শর্টলিস্ট নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, ৩ নভেম্বর ‘ম্যান বুকার‘ পুরস্কার ঘোষণা



সাঈদ চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

২০২১ সালের বুকার প্রাইজ় নিয়ে বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গনে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। নোবেল পুরস্কারের পরই ’বুকার প্রাইজ ফর ফিকশন’ সবচেয়ে আলোচিত এবং সম্মানীত। ফলাফল ঘোষণার ক্ষেত্রে যথার্থ যাচাই-বাছাই এবং অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।

বৃটেন সহ দুনিয়াব্যাপী লেখক-পাঠকরা কারো কারো নাম প্রস্তাব করে থাকেন। জনগুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সমূহ থেকে প্রথমে লংলিস্ট এবং পরে শর্টলিস্ট হয়। সবশেষে নির্বাচকদের বিচারে চূড়ান্ত বিজয়ীর নাম ঘোষিত হয়। আগামী ৩ নভেম্বর জানা যাবে কে হলেন বুকারজয়ী সৌভাগ্যবান।

প্রতি বছরের মত এবারো কর্তৃপক্ষ অসংখ্য বই থেকে বাছাই করে একটি তালিকা তৈরী করেন। এবার ১৩টি বই নিয়ে ‘লংলিস্ট’ বা দীর্ঘ তালিকা হয়। তারা আরো অনেক যাচাই-বাছাই শেষে এখন শর্টলিস্ট বা সংক্ষিপ্ত তালিকা করেছেন। ছ’টি উপন্যাস আছে এই শর্টলিস্টে।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর তারিখে ঘোষিত লিস্ট মোতাবেক কাঙ্ক্ষিত প্রাইজের জন্য লড়াই হয় ১৩ জন লেখকের ১৩টি বই। এরমধ্যে ২০১৭ সালে সাহিত্য নোবেল এবং ১৯৮৯ সালে বুকার পুরস্কার বিজয়ী জাপানি লেখক স্যার কাজুও ইশিগুরো ছিলেন দীর্ঘ তালিকায়। তার ‘ক্লারা এন্ড দ্য সান’ বইটি ছিল বিশেষ বিবেচনায়। ২০১৯ সালে পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী আমেরিকান লেখক রিচার্ড পাওয়ার্স-এর ‘বিউইল্ডারমেন্ট’ রয়েছে পুরস্কারের তালিকায়। তিনি ১৯৯১ সালে টাইম ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা বই পুরস্কার অর্জন করেন।

 ব্রিটিশ-ভারতীয় লেখক সঞ্জীব সাহোতার ‘চায়না রুম’ দীর্ঘ তালিকায় জায়গা করে নেয়। তার ‘দ্য ইয়ার অব দ্য রানআওয়েজ’ ২০১৫ সালের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল। কানাডীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক র্যাচেল কাস্কের ‘সেকেন্ড প্লেস’ এবারের দীর্ঘ তালিকায় স্থান পেয়েছে। ২০০৫ সালে তার ‘ইন দ্য ফোল্ড’ এই তালিকায় ছিল।

শ্রীলংকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট তামিল ঔপন্যাসিক অনুক অরুদপরগসম-এর ‘আ প্যাসেজ নর্থ’ বইটি তালিকাভুক্ত হয়েছে। তিনি দক্ষিণ এশীয় সাহিত্যের ডিএসসি পুরস্কার জিতেছেন। ব্রিটিশ-সোমালি লেখক নাদিফা মোহামেদের ‘দ্য ফরচুনম্যান’, আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও কবি প্যাট্রিকা লকউডের ‘নো ওয়ান ইজ টকিং অ্যাবাউট দিস’, মার্কিন লেখক ম্যাগি শিপস্টিডের ‘গ্রেট সার্কেল’, দক্ষিণ আফ্রিকার ডেমন গ্যালগাট এর ‘দ্য প্রমিস’ তালিকায় আছে। ২০০৩ সালে তার ‘দ্য গুড ডক্টর’ এবং ২০১০ সালে ‘ইন এ স্ট্র্যাঞ্জ রুম’ সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল। 

কানাডীয় উপন্যাসিক ম্যারি লসনের ‘দ্য টাউন কল্ড সোলাস’ এবার দীর্ঘ তালিকায় স্থান পেয়েছে। ২০০৬ সালে তার ‘দ্য আদার সাইড অব দ্য ব্রিজ’ দীর্ঘ তালিকায় ছিল। এই তালিকায় আরো আছে মার্কিন লেখক নাথান হ্যারিসের ‘দ্য সুইটনেস অব ওয়াটার’, দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক ক্যারেন জ্যানিংসের ‘অ্যান আইল্যান্ড’, এবং ব্রিটিশ লেখক ফ্রান্সিস স্পাফর্ডের ‘লাইট পার্পেচুয়াল’।

অবশেষে ছ’টি উপন্যাস শর্টলিস্ট হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার সাহিত্যিক ড্যামন গ্যালগাট-এর দ্য প্রমিস, আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও কবি প্যাট্রিসিয়া লকউড-এর নো ওয়ান ইজ় টকিং আবাউট দিস, আমেরিকান ঔপন্যাসিক রিচার্ড পাওয়ার্স-এর বিউইল্ডারমেন্ট, শ্রীলঙ্কার অনুক অরূদপ্রগসম-এর আ প্যাসেজ নর্থ, ব্রিটিশ-সোমালি সাহিত্যিক নাদিফা মোহামেদ-এর দ্য ফরচুন মেন এবং আমেরিকান ঔপন্যাসিক ম্যাগি শিপস্টেড-এর গ্রেট সার্কেল।

এবছরের বিচারক কমিটির প্রধান হয়েছেন ইতিহাসবিদ মায়া জেসনফ। বুকার বিজয়ী পাবেন ৫০ হাজার পাউন্ড। বাংলাদেশী হিসেবে প্রায় ৫৯ লাখ টাকা।

‘ম্যান বুকার‘ বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম মর্যাদা সম্পন্ন পুরস্কার। বিগত এক বছরে প্রকাশিত পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের উপন্যাস থেকে বাছাই করা শ্রেষ্ঠটি এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। ১৯৬৯ সাল থেকে এই পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। এক সময় শুধুমাত্র কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশ এবং আয়ারল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ২০০৫ সাল থেকে এই পুরস্কার আন্তর্জাতিক ভাবে বিশ্বময় সম্প্রসারিত হয়েছে। 

৫২তম বুকার পুরস্কার বিজয়ীর নাম ১৯ নভেম্বর ২০২০ তারিখে ঘোষণা হল। সেরা হাসি হাসলেন স্কটিশ-আমেরিকান লেখক ডগলাস স্টুয়ার্ট। বিশ্ব সাহিত্যে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হল। তার ‘ শুগি বাইন‘ সেরা হিসেবে বেছে নিলেন বুকার পুরস্কার কমিটির বিচারক মন্ডলী। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে তিনি এই মর্যাদা সম্পন্ন পুরস্কার পেলেন। বিজয়ী ঘোষণার পর তার হাতে স্মারক তুলে দেন প্রধান বিচারক মার্গারেট বাসবি। প্রদান করা হয় ৫০ হাজার ইউরোর অর্থমূল্য। বারাক ওবামা, মার্গারেট অ্যাটউড সহ বিশ্ব বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা শুভেচ্ছা পাঠান স্টুয়ার্টের উদ্দেশ্যে।

২০২০ বুকার পুরস্কারের মনোনয়নের তালিকায় ছিল- দ্য নিউ ওয়াইল্ডারনেসের জন্যে ডায়ান কুক, এই মরনোয়ল বডির জন্যে সিৎসি ডাঙ্গারেমবাগা, বার্ন সুগার‘র জন্যে অবনী দোশি, হু দে ওয়াজ‘র জন্য গ্যাব্রিয়েল ক্রাউজে, মিরর এবং দ্য লাইট‘র জন্যে হিলারি মন্টেল, অ্যাপিরোগন‘র জন্য কলম ম্যাকক্যান, শ্যাডো কিং এর জন্যে মাজা মেনগিস্টের, সাচ আ ফান এজ‘র জন্যে কাইলি রেইড, রিয়েল লাইফ‘র জন্যে ব্র্যান্ডন টেইলার, রেডহেড বাই দ্য সাইড অফ দ্য রোড‘র জন্যে অ্যানি টেলার, শুগি বাইন‘র জন্যে ডগলাস স্টুয়ার্ট, লাভ অ্যান্ড আদার থট এক্সপেরিমেন্ট‘র জন্যে সোফি ওয়ার্ড, হাউ মাচ অফ দিজ হিলস ইস গোল্ড‘র জন্যে সি পাম জাং।

পুরস্কার জেতার পর স্টুয়ার্ট মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। নিজের মাকে প্রাণময় ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, উপন্যাসের পরতে পরতে মা সম্পর্কে আমি পরিষ্কার করে বলেছি। তাকে ছাড়া এখানে আসতে পারতাম না। আমার কাজ কোন ভাবেই এখানে পৌঁছাত না। মাত্র ১৬ বছর বয়সে মাতৃ বিচ্ছেদের যন্ত্রনাকে অনুভব করেছিলেন স্টুয়ার্ট। অকালে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়া মাকেই নিজের লেখা প্রথম উপন্যাস উৎসর্গ করেছেন এই স্কটিশ লেখক। মা-ই ছিলেন তার সব থেকে কাছের মানুষ। মায়ের মাদকাসক্তি বেড়েই চলেছিল দিনের পর দিন। বার বার বুঝিয়েও লাভ হয়নি কোনো। ভেতর ভেতর অ্যালকোহল তাকে নিশ্চুপেই ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। ‘শুগি বাইন‘ উপন্যাসে ওঠে এসেছে তার বেড়ে ওঠা আর নিজের জীবনের অসংখ্য স্মৃতি। মিশে আছে মায়ের মৃত্যু যন্ত্রণা, তার মূল্যবোধ, সামাজিক বেড়াজাল, উত্থান-পতনের কথা। রয়েছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার এক হৃদয়ভেদী আখ্যান। 

গ্লাসগোতে বেড়ে ওঠা স্টুয়ার্ট তার জন্মভূমি স্কটল্যান্ডবাসীকেও ধন্যবাদ জানান। বিশেষ করে গ্লাসগোর অধিবাসীদের। তিনি বলেন, গ্লাসগোবাসী মানুষের সহানুভূতি, রসবোধ, প্রেম ও সংগ্রাম এই বইয়ে মূল কেন্দ্রবিন্দু। গ্লাসগো স্কটল্যান্ডের বৃহত্তম এবং যুক্তরাজ্যের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। এটি গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের উত্তর দিকের এক তৃতীয়াংশে অবস্থিত। এর দক্ষিণ-পূর্বে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ৯৬ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত, উত্তর ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর, উত্তর-পূর্বে উত্তর সাগর এবং দক্ষিণে আইরিশ সাগর অবস্থিত। মূল ভূখন্ড ছাড়াও দেশটির অনেক দ্বীপ রয়েছে। এক সময়কার বিশ্বের নেতৃস্থানীয় শিল্প শহর ছিল। স্কটিশ পানি সীমা উত্তর আটলান্টিক এবং উত্তর সাগর বেষ্টিত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বৃহত্তম তেল মজুদ এরিয়া। এজন্যই গ্লাসগো ও অ্যাবরদিনকে স্কটল্যান্ড তৃতীয় বৃহত্তম শহর এবং ইউরোপের তেল রাজধানী বলা হয়।

ম্যান বুকার বিজয়ী ডগলাস স্টুয়ার্ট ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে এখন নিউইয়র্কে বসবাস করেন। গত দুই দশকে তিনি কাজ করেছেন কেলভিন ক্লেইন, বানানা রিপাবলিক, জ্যাক স্পেড প্রভৃতি বহুজাতিক সংস্থায়। রয়্যাল আর্ট কলেজ থেকে স্নাতক করার পরই তিনি পাড়ি দিয়ে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। ২৪ বছর বয়স থেকেই থাকেন নিউইয়র্ক শহর। এ বছরেই তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘লক অ’ শেষ করেছেন, যার পটভূমি গ্লাসগো ঘিরেই গড়ে উঠেছে। 

এ পর্যন্ত ম্যান বুকার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বিশ্বখ্যাত অনেক লেখক। ১৯৬৯ সালে যুক্তরাজ্যের পি. এইচ. নিউবি - সামথিং টু আনসার ফর উপন্যাস, ১৯৭০ সালে যুক্তরাজ্যের বার্নিস রুবেনস- দ্য ইলেক্টেড মেম্বার উপন্যাস, ১৯৭১ সালে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর ভি এস নাইপল- ইন অ্যা ফ্রি স্টেট ছোটগল্প, ১৯৭২ সালে যুক্তরাজ্যের জন বার্গার- জি উপন্যাস, ১৯৭৩ সালে যুক্তরাজ্য আয়ারল্যান্ডের জেমস গর্ডন ফারেল- দ্য সেইজ অফ কৃষ্ণপুর উপন্যাস, ১৯৭৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার নাডিন গর্ডিমার- দ্য কনজারভেশনিস্ট উপন্যাস ও যুক্তরাজ্যের স্ট্যানলি মিডলটন- হলিডে উপন্যাস, ১৯৭৫ সালে যুক্তরাজ্যের রুথ প্রয়ার ইয়াবভালা- হিট অ্যান্ড ডাস্ট  উপন্যাস , ১৯৭৬ সালে যুক্তরাজ্যের  ডেভিড স্টোরি- স্যাভাইল উপন্যাস,  ১৯৭৭ সালে যুক্তরাজ্যের পল স্কট- স্টেয়িং অন উপন্যাস, ১৯৭৮ সালে যুক্তরাজ্যের আইরিশ মুরডক- দ্য সী, দ্য সী উপন্যাস।

১৯৭৯ সালে যুক্তরাজ্যের পেনেলোপে ফিটজেরাল্ড- অফশোর দর্শনতাত্ত্বিক উপন্যাস, ১৯৮০ সালে যুক্তরাজ্যের উইলিয়াম গোল্ডিং- রায়টস অফ পেসেজ উপন্যাস, ১৯৮১ সালে ভারতের সালমান রুশদি- মিডনাইট চিলড্রেন উপন্যাস, ১৯৮২ সালে অস্ট্রেলিয়ার  থমাস কেনিলি- শিন্ডলার্স আর্ক জীবনী উপন্যাস,  ১৯৮৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার  জন ম্যাক্সওয়েল কুতসি লাইফ অ্যান্ড টাইম অফ মাইকেল কে উপন্যাস, ১৯৮৪ সালে যুক্তরাজ্যের আনিতা ব্রুকনার- হোটেল ডু লাক উপন্যাস, ১৯৮৫ সালে নিউজিল্যান্ডের  কেরি হুম- দ্য বোন পিপল রহস্য উপন্যাস, ১৯৮৬  কিংস্লে অ্যামিস- দ্য ওল্ড ডেভিলস্ কমিক উপন্যাস, ১৯৮৭ সালে যুক্তরাজ্যের পেনেলোপে লাইভলি- মুন টাইগার উপন্যাস, ১৯৮৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার  পিটার কেরি- অস্কার অ্যান্ড লুসিন্ডা ঐতিহাসিক উপন্যাস।

১৯৮৯ সালে যুক্তরাজ্যের জাপানী কাজুও ইশিগুরো- দ্য রিমেইনস অফ দ্য ডে ঐতিহাসিক উপন্যাস, ১৯৯০ সালে যুক্তরাজ্যের এ. এস. বায়াত- পজেসন: অ্যা রোমান্স ঐতিহাসিক উপন্যাস, ১৯৯১ সালে নাইজেরিয়ান বেন ওকরি- দ্য ফ্যামিস্ড রোড উপন্যাস, ১৯৯২ সালে কানাডার মাইকেল ওন্ডাৎজি- দ্য ইংলিশ পেশেন্ট ও  যুক্তরাজ্যের        ব্যারি উন্সওর্থ- স্যাক্রেড হাঙ্গার ঐতিহাসিক উপন্যাস, ১৯৯৩ সালে যুক্তরাজ্য আয়ারল্যান্ডের রডি ডয়েল- প্যাডি ক্লার্ক হা হা হা উপন্যাস,  ১৯৯৪ সালে যুক্তরাজ্যের জেমস কেলম্যান- হাউ লেট ইট ওয়াজ, হাউ লেট উপন্যাস, ১৯৯৫ সালে যুক্তরাজ্যের প্যাট বার্কার- দ্য গোস্ট রোড যুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস, ১৯৯৬ সালে যুক্তরাজ্যের গ্রাহাম সুইফট লাস্ট অর্ডারস্ উপন্যাস, ১৯৯৭ সালে ভারতের অরুন্ধতী রায়- দ্য গড অফ স্মল থিংস উপন্যাস, ১৯৯৮ সালে যুক্তরাজ্যের ইয়ান ম্যাক্ইউয়ান- অ্যামস্টারডাম উপন্যাস।

১৯৯৯ সালে  দক্ষিণ আফ্রিকার জন ম্যাক্সওয়েল কুতসি- ডিসগ্রেস উপন্যাস, ২০০০ সালে কানাডার মার্গারেট অ্যাটউড- দ্য ব্লাইন্ড অ্যাসাসিন ঐতিহাসিক উপন্যাস, ২০০১ সালে যুক্তরাজ্যের পিটার কেরি- ট্রু হিস্ট্রি অফ দ্য কেলি গ্যাং ঐতিহাসিক উপন্যাস, ২০০২ সালে কানাডার ইয়ান মার্টেল- লাইফ অফ পাই রোমাঞ্চকর উপন্যাস, ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার ডিবিসি পিঁয়ের- ভার্নন গড লিটল ব্ল্যাক কমেডি, ২০০৪ সালে যুক্তরাজ্যের অ্যালান হলিংঘার্স্ট- দ্য লাইন অফ বিউটি ঐতিহাসিক উপন্যাস, ২০০৫ সালে যুক্তরাজ্য আয়ারল্যান্ডের জন ব্যানভিল- দ্য সী উপন্যাস, ২০০৬ সালে ভারতের কিরণ দেশাই- দ্য ইনহেরিটেন্স অফ লস উপন্যাস, ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্য আয়ারল্যান্ডের অ্যান এনরাইট- দ্য গেদারিং উপন্যাস, ২০০৮ সালে ভারতের অরবিন্দ আদিগা- দ্য হোয়াইট টাইগার উপন্যাস।

২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যের হিলারি ম্যান্টেল- উলফ হল ঐতিহাসিক উপন্যাস, ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের হাওয়ার্ড জ্যাকবসন- দ্য ফিঙ্কলার কোশ্চেন উপন্যাস, ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যের জুলিয়ান বার্নস- দ্য সেন্স অফ অ্যান এন্ডিং উপন্যাস, ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের হিলারি ম্যান্টেল- ব্রিং আপ দ্য বডিজ উপন্যাস, ২০১৩ সালে নিউজিল্যান্ডের এলিয়ানর ক্যাটন- দ্য লুমিনারিজ উপন্যাস, ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার রিচার্ড ফ্লানাগান- দ্য ন্যারো রোড টু দ্য ডিপ নর্থ উপন্যাস, ২০১৫ সালে জ্যামাইকার মারলন জেমস- অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অফ সেভেন কিলিং উপন্যাস, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পল বিটি- দ্য সেলআউট ব্যঙ্গধর্মী উপন্যাস, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ সান্ডার্স- লিংকন ইন দ্য বার্ডো ঐতিহাসিক উপন্যাস, ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের অ্যানা বার্নস- মিল্কম্যান উপন্যাস, ২০১৯ সালে কানাডার মার্গারেট অ্যাটউড- দ্য টেস্টামেন্টস উপন্যাস ও যুক্তরাজ্যের বার্নার্ডাইন এভারিস্টো- গার্ল, উইমেন, আদার উপন্যাস।

বাংলাদেশী পাঠকের কাছে ‘ম্যান বুকার‘ পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচিতদের মধ্যে রয়েছেন, ২০০১ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত লেখক স্যার ভিএস নাইপল। ‘ইন আ ফ্রি স্টেট’ এর জন্য তিনি ম্যান অব বুকার অর্জন করেন। পিস অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে ডেভিড গ্রুসম্যানকে সবাই চিনে। ব্যতিক্রমী একটি উপন্যাস লিখে ২০১৭ সালে বুকার প্রাইজ লাভ করেন তিনি।  ২০১০ সালে ফিলিস্তিনি এলাকায় ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে অবস্থান ও বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। পুলিশের হাতে মারও খেয়েছেন ইসরায়েলের লেখক ও মানবাধিকার কর্মী ডেভিড গ্রুসম্যান।

অরুন্ধতী রায় ভারতীয় ঔপন্যাসিক, বুদ্ধিজীবী এবং পিস অ্যাকটিভিস্ট। তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে আছেন তার উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ এর জন্য। ১৯৯৭ সালে উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী হৈচৈ পড়ে যায়। ১৯৯৮ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার লাভ করেন উপন্যাসটির জন্য। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি পরিবেশগত সংশ্লিষ্টতা এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়েও কাজ করেন। ভারতের আসাম রাজ্যের শিলংয়ে অরুন্ধতী জন্মগ্রহণ করেন।

সালমান রুশদি একজন ব্রিটিশ ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তার দ্বিতীয় উপন্যাস মিডনাইটস চিলড্রেন ১৯৮১ সালে বুকার প্রাইজ অর্জন করে। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তার লেখা জঘন্য বিতর্কিত বই স্যাটানিক ভার্সেস বিশ্বের অনেক দেশেই নিষিদ্ধ। বইটি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে। এর প্রতিবাদ হয় বিশ্বের সকল মুসলিম দেশে। বাংলাদেশে সহ বিভিন্ন দেমে বইটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে।

আরব বিশ্বের প্রথম সাহিত্যিক হিসেবে ২০১৯ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার জিতেছেন জোখা আলহারথি। মাতৃভূমি ওমানের রূপান্তর বিষয়ক উপন্যাস ‘সেলেস্টিয়াল বডিস’র জন্য এই পুরস্কার লাভ করেন তিনি। বৈচিত্র্যময় আরব সংস্কৃতির নতুন দ্বার উন্মোচন হয়েছে এই উপন্যাসে। বিচারকরা আলহারথির ঐশ্বর্যময় কল্পনাশক্তি, লেখার চিত্তাকর্ষক শৈলি এবং কাব্যিক অন্তর্দৃষ্টির প্রশংসা করেন। উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে আল-আওয়াফি গ্রামকে ঘিরে। একটি সনাতনী সমাজ থেকে ঔপনিবেশ-উত্তর যুগে যে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল ওমান, তিন বোনের মাধ্যমে সেই পরিবর্তন, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ওমানিরা কীভাবে এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে তা দেখাতে চেয়েছেন জোখা আলহারথি।

লেখক: লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক।

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;