কুমিল্লা থেকে ডুয়ার্স: বিস্মৃতপ্রায় ডুয়ার্স গান্ধীর গল্প



ড. রূপ কুমার বর্মণ
কুমিল্লা থেকে ডুয়ার্স: বিশ্মৃতপ্রায় ডুয়ার্স গান্ধীর গল্প

কুমিল্লা থেকে ডুয়ার্স: বিশ্মৃতপ্রায় ডুয়ার্স গান্ধীর গল্প

  • Font increase
  • Font Decrease

উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মুক্তিসংগ্রাম আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বহুচর্চিত বিষয়। স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলণের বহুকৌণিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি সমান্তরাল ধারা হিসাবে সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত প্রধান নেতৃবর্গকে “আইকন” বানানোর প্রয়াস। এর অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ বিশ শতকের ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জাতীয় ইতিহাসে “ব্যক্তির ভূমিকা” শ্রেণিকক্ষের পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমেরও আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এর জন্যই আমরা রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) শুরু করে ‘বঙ্গবন্ধু’ পর্যন্ত আরোও অন্যান্য জাতীয় চরিত্রকে আমাদের দৈনন্দিন আলোচনার বৃত্তে নিয়ে আসি। আর এক্ষেত্রে যার কথা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় তিনি হলেন “অহিংস আন্দোলনের পূজারি” মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮)। বস্তুতঃ ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’ (১৯১৭), ‘অসহযোগ আন্দোলন’ (১৯২০-১৯২২),  ‘আইন-অমান্য আন্দোলন’ (১৯৩০-৩২) ও ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলনের’ (১৯৪২-১৯৪৪) মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন গণ-আন্দোলনের প্রতীক। তাঁর নেতৃত্ব ও সকলকে একত্রিত করে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করার পদ্ধতি তৎকালীন ভারতকে (১৯২০-১৯৪৮) এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর মতো সংগ্রামী নেতা-নেত্রীদের তুলনার ক্ষেত্রে গান্ধীই হয়ে উঠেছিলেন Point of Reference। ফলে ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ তিন দশকে ভারতীয় উপমহাদেশ হয়ে উঠেছিল ‘বহু গান্ধীর দেশ’। স্বাভাবিকভাবেই “সীমান্ত গান্ধী” (খাঁন আব্দুল গফফর খাঁন: ১৮৯০-১৯৮৮), মেদিনীপুরের “গান্ধী বুড়ি” (মাতঙ্গিনী হাজরা : ১৮৭০-১৯৪২), “উড়িষ্যা গান্ধী” (গোপবন্ধু দাস : ১৮৭৭-১৯২৮) বা “বিহারি গান্ধীর” (রাজেন্দ্র প্রাসাদ: ১৮৮৪-১৯৬৩) মতো আর অনেক স্থানীয় গান্ধীই স্থান পেয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। তবে অনেক গান্ধীই রয়ে গেছেন ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে। কেউবা আবার হারিয়ে গেছেন স্মৃতির অতল গহ্বরে। এরকমই একজন প্রায় বিস্মৃত গান্ধী ছিলেন “ডুয়ার্স গান্ধী” বা নলিনীমোহন পাকরাশী (১৮৯৪-১৯৭৬)।

নলিনীমোহন পাকরাশীর (ভট্টাচার্য) জন্ম ১৮৯৪ সালে ব্রিটিশ-শাসিত অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লা (তিপ্রা/ত্রিপুরা) জেলায়। বহু পণ্ডিত ও সংগ্রামীর জন্মস্থান বাংলার অন্যতম সংস্কৃতিবান এই জেলার গুরুত্বপূর্ণ মহকুমা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানা এলাকায় ছিল তাঁর পৈত্রিক বাড়ি। মিথিলা থেকে ‘ন্যায়রত্ন’ উপাধিপ্রাপ্ত তাঁর পিতা নবীনচন্দ্রের যখন মৃত্যু হয় (১৯০৪ সালে) তখন নলিনীমোহনের বয়স তখন মাত্র ১১ বছর। স্বাধীনচেতা নলিনীমোহন বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের (১৯০৫) সময় থেকেই জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ও পারিবারিক দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নলিনীমোহনকে পাঠানো হয় ময়মনসিংহে। জমিদার, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান ময়মনসিংহে এসে নলিনীমোহন জড়িয়ে পড়লেন যুগান্তর দলের সঙ্গে। যুগান্তর দলের সুরেন্দ্র মোহন ঘোষের [১৮৯৩-১৯৭৬) সান্নিধ্যে এসে তিনি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরোধিতার মনোভাবকে আরও শক্তিশালী করেন। কিন্তু পারিবারিক পরিস্থিতির চাপে নলিনীমোহনকে চলে আসতে হয় রংপুরে। এখানে উচু বেতনে কাজ নেন এক ঠিকাদারি সংস্থায়। তাঁর তত্বাবধানে তৈরি হয় রংপুরের কারমাইকেল কলেজের [Carmichael College (1916)] বাড়ি।

স্বাধীন রাজনৈতিক চিন্তা ও বহু মানুষকে একত্রিতভাবে কাজ করানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে নলিনীমোহন ডুয়ার্স অঞ্চলে আসেন ১৯২১ সালে। ততদিন ডুয়ার্সের রাজাভাতখাওয়ায় গড়ে উঠেছে জঙ্গলের কাঠ বিক্রির Auction Centre। বাবু রামরূপ সিংহের অধীনে ১৫০ টাকার বেতনে চাকরি নিয়ে ১৯২৯ থেকে নলিনীমোহন পাকাপাকিভাবে আলিপুরদুয়ারে বসবাস শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে ডুয়ার্স অঞ্চলের জাতীয় আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ভূটান থেকে অধিকৃত ডুয়ার্সকে নিয়ে ১৯৬৯ সালে গঠিত হয় জলপাইগুড়ি জেলা। জলপাইগুড়ি মহকুমার সঙ্গে আলিপুরদুয়ার মহকুমার বক্সা, ফালাকাটা, আলিপুরদুয়ার, কুমারগ্রাম, শামুকতলা, মহাকালগুড়ি, কামাখ্যাগুড়ি ও অন্যান্য অঞ্চলেও নতুন ধরনের ভুমি বন্দোবস্ত শুরু হয়। শুরু হয় কৃষিজমি, নদী, ঘাট ও হাট থেকে খাজনা আদায়ের নতুন প্রথা।

পাশাপাশি ইংল্যান্ডের “শিল্পায়নজনিত উদ্বৃত্ত মুলধনের” বিনিয়োগ করার জন্য আসাম ও ডুয়ার্স হয়ে ওঠে চা-বাগিচার বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু। ডুয়ার্স রূপান্তরিত হয় “ঔপনিবেশিক শক্তির বাগানে” (Garden of the Empire)। আলিপুরদুয়ার মহকুমার ভুটান ঘেঁষা অঞ্চলে দেশীয় ও ইউরোপীয় উদ্যোগীদের প্রচেষ্টায় স্থাপিত বেশ কিছু চা-বাগান। কালচিনি, হ্যামিলটনগঞ্জ, মাদারিহাট, রাজাভাতখাওয়া, কার্তিক, রায়ডাক, তুরিতুরি ও কুমারগ্রামের চা-বাগানগুলি ভরে ওঠে আদিবাসী শ্রমিক ও বাঙালি ‘বাবুদের’ ভিড়ে।

চা-বাগান অর্থনীতি, কাঠ ও প্রশাসনিক কারনে জলপাইগুড়ি হয়ে ওঠে এক গুরুত্বপূর্ণ জেলা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, চা-নিলাম কেন্দ্র, আদালত, নগরায়ন ও ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার কেন্দ্ররূপে বিশ শতকের প্রথমার্ধে জলপাইগুড়ি শহর পরিণত হয় তার  প্রাণকেন্দ্রে। রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষা-সংস্কৃতির মূল ধারক হয়ে ওঠে জলপাইগুড়ি শহরের পাশ্চত্য শিক্ষায় আলোকিত আইনজীবী ও তাদের সহযোগী শ্রেণি। খুব সংগত কারণেই ডুয়ার্সের চা-বাগানের শ্রমিক ও “উৎপাদনের প্রাথমিক ক্ষেত্রে নিযুক্ত” স্থানীয় জাতি-জনজাতি সম্প্রদায়গুলি থেকে যায় জলপাইগুড়ির “অভিজাত- নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ক্ষমতার বৃত্তের” বাইরে।

অন্যদিকে, জলপাইগুড়ি শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত আলিপুরদুয়ার মহকুমা শহর ছিল অপেক্ষাকৃত অনুন্নত। গুটিকয় হাইস্কুল গড়ে উঠলেও এই শহরে ছিল না কোন কলেজ। পাশ্ববর্তী গ্রামগুলির অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। বিশ শতকের গোড়ায় মিশনারিদের চেষ্টায় বেশ কিছু প্রাইমারি ও মিডল ইংলিশ স্কুল গড়ে উঠলেও কুমারগ্রাম, মহাকালগুড়ি, কামাখ্যাগুড়ি, শামুকতলা, ফালাকাটা, মাদারহাটি ও বীরপাড়ার স্থানীয় মানুষেরা উচ্চশিক্ষায় সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। তাঁদের পক্ষে এলিট-রাজনীতির কেন্দ্রে প্রবেশ করা বা রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়া ছিল একেবারেই অসম্ভব।

বিশ শতকের গোড়ার দিকের আলিপুরদুয়ারের এরকম পরিস্থিতিতে ১৯২১ এ নলিনীমোহন আলিপুরদুয়ারে এসে দেখলেন যে এখানে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ(১৮৮৩), কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ (১৮৯৯)  বা রংপুরের কারমাইকেল কলেজের মতো কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। নেই পূর্ববাংলার জমিদার শ্রেণির কৃষক শোষণ। এমনকি পূর্ববাংলার মতো রাজনীতি চেতনাও নেই। তবে এখানে আছে অন্য ধরনের শাসন ও শোষণ। শাসিতের হয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার মানুষের বড় অভাব। জলপাইগুড়ির এলিট নেতৃবর্গের ডুয়ার্সের সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মতো মানসিকতাই ছিলোনা। এরকম পরিস্থিতিতে নলিনীমোহন চুপ থাকতে পাড়েননি। মাসিক ১৫০ টাকা বেতনের কাজ ছেড়ে নলিনীমোহন ঝাঁপিয়ে পড়লেন জনগণকে সংগঠিত করার কাজে। নিজেকে উৎসর্গ করলেন ডুয়ার্সের সাধারণ মানুষকে নেতৃত্ব  দেওয়ার জন্য। তাঁর নেতৃত্বে শামুকতলার শুক্রবারের হাটে সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন (১৯২৯) ও ফালাকাটায় আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০) তাঁকে ডুয়ার্সের রাজনৈতিক মহলে পরিচিত করে তোলে। কুমারগ্রামদুয়ার থেকে মাদারিহাট, ভলকা থেকে ফালাকাটা---ডুয়ার্সের সবত্রই নলিনীমোহন হয়ে ওঠেন “নলিনী ঠাকুর”। কুমারগ্রামদুয়ার, আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা ও মাদারিহাটের অন্যান্য কৃষক সম্প্রদায়ের ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাবকে সংগঠিত করেন নলিনীমোহন।

ভারত শাসন আইন (The Government of India Act, 1935) গৃহিত হওয়ার পরে ১৯৩৭ এর বিধানসভার নির্বাচনে ডুয়ার্সের নির্বাচনী রাজনীতিতে ভাগ বসানোর জন্য এগিয়ে আসেন জলপাইগুড়ির এলিট-রাজনীতিকগন। প্রসন্নদেব রায়কত, খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত (১৮৯৮-১৯৮৫) ও উপেন্দ্রনাথ বর্মন (১৮৯৮-১৯৮৮) জলপাইগুড়ি থেকে বাংলার বিধানসভায় প্রবেশ করেন। জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি বিধানসভা ক্ষেত্রের তপশিলিজাতির প্রতিনিধি উপেন্দ্রনাথ ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রীসভার (১৯৪১-৪৩) মন্ত্রী হয়ে ডুয়ার্স অঞ্চলের কৃষকদের খাজনা কমানোর আর্জি জানিয়েছিলেন বিধানসভায়। কিন্তু এটা বাস্তবায়িত হয়নি। ডুয়ার্স অঞ্চলের মাটি পূর্ববাংলা বা দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির মতো এতোটা উর্বর ছিল না। ফলে এখানকার জোত জমির কৃষকদের পক্ষে ভূমি রাজস্বের হার হয়ে উঠেছিল একটা বড় বোঝা। কৃষকদের মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল খাজনা না দেওয়ার প্রবণতা।  “No Rent” বা খাজনার বন্ধের আন্দোলন কুমারগ্রামদুয়ার এলাকায় প্রখর রূপ ধারন করেছিল নলিনীমোহনের নেতৃত্বে। কুমারগ্রামের জোতদার মঘা দেওয়ানী বা মদন সিং বরুয়ার মতো কংগ্রেসি কৃষকেরা খাজনা বন্ধের আন্দোলনকে গণ-আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছিলেন। খাজনা বন্ধের প্রভাব পড়েছিল কুমারগ্রামের কুলকুলি, দলদলি ও শামুকতলার হাটেও।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৩৯-১৯৪৫) ভারতের রাজনীতির জটিল পরিস্থিতিতে ১৯৪২ এর ৮ই আগস্ট জাতীয় কংগ্রেসের “ভারত ছাড়ো” (Quite India) আন্দোলনের ডাক দেয়। “করেঙ্গে-ইয়ে-মরেঙ্গে” ধ্বনিতে ভেসে ওঠে ভারতের আকাশ বাতাস। ৯ই আগস্ট গান্ধীজী সহ জাতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রিয় নেতৃবর্গকে গ্রেফতার করা হয়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাবে স্থানীয় কংগ্রেসী নেতৃবর্গ তাঁদের নিজস্ব মত ও কর্মপন্থানুযায়ী ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতায় মেতে উঠেন। ব্রিটিশ শাসনের প্রতীক (বিশেষত রেললাইন, টেলিগ্রাফ, পোস্ট অফিস ও যোগাযোগ ব্যবস্থা) সমূহের উৎপাটনে মেতে উঠে উন্মত্ত জনতা। ডুয়ার্সের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তাঁর প্রভাব অনুভূত হল। নলিনীমোহনের নেতৃত্বে কুমারগ্রাম থানা আক্রমন করে টেলিগ্রাম লাইন কেটে দিয়ে কাঠের তৈরি সেতুগুলির পাটাতন উপরে দিয়ে কুমারগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন এখানকার স্থানীয় জনগণ। ‘তারকাটা আন্দোলন’ নামে পরিচিত এই গন-আন্দোলনের পর নলিনীমোহন ডুয়ার্সের সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হলেন “ডুয়ার্স গান্ধী” নামে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ইতিহাসের পরবর্তী পর্যায় আমাদের সকলেই জানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর ভারতের রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের আলাপ-আলোচনার ফলস্বরূপ বিভিন্ন পরিকল্পনা গৃহিত হয়। ১৯৪৬ এর নির্বাচনের পর ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গঠিত হয় ভারতের সংবিধান সভা (The Constituent Assembly)। ১৯৪৭ এর আগষ্ট মাসে ব্রিটিশ-ভারত দ্বিখন্ডিত হয়ে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি জাতিরাষ্ট্র (Nation State)। পশ্চিম বাংলার অন্যান্য জেলার মতো জলপাইগুড়িও ভরে যায় পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তুদের ভিড়ে। পূর্ববাংলার ময়মনসিংহ, পাবনা ও রংপুর থেকে উৎখ্যাত মানুষের ভিড়ে দ্রুত পাল্টে যায় ডুয়ার্সের জনবৈচিত্র। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ডুয়ার্সের জনগণ নলিনীমোহনকে ভুলতে শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় (১৯৭২-১৯৭৭) কোচবিহারে এসে নলিনীমোহনকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেও বা তাঁকে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামীর’ পদক দিয়ে ভারত সরকার সম্মানিত করলেও পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের শাসনকালে (১৯৭৭-২০১১) নলিনীমোহনের মতো ‘ডুয়ার্স গান্ধী’ চলে যান বিস্মৃতির অন্তরালে।

লক্ষ্য করার বিষয় হল জাতিয়তাবাদী দৃষ্টিতে লেখা পাঠ্যপুস্তকে ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিবাচক সুযোগ থেকে বঞ্চিত ও ঔপনিবেশিক শাসনের দ্বারা সরাসরি শোষিত ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চল, কৃষক, আদিবাসী, শ্রমিক ও অন্যান্য প্রান্তিক মানুষেরা গুরুত্ত্ব পান নি। মার্ক্সবাদী ও নিম্নবর্গীয় ঐতিহাসিকেরা কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনকে ইতিহাসের আলোচনায় স্থান দিলেও তাঁরা ডুয়ার্স অঞ্চলের ঔপনিবেশিক শক্তির বিরোধিতার আন্দোলন বা নলিনীমোহনের মতো নিস্বার্থ দেশসেবকের অবদানকে স্বীকৃতি দেননি। তবে ঔপনিবেশিক শাসন-সৃষ্ট আধুনিক শিক্ষা, মুদ্রনযন্ত্র, সংবাদ পত্র ও সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবহীন ডুয়ার্সের সাধারণ মানুষের ঔপনিবেশিক শক্তির বিরোধিতাকে অনুভব করতে হলে ‘কুমিল্লা থেকে আসা নলিনীমোহনের ডুয়ার্স গান্ধী হয়ে ওঠাকে’ স্মরণ করতে হবে ।

ড. রূপ কুমার বর্মণ, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আম্বেদকর চর্চা কেন্দ্রের সমন্বয়ক

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;