ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-১০



মাহফুজ পারভেজ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

[দশম কিস্তি]

নিজের জীবনের কথা, প্রেম ও বিচ্ছেদের কথা, ক্যাভিন বা ম্যাথু কথা ভাবতে ভাবতে ম্যারি নিজের শিকড়ের ইতিবৃত্তে চলে যান প্রায়ই। তাঁর দুই প্রেমিকের মতো তিনিও ভিনদেশ থেকে পূর্বপুরুষের সূত্রে এসেছেন মার্কিন মুলুকে। তাঁর পরিবারের আদি শিকড় প্রোথিত আটলান্টিকের আরেক তীরে, ফ্রান্সে। দেশটির মূল ভূখণ্ডে নয়, প্রান্তিক এলাকা নর্মান্ডি উপকূলে। জীবনের হিসাবপত্র মিলাতে গিয়ে ম্যারি টের পান, ফরাসি ভাষার আলাদা সিনট্যাক্স ও উচ্চারণশৈলীর মতোই স্বাতন্ত্রিক তাঁর জীবনের বিন্যাস।

ম্যারির পিতামহ বলতেন, ফ্রান্সের নর্মান্ডি ছোট্ট এলাকা হয়েও বিশ্ব ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। নাৎসি জার্মানদের হাত থেকে ফ্রান্সকে মুক্ত করার জন্য মিত্র শক্তির অবতরণ হয়েছিল সেখানে এবং বীরোচিত প্রতিরোধ যুদ্ধের মাধ্যমে ঘুরিয়ে দিয়েছিল যুদ্ধের গতি। যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাওয়া মেডেল কোটের বুকে লাগিয়ে হাজার হাজার 'ওয়ার ভেটেরান'-এর সঙ্গে তিনি নর্মান্ডিতে আয়োজিত 'ডি-ডে' অনুষ্ঠানে যেতেন প্রতিবছর। যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিনই তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতা পালন করেছেন। ম্যারি আর তাঁর সমবয়সী ভাইবোনদের রূপকথার মতো অতীতের গল্পগুলো শোনাতে ভালোবাসতেন তিনি:

"তোমরা জন্মসূত্রে আমেরিকান হলেও আমি জন্মেছি ন্যার্মান্ডিতে। আটলাণ্টিক বিধৌত ছোট শহর নরমান্ডি হচ্ছে আমার পৈত্রিক নিবাস। আমার পিতা সেখানেই একটি কফিশপ চালাতেন। উপকূলের সাধারণ মানুষ ও সওদাগরদের মতই আমিও ওয়ার্কিং ক্লাসের সন্তান।" 

ম্যারি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতেন দাদার জীবনসংগ্রামের আখ্যান। দাদা সময় পেলেই তাঁর অতীতের গল্পগুলো উন্মোচিত করতেন:

"উপকূলীয় অঞ্চলের শ্রমজীবী পরিবারের ছেলে হওয়ায় আমাদের বংশে ছিল সাহস আর ঝুঁকি নেওয়ার শক্তি। একদিন জাহাজে করে সমুদ্রে ভেসে চলে এলাম আমেরিকায়। তখন বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। আমার দেশ বিজয়ী ও স্বাধীন। মহাযুদ্ধের শেষে আমিও আমার আরও স্বাধীনতার সন্ধানে পাড়ি দিলাম মহাসমুদ্র। আমেরিকা তখন নতুন স্বপ্নের দেশ। অবারিত সুযোগের হাতছানি সেখানে। আমি দেশান্তরী হলেও স্বদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করি নি। কিন্তু বিলক্ষণ জানি, তোমরা দিনে দিনে পূর্বপুরুষের দেশ, স্মৃতি, অস্তিত্ব ও আত্মপরিচিতি এক সময় বিস্মৃত হয়ে যাবে।"

এসব কথা বলার সময় বৃদ্ধ পিতামহের চোখ ছলছল করতো। তিনি কখনোই তাঁর অতীতকে ভুলে যেতে চাইতেন না। ম্যারি অনেক পরে দাদার ডায়েরি পড়ে বৃদ্ধের আকুতি টের পেয়েছিলেন। তাঁর লিখন মূলত আত্মজৈবনিক, স্মৃতিকথন, জীবন ও জগতের বয়ান। প্রথম জীবনের ঘটনা নিয়ে কিছু আখ্যানধর্মী লেখা লিখলেও পরে তিনি সরে আসেন স্মৃতিকথায়। একজন অভিবাসী মানুষের বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাওয়া পৃথিবী এবং পরিপার্শ্ব তাঁর লেখায় বার বার ছায়াপাত করছে। ব্যক্তির সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিক সমাজ এবং বৃহত্তর জাতীয় পরিসরের গল্পে তিনি তাঁর নিজের পরিবারের প্রথম গর্ভপাতের প্রসঙ্গ যেমন এনেছেন, তেমনি মাতৃবিয়োগ, অ্যালঝাইমার্স বা ক্যানসারের কথা লিখেছেন। এক ফাঁকে মহাযুদ্ধে যোগ দেওয়ার কাহিনীও তিনি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। স্মৃতিকে মুছে নিয়ে নয়, সঙ্গে নিয়ে যে জীবন তিনি যাপন করেছেন, অকপটে ডায়েরিতে বয়ান করেছেন সেইসব ইতিবৃত্ত।

ম্যারি তাঁর পিতামহের ডায়েরি যতই পড়েন, ততই অবাক হন। নিজের বংশধারার খোঁজ-খবরের পাশাপাশি একজন সংবেদনশীল মানুষের অন্তর্জগত উন্মোচিত হয় তাঁর কাছে। "লোকটি শুধু আমার পূর্বপুরুষই নন, একজন প্রেমিক ও বৈচিত্র্য পিয়াসী মানুষও ছিলেন", ম্যারি তাঁর পিতামহ সম্পর্কে এমনই ধারণা অনুভব করেন। ডায়েরিটি পড়লে যেকোনও পাঠকেরই এমনটি মনে হবে। যৌবনের  ঊষালগ্নে পূর্ব ইউরোপীয় এক নারীর সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ও বহুমাত্রিক বর্ণালির ভালবাসাকে উপস্থাপন করেছে পিতামহ। তাঁর ডায়েরিকে মনে একটি 'কালেক্টিভ আত্মজীবনী'। আত্মজীবনী হলেও তিনি নিজেকে দেখেছেন প্রবাহমান সময়ের একটি অংশ হিসবে। পুরো একটি সময়কালেরই অখণ্ড ও ধারাবাহিক বিবরণ যেন তাঁর ডায়েরি, যার প্রতিটি অক্ষরে মরে যাওয়া অতীতের আত্মারা স্মৃতিমন্দিরের বেঁচে থাকে। এবং শুধু বেঁচেই থাকে না, আছড়ও কাটে জীবন্ত অভিঘাতে। স্মৃতির বলয় থেকে বলয়ে উত্তীর্ণ এমন অদ্ভুত সুন্দর গল্প ম্যারি আগে পড়েন নি।

ম্যারির পিতামহের মৃত্যুর পর কমিউনিটি থেকে একটি শোকসভার আয়োজন করা হয়েছিল। পরিবারের তরফে ম্যারি ও তাঁর কিছু আত্মীয়-পরিজন তাতে অংশ নেন। শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন কয়েকজন। শোকসভার শেষে তাঁর সম্পর্কে গৃহীত একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্তে জানানো যে, "সাহস এবং ধৈর্যের সঙ্গে শিকড়ের সন্ধান করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত স্মৃতির সঙ্গে মিলন-বিরহের সম্পর্ককে চর্চা করেছেন জীবনভর। একজন ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে বছরে পর বছর ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা আর চড়াই–উতরাইয়ের বিবরণ প্রকাশ করেছেন তিনি। তাঁর জীবনের ঘটনাগুলো ব্যক্তির, সমাজের, ইতিহাসের, সমাজবিজ্ঞানের ভাগীদার।"

পিতামহের ডায়েরি পড়তে পড়তে ম্যারির মনে এই প্রশ্ন জাগে যে, আমরা কি আসলেই আমাদের যাপিত বছরগুলোকে চেনার জন্য কোনো স্যুভেনির রেখে এসেছি? কিংবা কোনো চিহ্ন? কোনো দাগ? পেরিয়ে আসা যে পরিসরে আমরা আর থাকবো না সেখান থেকে আমরা কি কিছু বাঁচানোর প্রচেষ্টা করছি?

চট করে ম্যারির মনে বাগানের নিঃসঙ্গ পাইন গাছটি দোলা দেয়। তাঁর এবং তাঁকে কেন্দ্র করে আবর্তিত জীবনের কিছুটা স্মৃতি তো গাছটির সঙ্গে আছে। অবশ্যই পাইন গাছের সঙ্গে তাঁর স্মৃতির অনেকটাই মিশে আছে। কিন্তু একদিন যখন গাছটিও মরে যাবে বা ঝড়ে উপড়ে পড়বে, তখন? ম্যারি কিছু ভাবতে পারেন না। চারপাশটা তাঁর কাছে বড্ড ফাঁকা আর অচেনা মনে হয়। আস্ত একটি জীবনকে মনে হয় কর্পূরের মতো উবে যাওয়া রাসায়নিক বস্তু। মনে হয় স্বপ্নের মধ্যে পাশ ফিরলেন তিনি। ঘুমের মধ্যে যেন বুঝলেন, অঝোর বৃষ্টিতে সব ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ম্যারির মনে হলো, কে যেন কোথাও খুব কষ্ট পাচ্ছে ঠিক তারই মতো।

ক্যাভিনের মুখ ভেসে আসে ম্যারির চোখের পর্দায়। ক্যাভিন বলতো, "লেখালেখি হল রাজনৈতিক কাজ। সমাজে যে বৈষম্য আছে, তা আমাদের নজরে নিয়ে আসবে লেখালেখি। মানুষের দুঃখ-কষ্টের ভাষাচিত্র হয়ে প্রস্ফুটিত হতে হবে প্রতিটি লেখাকেই। সেজন্যই ভাষাকে ছুরির মতো ব্যবহার করতে হবে, যা কল্পনার পর্দা ছিঁড়ে ফেলবে।" লেখালেখির শক্তির স্বতন্ত্রতায় বিশ্বাস করতো ক্যাভিন। তাঁর লেখালেখি কখনও আপস করেনি এবং একেবারে সাধারণ ভাষায় লেখা হয়েছে - একেবারে স্বচ্ছ ভাষায়, যদিও বিষয়গুলো জটিল ও স্পর্শাতীত।" সবাই স্বীকার করছেন যে, ব্যক্তিগত ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে পড়ে থাকা প্রপঞ্চগুলোকে তুলে এনে ক্যাভিন যেভাবে আখ্যান ও ইতিবৃত্তের কাঠামো বদলে দিয়েছে, তা যুগান্তকারী। ক্যাভিনের সঙ্গে তাঁর পিতামহের অদ্ভুত মিল খুঁজে পান ম্যারি। সবাই যেন একই রকম দুখী মানুষ। বড়ই তাপিত ও পীড়িত একেকটি জীবন।

ম্যারির পিতামহ প্রায়ই আফসোস করতেন, 'ডি-ডে' অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অসম সাহসী বীর যোদ্ধাদের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। তিনি চাইতেন নর্মান্ডি উপকূলে তাঁদের স্মৃতির প্রদীপকে আরও প্রোজ্জ্বল করেছেন। সাহস এবং নিখুঁত তীক্ষ্ণতার মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগত স্মৃতির শিকড়, বিচ্ছিন্নতা এবং সংযমের কথা উন্মোচন করতেন রণাঙ্গনের পটভূমিতে। 'স্মৃতির শিকড়ের সাহসী ও সহজবোধ্য উন্মোচন'-এর স্বীকৃতি তিনি প্রত্যাশা করেন নি। বরং তিনি ও তাঁর আগে-পরের প্রজন্মগুলোর সঙ্গে ঘটা প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। ডায়েরি লেখার যে চিরাচরিত ঐতিহ্য, তাকে অতীতকালের বন্দিদশা থেকে বর্তমানের চলমানতায় প্রতিস্থাপিত করে ইতিহাসের পুনর্জন্ম দিতে ইচ্ছুক ছিলেন তিনি। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে ও পরের ফরাসি সমাজের চেহারা তুলে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন নিজের গল্পের মধ্য দিয়ে। জীবন ও স্মৃতির এমন ঘনিষ্ঠ মেলবন্ধন রচনা এবং শৈল্পিক রূপান্তর ঘটনোর সৃজনশীল কৃতিত্ব অবিকশিত রেখেই মারা যান তিনি।

ম্যারির পিতামহের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি ছিল 'ডি-ডে' ঘিরে আবর্তিত। তিনি মনে করতেন, নর্মান্ডি উপকূলে 'ডি-ডে' ল্যান্ডিং ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের 'টার্নিং পয়েন্ট', যখন ফরাসি, ব্রিটিশ, আমেরিকান, কানাডিয়ান সেনা সদস্যরা সম্মিলিতভাবে দখলদার জার্মান নাৎসি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেছিলেন। 'ডি-ডে' ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির শুরু। মিলিটারি জার্গনে বা পরিভাষায় 'ডি-ডে' হলো এমন একটি দিন, যেদিন 'কমব্যাট অ্যাটাক' বা 'অপারেশন' শুরু করা হয়। সবচেয়ে বিখ্যাত 'ডি-ডে' হলো ১৯৪৪ সালের ৬ জুন- 'দ্য ডে অব নর্মান্ডি ল্যান্ডিং'- নাৎসি দখল থেকে মূল ইউরোপকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মিত্রশক্তির সাঁড়াশি আক্রমণ। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ 'সিবর্ন' বা 'সমুদ্রবাহী আক্রমণ'। মিত্রবাহিনীর এক লাখ ৫৬ হাজার সদস্য ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে নর্মান্ডিতে পৌঁছেছিলেন। এর মধ্যে প্রায় ১২ হাজার হয় নিহত নয়তো আহত হয়েছিলেন প্রথম দিনেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপ্রতিরোধ্য জার্মান বাহিনীকে প্রচুর আত্মদানের বিনিয়মে পরাজিত করে হটিয়ে দিতে পারার সাফল্য ছিল ঐতিহাসিক। এইসব ‘স্মৃতির শিকড়ের সাহসী উন্মোচন’ করে নর্মান্ডি উপকূল থেকে মার্কিন মুলুকে অভিবাসী লোকটি নিজের আত্মা ও বিবেকের কাছে সৎ থাকতে প্রয়াসী ছিলেন সারা জীবন।

এমন একজন লড়াকু মানুষের অধঃস্থ উত্তর-প্রজন্ম হয়ে হতাশা ও জীবনবিমুখ হতে পারেন না ম্যারি। তিনি বিশ্বাস করেন, আমি কোন পরিবেশ থেকে এসেছি বা কেমন পরিবেশে-পরিস্থিতিতে আছি, তা একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। স্বপ্ন আর লক্ষ্য থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর থাকতে হবে স্বপ্ন-সফল করার পরিকল্পনা। ম্যারি একটি কথা সবসময় মনে রাখেন, জীবন হলো খেলার মাঠের মতো। ময়দানে একজন খেলোয়াড়কে শুধুমাত্র জয় দিয়ে বিচার করা হয়। কিন্তু জীবনের মাঠে জয়ই শেষ কথা নয়। পড়ে গিয়ে কী করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছি, সেটাই মূল কথা।

তাঁর মনে হয় পড়ে যাওয়ার বিষয়টি জীবনে অনেক বেশি ঘটছে। প্রেম-বিরহের যাতনার সঙ্গে মহামারি করোনার ধকল সামলাতে হচ্ছে। এজন্যই সম্ভবত বাড়ি ফিরে অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে তাঁর। ভাবছেন আগে তো এত ক্লান্ত লাগত না। এর কারণ হয়ত কিছুই নয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক অভ্যেসই বদলে গিয়েছে। আগের মতো হুল্লোড়ে মেতে যেতেও ইচ্ছে করে না। ম্যারি কয়দিনের ছুটি নিলেন।

খবর পেয়ে পল্লবী তাঁকে দেখতে এসেছে। সে কিছু টোটকা বাতলে দিল। প্রাচ্যদেশীয় সমাজে মানুষ এসব চর্চা করে শরীর ও মন চাঙ্গা রাখে। বয়সের চেয়ে বেশি গাম্ভীর্য নিয়ে পল্লবী বলে:

"তোমাকে রোজ স্নান করতেই হবে। কোথাও বেরোনার আগে এবং ঘুরে এসেও। তোমার বড় চুল। তাই রাতের দিকে, ভাল করে গা ধুয়ে নিলে আরাম পাবে। স্নানের জলে কয়েক ফোঁটা এসেনশিয়াল অয়েল ফেলে দিলে তরতাজা লাগবে।"

পল্লবীর কথাগুলো শুনে মনে মনে হাসে ম্যারি। দরদী কেউ এসে দুদণ্ড ভালোমন্দের খোঁজ নিলে বেশ ভালোই লাগে। আজকাল এমন করে আপন হয়ে কেউ পাশে আসে না। সবাই বড় ব্যস্ত। ছেলে টমাসও নিজের পড়াশোনার কাজে মনোযোগী। ম্যারি নিজের সমস্যার কথা বলে ছেলেকে বিব্রত প বিরক্ত করতে চান না। তবু কেন যেন না চাইলেও পল্লবী এসে হাজির হয়। ঘরের টুকটাক কাজে হাত লাগায়। পরামর্শ দেয়। কখনো টমাসের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করে। পল্লবীর আন্তরিক কথাবার্তা ও আচরণ বেশ লাগে ম্যারির।

একদিন পল্লবী অদ্ভুত এক কাণ্ড করলো। একটা গামলায় হালকা গরম পানিতে একটু ইপসম সল্ট দিয়ে ১৫ মিনিট পা ডুবিয়ে রাখতে বাধ্য করলো সে। ওই সময়টা চোখ বন্ধ করে রিল্যাক্স মুডে রাখলো ম্যারিকে। তারপর হালকা মিউজ়িক চালিয়ে দিয়ে বললো:

"মিনিট পনেরো পরে তোমার শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগবে। পায়ে জোর পাবে। হাঁটার কষ্ট হবে না।"

"আমার তো হাঁটার কষ্ট হয় না। দিব্যি অনেকক্ষণ চলতে পারি।"

"তা পারো বটে। আমি চাই তোমার আরও ভালো হাঁটার সামর্থ্য হোক।"

"এটা কেন চাইছো?"

"আমি তোমাকে নিয়ে দূরের কোনও এক দেশে ঘুরতে যাবো। তোমার সাথে ঘুরে ঘুরে রংধনু দেখবো।"

পল্লবীর শেষ কথাটা বুকের মধ্যে ঝঙ্কারের মতো অনুভব করেন ম্যারি। তাঁর সারা শরীরে তিনি দুলনি বোধ করেন। অতীত, স্মৃতি, প্রেম, বিরহগুলো রংধনুর নানান রঙের ঘোরে প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করে তাঁকে।

[পরবর্তী কিস্তি আগামী শুক্রবার]

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-৯

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;