স্মৃতির মনিকোঠায় ড. আশরাফ সিদ্দিকী



সাঈদ চৌধুরী
ড. আশরাফ সিদ্দিকী

ড. আশরাফ সিদ্দিকী

  • Font increase
  • Font Decrease

ড. আশরাফ সিদ্দিকীর মৃত্যুবার্ষিকী ফিরে এল। হৃদয় দিয়ে তার শূন্যতা অনুভব করছি। ২০২০ সালের ১৯ মার্চ তিনি ইন্তেকাল করেন। আজ সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্টের উদ্যোগে লন্ডনে তার আত্মার মাগফিরাতের জন্য বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন।

ড. আশরাফ সিদ্দিকী ছিলেন বিশিষ্ট লোকবিজ্ঞানী। বাংলাদেশে লোক ঐতিহ্য গবেষণায় তার তুলনা রহিত। বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যকে যারা সমৃদ্ধ করেছেন ড. আশরাফ সিদ্দিকী তাদের একজন। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, শিশু সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ড. আশরাফ সিদ্দিকী ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন।

আমি বিলেতে বাংলা চর্চা নিয়ে গবেষণাকালে ড. আশরাফ সিদ্দিকী বহুবার আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তাকে জানিয়ে ছিলাম, বিলেতে বাংলা ভাষার চর্চা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পর লন্ডনে সবচেয়ে বেশি বাংলা চর্চা হয়। ব্রিকলেন ‘বাংলা টাউন’ এখন ‘তৃতীয় বাংলা’ হিসেবে খ্যাত। গ্রেট বৃটেনে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশির বসবাস। শুধু টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে বাস করেন ৫০ হাজারের অধিক।

ড. আশরাফ সিদ্দিকী বিলেতে আমাদের ভাষা ও সংস্কিৃতি চর্চা সম্পর্কে লেখা চেয়েছিলেন। ‘বিলেতে বাংলা চর্চা ও বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন’ শীরোনামে একটি লেখা পাঠিয়েছিলাম। ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। সেখানে আমি উল্লেখ করেছি, বিলেতে বাংলা ভাষার চর্চা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পর লন্ডনে সবচেয়ে বেশি বাংলা চর্চা হয়। ব্রিকলেন ‘বাংলা টাউন’ এখন ‘তৃতীয় বাংলা’ হিসেবে খ্যাত। গ্রেট বৃটেনে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশির বসবাস। শুধু টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে বাস করেন ৫০ হাজারের অধিক।

ড. আশরাফ সিদ্দিকী ও সাঈদ চৌধুরী

ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে সিলেট অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের চাষ শুরু হলে চা রফতানির কাজে সিলেটের মানুষ বিলেত যাত্রা শুরু করেন। এরপর জাহাজ শ্রমিক হিসেবে ব্যাপক হারে মানুষ বিলেত পাড়ি জমিয়েছেন। উচ্চতর পড়ালেখার জন্যও এসেছেন অনেকে। ভ্রমণ, কর্মসংস্থান এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ নিয়েও হাজার হাজার মানুষ প্রবাসী হয়েছেন। উচ্চ শিক্ষিতরা বিভিন্ন পেশায় জড়িত হলেও অসীম সাহসী সাধারণ মানুষ বিলেতে গড়ে তুলেছেন একের পর এক রেস্টুরেন্ট। গত শতকে বাংলাদেশিদের প্রতিষ্ঠিত প্রায় দশ হাজার রেস্টুরেন্ট এখন বৃটেনের কারি ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

আমার সম্পাদিত বাংলাদেশি ব্যবসা-বাণিজ্যের নাম ঠিকানা ও ফোন নম্বর সম্বলিত ‘ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি’তে আরও অনেক তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে।
নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিরা গড়ে তুলেছেন মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। যেখানে ধর্ম ও ভাষা চর্চা চলছে সমান্তরাল ভাবে। বহুজাতিক সমাজের আবাসস্থল মাল্টিকালচারাল লন্ডন সিটিতে ১৩১টি স্পোকেন ল্যাঙ্গুয়েজ আছে। ভাষার দিক থেকে বাংলার অবস্থান এখন চতুর্থ। এভাবে বিলেতে বাংলাদেশিরা বাংলা ভাষার বিশ্বায়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

বাঙালির বিলেত জয় সম্পর্কে তথ্য চেয়েছিলেন ড. আশরাফ সিদ্দিকী। মূলত: বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জে বসবাসের শতক অনেক আগেই পেরিয়েছে অভিবাসী বাংলাদেশি জনগোষ্ঠি। বৃটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৪ জন এমপি রয়েছেন। বৃটিশ পার্লামেন্টে রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রুপা হক ও আফসানা বেগম শক্তিশালী অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছেন। হাউজ অব লর্ডসে আছেন পলা মঞ্জিলা উদ্দিন। বিভিন্ন কাউন্সিলে মেয়র ও কাউন্সিলর হয়েছেন বহু বাংলাদেশি। বৃটিশ বাংলাদেশি কূটনীতিবিদ আনোয়ার চৌধুরী বৃটিশ হাই কমিশনার হিসেবে বেশ খ্যাতি কুড়িয়েছেন।

ব্রিকলেন বাংলা টাউন বিলেতের মানচিত্রে একটা আইকনের মর্যাদা পেয়েছে। কিছু কিছু স্কুল-কলেজে জিসিএসই ও এ-লেভেলে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ একটা বিষয় হিসেবে পড়ানো হচ্ছে। বিলেতের মাধ্যমিক স্কুলে ছেলে-মেয়েদের বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে দ্বিতীয় কোন ভাষা পড়তে হয়। টাওয়ার হ্যামলেটসের স্মিদি স্ট্রিট স্কুলে পাইলট প্রজেক্টের অধীনে মডার্ন ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে বাংলা পড়ানো শুরু হয় ২০০৭ সালে।

বাংলাদেশ প্রেমিক ড. উইলিয়াম রাদিচে বাংলা ভাষা নিয়ে অনেক কাজ করছেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের সোয়াস (স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ)-এর শিক্ষক। সেখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গুরুত্বের সঙ্গে চর্চা হয়। অভিবাসীদের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দেওয়ায় বৃটেনে বাংলা ভাষাও গুরুত্ব পাচ্ছে।

বাংলা টাউন থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় হয়েছে। মসজিদ, দোকানপাট, হাসপাতাল, পার্ক সবখানে বাংলার ব্যবহার বেড়েছে। নিউহাম, ওয়েস্টহাম, ক্যামডেন, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, কার্ডিফ ও নিউক্যাসলের মতো এলাকাগুলোতে অনেক প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার নাম বাংলায় লেখা আছে।

ড. আশরাফ সিদ্দিকী সিলেটে মুসলিম সাহিত্য সংসদে

বাংলাদেশি কমিউনিটিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় আলোচনা ও জাতীয় দিবসগুলো বাংলা চর্চার প্রধান অবলম্বন। বাংলা সংবাদপত্র ও রেডিও-টেলিভিশন এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বাংলা ভাষা ও ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চার লক্ষ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক প্রবাসী স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বিলেতে চলে এসেছেন।

লন্ডনে বঙ্গবন্ধু স্কুল, ওসমানী স্কুল, কবি নজরুল প্রাইমারি স্কুল, আলতাব আলী পার্ক, বাংলাদেশ সেন্টার, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার পরিচয় ধারণ করে আছে। ড্রাইভিং টেস্টের থিওরি পরীক্ষায় এবং এনএইচএস হাসপাতালগুলো ভয়েস ডিরেকশনে অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা ও সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় নির্দেশনা চালু হয়েছে। স্থানীয় স্কুলগুলোতে স্বকীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ও সিলেটি ভাষা তালিকাভুক্ত হয়েছে। অসংখ্য লাইব্রেরিতে এখন বাংলা বই গুরুত্বের সাথে রাখা হয়।

বিলেতে বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতার শতবছর পূর্ণ হয়েছে। ১৯১৬ সালের ১ নভেম্বর পাক্ষিক ‘সত্য বাণী’ প্রকাশিত হয়। এরপর মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিকসহ বহু পত্রিকা ও ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে। রেডিও-টেলিভিশন এবং বেশ কয়েকটি অনলাইন পত্রিকাও সুনামের সাথে পরিচালিত হয়ে আসছে। আমার সম্পাদিত ও সংবাদ সংস্থা মিডিয়া মহল থেকে প্রকাশিত ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) ৫৭টি দেশের তত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ ডাইরেক্টরি মুসলিম ইন্ডেক্স ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছে।

বৃটেনের সকল এশিয়ান রেস্টুরেন্ট নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ইউকে এশিয়ান রেস্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি। এতে প্রমাণিত হয়েছে এশিয়ান ১৮ হাজার রেস্টুরেন্টের মধ্যে অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশি। এভাবেই বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা আলোচনায় আসছে বার বার।

ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় দিন একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ বিশেষভাবে বিদেশিদের বাংলা চর্চায় উৎসাহ যুগিয়েছে। বাংলাদেশি হিসেবে নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের জন্য বাংলার প্রতি আন্তর্জাতিক বিশ্বের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর লন্ডনের আলেক্সজান্ডার প্যালেসে ডক্টর ইউনুসকে দেওয়া সম্বর্ধনা সভায় বৃটিশ ও ইউরোপীয় এমপিসহ প্রায় ২ হাজার মানুষের উপস্থিতি ও ইউরোপীয় মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার এরই প্রমাণ বহন করে।

বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, ডয়েচে ভেলে, রেডিও জাপান, চীন আন্তর্জাতিক বেতার, মস্কো রেডিও, রেডিও ভেরিটাস, কানাডার বাংলা রেডিও চ্যানেলসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বাংলা ভাষার প্রচার-প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

বিলেতে অধ্যয়ন শেষে অনেক বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। দেশ থেকেও অনেকে গিয়েছেন এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকার দেশে দেশে।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করছেন বাংলাদেশের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর বহু সদস্য। ফলে সেসব স্থানেও বাংলা ভাষা চর্চা হচ্ছে নানাভাবে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, টেকনোলজিক্যাল গ্লোবালাইজেশন মানবজাতির ভাষাকেও বিশ্বায়িত করে তুলছে দ্রুতগতিতে। সম্প্রতি সিয়েরা লিয়ন বাংলা ভাষাকে তাদের দেশে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। এভাবেই বাংলা ভাষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে পৃথিবীব্যাপী।

দীর্ঘদিন বিদেশে বসবাসের ফলে অনেক বাংলাদেশি বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছেন। রাজনীতিতে আপন কর্মদক্ষতা গুণে অনেকে লাভ করেছেন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদ-পদবি। এতে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশি জাতির মর্যাদা বেড়েছে।

আমার লেখাটি পড়ে ড. আশরাফ সিদ্দিকী লন্ডন নিয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেছিলেন। আমরা চেয়েছিলাম তৃতীয় বাংলা খ্যাত লন্ডনে তাকে নিয়ে আসা উচিত। কথাও হয়েছিল আসবেন। তার জনপ্রিয় ভ্রমণ কাহিনী ‘প্যারিস সুন্দরী’র মত লন্ডন নিয়ে আরেকটা বই লিখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯-এর কারণে সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। এরই মাঝে তিনিও চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

ড. আশরাফ সিদ্দিকীর হাতের লেখা

১৯৯৯ সালে আমার বিয়ের ম্যাগাজিন ‘হৃদয়ের জানালা’য় চমৎকার লেখা দিয়েছিলেন ড. আশরাফ সিদ্দিকী। তারও আগে সিলেটে তাকে নিয়ে প্রাণবন্ত অনুষ্ঠান করেছি। ১৯৮৯ সালে দুর্বার সাহিত্য সংকলনে লেখা নেওয়ার জন্য প্রথম সাক্ষাৎ করি। এরপর বার বার তার সান্নিধ্য পেয়েছি। আজ এসব স্মৃতি আমাকে কাতর করে।

৪০ এর দশকের শুরুতে প্রতিশ্রুতিময় কবি হিসেবে ড. আশরাফ সিদ্দিকীর আত্মপ্রকাশ। সাহিত্যিক জীবনে তিনি রচনা করেছেন পাঁচশ এর অধিক কবিতা। বাংলার লোক ঐতিহ্য নিয়ে করেছেন গভীর গবেষণা। তিনি রচনা করেছেন ৭৫টি গ্রন্থ এবং অসংখ্য প্রবন্ধ।

১৯৪৮ সালে দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে ‘তালেব মাস্টার’ কবিতা রচনা করে তিনি অল্প সময়ের মধ্যে গণ মানুষের কবি হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ‘গলির ধারের ছেলেটি’ ছোট গল্প লেখক হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ছোট গল্প অবলম্বনে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘ডুমুরের ফুল’ চলচ্চিত্রটি জাতীয় পুরস্কার পায়।
বাংলার মৌখিক লোক সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে লিপিবদ্ধ করার জন্য ড. আশরাফ সিদ্দিকী বিশেষভাবে সমাদৃত। তার লেখা বইগুলো ‘লোকসাহিত্য’, ‘বেঙ্গলী ফোকলোর’, ‘আওয়ার ফোকলোর আওয়ার হেরিটেজ’, ‘ফোকলোরিক বাংলাদেশ’ এবং ‘কিংবদন্তীর বাংলা’ দক্ষিণ এশিয়ার লোক সাহিত্যে গবেষণায় মৌলিক বই হিসেব বিবেচিত হয়।

‘ভোম্বল দাশ: দ্যা আঙ্কল অব লায়ন’ এবং ‘টুনটুনি এন্ড আদার ষ্টোরিজ’ ইত্যাদি গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে তিনি বাংলার লোকজ গল্পকে বিশ্ব সাহিত্যের ভান্ডরে পৌঁছে দেন। ১৯৫৮ সালে প্রখ্যাত ম্যাকমিলান পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত তার ‘ভোম্বল দাশ’ বইটি ছিল সে বছরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক বিক্রিত শিশুদের বইয়ের তালিকায়। পরে এ বইটি ১১টি ভাষায় অনূদিত হয়। তার ৭০দশকে লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন’ ও ‘প্যারিস সুন্দরী’ আজও তরুণ পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়।

ড. আশরাফ সিদ্দিকী পড়াশোনা করেছেন শান্তিনিকেতন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে তিনি আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় এমএ এবং পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি রাজশাহী কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, ময়মনসিংহের এএম কলেজ, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

ড. আশরাফ সিদ্দিকী কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক, ডিস্ট্রিকট গ্যাজেটিয়ারের প্রধান সম্পাদক ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার চেয়ারম্যান, প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট, নজরুল একাডেমির আজীবন সভাপতি এবং নজরুল ইনস্টিটিউটের সভাপতির দায়িত্বপালন করেন। ত্রিশালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন তিনি।

ড. আশরাফ সিদ্দিকী বহুবর্ণিল কর্মযজ্ঞের ভেতর দিয়ে তার দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করেছেন। ১৯২৭ সালের ১ মার্চ নানাবাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নাগবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা আব্দুস সাত্তার সিদ্দিকী ছিলেন সৌখিন হোমিও চিকিৎসক এবং ইউনিয়ন পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান। মা সমীরণ নেসা ছিলেন স্বভাব কবি।

আশরাফ সিদ্দিকী তার নানাবাড়ির পাঠশালায় শিক্ষাজীবন শুরু করেন। দ্বিতীয় থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন বাবার প্রতিষ্ঠিত রতনগঞ্জ মাইনর স্কুলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন প্রথম কবিতা লেখেন। সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে। মামা আবদুল হামিদ চৌধুরীর বাসায় থেকে পড়াশোনা করতেন। সপ্তম শ্রেণিতে থাকাকালীনই তার কবিতা ‘স্বগত’ ও ‘পূর্বাশা’ সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ সময় তিনি কিছু আঞ্চলিক বাংলা ধাঁধা সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাঠান। রবীন্দ্রনাথ তার প্রশংসা করেন। এর কিছুদিন পর তিনি শান্তিনিকেতনে পড়ার জন্য ভারতে চলে যান।

আশরাফ সিদ্দিকী ১৯৪৭ সালে শান্তিনিকেতনে বাংলায় অনার্স পড়াকালীন দেশবিভাগ হলে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্থ টাঙ্গাইলের করটিয়া সরকারি সা’দত কলেজ থেকে অনার্স সম্পন্ন করেন। অনার্স কোর্সে বাংলা সাহিত্যে তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম হন। এরপর ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয়বার এমএ করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে লোকসাহিত্যে পিএইচডি করেন।

১৯৫০ সালে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন আশরাফ সিদ্দিকী। ১৯৫১ সালে এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন রাজশাহী সরকারি কলেজে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ায় তার সাথে গবেষণার জন্য ওই বছর নভেম্বর মাসে ডেপুটেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে আবার ফিরে যান রাজশাহী কলেজে। তিনি ১৯৫৭ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে বদলি হয়ে ঢাকা কলেজে যোগ দেন এবং সেখান থেকেই উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান।

১৯৬৭ সালে পিএইচডি শেষ করে কিছুদিন ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে অধ্যাপনা করেন। একই বছর ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ারে প্রধান সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে দায়িত্ব পান তদানীন্তন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালকের। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ারের প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন।

আশরাফ সিদ্দিকী ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ছয় বছর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৮৩ সালে জগন্নাথ কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীনই দীর্ঘ কর্মজীবন থেকে অবসর নেন আশরাফ সিদ্দিকী।
এসবের বাইরেও বিভিন্ন সময় গুণী এ ব্যক্তি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার চেয়ারম্যান, প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট, নজরুল একাডেমির আজীবন সভাপতি ও নজরুল ইনস্টিটিউটের সভাপতির দায়িত্বপালন করেন। ত্রিশালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছেন আশরাফ সিদ্দিকী।

৪০ এর দশকের শুরুতে প্রতিশ্রুতিময় কবি হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ। দেশবিভাগের পর অভাবের তাড়নায় এক স্কুলশিক্ষক পরিবারের সবাইকে নিয়ে আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনা আশারফ সিদ্দিকীকে তুমুল নাড়া দেয় ও তার সাহিত্য রচনার প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। সে সময় তিনি লেখেন কালজয়ী কবিতা ‘তালেব মাস্টার’ । এ কবিতার মধ্য দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে গণমানুষের কবি হিসেবে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৫০ সালে এটিকেই নামকবিতা করে প্রকাশ পায় তার কবিতার বই ‘তালেব মাস্টার ও অন্যান্য কবিতা’। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় তার কবিতার বই- সাত ভাই চম্পা, বিষকন্যা, ও উত্তরের তারা।
১৯৬৫ সালে ‘রাবেয়া আপা’ নামক গল্প দিয়ে গল্পকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন আশরাফ সিদ্দিকী। ‘গলির ধারের ছেলেটি’ গল্পটি তাকে গল্পকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এ গল্প অবলম্বনে নির্মিত প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত পরিচালিত ডুমুরের ফুল চলচ্চিত্রটি একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও লাভ করে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক সাহিত্য বিষয়ে পড়াকালীন তিনি রচনা করেন শিশুতোষ সাহিত্য ‘সিংহের মামা ভোম্বল দাস’, যা বিশ্বের ১১টি ভাষায় অনূদিত হয়। ‘ভোম্বল দাশ: দ্যা আঙ্কল অব লায়ন’ এবং ‘টুনটুনি এন্ড আদার স্টোরিজ’ গ্রন্থগুলোর মধ্যে দিয়ে তিনি বাংলার লোকগল্পকে বিশ্ব সাহিত্যের ভাণ্ডারে পৌঁছে দেন। ১৯৫৮ সালে প্রখ্যাত ম্যাকমিলান পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত তার ‘ভোম্বল দাশ’ বইটি ছিল সে বছরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক বিক্রিত শিশুদের বইয়ের তালিকায়।

এছাড়া ৭০-এর দশকে লেখা আশরাফ সিদ্দিকীর বই ‘রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন’ ও ‘প্যারিস সুন্দরী’ আজও তরুণ পাঠকদের কাছে বিপুল জনপ্রিয়। বাংলার মৌখিক লোক সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে লিপিবদ্ধ করার জন্য ড. আশরাফ সিদ্দিকী বিশেষভাবে সমাদৃত। তার লেখা- ‘লোকসাহিত্য’, ‘বেঙ্গলী ফোকলোর’, ‘আওয়ার ফোকলোর আওয়ার হেরিটেজ’, ‘ফোকলোরিক বাংলাদেশ’, ‘কিংবদন্তীর বাংলা’ দক্ষিণ এশিয়ার লোক সাহিত্যে গবেষণায় মৌলিক বই হিসেব বিবেচিত হয়। এছাড়া বাংলাদেশের লোক সাহিত্য নিয়ে লেখেন ‘লোক সাহিত্য প্রথম খণ্ড’। এরই ধারাবিহিকতায় ‘কিংবদন্তির বাংলা’, "শুভ নববর্ষ', "লোকায়ত বাংলা', "আবহমান বাংলা', "বাংলার মুখ' বইগুলো প্রকাশিত হয়। ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে শোনা রূপকথার গল্প থেকে অণুপ্রাণিত হয়ে ১৯৯১ সালে লেখেন ‘বাংলাদেশের রূপকথা’ নামক বইটি।

দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে আশরাফ সিদ্দিকী রচনা করেছেন পাঁচশ’র অধিক কবিতা। কবিতা, বাংলার লোক ঐতিহ্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে তিনি রচনা করেছেন ৭৫টিরও অধিক গ্রন্থ। এছাড়া অগ্রন্থিত অনেক মূল্যবান লেখাপত্র রয়েছে।

বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন আশরাফ সিদ্দিকী।

১৯৫১ সালের ২৩ ডিসেম্বর সাঈদা সিদ্দিকীকে বিয়ে করেন আশরাফ সিদ্দিকী। স্ত্রী সাঈদা ছিলেন আজিমপুর গালর্স হাই স্কুলের শিক্ষিকা। তাদের পাঁচ সন্তান সবাই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং নিজ নিজ পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত। তার ছেলে সাঈদ সিদ্দিকী বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ‘ক্যাটস আই’-এর চেয়ারম্যান, আরেক ছেলে নাহিদ আলম সিদ্দিকী'স ইন্টারন্যাশনালের অধ্যক্ষ, মেয়ে তাসনিম সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আরেক ছেলে রিফাত আহমদ সিদ্দিকী'স ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপারসন ও রিয়াদ সিদ্দিকী নামে আরেক ছেলে ক্যাটস আই-এর পরিচালক।

লেখক: লন্ডন প্রবাসী। সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;