ভাসা ভাষা



আফরিনা ওয়াশিন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

উপমহাদেশের বিখ্যাত পণ্ডিত কালিদাসের অনিচ্ছা শর্তেও কিছু পণ্ডিত প্রায় জোরপূর্বক আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন। অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হল, কালিদাস কখনও কাওকে তাঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন করেন না। আদোতে কালিদাস কিপ্টে নন। তিনি তার পরিবারের অজ্ঞ সদস্যদের নিয়ে চিন্তিত, কিভাবে করবে তারা বিজ্ঞ অতিথিদের আপ্যায়ন? তাই তিনি তার বাবার সামনে পুঁথি ধরিয়ে দিয়ে তা পাঠ করতে বসালেন। যেহেতু বাবা এই বিষয়ে অজ্ঞ, কালিদাস তাঁকে অনুরোধ করলেন ভগবান, কৃষ্ণ এবং রাম নাম জপতে। পুত্রের কথা মতো বাবা এক নাগাড়ে নাম জপতে আরম্ভ করলেন, “ভগবানকৃষ্ণরাম…… ভগবানকৃষ্ণরাম…।“ একপর্যায়ে সব গুলিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো , “ভকর…ভকর…ভকর…ভকর…”। বিজ্ঞ অতিথিগণ জপের আদ্যপান্ত কিছু না বুঝে কালিদাসকে প্রশ্ন করলেন । উত্তরে কালিদাস জানালেন, এটি ভগবান, কৃষ্ণ ও রাম এঁর সংক্ষিপ্ত রূপ। উপস্থিত বিজ্ঞজন স্বভাবতই ধারণা করে নিলেন কালিদাস বংশগতই জ্ঞানী বটে।

গল্পটি কোথায় শুনেছিলাম মনে নেই। রেফারেন্স দেয়ার ভয়েই হয়তো স্বীকার করে নিলাম। তবে গল্পটি একারণেই বললাম, শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের দৌড়ও ভকর…ভকর… জ্ঞানের মতোই। তা সে পাঠ্য বই হোক কিংবা ধর্মীয় গ্রন্থ। ভাষাই বুঝি না আর বই পড়ে বুঝবো কি? তাই বলে আমি আমাদের সব শিক্ষককে কালিদাসের বাবার ভূমিকায় দাঁড় করাচ্ছি এমনটিও নয়। কিন্তু ইংরেজি ক্লাসে শিক্ষক যখন বলেন, “ইংরেজি বলতে হলে, ইংরেজিতেই চিন্তা করতে হবে”। তখন আমার মতো অনেকেরই হয়তো না ঘারকা, না ঘাটকা অবস্থায় পড়তে হয়।

ভার্সিটিতে কোন এক ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় আমি বাংলা বিষয়ে ফেল করেছিলাম। সবাই ভীষণ হেসেছিল। আমি নিজেও যে দাঁতে বাতাস লাগাইনি তা নয়। কারণ ইংরেজিতে যথেষ্ট ভাল নম্বর পেয়ে পাস করেছি। আমার এই লজ্জাহীনতার পেছনেরও একটা ঘটনা আছে। আমার স্বর্গীয় মাতামহ একবার আমেরিকা ঘুরে এসে জানালেন, সেখানে ছোট ছোট বাচ্চারাও ইংরেজি বলতে পারে। বিষয়টি ছোট বয়সেই আমাকে খুব মর্মাহত করেছিল। এরপর থেকে আদা জল খেয়ে ইংরেজির পেছনে লেগে পড়লাম। ইংরেজির পেছনে লেগে না আমি তার আগে যেতে পেরেছি, না মাঝে। ঠিক পেছনেই আছি। ততদিনে আমার বাংলা ব্যাকরণ বই উইপোকাতে খেয়ে নিয়েছে। বাংলা না বুঝেই ইংরেজি শিখবো কি করে? কবির ভাষায় আমার এই অভাগা দশা ঠিক এমন-

“ওরে বাছা মাতৃ কোষে রতনের রাজি,

এ ভিখারী দশা কেন তোর আজি?”

শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল মানুষের পূর্ণ বিকাশ ঘটানো। যা পড়ছি তা যদি আর আচার আচরণ বা অভ্যাসেই না আসে তাহলে সমাজ বিবর্তনের কথা বলেই বা কি লাভ। শিক্ষার ভাষা সহজতর হলে তবেই না তা অভ্যাসে রূপ নিবে। মানুষ তার অভ্যাসের সাথে যতটা নিরাপদ, চাপিয়ে দেয়া বিষয়ে ঠিক ততোটাই আনাড়ি এবং ভীতু।

একথা স্বীকার করতে সংকোচ নেই ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ইংরেজির হাত ধরেই এসেছিল। কিন্তু ভারতীয় স্থানীয় বিজ্ঞ সমাজ প্রথমেই বুঝেছিলেন ইংরেজি শিক্ষা তৎকালীন ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থাকে নিজের গতি থেকে আলাদা করতে চাইছে। তাই তারা নিজের ভাষা ও শিল্প সংস্কৃতিকে বাঁচাতেই সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে তাদের হয়ে তাদের ভাষায় বই লেখা শুরু করলেন। অথচ শখানেক বছর পরে এসেও বাংলা ভাষাভাষি লেখক-পাঠক সম্পর্ক ঠিক তেমন সহজ নেই। লেখকের অবস্থাও আমার মতো আনাড়ি ছাত্রের মতো। না সে বাংলা সাহিত্যানুরাগী না অন্যকোন সাহিত্যে যথেষ্ট পারদর্শী। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধর্মশালার নামে মুষ্টি চাল আদায়ের মতো সব সাহিত্য ঘেটে যতটা কঠিন লিখছেন, ততোটাই যেনো পাণ্ডিত্য জাহির হয়। লেখক পাঠকের বিনিসুতার বাঁধনের কষাঘাতে ভাষা হল বলির পাঠা। ভাল বাংলা বই পড়ছি না, ভাল বাংলা জানছি না। তবে খারাপ বাংলা কি তাতেও আমাদের পরিপক্ক দক্ষতা আছে কিনা প্রশ্নের বিষয়। জুবার্টের ভাষায় বলতে হয়, “এককালে পৃথিবী বইয়ের উপর কাজ করতো, এখন বই পৃথিবীর উপর কাজ করে. ‘’ সাথেসাথে পাঠকের কান চিলে নিয়ে যায় ক,দিনের জন্য। এরপর যখন কান ফেরত আসে, তখন তা আর কান থাকে না। রীতিমত ইংরেজি শব্দ “ফান” হয়ে যায়। সুতরাং লেখক যে শুধু পাঠককে বোকা বানাচ্ছেন তা-ই নয়, বোকা বনে যায় সমগ্র বাংলা ভাষাভাষি পাঠক সমাজ।

এতোসব দুর্গতির দায় কেবল লেখক একা নিতে বাধ্য নন। কারণ বুদ্ধিজীবী মহল তার আগেই সুবিধা জনক অবস্থায় শেয়ালের মতো গর্তে লেজ ঢুকিয়ে বসে আছেন। কাঁকড়ার টান লাগলেই গর্ত থেকে লেজ আপনা আপনিই বেরিয়ে আসবে। কাঁকড়াটিকে করমর করে চিবিয়ে খাবেন। কিন্তু পাশে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে জানান দেবেন না, “যতোটা টাকা ফেলবেন, ততোটাই বলে দেবো আপনার হয়ে।‘’ হর্তাকর্তাদের টেবিলে নোট পড়লে আপনিই হয়ে উঠতে পারেন লেখক, গায়ক বা শিল্পী হিসেবে লেটেস্ট কিংবা ফিটেস্ট।

ধর্ম গ্রন্থের জন্য তো সমাজ বদল বা শিক্ষার অভ্যাস কোনদিনই বদলায় না । কুরআনে বর্ণিত আছে, “ ধর্ম প্রচারের জন্য প্রেরিত পুরুষ কেবল নিজ গোত্রের মানুষদের ভাষায় কথা বলেন, যাতে করে তিনি সহজ এবং স্পষ্ট ভাবে ধর্মের বাণী প্রচার করতে পারেন।”( ১৪ আব্রাহাম, ৪)। আমাদের কতজন ধর্মীয় প্রতিনিধি এই বিষয়টিকে আমলে নিয়ে সামনে এনেছেন। কতজন ধর্মবিদ ওয়াজ মাহফিলে বলেছেন মাতৃভাষায় কুরআন পাঠে করলেও পুণ্য আসে। পুণ্যের ঘর শূন্য রেখেই নিজের শেখা আরবিকে আরও কতোটা দূর্বোধ্য ভাবে প্রদর্শন করে মাদ্রাসা বোর্ডকে মহান ঘোষণা করা যায় সেই তালেই থাকেন।

তালে তাল মিলিয়েছেন পন্ডিত মশাইও। বৈদিক ছন্দোমঞ্জরীতে বর্ণিত আছে, "মননাৎ ত্রায়তে যস্মাৎ তস্মাৎ মন্ত্র উদাহৃতঃ।" অর্থাৎ যা মন,চিন্তা ও ধ্যানের দ্বারা সংসারের সকল দুঃখ-কষ্টের হাত থেকে পরিত্রাণ দেয় তাই মন্ত্র। প্রায় একই কথাকে পরিশ্রমের সাথে যুক্ত করে মধযযুগের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বলছেন- “মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন ।” মন্ত্র বিষয়টাই এমন বার বার পাঠ করার কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ কষ্ট করলে কেষ্ট মিলবে। বুঝলাম, আপনাদের ধর্মগ্রন্থের ভাষা আমাদের বাংলা ভাষারই পূর্ব রূপ। তাই বলে তা সহজ বাংলায় অনুবাদ করলে অন্যরা পড়লে আপনার জাতটা চলে যাবার সম্ভাবনা থাকে কি? ধর্ম আর রাজনীতির প্রধান অস্ত্র যদি হয়ে থাকে ভাষা তাহলে আর আমরা আলাদা হলাম কি করে। সেই তো ইংরেজদের মতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট রেফারির মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাছের মায়ের পুত্র শোক করছি।

বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাবোর্ডগুলো ভাষার স্বতন্ত্রতাকে কোন পর্যায়েই নিরপেক্ষ থাকতে দিতে চাইছে না। বৈদিক সমাজের শ্রেণিভেদের মতোই ভাষার জাত নির্ধারণ হচ্ছে। যা সাজালে এমন দাঁড়ায়- ইংরেজি মাধ্যম ব্রাক্ষ্মণ শ্রেণী, বাংলা মাধ্যম ক্ষত্রিয়, মাদ্রাসা বোর্ড বৈশ্য আর বাকী বিভিন্ন আদিবাসীদের শিক্ষা মাধ্যমগুলো শূদ্র। ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রটি বাঙালি হয়েও বাংলা জানবে না, এটা ইদানীং গর্বের কারণ । কিন্তু বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা কেনো শুদ্ধ বাংলা জানে না এই কথাটা আলোচনায় কতবার এসেছে? পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ ইংরেজি ভাষা চর্চা করে বলে তো এই না, তারা নিজের মাতৃভাষাকে বাদ দিয়েছে বা সিলেবাসে গণ্য হিসেবে স্থান দিয়েছে। গ্রামের একটি ছোট ছেলে হন্তদন্ত হয়ে তার বদরাগী কৃষক চাচার কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে জানালো তার ফসলের ক্ষেতে কারা যেনো মল ত্যাগ করছে। চাচা লাঠি নিয়ে ছুটলো ক্ষেতের দিকে। পুরুষালী কণ্ঠে চিৎকার করে বললো, “ কে হাগোছে আমার জমিতে?” হঠাৎ করে একজন আর্মি সদস্যকে উঠে দাঁড়াতে দেখে চাচা মেনী বিড়াল সেজে গেলেন। সে আঙুল তুলে তার সব ক্ষেত দেখিয়ে বললো, “ এটা আমার জমি, ওটা আমার জমি। হাগেন, হাগেন। আপনারা হাগবেন না, তো কারা হাগবে।” আমাদের অবস্থাও অনেকটা চাচার মতই। ইংরেজি জানলে জগতের সব সুবিধা আমাদের। তাই ওটাই আগে। তাহলে প্রশ্ন আসে , জাপান, চীন, জার্মানিদের কি চাচার প্রয়োজন হয় না?

এতকিছু বলার পেছনে ইংরেজিকে ভাষা হিসেবে অস্বীকার করা কিংবা ছোট করে দেখানোর কোন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইচ্ছা নেই আমার। কেবল এটাই বলতে চাইছি, শুধু ইংরেজি বা অন্য ভাষায় দক্ষতা আছে বলে আমি আমার নিজের মাতৃভাষাকে অবহেলা করবো এটা ঠিক হবে না। শেষমেষ অস্তিত্বের গোড়া না নড়বরে হয়ে যায়। নিজের ভাষায় সঠিক ভাবে আয়ত্ত থাকলে অন্য যে কোন ভাষা আরও স্বল্প সময়ে আয়ত্তে আনা সম্ভব। কারণ সুন্দর বাক্য তৈরি করাতেই ভাষার আর্ট। ব্যক্তির মুখ যদি হয় তুলি, ভাষা তাতে রঙ। যেভাবে সাজাবেন, সেভাবেই সাজবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে প্রথম বর্ষেই আমি আবিষ্কার করেছিলাম আমার পাঠ্য বইয়ের প্রায় সবই ইংরেজি ভাষায় রচিত। বাংলাদেশ বলতে আমরা যারা এখনও যারা ঢাকা বুঝি তাদের মফস্বল কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা নেই বললেই চলে। সেই জায়গা থেকেই আসা আমার জন্য বাংলা বই খোঁজাটা খুব একটা হাস্যকর চোখে না দেখার অনুরোধ রইলো। কারণটা বলি, অনেক খোঁজাখুঁজির পর কিছু ইংরেজি অনুবাদকৃত বাংলা বই পেলেও তা যে ইংরেজির চেয়েও ভয়াবহ রকমের কঠিন এটা কেবল আমরাই জানি। যার ফলে বাংলা বই পড়ার ইচ্ছাটাকে ছেঁড়া ঝুলিতে রেখেই ইংরেজিকে গুরু মেনে এগিয়ে যেতে হয়। এতে করে কি আমাদের অজ্ঞতা ঢাকা সম্ভব হলো? জৈনক অনুবাদক বেচারার যে বাঙলার দাঁতের গোঁড়া এখনও নড়ছে সেটা উনি না স্বীকার করলেও বাঙলার ছেঁড়া ঝুলিটি দামি কাপড়ের নিচে থেকেও উঁকি মেরে জানান দেয়। সুতরাং যে ছেলেটি বা মেয়েটি গণিতে ভাল, বিজ্ঞানে ভাল, কেবলমাত্র ইংরেজি জানে না বলে তাঁর ভেতরের আবিষ্কারককে আমরা ইচ্ছা করেই গলা টিপে হত্যা করি। খুব বেশি হলে তাঁকে নিয়ে বিজ্ঞ সমাজ দুচারটা হাস্যকর উক্তি লিখতে পারেন। কিন্তু সহজবোধ্য অনুবাদ লিখে দিতে বললে উটের মতো গর্তে মাথা লুকিয়ে রাখবেন। ভুললে চলবে না গীতাঞ্জলী অনুবাদ হয়ে “সং অফারিংস” হয়েছিল বলে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিশ্চয়ই মাতৃভাষার পূর্ণ দক্ষতা ছিল জন্যই অনুবাদ করতে গিয়ে পান্ডিত্য দেখাতে কঠিন কঠিন শব্দ না লিখে অভ্যাস সুলভ সরল শব্দ লিখেই সর্বজনগ্রাহী করেছিলেন। অনুবাদ সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য হল ভাষার কাছে আত্মসমর্পণ করা। মোটেও পাণ্ডিত্য জাহির করা নয়।

নেলসন ম্যান্ডেলা হয়তো তাঁর নিজের অতীতকে স্মরণ করেই বলেছিলেন, “ যদি তুমি কারো সাথে তোমার ভাষায় কথা বলো, তাঁর কাছে যেতে পারবে; যদি তাঁর ভাষায় কথা বলো, তার হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারবে।“ আমাদের ভারতবর্ষে এই উদাহরণ আমরা কমই দেখেছি। মুখের ভাষা আর পরনের কাপড় দিয়ে মানুষকে বিবেচনা করি। ঠিক যেমন মুখে স্বাদ লাগলেই খাবার অযোগ্য হলেও খাই। যেমন আদিবাসী কোটার ব্যবস্থা করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিচ্ছি বটে। কিন্তু ক্লাসে এলে তার বুলি নিয়েই বুলিং করছি। আমাদের শিক্ষকরাও যে তাদের হয়ে বা তাদের মতো করে শেখাচ্ছেন তাও নয়। ভারতীয় ইতিহাসে গুরুশিষ্য পরম্পরা যে সুখকর না তার প্রমাণ বারবার সামন আসে। দ্রোণাচার্য যেমন ভাল ছাত্র অর্জুনকে নিয়ে গর্ব করতে করতে একলব্যের মত প্রকৃত বীরকে থামিয়ে দিয়েছিলেন, আমাদের শিক্ষকরাও তেমন একচোখা ভাবেই যারা এগিয়ে তাদেরকেই এগিয়ে নিয়ে যান। ওইসকল আদিবাসী ভাষাভাষীর শিক্ষার্থীদের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার সময় কই তাদের। এমনই অভাগা জাতি আমরা, বেশির ভাগ মানুষই জানি না আদিবাসী ভাষাগুলোতেও শিক্ষার প্রচলন আছে বা আরও প্রচলিত হতে পারে। আমার কেন কেবল মনে হয় আদিবাসী শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলে, যেচে গিয়ে ডেকে এনে এইসকল নিরীহ মানুষদের জাতিসত্ত্বাকে আঘাত করছি আমরা।

চীনা কবি লু চি বলেছিলেন, “লেখকের আনন্দই সব জ্ঞানীলোকের আনন্দ। প্রাণ না থাকলে ঘটে প্রাণের জন্ম ,নিরবতার বাইরে কবি দেন গানের জন্ম।” মানুষ ভাষা সৃষ্টি করেছে। সুতরাং বর্ণ, শব্দলিপি, প্রতিলিপিও মানুষেরই তৈরি। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কিন্তু দুচারটা ভাষা ভুল বললে বা লিখলেই আমাদের অগ্রজরা যেভাবে তেড়ে আসেন এবং সমালোচনা করেন, তাতে করে মনে হয় ভুল করার চেয়ে না বলা, না লেখাই ভাল ছিল।

আমারা বাঙালীরা গোঁড়া থেকেই উদার মনভাবের। কিন্তু একটা বিষয়ে আমরা ভীষণ গোঁয়ার। যে কোন পরিবর্তনকে আমরা মানতে চাই না সহজে। কখনোবা দেরীতে মানি। যেমন ইওরোপীয় পরাবাস্তববাদ আমরা মহাজ্ঞানীর মতো ধারণ করেছি। কিন্তু নিজের দেশের অল্প বয়সী একজন লেখকের ভাষায় সামান্য মেটাফোর মানতে পারি না। শুধু লেখকের ভাষাই বলছি কেন। শিল্পের ভাষাতেও একই অবস্থা। সিনেমা হলে গেলে শোনা যায়, “ আই সে গেট আউট, আমি বলছি তুমি বেরিয়ে যাও”। যেনো ইংরেজির সাথে এর বাংলা অর্থ না বলে দিলে আমরা কিছু বুঝতাম না। কিন্তু এখনকার একজন তরুণ নির্মাতা যদি দেখান, একজনের চোখে রাগ, হিংস্রতা দেখে অপরজন মাথা নিচু করে প্রস্থান করলো, তাহলেই বিপত্তি শুরু। কেন ডায়লগ দিয়ে দর্শককে গুলিয়ে খাওয়ানো হলো না। চোখের ভাষা আর মুখের ভাষা কোন ভাষা নিয়েই আমরা ভাবছি না এবং দর্শক ও পাঠককুলকেও দায়িত্ব নিয়ে ভাবতে সুযোগ করে দিচ্ছি না। না ভাবলে তো ভাষা গতি থেমে যাবে। সাহিত্য হবে না , গান হবে না। আমাদের অগ্রজরা যদি আমাদের এই ভাবনার জগতকে কিছুটা স্বাধীন করে দেন, তাহলেই ভাষা সমৃদ্ধ হতে পারে।

মাতৃভাষা একটি বড়সড় ঢালের মতো। পৃথিবীর ইতিহাসে যত রাজা বা শাসক এসেছেন সবারই প্রথম রীতি ছিল নিজের মাতৃভাষাকে রাজ ভাষার মর্যাদা দেয়া। এতে করে তাদের জন্য শাসন ব্যবস্থার বিস্তার ঘটানো সহজ হতো। এতোটা দূরে গিয়ে উদাহরণ না টেনে আমাদের ভাষা আন্দোলনের কথাই ধরা যাক। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী আমাদেরকে শাসন করার জন্যই নিজেদের সুবিধা মতো ঊর্দূকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দিতে চেয়েছিল। আমরা তাদের হা তে হা মেলালেই যে তারা আমাদেরকে শাসন করা বন্ধ করতো তেমনটি নয়। বরং বাংলা জানি বলেই আমরা নিজেদের ভাষাভাষির মানুষদের খুব কম সময়েই একত্র করে জনঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম। সুতরাং মাতৃভাষা কেবল একটি ভাষাই নয়, বহিঃশত্রুর হাত থেকে বাঁচার প্রতীকী কৌশলও বটে।

পাকিস্তানের ঊর্দুকে আমরা মেনে নিইনি তা ঠিক। তবে উপনিবেশিক শাসনের দিন এখনও শেষ হয়নি তা বেশ বোঝা যায় সর্বত্র ইংরেজির রাজত্ব দেখে। এই বিষয়টিকে হয়তো আমরা জেনে কিংবা নিজের অজান্তেই মেনে নিয়েছি। ভাষা হিসেবে ইংরেজি খুব সহজ তাও না। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা প্রবন্ধে লিখেছেন, “একে তো ইংরেজি ভাষা অতিমাত্রায় বিজাতীয় ভাষা। শব্দ বিন্যাস,পদ বিন্যাস সম্বন্ধে আমাদের ভাষার সহিত তাহার কোন প্রকার মিল নাই। তাহার পরে আবার ভাব বিন্যাস এবং বিষয় প্রসঙ্গও বিদেশী। আগাগোঁড়া কিছুই পরিচিত নহে, সুতরাং ধারণা করিবার পূর্বেই মুখস্থ করিতে হয়। তাহাতে না চিবাইয়া গিলিয়া খাইবার ফল হয়।”

বাংলাকে অবজ্ঞা করে ভকর…ভকর… করে ইংরেজি পড়লেও ভাষা না জানার যে আক্ষেপ থাকবে তাতে হয়তোবা জীবনের অনেক কথা, ভাব, অভিব্যক্তি না জানিয়েই পৃথিবী ছাড়তে হবে। আবারও কবির ভাষাতেই ইতি টানছি – ‘এ যেন রে অভিশপ্ত প্রেতের পিপাসা — সলিল রয়েছে প’ড়ে, শুধু দেহ নাই।” বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে চাইলে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা জানতে হবে। কিন্তু নিজের মাতৃভাষাক শুধুমাত্র একটি পাঠ্য বিষয় না ভেবে মুখ্য স্থানটি দেয়ার পর ইংরেজি জানা মঙ্গলকর।

মহাভারতে দ্রৌপদীর জন্য নীলপদ্ম তুলতে গিয়ে যুধিষ্ঠিরের ভাইয়েরা একের পর এক যক্ষের হাতে নিহত হয়েছিল। তাদের পুনঃজীবনীর জন্য যুধিষ্ঠিরকে যক্ষের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। একটি প্রশ্ন ছিল, সুখীজন কে? যুধিষ্ঠির উত্তর দেয়- “দিবসাস্যাষ্টমে ভাগে শাকং পচতি যো নরঃ অনুনী চাপ্রবাসে চ স বারিচর মোদতে।” এর অর্থ দাঁড়ায়, সন্ধ্যাবেলা যে লোক শাক রান্না করে, যার কোন ঋণ নেই আর যে বিদেশ থাকে না তাকেই সুখী বলা হয়।“ অথচ নিজের ভাষা থাকতেও আমরা যেনো নিজ দেশেই রিফিউজির মতো আশ্রিত। মাতৃভাষায় জ্ঞানার্জন করা আমাদের জন্মগত অধিকার। কিন্তু অপসংস্কৃতি আমাদের ঘারে এতটাই জেঁকে বসেছে, মাতৃভাষার পূর্ণ সম্মানটাও আমরা দিচ্ছি না। মাতৃভাষায় শিক্ষার সহজ মাধ্যম গড়ে তোলাই এখন সময়ের দাবি। একমাত্র বাংলা ভাষাই পারে বাংলাদেশের সকল শিক্ষার মাধ্যমকে এক করতে। পারে সব কাতারের মানুষকে এক কাতারে এনে দাঁড় করাতে। কথার চেয়ে বড় মরণাস্ত্র নেই, মাতৃভাষার চেয়ে বড় কোন ঢাল নেই।

৩১.০১.২০২১

আফরিনা ওশিন,শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;