানে তাঁর স্বামীকে সেটির ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যায় তাহলে তিনি দেশসেবার ব্রতে আত্মনিয়োগের চিন্তা করতে সম্মত আছেন। সাহসিকা একজনকে পাওয়া যায়- কিন্তু সেক্ষেত্রেও সমস্যা থাকে। মেয়েটি বছরখানেক আগেই তার ডিগ্রিটি অর্জন করেছে। এখন তার বিবাহের প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তাকে প্রায়ই শহরে ছুটতে হবে, কেননা, সম্ভাব্য পাত্রপক্ষ কখনই এরকম দ্বীপে আসতে চাইবে না। তাছাড়া সে জানে, দ্বীপে অবতরণকালে লোকেদের কাদামেখে বা কাদা-লেপ্টালেপ্টি হয়ে তবে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। হতাশায় মনটা ছেয়ে গেলেও হতোদ্যম হয় না লুইগি। গোলাম কবিরের মাধ্যমে সে খোঁজ নিয়ে জেনেছে, দ্বীপের দু’টি ছেলে এবং তিনটি মেয়ে প্রতিবেশী জেলা সদরের কলেজে প্রথম ও শেষ বর্ষে পড়ছে। তাদের মধ্যে দু’জন বিজ্ঞানের ছাত্র। ভাল ফল করে তারা যদি ডাক্তার হতে পারে তাহলে নিশ্চয়ই তারা তাদের হিতৈষণা দ্বীপটির জন্যে নিয়োগ করবে। আবার, এমনও ভয় তার জাগে, দ্বীপের অনেকের স্বপ্নই নাকি লেখাপড়া শিখে চিরদিনের জন্যে দ্বীপ ত্যাগ করে চলে যাওয়া। তাদের ধারণা, দ্বীপটি আকস্মিকভাবে ডুবে গেলে তাদের লেখাপড়া-জ্ঞানগম্যি কিছুই আর কাজে লাগবে না।

আরও পড়ুন: দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান (পর্ব-১)

লোকেরা যে সবসময় হতোদ্যম এবং অদৃষ্টের হাতে সমর্পিত সেটাও সত্যি নয়। সন্তানসম্ভবা মেয়েটির মৃত্যু হৃদয়বিদারক হলেও সেটি এক ধরনের দৃষ্টি-উন্মোচক দৃষ্টান্তরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। লোকেরা একটু-একটু করে প্রশ্নশীল হতে থাকে। তারা সর্বরোগহর মন্ত্রপূত পানিকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে নারাজ। আরও এক গর্ভবতী মেয়ের ঝুঁকি দেখা দিলে তার পরিবারের লোকজন তাকে নিয়ে রওনা দেয় প্রতিবেশী জেলা-শহরের দিকে। যদিও সেটি মফস্বল শহর তবু সেখানে ক্লিনিক এবং ডাক্তার মেলে। কিন্তু সুবর্ণদ্বীপ থেকে চাইলেই সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। আর সেটি যদি হয় সূর্য ডুবি-ডুবি করে এমন সময়ে। প্রথমে তারা বোরখাবৃত মেয়েটিকে ওঠায় একটা ভ্যানগাড়িতে। সেখান থেকে যায় ঘাটের দিকে যেখানে ছিল একটা স্পিডবোট। তখন শরৎকালের আকাশে ছিল হাল্কা মেঘের আনাগোনা। হয়তো এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল, তারপর আকাশ ফর্সা। নদী-সাগরের সংযোগস্থল যে-জায়গাটাকে তারা বলে চ্যানেল সেটাও প্রশান্ত। ভ্যান থেকে তাকে ওঠানো হলো স্পিডবোটে। একটুখানি দুলুনি দিয়ে চলতে আরম্ভ হলো বোট। ঝড়ো হাওয়া থাকলে আধাঘণ্টার পথের জন্যে লেগে যায় প্রায় এক ঘণ্টা। হঠাৎই কোত্থেকে এক উটকো মেঘ এসে অশনির মত দাঁড়ায় তাদের মাথার ওপরে। খানিকটা দমকা হাওয়ার মত উঠে যাত্রীসহ গোটা স্পিডবোটকে দেয় কাঁপিয়ে। ভয়ে গর্ভবতী মেয়েটির সমগ্র সত্তা কেঁপে ওঠে। কম্পমান মেয়েটি তার অভ্যন্তরে কেমন যেন এক অব্যক্ত বেদনা বোধ করতে থাকে। সেটি যে প্রসববেদনাই সেটা সঙ্গে-সঙ্গে তার বোধিতে আসে না যেহেতু সেটাই ছিল তার প্রথম সন্তানের অভিজ্ঞতা। বোটের মধ্যেই তার সন্তানের জন্ম হয়ে যায়। সঙ্গে থাকা মাঝবয়েসি এক নারীর কল্যাণে মা এবং সন্তান দু’জনেরই প্রাণরক্ষা হয়। মেয়েটির নাম রাখা হয় বাতাসি। মেয়েটির কথা উঠলেই লোকেদের ঝড়ো হাওয়ার কথা মনে পড়ে আবার ঝড়ো হাওয়া উঠলে তাদের মনে পড়ে বাতাসির কথা।

এইটুকু সচেতনতাও বড় কম নয়- বাতাসির জন্মবৃত্তান্ত শুনে আশান্বিত হয় লুইগি পালোমার। ভাল কোন বিদ্যায়তন নেই যেখানে তারা লেখাপড়া করে সচেতনতা অর্জন করবে। একটি বিদ্যায়তন যদি খোলা যায় দ্বীপে তাহলে লোকেরা নিশ্চয়ই নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে  দিন-দিন আরও জেগে উঠবে। তারা সর্বরোগহর ঔষধের ওপর আস্থা হারিয়ে দ্বীপ ছেড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যখন ঢেউয়ের তোড়েও দিকভ্রষ্ট হয় না তখন তাদের ভবিতব্য বিষয়ে নিশ্চয়ই আশাবাদী হওয়া যায়। কিন্তু চাইলেই বিদ্যায়তন বা স্কুল খোলা যায় না। দ্বীপের অধিকাংশ লোক দরিদ্র। তাদের অধিকাংশের ধারণা, ক্ষেতেখামারে কাজ না করে বই নিয়ে বসে থাকাটা অকর্মণ্যতার লক্ষণ। বই পড়লে জমিতে ফসল হয় না, যদি তার পরিবর্তে বই-পড়ার সময়টাকে খাটাখাটুনিতে প্রয়োগ করা যায় তাহলে অন্তত জমিতে কয়েক সের বেশি হলেও শস্য মেলা সম্ভব। আর, যেটুকু পঠনপাঠন দ্বীপের ছেলেমেয়েরা সকালবেলা তাদের ধর্মীয় শিক্ষকদের নিকট থেকে লাভ করে তার বাস্তব কোন প্রয়োগ লুইগি দ্বীপের কোথাও দেখতে পায় না। তাই সে তার সহকারী গোলাম কবিরকে একদিন জিজ্ঞ্যেস করে, এখানকার লোকদের বাপ-দাদারা কী লেখাপড়া করে নি কখনও? যদি সেটা তারা করে থাকে তাহলে নিজেদের সন্তানকে তারা লেখাপড়া কেন করাচ্ছে না? কবির তখন লুইগিকে বোঝায়, সুবর্ণদ্বীপের আদি বসতি-স্থাপনকারীরা সবাই এসেছিল কাস্তে-কোদাল-খুরপি-টুকরি নিয়ে। তাদের তল্পি-তল্পা অবলম্বন-সম্বল কোথাও কোন কিছুর মধ্যেই ছিল না একটা বইয়ের পাতাও। কাজেই তাদের কাছ থেকে উত্তরপ্রজন্মমুখি শিক্ষা-সচেতনতা আশা করা অনুচিত। তবু, একবার ডেনমার্কের একটি সাহায্য-সংস্থা সচিত্র বর্ণমালার বই সাহায্য হিসেবে দিয়ে যায় দ্বীপের ছেলেমেয়েদের জন্যে। আরেকবার কানাডার একটি সাহায্য-সংস্থা স্বাস্থ্যবিষয়ক ক্ষুদ্র পুস্তিকা বিতরণ করে যায় দ্বীপে। বর্ণপরিচয় না থাকলেও, লেখাপড়া না জানলেও ছবি দেখে অনেকেই তখন স্বাস্থ্যসম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য জানতে পারে। যেমন, একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটি শিশু টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজে। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটি শিশু সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে পরের ছবিতে খেতে বসেছে বাবা-মা’র সঙ্গে। অশিক্ষিতদের মধ্যেও যেসব পিতামাতা খানিকটা সচেতন তারা ডেনমার্কের সাহায্য-সংস্থার দেওয়া বইগুলিকে বর্ণমালা শেখার কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে কানাডার সাহায্য-সংস্থার সচিত্র পুস্তকটিকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে দু’টোর সমন্বয় দিয়ে একটা ঘরোয়া শিক্ষাব্যবস্থা নিজেদের অজান্তেই চালু করে দেয়। তাতে খানিকটা বিপরীতে হিত গোছের প্রতিক্রিয়াও হয়। বর্ণমালা এবং সচিত্র বইয়ের যৌথ অবদানে সমৃদ্ধ ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা প্রবল তৃষ্ণার ভাব জেগে ওঠে। সেই তৃষ্ণার ফলে তারা বলতে থাকে, আমরা আরও বই চাই, আমরা আরও বই চাই। যতই তাদের পিতামাতা তাদের ধমকায় ‘চুপ র্ক’ ‘চুপ র্ক’ বলে ততই তারা চেঁচায়, ‘বই চাই বই চাই’ বলে। এইসব জেনেশুনে লুইগি ভাবে, সুবর্ণদ্বীপে একদিন লোকেরা ঘরে-ঘরে পাঠ করতে থাকবে- বই।

আরও পড়ুন: দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-২)

দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান

চলবে...

৫ম পূর্ব পড়ুন আগামী শুক্রবার

   

মহাশূন্যে যাবে জাপানের তৈরি কাঠের স্যাটেলাইট



বিজ্ঞান ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

মহাশূন্যে উৎক্ষেপণের জন্য কাঠের স্যাটেলাইট তৈরি করেছেন জাপানের বিজ্ঞানীরা। এটি স্পেসএক্স থেকে মহাশূন্যে উৎক্ষেপণ করা হবে বলে জানিয়েছেন তারা।

বুধবার (২৯ মে) ইয়েমেনের বার্তাসংস্থা সাবা এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে।

খবরে জানানো হয়, জাপানের কিয়েটো বিশ্ববিদ্যালয় ও সুমিটোমো ফরেস্ট্রি ফাউন্ডেশন বিশেষজ্ঞেরা ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চার বছরের চেষ্টায় এই স্যাটেলাটটি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।

বুধবার কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিজ্ঞানীরা ৪ বছরের কঠোর পরিশ্রম করে কাঠের তৈরি স্যাটেলাইটটি তৈরি করেছেন। এই স্যাটেলাইটের নামকরণ করা হয়েছে, ‘লিগনোস্যাট’ (LignoSat)। এটি পৃথিবীর সর্বপ্রথম কাঠের তৈরি স্যাটেলাইট। পরিবেশের কথা চিন্তা করে এই স্যাটেলাইটটি তৈরি করা হয়েছে। এটি যখন তার অভিযান শেষ করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করবে, তখন এটি সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যাবে।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘লিগনোস্যাট’ স্যাটেলাইটির আকৃতি ১০ সেন্টিমিটার। এটির পুরুত্ব ৪ থেকে ৫.৫ মিলিমিটার। তবে এটির ভেতরের স্তর হবে অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি এবং এর ভেতরে একটি সোলার প্যানেল থাকবে। সবমিলিয়ে এটার ওজন হবে মাত্র এক কেজি। এই স্যাটেলাইট সম্পূর্ণ সনাতনী জাপানি পদ্ধতিতে কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এতে কোনো ধরনের ‘অ্যাডহেসিভ’ (আঠা) ব্যবহার করা হয়নি।

জাপানি বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ‘লিগনোস্যাট’ স্যাটেলাইটটি স্পেসএক্স থেকে এ বছরই উৎক্ষেপণ করা হবে। তারা আরো জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে এটি পৃথিবীর বাইরে পরীক্ষামূলকভাবে উড়াল সম্প্ন্ন করেছে। স্যাটেলাইটটি কী কাজে ব্যবহার করা হবে, তা অবশ্য জানানো হয়নি।

;

১২৫তম জন্মবর্ষ

মুক্তির অন্বেষী নজরুল



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নজরুল জীবনের ‘আর্তি ও বেদনা’র সম্যক পরিচয় পেতে হলে সেকালের মুসলিম সমাজের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কিছু আলোচনা আবশ্যক হয়ে পড়ে। নজরুলের আবির্ভাবকালে মুসলমানদের সামাজিক আবহাওয়া এমনই জীর্ণ ও গণ্ডিবদ্ধ ছিল যে, কোনো শিল্পীরই সেই আবহাওয়াতে আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার সম্ভব ছিল না। জীবনের প্রথমদিকে তাই কামাল পাশা প্রমুখ ইতিহাসখ্যাত বীর মুসলিমেরা নজরুল-মানসকে আচ্ছন্ন করেছিল।

কিন্তু অচিরেই তিনি বাঙালির জাগরণের পথিকৃতে রূপান্তরিত হন। বাংলার জাগরণ গ্রন্থে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর অগ্রণীজন কাজী আবদুল ওদুদ জানাচ্ছেন, ‘নজরুলের অভ্যুদয়ের পরে ঢাকায় একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর অভ্যুদয় হয়; তাঁদের মন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ এবং যারা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং বাঙালি মুসলমানের চেতনার জগতে নাড়া দিলে সচেষ্ট হয়েছিলেন।’

চরম দারিদ্র্যের মাঝে থেকেও জীবনের জয়গান গেয়েছেন কবি নজরুল, ছবি- সংগৃহীত

উল্লেখ্য, ১৯ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় অধ্যাপক ও ছাত্রের মিলিত প্রয়াসে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। সংগঠনটির সঙ্গে ‘সাহিত্য’ শব্দটি যুক্ত থাকলেও এটি গতানুগতিক ও মামুলি কোনো সাহিত্য সংগঠন ছিল না। ‘সাহিত্য’ শব্দটিকে বৃহত্তর পরিসর ও অর্থে গ্রহণ করেছিলেন উদ্যোক্তারা। ফলে, তাঁদের কাছে সাহিত্যচর্চা ছিল জীবনচর্চার নামান্তর। এই সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা। নিজেদের কর্মকাণ্ডকে তাঁরা অভিহিত করেছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামে।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-প্রতিষ্ঠার পরের বছরেই (১৯২৭) সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র হিসেবে সাময়িকী ‘শিখা’ প্রকাশ করে, যে কারণে এদের ‘শিখা গোষ্ঠী‘ নামেও অভিহিত করা হয়।

শিখা প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ বছর (১৯২৭-১৯৩১)। বাঙালি মুসলমানের বিভিন্ন সমস্যা তথা শিক্ষা, সাহিত্য, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দর্শন, চিন্তা ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানদীপ্ত আলোচনা করেছেন এই সমাজের লেখকগণ। ‘বুদ্ধির মুক্তি ও কবি নজরুলকে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

বুদ্ধির মুক্তি, মানব মুক্তি, সমাজের মুক্তি তথা মানুষের শির উচ্চতর করার বাণী উৎকীর্ণ করেছিলেন নজরুল। গেয়েছিলেন মানবতার জয়গান। অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্যের গানে মুখরিত ছিল তাঁর জীবন ও কর্ম। মানুষের চেয়ে বড় কিছু ছিল না তাঁর কাছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী ছিলেন তিনি। জগতের বঞ্চিত, ভাগ্য বিড়ম্বিত, স্বাধীনতাহীন বন্দিদের জাগ্রত করার মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন নজরুল। মানবতার জয়গান গেয়ে লিখেছিলেন-'গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্ …’।

মানুষ আর মানুষের হৃদয়কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’। আবার তাঁর কলম থেকেই বেরিয়ে এসেছিল বজ্রনির্ঘোষ আহ্বান- ‘জাগো অনশন-বন্দি, ওঠ রে যত জগতের বঞ্চিত ভাগ্যহত’।

শুধু যে কবিতাই লিখেছেন তা তো নয়। তিনি এমন অনেক প্রবন্ধও রচনা করেছেন। নজরুলের দেশপ্রীতি, দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আজও অনুপ্রাণিত করে। তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে।

সাম্য ও মানুষের কবি ছিলেন কবি নজরুল ইসলাম, ছবি- সংগৃহীত

‘সাম্য, সম্প্রীতির কবি নজরুল তাঁর হৃদয়মাধুর্য দিয়ে সব শ্রেণিবৈম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে জাত–ধর্ম ছিল হৃদয়ের প্রেমধর্ম; যে প্রেম মানুষের কল্যাণে উৎসারিত হয়ে ওঠে। শুধু লেখনীর দ্বারা নয়, নিজের জীবনের সবরকম ঝুঁকি নিয়ে ঐক্যের আশায় আশাবাদী ছিলেন নজরুল।

তাঁর ব্যক্তিজীবনে এই ভাবনার প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর বিবাহের ক্ষেত্রে, পুত্রদের ক্ষেত্রেও। তাঁর পরিবারের সব সদস্য এবং আপামর বাঙালি এই সত্য নিত্য উপলব্ধি করেন।

১২৫তম জন্মবর্ষে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চৈতন্য মুক্তির অন্বেষী। তাঁর গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক তথা সুবিশাল সাহিত্যকর্ম বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, নানা কারণে তাৎপর্যবাহী।

কেননা, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রখর প্রতাপে ত্রস্ত এবং যুদ্ধ ও আগ্রাসনে জর্জরিত পৃথিবীতে থেমে নেই অন্যায়, অবিচার, হামলা, নির্যাতন।

ইউক্রেন, ফিলিস্তিন থেকে মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত পৃথিবীময় শোষণ, নির্যাতন, হত্যা, রক্তপাতে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত করোনা-বিপর্যস্ত পৃথিবী আর মানুষ এখন অবর্ণনীয় দুর্দশা ও দুর্বিপাকে বিপন্ন।

এমতাবস্থায় অনাচারের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহী নজরুলের মানব অধিকারের রণহুঙ্কার বড়ই প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। কারণ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহীরুহ-তুল্য কাজী নজরুল ইসলাম প্রেম, বিদ্রোহ, মুক্তি ও মানবতার মহান সাধক।

১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত বৃটিশ-বাংলার সর্বপশ্চিম প্রান্তের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় জন্ম নেন কাজী নজরুল ইসলাম আর ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

বাংলাদেশের এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষীদের শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, যেমনটি তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।'

উল্লেখ্য, কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তাঁর কবরস্থানের স্থান নির্ধারণ নিয়ে নানাজন নানামত দিতে থাকেন। এ অবস্থায় স্থাননির্ধারণী সভায় রফিকুল ইসলাম প্রস্তাব করেন নজরুল তাঁর এক গনে লিখেছেন-

‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’॥

সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর কবর হোক। তাঁর এ প্রস্তাব সভায় গৃহীত হলো। পরবর্তীকালে এ কবর পাকা ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি নজরুলকে ভারত থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, ছবি- সংগৃহীত

‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবনযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলির একটি 'বিদ্রোহী', যা স্পর্শ করেছে রচনার শতবর্ষের ঐতিহাসিক মাইলফলক।

কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়, ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক ‘প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক ‘সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ‘ধূমকেতু’তে (২২ আগস্ট, ১৯২২) ছাপা হয়।

বলা বাহুল্য, অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তার কারণেই কবিতাটিকে বিভিন্ন পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপিত করেছিল। ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি ও রচয়িতা কবি নজরুল ‘চির উন্নত শির’ রূপে বিরাজমান।

পুরো বাংলা ভাষা বলয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এমন শাণিত প্রতিবাদ তুলনাহীন। বিদ্রোহীর শতবর্ষকে ‘জাগরণের শতবর্ষ’ রূপে উদযাপন করা হয়, বাংলা ভাষাভাষী পরিমণ্ডলে আর ১২৫তম জন্মবর্ষে মুক্তির অন্বেষী নজরুলকে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করে সমগ্র বাঙালি জাতি!

 ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

;

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;