স্বাধীনতার ৫০ বছর: কতদূর এগুলো বাংলাদেশের সাহিত্য?



অসীম নন্দন, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
অলংকরণ ও সম্পাদনা: রুদ্র হক

অলংকরণ ও সম্পাদনা: রুদ্র হক

  • Font increase
  • Font Decrease

একটা দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী মানে বিরাট ব্যাপার। আর আমরা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের স্বাদ পাচ্ছি। স্বাধীন দেশ মানে অন্য অনেক অধিকার অর্জনের সাথে সাথে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও লাভ করা। আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পেলেই কেবল একটা দেশের শিল্প-সাহিত্য সমৃদ্ধ হতে পারে। যত বেশি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পাওয়া যায় তত বেশি সমৃদ্ধ হয় দেশের সাহিত্য।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্য গত ৫০ বছরে কতটুকু সমৃদ্ধ হয়েছে? এই প্রশ্নের জবাব আসলে এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ইতিহাসের দিকে। কেন বাংলাসাহিত্যের কথা না বলে আমি বাংলাদেশের সাহিত্যের কথা বলছি? প্রথমেই এই বিষয়টা পরিষ্কার করে নিতে চাই। কারণ ঐতিহাসিক দিক থেকে অঞ্চলগতভাবে বাংলাসাহিত্যে একটা স্পষ্ট বিভাজন আছে। ৪৭-এর সেই দেশবিভাগের কূটকৌশলে এই বিভাজন সৃষ্টি হলো।

আর আমরা এক শাসকের থেকে মুক্তি পেয়ে আরেক শাসকের হাতে শৃঙ্খলিত হলাম। তবে আমরাই সেই জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। এটা আমাদের অহংকার। আর এই বাংলা ভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা চাওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন একটা ভূখন্ডের স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলাম। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের স্বপ্নদ্রষ্টা। এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমরা পেলাম এই বাংলাদেশ।

এখন আমরা বাংলাদেশের সাহিত্যের দিকে তাকালে এর বিচিত্র সম্ভাবনাকে খুঁজে পাবো। যদিও দশকের চিন্তা থেকে কোনো সাহিত্যকে কিংবা সাহিত্যিককে বিশ্লেষণ করা বিশেষ কার্যকরী বিষয় নয়। তবে আলোচনার সুবিধার্থে আমরা এই দশকের চিন্তা ধরেই এগোবো। এবং সবশেষে আমরা একটা সামগ্রিক চিত্র পাবো।

যেহেতু সত্তরের দশকেই বাংলাদেশের জন্ম তাই তার পরবর্তী দশকগুলোকেই আমাদের বাংলাদেশের সাহিত্য বলা উচিত। কিন্তু এখানেই দশকের হিসাবে গন্ডগোলটা বাঁধে। কেননা সত্তরের দশকে বাংলাদেশের জন্ম হলেও পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের শক্তিমান কবি-সাহিত্যিকদের অমর সৃষ্টিগুলোকে আমরা বাংলাদেশের সাহিত্য থেকে বাদ দিতে পারি না।

তাঁদের সাহিত্যের অন্তর্দৃষ্টিতে সমাজের ঐসময়টাকে আমরা প্রকটভাবে দেখতে পাই। তাঁদের বহুমাত্রিক সাহিত্যপ্রতিভা এই দেশের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।

সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল উত্তাল। বারবার ক্ষমতার পটপরিবর্তন, মানুষের স্বপ্নের অতৃপ্তি আর অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক সমীকরণগুলো বাংলাদেশকে সেসময়ে একরকম দুঃস্বপ্নের দেশে পরিণত করেছিল। আর সেই উত্তাল সময়কে আমরা আমাদের বাংলাদেশের সাহিত্যের মাঝেও দেখতে পাই।

একরকম নির্মোহ বয়ানে সেই সময়টা লেখকদের লেখায় চিত্রিত হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সত্তরের দশকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-নির্ভর কোনো কাজ তখন প্রকাশিত হয়নি। মানে কোনো সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধার বয়ানে কোনো কথাসাহিত্য সেই দশকে কেন হয়নি তা প্রশ্নবিদ্ধ। পরবর্তী সময়ে যদিও সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ।

এই সময়কার কবিতায় সবচেয়ে যে বৈশিষ্ট্যটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তাহলো কবিতার শ্লোগানধর্মীতা। এই সময়ের কবিতাগুলোই একেকটি শ্লোগান হয়ে উঠেছিল। কিংবা বলা যায় শ্লোগানই হয়ে উঠেছিল কবিতা।

তবে ৮০'র দশকে বাংলাদেশের কবিতায় একটা নতুন ভাবনার বিকাশ ঘটে। এই দশক থেকেই লিটল ম্যাগাজিনের উত্থান ঘটে। গাণ্ডিব, অনিন্দ্য, পেঁচা, দামোদর, পূর্ণদৈর্ঘ্য, ফু, প্রসূন এবং আরো অনেক লিটল ম্যাগাজিনের উত্থান ঘটে এই সময়ে। যার ফলে বাংলাদেশের সাহিত্যে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। এসময়ে সাহিত্যে নানানরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। এছাড়া লিটল ম্যাগাজিনের কল্যাণে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা'র তাত্ত্বিক আবহাওয়া এসময় খুব জনপ্রিয়তা পায়।

যদিও বর্তমানে লিটল ম্যাগাজিনের সেই প্রতাপ এখন ম্লান হয়ে গেছে। তবে এখনও কালি ও কলম, চিরকুট,মেঘফুল, দেশলাই, বিন্দু, ড্যাস এবং আরো অনেক লিটলম্যাগ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ৮০'র দশককে লিটল ম্যাগাজিনের দশক বলা হলেও এর প্রকৃত সূত্রপাত হয়েছিল ৬০'র দশকে। সেই সময়কার উল্লেখযোগ্য লিটলম্যাগগুলো হচ্ছে স্যাড জেনারেশন, সপ্তক, স্বাক্ষর, না, বহুবচন প্রভৃতি।

৯০'র দশকে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যের আরো একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এবং এই দশকের পরবর্তী সময়ে মানে একবিংশ শতকের শূন্য দশক এবং তারপরের দুই দশকে এদেশের সাহিত্যে নানানরকম সংযোজন শুরু হয়।

শ্লোগানধর্মীতা থেকে কবিতা ধীরে ধীরে উত্তরাধুনিককালে উন্নিত হয়। এবং কবিতার বৈশিষ্ট্য অনেক বেশি বিমানবিকতার দিকে ধাবিত হয়েছে। কবিতার মাঝে গল্পধর্মী পরাবাস্তববাদী এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায় বর্তমান সময়ে। এছাড়া কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রেও নানানরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলমান আছে। কথাসাহিত্যে সুররিয়ালিটির ব্যবহার দেখা পাওয়া যায় এসময়ে।

এছাড়া ইতিহাস-নির্ভর কথাসাহিত্যও প্রবলভাবে বিকশিত হয়েছে এই সময়ে। ইতিহাস-নির্ভর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে নিষিদ্ধ লোবান, মা, দেয়াল, রাইফেল রোটি আওরাত, জীবন আমার বোন, হাঙর নদী গ্রেনেড, আমার বন্ধু রাশেদ, জোছনা ও জননীর গল্প, ক্রাচের কর্নেল ইত্যাদি।

গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রভাব-বিস্তারকারী কাজ সেই তূলনায় অপ্রতুলই রয়ে গেছে। যে কারণে মৌলবাদীতার নীল দংশন থেকে আমাদের স্বপ্নের দেশ এখন বাস্তবের রূপ দেখতে পায়নি। আমাদের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন যতটা হবার কথা ছিল, সেই তুলনায় হয়েছে সামান্যই। সমাজতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক যে সমাজের স্বপ্নের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল, তা রয়ে গেছে অধরাই।

সত্তর, আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে আমরা প্রকৃত মুক্তমনা সাহিত্যিকদের দেখা পেলেও একবিংশ শতকের শূণ্য, এক এবং দুইয়ের দশকে তেমন সাহিত্যিকদের কাজ পেয়েছি খুব কম। একটা দেশের মননকে সমুন্নত করতে মুক্তমনা সাহিত্যের যে পরিমাণ সহযোগিতা দরকার ছিল, তা আমরা সেই চাহিদা মতো পাইনি। বাংলাদেশের সাহিত্যে মননশীল পাঠক তৈরির জন্য যে অনমনীয় দৃষ্টান্ত থাকা উচিত ছিল, এই সময়ের চাটুকার সাহিত্যের জয়জয়কারে তা বিঘ্নিত হয়েছে।

বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত জনগণ জ্ঞান অর্জন করে মননশীল ও সৎ-মানুষ হবার চেষ্টার দিকে না গিয়ে, একপ্রকার ছা-পোষা কেরানি হবার স্বপ্নের দিকে ধাবিত হয়েছে। এই ব্যর্থতার দায়ভার অবশ্যই বাংলাদেশের সাহিত্যিকগোষ্ঠী এবং সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে নিতে হবে। কেননা তাঁরা সেই রকম প্রভাববিস্তারকারী কাজ করতে পারেনি।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমরা যেসব গুণী কবি-সাহিত্যিকদের বাংলাদেশের সাহিত্যে পেয়েছি তাঁরা হলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা, সৈয়দ শামসুল হক, আবুল হাসান, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ, আবিদ আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, হুমায়ুন আহমেদ, শহীদুল জহির, প্রমুখ।

এছাড়া আরো অনেকেই আছেন যাদের নাম নিতে গেলে আসলে নামের তালিকাটা দীর্ঘ থেকে আরো দীঘর্তর হবে। আগেই বলেছিলাম সাহিত্য কিংবা সাহিত্যিক কাউকেই দশকের হিসেবে বিশ্লেষণ করাটা কঠিন এবং কখনো কখনো অচল ব্যবস্থাও বলা যায়।

এখন কথা হচ্ছে আমাদের দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আসলে কতটা কার্যকরী হয়েছে? এই প্রশ্নের জবাবটা সন্ধান করা খুবই জরুরি। কারণ সমৃদ্ধ সাহিত্যের জন্যই এই স্বাধীনতা থাকাটা খুব জরুরি। এবং সাহিত্য যত সমৃদ্ধ হবে তত বেশি মানুষের মাঝে তা প্রভাববিস্তার করবে।

৫২'র ভাষা আন্দোলনে তো আমরা স্বাধীনভাবে নিজের ভাষায় কথা বলতে পারার অধিকারের জন্যই প্রাণ দিয়েছিলাম। এই ইতিহাস যেমন আমাদের জন্য গৌরবের, সেরকমই আমাদের দেশে এই মতপ্রকাশের অধিকার যে এখনও প্রশ্নবিদ্ধ; এই প্রশ্নবিদ্ধতাও আমাদের জন্য পীড়াদায়ক।

এই বিশ্লেষণ থেকেই কি আমরা বলতে পারবো বাংলাদেশের সাহিত্য গত পঞ্চাশ বছরে সমৃদ্ধি'র চরম শিখরে পৌঁছে গেছে? না, একেবারে এত মোটা দাগে বলা মুশকিল। যেহেতু এখনও আমাদের বাংলাদেশের সাহিত্যের আন্তর্জাতিক কদর সেরকম অর্থে আমরা বৃদ্ধি করতে পারিনি। এবং অনুবাদ সাহিত্যে আমরা কাঙ্খিত সফলতা পাইনি।

সাহিত্যের আন্তর্জাতিক কদর বৃদ্ধি করতে চাইলে আমাদেরকে অনুবাদ-সাহিত্যে মনোযোগী হতে হবে। বাংলাদেশের সকল উল্লেখযোগ্য বইকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হলে প্রয়োজন ভালো অনুবাদের ব্যবস্থা করা। আর এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সাহিত্যের বিচিত্র সম্ভার বিশ্বের মানুষের দরবারে পৌঁছে যাবে ও সমৃদ্ধি পাবে।

সকলরকম প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তির হিসাবনিকাশ শেষ হলে আমরা একটা কথা খুব দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে কেবল বাংলাদেশের সাহিত্যই টিকিয়ে রাখতে পারবে। যদিও অনেকে মনে করেন ঔপনিবেশিক ভাষাগুলোর প্রভাব বাংলা ভাষাকে দূষণ করছে, তবে এই দূষণকে আমরা শাপে-বর বলতে পারি। কেননা ভাষা তো চিরকাল প্রবহমান। পরিবর্তনই তার ধর্ম।

আর পরিবর্তনের জন্য অন্য ভাষা থেকে গ্রহণটাও বাংলা ভাষার জন্য পুষ্টিকর। তবে অধিক আহার গ্রহণ করা যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর হতে পারে, সেরকমভাবে অন্য ভাষার অধিক প্রভাবও ভাষার জন্য অস্বাস্থ্যকর হতে পারে।

তাই বাংলাদেশের সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের এই ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আর আমরা প্রচন্ডরকম আশাবাদী; এই সকল প্রশ্ন এবং জবাবের মধ্য দিয়ে, বাংলা ভাষার দীর্ঘদিন টিকে থাকার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলবে।

 

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;