ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-৮



মাহফুজ পারভেজ
ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-৮

ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-৮

  • Font increase
  • Font Decrease

[অষ্টম কিস্তি]

“এই ছবিতে তুমি যে ঘাসের ওপর থেকে রংধনু শুরু করলে, কী করে তা বাস্তবের কাছাকাছি হবে?”

ম্যারির প্রশ্ন শুনে পল্লবী মাথা ঝুঁকিয়ে তার হাতের পেনসিলটা কাগজে এলোমেলো ঘষতে থাকে। কোনো উত্তর দেয় না। ক্যাম্পাসে পড়তে আসা দক্ষিণ এশীয় তরুণীটির দিকে অপলক চেয়ে থাকেন ম্যারি। পল্লবী মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেই একসময় বিড়বিড় করে, “আমি তো কখনো সত্যিকারের রংধনু দেখিনি!”

ম্যারি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রায় অর্ধস্ফুটে বলেন, “বুঝেছি। তবে আর কী।”

কথাটা বলে ম্যারি নিজের মনে ভাবলেন, মেয়েটিকে এভাবে বলা ঠিক হয় নি। পল্লবী আহত হতে পারে কিংবা তার মধ্যে না-পারার হতাশা আসতে পারে। এটা ঠিক কাজ নয়। শিক্ষার্থীর গুণ জাগ্রত করা তার দায়িত্ব। কোনো কিছু করার এবং পারার পথ দেখানো কর্তব্য। না-পারার বিষয়গুলো মনে করিয়ে তাকে আটকে দেওয়া মোটেও ঠিক হয় নি।

নিজের ভুল বুঝতে পেরে পল্লবীর পাশে বসে হাসতে হাসতে ম্যারি বলেন, “সব সময় বাস্তবকে হুবহু আঁকার দরকার নেই। দেখা জিনিস হুবহু আঁকতে নেই। স্বপ্ন, কল্পনা আর ইচ্ছে মিশিয়ে আঁকতে হয়। তবেই সেটা তোমার একান্ত নিজের সৃষ্টি হবে।”

পল্লবীর ঠোঁটের কোণ বেঁকে উঠতে উঠতেও ফের স্বাভাবিক হয়ে যায়। তার খুশির সঙ্গে শোনা যায় হাতের চুড়ির রিনিঠিনি শব্দ। ম্যারি সন্তর্পণে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেন।

অন্য ছেলেমেয়েগুলোর ড্রয়িং খাতা চেক করে ম্যারি খানিকটা আশাহত হন। কিন্তু তিনি সেটা নিজের মনেই লুকিয়ে রাখেন। এদের দোষ দেওয়ার কিছু নেই। সত্যি সত্যি রংধনু তারা দেখে নি। বইয়ে দেখা কিংবা ইউটিউবের রংধনু দেখে দেখে যতটুকু আঁকতে পেরেছে, সেটাই বেশি।

একটি বিষয় দেখে ম্যারি খুবই বিস্মিত হন। রংধনু পৃথিবীর সর্বত্র একই রকম হবে, এটাই বিজ্ঞানের সূত্র। কিন্তু ছেলেমেয়েদের রংধনুতে তেমন ছাপ নেই। আফ্রিকা থেকে আসা সারাহ রংধনু এঁকেছে কালচে আকাশের প্রেক্ষাপটে। চীনের ছেলে লি লালচে আকাশের পটভূমিতে যে রংধনু চিত্রিত করেছে, তাতে সাতটি রঙ স্পষ্টভাবে খোলে নি। ম্যারি টের পান, সবার মনে আলাদা আলাদা আকাশ, যা তারা কল্পনা করেছে নিজের দেশ ও পরিবেশের প্রভাবে। তাই পল্লবীকে আলাদাভাবে দোষ দেওয়া ঠিক নয়। তার রংধনু তারই নিজস্ব পরিবেশ ও অনুভূতির ফসল, যা তিনি এই প্রথম একেকজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে একেক রকমের দেখলেন। রংধনু অভিন্ন হলেও মানুষের মন আর কল্পনা যে সেটাকে আলাদা অবয়ব দিয়েছে, সেটা দিব্যি প্রকাশ পায় ম্যারির কাছে।

ড্রয়িং খাতাগুলো নিয়ে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে বিরত রইলেন ম্যারি। সবাইকে একটিই কমেন্ট করলেন তিনি, “গুড ওয়ার্ক, ট্রাই এগেইন।”

ম্যারি কিন্তু ঠিকই টের পান, ছেলেমেয়েগুলোর কাজে অবচেতনভাবে একটি বার্তাই ভেসে ওঠে, তা আসলে তাদেরই সঙ্কুল পরিস্থিতির প্রতিফলন। যে কারণে তাদের ছবির আকাশগুলো বদলে গিয়েছে। কোনও একটি হয়েছে কালচে, কিছু লালচে কিংবা পিঙ্গল। চোখের সামনের আর্থসামাজিক বাস্তবতাই তাদের অনুভতি ছুঁয়ে ভিসুয়াল রিপ্রেজ়েন্টেশনের গভীরে বিশেষ ভাবে নিহিত রয়েছে। উত্তাল পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে যার জন্ম, তার ছবির আত্মদর্শী চৈতন্যের মধ্যে সেই বীজমন্ত্র লুক্কায়িত থাকবেই।

চিত্রকর্ম বোঝার ও বিশ্লেষণের আলাদা চোখ আছে ম্যারির। কারণ, একসময় ম্যারি নিজেই ছিলেন ক্যাম্পাসের চলমান শিল্প আন্দোলনের অন্যতম হোতা। শিল্পকে মানুষের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার সেই অবিরত প্রচেষ্টার ফসল তুলেছিলেন তিনি আর তার সঙ্গে এক জেদি যুবক, ক্যাভিন। তাদের চাঞ্চল্যে ক্যাম্পাসের গথিক স্থাপত্যের গম্বুজওয়ালা ভবনগুলো ছুটির দিনের বৈকালিক আড্ডায় গমগম করত। এক শিল্পশোভিত ক্যাম্পাসের উদ্ভাস হতো কবি-সাহিত্যিক-চিত্রকর-ভাস্কর-গায়ক-সমালোচক-সম্পাদকদের ভিড়ে। সঙ্গে থাকতো আর্ট, পত্রপত্রিকা ও বই বিষয়ক আড্ডা। চলতো আবৃত্তি, কবিতাপাঠ, গান ও গল্পপাঠের মশগুল আসর।

প্রায়ই মহান শিল্পীদের ছবির প্রদর্শনী, নতুন উদীয়মান শিল্পীদের কাজ সংগ্রহ, মার্কিন দেশের লিথো প্রেসগুলোর সন্ধান, পুরনো ছাপচিত্রের খোঁজে অহর্নিশ অন্বেষণ ইত্যাদি ছিল তার যাপনের অবিচ্ছেদ অংশ। শিল্প ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ তখন থেকেই তাঁর অবচেতনে তৈরি করে ফেলেছিল চিত্রকর্মের এক মহার্ঘ মিউজ়িয়াম।

একবার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সহায়তায় তিনটি কক্ষ নিয়ে ম্যারির কাজগুলোর একটি প্রদর্শনীর পরিকল্পনা ও আয়োজন করেছিল তাঁরই সাথী ও বন্ধুসম ক্যাভিন। প্রায় দেড়শোটি নানা মাধ্যমের কাজ ও বিবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সে এক মহাযজ্ঞ! এই উপলক্ষে তাঁর শিল্প নিয়েই একটি ডকু-ফিল্ম রিলিজ় করে বন্ধুরা। সমালোচকরা বলেছিলেন, অভিনবত্বে একটি আলাদা মাত্রার সংযোজন ঘটেছে ম্যারির কাজে। যেন রূপবন্ধ নতুন ভাবে পুনর্বিন্যাসের ফলে সিম্ফনি ও স্টাইল, বক্তব্য ও বর্ণনা, কম্পোজ়িশন ও ক্যাজ়ুয়ালিটি, মেসেজ ও মেটাফর একে অপরের পরিপূরক হয়ে প্রকাশিত হয়েছে ম্যারির আঁকা ছবিগুলোর পরতে পরতে।

হবে না কেন? ড্রয়িং, ছাপচিত্রের রঙিন পুনর্নির্মাণ, জলরং, ইঙ্ক, তেলরং, গ্রাফিক্স, মিশ্র মাধ্যম, রঙিন পেন্সিল, উডকাট, লিনোকাট, সেরিগ্রাফ, নিউজ পেপার ম্যাটে মিশ্র মাধ্যম, অ্যাক্রিলিক, এচিং, ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য— কী করেননি ম্যারি? শিল্পের যাবতীয় নিরীক্ষায় সৌন্দর্যের সবগুলো পথ পেরিয়ে এসেছেন তিনি। তারপর এক সময় নিঃসঙ্গ ও একেলা হয়ে পড়েছেন নিজেরই অজান্তে।

রংধনু নিয়ে অ্যাসাইনমেন্টে ব্যস্ত ছেলেমেয়েদের ছবিগুলোর সঙ্গে মেতে ম্যারির চাপা-শিল্পীসত্তা গুপ্ত লাভাস্রোতের মতো বের হয়ে এলো। সবাই চলে যাওয়ার পর তিনি আলাদাভাবে পল্লবীকে নিয়ে বসলেন। মেয়েটির সঙ্গে তিনি একটি অদ্ভুত নিবিড়তা অনুভব করেন। সবার চেয়ে বেশি সখ্যতাও তিনি বোধ করেন পূর্বদেশের এই মেয়েটির সঙ্গে। ঘরবাড়ি ছেড়ে মার্কিন দেশের ক্যাম্পাসে পড়তে আসা বেশকিছু ছেলেমেয়ের মধ্যে পল্লবী নামের এই তরুণীর জন্য কেন ম্যারি অনেক বেশি নৈকট্য অনুভব করেন, তা তিনি নিজেও ঠিকঠিক জানেন না। এই মেয়েটি পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে নানা বিষয়ে তার সঙ্গে এসে কথা বলে। তার প্রশ্নের ধরণ, জিজ্ঞাসার তীব্রতা ও কথা বলার আন্তরিক সুর ম্যারিকে মুগ্ধ করে। প্রাচ্য দেশের সংস্কৃতিতে বড় হওয়া মেয়েটির মধ্যে অপার কৌতূহল। গান শুনতে আর বই পড়তেও ভীষণ ভালোবাসে সে। ম্যারি প্রায়ই তাকে একমনে লাইব্রেরিতে পড়তে দেখে। বিচিত্র সব বই ইস্যু করে পড়ার জন্য বেছে নেয় পল্লবী। জানাশোনা কিছুটা গভীর হলে পল্লবী কিছু গান প্রেজেন্ট করে ম্যারিকে। গানের কথাগুলো বাংলায় কিন্তু সুর হৃদয়-ছোঁয়া। বিশেষ করে একটি গান ম্যারিকে আচ্ছন্ন করে প্রবলভাবে। গানটির প্রথম লাইন “তোমারও পরাণ যাহা চায়।”

ম্যারি একবার জিজ্ঞেস করেছিল পল্লবীকে, “এতোজন থাকতে তুমি আমাকে তোমার দেশের তোমার ভাষার গান উপহার দিলে কেন?”

“তোমাকে খুব দুখী ও বিষণ্ন মনে হয় আমার। গানগুলো শুনলে তোমার ভালো লাগবে।” কালবিলম্ব না করেই জানিয়েছিল পল্লবী।

ম্যারি ভীষণ অবাক হন। তারুণ্য ও যৌবনের সন্ধিক্ষণের সঙ্কুল পরিস্থিতিতে রয়েছে এই মেয়ে। অথচ কেমন করে তার মনের গভীরে ডুব দিয়েছে মেয়েটি। অলক্ষ্যে আপন হয়ে যাওয়া এমন একটি মেয়েকে মন থেকে ভালো না বেসে পারেন না ম্যারি।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে ম্যারি বাস্তবে ফিরে আসেন। পল্লবীর আঁকার সরঞ্জাম গুছিয়ে দিতে দিতে বলেন, “তোমার যেমন ইচ্ছে হয়, তেমনভাবেই আঁকো তোমার রংধনু। আমি সেই ছবির নাম দেবো ‘পল্লবীর রংধনু’।"

উচ্ছ্বল ঝরণার মতো আনন্দে উজ্জ্বল হয় পল্লবীর সমস্ত মুখমণ্ডল। পল্লবী হাসতে হাসতে উঠে পড়ে। আঁকার খাতা আর রঙের বাক্স দু’হাতে নিয়ে সে রওনা দেয় নিজের হোস্টেলের দিকে। যেতে যেতে বলে,

“মিস, আমি তোমাকে একটা চমৎকার রংধনু উপহার দেবো, যা আমি শুধু তোমার কথা ভেবে আঁকবো। আমি নিশ্চিত, তুমি খুবই পছন্দ করবে আমার রংধনু।”

পল্লবীর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ম্যারি একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। পথের শেষে অদৃশ পল্লবীর ছায়াও আর নেই। সেখানে মনে হয় আবছায়ায় দেখা যাচ্ছে ক্যাভিনকে, যে লোকটি জীবনে প্রথম তাকে রংধনুর রঙের অরণ্যে পাগল করেছিল। ম্যারি তার একান্ত ভাবনায় ছেদ টেনে আকাশের দূর দিগন্তে তাকান। তারপর নিজেকে কিছুটা ঘুরিয়ে পশ্চিম আকাশে দৃষ্টি দেন তিনি। ক্যানভাসের মতো রংবহুল আকাশে তখন প্রদোষের আবিরমাখা উল্লাস। এখনই দিবাবসানে হাত ধরে শুরু হবে অন্ধকার রাতের।

ম্যারি অস্তগামী রশ্মির দিকে তাকিয়ে একাকী কি যেন চিন্তা করেন। তার ঘটনাবহুল জীবনের কোনো খণ্ডাংশের ছায়াপাত কি দেখতে পান তিনি আকাশের উদার শরীরে? তার স্থির ও অবিচল দৃষ্টি আটকে যায় অস্তাচলের দূর দিগন্তে। এক সময় তিনি অস্পষ্ট শব্দের মায়াজালে কোনক্রমে উচ্চারণ করেন, “তাঁর জীবনে অস্তবেলার রঙ-টা অন্যরকমও হতে পারত।”

পরবর্তী কিস্তি আগামী শুক্রবার।

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-৭

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;