একলা একলা আকার



দেবদুলাল মুন্না, অতিথি লেখক
অলংকরণ ও সম্পাদনা: রুদ্র হক

অলংকরণ ও সম্পাদনা: রুদ্র হক

  • Font increase
  • Font Decrease

‘সাব-লেট যারা দেন তারা মাঝারি অসহায় । যারা সাব-লেট নিন তারা প্রান্তিক। ফলে এই দুই অসহায় পক্ষের মালিক বাড়িমালিক। আবার ভাড়াটে ও সাব-লেট নেনেওয়ালা না থাকলে মালিক অসহায়। এটিকে একটি স্পেসকে নিয়েও দ্বন্ধ। সপ্তদশ শতাব্দীতে প্যারিসের লুঁগে শহরে সাব-লেট সংক্রান্ত একটি মামলায় বলা হয়েছিল, ইহা আপাত স্থানসংকুলানের জন্য মানবিক মনে হলেও খুব ঝুঁকিপূর্ণ সহাবস্থান।’
-সেভেন লেটার্স ডাউন মেমোরি: মন্টেস্কু

এক

পুরোটাই খেলা। আমি দেখছিলাম ব্রা। কালো। বেশ আটসাট করে জড়ানো তাবুর শরীরে। এবার আস্তে আস্তে হাতুড়ি গাঁইতি নিয়ে এগোলাম। টুকরোগুলো খুলি। নগ্ন নারী শরীরের স্তনকে কতভাবে ভেবেছি। কিন্তু ‘বাস্তবে এই প্রথম। আচ্ছা এভাবেওতো ভাবা যায় ব একটা র-ফলা পরে আছে। গ্রেট, তার মানে এভাবে বলা যায় যে র-ফলা পরে ফেললেই বিতর্কিত হয়ে ওঠে বা"- এটা তো ডিকন্সট্রাকশান এবং লিটারেল থিংকিং এর প্রথম ভাগ।

এটা একটা দেখাপদ্ধতি , আমরা কি দেখতে পারি একটা ত্রিভুজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার আকার, ত্রিভুজের সাথে ডিভোর্স তাই সে ত্রিভুজাকার নয়? ত্রিভুজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার একলা আকার... এইসবই কিন্তু র-ফলা ছাড়িয়ে নেওয়া অবিতর্কিত বা এর সন্তান... বা, আমরা কি এমন কোন দিকে যেতে পারি যেখানে র-ফলা কে ঢেউ বা তরঙ্গ’র মতো দেখি। ভাবি, বক্ষবন্ধনী থেকে তরঙ্গ খুলে নিলে দুইটি স্তনের মাঝে অপশান জেগে ওঠে।

তাবু জানতে চায়, এ আদরের সময়ও তুমি কি ভাবো ?
বলি, ধরো যদি তোমার উপরে আমি মারা যাই হঠাত, তখন কি হবে ? পুলিশ, মামলা কি করে তুমি হ্যান্ডলিং করবে বা পালাবে আমার লাশ ফেলে?
তাবুর মনে হলো বিছানাটা কেমন যেন আর্দ্র আর্দ্র লাগছে। এক ঝটকায় কাঁথাটা সরিয়ে দিতেই বিস্ফারিত চোখে সে তাকাল বেডশিটের উপর। রক্তজবার মতো লালরক্তে ভিজে আছে বিছানার মাঝখানটা। সমস্ত চাদরটা যেন দেখাচ্ছে জাপানের পতাকার মতো। রাতে তার রজস্বলা হয়েছে সে টেরই পায়নি। আজ তো ঋতুস্রাব হওয়ার কথা নয়। ধার্য তারিখ আরো দু’দিন পর। জলের স্রোতের মতো এমন রজোদর্শনে খানিকটা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে তাবু।

সে জানতে চায় এ অবস্থায় আমি তার ভুবনে যেতে চাই কিনা। আমি বলি, তুমি তো আমার কাছে সাব-লেটের মতো ছিলে। মালিক ছিল তোমার স্বামী। আমি প্রেমিক। আমি তোমার মন ও শরীর ভাড়া করেছিলাম প্রেমের দেনমোহরে। কিন্তু আমারই জন্যে তোমার সংসার ভাঙবে, তুমি সত্যি ইন্দিরা রোডে একটা বাসায় সাবলেট নিয়ে একা একা থাকবে, আমি ভাবিনি কোনোদিন।

এসব বলার সময় আমি আবারও তার তলপেটে ত্রিভুজাকারের একটি কোণ দেখি। কিছু ঘাস। আর রক্তপাত। আমি তার ভেতরে যেতে যেতে ভাবি,না , আর কখনো কোথাও বিপ্লব বা প্রতিবিপ্লব হবে না,এখন সব যেন একলা একলা আকার। অন্যরকম খেলা। গ্র্যান্ড ম্যাটা ন্যারেটিভলেসের। তাবু তবু কিসব জানি বলতে থাকে। বসন্ত তুমি আর এসো না এটি তো বলা যায় না। বলা গেলেও সে আসবে।

পাওলো কোয়েলহোর একটা উপন্যাস আছে। নাম, ইলাভেন মিনিট। এটির গল্প তাবু আজ আসার পরই শুনিয়েছি। মুভি হয়েছে এটি। তাবু কয়েকদিন আগে দেখেছে জানালে আমার মনে পড়ে সব। সেখানে মারিয়া নামের যৌনকর্মী এক জায়গায় ভাবছে বা বলা যায় ডায়েরিতে লেখছে : আমি আবিষ্কার করেছি কী কারণে একজন পুরুষ একজন মহিলাকে টাকা দেয়। সে সুখী হতে চায়। শুধুমাত্র অর্গ্যাজম পাওয়ার জন্য সে এক হাজার ফ্রাংক দেয় না। সে সুখী হতে চায়। আমিও চাই। সবাই চায়। অথচ কেউ সুখী নয়। আমার কী হারাবার আছে, যদি কিছুক্ষণের জন্য আমি ঠিক করি আমি হব একজন ‘ ’।

তার রেগুলার কাস্টমার বা প্রেমিক র্যালফের সঙ্গে কিছু আলাপ:
মারিয়া:একজন বেশ্যার প্রেমে পড়লে কী করে?
র‌্যালফ : আমার মনে হয় এর কারণ, তোমার শরীর কোনোদিন আমার একার হবে না জেনে আমি মন দিয়েছি তোমার আত্মাকে জয় করাতে।
মারিয়া: তোমার ঈর্ষা হয় না? আমার কাছে তো অন্যরাও আসে?
র‌্যালফ : না। তুমি বসন্তকে বলতে পারো না, এখানে এসো আর যতদিন সম্ভব থাকো।
মারিয়া: মানে ?
র‌্যালফ : মানে হলো ১১ মিনিটই অসীম। তুমি তো স্থায়ী কারো না। তাই তোমাকে পাওয়ার ব্যাকুলতা। হয়তো অস্থায়ীকেই মানুষ নিজের অজান্তে বেশি ভালবাসে। ঠিক জানি না। এটাও উত্তর হতে পারে।
তাবু ওইসব আমাদের এডাল্ট সিনগুলো উপভোগ ও আমি ‘ইলেভেন মিনিট’ কাটানোর ঘোর কাটাতেই বুঝতে পারি সন্ধ্যা নামছে। তাবু ওয়াশরুমে যায়। ফ্রেশ হয়। শাড়ি পরে। আমিও সে যাহা আমি তাহা। এরপর তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য বিশ্বরোড পর্যন্ত এসে একটা স্কুটারে তোলে তাবুকে বিদায় দিই।

দুই

রোজেনের সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়েছে কতোবছর আগে ঠিক মনে নেই। সেটার হিসাব রাখতেও চাই না। রোজেন মাঝেমধ্যে ফোনকল দেয়। আমিও। আমাদের এখনও যোগাযোগের কারণ সন্তান । তুণা। তুণা এ লেভেল শেষ করে চেষ্টা করছে বাইরে পড়তে যাওয়ার। রোজেন একদিন আমাকে ফোনকল দেয়, বলে, তোমার মেয়েতো ডিপ্রেসনে ভুগতেছে। তার নাকি কিচ্ছু ভাল লাগে না। হাত ব্লেড দিয়া কাটছে। এতটুকু বলে লাইন কেটে দেয়।

আমি তুণাকে ফোন করি। সে ধরে না। ওইদিনই সন্ধ্যায় আমি রোজেনদের বাসায় যাই। নিজেকে মেহমান মনে হচ্ছিল। তুণাকে বলি , তোমার সমস্যা কী ? তুণা উত্তর দেয়, সমস্যা কী ? নাই তো! আমি তাকে যেন এখুনি হারিয়ে যাবে কিন্তু হারাতে দেবো না এমন ভয়ে খুব জোরেসোরে জড়িয়ে ধরি। সে ঘটনার আকস্মিকতায় একটু অপ্রস্তুত। আমি বুঝি ঠিক হচ্ছে না, বিয়িং ইজি। ওকে ছেড়ে দিয়ে দুহাত ধরে নেইলপালিশ দেখার ভান করে বলি, বাহ, সুন্দর রঙ তো।

আসলে দেখি তার বাম হাতের ব্লেডে কাটা ধীরে ধীরে লাল থেকে কালো হতে থাকা দাগগুলো। বলি, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। আসলে দেখি তার চোখ ভরা বিষন্নতা। রোজেন চাওমিন দেয়। আমি ও তুণা খাই। খাবার ফাঁকে তুণা হঠাৎ জানতে চায়, বাবা, তুমি কি এখনও মদ খাও ? ভাবি, খাইতো। কিন্তু তাকে এখন বলা ঠিক হবে কি! বলি খাই, খুব কম। মাসে এক বা দুইদিন।

এসব কথার মাঝেই তার হাউস টিউটর এলে তুণা পড়তে চলে যায় রিডিংরুমে। কিছুক্ষণ টিভি চ্যানেল সার্ফিং করি। রোজেন এলে এটা সেটা মানে দরকারি কথা বলি। এরপর কি মনে করে বলে ফেলি, তুণার জন্য আমাকে কি সাবলেট দিবে ? ওর ডিপ্রেসন কেটে গেলে বাইরে চলে গেলে আমিও চলে যাবো।’

রোজেনের এমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখি যেন বাংলা মুভির কোন সংলাপ আওড়াচ্ছি আমি। সে আমাকে বিদায় দেবার সময় এতো জোরে দরজা লাগায় সে শব্দটা চারতলা থেকে আমি নিচে নামার আগেই বাসার গেট পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। আমি সিড়ি দাপিয়ে নিচে নামতে থাকি এবং আমার মাঝে সেই প্রথম ইচ্ছা জাগে কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করুক। কিন্তু আমি জানি, বাস্তবতা হলো মানুষের জীবনে অপেক্ষার চেয়ে বড়ো কাজ হলো বহুপথে বারবার নিজের কাছে ফেরা।

বাসায় ফেরার পর রোজি ফোন করে জানায়, পরদিন দেখা করতে । পরদিন ধানমন্ডির সাতাশ নাম্বারের একটা রেস্তেরায় স্লাইডার ঠেলে রোজি ঢুকে । সোফার কোণে বসে ছিলাম। বসল মুখোমুখি। একটু সময় নিলো। মাঝে দুটি কফির মগ। আমি বললাম, 'দেখো রুচিবোধ চিরস্থায়ী কোনো ব্যাপার না। যার থাকে সে কুপমণ্ডুক। এটি তুমি ও না। আমি ও না। আমাদের মধ্যে অনেক কিছু হয়েছে। একটা ডিপ রিলেশন।

এটাকে কেউ প্রেম বলে। কিন্তু প্রেম বলো আর যাই বলো মানুষের রিলেশন তো স্থবিরতার শর্ত মেনে বেচেঁ থাকবে না। যদি বেচেঁ থাকে তবে সেটি ভণ্ডামি । অবশ্য জীবন একটু কপটতাকে ও এ্যালাও করে। অকপট হয়ে সমাজ সংসারে বেঁচে থাকা যায় না। এটাও তুমি জানো।'

এর বেশি কিছু বলিনি। বেরিয়ে যায় রোজি যা বোঝার সেটি বোঝে। কি বুঝেছে সেটি অবশ্যই আমার জানার কথা না। লাটিমের চক্কর। এই চক্রকে ঘিরে নাচে বাদর। মানুষের ভীড়। এরিমধ্যে হেটে যায় সবুজ টিয়া। রব উঠে, আমার নাম সুশান্ত। টিয়া যায় এগিয়ে। একটি হলুদ এনভেলাপ তোলে। ওই এনভেলাপ নেয় কারবারি। বলে যায় , ‘সুশান্ত ঘোষ, আপনার সামনে মহা বিপদ’।
এসব দেখতে দেখতে খবর পাই, রোজি আরেকজনের সঙ্গে প্রেম করছে। সরেছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। যেন ঘুরে বেড়ানোর জন্যই মন জন্মেছি আমরা। ঘুরেফিরে বলছি,‘নিঃসঙ্গতা মানে সঙ্গের অভাব নয়। নিঃসঙ্গতা আরো ব্যপ্ত এক ক্ষেত্র, এক কুয়াশাময় জগত। ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট। সেখানে ঢুকে যাওয়া সহজ, সেখান থেকে ফিরতে পারা সহজ নয়। মুখ বদলে গেলেও সঙ্গীর,থেকে যায় স্মৃতি। আই এ্যাম সিঙ্গেল বাট নট এলোন।’

রোজির সাথে আর আমার দেখা হয়নি। এখন শরতকাল। তবু বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরে বসে গান শুনি। কথাগুলো এমন,একটা কাঁচঘর। সেই কাঁচঘরে বসে তুমি ই ঢিল ছুড়ছো। ভেঙে পড়ছে তোমার চারপাশ। তুমি কি তোমার সব্বাইকে ভুলে গিয়েছ !

আসলে এসব যেনবা আমার সাজানো ফ্যান্টাসি। আমি একটা অন্যজগতে ঢুকে পড়েছি। বারবার যখন প্রেমে পরা কোনো নারীকে প্রত্যাখান করে ফিরে আসছি তখন যেন মনে হয়, রোজেন আমাকে যেভাবে ডিভোর্স দিয়ে প্রত্যাখান করেছিল সেসময়ের আমার যন্ত্রণা, বিষাদ সবটুকু সেসব নারীদের ভেতর দিয়ে আমি রোমেনকে ফেরত দিতে চাচ্ছি। এরকম খেলায় মেতে উঠা নিশ্চয়ই সুস্থতা না। অদ্ভুত একটা ব্যাপারও ঘটে, যেমন প্রেমে জড়ানোর সময় মনে হয় ঠিক ঠিক আশ্রয় চাইছি। কিন্তু কিছুকাল চলে যাওয়ার পর ওইসব প্রেমিকারাই আমার কাছে একঘেয়ে উঠে পড়ে কিনা আমি খুব ক্লিয়ার না। নাকি তুণার কথা মনে পড়ে বলে সরে আসি?

মনে হয় সেসব সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ঠিক আগে যেনবা তুণা আমাকে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনছে। আমার হাত’ পা মোটা রশি দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা। সারা শরীরে কালো বসন্তের দাগ। একমুখ চুল দাড়ি। চোখ ঘোলাটে।বিছুটি। আমাকে কোথাও থেকে নিয়ে হেটে হেটে ফিরছে তুণা। সে সামনে। আমি পেছনে। দেখা যায় এরপরও আমি তুণার কাছ থেকে ছিটকে পড়ে ফের ভুলপথে পা বাড়াচ্ছি।

তিন

সেই ভুল পথেই পা দেওয়াতেই কী তুণা ডিপ ডিপ্রেসনে যাচ্ছে ? আমিও তো খুব ছোটবেলা থেকে খালি পালাতেই চেয়েছি। কখনো প্লেনে করে, কখনো ট্রেনে, কখনো কালিঘাটের ট্যাক্টরে, কখনো বা ঘুমের ওষুধে, মদে, আবার কখনো অচেনা মানুষদের নিজের ঘরবাড়ি ভেবে নিয়ে। এভাবে পালাতে পালাতেই তো দুদিক থেকে দুজন মানুষ জড়ো হয়েছিল রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে। শ্রীমঙ্গলে। ট্রেনের দেরি। রোজেন আর আমি। এরপর আলাপ। ট্রেনে মুখোমুখি সিটে বসে যাত্রা।

ওহ আচ্ছা, রোজেন আপনার নাম? অর্থ কি? অর্থ হচ্ছে উপযুক্ত ? আধুনিক? অস্থির? নাকি আইনস্টাইনের ক্ষুদ্র বিবর ? আচ্ছা ওই ক্ষুদ্র বিবরটা কেমন ? সেই বিবর চিনতে চিনতে একসময় ঘরের মেঝেতে বিছানা। শিওরে লাল টেবিল ল্যাম্প। মাথার নিচে কার্লমার্কসের চারখন্ড ও কহলিল জিবরানের প্রফেট, এসবের ওপরে গোটা পাঁচেক ওড়না। কিন্তু তুণার জন্মের পরপরই তো পাল্টে গেল সব।

সেই তুণাই কি এখন প্রতিদিনের অন্ধকার ভেতরে নিয়েছে, অনেক ভেতরে। খুব যখন ছোট্ট ছিল, অন্ধকার ঘরে তাকে বন্ধ করে দেওয়া হত মজা দেখার জন্য। ওইটুকু মেয়ে, অন্ধকার ঘরে ভয় পায় না! কাঁদে না! যে কাঁদে না, সে কি ভয় পায় না? অনেক, অনেকদিন পর একদিন বলেছিল আমাকে, যে বলাগুলো বহুকাল ধরে গভীরে পুঁতে রাখা, শিকড় গজিয়ে গাছ হয়ে যাওয়া অভিজ্ঞতা খুঁড়ে বের করে আনা, যে ভয় তো পেত, খুব ভয় করত। কিন্তু কাঁদত না। কাঁদতে পারত না।

আসলে, বুঝতেই পারত না যে কাঁদা উচিৎ। ওসব সে শিখেওছিল দার্জিলিং এ মাউন্ট হারম্যান বোর্ডিং ইশকুলে যখন তাকে পড়তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ওই ছোট্টবেলা থেকেই তুণার একটা ভেতরকার জগৎ ছিল। একটা অন্য মাত্রার সত্যি, যা বাস্তবের মিথ্যে রাংতা-মোড়ক ঢাকা পৃথিবীতে খুলে দেখানো যায় না। খুব ছোট্ট ছোট্ট কিছু চাহিদা ছিল তার, কিছু পুঁচকে পুঁচকে আনন্দ, যার অধিকাংশই, অন্ধকারের স্বাভাবিক নিয়মে, কারো না কারো বাস্তবের বুটজুতো থেঁতলে দিয়েছে। সেই থেঁতলানো ইচ্ছেগুলোই অপু জমিয়ে রেখেছে তাও।

সহজে সে কিছু ফেলে দিতেও পারে না। নিজের পুরনো কাপড়, ডায়েরি, বলপ্যান , টর্চলাইট সবই। মনের ভেতরে যে বিশাল দিঘীটার বাস, সেখানে সবচেয়ে গহন জায়গাটায় কৌটোয় পুরে রাখা তুণার যে প্রাণভোমরা, তা আসলে এক সমুদ্রসমান মায়া। খালি চোখে দেখা যায় না, চশমা পরেও না। আমি হয়ত দেখি। বা দেখিনা। বা ওকে ঘিরেও রয়েছে হয়তোবা আমার ফ্যান্টাসি।

চার

তাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় ফেসবুকে। এরপর ঘনিষ্ঠতা। একদিন দেখাও হয়। তখন তার স্বামী আছে। সংসার আছে। ভালো চাকরি আছে। বাড়ি আছে। গাড়ি আছে। যা নেই সেটি হলো কোনো বন্ধু নেই। আর আমার, বন্ধু রাখার জায়গা নেই প্রায়। সন্ধেবেলা শিশির পড়ছে,শিল্পকলা একাডেমিতে ‘নিত্যপুরাণ’ নাটক দেখে আমি আর তাবু মাঠে বসে ছিলাম। সেদিনই প্রথম দেখা।

আমি বলি, ‘এত গল্প জমে আছে আমার কাছে, তুমি শুনতে শুনতে বোরড ফিল করবে না তো?’ সে হাসে। বলে, ‘একটু অদলবদল ছাড়া সব মানুষের আসলে একই গল্প। তুমি যেভাবেই বলো না কেন, চমকাব না। ঘোর লাগার সময় কেটে গেছে আমার। হয়তো সেজন্যই নির্বান্ধব। তড়িঘড়ি করে বলার কিছু নেই। আবার ধীরে আস্তে অনেক ভেবেও বলার কিছু নেই।’

আমি তাবু’কে মুগ্ধ করার জন্য বললাম, আচ্ছা, তোমার কি ওই গল্পটা জানা আছে যে এক বৃদ্ধ লোক নিজেকেই চিঠি লিখত ও পোস্টঅফিসে গিয়ে চিঠি পোস্ট করে চলে আসত। এরপর সেই চিঠির অপেক্ষায় থাকত। পিয়ন এসে চিঠি দিয়ে গেলে সে পড়ত। এভাবে একশো একুশটা চিঠি লিখেছিল প্রেরক ও প্রাপক হিসেবে।

তাবু বলে, জগৎ পুরনো। মানুষ নতুন। এ গল্প নতুন ভার্সন। পুরনোটা এমন, এক আদিবাসী দ্বীপে একা থাকত। কেউ কথা বলার ছিল না। তাই কাজকর্মের ফাঁকে সে দুই কণ্ঠস্বরে কথা বলত। এক নারীকণ্ঠ। অন্যটি তার। পরে একদিন তার কণ্ঠই নারীকণ্ঠের মতোন হয়ে গেল। আর আসল কণ্ঠ ফিরে পেল না।

আমি জানতে চাই, তুমি এ দুটি গল্পে কী পাও?
সে বলে, মানুষের একাকিত্ব। আসলে মায়ার সংসারে ভাষার সংসারে আমরা প্যান্টোমাইম। আমরা কতোটুকুই বা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি? পারি না। গল্পের ভাষার তো তাই ভাণ্ডার বড়ো থাকার কথা নয়। আপনি পারবেন আমার অনুভূতি অনুবাদ করতে? বা আমি আপনার?

আমার তখন সদ্য রোজেনের সাথে ডির্ভোস হয়েছে। ফলে একটা নারীসঙ্গ দরকার। কিন্তু কথা বলে বুঝতে পারি তাবু বেশ ফেমিনিস্ট। নিজেকে যতোটুকু আমি জানি সেটা হচ্ছে আমার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে মেল শভিনিজম কাজ করে। কিন্তু সেটা প্রকাশিত হলে তো আর কাজ হবে না। তাই আমি তার সাথে যে কৌশলটা নিই সেটি হলো, নারীবাদ পশ্চিমা প্রেডাক্ট,বিশেষ ইস্যু, এটসেটরা এটসেটরা। যে সমাজে পুরুষই মানুষ হিসেবে মুক্ত না সেখানে কে কাকে মুক্তি দিবে।

মানে রাষ্ট্রকে দাঁড় করানোর চেষ্টার ভেতর দিয়ে কৌশলে আমার মেলশেভিনিজমকে আড়াল করে তার ফেমিনিস্ট সত্ত্বাকে ভাঙতে থাকি। সে আমাকে জানায়, তার স্বামী শরীরে হাত তোলে। মাস্টারবেশন করে। পর্ণো দেখে। মানুষের সঙ্গে মিশুক চায় না। অনেকটা বোঝে না বোঝে একটা ঘোরের মধ্যেই তাবু একসময় আমার প্রেমিকা হয়ে ওঠে। আমাদের গল্প পুরনো হয়। হয় প্রাগহৈতিহাসিক।

এরপর বহুদিন পর কোভিডকালে হোম কোয়ারেন্টাইনের কোনো একদিনে আমি ফোনকল পাই তাবুর। ওপাশে সে কাঁদছে। তার কান্না যেন কুন্ডুলি পাকিয়ে আমার কানে এসে ঢুকে আমার শৈশবের কালিঘাটের তেতুল গাছের ওপরে বসে থাকা ঘুঘুর মতো। বৃষ্টির দিনে ঘুঘু ডাকে সেই প্রথম আমি জেনেছিলাম। সেই শৈশবে। তাবু জানায়, সে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। মনে হয়, তার বেরিয়ে পড়া যেন ট্রেন মিস করা হোটেলের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়া একটা মেয়ের নিরুপায় রিকশা নিয়ে ইতস্তত এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি।

তাবু জানায়, কোথাও উঠবে। আর স্বামীর বাসায় ফিরবে না। মনে হয়, আমি এভাবে বহুবার এখান থেকে ওখানে আশ্রয়ের জন্য ছুটেছিলাম, সেই ছুটা শেষে ফের রাস্তায় ওভারস্যাক ঝুলিয়ে দাড়িয়ে থাকা। তাবু সেই থেকে সে ইন্দিরা রোডে একটা বাসায় এক বান্ধবীর সহায়তায় সাবলেটে উঠে। এর আগে বান্ধবীর বাসায় ছিল। তাবু আমাকে ফোন করে, জানতে চায় তুণার খবর। বলি, আমি রোজেনের কাছে তুণার জন্য সাবলেট চেয়েছি। এ সাবলেটটা আমার খুব দরকার।

পাঁচ

এর দুমাসের ভেতরেই আমি রোজেন ও তুণাদের সঙ্গে নতুন কলাবাগানের বাসায় সাবলেট উঠি। তুণা বাসায় থাকলে বেশিরভাগ সময়ই আমার ঘরে কাটায়। আমি ও তুণা প্রায়ই খাবার খেতে একসাথে টেবিলে বসি। টিভি দেখি। আমাদের বাবা-মেয়ের সহাবস্থানের সময় পাশের রুমে বা অন্যখানে রোজেন থাকে। তার কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। টের পাই, আমার পছন্দের খাবার রান্না করতে সে ভুলে যায়নি। মাঝেমধ্যে শুনি রোজেন তুণার কাছে আমাকে নিয়ে গল্পও করে।

এই যেমন, প্যাথলজিক্যাল টেস্টের জন্য তুণাকে নিয়ে রোজেন গিয়েছিল। ব্লাড দেওয়ার সময় একটু ভয় পাচ্ছিল তুণা। ছয় টিউব রক্ত দিতে হবে শুনেই ভয় পেয়েছিল মা-মেয়ে। সেসময় রোজেনও বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। ব্লাড দেওয়ার পর রোজেন তুণাকে বলেছিল, তুমি ছোট তাকতে টিকাটুকা দেওয়ার সময় তোমার আব্বু আসত। আমি তো এসব দেখে অভ্যস্ত নই। এ ঘটনা তুণা আমাকে না বললে আমি জানতাম না।

জগতের নিয়মই তাই যে কোনোকিছুই একইরকম থাকে না। বিলীন অথবা বিস্তার। ভয় থেকে সভ্যতার শুরু। আবার সভ্যতাই ভয়েরও জন্ম দেয়। কী অবাক প্যারাডক্স। চিকিৎসাবিজ্ঞান এগুলো ঠিকই কিন্তু যেন জানান দিলো একটা ধুলির চেয়েও ক্ষুদ্র অদৃশ্য ভাইরাস বা ব্যকটেরিয়া সবকিছু শেষ করে দেয়। তুণা ফিজিক্সে ভাল। সে আমাকে এসব শোনায়। আমি জানি না এমন ভাব করে সব শুনি তাকে মুগ্ধ করার জন্যে। মেটোনিমি ও মেটাফোরের ক্ষেত্রে যে সাদৃশ্য রয়েছে সেটির ব্যাখা আমাকে শোনায়। আমি শুনি আর বয় পাই। আহা তুণা অল্প বয়সে জগতের বেশিকিছু জেনে ফেলেনি তো!

সে কি রহস্যগুলোর দরজা একে একে পেরিয়ে যাচ্ছে! একদিন ড্রয়িংরুমে খুব জোরে একটা ব্যালেন্ডিয়া মিউজিকের সুর শুনি। এরপরই তুণা আমাকে ডাকতে ডাকতে আমার গরে আসে। জড়িয়ে ধরে। জানায়, সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাই করেছিল ভর্তির জন্যে। সেখান থেকে পরীক্ষার রেজাল্ট পেয়েছে। পাস করেছে। ভর্তি হতে বলেছে। আমিও ছুটে যাই আনন্দে। রোজেন সোফায় বসেছিল। সেইপ্রথম ডিভোর্সের পর তিনজনে আড্ডায় আনন্দে মেতে উঠি।

আমি ও রোজেন তুণাকে তিন/চারটা অতীতের গল্প শোনাই যেসব অনুপ্রেরণামুলক। ফাঁকে প্রেসার কুকার বাজে। বিড়ালটা সোফার কোণ থেকে লাফ দিয়ে দেয়ালে ঝুলানো স্মার্ট টিভিতে আরেকটি বিড়ালকে দেখে ঝাপটে ধরতে যায়। রোজেন কোনো কারণে ঘরের বাতি নিভিয়ে দেয় ‘চোখে বড় লাগছে’ বলে। তুণার মধ্যে কোনো ডিপ্রেসন নেই। অনেকদিন থেকেই ছিল না অবশ্য। আমি তুণা’কে বলি, কতো কতো দেশ ঘুরবে। কি আনন্দ তোমার!

তোমার ইলিনয়ের ম্যাজিক হোমে যাওয়ার খুব ইচ্ছা করত একসময় আমার। আমি তো যেতে পারিনি। তুমি যেও। সেই ম্যাজিশিয়ানের বাড়ি। কি যেন নাম, ডেভিড ক্র্যাটস। তুণা খুব আগ্রহভরে জানতে চায়। ম্যাজিক হোম নিয়ে আমিও ভালো একটা জানি না। কি বলব, মিথ্যার ধরণই এমন যে বেশিক্ষণ সে সাবলীল থাকেনা। তাই যতোটুকু জানি সেটুকুই বলতে থাকি, ম্যাজিক হোমে একসময় কলম্বাসের সঙ্গী এক ম্যাজিশিয়ান আশ্রয় নিয়েছিল। সে সারাদিন সারাসন্ধ্যা হাটত শহরময়। কারো সাথে কথা বলত না। এমনকি কখনো কখনো হেটে একশহর থেকে অন্য শহরেও যেতো। সে বেঁচে ছিল অনেকদিন। কিন্তু মরে যাওয়ার কয়েকবছর আগে তার বাড়ির বিভিন্ন ঘরবাড়ি সে বিভিন্নজনকে সাব-লেট দেয়। সন্ধ্যার পর সে একটা হলঘরের মতো রুমে সবাইকে আসতে বলত।

সবাই মিলিত হওয়ার পর সে পিয়ানো বাজিয়ে শোনাতো। এরপর মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে সে নিরুদ্দেশ হয়। তার বাড়ির সাব-লেটবাসীরা অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু সে ফিরে না।এরপর একরাতে বোমা বর্ষিত হয় বাড়িতে। কারা করেছিল, কে জানে। কোনো একটা যুদ্ধে এমন হয়েছিল। মজার ব্যাপার সে ই বোমা বর্ষণে সবাই মারা যান। এর পঁচিশবছর পর একটা মানুষকে দেখা যায় সেই ভাঙা বাড়ি ঠিক করছেন। গড়ছেন। যারা ম্যাজিশিয়ানকে চিনতেন তারা দেখেন সেই ম্যাজিশিয়ান ফিরে এসেছেন। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব ! আবার এটাও তো সত্য সেই মানুষ , বয়স চেহারা , আচরণ, উচ্চতা সবদিক থেকে মিলিয়ে ওই ম্যাজিশিয়ানেরই মতোন।
এসব আনন্দমুখর দিনগুলো আমাদের কেটে যায় দ্রুতই। রোজেন, তুণা ও আমি ঘুরে ঘুরে শপিং করে তুণার জন্য। টিকেট কনফার্ম করি। এরপর একদিন সেই দিন আসে। তুণার বিমানে চড়ার। আমরা একটু আগেভাগেই যাই।

তুণা চলে যায়। একটা ট্যাক্সিক্যাবে আমি ও রোজেন নিশ্চুপ বসে বাসায় ফিরি। দুজন দুঘরে। এর সপ্তাহ খানেকের ভেতরেই রোজেন আমাকে জানায় সাব-লেটের দিন শেষ। সংসার মানে একসঙ্গে একটা প্রোডাকশন, একটা ছবি, একটা গল্প। সংসার মানে অদরকারি এটাসেটা, মনের ভুলে কিনে ফেলা চায়ের কাপ, চুড়ি, মাটির পাতিল, যা কোনো কাজে লাগে না। কিন্তু কখনো দেখলে মনে হয় আহা কিনেছিলাম এইসবও । এইসব... সব... প্যাকিং বাক্সে চালান হয় বারংবার। ভাঙ্গা জিনিস, ভাঙ্গা কথা, ভাঙ্গা স্মৃতি, ভাঙ্গা প্রমিস, এসব নিয়েই ভাঙ্গা সংসার আবার একটু একটু করে ফেভিকল দিয়ে জোড়া লাগানো।

আমি ও রোজেনও ফেভিকল দিয়ে জোড়া লাগিয়েছিলাম। ফেভিকল হয়ত তুণা ছিল। তারপর একদিন পরবর্তী সংসারের জন্য বা একা থাকাকেই মেনে নিয়ে গোপন দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে নতুনভাবে চলা। যেন জিনসের প্যান্টে ধুলো লেগেছে। ঝেড়ে ফেলা। বিশ্ব সংসারে মনে হয় সবাই একাই , জাস্ট নিজের কাছেই অচেনা । ডার্ক পোট্রেট । তবু আরেকজনকে চিনতে চিনতে সংসারে গুম হয়ে যাওয়া । প্রেমে গুম হওয়া। যেন মনুষ্য জীবন একটা তৈরিই হয় শিকারের জন্য । শীরিষ গাছের ডালে বিতুয়া পাখি তাকিয়ে আছে আপনার দিকে, বিশ্বাস করেন একটু নড়লে চড়লেই ঠোকর। বেইসিক্যালি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু সেটাই আসলে বড়ো প্রোডাকশন। আমিও এক সন্ধ্যায় ফের রোজেনের বাসা ছাড়ি।

ছয়

এসবের মধ্যে আরো কিছু আলেখ্য রয়েছে। যেমন তাবুর স্বামী স্ট্রোক করে মারা গেছে। তাবু সেকথা জানিয়েছিল কয়েকদিন আগে। আমি বসুন্ধরায় এক বন্ধুর বাসায় ফের সাবলেটে উঠি। তুণা ভর্তি হয়েছে। ভালো আছে। রোজেনের প্রমোশন হয়েছে। বদলি হবে চিটাগাং , একদিন ফোনে জানালো। তাবু প্রেম করছে শহিদুল নামের এক ব্যাংকারের সাথে। রোজি একটা এনজিওর কাজে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

একরাতে আমার কাছে মেসেনজারে কল আসে। সম্ভবত ছোটবেলার বন্ধু উৎপলের। আমি কি বলি ঠিক মনে নেই। বা সে কি বলে সেটিও বুঝতে পারি না। মনে হয় আমরা অনেক দুরে দুরেই কথা বলছি। নেটওয়ার্কের সমস্যা। বাসার বেলকনিতে রকিং চেয়ারে বসেছিলাম , এটুকু শুধু মনে আছে। এর আগে বা পরে সত্যি কথা কি আমি মনেই করতে পারছিলাম না আলঝেইমার বা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মতো। হয়। এমন হয়। অনেক বেশি গল্প জমা হলে। লাম্পট্যের গল্প। প্রেমের গল্প। অপ্রেমের গল্প । মায়ার গল্প। বিশ্বাসহীনতার গল্প। ঠিক কোন গল্পটা থেকে আমি নিজেকে আলাদা করব অথবা সব গল্পতেই আমাকে খুঁজতে খুঁজতে যেন আমি একটা মলাট তৈরি করি।

মলাটের মধ্যে মিশে যেতে থাকি। যেখানে সবটাই গল্প। এক বৃহত্তর গল্প, তার মধ্যে আরো কিছু বড়গল্প, মেজোগল্প, ছোটগল্প। যেমন, শৈশবে জ্যামিতি বইয়ের পাতায় বিদঘুটে সম্পাদ্যের চিত্রের নিচে যে “অংকনের বিবরণ” লেখা থাকে সেখানে মাঝে মাঝেই দেখা পেতাম হঠাৎ সূক্ষ্মকোণ কিংবা স্থূলকোণ অঙ্কিত। আবার উপপাদ্যের প্রমাণেও দেখতাম, “তারা পরস্পর বিপ্রতীপ কোণ” কিংবা “তারা পরস্পর সম্পূরক কোণ”-এই ধরণের লেখা। এখন আমি যদি সূক্ষ্মকোণ আর স্থূলকোণ কীভাবে আঁকতে হয় তা না জানি অথবা বিপ্রতীপ কোণ আর সম্পূরক কোণ কখন হয় তা না জানি, তাহলে আমার জন্যে সম্পাদ্য আঁকা কিংবা উপপাদ্য প্রমাণ করা উভয়ই প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। আমি যেন ওই অসম্ভব ধাঁধায় জড়িয়ে পড়েছি।

আমার এরপর আর সত্যি আগে বা পরের কিছুই মনে ছিল না। শুধু কিছু একলা আকার সেই রাতে দেখতে পারছিলাম। আর কিছুই না। এমনকি আমার প্রাণপ্রিয় তুণাকেও না।

 

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;