'দলিত চর্চা' সমাচার



ড. রূপকুমার বর্মণ
'দলিত চর্চা' সমাচার

'দলিত চর্চা' সমাচার

  • Font increase
  • Font Decrease

বিগত কয়েক দশকে, বিশেষত ভারতের পটভূমিতে, সমাজবিজ্ঞান, সংবাদ মাধ্যম ও সাধারণ জনমানসে ‘দলিত প্রতর্ক’ (Dalit Discourse) ও ‘দলিত চর্চা’ (Dalit Studies) সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। একটি সামাজিক ধারণা হিসাবে ‘দলিত’ শব্দটির বহুকৌণিক ব্যাখ্যা ‘দলিত চর্চায়’অবাঞ্ছিত বিতর্ক ও পক্ষপাতদুষ্টতার জন্ম দিয়েছে। ‘দলিত চর্চায়’ ‘দলিত’ নিষ্পেষিত জনগণের ব্যক্তি বা সমষ্টিগত ধারনার বহিঃপ্রকাশ হলেও ‘দলিতবাদের’ (Dalitology) দলিত কিন্তু অনেকবেশি শক্তিশালী, যারা নিজেদের কথা দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করতে চান।

সাধারণভাবে দলিত বলতে বোঝায় ‘নিগৃহীত, শোষিত, নিষ্পেষিত ও সামাজিকভাবে নিপীড়িত মানুষদের, যাদেরকে কেবলমাত্র জন্মগত কারণে জাত-ব্যাবস্থার পাদদেশে স্থান দেওয়া হয়’। এদের আবার কখনও কখনও অস্পৃশ্য, অন্তজঃ, ইতর, চন্ডাল বা মনুষ্যেত্বের জীবরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।

‘দলিত চর্চায়’ নিযুক্ত ঐতিহাসিক বা সমাজবিজ্ঞানীগণ দক্ষিণ এশীয় সমাজের তপশিলি জাতি, জনজাতি বা পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জনগণকে সমষ্টিগতভাবে দলিত বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মহারাষ্ট্রের ‘দলিত প্যান্থারদের’ কাছে দলিতের ধারণা অতি স্পষ্ট। ১৯৭০ ও ১৯৮০র দশকে ‘দলিত প্যান্থার’ আন্দোলনে বিশ্বাসী ও সমর্থকগণ মনে করতেন “দলিত হল সামাজিক পরিবর্ত ও বিপ্লবের একটি প্রতীক, যারা মানবতাবাদে বিশ্বাস করেন। একই সঙ্গে তাঁরা সেইসব ধর্মীয়গ্রন্থ ও শাস্ত্রের বিরোধী, যা সমাজে বিভেদমূলক সামাজিক ও ধর্মীয় আচার আচরণ তথা সামাজিক অন্যায়ের প্রচার করে।”অর্থাৎ ‘দলিতবাদ’হলো সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক।

দলিতপন্থীদের কাছে দলিতবাদের অর্থ দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ নয় বরং নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদই তাঁদের পাথেয় ও উদ্দেশ্য। তাঁরা প্রথম দিকে মহারাষ্ট্রের মাহারদের (একটি তপশিলি জাতি) সম্পর্কে দলিত শব্দটির প্রয়োগ করেছিলেন। ধীরে ধীরে দলিতের ধারণার মধ্যে সমস্ত তপশিলি জাতি, উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (Other Backward Classes) ও সমাজের অন্যান্য দুর্বল অংশকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। দলিতের ধারণা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ১৯৯০-এর দশকে যখন দলিতদের ভারতীয় সমাজের ‘মূল উৎপাদক’(primary producers)হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৯০-এর দশকের ভারতের বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ‘দলিত প্রতর্ক’ বিকাশের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। প্রথমটি ছিল তাঁর জন্ম শতবর্ষে ড. বাবা সাহেব ভীমরাও আম্বেদকরকে ‘ভারতরত্ন’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া। এর সঙ্গে তপশিলি জাতি থেকে ভারতের নবম উপরাষ্ট্রপতি (১৯৯২-১৯৯৭) ও দশম রাষ্ট্রপতিরূপে (১৯৯৭-২০০২) ড. কে. আর. নারায়ননকে নির্বাচন দলিত প্রতর্কের জন্য সদর্থক পরিবেশ তৈরি করেছিল। তৃতীয়ত, মন্ডল কমিশনের সুপারিশ মেনে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থাকে সুপ্রীম কোর্টের স্বীকৃতি (১৯৯৩) সারা ভারতে দলিত আন্দোলনের মূল বক্তব্যকে উদ্দীপিত করে তোলে। একই সঙ্গে উত্তর প্রদেশে কুমারী মায়াবতীর নেতৃত্বে বহুজন সমাজ পার্টির (BSP) সরকার গঠন দলিতবাদকে আশাবাদী করে তুলেছিল। ফলত: দলিতবাদ সম্পর্কিত রচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে। এই ধারা দক্ষিণভারতের দলিত খ্রিস্টানদের হাতে শক্তিশালী রূপ ধারণ করে।

কিন্তু দলিতবাদের সদর্থক ব্যাখ্যা প্রায়ই অ-দলিতদের (non-Dalits) দলিত চর্চায় নেতিবাচক ধারনায় পরিণত হয়, যখন তাঁরা ‘দলিত’ বলতে কেবলমাত্র পূর্বতন অস্পৃশ্যদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। ১৯৮০-এর দশক থেকে অ-দলিতদের দলিত চর্চায় ঔপনিবেশিক আমলের দলিত আন্দোলনগুলোর সামাজিক ন্যায় (Social Justice) প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদী রূপটিকে চেপে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই দলিতবাদের প্রকৃত স্বরূপ অনুধাবন করার সঙ্গে সঙ্গে ‘দলিত প্রতর্ক’ সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক।

দলিত প্রতর্কের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন হল দলিত প্রতর্কের ‘দলিত’কারা? দলিত প্রতর্কের দলিত শুধুই ‘দলিত’ হয়েছেন/ হচ্ছেন এমন নয়। ‘বঞ্চিত, দলিত, অত্যাচারিত বা শোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যারা বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রশ্ন উস্থাপন করতে বা প্রতিবাদ করতে ভুলে যান না তাঁরা।ঁরাই এই দলিত প্রতর্কের দলিত’। অর্থাৎ তাঁরা নিজেদের অবস্থান ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সক্ষম। এই প্রতিবাদী স্বরই হল দলিত প্রতর্কের চালিকা শক্তি যা ‘দলিত চর্চায়’ হয় উহ্য থাকে না হয় স্বীকার করা হয় না।

দলিত প্রতর্কের দ্বিতীয় প্রশ্নটি আরোও বেশি শক্তিশালী। এটা হল দলিতরা কেন লেখেন? কেনই বা প্রশ্ন উত্থাপন করেন? প্রশ্নগুলো আপাতদৃষ্টিতে কঠিন মনে হলেও বাস্তবে এর উত্তর অতি সহজ। তাঁরা লেখেন কারণ তাঁরা চান কেবলমাত্র কোন নিদির্ষ্ট পরিবার/সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করায় তাঁরা যে সামাজিক বঞ্চনা, নিষ্পেষণ, অত্যাচার, পক্ষপাত ও অসাম্যের শিকার হন বা বিরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন তা যেন বিশ্ববাসীর কাছে প্রকাশিত হয়। তাঁদের ব্যথারও যেন সমব্যাথী যেন খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁদের লেখা যেন অসাম্য, অন্যায় ও মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। তাই মহারাষ্ট্রের দলিতপ্যান্থারপন্থী নামদেও দাসাল থেকে শুরু করে হিন্দি জগতে ড. তুলসীরাম ও ওমপ্রকাশ বাল্মিকী, বাংলার হরিশংকর জলদাস,  যতীন বালা,  মনোহর মৌলি বিশ্বাস, মনোরঞ্জন ব্যাপারী এঁরা সবাই কলম তুলে নিয়েছেন তাঁদের অভিজ্ঞতাকে জনসম্মুখে প্রকাশ করার জন্য। তাঁরা যা দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন, তাঁদের মনে হয়েছে প্রকাশ হওয়া দরকার তাঁরা তাই লিখে চলেছেন। এ লেখার ধারা বিরামহীন। সাহিত্যধর্মী লেখার সঙ্গে শুরু হয়েছে সমালোচনাধর্মী, গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা। সমাজবিজ্ঞানের কলাকুশলে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ক্ষুরধার যুক্তির স্পর্শে শক্তিশালী এই ধারা কাঞ্চা ইলিইয়া, গোপাল গুরু, সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে। সাম্প্রতিককালে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ভাষায় এই ধরনের গবেষণা দলিত প্রতর্ককে সমৃদ্ধ করে চলেছে।

দলিত প্রতর্কের তৃতীয় বৈশিষ্ট্যটিও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটা হল “তাঁরা কি লেখেন ?” এর উত্তরে বলা যায় যে তাঁরা লেখেন, তাঁদের কথা যা এত দিন লেখা হয়নি। নিত্যদিনের লাঞ্চনা, দলিত হওয়ার বঞ্চনা, লাঞ্চিত হওয়ার যন্ত্রনা, অমর্যাদা, অপমান ও অবজ্ঞার গ্লানি, এবং অযৌক্তিক প্রথা ও Prejudice এর বিরুদ্ধে তাঁরা সোচ্ছার হন। তাই তাঁরা গল্প, কবিতা, উপন্যাস, আত্মজীবনী ও গবেষণা মূলক প্রবন্ধে নিজেদের কথা অবলীলায় বলে চলেছেন। আবার তাঁরা লেখেন দলিতদের হয়ে অন্য দলিতদের কথা। অর্থাৎ দলিত লেখনীগুচ্ছ হল “of the Dalits, on the Dalits by the Dalits through creative writings, autobiographies and researches.”

যাইহোক, দলিত প্রতর্কের যে প্রশ্নটি আমাকে সবচেয়ে ভাবিয়েছে সেটি হল দলিত প্রতর্কের দলিত লেখকরা কখন লেখেন? তাঁরা কি সময় পেলেই লেখেন? না কি তাঁদেরও লেখার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। তাঁরা কি যখন নির্যাতিত হচ্ছেন তখন লিখছেন না যখন তাঁরা সামাজিক আঘাত পেড়িয়ে এসে লিখছেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি দেখেছি  যে, উৎকৃষ্টমানের দলিতপন্থী লেখাগুলোর বেশিরভাগ সৃষ্টি হচ্ছে যখন তাঁরা নিজেদের কথাগুলোকে প্রকাশ করার পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছেন অথবা তাঁরা মনে করেছেন তাঁদের নিজের বক্তব্যগুলো তুলে ধরার উপযুক্ত সময় এসেছে। দলিতপন্থী লেখকগণ যখন লিখছেন তখন তাঁরা আর নিম্নবর্গীয় (Subaltern) থাকছেন না কারণ তাঁরা লাঞ্চনার সময়কে ইতিমধ্যেই অতিক্রম করেছেন। বাংলার ক্ষেত্রে প্রসঙ্গত বলা যায়-- যে সমস্ত দলিত আত্মজীবনীমূলক লেখাগুলো আমাদের নজরে এসেছে তার প্রায় সবকটিই আত্মজীবনীকারদের জীবনের শেষ প্রান্তে এসে লেখা। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তাঁরা কেবলমাত্র জীবন সায়াহ্নে উপস্থিত হয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। বরং আমরা লক্ষ করি নবীন দলিত কবি, সাহিত্যিক বা গবেষক-শিক্ষক লিখতে থাকেন তাঁদের মনে জেগে ওঠা প্রশ্নগুলিকে সমাজের বুকে ছুড়ে দিতে।

তবে লেখাগুলো যখনই সৃষ্টি হোক না কেন বাস্তবে দলিতদের লেখা প্রকাশ করা খুব কঠিন ব্যাপার। তথাকথিত অভিজাত প্রকাশক বা প্রতিষ্ঠান কখনই দলিতদের প্রথম দিকের লেখা প্রকাশে আগ্রহী হন না । তাই দলিতদের প্রথম দিকের লেখা প্রকাশ করতে খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হতো/হয়। স্বভাবতই প্রকাশনার অভিজ্ঞতার অভাবের জন্য তাঁদের লেখাগুলোতে মুদ্রন-জনিতত্রুটিসহ নানাবিধ অবাঞ্ছিত প্রমাদ থেকে যায়। এই ত্রুটি তাঁদের প্রাথমিক স্তরের লেখাগুলোকে সর্বজন্যগ্রাহ্য করে তোলার পক্ষে বড় বাধার সৃষ্টি করে।

কিন্তু তাঁদের সব লেখাই মূদ্রন জনিত ত্রুটির শিকার হয় না। বরং ছোট প্রত্রিকা, সাময়িক পত্র পত্রিকা বা উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত ম্যাগাজিন বা স্মরনিকায় প্রকাশিত অনেক সৃজনশীল লেখাই পরবর্তীকালে পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়। একবার সমাদৃত হলে তথাকথিত অভিজাত প্রকাশক-ব্যবসায়ীগণ দলিতদের লেখা প্রকাশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমরা এখানে একটা উদাহরণ তুলে ধরছি। ধরা যাক অদ্বৈত মল্লবর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’এর কথা। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪০ দশকে ‘মোহম্মদী’ প্রত্রিকায় একটি ধারাবাহিক হিসাবে। পুর্ণাঙ্গ উপন্যাস হিসাবে এটি প্রকাশিত হয় অদ্বৈতর মৃত্যুর পরে। ১৯৯০ এর দশকে দলিত প্রতর্কের বিকাশের সময় ক্যলিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বার্কলে) থেকে এর ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়।  অর্থাৎ অদ্বৈতের জীবদ্দশায় তাঁর মূল্যবান সৃষ্টি প্রকাশের জন্য জগৎ সংসারের প্রতিষ্ঠিত কোন প্রকাশক এগিয়ে আসেননি। কিন্তু আজকে তাঁর লেখার অনুবাদ প্রকাশিত হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে। একইভাবে অন্যান্য দলিত লেখকদের রচনাও অভিজাত প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হচ্ছে বাজার জনিত চাহিদাপূরণ তথা জ্ঞানচর্চার নতুন দিগন্তে নতুনভাবে পুরানো বিষয়কে ব্যাখ্যা করার তাগিদ থেকে।

দলিত প্রতর্কের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এর ‘গ্রহনযোগ্যতার’ প্রশ্ন। দলিত সাহিত্য যখন দলিত সংস্থা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে তখন অ-দলিত পাঠক তাকে কিভাবে গ্রহণ করেছেন? দলিত সাহিত্য স্বাভাবিকভাবেই তথাকথিত অ-দলিত/ প্রভাবশালী গোষ্ঠির কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠছে না। এমনকি কোন একটি দলিত গোষ্ঠির সাহিত্যিক প্রয়াস অন্য গোষ্ঠির কাছেও সমাদৃত হচ্ছে না। তাই দলিতরা নিজেই তাঁদের প্রাথমিক স্তরের সাহিত্যিক প্রয়াসের মূল পাঠক। কিন্তু দলিত সাহিত্যের যে সব সৃষ্টির নন্দনতত্ব, সর্ব্বজনীন আবেদন ও চিন্তাচেতনায় অনেকবেশি বৃহত্তর বা অন্ন্য তাদের পরিমার্জিত রূপ দলিত–অ-দলিত নির্বিশেষে বৃহত্তর পাঠক সমাজে স্থান করে নিচ্ছে। এটা সম্ভব হচ্ছে অ-দলিত গবেষক ও শিক্ষকদের উদ্দ্যোগে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে দলিতচর্চার হাত ধরে। ফলে লক্ষ করা যায় দলিত সাহিত্য প্রাথমিক স্তরে দলিতদের মধ্যে অথবা তাদের নিকট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলেও দলিত-চর্চার সূত্র ধরে তা ক্রমশ বৃহৎ আকার ধারণ করে। তাই এক্ষেত্রে ‘দলিতপন্থী’ রচনা ও ‘দলিতচর্চা’ পরস্পরের পরিপূরক!

ড. রূপ কুমার বর্মণ, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও  আম্বেদকর চর্চা কেন্দ্রের সমন্বয়ক ।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;