স্বাস্থ্যের প্রতি রাগ, রচনাবলি পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন কাফকা



আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
ফ্রানৎস কাফকা

ফ্রানৎস কাফকা

  • Font increase
  • Font Decrease

নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তার সাহিত্যের হাতেখড়ির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একটা গল্প উল্লেখ করেছেন। গল্পের নাম মেটামরফসিস। মার্কেজের দাবি মতে, গল্পটির প্রথম লাইন পড়ার পরই তার খাট থেকে পড়ে যাবার যোগাড় হয়েছিল। এভাবেও যে গল্প শুরু করা যায়; সে সম্পর্কে তার ধারণা ছিল না।

সেই গল্পটার লেখকের নাম ফ্রানৎস কাফকা। আধুনিক বিশ্বসাহিত্যে সবথেকে প্রভাবশালী এবং দুর্বোধ্য এক পথিকৃৎ। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিকদের মধ্যেও একগাদা নাম পাওয়া যাবে; যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কাফকা দ্বারা অনুপ্রাণিত। অথচ কাফকার জীবন কিন্তু সুখের ছিল না।

কাফকার জন্ম ১৮৮৩ সালের ৩ জুলাই। বর্তমান চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগের মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারে। ইউনিভার্সিটি অব প্রাগ-এ আইন নিয়ে পড়াশোনা করার পর এক বীমা কোম্পানিতে যোগ দেন। লেখালেখির কাজটা হতো মূলত সন্ধ্যার দিকে। ১৯২৩ সালের দিকে বার্লিনে সরে এসে পুরোদমে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু ভাগ্য বিরূপ। টিউবারকুলোসিস-এর শিকার হিসাবে অচিরেই পাড়ি জমাতে হয় পরপারে। বেশিরভাগ লেখাই প্রকাশনার মুখ দেখতে পায় তার বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের হাত ধরে।

যাপিত জীবন

তখনকার অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্যের বোহেমিয়ার প্রাগে জন্ম নেওয়া কাফকা শৈশব থেকেই এক নির্মম বাস্তবতা নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন। মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারের বড় সন্তান। ছোট দুই ভাই গেয়র্গ এবং হেনরিখ ছোটবেলাতেই মৃত্যুবরণ করে। কাফকার বয়স তখন মাত্র ছয় বছর। পরবর্তীতে সেই পরিবারে আরো তিনজন কন্যা যুক্ত হয়; যাদের সবাই মারা যান নাৎসিবাহিনীর হত্যাযজ্ঞে।

পিতামাতার সাথে কাফকার সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল না। গৃহিণী মা জুলি ঘর সামলাতেই নিজের সমস্তটা নিয়ে ব্যস্ত। পুত্রের লেখক হবার স্বপ্ন তার কাছে না পেয়েছে অর্থ, না পেয়েছে গুরুত্ব। বাবা হারম্যান ছিলেন বদরাগী আর আধিপত্যকামী মানসিকতার। নিজে সফল ব্যবসায়ী থাকলেও পুত্রের স্বপ্ন তার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে থোড়াই।

আরো পড়ুন ➥ সারা জীবন একটি কাব্যগ্রন্থ পরিমার্জন করে গেছেন হুইটম্যান

কাফকার জীবন এবং লেখাগুলোতে তার বাবার দারুণ প্রভাব ছিল। একজন স্বৈরাচারী আর মাথা গরম পিতা, যার কাছে পুত্রের সৃজনশীলতার কোনো মূল্য নেই। কাফকা নিজেও বিশ্বাস করতেন, তার জীবনের বেশিরভাগ সংগ্রাম, সম্পর্কের নাটকীয়তা কিংবা অনুরূপ জীবন মূলত এসেছে পিতার সাথে জটিল সম্পর্কের সাঁকো বেয়ে। সাহিত্যে কাফকার চরিত্রগুলো প্রায়শ উর্ধ্বতন ক্ষমতার বিরুদ্ধে নেমে আসত। 

শিক্ষা ও কর্মজীবন

কাফকার মাতৃভাষা ছিল জার্মান। নিজের চেক নাগরিকত্ব কিংবা ইহুদি উত্তরাধিকারের বাইরে তার সাংস্কৃতিক পরিচিতি জার্মান হিসাবেই গৃহীত হয়েছিল। হাইস্কুল শেষ করে ভর্তি হলেন চার্লস ফার্দিনান্দ ইউনিভার্সিটি অব প্রাগ-এ। রসায়ন পড়তে মনস্থ হলেও মাত্র দুই সপ্তাহ পরেই আইন বিভাগকে বেছে নেন। তার এই পছন্দ পিতাকে তুষ্ট করে। কাফকাও সময় বের করতে সক্ষম হন শিল্প ও সংস্কৃতিতে মগ্ন থাকতে। ১৯০৬ সালে আইন থেকে ডিগ্রি নিয়ে বের হন।

◤ কাফকার পিতা হারম্যান এবং মা জুলি ◢


১৯০৭ সালের শেষের দিকে একটি ইতালিয়ান বীমা কোম্পানিতে চাকুরি নেন। এই অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর নিজেকে দেবার মতো সময়টা পর্যন্ত পাওয়া যেত না। লেখালেখির জন্য সময় দেওয়া যেন সাধ্যের বাইরে। চাকুরিতে তাই এক বছরও টিকতে পারেননি। খুব দ্রুত বোহেমিয়ারই এক ইন্সুরেন্স ইনস্টিটিউটে যোগ দিলেন। এবার কিছুটা বেশি সময় দিলেন কাজে। ১৯১৭ সালের আগে পর্যন্ত তিনি স্থায়ীভাবে কাজ করলেন। এর পরপরই অসুস্থ হয়ে অবসরে যেতে বাধ্য হন একরকম।

ভালোবাসা এবং স্বাস্থ্য

কর্মজীবনে কাফকা ছিলেন মোটামুটি জনপ্রিয়। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন ধাঁধা আর জটিলতায় পরিপূর্ণ। ফলে মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন থেকে বের হতে পারেনি তার প্রেমও। প্রেমিকা ফেলিস বুয়্যারের সাথে পরপর দুইবার বাগদান হলেও বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি সম্পর্ক। বরং বিচ্ছেদে সমাপ্তি ঘটাতে হয় দিন শেষে।

পরবর্তীতে আবার প্রেমে পড়েন ডোরা ডায়াম্যান্টের। কাফকা অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকলেও সেই ভাঙা শরীরেই দুইজন থিতু হন বার্লিনে। দিন যেতে থাকল, কাফকার বাড়তে থাকল অনিদ্রা, হতাশা, উদ্বেগ আর মাইগ্রেইনের সমস্যাগুলো।

◤ ডোরার শত প্রচেষ্টাতেও নিয়তি বদলায়নি কাফকার ◢


কাফকা এবং ডোরা প্রাগে ফিরে আসেন। চিকিৎসার প্রচেষ্টায় ঘুরে আসেন ভিয়েনাতে। তারপরেও শেষরক্ষা হয়নি। ১৯২৪ সালের ৩ জুন অস্ট্রিয়ার কিয়েরলিংয়ে মৃত্যুবরণ করেন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকথক।

উল্লেখযোগ্য রচনাসমগ্র

লেখক হিসাবে কাফকার খ্যাতি এসেছে তার মৃত্যুর পরে। কাফকার জীবন ও দর্শন তার লেখার ছত্রে ছত্রে সাজিয়ে রাখা। ম্যাক্স ব্রড নামের এক পুরাতন বন্ধু তাকে সহযোগিতা করেছে ব্যাপকভাবে। মৃত্যুর আগে এবং পরে—দুই সময়েই।

তার সবথেকে জনপ্রিয় ছোটগল্প ‘দ্য মেটামরফোসিস’। ১৯১২ সালে লেখা এবং ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয়। Mediation নামে একটা গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সাল নাগাদ। আরেকটি বিখ্যাত রূপক ‘দ্য ট্রায়াল’ লিখিত হয় ১৯১৪-১৫ সালের মধ্যে। যদিও তার শরীর ক্রমশ খারাপ হয়ে পড়ছিল। তারপরেও থামালেন না লেখালেখি। ১৯১৬ সালের দিকে শেষ হলো ‘The Judgement’-এর কাজ। এখানে যেন তিনি তার সাথে পিতার সম্পর্ককে কোনো রকম রাখঢাক ছাড়াই তুলে ধরলেন। প্রায় ভেঙে পড়া শরীর নিয়েই ১৯১৯ সালের শেষ দিকে সম্পন্ন করলেন In the Penal Colony এবং A Country Doctor নামের দুইটি অসাধারণ লেখা।

◤ মেটামরফোসিস-এর প্রকাশ ছিল সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা ◢


সময়টা ১৯২৪ সাল। তারপরেও টিকে আছেন কাফকা। লিখে ফেললেন A Hunger Artist. চারটি ছোটগল্পের সমন্বয়ে খুবই সংক্ষিপ্ত ও সমৃদ্ধ লেখা। আরো একটি ছাপ এই লেখায় স্পষ্ট। কাফকার জীবনের শেষ দিককার বৈশিষ্ট্য। শরীরে এক ঘাতক নিয়ে কতদিন নিজেকে ধরে রাখা যায়! জীবনের প্রতি বিরক্ত কাফকা ছেড়ে দিলেন তাই। বন্ধু ব্রডকে অনুরোধ করলেন তার অপ্রকাশিত লেখাগুলো পুড়িয়ে ফেলতে।

ভাগ্যিস ব্রড সেদিন বন্ধুর অনুরোধ অগ্রাহ্য করেছিলেন। অথবা চিনতে পেরেছিলেন তার হাতে আসা লেখাগুলোই ভবিষ্যতে সারা পৃথিবীতে লেখকদের অনুপ্রেরণা যোগাবে। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হলো ‘The Trial’, আর পাঠকেরা যে সম্পূর্ণ নতুন এক স্বাদ খুঁজে পেল। দারুণভাবে সফল হলো উপন্যাসটি। জোসেফ কে নামে জনৈক ভদ্রলোককে নিয়ে গল্প আবর্তিত হয়েছে; যিনি তথাকথিত বিচার ব্যবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উপস্থাপন করছে নগ্ন সত্যকে।

◤ এই বন্ধুত্বের দায় বুঝতে পেরেছিলেন ব্রড, দিয়েছিলেন প্রমাণ ◢


উৎসাহিত হয়েই পরের বছর ব্রড ‘The Castle’ প্রকাশ করেন। আরো একবারের জন্য পাঠক উপস্থিত হলো আমলাতান্ত্রিক আধিপত্য ও নোংরামির নগ্ননৃত্য দেখার মঞ্চে। নায়ক ‘কে’ এবং গ্রামের কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধানকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ঘটনার মূল আখ্যান। ১৯২৭ সালে ‘আমেরিকা’ প্রকাশিত হলে আরেক দফা আলোচনায় আসেন বোদ্ধামহলে। কার্ল রোসম্যান নামের এক ছোট্ট সহজ সরল বালক পিতা-মাতা কর্তৃক আমেরিকা প্রেরিত হলে কিভাবে পদে পদে শোষিত হয়; গল্পের উপজীব্য সেটাই। ১৯৩১ সালে ব্রড কাফকার যে ছোট গল্প প্রকাশ করে ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’ নামে, তা মূলত লেখা হয়েছিল অন্তত ১৪ বছর আগে।

পরবর্তী প্রজন্মে প্রভাব

কাফকার মৃত্যুর সময় তার নাম পরিচিত ছিল কেবল ছোট্ট একটা পাঠক দলের কাছে। সাধারণ পাঠক কিংবা সে যুগের খ্যাতনামা সাহিত্যিকেরা তার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিল না মোটেই। তার মৃত্যুর পর যখন বন্ধু ব্রড এক এক করে লেখাগুলো প্রকাশ করা শুরু করেন; কাফকা যেন নতুন করে জন্ম লাভ করে সেদিন থেকে। তারপর আস্তে আস্তে যত দিন গেছে, তাকে নিয়ে পাঠক মহলেই কেবল জনপ্রিয়তা বাড়েনি, বেড়েছে বাঘা বাঘা পণ্ডিতের আনাগোনা। তার লেখা সেই যুগেই জার্মান সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।

বিশ শতকের ষাটের দশকেও পূর্ব ইউরোপ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর শোষণের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময়ে কাফকা যেন আবার নতুন করে প্রয়োজন হয়ে দেখা দিল পাঠকের কাছে। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নগ্নরূপ নিয়ে লিখিত গল্পের মধ্য দিয়ে সাহিত্যে এলো এক নতুন ধারা—কাফকায়েস্ক।

◤ প্রাগে নির্মিত কাফকার স্মরণে ভাস্কর্য ◢


কাফকার আবেদন উপলব্ধি করতে হলে কেবল একটা গল্প স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৮৮ সালে কাফকার নিজের হাতে লেখা এক পাণ্ডুলিপি নিলামে উঠল। আর কিছু না, The Trial গল্পের পাণ্ডুলিপি। আর তা বিক্রি হয়েছিল ১.৯৮ মিলিয়ন ডলারে। যে কোনো আধুনিক পাণ্ডুলিপির মধ্যে সবথেকে বেশি দামে বিক্রি হওয়া পাণ্ডুলিপি। কিনেছিলেন এক জার্মান। কেনা শেষ হলে তার মতামত ছিল, “এটি বিশ শতকের জার্মান সাহিত্যের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। জার্মানিকেই এটা রাখতে হবে।”

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;