মোহাম্মদী, কৃষক ও নবযুগে যেভাবে চাকরি হারান আবুল মনসুর আহমদ



ড. কাজল রশীদ শাহীন
মোহাম্মদী, কৃষক ও নবযুগে যেভাবে চাকরি হারান আবুল মনসুর আহমদ

মোহাম্মদী, কৃষক ও নবযুগে যেভাবে চাকরি হারান আবুল মনসুর আহমদ

  • Font increase
  • Font Decrease

(পূর্ব প্রকাশের পর) আবুল মনসুর আহমদ ‘মোহাম্মদী’তে ভালই ছিলেন, কর্মঘণ্টা বেশি হলেও বিবিধ রকমের কাজ মনের আনন্দে শিখে নেন। মনে করেছেন সকল সুযোগকে কাজে লাগানো উচিৎ। এমনকি প্রুফ দেখার মধ্যেও তিনি বিশেষ আর্ট খুঁজে পান।

তিনি লিখেছেন ‘প্রুফ দেখা একটা বিশেষ আর্ট। জ্ঞানের চেয়ে দক্ষতা ও নিপুণতা এ কাজে অধিক আবশ্যক।’ এ ছাড়া তাঁর ‘মতিগতি’ও ছিল অন্যরকম। এই ‘মতিগতি’র সুবাদে এবং ‘কাঁধ পাতিয়া দেয়ার’ অভ্যাস গুণেই তাঁর পক্ষে পরবর্তীতে একজন কিংবদন্তিতুল্য সম্পাদক হয়ে ওঠা সম্ভব হয়।

মোহাম্মদীতে চাকরি করেন প্রায় দেড় বছর। তারপর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো চাকরি চলে যায়। অপরাধ কি, কিছুই জানানো হয়নি। কারণ খুবই গৌণ। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নিষেধ না করে, কোনো প্রকার কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর হাতে বরখাস্তের কাগজ ধরিয়ে দেন। আর তক্ষুনি আবিষ্কার করেন, মোহাম্মদীতে কাজ করার পরও ‘সত্যাগ্রহী’ পত্রিকার মওলানা আবদুল্লাহিল কাফী ও মওলানা আবদুল্লাহিল বাকীকে সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান মোহাম্মদী কর্তৃপক্ষ যৌক্তিক মনে করেননি।

আবুল মনসুর আহমদ পরবর্তীতে এ প্রসঙ্গে ‘আত্মকথা’য় বলেছেন, ‘সত্যাগ্রাহীতে সাহায্য করা অপরাধ জানিলে এ কাজ তিনি করিতেন না। কারণ এই পঞ্চাশ টাকা বেতনের চাকরি ছাড়িয়া থাকার মতো উপায় নেই। ...বিবাহ করিতে রাজি হইয়াছেন এবং বিয়ার দিন তারিখও ঠিক হইয়া গেছে।’

আবুল মনসুর আহমদের তৃতীয় চাকরি ‘দি মুসলমান’ পত্রিকায়। মওলানা আবদুল্লাহিল কাফীর অনুরোধে মৌলবি মুজিবুর রহমান এখানে চাকরি দেন। অগ্রিম বেতন পঁয়ষট্টি টাকা দিয়ে গ্রামে গিয়ে বিয়ে করে আসার নির্দেশ দেন। এখানে চার বছর চাকরি করেন।

অভিজ্ঞতার কথায় লিখেছেন মৌলবি সাহেবের কাছে শেখা শিষ্টাচারের কথা। তিনি লিখেছেন, ‘কোন সমালোচনা বা নিন্দা করিতে গিয়া শিষ্টাচার ও ভদ্রতার খেলাফ করিও না।’ এই প্রতিষ্ঠানে তাঁর কর্মদক্ষতার যথাযথ মর্যাদাও পেয়েছিলেন। শুধুমাত্র তাঁর কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ বাংলা সাপ্তাহিক ‘খাদেম’ প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি সম্পাদন-পরিচালনার পুরো দায়িত্ব পান। এবং একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনায় বিশেষ দূরদর্শিতার পরিচয় দেন।

ঘটনাটা এরকম-এলাহাবাদের স্বামী সত্যদেব ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি কলকাতায় এলে তাকে অভ্যর্থনা ও টাকার তোড়া দেওয়ার আয়োজন করা হয়। সেই সময়ের সব মুসলমান সংবাদপত্রই এ কাজের সমর্থন করেন। কিন্তু ‘খাদেম’ একা এর প্রতিবাদ জানায়। এ ব্যাপারে তাঁর যুক্তি হলো, ‘‘কোনো অমুসলমান ইসলাম কবুল করিলেই তাকে অভ্যর্থনা দেওয়ার যে ঘটা হয়, এটা ইসলাম ও মুসলমান সমাজের জন্য অপমানকর। এতে প্রমাণিত হয় যে ঐ ভদ্রলোক ‘ইসলাম’ ও মুসলমান সমাজের শক্তি ও মর্যাদা বাড়াইয়াছেন।’’

এ কারণে খাদেমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে মৌলবি সাহেবের কাছে নালিশ করা হয়। মৌলবি সাহেব তাঁর মত সমর্থন করেও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর উপদেশ দেন। তিনি চুপ থাকেন।

কয়েকদিন পর দেখা গেল, আবুল মনসুর আহমদই ঠিক ছিলেন। স্বামী সত্যদেবরূপী মহীউদ্দীন এই অঞ্চল থেকে পাঁচ লাখ টাকা হস্তগত করে এলাহাবাদে ফিরে আর্য ধর্মে পুনরায় দীক্ষিত হন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন।

আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, ‘অভ্যর্থনা-ওয়ালাদের মুখে চুনকালি পড়িল। আমার সমর্থকদের দন্ত বিকশিত হইল। কিন্তু বিজয়ানন্দের উল্লাসে নিজের হতভাগ্য নির্বোধ সমাজের জন্য আমার চোখে পানি আসিল।’

তাঁর প্রথম পর্যায়ের সাংবাদিকতার ইতি ঘটে ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে। এ পর্বের সাংবাদিকতায় বিশেষভাবে লক্ষণীয় হলো, তাঁর আগামী দিনের সম্পাদক হওয়ার ‘ড্রেস রিহার্সাল’ সম্পন্ন হয়। ‘ছোলতান’, ‘মোহাম্মদী’, ‘দি মুসলমান’, ও ‘খাদেম’ পত্রিকায় নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করেন। বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে, ‘মতিগতি’ ও ‘কাঁধ পাতিয়া দেয়ার অভ্যাস’। যার সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যাপক পড়াশোনার অভ্যাস। অনুসন্ধান বলছে এসব গুণাবলীই একজন সহ-সম্পাদককে সাংবাদিকতা জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে সফল ও সার্থক সম্পাদক হয়ে উঠতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে। মাঝে নয় বছরের ব্যবধান। কিন্তু এ সময়ে সক্রিয় সাংবাদিকতায় যুক্ত না থাকলেও পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে দীপ্যমান ও গতিশীল রেখেছিলেন সাংবাদিক-সম্পাদকের প্রবৃত্তিকে। এ পর্বে তিনি আবির্ভূত হন পূর্ণ সম্পাদক রূপে।

নিখিল-বঙ্গ-কৃষক-প্রজা সমিতির উদ্যোগে ‘কৃষক’ প্রজা আন্দোলনের মুখপত্ররূপে প্রকাশনায় আসে ‘দৈনিক কৃষক’। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন হুমায়ুন কবির। পরিচালক সভায় যুক্ত হন মৌ. শামসুদ্দীন আহমদ, মৌ. সৈয়দ নওশের আলী, নবাবজাদা সৈয়দ হাসান আলী, খান বাহাদুর মোহাম্মদ জান ও ডা. আর আহমদ। পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি শ্রীযুক্ত সুভাষ চন্দ্র বসু। সম্পাদকের বেতন দুই শ টাকা আর টেবিল অ্যালাওয়েন্স পঞ্চাশ টাকা।

কৃষকের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন: ‘‘খাটিলাম খুব। অল্পদিনেই কাগজ সাংবাদিক মহলে সম্মান ও জনসাধারণের মধ্যে পপুলারিটি অর্জন করিল। আদর্শ নিষ্ঠায় স্বাধীন মতবাদে এবং নিরপেক্ষ সমালোচনায় ‘কৃষক’ বেশ নাম করিল।’’ যদিও নাম-যশে কৃষক সকলের কাছে সমাদৃত একটা পত্রিকা হয়ে উঠল, কিন্তু ভাগ্যাকাশে দেখা দিল কালোমেঘ। কৃষক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে হুমায়ুন কবির পদত্যাগ করলেন।

উক্ত ঘটনায় আবুল মনসুর আহমদের উপলব্ধি হলো:

এক. দৈনিক পত্রিকা চালাতে হলে যথেষ্ট মূলধন দরকার, যা বিবেচনায় নেয়নি কৃষক কর্তৃপক্ষ।

দুই. সংবাদপত্র এখন আর মিশনারি ওয়ার্ক নয়, এর চারিত্র্যকাঠামো এখন ইন্ডাস্ট্রিতে রূপ নিয়েছে।

তিন.  দৈনিক পত্রিকা চালাতে এবং লাভজনক করতে মোটা অংকের মূলধন বিনিয়োগ করার সামর্থ্য ও সদিচ্ছা থাকতে হবে।

হুমায়ুন কবিরের পর কৃষকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হলেন খান বাহাদুর মোহাম্মদ জান। অবাঙালি হওয়ায় চার-পাঁচ মাসের মধ্যে তিনি এ কাজে আগ্রহ হারান। এরপর দায়িত্ব নেন মি. হেমেন্দ্র নাথ দত্ত ওরফে মি. এইচ দত্ত। তিনি কলকাতা কমার্শিয়াল ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হওয়ায় কৃষকের ভাগ্যে সুদিন ফিরে আসে। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, ‘আমি কম্পোজিটারদের জন্য ফ্যানের ব্যবস্থা করিলাম (পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো)। বড়ো-বড়ো লাভের কাগজ সচরাচর ঐ সময় তা করে নাই। আমার কাজকে তারা বিদ্রূপ করিয়াছে।’

কিছুদিনের মধ্যে কৃষকে নীতিগত বিরোধ দেখা দেয়। ওই সময় হক মন্ত্রিসভায় প্রস্তাবিত মাধ্যমিক শিক্ষা বিল নিয়ে বিতর্ক ওঠে। ওই বিল পাস হলে মেট্রিক পরীক্ষার কর্তৃত্ব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে উপরমহলের প্রায় সকলেই এর বিরোধিতায় নামে। বেশির ভাগ সংবাদপত্র ও কংগ্রেস পার্টি আইন সভার ভেতরে-বাইরে এর প্রতিবাদে জনমত গড়ে তোলে। কেবল কৃষক এই বিলের সমর্থন করে সম্পাদকীয় লেখে।

এই নিয়ে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে বিরোধে শেষাবধি পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। সে সময় প্রশ্ন ওঠে যে, সংবাদপত্র তা হলে কার কথায় চলবে? মালিক না সম্পাদক। তাঁর যুক্তি ছিল মালিকপক্ষের কথায়। যা সেদিন ওয়ার্কিং জার্নালিস্টরা কেউই পছন্দ করেননি। প্রতিবাদ জানান।

আবুল মনসুর আহমদ এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বলিয়াছিলাম সাংবাদিকতা ওকালতির মতোই একটা প্রফেশন। এটা মিশনারির মতো আদর্শ সেবা নয়। উকিল  যেমন দোষী-নির্দোষ সকলের কেস নেন, সাংবাদিকও তেমনি কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, হিন্দুসভা নির্বিশেষে সকলের কেস নিবেন। সাংবাদিক এইভাবে পরের জন্য টাকার বিনিময়ে কলম চালাইতে গিয়া এতটুকুমাত্র দেখিবেন যে ঐ সাংবাদিক কর্তব্যের বাহিরে তাঁর স্বাধীনতা যেন ব্যাহত বা সংকুচিত না হয়। আপনি যদি কংগ্রেসি হন, তবে কংগ্রেস বিরোধী কাগজে আপনি চাকরি নিবেন না। যদি নেন, কংগ্রেস বিরোধী কথাই আপনাকে লিখিতে হইবে।’

১৯৪১ সালের অক্টোবর মাস। আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় ‘নবযুগ’ পত্রিকায়। এ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে নাম দিতে রাজি হননি, দেনওনি। ছিলেন ‘শ্যাডো এডিটর’। বেতন সাকুল্যে তিনশ’ টাকা। সম্পাদক হিসেবে নাম দেওয়া হয় কাজী নজরুল ইসলামের। নবযুগ ছিল এ. কে. ফজলুল হকের দৈনিক পত্রিকা।

নাম না দেওয়ার পেছনে উনার যুক্তি হলো, নিরপেক্ষভাবে যে কোনো মতের পত্রিকায় কাজ করা যায়। এই উপদেশ তিনি অন্যদেরও দিতেন। কিন্তু নিজে গ্রহণ করেননি। যুক্তি হলো তাঁর একটা ‘রাজনীতিক জীবন আছে’।

অবশ্য নবযুগের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় বেশিদিন তিনি এই মতে অটল থাকতে পারেননি। আবার কৃষক থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতায় এই বোধোদয়ও হয় যে, পত্রিকা চলবে মালিকের অভিপ্রায় অনুযায়ী। তিনি লিখেছেন, ‘‘হক সাহেবের তখনকার রাজনৈতিক সাফল্য-অসাফল্যের সাথে ‘নবযুগ’ এর মরা-বাঁচা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ছিল।

‘নবযুগ’-এর বাঁচিয়া থাকা শুধু আমার একার নয়, ‘নবযুগে’র শতাধিক চাকুরিয়ার জীবন নির্ভর করিতেছে। দু’চার জন বাদে এঁরা সবাই মুসলমান। ‘নবযুগ’ না থাকিলে এঁদের বিপদ হইবে। ‘কৃষক’-এর সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা হইতে এটা আমি বুঝিয়াছিলাম। কাজেই অন্তত ‘নবযুগ’-এর জন্যও হক সাহেবের এই নয়া রাজনীতিকে সফল করিতেই হইবে, এই প্রয়োজনের বিচারেই আমি সম্পাদকীয় লিখিয়া চলিলাম।’’

যে হেমেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে আবুল মনসুর আহমদ কৃষক ছেড়েছিলেন। আকস্মিকভাবে তিনি আবার ম্যানেজিং ডিরেক্টর রূপে নবযুগে আবির্ভূত হন। প্রথম দিনের সৌজন্য পরিচয়েই ঘটে বড় রকমের বিপত্তি। দু-এক কথার আলাপেই তা রূপ নেয় অনভিপ্রেত ঘটনায়। এবং ঘটনা প্রকৃতপক্ষে যা নয়, সেদিকেই মোড় নেয়। দত্তবাবু রেগে বলে উঠলেন, ‘আমাকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন? এ অপমানের আমি বিচার করাইব।’ এ কথা বলে বের হতে গিয়ে দুর্ভাগ্যবশত হুমড়ি খেয়ে চৌকাঠের উপর পড়ে মূর্ছা যান।

এই নিয়ে ‘ভোটরঙ্গ’ ও ‘অবতার’ নামের জনপ্রিয় দুই স্যাটায়ার পত্রিকায় লেখা হয় ‘হেমেন্দ্র বধ কাব্য’ ও ‘হেমেন্দ্র-মনসুর-সংবাদ’ নামে অমিত্রাক্ষর ছন্দের কাব্য নাটিকা। এসব ঘটনায় দত্তবাবু আরও রুঢ় হয়ে ওঠেন এবং নবযুগের দুই প্রধান ব্যক্তির মধ্যে কথা ও মুখ দেখাদেখি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

কিছুদিনের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গেলে কাজী নজরুল ইসলামের তরফে পাঠানো টেলিগ্রামে জানানো হয় ‘আপনার সার্ভিসের দরকার নাই।’ উনার সাংবাদিকতা জীবনের তৃতীয় পর্যায়ের সমাপ্তি হয় এভাবেই। (চলবে…)

লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক, [email protected]

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;