ঐশ্বর্যময় কবি দিলওয়ার



সাঈদ চৌধুরী
ঐশ্বর্যময় কবি দিলওয়ার

ঐশ্বর্যময় কবি দিলওয়ার

  • Font increase
  • Font Decrease

কবি দিলওয়ার বাংলা সাহিত্যের এক প্রবাদ পুরুষ। তার মন ছিল গভীর ঐশ্বর্যময়। স্বভাব ছিল বহতা নদীর মতো, সতত বহমান।

দিলওয়ার এক বিস্ময় প্রতিভা। মানুষ হিসেবে এবং কবি হিসেবে ছিলেন অনেক বড় মাপের অনন্য একজন। তিনি গণমানুষের কবি। মুক্তিকামী মানুষের কবি। তার নিজের ভাষায়- ‘পৃথিবী স্বদেশ যার, আমি তার সঙ্গী চিরদিন’।

কাব্যের সুদূর প্রসারী আবেদন সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন বলেই কবি বলতে পেরেছেন- ‘এবার এলো শক্তিহীনের/ শক্তি লাভের দিন/ নবীন ভুবন সৃষ্টি হবে/ ঐক্যে অমলিন।‘

২০০১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা টাউন হলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সংঘ কর্তৃক কবি দিলওয়ারকে প্রদত্ত সংবর্ধনার মানপত্রে উল্লেখ করা হয়- ‘সাথী আজ তোমাকে সংবর্ধিত করার সুযোগ পেয়ে আমরা আনন্দিত। তোমাকে সম্মান জানানোর নাম মানুষকে ভালোবাসা। … তুমি কোনো একটি দেশের নও। কোনো দেশের কোন সীমানা তোমাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। তোমার আশ্চর্যজনক সুস্থমন, প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও দৃঢ় আত্মসম্মানবোধ তোমাকে এক কর্মযোগী করে তুলেছে।’

কবি দিলওয়ার সাম্য, মানবতা ও শোষিত মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। তিনি আমাদের অনেক স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন। তার কবিতার বহু পংক্তি সাধারণ মানুষেরও মুখস্থ। সমাজ পরিবর্তনে সংগ্রামীদের উদ্দীপ্ত করে তার এসব ছড়া ও কবিতা।

জাতীয় মুক্তির সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি বলেন- ‘চাই বিপ্লব, চাই বিপ্লব, চাই/ বিপ্লব ছাড়া মুক্তির উপায় নাই/ পুরাতন করে কর্তন/ আনো নব পরিবর্তন/ নরদানবের বংশ/ করবো সমুলে ধ্বংস/ বুঝে নাও আজ এই ধরণীর/ প্রাপ্য যে যার অংশ/ রুখিয়া দাঁড়াও ভাইরে/ জীবনের গান গাইরে/ প্রাণ ধারণের প্রাপ্য রাসদ/ চাইরে মোদের চাই/ বিপ্লব ছাড়া জীবন জাগার কোনো উপায় নাই/ দাও তবে প্রতিঘাত/ হাতেতে মিলাও হাত/ দাও হুঙ্কার, টুটাবোই মোরা/ দুঃস্বপ্নের রাত।’


সিলেট শহরতলীতে ঠিকানা থাকলেও কবি দিলওয়ার আলোচিত ও সমাদৃত ছিলেন রাজধানী ঢাকা ও কলকাতার শীর্ষ কবিদের মধ্যে। ১৯৮০ সালে কবি দিলওয়ার কাব্য চর্চায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ লাভ করেন ১৯৮১ সালে। ২০০৮ সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে একুশে পদক প্রদান করা হয়। তিনি একাধারে কবি, ছড়াকার, সাংবাদিক, নাট্যকার ও গীতিকার ছিলেন। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে তার কবিতা প্রেরণা সঞ্চার করেছে।

দিলওয়ার গণমানুষকে হদয়ে কতটা জায়গা দিয়েছিলেন তার প্রমাণ মিলে বিভিন্ন কবিতায়। ‘আয়রে চাষি মজুর কুলি মেথর কুমার কামার/ বাংলা ভাষা ডাক দিয়েছে বাংলা তোমার-আমার।’ অথবা ‘বহু লাঞ্ছনা, বহু অপমান/ সহিয়াছে যারা মুখ করি ম্লান/ জয় হবে সেই নিপীড়িতদের/ জালিমেরা শির নোয়াবে/ এইবারে রাত পোহাবে।‘

কবি দিলওয়ারের কণ্ঠে জাগরনীর সুর ছিল। নিজ সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যে তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন। বেদনাক্লিষ্ট মানুষকে জাগ্রত করে কবি বলেন-‘পৃথিবীতে এসে কেঁদে যায় যারা বেদনার গেয়ে গান/ হতাশার কালো নয়নে মাখিয়া তপ্ত নিশ্বাস ফেলে/ নত করি শির চরণে নিজের দুঃখের পসরা ঠেলে/ মহাজীবনের ললাটে আঁকিয়া তলোয়ার খরশান/ তাদের বিফল জীবনের লাগি, বলো ঠিক দায়ী কারা/ বিধি না জনক? শাক্ত না ধনী? কোথায় জবাব তার/ লুকালো কোথায় উত্তরদাতা, সে কোন অন্ধাকার?/ নিবিড় আবেগে কাঁপিছে আমার দুইটি আঁখির তারা!’

‘গণমানুষের কবি’ বললে তার নাম বলতে হয়না। ১৯৭৭ সালের ৭ মার্চ সিলেটে কবি দিলওয়ারকে দেয়া নাগরিক সংবর্ধনার মানপত্রে ‘গণমানুষের কবি’ অভিধায় অভিষিক্ত করা হয়। এরপর তিনি আজীবন বরণীয় হয়েছেন এই নামেই।

শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের প্রতি কবির ভালোবাসার অন্ত নেই। শিশুর মত তার সরল কবি মন কোমলমতি মানুষদের টানে। ছোট বেলায় কবির কথা মনে হলে শান্ত সকালে সুরমা পারের সূর্যোদয় অবলোকন করে করে অনাবিল আনন্দে ছুটে যেতাম। মনে মনে আবৃতি করতাম তার ‘কীনব্রীজে সূর্যোদয়’। ‘এখন প্রশান্ত ভোর। ঝিরঝিরে শীতল বাতাস/ রাত্রির ঘুমের ক্লান্তি মন থেকে ঝেড়ে মুছে নিয়ে/ আমাকে সজীব করে। উর্ধ্বে ব্যাপ্ত সুনীল আকাশ/ পাঠায় দূরের ডাক নীড়াশ্রয়ী পাখীকে দুলিয়ে।/ নীচে জল কলকল বেগবতী নদী সুরমার,/ কান পেতে শুনি সেই অপরূপ তটিনীর ভাষা/ গতিবন্ত প্রাণ যার জীবনের সেই শ্রেয় আশা/ সৃষ্টির পলিতে সেই বীজ বোনে অক্ষয় প্রজ্ঞার।/ সহসা ফিরিয়ে চোখ দিয়ে দেখি দূর পূবাকাশে/ তরুণ রক্তের মতো জাগে লাল সাহসী অরুণ/ পাখীর কাকলি জাগে। ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে/ দিনের যাত্রার শুরু। অন্তরালে রজনী কুরণ!/ ধারালো বর্শার মতো স্বর্ণময় সূর্যরশ্মি ফলা/ কীন ব্রীজে আঘাত হানে। শুরু হয় জনতার চলা।’

সিলেটে বৃটিশ ঐতিহ্যের নিদর্শন এই ব্রিজ। পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ পায়ে হাঁটার সেতু। বড় বড় লোহার কাঠামোয় অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। ১৯৩৩ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়। চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় ১৯৩৬ সালে। তৎকালীন আসাম প্রদেশের গভর্নর মাইকেল কীনের নামে এই সেতুর নামকরণ হয় কীনব্রিজ। ১১৫০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৮ ফুট প্রস্থ ব্রিজ দিয়ে হাঁটার সময় বড় মনোরম দেখায়। নদীর কাব্যময় ঢেউ বয়ে চলে অবিরাম। বুকের মধ্যে ছল ছল করে ঢেউ ছলকায়। কখন পৌছে যাই কবি মন্জিল। ভার্থখলা, খান মন্জিল।

খান মঞ্জিল আমার খালার বাড়ি। মুসলিম খান আমার খালু। তিনি কবি দিলওয়ারের বড় ভাই। বিশিষ্ট ছড়াকার কাদের নওয়াজ খান ও ছড়াকার বদরুল আলম খান আমার খালাত ভাই। কবিপুত্র কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, শাহীন ইবনে দিলওয়ার, কামরান ইবনে দিলওয়ার এবং তাদের ভাই-ভাতিজাসহ অনেকে লেখেন। মান সম্পন্ন লেখ। তবে আমার কাছে মূলত তিনিই প্রধান আকর্ষণ। মনের গভীরে থাকে সুরমা পারের কবি, আমাদের প্রিয় দিলু মাম।

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের জননন্দিত লেখক কবি দিলওয়ার আমাদের সাহিত্যে দৃঢ়তা ও শক্তিময়তার অভাব অবলীলায় পূরণ করেছেন। তার কবিতা স্বাধীনতা, মানবতা এবং সুবিচার প্রত্যাশায় তীক্ষ্ণ, তীর্য ও উজ্জ্বল। তার কল্পনায় ধর্মীয় উদারতা ও সাম্যবাদ আবার কখনো নৈরাজ্য স্পর্শ করেছে। তবে ভালোবাসা সর্বত্র প্রাধান্য পেয়েছে।

‘সে’ কবিতায় কবি দিলওয়ার বলেন- ‘ভারি মজার মজার কতো কথাই-না সে বলতো/ সে বলতো হাত দুটি নেড়ে নেড়ে, সহাস্যে, সোল্লাসে/ ছাই ছাপা আগুনের মত সেই ক্ষণে সে জ্বলতো/ আমি বুঝতাম বৈকি। আমি বুঝতাম অনায়াসে।/ … তার সেই ক‘টি কথা এই মনে এখনো সরব/ হিটলারের মুন্ডু হাতে আমি যেন মার্শাল জুকভ।’

কবির মুখে কত শত পংক্তিমালা শুনেছি, আজো কানে বাজে। সমাজ বিকাশের চেতনাকে কেন্দ্র করে সৃজিত অবিস্মরণীয় পংক্তিমালা। যে কবিতা সূর্যের মতো সর্বত্রই রশ্মি ছড়ায়। ‘যতদিন বেঁচে আছো ততদিন মুক্ত হয়ে বাঁচো/ আকাশ-মাটির কন্ঠে শুনি যেনো তুমি বেঁচে আছো।’ অথবা ‘মৃত্যুর মিছিলে তুমি জীবনের দীপ্ত তরবারী/ একথা নতুন করে তোমাকে জানাতে হবে নাকি?/ এ-কথারি ঢেউ নিয়ে কখন ছেড়েছে নীড় পাখী/ উন্মুক্ত আকাশ তলে তোমারি বন্দনা শুনি, নারী...সে কথা ভুলোনা তুমি। ভুলো না পাথর চাপা ঘাসে/ তোমারি সৌহার্দে, নারী, ঈশ্বর শিশুর মতো হাসে।

‘তুমি রহমতের নদীয়া, দোয়া করো মোরে হযরত শাহজালাল আউলিয়া’ এসব গান ও কবিতা সিলেটের জনমনে এখনো ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। সিলেট বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়েছিলো কবি দিলওয়ারের এই গানটি দিয়ে। প্রায় পাঁচ দশক ধরে সিলেটের অসংখ্য শিল্পী তার লেখা গান গেয়ে আসছেন। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে তার লেখনি নিসৃত হয়েছে। করিব কণ্ঠে কতবার শুনেছি- ‘আমিতো কাঠুরে নই, আমি তো চাইনে কেটে নিতে/ ফুলের ফলের উৎস: গাছের সবুজ বাহুগুলি/ চুলোর নারকী ক্ষুধা নেই তো ইচ্ছের চারিভিতে/ নির্বিকার বহ্নিমান পোড়াতে বাসনা শতমূলী।/ আমার একান্ত সুখ বৃক্ষের আদিম সমতায়/ যে-পাখীরা নীড়ভ্রষ্ট, আসুক উল্লাসে তারা ফিরে/ সবুজ সুঠাম যতো বাহুর সহিষ্ণু মমতায়/ শূন্যের বিপুল আর্তি ফিরুক শূন্যের বুক চিরে!/ আমার কুঠার যেই, রইবে সে ক্রোধে চিরকাল/ শ্বাপদসংকুল যতো গহন অরণ্যপানে খাড়া/ অশান্ত কাঁপিয়ে যাবে জীঘাংসু রাত্রির শিরদাঁড়া/ কুঠারের তীক্ষ্ণ ধারে বহমান অনন্ত সকাল!/ ফুলের গন্ধের নদী ফলের নৌকোর খোলে হাল/ বৃক্ষের বাহুতে বসে পাখিরা সংগীতে তোলে তাল।

‘শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন’ কবিতায় শ্রেণি বিভক্তির বিরুদ্ধে কবির দৃপ্ত উচ্চরণ- ‘শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন যদি অপরাধ হয়/ আমরা কি আজো দিতে পারলাম/ মানুষের পরিচয়?/ ডুবে আছি আজো খন্ডে খন্ডে সাম্প্রদায়িক পাঁকে/ দম্ভদূষিত নাগপাশে বেঁধে/ মানুষের বিধাতাকে।/ প্রতিদিন ভোরে ও-কার সূর্য মর্মরক্তে ভিজে/ আমাদের ঘরে আলো দিয়ে যায়/ বিগলিত হয়ে নিজে?/ ও-কার বাতাস প্রতি নিশ্বাসে বিশ্বজনীন হয়?

শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন/ এ তো ভুলবার নয়।/ শুধু মুখে নয় বুকেও ক্ষরিত সাম্প্রদায়িক বিষ/ অঘ্রাণে তাই ব্যথারক্তিম ঐশী ধানের শিষ!/ কতকাল ধরে, বলতে পারি না/ আত্মহনন কাজে/ ব্যস্ত রয়েছি আমরা সবাই। প্রভাত মথিত সাঁঝে।/ কেটে গেল কত পিতামহ আর/ প্রপিতামহের কাল/ বোধির গোড়ায় সার হলো কত বিভেদের জঞ্জাল।

শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন/ চিরাচরিতের পথে/ জীবন কখনো চলতে পারে না- নদীর জীবন স্রোতে!/ ঔরসজাত মানবতা চাই/ কালের শুদ্ধসুধা/ রক্তে আমার এই তো ধর্ম/ এই তো মাতৃক্ষুধা।

‘বলে রাখি শোনো, করো নাকো হৈ চৈ/ যতদিন আছে শ্রেণি বিভক্ত জাতি/ আমি কিছুতেই তোমাদের দলে নই।’

নিপীড়িত জনতার সাহসের বাতিঘর গণ মানুষের কবি দিলওয়ার বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিলেন সদা সোচ্চার। তার ভাষায়- ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি: পদ্মা তোমার যৌবন চাই/ যমুনা তোমার প্রেম/ সুরমা তোমার কাজল বুকের পলিতে গলিত হেম।/ পদ্মা যমুনা সুরমা মেঘনা/ গঙ্গা কর্ণফুলী/ তোমাদের বুকে আমি নিরবধি/ গণমানবের তুলি!/ কত বিচিত্র জীবনের রং/ চারদিকে করে খেলা/ মুগ্ধ মরণ বাঁকে বাঁকে ঘুরে/ কাটায় মারণ বেলা!/ রেখেছি আমার প্রাণ স্বপ্নকে/ বঙ্গোপসাগরেই/ ভয়াল ঘূর্ণি সে আমার ক্রোধ/ উপমা যে তার নাই!/ এই ক্রোধ জ্বলে আমার স্বজন/ গণমানবের বুকে/ যখন বোঝাই প্রাণের জাহাজ/ নরদানবের মুখে!/ পদ্মা সুরমা মেঘনা…/ অশেষ নদী ও ঢেউ/ রক্তে আমার অনাদি অস্থি,/ বিদেশে জানে না কেউ!’

কবির সত্যিকারের সহযাত্রী আনিসা দিলওয়ার আছেন তার সৃষ্টিশীলতার বড় একটা অংশ জুড়ে। ‘গোটা বিশ্ব আজ প্রিয়তমা’ কবিতায় তিনি বলেন- ‘প্রিয়তমা এসো তুমি যৌথকণ্ঠে শেষ বার বলি/ আমরা বহন করি অলৌকিক মানবতা বোধ/ তাকে রোজ স্নাত করে অতলের জলীয় আমোদ/ তার স্বাদ পেতে চায় আদিম প্রাণের কথাকলি/ উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখি রোদ হাতে নাজিম হিকমত/ ম্যাক্সিম গোর্কির রাত আজো কিনা হয়নি নিঃশেষ/ জননীর কণ্ঠে শুনি বাঁধভাঙ্গা কঠোর আদেশ/ ধ্বংসকে দেখিয়ে দাও সৃজনের ধ্র“পদী হিম্মত/ প্রিয়তমা, মনে রেখো পৃথিবীর সূর্যপ্রদক্ষিণ/ অগত্যা বিশ্রাম নেই আকাঙ্খিত আলোর সফরে/ অনাগত সন্তানেরা রক্তস্রোতে বিচরণ করে/ পশু মানুষের হাতে নয় তারা কখনো অধীন/ প্রিয়তমা তুমি নও, গোটা বিশ্ব আজ প্রিয়তমা/ তার জন্য অনিবার্য বৈপ্লবিক প্রেম-পরিক্রমা।’

ষাটের দশকে দক্ষিণ স্বাধীনতাকামী নেলসন ম্যান্ডেলা যখন জেলে বন্দি, তখন দিলওয়ার তাকে নিয়ে লিখেন- ‘নেলসন ম্যান্ডেলা: একটি আগ্নেয় স্মরণ।’ কবি বিশ্বমানবতার পক্ষে কলম ধরেন ‘আনিসা শুনতে পাও, ‘উহুরু’ ‘উহুরু’ সেই ডাক?/ অগ্নিগোলকের মতো কৃতঘ্ন আঁধার ভেদ করে/ সে-ডাক ছুটন্ত দ্যাখো। রৌদ্র নৃত্য কালের অধরে!/ কৃষ্ণ সাগরের স্রোতে শ্বেতদৈত্য আতংকে নির্বাক/ এবং শুনতে পাও খাচাভাঙ্গা সিংহের গর্জন?/ শানিত থাবায় তার জন্মগত মুক্তির সনদ/ সে হাঁকে অকুতোভয়ে: করবে কে আয় গতিরোধ/ দেখি কার শক্তি কতো। আমি আজ অরাতি দমন/ সেই বজ্রনাদ শুনে, চেয়ে দ্যাখো, ধবল প্যান্থার/ শ্বেতাঙ্গ অসুরবৃন্দ জ্বরার্ত শিশুর মতো কাঁপে/ বিপুলিপ্ত নিকটবর্তী। শাখায় ঝুলন্ত স্বৈরাচার/ অতল তিমির গর্ভে সূর্যকান্ত মণির মতোন/ আফ্রিকা ক্রমশঃ দীপ্ত কন্ঠে কোটি পল রোবসন’।

কেবলমাত্র নেলসন ম্যান্ডেলা নিয়েই নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেক বিষয় নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন। যেখানে কবিতায় সর্বাগ্রে স্থান পেয়েছে সাম্য, মৈত্রী ও মানবতার অমীয় বাণী।

কবি দিলওয়ারের প্রথম কবিতা ‘সাইফুল্লাহ হে নজরুল’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে সাপ্তাহিক যুগভেরীতে। ১৯৫৩ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জিজ্ঞাসা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে বের হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ঐকতান’। এরপর কবি একে একে লিখেন পুবাল হাওয়া (গানের বই, ১৯৬৫), উদ্ভিন্ন উল্লাস (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৬৯), বাংলা তোমার আমার (গানের বই, ১৯৭২), ফেসিং দি মিউজিক (ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ, ১৯৭৫), স্বনিষ্ঠ সনেট (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৭৭), রক্তে আমর অনাদি অস্থি (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৮১), বাংলাদেশ জন্ম না নিলে (গ্রবন্ধগ্রন্থ, ১৯৮৫), নির্বাচিত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৮৭), দিলওয়ারের শত ছড়া (ছড়ার বই, ১৯৮৯), দিলওয়ারের একুশের কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৯৩), দিলওয়ারের স্বাধীনতার কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৯৩), ছাড়ায় অ আ ক খ (ছড়ার বই, ১৯৯৪), দিলওয়ারের রচনাসমগ্র ১ম খণ্ড (১৯৯৯), দিলওয়ার-এর রচনা সমগ্র ২য় খণ্ড (২০০০), ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর ডাকে (ভ্রমণ, ২০০১), দুই মেরু, দুই ডানা (কাব্যগ্রন্থ ২০০৯)৷

সাহসী শব্দ সৈনিক কবি দিলওয়ারের ‘চলমান শব্দাবলী’র মতো কলামগুলো দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। তার গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘সাদা কালো বিড়াল’ এবং ‘ইলিশ মাছের কাঁটা’। মঞ্চ নাটক হচ্ছে ‘আসল মুক্তিযুদ্ধ এবং রুধিরাক্ত কাল’।

ইংরেজি রচনা ও অনুবাদেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন কবি দিলওয়ার। অনুবাদ করেছেন মার্কিন কবি নরমান, কোরীয় লেখক মোগউ, জার্মান কবি কাল ক্রালাউ, রুশ কবি আইওন, ইতালিয়ান কথা সাহিত্যিক মোরাকিয়ান সহ বিখ্যাত লেখকদের বই।

কবি ক্লান্তিহীন উদ্যম, দুর্বার উদ্দীপনায় ছিলেন গতিশীল ও প্রত্যাশাময়ী। আমার 'ছায়াপ্রিয়া' উপন্যাস সম্পর্কে গণমানুষের কবি দিলওয়ার লিখেন- ‘বোধশক্তি অর্জনের পর থেকেই মানুষ যে তিনটি অমূল্য উপকরণকে পাথেয় করে নানাভাবে নিজের প্রকাশ ঘটাতে থাকে সেই ত্রয়ী হচ্ছে মন, স্মৃতি ও চিন্তাশক্তি। মানুষের আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জগতে যে সব বিস্ময় স্তরে স্তরে বিন্যস্ত রয়েছে, তাদের একটি হচ্ছে সাহিত্য। বাংলা ভাষার হাজার বছরের ইতিহাসে কবিতার স্থান সর্বোচ্চ হলেও উপন্যাসের শুরু প্রায় দেড়শ বছর থেকে। সমালোচকেরা এক্ষেত্রে প্রথম উপন্যাস হিসেবে গণ্য করেন যে গ্রন্থটিকে তার নাম "আলালের ঘরের দুলাল"। অতি অল্প সময়কালের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের ধারাটি বিস্ময়কর উন্নতি সাধন করে। আমার এই অতীত স্মৃতি চারণের মূলে একজন তরুণের লেখা একটি উপন্যাস 'ছায়াপ্রিয়া'।

একান্ত স্নেহাস্পদ উপন্যাসিক সাঈদ চৌধুরী তার প্রথম গ্রন্থটি নিয়ে পাঠক সমাজে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছেন। এই উৎসাহ ব্যঞ্জক প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে যে, সাঈদ চৌধুরী তার লেখায় পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থার মানসিক সুখ-দুঃখকে অনেকটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। নিঃসন্দেহে এটি এক প্রাচুর্যময় সম্ভাবনার ঝলকানি। পরিমিত কলেবরের উপন্যাসটিতে লেখক ভাবনা একাত্ব হয়ে আছে। কেন জানি মনে পড়ে যায় আমার প্রথম যৌবনে পঠিত একটি বিদেশী উপন্যাসের কথা। সেই উপন্যাস রচয়িতার বাড়ি ছিল নরওয়ের এক গ্রামাঞ্চলে। তিনি হলেন বিশ্ব বিখ্যাত ন্যুট হামসুন। উপন্যাসের নাম হাংগার। যদিও বিষয় বস্তুর তুলনায় সাঈদ চৌধুরী ও হামসুনের মধ্যে ব্যবধান বিপুল। তা সত্ত্বেও আত্মপ্রকাশের প্রশ্নে দু'জনের মধ্যে কোথাও যেন একটি মিল রয়েছে।

আমি খুবই আনন্দিত যে, 'ছায়াপ্রিয়া' উপন্যাসটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আমি আশা করবো সাঈদ চৌধুরী পাঠকদের পক্ষ থেকে গ্রহণযোগ্যতার যে সম্মান অর্জন করেছেন, আগামীতে আরো সতর্কতা ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে নতুন নতুন সাহিত্যকর্ম উপহার দিয়ে তার অভীষ্ট লক্ষ্য পথে এগিয়ে যাবেন। প্রসঙ্গতঃ আমরা অবশ্যই স্মরণ করবো যে, প্রতিটি উন্নত দেশ তার অস্তিত্বে ধারণ করে আছে নিজ নিজ সাহিত্য-সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। আমি লেখকের ফলপ্রসূ দীর্ঘায়ু কামনা করি। -দিলওয়ার, ভার্থখলা, সিলেট।’

কবি দিলওয়ার ১ জানুয়ারি ১৯৩৭ সালে সিলেট শহরের দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলাস্থ পৈতৃক নিবাস খান মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী হাসান খান এবং মাতা মোছাম্মৎ রহিমুন্নেসা। পুরো নাম দিলওয়ার খান। যদিও তিনি পারিবারিক ‘খান’ পদবি কখনো ব্যবহার করেননি। রক্ষণশীল পারিবারিক ঐতিহ্য ভেঙে কবি দিলওয়ার সাধারণ মানুষের সাথে মিশে গিয়েছিলেন। সকল চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে কবি দিলওয়ারের চেতনায় ছিল শুধুই দেশপ্রেম। মানুষকে ভালোবেসে তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন।

‘আমার মৃত্যুর পর’ শীর্ষক লেখা কবিতায় কবি দিলওয়ার বলেছেন, ‘আমার মৃত্যুর পরে যদি তুমি/ কখনো খুঁজতে যাও এই মর্মভূমি/ মনে রেখো তবে/ বাংলার হৃদয় নিয়ে কেটেছে/ আমার দিন/ প্রতীচ্যের মুক্তির গৌরবে।’

২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর বার্ধক্যজনিত কারণে ইহকাল ত্যাগ করেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এই কবি। যার ভালোবাসা ছিল কর্মচঞ্চল মানুষের সাথে। জনতার বহমান কর্মধারার সঙ্গেও। তিনি একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা-ব্যক্তিত্ব। ঐশ্বর্যময় কবি। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি মানবতার মুক্তিকন্ঠ, গণমানুষের কবি দিলওয়ারকে।

লেখক: লন্ডন প্রবাসী। সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক।

   

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা



ড. মিল্টন বিশ্বাস
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • Font increase
  • Font Decrease

‌‌আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।'

আজ ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। দুর্যোগময় পৃথিবীতে তাঁর জন্মদিন ভিন্নতর তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী, বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ। তাঁকে কেন্দ্র করে কেবল পাকিস্তানি সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা নয় ১৯৭১ এর আগে থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে তাঁর মাধ্যমে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহানপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম অনুঘটক। তাঁর দীর্ঘ কারাজীবনের সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’। লেখাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ভক্ত বঙ্গবন্ধুই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’কে সংবিধানভুক্ত করেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনার ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কথা এভাবেই বলেছিলেন তিনি- Go to anywhere in the world and tell them that you have come from the country of Tagore, they will respect you.

বিশ্বকবির দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বকবির ভাষাপ্রেম এদেশের মানুষকে ভাষা সংরক্ষণের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাঁর কবিতা ও গান একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ের সম্পর্ক এবং সংকট-মুহূর্তে তাঁর সাহিত্য-সংগীতের দ্বারা উজ্জীবিত হওয়া সাধারণ একটি ঘটনা। মনে রাখতে হবে পাকিস্তানিদের চেয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য রবীন্দ্রনাথকে বারবারই সামনে এনেছেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙালিকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি- ‘কবিগুরু, তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ জীবদ্দশায় কবিগুরু দেখেছেন যুদ্ধ-বিপর্যস্ত পৃথিবীতে মহাবিপর্যয়ের ত্রাস। মারণব্যাধির মহামারি, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরে মানবসভ্যতার পরাজয়ের ভয়ঙ্কর ও বিব্রতকর চিত্র। তবু তিনি মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন ‘দুঃসময়’ (কল্পনা)-এর মতো আরো অনেক কবিতা-গানে।

লিখেছেন-দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা-/তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।’ (দুঃসময়) রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে-পরে বিশেষত ১৮১৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত একশ বছরে সাতবারের কলেরা মহামারিতে ভারতবর্ষে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। ১৮৯৬ সালের প্লেগ মহামারি, ১৮৯৭ সালের বড় ভূমিকম্প অথবা ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্যোগের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মনীতি বিশ্বকবির মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

২.
‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থের ‘সমবায়ে ম্যালেরিয়া-নিবারণ’ (ভাদ্র, ১৩৩০) এবং ‘ম্যালেরিয়া’ (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১) প্রবন্ধ ছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান প্রসঙ্গে তিনি মানবজীবন থেকে ব্যাধি নিবারণের কথা বারবার বলে গেছেন। একটি উদ্ধৃতি- ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, দুর্গতির কারণ সব দেশেই আছে। কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব কী। না, সেই দুর্গতির কারণকে অনিবার্য বলে মনে না করে, যখন যাতে কষ্ট পাচ্ছি চেষ্টা-দ্বারা তাকে দূর করতে পারি, এ অভিমান মনে রাখা। আমরা এতদিন পর্যন্ত বলেছি, ম্যালেরিয়া দেশব্যাপী, তার সঙ্গে কী করে লড়াই করব, লক্ষ লক্ষ মশা রয়েছে তাদের তাড়াব কী করে, গভর্মেণ্ট আছে সে কিছু করবে না... আমরা কী করব! সে কথা বললে চলবে না। যখন আমরা মরছি, লক্ষ লক্ষ মরছি... কত লক্ষ না মরেও মরে রয়েছে...যে করেই হোক এর যদি প্রতিকার না করতে পারি আমাদের কিছুতেই পরিত্রাণ নেই। ম্যালেরিয়া অন্য ব্যাধির আকর। ম্যালেরিয়া থেকে যক্ষ্মা অজীর্ণ প্রভৃতি নানারকম ব্যামো সৃষ্টি হয়। একটা বড়ো দ্বার খোলা পেলে যমদূতেরা হুড়্ হুড়্ করে ঢুকে পড়ে, কী করে পারব তাদের সঙ্গে লড়াই করতে। গোড়াতে দরজা বন্ধ করা চাই, তবে যদি বাঙালি জাতিকে আমরা বাঁচাতে পারি।’ আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে সম্মিলিতভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ব্যাধি বিস্তার রোধ করার উপায় বলেছিলেন কবি।

আরো এক জায়গায় তিনি লিখেছেন- ‘আমরা অনেকে জানি ম্যালেরিয়া কিরকম গোপনে ধীরে ধীরে মানুষকে জীবন্মৃত করে রাখে। এ দেশে অনেক জিনিস হয় না; অনেক জিনিস আরম্ভ করি, শেষ হতে চায় না; অনেক কাজেই দুর্বলতা দেখতে পাই...পরীক্ষা করলে দেখা যায় ম্যালেরিয়া শরীরের মধ্য থেকে তেজ কেড়ে নিয়েছে। চেষ্টা করবার ইচ্ছাও হয় না।’ অর্থাৎ রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ছিল স্পষ্ট ধারণা। তাছাড়া তখন বিশ্বভারতীর একটা ব্যবস্থা ছিল- শান্তিনিকেতনের চারিদিকে যে-সমস্ত পল্লিবসতি দেখা যেত সেগুলিকে তিনি নীরোগ রাখার জন্য বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।

৩.
বিশ্বকবি লিখেছেন- ‘সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।/সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ/মুক্তো করো ভয়/আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’ বিভিন্ন সংকটে ও দুর্যোগে আমরা ‘ম্রিয়মাণ’ কিন্তু ভয়-মুক্ত হওয়ার জন্য যাঁর কাছে মানসিক শক্তি পেতে পারি তিনি আমাদের জীবনে আবির্ভূত সংকট নিবারণের বাঞ্চিত সঙ্গী। তিনি নিজেও আশি বছর বয়স পর্যন্ত নিজের স্ত্রী, সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের মৃত্যুর করালগ্রাসে হারিয়ে যেতে দেখেছেন; তবে বিচ্ছেদ ও একাকিত্বের গভীর বেদনাকে অন্তরে ধারণ করে নিজের শক্তিতে জয়ী হয়েছেন। তাঁর দু কন্যা মাধুরীলতা ও রেণুকা দেবীর হয়েছিল যক্ষ্মাতে মৃত্যু এবং ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিল কলেরায়। অন্য কন্যা মীরাদেবীর পুত্র নীতীন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণও তাঁকে মর্মদাহিক বেদনায় দিশেহারা করেছিল।

তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃস্মৃতি’তে লিখেছেন- ‘ভাগ্যের উত্থান-পতন, দুঃখ কিংবা ক্লেশ কোনো কিছুই অবশ্য বাবার চিত্তের প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। মহর্ষির মতই তিনিও সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকতেন। বেদনা যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন, তা তাঁর ভিতরের শান্তিকে নষ্ট করতে পারত না। সবচেয়ে দুঃখের দুর্ভাগ্যকে সইবার মত এক অতিমানবিক শক্তি ছিল তাঁর।’

এর কারণ হলো তিনি ছিলেন বিশ্বের তাবৎ মানুষের ঐক্যবদ্ধতায় বিশ্বাসী। তিনি ভেবেছেন- ‘মানুষের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই, সমস্ত মানুষ এক। মানুষের সমাজে একজনের পাপের ফলভোগ সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়; কারণ, অতীতে ভবিষ্যতে, দূরে দূরান্তে, হৃদয়ে হৃদয়ে, মানুষ যে পরস্পর গাঁথা হয়ে আছে।...যে পাপের ভার এতদিন নানা স্থানে নানা জনে জমাইয়া তুলিতেছিল, তাহারই আঘাতে রুদ্র আজ জাগ্রত হইয়াছেন-দেবতার ও মানবতার অপমান তিনি সহ্য করিতে পারিতেছেন না।’

রুদ্রের রোষেই আজ করোনা মহামারিতে এত মৃত্যু, এত ঝড়-ঝঞ্ঝা; এই মৃত্যু মানবেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। তাই নতুন বন্দরে নোঙর করতে হলে সে মৃত্যুকেও বরণ করতে হবে; সে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে অকম্পিত বুকে বলতে হবে- ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।/তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।/...নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।’

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে একদিকে যুদ্ধের মৃত্যুভীতি অন্যদিকে উষ্ণ প্রকৃতির অসহনীয়তার পর সতেজ ও অবিনশ্বরতায় প্রাণের নিত্যধারা প্রবহমান। এই কঠিন ও সহজ সময়ে আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ, আগমন-বিদায় আর পুনরাগমন-পুনর্মিলনের খণ্ডাংশের যাপিত-জীবনে এসেছে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী- যা উজ্জ্বলতর মুহূর্তগুলোর একটি। আর দুর্যোগ, দুর্বিপাকে তাঁকে স্মরণ করেই আমাদের শান্তি ও আনন্দ লাভ সম্ভব।

৪.
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের সংকটে মৃত্যু, যন্ত্রণা ও দুঃখ-কষ্টে আমরা যেমন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছি তেমনি যারা মানবতার সেবায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন কিংবা মানুষের ধর্ম পালন করছেন তাদেরও সম্মান জানাচ্ছি বিশ্বকবির ভাবনা দিয়েই। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’ ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-‘মানুষ বিষয়বুদ্ধি নিয়ে নিজের সিদ্ধি অন্বেষণ করে। সেখানে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রানির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত।

সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়। তাঁর আরো এবটি দিক আছে যেখানে ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে লাভ-ক্ষতির বিচার করে না বরং অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করতে চায়। সেখানে স্বার্থের প্রবর্তনা নেই। আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড়ো জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।’ রবীন্দ্রভাষ্য মতে, আত্মত্যাগী মানুষই মনুষ্যত্বের দিশারি। তারাই এই বিশ্বজগতকে সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। মহামারির সংকটে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

৫.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রারম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলেন আধুনিক সভ্যতার দান হলো ইউরোপের অন্তরের সম্পদ। কিন্তু পৃথিবীর সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ দেখে ৮০ বছর বয়সে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায় তাঁর। ‘তবু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন তিনি। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে আশা করেছিলেন- ‘মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।

আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে...। ‘অপরাজিত মানুষে’র জয় আর ‘প্রবলপ্রতাপশালীর ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা’র অবসান যে সত্য হবে সে কথা মৃত্যুর ঠিক আগে বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রত্যাশা করেছিলেন ‘মানব-অভ্যুদয়ে’র মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের। লিখেছেন- ‘অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত/ধূলিতলে হয়ে যাবে ভগ্ন।/ নবজীবনের আশ্বাসে।/ জয় হবে মানব-অভ্যুদয়।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় মানবপীড়নের মহামারি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারে তার কৃপণতা ভারতীয়দের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল। দেখেছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর বর্বরতা জাগ্রত হয়ে উঠে মানবাত্মাকে অপমানে নিঃস্ব করে দেবার ঘটনাও। তিনি নিভৃতে সাহিত্যের রসসম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন থেকে বেরিয়ে এসে ভারতবর্ষের জনসাধারণের নিদারুণ দারিদ্র্য সচক্ষে দেখেছেন। অন্ন-বস্ত্র-পানীয়- শিক্ষা-আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক তার নিরতিশয় অভাব দেখে তিনি আধুনিক-শাসনচালিত ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন।

জনসাধারণের প্রতি ব্রিটিশদের অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য ছিল বলেই বাংলায় সংক্রমিত কলেরা ও ম্যালেরিয়া মহামারিতে তাঁর ভূমিকা ও দিক-নির্দেশনা পূর্বে উল্লিখিত ‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থে যথার্থভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের সময়টিও ছিল মানবসভ্যতার এক সন্ধিক্ষণ। সেসময় মানবসভ্যতার পরিবর্তনের রূপ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন কবি। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের পতন চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনতন্ত্র গণতন্ত্রের সঙ্গেই পথ ধরে চলেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কবির শঙ্কিত মন বারবারই বিশ্বের মানুষকে সচেতন করার জন্য উদগীব হয়েছে। এজন্যই ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ ও আত্মতৃপ্তির পরিধি থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘মানুষ আপন উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎমানুষ হয়ে উঠছে, তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা এই বৃহৎমানুষের সাধনা। এই বৃহৎমানুষ অন্তরের মানুষ। বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব। ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষের আত্মোপলব্ধি বাহির থেকে অন্তরের দিকে আপনিই গিয়েছে, যে অন্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌঁচেছে বিশ্বমানসলোকে।’

সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে পৃথিবীর মঙ্গল করা যায় না। জীবনকে সার্থক করার জন্য প্রয়োজন বিশ্বজনীন কর্মপ্রয়াস। সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র গাথাই হলো বিশ্বজনীনতা। মানুষ ব্যক্তিগত সীমাকে অতিক্রম করতে পারলেই তার বিশ্বমানব সত্তা চিহ্নিত হয়। ব্যক্তিগত মানুষ নয়, সে বিশ্বগত মানুষের একাত্ম। দেশকালগত সংকীর্ণ পার্থক্যের দিকে মনোযোগ না দিয়ে মানব সভ্যতার সমস্যাকে সমগ্র মানবের সত্য বলে জানতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তা থেকে উদ্ধারের।

কবির মতে, ‘মানুষ আপনাকে জেনেছে অমৃতের সন্তান, বুঝেছে যে, তার দৃষ্টি, তার সৃষ্টি, তার চরিত্র, মৃত্যুকে পেরিয়ে। মৃত্যুর মধ্যে গিয়ে যাঁরা অমৃতকে প্রমাণ করেছেন তাঁদের দানেই দেশ রচিত। সব মানুষকে নিয়ে; সব মানুষকে অতিক্রম করে, সীমাবদ্ধ কালকে পার হয়ে এক-মানুষ বিরাজিত।’ এই যে দেশকালপাত্র ছাড়িয়ে মানুষের বিদ্যা, মানুষের সাধনা সত্য হয়ে ওঠা এখানেই মানবধর্মের সারকথা নিহিত। ‘মানুষ এক দিকে মৃত্যুর অধিকারে, আর-এক দিকে অমৃতে; এক দিকে সে ব্যক্তিগত সীমায়, আর-এক দিকে বিশ্বগত বিরাটে। এই দুয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করা চলে না।’ তবে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ কখনও বিশ্বজীবনের জন্য কিছু করতে পারে না। এজন্য দরকার আত্মত্যাগী মানুষ যার আত্মগৌরব নেই।

৬.
মূলত জলবায়ুর উষ্ণতা কিংবা যুদ্ধের মহামারিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ও সভ্যতার বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য আমরা বিশ্বকবির জন্মদিনে তাঁর রচনা থেকেই আতঙ্ক ও কষ্ট দূর করার রসদ পাচ্ছি। তিনি যেন এসব সংকটে ঠেলে ভাঙনের পথে এসেছেন পৃথিবীকে রক্ষা করতে। কারণ মৃত্যুভীতিতেও আমরা মনে করি তাঁর কথাই সত্য- ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’… ‘আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’

মারণঘাতি ভাইরাসের মধ্যে তাঁর প্রকাশ সূর্যের মতো কুহেলিকা উদঘাটন করছে। ভয়কে জয় করার জন্য রিক্ত, ব্যর্থ, শূন্য মানুষকে বিস্ময়ে তিনিই উজ্জীবিত করছেন আজও। ২৫ বৈশাখে লেখা তাঁর নিজের কবিতাতেও সেই অভিব্যক্তি- ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/সূর্যের মতন।/ রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,/ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।’ অসীমের চিরবিস্ময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজকের পৃথিবীতেও স্মরণীয়।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email: [email protected]

;