‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ ও ইউরোপে নজরুল চর্চা    



সাঈদ চৌধুরী
কাজী নজরুল

কাজী নজরুল

  • Font increase
  • Font Decrease

 

কাজী নজরুল দ্রোহের কবি। শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর। আর ‘বিদ্রোহী’ একটি প্রভাবক কবিতা। আমাদের জাগরণের স্মারক। বিংশ শতাব্দীর এক বিস্ময়। যেখানে নজরুল বলছেন, বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির। 

বাংলা ভাষা যে এতটা আণবিক শক্তি সম্পন্ন, বিদ্রোহী প্রকাশের আগে কারও জানা ছিল না। বিদ্রোহী কবিতা বিপ্লবীদের কণ্ঠে দিয়েছে সংগ্রামের ভাষা। ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না’ কথাটি আপামর জনতাকে করেছে অনুপ্রাণিত। অপূর্ব সাহস ও শৌর্যে জনচিত্ত আহলাদিত হয়েছে।

জালিম শাহী এ কবিতায় অব্যক্ত ক্ষোভের প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছে। স্বৈর শাসকের গর্দানে ছিল মহা দুরমুশ। বিস্ময় আর অস্বস্তি তৈরি করেছে বৃটিশ প্রশাসনে। নিগৃহীত মানুষের মনে জাগিয়েছে পরিবর্তনের চেতনা ও প্রেরণা।

নজরুল সর্বাংশে স্বদেশি আবার বিশেষভাবে আন্তর্জাতিক। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। সমানভাবে সমাদৃত তার জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গে। ভারত ও বাংলাদেশে রয়েছে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। ইউরোপেও নজরুল চর্চা আগের চেয়ে বেড়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।

নজরুল কোনো নির্দিষ্ট কালে বা অঞ্চলে সীমিত নন। বিশ্বময় বিদ্রোহী কণ্ঠ হিসেবে আলোচিত ও সমাদৃত। মানবতা ও সাম্যের কবি হিসেবে অনন্তকাল ধরে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।

১৯২১ সালে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বিদ্রোহী লেখা হয়েছে। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় কবিতাটি ছাপা হয়। কয়েক দিনের মধ্যে প্রবাসী, সাধনা, ধূমকেতু ও বসুমতী সহ বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় এটি মুদ্রিত হয়। সৃষ্টি হয় সর্বত্র মহা তোলপাড়। 

সাহিত্য সমালোচকেরা মনে করেন বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে নজরুলের মত এমন সৌভাগ্য আর কারো হয়নি। মাত্র ২২বছর বয়সে তিনি বিস্ময়কর সাড়া জাগিয়েছেন।

বিদ্রোহী একটি কালজয়ী সৃষ্টি। ৮টি স্তবক, ১৪৯টি পঙ্‌ক্তির একটি দীর্ঘ কবিতা। অবশ্য বাংলা একাডেমির ‘নজরুল রচনাবলী’ ১৯৯৬ মোতাবেক একশ ঊনচল্লিশ পঙ্‌ক্তি উল্লেখ করা হয়েছে। আর একশ বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ গুণেন কেউ কেউ।

বিদ্রোহী মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। মুক্তক ছন্দে কবিতাটি মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। বাংলা ভাষায় নজরুলই এই ছন্দের প্রবর্তক। বিদ্রোহীর তাল ও ছন্দ সাগরের ঢেউয়ের মত তরঙ্গ সৃষ্টি করেছে। জাগিয়ে তুলেছে পাঠকহৃদয়। হাবিলদার নজরুল বিদ্রোহী কবি আখ্যায় ভূষিত হয়েছেন।

কবিতাটি শোনানোর পর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমি যদি আজ তরুণ হতাম, তাহলে আমার কলমেও ওই সুর বাজত।

বিদ্রোহী কবিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে দারুণ ভাবে জড়িয়ে আছে। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বিদ্রোহী লেখা হয়েছে। ১৯৭১ সালে ছিল বিদ্রোহী প্রকাশের GOLDEN JUBILEE বা সুবর্ণজয়ন্তি। আর এখন ২০২১ সালে বিদ্রোহী কবিতার শতাব্দী (CENTURY) ও বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তি।

১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে মধ্য কলকাতার নিউমার্কেট সংলগ্ন ৩/৪সি তালতলা লেনের একটি বাড়িতে বসে কাঠ পেন্সিলে কবিতাটি লিখেন কাজী নজরুল ইসলাম।

প্রথম প্রকাশ প্রসঙ্গে তৎকালীন কবি খান মুহম্মদ মঈনুদ্দিন লিখেছেন, মনে আছে, সেদিন আমাদের তরুণ মনে কী আবেগ, উন্মাদনা জেগেছিল! সারা বাংলা যেন আনন্দে, উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। পথে, ঘাটে, রেস্তোরাঁয়, চায়ের বৈঠকে শুধু এ কবিতারই আলোচনা চলছিল।

তরুণ সমাজ তো বিদ্রোহীর ভাষায় বাক্যালাপ শুরু করে দিল। যুবসমাজের আড্ডায় বা রাস্তায় একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে কবিতার কোনো একটি লাইন আউড়ে সম্বোধন করছে। আমি চেঙ্গিস, আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ। আরেকজন বলছে, আমি চির-বিদ্রোহী—বীর, বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির।

এই মহান পুরুষের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৫ মে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ প্রচেষ্টায় ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। সপরিবারে থাকার জন্য ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার পুরনো ২৮নং রোডের ৩৩০/বি বাড়িটি বরাদ্দ করা হয়। বাড়ির নামকরণ হয় ‘কবিভবন’।

১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে সরকারি ভাবে কাজি নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। পরের মাসেই তিনি দেশের শ্রেষ্ঠ স্বর্ণপদক ‘একুশে পদক’ সম্মানে ভূষিত হন।

৭৭ বছর বয়সে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট রোববার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে কবি নজরুল শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ সংলগ্ন কবরে তাকে সমাহিত করা হয়। ইন্তেকালের পরের বছর ১৯৭৭ সালে তাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির সম্মান প্রদান করা হয়। 

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ‍বিদ্রোহী কবি নজরুল সম্পর্কে যে গবেষণা (RESEARCH) চলছে তার অনেক কিছু জমা হচ্ছে বৃটিশ মিউজিয়ামে (BRITISH MUSEUM) । শিল্পকর্ম, প্রত্নসামগ্রী ও কারুপণ্যের সংগ্রহ ও প্রদর্শনীর বিচারে বিশ্বের প্রধানতম সংগ্রহশালা হচ্ছে বৃটিশ মিউজিয়াম। কবি নজরুলকে বাঙালি সাহিত্যিক এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে মিউজিয়ামের নিজস্ব ওয়েবসাইটে।

বিলেতে কবি নজরুল সেন্টার বেশ সমৃদ্ধ শিল্প ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। (KOBI NAZRUL CENTRE, 30 HANBURY STREET, LONDON E1 6QR) । এটি ইস্ট লন্ডনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মিলনস্থল ব্রিকলেন স্পিটালফিল্ডে অবস্থিত। ১৯৮২ সাল থেকে এখানে নজরুল চর্চার পাশাপাশি নিয়মিত বাংলা শিল্পকলার প্রচার, পারফর্মিং ও প্রদর্শনী হয়। 

আমাদের জাতীয় কবিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য লন্ডনে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নজরুল স্কুল (KOBI NAZRUL PRIMARY SCHOOL, SETTLES STREET, LONDON E1 1JP) জনমনে বিশেষ করে শিশুদের মাঝে কবি নজরুল সম্পর্কে আগ্রহ জন্মায়। 

২০০২ সাল থেকে সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্ট কবি নজরুলকে নিয়ে লন্ডনে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে দেশি-বিদেশী সাহিত্যিক-সাংবাদিক সহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকে অংশ গ্রহন করেন। অনুভবে নজরুল শিরোনামে অনুষ্ঠানে বক্তারা কবির লেখা থেকে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করেন। কবিকে ব্যাপক ভাবে বিশ্বময় পৌঁছে দেয়ার ব্রত নিয়ে কাজ করছে সংলাপ ফ্রন্ট।  https://www.facebook.com/sanglap.front গত ১৪ নভেম্বর ২০২১, রবিবার পূর্ব লন্ডনের রিচ মিক্স সেন্টারে টিএস এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ড এবং কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী মঞ্চস্থ হয়। https://laninfaeco.com/en/2021/11/18/saudhas-theatrical-production-the-rebel-and-the-waste-land-won-the-audience-of-east-london/ . বিশ শতকের দুটি কালজয়ী সাহিত্যকর্মের উপর ভিত্তি করে দ্য রেবেল এন্ড দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড নামক অনন্য নাট্য প্রযোজনা হাউসফুল দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল কর্তৃক FREEDOM AND INDEPENDENCE থিয়েটার উৎসবের অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের একটি শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক সাহিত্য ও সঙ্গীত প্ল্যাটফর্ম ’সওধা সোসাইটি অফ পোয়েট্রি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান মিউজিক’  কর্তৃক আয়োজিত ও মঞ্চস্থ হয়। এশিয়া ও ইউরোপের শ্রোতাদের মিশ্রণে একাডেমিক এবং সাধারণ শিল্প-প্রেমীরা অংশ গ্রহন করেন। উপস্থিত দর্শকদের মতে, এটা অবশ্যই স্মরণীয় এবং সমানভাবে শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। কেম্যান আইল্যান্ডের প্রাক্তন গভর্নর শীর্ষ বৃটিশ কূটনীতিক আনোয়ার চৌধুরী বলেন, এই প্রযোজনা দুটি ভিন্ন অভিব্যক্তির মাধ্যমে শান্তির দুটি বিস্ময়কর ব্যাখ্যা, যা আমার উপলব্ধিতে প্রশান্তি এনে দিয়েছে। প্রযোজনা পরিচালক ও সওধার প্রতিষ্ঠাতা কবি আহমদ কায়সার বলেন, আমরা যেভাবে দুটি প্রধান কাজকে কাঠামোগত এবং দার্শনিকভাবে মিশ্রিত করেছি, তা দর্শকরা পছন্দ করেছেন। এটি এখন বাংলাদেশ, ভারত এবং ইউরোপের আরও কয়েকটি শহরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে।

লন্ডনে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন দ্য টেগোরিয়ান্স (THE TAGOREANS)  কবি নজরুলকে নিয়ে চমৎকার তথ্যচিত্র করেছে ২০১৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর।  তারও আগে ১৯৯৯ সালে অত্যন্ত নান্দনিকতার সাথে  নজরুলের জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছে। তারা মূলত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন দর্শনে বিশ্বাসী এবং সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার সৃজনশীলতা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে কাজ করে। ১৯৬৫  সালে প্রয়াত তপন গুপ্ত এই সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। http://www.tagoreans.org/gallery.aspx

খ্যাতিমান লেখক শ্রীময়ী ভট্টাচার্য  (SREEMOYEE BHATTACHARYA) কবি নজরুলকে নিয়ে দুই ঘণ্টার একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানিয়েছেন ২০১৪ সালে। ২০১৭ সালে এটির প্রথম প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই বছর তা কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।  শ্রীময়ী ভট্টাচার্য  বলেন, নজরুলের প্রতিটি দিককে স্পর্শ করবে এমন কোনও তথ্যচিত্র ছিল না। ১৯৬৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেলুলয়েড 'নজরুল' নিয়ে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছিল, যা আর পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে কাজ করার পর নজরুলের মতো বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিত্বকে আরও ভালোভাবে জানার গুরুত্ব আমি উপলব্ধি করেছি। কবিতা, সঙ্গীত ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নজরুলের অবদান অকল্পনীয়। কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা ‘বিদ্রোহী কবি’ বলে থাকি। আমার ডকুমেন্টারির মাধ্যমে আমি সঙ্গীতের দৃশ্যপটে তার অবদানকেও স্পর্শ করেছি। তিনি গান লিখতেন। থিয়েটার, চলচ্চিত্র এমনকি প্রশিক্ষিত শিল্পীদের জন্য সুর তৈরি করতেন। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ‘হারমনি’ অনুষ্ঠানের জন্য তিনি পুরনো রাগগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। https://www.getbengal.com/details/is-kazi-nazrul-islam-more-celebrated-in-bangladesh-than-kolkata  লন্ডনের  সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ে  বেশ গুরুত্বের সাথে নজরুল চর্চা হয়। বাংলার বিদ্রোহী কবি : নজরুল ইসলাম (THE REBEL POET OF BENGAL: NAZRUL ISLAM) শীরোনামে অনেক তথ্যবহুল লেখা তাদের ওয়েবসাইটে রয়েছে। স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS) এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের অধ্যয়নের জন্য বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে MULOSIGE - Multilingual Locals and Significant Geographies নামে ইউরোপীয় রিসার্চ কাউন্সিলের অর্থায়নকৃত গবেষণা প্রকল্পের নেতৃত্বে রয়েছেন অধ্যাপক ফ্রান্সেসকা ওরসিনি। MULOSIGE প্রকল্পে বিশ্ব সাহিত্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য অসংখ্য লেখা অন্বেষণ করে বহুভাষিক সমাজের সামনে উপস্থাপন করা হয়। কবি নজরুলের লেখা এতে বিশেষ ভাবে স্থান পেয়েছে। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিশ্বসাহিত্যেরে উপাদান বিবেচনায় সুলেখক মরিয়ম ইরাজ নজরুল সম্পর্কে উর্দু সাহিত্যের অনেক মূল্যবান লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। http://mulosige.soas.ac.uk/the-rebel-poet-of-bengal-nazrul-islam/

বিশ্বের বিভিন্ন কবির কবিতা নিয়ে কাজ করে পয়েম হান্টার (POEM HUNTER)। কবি নজরুলের অনেক কবিতা তারা ইংরেজিতে অনুবাদ করে পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছে। POEMS FROM DIFFERENT POETS ALL AROUND THE WORLD. THOUSANDS OF POEMS, QUOTES AND POETS.  https://www.poemhunter.com/kazi-nazrul-islam/biography/#google_vignette

সুইডেনে কবি নজরুলকে নিয়ে অনুষ্ঠান ও লেখালেখি চোখে পড়ার মত। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিচারণ (REMINISCENCES: BANGLADESH NATIONAL POET KAZI NAZRUL ISLAM) তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য। এশিয়ান ট্রিবিউন থেকে নিয়ে এইচটি ডিজিটাল কন্টেন্ট সার্ভিসেস এটা প্রকাশ করেছে। https://www.thefreelibrary.com/Reminiscences%3A+Bangladesh+National+Poet+Kazi+Nazrul+Islam-a0501878986

ইংরেজি সাহিত্যের কবি জর্জ গর্ডন লর্ড বায়রন ও আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম সম্পর্কে  BYRON AND NAZRUL AS POET শীরোনামে  ১৭ জুন ২০২১ তারিখে দৈনিক সান পত্রিকায় লেখাটি বেশ পাঠক প্রিয়তা লাভ করেছে। https://www.daily-sun.com/printversion/details/559092/Byron-and-Nazrul-as-Poet এই লেখা ইউরোপের কয়েকটি অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।  বৃটানিয়া ইউনিভার্সিটির সাবেক ভিসি অধ্যাপক এম মতিউর রহমান লেখাটি সম্পর্কে বলেন, আমি যে  শিরোনামে লিখেছি, তা দুই কবির মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণের একটি অংশ। সাধারণভাবে বলতে গেলে আমরা জানি, কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের কবি এবং জর্জ গর্ডন লর্ড বায়রন ইংরেজি সাহিত্যের কবি। নিখুঁত বিশ্লেষণের জন্য কবি হিসেবে তাদের মধ্যে মিল এবং অমিলগুলি তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।

ইউরোপীয়ান আমেরিকান জার্ণালে (EUROPEAN - AMERICAN JOURNALS) কাজী নজরুল ইসলাম এবং তার বিদ্রোহী কবিতার উপর একটি গবেষণা রয়েছে। THE COMPULSIVE VOICE OF DECOLONIZATION: A STUDY ON KAZI NAZRUL ISLAM AND HIS REBELLIOUS POEMS শীরোনামে লেখাটি পাঠক মহলে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। https://www.eajournals.org/journals/international-journal-of-english-language-and-linguistics-research-ijellr/vol-8-issue-2-march-2020/the-compulsive-voice-of-decolonization-a-study-on-kazi-nazrul-islam-and-his-rebellious-poems/ লেখক তানজিন সুলতানার মতে, অন্য দেশ দ্বারা দখল ও নিয়ন্ত্রিত একটি দেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা ও নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে তোলা সহজ নয়। আফ্রিকা এবং এশিয়ার ইউরোপীয় উপনিবেশগুলিকে মুক্ত করার সংকল্প বিংশ শতাব্দীতে একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। বৃটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম বেশ প্রাসঙ্গিক। তার কবিতা ও সাংবাদিকতার সবচেয়ে অসামান্য দিক হল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। তিনি জানেন ঔপনিবেশিকদের শোষণ বন্ধ করতে হলে সাম্রাজ্যবাদের শক্তিকে উৎখাত করতে হবে। নিপীড়িত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিদ্রোহী কবিতার মাধ্যমে তিনি পশ্চিমা উপনিবেশ থেকে নিজের ভূখণ্ড, সংস্কৃতি এবং মানুষের মন-স্বাধীন করতে চেয়েছেন। 

যুক্তরাজ্যের DISABILITY ARTS ONLINE নজরুল সম্পর্কে লেখা সমূহ গুরুত্বের সাথে প্রচার করে।  https://disabilityartsonline.org.uk/kazi-nazrul-islam-debjani-chatterjee এই লিংকে সংযুক্ত লেখায় দেবযানী চ্যাটার্জি একজন কবি হিসেবে তার জীবন এবং কর্মজীবনে নজরুলের কবিতার প্রভাবের বিবরণ দিয়েছেন, যা দুটি মহাদেশের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। তার মতে, কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন বাঙালি বহুভাষী  লেখক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং বিপ্লবী। ‘নজরুল’ নামে জনপ্রিয়, তার কবিতা ও সঙ্গীত ফ্যাসিবাদ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ইন্দো-ইসলামিক নবজাগরণ এবং তীব্র আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ। নজরুল হলেন একজন মহান সাহিত্যিক, কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, গায়ক, অভিনেতা, সৈনিক এবং বিপ্লবী। তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গীতিকার-সুরকার। তার সবচেয়ে ফলপ্রসূ কিছু বছর অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করেছেন। তিনি নারী, যুবক, প্রতিবন্ধী, দরিদ্র এবং নির্যাতিত সকলের জন্য হিন্দু-মুসলিম সংহতি এবং সমতাকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন।

বৃটেনের জাতীয় কবি ডব্লিউ ওয়ার্ডসওয়ার্থ, পার্সি বি শেলি এবং কাজী নজরুল ইসলামের রোমান্টিক কবিতায় নৈতিকতা নিয়ে অধ্যাপক মোস্তফা মুনীর (PROFESSOR MUSTOFA MUNIR) চমৎকার একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। ETHICALITY IN ROMANTIC POETRY- W. WORDSWORTH, PERCY B SHELLEY AND KAZI NAZRUL ISLAM শীরোনামের লেখাটি ২৯ মে ২০২১ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে।

 https://www.observerbd.com/news.php?id=314585 . ইউরোপেও পাঠক নন্দিত এই লেখায় মোস্তফা মুনীর বলছেন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি এবং বিংশ শতাব্দীর কবি নজরুল তাদের স্বতন্ত্র প্রতিভা, দক্ষতা এবং রোমান্টিক কবিতা লেখার শৈলীর জন্য অত্যন্ত সম্মানিত। সাহিত্যে তাদের কাব্যিক অবদানের প্রভাব বিশাল ও গভীর। ক্লাসিক রোমান্টিক কবিতাগুলি তৈরি করার সময়  নৈতিক মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিকতা এবং ভালবাসার সাথে প্রকৃতির মার্জিত পরিবেশের সাহায্যে তাদের কল্পনাশক্তি ব্যবহার করেছেন।

কেমব্রিজে প্রকাশিত (CAMBRIDGE UNIVERSITY PRESS) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে কবিতায় নজরুলের লেখা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। THE CAMBRIDGE COMPANION TO THE POETRY OF THE FIRST WORLD WAR শীরোনামে বিশ্বখ্যাত লেখকদের কবিতা সংকলিত হয়েছে।  https://books.google.co.uk/books?id=aekfAgAAQBAJ&pg=PA273&lpg=PA273&dq=Poet+Nazrul+in+L qtvsiUQ&hl=bn&sa=X&ved=2ahUKEwie_8b4vqX0AhVIVsAKHc5JDfI4WhDoAXoECB8QAw#v=onepage&q=Poet%20Nazrul%20in%20London&f=false

বিশ্বের সেরা নিউজরিল সংরক্ষণাগার ‘বৃটিশ পাথে’ কবি নজরুলকে দারুণ ভাবে মূল্যায়ন করেছে।  কবির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সহ হাজার হাজার মানুষের অংশ গ্রহনের ডকুমেন্ট প্রকাশ করেছে। BANGLADESH: HUNDREDS OF THOUSANDS ATTEND HERO'S FUNERAL FOR BENGALI "REBEL" POET, NAZRUL ISLAM সংবাদ ও ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, শেষ বিদায়ে কবি লাখো জনতার দোয়া ও ভালোবাসায় সিক্ত। https://www.britishpathe.com/video/VLVA2SPQECSEMAX803JPA5BYDA5Z8-BANGLADESH-HUNDREDS-OF-THOUSANDS-ATTEND-HEROS-FUNERAL-FOR/query/Poet . প্রায় ৮৫ হাজার চলচ্চিত্রের ভান্ডারে সমৃদ্ধ বৃটিশ পাথ। বিনামূল্যে অনলাইনে দেখার জন্য কোম্পানির Facebook, Twitter, Instagram, Pinterest, Tumblr, WordPress এবং LinkedIn-এ তা রয়েছে। ১৮৯৬ থেকে বিশ্বজুড়ে প্রধান ইভেন্ট, বিখ্যাত ব্যক্তি ও সংস্কৃতির ফুটেজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক তাত্পর্যের ক্ষেত্রে অতুলনীয়। 

ইউরোপ সহ বিশ্বময় অত্যন্ত জনপ্রিয় বিশ্বকোষ নিউ ওয়ার্ল্ড এনসাইক্লোপিডিয়া (NEW WORLD ENCYCLOPEDIA) কবি নজরুল সম্পর্কে বিষদ বর্ণনা দিয়েছে। https://www.newworldencyclopedia.org/entry/Kazi_Nazrul_Islam . বিশ্বদর্শন হিসেবে খ্যাত নিউ ওয়ার্ল্ড এনসাইক্লোপিডিয়া (NWE) মানুষের জ্ঞানকে সংগঠিত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে সমগ্র বিশ্বের কাছে সহজে তথ্য পৌছতে পারে। এটি ১৭৬৮ সাল থেকে বিশ্বের প্রত্যেক মানুষের জন্য একটি দরকারী টুল এবং শিক্ষা ও গবেষণার জন্য আদর্শ সম্পদ।

সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে (THE UNIVERSITY OF SYDNEY) নজরুল চর্চার প্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে। সেখানে প্রকাশিত ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক গবেষণা KAZI NAZRUL ISLAM AND W.B. YEATS: THE VOICES OF SPIRITUAL FREEDOM, NATIONALISM AND INTERNATIONALISM একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ। (Authors: Jebun Geeti, International Entrepreneurship and Management Journal 4(1):93-107/, January 2016)। এতে কাজী নজরুল ইসলাম এবং ড. ইয়েটসকে ভারতীয় উপমহাদেশ ও আয়ারল্যান্ডের মানুষের আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদ এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের কণ্ঠস্বর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

জাজ মিউজিক গ্রুপের গ্র্যান্ড ইউনিয়ন অর্কেস্ট্রারে নেতৃস্থানীয় গায়িকা হিসেবে খ্যাত লুসি রহমান কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী চেতনার অন্বেষণের প্রয়াসে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। তিনি যুক্তরাজ্যের অসংখ্য মঞ্চ, টেলিভিশন এবং রেডিও তে অনুষ্ঠান করেন। বিবিসি এবং চ্যানেল ৪ টেলিভিশনে  একক অনুষ্ঠান করেছেন।  অনেক প্লেব্যাক গানের গায়িকা হিসেবেও গান গেয়েছেন। তিনি খ্যাতিমান শিল্পী আমিনা খৈয়ামের সাথে ২০১৫ সালের ২৪ এবং ২৫ মার্চ লন্ডনে একটি পারফরম্যান্স উপস্থাপন করেন। লুসি রহমান বলেন, তাদের প্রচেষ্টা হচ্ছে নজরুলের কাজকে সামনে নিয়ে আসা, যাতে আজকের বিশ্ব সমাজ তার প্রাসঙ্গিকতা অন্বেষণ করে।

ওয়ার্ডস উইদাউট বর্ডারস (WORDS WITHOUT BORDERS) কবি নজরুলকে নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। CELEBRATING KAZI NAZRUL ISLAM, REBEL POET OF BENGAL BY LIESL SCHWABE https://www.wordswithoutborders.org/dispatches/article/celebrating-kazi-nazrul-islam-rebel-poet-of-bengal-liesl-schwabe . এতে বলা হয়েছে নজরুলের তাৎপর্য একাডেমিক ক্ষেত্রের বাইরেও বিস্তৃত। তিনি নিজেকে বিপ্লবী প্রমাণ করে বাংলা সাহিত্য এবং রাজনীতি উভয়ই প্রজ্বলিত করেছেন। ওয়ার্ডস উইদাউট বর্ডারস আন্তর্জাতিক সাহিত্যের অনুবাদ, প্রকাশনা এবং প্রচারের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া প্রসারিত করে। তাদের প্রকাশনা এবং প্রোগ্রামগুলি সারা বিশ্বের ইংরেজি পাঠকদের জন্য বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ভাষার লেখকদের দ্বারা প্রদত্ত ঘটনাগুলিতে সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গির দরজা খুলে দেয়।

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে THE NAZRUL-BURNS CENTRE, The Centre for East-West Arts and Cultural Excellence, Scotland. এর মূল উদ্দেশ্য হলো বহুমাত্রিক বৈশ্বিক সংস্কৃতি চর্চা এগিয়ে নেয়া এবং বিশ্ব্যবাপী তার প্রচার। এজন্য তারা স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নস ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তাদের লেখনী নিয়ে গবেষণা করছেন। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী শিল্প, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে বহু-সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

’নজরুল ফাউন্ডেশন কানাডা’ কয়েক বছর ধরে দেশে-বিদেশে নজরুল চর্চা অব্যাহত রেখেছে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও কর্ম নিয়ে সরব রয়েছেন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান গবেষক কবি নুরুল ইসলাম।

ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মবিজ্ঞান বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফিলিস কে হারমান নজরুল বিষয়ক গবেষকদের অন্যতম। নজরুলের কবিতার চিত্রিত চারুকল্পে বহুরৈখিক সংস্কৃতি র্চচা, মানবতাবাদ, প্রেম, শত বছরের কবিতার বাঁকবদল, দ্রোহ, শোষকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, উত্তরাধুনিকতা, বৈশ্বিক পরিবেশ চিন্তা, কৃষকের ভাতের অধিকার, নারীর অধিকার, তৃণমূল মানুষের মৌলিক অধিকার সর্বোপরি ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’র অমোঘ দর্শনের যে উপাদান বিদেশী পণ্ডিতেরা পেয়েছেন তাতে  তারা মোহিত এবং আকৃষ্ট হয়েছেন।

বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী উপাচার্য এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উইনস্টন ই ল্যাংলি ইংরেজি ভাষাভাষি মানুষের কাছে নজরুলকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া জন্য KAZI NAZRUL ISLAM: THE VOICE OF POETRY AND THE STRUGGLE FOR HUMAN WHOLENESS শিরোনামে একটি বিশাল গন্থ সম্পাদনা করেছেন। ২০০৭ সালে এটি বই হিসেবে  প্রকাশিত হয়। দুই বছর পর বেরোয় দ্বিতীয় সংস্করণ। অনেকের মতো ল্যাংলিও বিশ্বাস করেন, ইংরেজ কবি শেলীর দৃষ্টিভঙ্গি নজরুলের লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে। ২০০২ সালে লসএঞ্জেলসে অনুষ্ঠিত  নজরুল কনফারেন্সে প্রফেসর ল্যাংলি নজরুলকে নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন। তিনি তার লেখায় নজরুলকে সমসাময়িক বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ফরাসী ভাসায় কাজী নজরুল ইসলাম: পোয়েমস চয়েসিস KAZI NAZRUL ISLAM: POEMS CHOISIS (French), কাজী নজরুল ইসলাম: চ্যান্সন্স KAZI NAZRUL ISLAM: CHANSONS (French) এবং স্প্যানিশ ভাষায় কাজী নজরুল ইসলাম: পেওমাস এলিগিডোস KAZI NAZRUL ISLAM: PEOMAS ELEGIDOS (Spanish) গ্রন্থ সমূহ সাম্প্রতিক কালে বেশ আলোচিত।

জাপানের ড. কুয়েকার নিউয়া (DR. KUEKER NEUA) নজরুলকে নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। একই ভাবে কবি নজরুলকে নিয়ে কাজ করা বিদেশীদের মধ্যে নেদারল্যান্ডের লেখক-সাংবাদিক ড. পিটার কাস্টার্স, চিনের ইয়াং উইং মিং প্রমুখের নাম উল্লেখ করতে হয়। তারা নজরুলের সাহসী ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে বিশেষ ভাবে মূল্যায়ন করেছেন।

কাজী নজরুল ইসলামকে মনে করা হয় আদর্শিক ধ্রুব তারার মতো। তার ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, নহে কিছু মহীয়ান...’ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মানুষ নজরুল বড় হয়ে উঠেছেন। নজরুল মানুষের মহত্ত্বকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। মাত্র ২৩ বছরে তিনি সাড়ে চার হাজার গান রচনা করে গেছেন। নজরুল ইনস্টিটিউট কবির ১৮০০ গানের স্বরলিপি তৈরি করেছে। তিন হাজার ১৬টি গানের একটি সংকলন প্রকাশ করেছে। http://nazrulinstitute.gov.bd/ ইউরোপে নজরুল চর্চায় নতুন আলোচনার বিষয় হচ্ছে সাংবাদিকতায় নজরুল। গবেষণা মতে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক বাঁধভাঙা প্রতিভা। বিদ্রোহী কবি হিসেবে ভুবনখ্যাত। সাংবাদিক হিসেবে উপমহাদেশে স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষক। ১৯২০ সালের ১২ মে মাসিক মোসলেম পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ২১ বছরে বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছেন। আকাশচুম্বী কবি খ্যাতির নিচে কিছুটা হলেও চাপা পড়ে গেছে তার সাহসী সাংবাদিকতার ইতিহাস।

নজরুল ছিলেন বিশ্বযুদ্ধের আপসহীন লড়াকু নৈসিক। এক সময় অস্ত্রের বদলে কলম হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ‘নবযুগ` ও ‘ধূমকেতু`র মতো কাগজে কবিতার পাশাপাশি সাংবাদিকতায় ঝড় তুলেছেন। সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণা লাঘবে সাংবাদিকতায় নব যুগান্তরের জন্ম দিয়েছেন। ঘুমন্ত ভারতবাসিকে জাগ্রত করে সাম্য-মৈত্রী ও স্বাধীনতার বীজ বপন করেছেন। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা সেই বীজের ফসল।  

জাতীয় জাগরণের বংশীবাদক কাজী নজরুল আধুনিক বাংলা গানের জগতে ’বুলবুল’ নামে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতবর্ষের মানুষ কেন পিছিয়ে পড়েছে, সে কথা তিনিই প্রথম দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে তুলে ধরেছেন। শাসক-শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে অদম্য মেধা ও সাহসের পরিচয় দেন। সংবাদ মাধ্যমে জনগণের মনে কথা তিনি যথার্থ ভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তার বিদ্রোহ  ছিল উপনিবেশের বিরুদ্ধে, জাত-পাত ও বিভাজনের বিরুদ্ধে, অসত্য-অসুন্দরের বিরুদ্ধে।

বিদ্রোহী নজরুলের সংবাদ তৈরি এবং প্রকাশের দক্ষতা ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং শিক্ষামূলক। বৈশ্বিকভাবে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতার বর্তমান অবস্থা তখন ছিলনা। দেশের সংবাদপত্র কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তা তিনি জানতেন। সাংবাদিকতার ব্যাপারে তার প্রতিভা দেখে সমকালিন সম্পাদকেরা তাজ্জব বনে গেছেন।

নজরুল ইসলামের লেখায় অবিচার ও শোষণ বিরোধী গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে শোষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রেরণা যুগিয়েছে। তার ‘জার্নালিজম অব আউটরেজ’ সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছিল। প্রতিটি লেখার প্রতিক্রিয়া দেখে সমকালীন খ্যাতিমান রিপোর্টারগণ বিস্মিত হয়েছেন। 

নজরুল জানতেন তথ্য কোথায় খুঁজতে হবে এবং কীভাবে এগুলোকে একটির সঙ্গে আরেকটিকে সংযুক্ত করতে হবে। প্রমাণ বিশ্লেষণ, যাচাই ও পটভূমি ব্যাখ্যার মাধ্যমে তিনি অর্থবহ প্রতিবেদন  তৈরি করেছেন। সাংবাদিকতার নৈতিক মান বজায় রাখতে গিয়ে আইনভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়ানোর চেষ্টা করেননি। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় গোয়েন্দা পুলিশের মতো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ তুলে ধরতেন। বিজ্ঞানীর মতো প্রমাণ আবিষ্কার করতেন।

'নবযুগ' পত্রিকার মাধ্যমে কাজী নজরুল সাংবাদিকতার জগতে নিজস্ব স্বকীয়তা প্রকাশে সক্ষম হন। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের অর্থায়নে ১৯২০ সালের ১২ জুলাই দৈনিক ’নবযুগ` নামে এই দৈনিক প্রকাশিত হয়। সম্পাদক হিসেবে ফজলুল হকের নাম মুদ্রিত হলেও মূলত নজরুল ছিলেন কার্যনির্বাহী সম্পাদক। ‌'নবযুগ' পত্রিকায় কবি লিখেন ‍‘কোথা থেকে এলো লেখার জোয়ার, তরবারী ধরা হাতে/ কারার দুয়ার ভাঙ্গিতে চাহিনু, নিদারুণ সংঘাতে ’।

নবযুগ পত্রিকায় নজরুল ইসলাম স্বাধীনতার ঝড় তুলতে শুরু করলেন। নজরুলই প্রথম কবিতা দিয়ে পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখার সুচনা করেন। ‍ ’মেকাপ করিয়া অভিনেতা হয়/ নেতা নাহি হওয়া যায়/ নিরহংকার নির্লোভ নেতা/ কোন কিছু নাহি চায়।/ অভিনন্দন মালা চাহে নাকো/ চাহে না জ্বয়ধ্বনি/ চাকরের মত দেশ সেবা করে/ তাহাকেই নেতা জানি।‍’

নবযুগে ‘ধর্মঘট’ বা ‘উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন’ প্রবন্ধে উপেক্ষিত কৃষক-মজুর সমাজের প্রতি নজরুলের অসাধারণ মমত্ববোধ প্রকাশ পায়। নবযুগে নজরুলের বড় বড় অক্ষরের কাব্যিক শীরোনাম আর জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় লেখা ছিল পান্ডিত্য ও বৈদগ্ধ্যে সমৃদ্ধ। মৃত্যুভয়কে পেছনে ঠেলে তার অসাধারণ খবর প্রকাশের অসীম সাহসিকতা সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। শক্তিশালী ও শাণিত সম্পাদকীয় লিখে তিনি বিদেশী শোষক এবং অত্যাচারী শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে তোলেন। ইংরেজ সরকার তার কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদন্ডে দন্ডিত করে।

আদালতে নজরুলের রাজবন্দীর জবানবন্দীতে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। ইংরেজ সরকারের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রায় চল্লিশ দিন তিনি একটানা অনশন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁকে গ্রন্থ উৎসর্গ করে ভালোবাসা জ্ঞাপন করেন। অপরদিকে তদানীন্তন বৃটিশ সরকারের শ্যেন দৃষ্টি পড়ে পত্রিকাটির উপর। সরকার একাধিকবার সতর্ক করেও দমাতে পারেনি। অবশেষে ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে` শীর্ষক প্রবন্ধের জন্য ’নবযুগ` পত্রিকার জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করে।

১৯২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী মওলানা আকরম খাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক মোহাম্মদী। পরবর্তীতে দৈনিক সেবক। উভয় পত্রিকায় নজরুল সম্পৃক্ত ছিলেন। কিন্তু নজরুলের প্রদাহজনক লেখা প্রকাশের হিম্মত তিনি বেশি দিন দেখাতে পারেননি। নজরুলের লেখা সেন্সর করায় রাগ করে এটি ছেড়ে দেন।

১৯২২ সালের ১১ আগস্ট নজরুলের সম্পাদনায় অর্ধ সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু` প্রকাশিত হয়। পত্রিকার অভিনন্দন জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাণীতে লিখেন- আয় চলে আয়, যে ধূমকেতু,/ আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,/ দুর্দিনের এই দুর্গ শিরে/ উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।/ অলক্ষণের তিলক রেখা/ রাতের ভালো হোক না লেখা/ জাগিয়ে দে রে চমক মেরে,/ আছে যারা অর্ধচেতন।

‘ধূমকেতু` প্রথম সংখ্যায় নজরুল লেখেন, দেশের যারা শত্রু, দেশের যা কিছু মিথ্যা, ভন্ডামি, মেকি তা সব দূর করতে ‘ধূমকেতু` হবে আগুনের সম্মার্জনী। … ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। … ভারত বর্ষের এক পরমাণু অংশ ও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসন ভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোন বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না।`

‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা‘, ’ঘর শত্রু বিভিষণ‘, ‘দুঃশাসনের বস্ত্রহরণ’, ‘চালাও যুদ্ধ চালাও’ ইত্যাদি সংবাদ সরস অথচ তীক্ষ্ন শিরোনাম দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পত্রিকাটি ছাপা হবার সাথে সাথে বিক্রি হয়ে যেত। রাস্তার মোড়ে মোড়ে তরুণের দল কাগজটি কেনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো। কাগজের বান্ডিল নিয়ে হকার আসার পর হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি লেগে যেত। আগ্রহী পাঠকেরা হকারকে আগাম টাকা দিয়ে রাখতো। চায়ের দোকানে পাঠকদের ভিড়,  ছাত্রদের হোস্টেলে, বৈঠক ঘরে সর্বত্র আলোচনা চলতো।

ধূমকেতুর প্রকাশকে স্বাগত জানিয়ে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ আগস্ট অমৃতবাজার পত্রিকায়  আশাবাদ ব্যক্ত করে লেখা হয় ‘সৈনিক কবির হাতে ‘ধূমকেতু’ শুধু ধ্বংসের প্রতীক না হয়ে সুন্দর স্থায়ী ও পবিত্র  কিছু সৃষ্টি করতে সমর্থ হবে।’ ‘ধূমকেতু` দ্বাদশ সংখ্যায় প্রকাশিত নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে` শীর্ষক কবিতার জন্য তিনি কারারুদ্ধ হন।

পরবর্তীতে নবযুগ আবার প্রকাশিত হয়। সম্পাদক নিযুক্ত হন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২২ সালে মাওলানা আকরাম খাঁ কারারুদ্ধ হলে কাজী নজরুল ইসলাম তার সম্পাদিত ‘দৈনিক সেবক’-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর লেবার স্বরাজ পার্টির একটি মুখপত্র ‘লাঙল’ প্রকাশিত হয়। কাজী নজরুল ইসলাম সেটির পরিচালক নিযুক্ত  হন এবং সম্পাদক  হন  তার বন্ধু মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়। মণিভূষণ ছিলেন নাম মাত্র সম্পাদক। সব কিছুই করতেন নজরুল। ১৯২৬ সালের ১২ আগস্ট ‘গণবাণী’ প্রকাশিত হয়। গণবাণীতেই তিনি লেখেছেন অনেক দিন।

১৯২২ সালের নভেম্বরে কবি গ্রেফতার হন। ১৯২২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাাঁকে জেলখানায় পাঠানো হয়। করাগারে থেকেও বিদ্রোহের আগুন নিভেনি কবি নজরুলের।

ব্যাপক বাধা বিপত্তি আর চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে ১৯২৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশ করলেন লাঙ্গল পত্রিকা। এই পত্রিকার সব কাজকর্ম তিনি একাই করতেন। লাঙ্গলে এবার তিনি আরো বেশি জ্বালাময়ী লেখা লিখতে থাকলেন। কবি লিখলেন- ‍ ’ দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা/ শুধিতে হইবে ঋণ।‍ ’

ইউরোপে এখন সাংবাদিকতায় যে মানদন্ডের কথা কথা বলা হচ্ছে, বহুকাল আগে কবি নজরুল তা বাস্তবে প্রমান করে গেছেন।  তাই কবিতার পাশাপাশি সংবাদিকতায় নজরুল এখন বেশ আলোচিত বিষয়। বছরের হিসেবে ক্যালেন্ডারের পাতায় একশ বছর অতিক্রম করেছে।  সে সাংবাদিকতার হালখাতা মিলাতে গেলে অবাক হতে হয়। নজরুল সংবাদপত্রের সব ধারণা পাল্টে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অনুসন্ধানী ও সৃজনশীল সাংবাদিকতার কিংবদন্তি। নজরুলকে আধুনিক বাংলা সাংবাদিকতার জনক বা ফাদার অব দ্য জার্নালিস্ট বলা যায়। যে জন্যে আগামীর ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

লেখক: লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক, কবি কথাসাহিত্যিক

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;