শামসুর রাহমান যেভাবে আমাদের হলেন



ফরিদ কবির
শুভ জন্মদিন শামসুর রাহমান

শুভ জন্মদিন শামসুর রাহমান

  • Font increase
  • Font Decrease

কবি শামসুর রাহমানকে আমার প্রায়ই মনে পড়ে। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, কেন? অনেকে এও বলতে পারেন তাঁর কবিতা তো আমরা পড়ি না। তারা কী পড়েন, কার লেখা পড়েন, কেন পড়েন—এমন প্রশ্ন করার আগ্রহ আমার নাই। আমি যদি ধরেও নিই, তাঁর কবিতা পড়ার প্রয়োজনীয়তা আমাদের ফুরিয়ে গেছে, তাহলেও শামসুর রাহমান আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবেই চিহ্নিত হবেন। একই সঙ্গে একথাও বলতে হবে, শামসুর রাহমানের কবিতা এতটাই প্রভাবসঞ্চারী যে বাংলাদেশের কবিতায় তিনিই একমাত্র কবি যার প্রভাব আমার ধারণা, এখনো একেবারে অপসৃত হয়নি। এখনো অনেক কবিই অজান্তে তাঁর ভাষা ও প্রকরণ অনুসরণ করে চলেছেন। যেমনটা হয়তো শামসুর রাহমানও এক অর্থে ছিলেন জীবনানন্দ দাশের কাব্যভাষারই উত্তরসূরী।

আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হকসহ দু-একজন ব্যতিক্রম বাদে রফিক আজাদ, হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে খোন্দকার আশরাফ হোসেনসহ বাংলাদেশের প্রায় সকল কবির কাব্যভাষায় শামসুর রাহমানের প্রবল উপস্থিতির কথা অস্বীকার করা মুশকিলই। এমনকি এখনো আমাদের অনেক কবি আসলে তাঁর ভাষা ও প্রকরণ সামান্য অদলবদল করে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতে বহন করে চলেছেন তাঁরই উত্তরাধিকার। এমন উদাহরণ আমি অনেক দিতে পারব।

এই যে একজন কবি তাঁর পরবর্তী কবিদের ওপর প্রভাব জারি রাখতে পারলেন দীর্ঘদিন ধরে এটিই তাঁর সাফল্য, এরই মাধ্যমে তিনি আসলে জায়গা করে নিয়েছেন এদেশের কবিতার ইতিহাসে। এখন তাঁকে কে পাঠ করল বা না করল তাতে কিছুই তাঁর যায় আসে না। এবং এটাও সত্যি, তাঁর কবিতা যে এখনকার নবীন কবিরা তেমন পড়েন না তার কারণ তৈরি হয়েছে আশির দশকেই। সে সময়ে একঝাঁক তরুণ কবি বাংলা কবিতার শামসুরীয় ধারাকে উপেক্ষা বা অস্বীকার করে নতুন এক কাব্যধারার উন্মেষ ঘটান। তাঁর কবিতা না পড়ার পেছনে একদিকে যেমন তাঁকে অস্বীকার করার মানসিকতা কাজ করেছে, তেমনি আছে তাঁর কবিতার প্রভাববলয়ে ঢুকে পড়ার ভয়ও। আমার তো মনে হয়, শামসুর রাহমানের কবিতার এমন এক আগ্রাসী শক্তি আছে যা অপেক্ষাকৃত তরুণ কবিদের আকৃষ্ট করতই।

যদি এমনও হয়, শামসুর রাহমান আর কেউ পড়ছে না, তাতেই কি তিনি বিস্মৃত হয়ে যাবেন? আমার তাও মনে হয় না। একটা-দুটো পঙক্তি, বা কোনো বিশেষ উপলক্ষে লেখা তাঁর কোনো কোনো কবিতা এখন জড়িয়ে আছে আমাদের এই দেশের এমন কিছু ঘটনা ও ইতিহাসের সঙ্গে যে তাঁকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করা কঠিনই। হোক তা তাঁর একটি অত্যন্ত দুর্বল কবিতা। এদেশ যতদিন থাকবে তাঁর ‘স্বাধীনতা তুমি’ বা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ প্রজন্মের পর প্রজন্ম উচ্চারিত হবেই। যতক্ষণ না আর কোনো কবিতা নতুন এবং আরো সর্বগ্রাসীরূপে তাকে ছাপিয়ে না যাচ্ছে।

না। শামসুর রাহমানের কবিতা নিয়ে আসলে এই লেখা লিখতে বসিনি। শামসুর রাহমানকে আমার মনে পড়ে অন্য নানাবিধ কারণে। একজন মানুষকে যেমন মানুষ হয়ে উঠতে হয়, একজন কবিকেও তেমনি কবিও হয়ে উঠতে হয়। তার ছাপ তাঁর জীবনাচরণেও পড়তে বাধ্য। তাঁর মধ্যে এমন কিছু আছে যে এখনো ‘কবি’ এই শব্দটি উচ্চারণমাত্র আমার তাঁর মুখটাই মনে পড়ে। চোখের সামনে তাঁর মুখটাই ভেসে উঠতে দেখি।

আমার এক কবিবন্ধু সাখাওয়াৎ টিপু একদিন বলছিলেন, শামসুর রাহমান তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। এমন কথা আমি বহুজনের মুখে শুনেছি। তাঁর কালের কবি-শিল্পীরা যেমন তাঁর কথা বলতেন, তেমনি অনেক সাধারণ মানুষও যারা এক-দুবার তাঁর সান্নিধ্যে গেছেন, তারা তাঁকে ভুলতে পারতেন না। এর অর্থ, কবি হোক বা না হোক, শামসুর রাহমান সবাইকেই একই রকমভাবে কাছে টেনে নিতে পারতেন। মিশতে পারতেন যে কারোর সঙ্গেই। এমনকি, তিনি ছোট-বড় সকলকেই সম্বোধন করতেন ‘আপনি’ বলে। এর জন্য অনেক বড় একটা কলিজার দরকার হয়। কাউকেই আমি অসম্মান করতে দেখিনি তাঁকে।

আমি তো আমার অনেক কবিবন্ধুকে দেখি, লোকজনের সঙ্গে মেশার ব্যাপারে তারা খুবই শুচিবায়গ্রস্ত। সকলের সঙ্গে তারা মিশতে পারেন না। শামসুর রাহমান মিশতেন সকলের সঙ্গেই। কেউ তাঁর দপ্তরে বা বাড়িতে গেলে তাকে আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানাতেন।

অনেক তরুণ কবিকেই তিনি নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। একটা ঘটনার উল্লেখ এখানে না করলেই নয়। ১৯৮৭ কি ৮৮ সাল। আমার ছোট ভাই তখন পড়াশোনা শেষ করে একেবারেই বেকার। আমি একদিন দৈনিক বাংলায় তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি তখন দৈনিক বাংলার সম্পাদক। তাঁকে বললাম, রাহমান ভাই, আমার ছোট ভাইকে একটা চাকরি জোগাড় করে দেন। রাহমান ভাই সাজ্জাদকে চিনতেন। ওর কবিতা খুবই পছন্দ করতেন। তিনি বললেন, আচ্ছা, চেষ্টা করব।

বাংলাদেশ জেনারেল ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে সাজ্জাদের চাকরি হয়ে গেল। পরে জেনেছি, সেখানে তিনি কবি ত্রিদিব দস্তিদারেরও চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সম্প্রতি আমাকে ‘আওয়ার টাইম’ পত্রিকার সাংবাদিক ফাকরুল চৌধুরী জানালেন, আমি বলে দেবার পরই নাকি ওরও চাকরির ব্যবস্থা হয়েছিল ‘মূলধারা’ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকায়। রাহমান ভাই তখন সে কাগজের সম্পাদক।

রাহমান ভাই শুধু কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন আমাদের কাছে অভিভাবকের মতো। যে কোনো বিপদে, সমস্যায় আমরা অনেকেই তাঁর কাছে ছুটে যেতাম, তাঁর পরামর্শ নিতাম। যে কোনো তরুণকে তিনি কিভাবে এতটা প্রশ্রয় দিতে পারতেন, তা ভাবলে এখনো আমার বিস্ময়ই জাগে।

রাহমান ভাই ছিলেন তরুণদের চাইতেও তরুণ। কেমন সেটা?
১৯৮৫ সাল। কলকাতায় আবৃত্তিলোক আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী একটা কবিতা উৎসবের দাওয়াত পেয়েছি আমরা বেশ কয়েকজন। উৎসব কর্তৃপক্ষ কলকাতায় আমাদের থাকা-খাওয়া ছাড়াও বিমানে আমাদের যাতায়াতেরও ব্যবস্থা করবে। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার, আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুনসহ আমরা সড়কপথেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যাতে টাকা বাঁচিয়ে সেটা দিয়ে বইপত্র কিনতে পারি। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ ও রুবী রহমানসহ অন্য কবিরা বিমানে যাবেন, তেমনই ঠিক হলো। এরই মধ্যে শামসুর রাহমান একদিন জানতে চাইলেন, আমরা কিভাবে যাচ্ছি?
আমি বললাম, রাহমান ভাই, আমরা তো বাই রোড যাচ্ছি। বেনাপোল হয়ে।
শুনে তিনি বললেন, কেন, বিমানে যাচ্ছেন না কেন?
আমি মজা করতে বললাম, বিমানে গেলে তো কিছুই দেখা হবে না। হাওয়ায় ভেসে চা খেতে খেতেই দেখব কলকাতা পৌঁছে গেছি! আমরা আসলে অনেক কিছু দেখতে দেখতে যেতে চাই।
রাহমান ভাই বললেন, বাই রোড কে কে যাচ্ছেন?
আমি নামগুলো বলতেই দেখি তাঁর চোখ চকচক করছে! তিনি প্রায় ছেলেমানুষের মতো বললেন, আমিও তবে আপনাদের সঙ্গেই যাব।
আমি বললাম, রাহমান ভাই, এ বয়সে এত লম্বা জার্নি আপনার পোষাবে না। সারা রাত বাসে বসে যাওয়া আপনার জন্য অনেক কষ্টকর হবে। আপনি প্লেনেই যান।
রাহমান ভাই বললেন, বাস জার্নি যদি আপনাদের জন্য কষ্টকর না হয়, তবে আমার জন্যও হবে না।
আমি তাঁকে অনেক বলেও নিরস্ত করতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত তিনি দলছুট হয়ে আমাদের সঙ্গে বাসেই কলকাতা রওনা হলেন।

তখন এত আরামদায়ক বাস যেমন ছিল না, তেমনি ভ্রমণও এত মসৃণ ছিল না। আরিচা গিয়ে আমাদেরকে লঞ্চে উঠতে হতো। তারপর ওপার গিয়ে নতুন একটা বাসে উঠতে হতো।

শামসুর রাহমান সাধারণ মানুষের কাছে কতটা প্রিয় ছিলেন তা আমাদের জানা ছিল না। বাসে-লঞ্চে সর্বত্রই আমাদের আড্ডা বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। নানান শ্রেণির মানুষ এসে তাঁর সঙ্গে আলাপ জমাতে আসছিলেন। অনেকে তাঁর অটোগ্রাফ নিচ্ছিলেন। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন সেলিব্রেটিও।

আরেকটা ঘটনা বলেই, এ লেখা শেষ করব।
শামসুর রাহমানকে কখনোই আমার দরিদ্র মনে হতো না। কিন্তু তিনি আদতে তেমন ধনী ছিলেন না। কিন্তু বিপদে পড়ে কেউ তাঁর কাছে একবার পৌঁছুতে পারলে তাকে ফেরাতেনও না।

১৯৮৬ সাল। আমার তখন প্রচণ্ড আর্থিক অনটন চলছে। আমার বন্ধুদের বেশিরভাগই তখন বেকার। যে দু-চারজন চাকরি করেন, তাদেরও ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। আমার মনে পড়ল, একবার বিপদে পড়ে আমারই কবিবন্ধু তাঁর কাছ থেকে একবার ধার করেছিলেন। আমার কেন জানি মনে হলো, রাহমান ভাই আমাকে ফেরাবেন না। আমি দৈনিক বাংলা অফিসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি তখন সম্পাদক হলেও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আমাদের এপয়েন্টমেন্ট-টেপয়েন্টমেন্ট করতে হতো না। আমরা তাঁর রুম কিছুটা খালি দেখলেই দরোজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়তাম। সেদিনও তেমনভাবেই ঢুকলাম। ভেতরে বেশ কয়েকজন কবি ও সাংবাদিক বসে ছিলেন। আমি চুপ করে একপাশে বসে রইলাম। তারা চলে গেলে রাহমান ভাই আমার দিকে ফিরলেন। স্বভাবসুলভভাবেই হেসে কেমন আছি জানতে চাইলেন।
আমি বললাম, রাহমান ভাই আমি খুব বিপদে পড়েছি। আমাকে কি একটু হেল্প করা যায়?
শুনে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন।
কী বিপদ বলেন তো? জানতে চাইলেন তিনি। তাঁর কণ্ঠ বরাবর আন্তরিক।
বললাম, রাহমান ভাই, আমার কিছু টাকার দরকার।
আমি তাঁর কাছে টাকা চাইতে পারি এটা সম্ভবত তিনি আঁচ করতে পারেননি। তিনি কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়লেন। তবে মুহূর্তেই সেটা সামলে নিয়ে বললেন, কতো?
আমি বললাম, হাজার দুয়েক।
রাহমান ভাই চুপ করে থাকলেন। আমি তখন তাঁর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরেও ঘামতে শুরু করলাম টেনশনে।
রাহমান ভাই কিছুক্ষণ পর মুখ খুললেন—এখনই লাগবে?
আমি মাথা নাড়লাম। মানে, এখনই লাগবে।
তাঁর পকেটে সম্ভবত অতো টাকা ছিল না। তিনি আমাকে বললেন, এত টাকা তো আমার কাছে নেই। ঘণ্টাখানেক কোথাও থেকে ঘুরে আসেন। দেখি কী করা যায়।
আমি উঠে এলাম।
ঘণ্টাখানেক পর তাঁর রুমে আবার গেলাম। তাঁর রুমে অনেক লোকজন। রাহমান ভাই আমার দিকে একটা খাম এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, এটা রাখেন।
রাহমান ভাই সেই টাকা আমার কাছে কখনো ফেরত চাননি। কখনোই না। আর, আমারও সেই টাকা তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়নি।

অল্প বয়সে আমরা ভাবতাম, তিনি হয়তো বেশ পয়সাঅলা! কিন্তু পরে, ধীরে ধীরে জেনেছি, তিনি খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। পরে এও শুনেছি, তাঁর তেমন কোনো সঞ্চয়ও ছিল না! দৈনিক বাংলা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাঁর আয়ের পথ প্রায় ছিলই না। প্রকাশকরা তাঁকে ঠিকমতো টাকা-পয়সা দিত না। ‘অধুনা’ বা ‘মূলধারা’র মতো কিছু সাহিত্য পত্রিকায় তিনি কিছুদিন কাজ করেছিলেন। বাকি সময়টা তিনি প্রায় লিখেই কাটিয়েছেন। জীবনের শেষ সময়টা তাঁর কেটেছে বেশ অর্থকষ্টের মধ্যেই। তবে, তাঁর সৌভাগ্য, অনেক তরুণের হৃদয়ে তিনি নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। অনেকেই তাঁর কাছে যেতেন।

শামসুর রাহমান, সব শ্রেণির, সব বয়সের মানুষকেই গ্রহণ করতেন আন্তরিকভাবে। তাঁর মুখে লেগে থাকত তাঁর চিরপরিচিত মৃদু হাসিটুকুও।
তেমন প্রশ্রয়, তেমন হাসি এ জগতসংসারে আর দেখি না।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;