পিটার বিকসেলের গল্প

আমেরিকা বলে কোনো স্থান নেই



অনুবাদ : মিলু হাসান
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

গল্প বলে এমন একজনের গল্প ছিল আমার কাছে। আমি তাকে বলতে বলতে কান ঝালাফালা করে ফেলছি যে আপনের গল্পে আমার এক ছটাকও ঈমান নাই। আমি বলছি—আপনে মিছা কইতাছেন। আপনের আষাঢ়ের গপ্ আমার লগে কইয়েন না, বানাইয়া বানাইয়া, আমারে বিশ্বাস করানির জন্য। এসব বলার পরেও তার উপরে কোনো প্রভাব পড়ল না। তার কোনো ভাবান্তর হলো না, সে গল্প বলেই যাচ্ছে, তারপর আমি শেষে বললাম—আপনে মিথ্যুক, আপনে আজগুবি গপ্ কওয়া লোক, আপনে মিষ্টি মিষ্টি গপ্ ফাঁদেন একটার পর একটা, আপনে ধাপ্পাবাজ রসিক। সে একরোখা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ, মাথা নেড়ে হুঁ হুঁ করল, একটা মনমরা হাসি দিল আর খুব নরম সুরে এমন কথা বলল যে আমি নিজে বেশ শরমিন্দা বোধ করলাম, শরমে পড়ে গেলাম, সে বলল : আমেরিকা বলে কোনো দ্যাশ নাই।

শুধু তারে বুঝ দেবার জন্য আমি তারে কথা দিছিলাম যে আমি তার গল্পটা লিখব। গল্পটা শুরু হয়েছিল পাঁচশো বছর আগে স্পেনের রাজার রাজদরবারে। তার মধ্যে আছে এক রাজপ্রসাদ, রেশম আর মখলম, সোনা, রুপা, দাড়ি, মুকুট, মোমবাতি, দাসদাসী, আছে তারা যারা সকাল হতে না হতে একে অন্যের ভুঁড়িতে ঢুকিয়ে দেয় তলোয়ার, যারা আগের রাতে পরস্পরের পায়ের কাছে দস্তানা ছুড়ে চ্যালেঞ্জ দেয় যুদ্ধের আর মিনারে পাহরাদার বাজায় শিঙা। আর আছে বার্তাবাহক এরা লাফিয়ে নামে ঘোড়া থেকে আর লাফিয়ে ওঠে জিনপড়ানো ঘোড়ায়, আছে রাজার সাচ্চা দোস্তরা আর ভণ্ড দোস্তরাও, আছে চোখ ধাঁধানো রূপবতী আর ছলচাতুরী আয়ত্ত করা বিপদজনক রমণী, আছে অঢেল সুরা আর রাজপ্রসাদের চারদিকে আছে এমন সব লোকজন যারা এইসব কিছুর জন্য দাম চুকানো ছাড়া ভালো কিছু করার কথা ভাবতেই পারে না। কিন্তু এরকম জীবন যাপন করা ছাড়া রাজা অন্য কোনো জীবন যাপনের কথা ভাবতেই পারে না, যেখানেই যে বেঁচে থাকুক থাকুক, খুব আলিশানভাবে আরাম-আয়েশে কিংবা দীনদরিদ্রে, মাদ্রিদ, বার্সেলোনা অথবা যেখানেই হোক, দিনশেষে সেই একঘেয়ে ডেইলি রুটিন, বিরক্তি চরমে উঠে যায়। যেমন যারা অন্যখানে থাকে তারা ভাবে বার্সেলোনা একটা চমৎকার জায়গা আর যারা বার্সেলোনা থাকে তারা ভাবে অন্য কোনোখানে গেলে বুঝি বাঁচে প্রাণ।

গরিবরা ভাবে রাজার মতো জীবন যাপন করা কতই না মজার আর এ ভেবে দিলে কষ্ট পায় যে রাজা ভাবে গরিবদের গরিব হওয়াই ঠিক আছে।

সকালে রাজা ঘুম থেকে উঠে আর রাত্রে বিছানায় নিদ্রা যায়, আর সারাটা দিন কাটে একঘেয়ে, বিরক্তিকর আর কত যে টেনশন—দাসদাসী নিয়ে টেনশন, সোনা, রুপা, মখমল, রেশম নিয়ে টেনশন আর তার উপরে মোমবাতিগুলোও তার একঘেয়ে লাগে। তার বিছানা পরিপাটি-সাজানো-গোছানো, জমকালো কিন্তু এতে ঘুম দেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করবার কিছু নাই।

দাসদাসীরা সকালে তারে মাথা নুয়ে সম্মান করে—ঠিক ততটুক নোয় পরদিন সকালে, এতে রাজা অভ্যস্ত, এগুলা সে খেয়াল করে না। কেউ তাকে দেয় কাঁটা চামিচ, কেউ তাকে দেয় তলোয়ার, কেউ তার বসার জন্য কেদারা পেতে দেয়, আমজনতা তারে জাঁহাপনা বলে ডাকে আর সাথে জুড়ে দেয় কত কত লকব আর ব্যস, এই তো, এইসব। কেউ তাকে কখনোই বলেনি—আপনি ইডিয়েট, আপনি বোকারাম আর আজকে তার সাথে তারা যে বাতচিৎ করেছে, সেসব পুরানো প্যাঁচাল তারা গতকালও তার সাথে করেছে।

এই হলো গিয়ে অবস্থা।

আর এ জন্য রাজা মশাই রাজদরবারে ভাঁড় পালেন। ভাঁড়েরা যা খুশি করার অনুমতি দেওয়া আছে, যা খুশি তাইই বলতে পারে—রাজামশাইয়ের মুখে হাসি ফুটাবার জন্য, আর যখন তাদের কাণ্ডকীর্তি দেখে রাজা মশাইয়ের হাসি পায় না তখন তিনি তাদের কতল করার হুকুম জারি করেন কিংবা অইরকম কিছুই করার হুকুম দেন।

তো, একবার তার রাজদরবারে এক ভাঁড় ছিল যে কথাবার্তায় প্যাঁচগোছ লাগিয়ে দিত। রাজা মশাই এতে হাসির খোরাক খুঁজে পেতেন। ভাঁড় ‘রাজামশাই’ না বলে বলত ‘পাদমশাই’, ‘প্রসাদ’ না বলে বলত ‘পরসাদ’ আর ‘গুড মর্নিং’ না বলে বলতো ‘মুড গরিং’।

আমার মনে হয় ব্যাপারটা বোকাসোকা কিন্তু রাজা মশাই ভাবতেন ফানি। বছরের অর্ধেকটা সময়, ৭ জুলাই অব্দি, তিনি ভাবতেন ব্যাপারটা ফানি আর যখন ৮ তারিখ উনার ঘুম ভাঙল আর ভাঁড় বলল—‘মুড গরিং’, ‘পাদমশাই’—তখন রাজা মশাই বললেন—ওর থেকে আমারে রেহাই দাও।

আরেকজন ভাঁড় খাটো, মোটাসোটা যাকে সবাই পেপে বলে ডাকত, সে রাজামশাইকে মাত্র চারদিন খুশি রাখতে পেরেছিল। সে রাজদরবারের নারী, পুরুষ, রাজপুত্র, উজির-নাজির, সেনাপতির চেয়ারে মধু মেখে রাজার মুখে হাসি ফুটিয়েছিল। চতুর্থদিনে সে যখন রাজামশাইয়ের সিংহাসনে মধু মাখল, রাজামশাইয়ের হাসি পেল না আর পেপে ভাঁড় রইল না। তারপর রাজা মশাই দিন-দুনিয়ার সবচে ভয়ংকর ভাঁড়টিকে খরিদ করে আনলো৷ সে দেখতে কুৎসিত, একইসাথে হাড্ডিসার আবার নাদুস-নুদুস, লম্বা-রোগা আবার বেঁটে-মোটা। কেউ জানত না সে কথা বলতে পারে কিনা নাকি ইচ্ছা করেই চুপ করে থাকে কিংবা সে বোবা কিনা। তার চোখের নজরের ভাব ছিল বিদ্বেষপরায়ণ, তার মুখ ছিল দেখতে বদমেজাজি, তার একমাত্র মধুর দিক ছিল তার নাম : তাকে জনি বলে ডাকা হতো।

কিন্তু তার সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার ছিল তার হাসবার ভঙ্গি৷ হাসিটা শুরু হতো ছোট আকারে, তার পেটের মাঝখান থেকে স্বচ্ছন্দে ধীরে ধীরে, ফুলে ফেঁপে উঠে, আস্তে আস্তে তা ঢেঁকুরে পরিণতি লাভ করে জনির দম আটকে চোখ-মুখ লাল হয়ে বিস্ফোরণের মতন ফেটে পড়ত, এক ভয়ংকর গর্জনের মতন চেঁচিয়ে একাকার হয়ে যেত; তারপর সে জোরে জোরে শব্দ করে মাটিতে পা ঠুকত, নাচত আর হাসতেই থাকত হো-হো করে আর এতে রাজা মশাই বেশ মজা পেতেন আর অন্যদের মুখ বেজার হয়ে যেত আর ভয়ে কলিজা চুপসে যেত। আর রাজপ্রাসাদের সব জায়গায় যখন এ হাসির আওয়াজের শব্দ পেত লোকেরা তখন দরজা-জানলা বন্ধ করে দিত, শাটার নামিয়ে নিত, বাচ্চাদের বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দিত আর কর্ণে গুঁজে দিত তুলা।

জনির হাসবার ভঙ্গি ছিলো দিন-দুনিয়ার সবচে ভয়ংকর ব্যাপার।

আর রাজা মশাই যাই বলতেন জনি হাসতোই। একদিন রাজা মশাই বললেন : জনি আমি তোরে ফাঁসিতে ঝুলাব। আর জনি তা শুনে হাসতেই থাকল হি-হি-হা-হা-হি-হি-হো-হো করে হাসতেই থাকল, এরকম হাসি সে আগে কখনোই হাসেনি।

তারপর রাজা মশাই সিদ্ধান্ত নিল আগামীকাল জনিকে ফাঁসিতে ঝুলাবে। রাজা ফাঁসিকাষ্ঠ বানালেন, তিনি তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ছিলেন সিরিয়াস, ফাঁসিকাষ্ঠের সামনে কেমন করে হাসে জনি তা দেখবার খায়েশ জেগেছিল উনার মনে।

তিনি হুকুম জারি করলেন আমজনতাকে এ ন্যক্কারজনক মজমা দেখতে আসার জন্য। কিন্তু লোকেরা সব লুকিয়ে পড়ল, দরজার খিল লাগিয়ে দিল আর সকালে রাজা মশাই দেখলেন তিনি আর জল্লাদ, জল্লাদের হেল্পার আর হাস্যরত জনি।

আর রাজা তার দাসদাসীকে চিল্লাইয়া বললেন—লোকজনরে ধরে আন্। দাসদাসীরা পুরো শহর খুঁজে কাউকে পাইল না, রাজা রাগে কিরমির করতেছিল আর জনি হাসছিল। অবশেষে দাসদাসীরা খুঁজে আনলো একটা বালককে, তারা টেনে হিঁচড়ে তাকে রাজার সামনে আনলো। বালকটি ছিল দেখতে ছোট্ট, গোমড়ামুখ আর লাজুক। রাজা তাকে ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে নির্দেশ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে বললেন। বালকটি ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে তাকাল, হাসল আর হাততালি দিতে থাকল আর বিস্ময় নিয়ে বলল—আপনে নিশ্চয়ই খুব ভালা রাজা, পায়রা বসনের জন্য দাঁড় বানাইছেন, দ্যাখেন, দ্যাখেন, অলরেডি দুইটা আইসা বইছে।
রাজা বলল—তুই একটা ইডিয়েট। তোর নাম কী?
: আমি ইডিয়েট, রাজামশাই, আমার নাম কোলম্বো, আমারে মায় কোলুম্বিনে কইয়া ডাকে।
রাজা বলল—তুই ইডিয়েট। এখানে একজনকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে।
কোলুম্বিনে জিজ্ঞাসা করল—উনার নাম কী? যখন সে তার নাম শুনল, সে বলল—কী সুন্দর একটা নাম, তাহলে তার নাম জনি। এত সুন্দর একটা নাম যার তারে কেউ ফাঁসিতে ঝুলাইতে পারে?
রাজা বললেন—কারণ ওর হাসি ভয়ংকর, বেজায় বিচ্ছিরি। রাজা জনিকে হাসতে বললেন আর জনি আগের চেয়ে দ্বিগুণ ভয়ংকর, বেজায় বিচ্ছিরি করে হেসে উঠল। কোলুম্বিনে তাজ্জব হয়ে গেল আর উনাকে জিজ্ঞেস করল—জনাব, রাজা মশাই, আপনার কাছে উনার হাসি হাছা- হাছাই ভয়ংকর লাগতাছে ? রাজা অবাক হলেন, কোনো উত্তর উনার মাথায় এলো না আর কোলুম্বিনে বলতে থাকল—ওর হাসির ভঙ্গিটা আমার পছন্দ লাগতাছে না, কিন্তু দ্যাখেন, দ্যাখেন, পায়রাগুলি এহনো ফাঁসিকাষ্ঠে বইসা আছে। ওর হাসি শুইন্না ডরায় নাই। তাদের কাছে উনার হাসি ভয়ংকর লাগেনি। পায়রাদের কান খুবই স্পর্শকাতর। জনিকে আপনার ছাইড়া দিতে হবে। রাজা ব্যাপারটা ভেবে-চিন্তে বললেন—যা, জনি, তোরে ছেড়ে দিলাম। আর জনি পহেলাবারের মতো একটা কথা উচ্চারণ করল কোলুম্বিনের উদ্দেশ্যে—শুকরিয়া। তারপর ভালো মানুষের মতো একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল। রাজার আর কোনো ভাঁড় রইল না।
রাজামশাই কোলুম্বিনেকে বলল—আমার লগে চল্।
রাজ-দাসদাসী, রাজদরবারের সবাই ভাবল যে, কোলুম্বিনে রাজদরবারের নতুন ভাঁড়।

কিন্তু কোলুম্বিনে এতে মোটেও খুশি হলো না। সে দাঁড়িয়ে রইল, তাজ্জব। কালেভাদ্রে একটা কথা বলবে কি বলবে না, হো হো করে হাসেও না, শুধু একটা মুচকি হাসল আর কেউ এতে হাসল না। লোকজন বলল—সে তো ভাঁড় না, সে ইডিয়েট। কোলুম্বিনে বলল—আমি ভাঁড় নই, আমি ইডিয়েটই।

তখন লোকজন তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করল। রাজা যদি জানতেন কোলুম্বিনেকে নিয়ে লোকে হাসি-তামাশা করছে, তাহলে তিনি রাগান্বিত হয়ে পড়তেন, কিন্তু কোলুম্বিনে রাজার কাছে তা বলল না। কারণ তাকে নিয়ে কেউ হাসি-তামাশা করলে সে কিচ্ছুই মনে করে না। রাজদরবারে আছে পালোয়ান, চালাক-চতুর লোক, রাজা তো রাজাই, রুপসী আওরাত, সাহসী পুরুষ, অনুগত ধর্মযাজক আর রান্নাঘরের দাসীরা বেশ পরিশ্রমী—কেবল কোলুম্বিনে, এই কোলুম্বিনে কিচ্ছুই না। যখন কেউ একজন বলে—আয়, কোলুম্বিনে আমার লগে কুস্তি লাগ্, কোলুম্বিনে উত্তর দেয়—আমার শইলে আপনের মতন জোর নাই। যখন কেউ বলে—সাত গুণ দুই কত রে? কোলুম্বিনে উত্তর দিত—আমি আপনের চেয়ে বেশি মুর্খচোদা। যখন কেউ একজন বলে—তোমার কি ঝরনা থেকে লাফ দেওয়ার সাহস আছে ? কোলুম্বিনে জবাব দিত—আমি ভীতুর ডিম। আমার সেরম সাহস নাই।

যখন রাজা তাকে জিজ্ঞেস করল—কোলুম্বিনে তুমি কী হতে চাও? কোলুম্বিনে জবাবে বলল—আমি কিচ্ছুই হইবার চাই না। আমি তো অলরেডি একটা কিচ্ছু হয়েই আছি৷ আমি কোলুম্বিনে। রাজা মশাই বললেন—কিন্তু তোমাকে তো একটা কিছু হতেই হবে। কোলুম্বিনে বলল—একটা মানুষ কী কী হইবার পারে?
তারপর রাজা মশাই বললেন—ওই যে, দাড়িওলা লোকটি দেখতাছো, তামাটে রঙের, শুকনো ও কুঁচকানো মুখশ্রী, সে হলো নাবিক। সে নাবিকই হতে চেয়েছে আর তাই-ই হয়েছে। সে পাল খাটানো জাহাজে করে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায় আর রাজা মশাইয়ের জন্য নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার করে। কোলুম্বিনে বলল—রাজা মশাই যদি চান, তাহলে আমিও নাবিক হব। এ কথা শুনে রাজদরবারে হাসির রোল পড়ে গেল। কোলুম্বিনে রাজদরবার থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল আর উচুস্বরে কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে বলল—আমি একটা দ্যাশ আবিষ্কার করমু, আমি একটা দেশ আবিষ্কার করমু। লোকজন পরস্পরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল আর মাথা ঝাঁকাল আর কোলুম্বিনে রাজপ্রাসাদ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। শহরের ওপর দিয়ে, মাঠের ওপর দিয়ে আর মাঠে যেসব কৃষকেরা ছিল তারা তাকে দ্রুত ছুটতে দেখছিল, সে তাদেরকে ডেকে বলল—আমি একটা দ্যাশ আবিষ্কার করমু, আমি একটা দ্যাশ আবিষ্কার করমু। আর সে দৌড়াতে দৌড়াতে এক অরণ্যে এসে পৌঁছল। আর সপ্তাহে পর সপ্তাহ অরণ্যের ঝোঁপঝাড়ে লুকিয়ে রইল এবং ওই সপ্তাহগুলিতে কেউ কোলুম্বিনের কোনো খোঁজ পেল না৷ রাজা মশাই বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়লেন, নিজকে নিজে ধিক্কার দিতে থাকলেন আর রাজদরবারের লোকেরা যারা কোলুম্বিনেকে নিয়ে হাসি-তামাশা করেছিল তারা শরমিন্দায় ভুগতে থাকল। আর সেজন্য মিনারের পাহারাদার যখন শিঙায় ফুঁ দিল তখন কোলুম্বিনেকে মাঠ পেরিয়ে, শহর পেরিয়ে, রাজফটক পার হয়ে রাজা মশাইয়ের কাছে আসতে দেখল সবাই বেশি আনন্দিত হলো আর কোলুম্বিনে রাজা মশাইকে বলল—জাঁহাপনা, কোলুম্বিনে, একটা দ্যাশ আবিষ্কার করছে। রাজদরবারের কেউ কোলুম্বিনেকে নিয়ে যেহেতু হাসি-তামাশা করতে চাচ্ছিল না, তাই তারা গম্ভীর মুখের ভান করে সওয়াল করল—নাম কী দ্যাশের? কোনহানে এইটা? কোলুম্বিনে জবাব দিল—এইটার এহনো নাম হয় নাই, এই তো মাত্র দ্যাশটার সন্ধান পাইলাম, এইটা মেলা দূর, সমুদ্রের ভিত্তে। এরপর দাড়িওলা নাবিক জোশ নিয়ে উঠে দাঁড়াল আর বলল—ঠিক আছে, কোলুম্বিনে। আমি, আমেরিকাগো ভিসপুচ্চি। আমি দ্যাশটা খুঁজতে যামু, তুমি খালি কও কেমনে যাইতে হবে।
কোলুম্বিনে জবাব দিল—পাল খাটানো জাহাজ লইয়া সমুদ্রে বেরিয়ে পড়বেন, তারপরে সোজা সামনে যাইতেই থাকবেন, যাইতেই থাকবেন, যদ্দিন না দ্যাশটার দেখা না পান, হাল ছাইড়া ফিরা আইলে কিন্তু হবে না। কোলুম্বিনে ডর পেয়ে গেল, কারণ সে ছিল মিথ্যুক, সে জানত যে ওরকম কোনো দেশ নাই। সেই টেনশনে কোলুম্বিনের রাতের আরামের ঘুম হারাম হলো। কিন্তু আমেরিকাগো ভেসপুচ্চি দেশটার খোঁজে বেড়িয়ে পড়ল। কেউ জানত না সে পাল খাটানো জাহাজ নিয়ে কোথায় গেছে।

হয়তো সে অরণ্যে লুকিয়ে ছিল। আর যখন শিঙায় ফুঁ দেওয়া হলো আমেরিকাগো ফিরে আসল।

কোলুম্বিনের মুখ লজ্জায় লালে লাল হয়ে গেল আর এত নামজাদা-এত বড় নাবিকের দিকে তাকাবার সাহস পর্যন্ত সে পাচ্ছিল না। ভেসপুচ্চি রাজা মশাইয়ের সামনে দাঁড়াল, কোলুম্বিনের দিকে চেয়ে চোখ টিপ্পি দিয়ে গভীর নিঃশ্বাস নিল, কোলুম্বিনের দিকে চেয়ে আবার চোখ টিপল, শোনা যায় এরকম জোরে স্পষ্টভাবে বলল—রাজামশাই, সে বলল—রাজা মশাই, এরকম একটা দ্যাশ আছে। ভেসপুচ্চি আমেরিকাগো গোমর ফাঁস না করার কারণে কোলুম্বিনে এতই খুশি হলো যে দৌড়িয়ে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল আর বলল—আমেরিকাগো, আমার জান আমেরিকাগো। আর লোকে ধরে নিল এটাই বুঝি দেশটার নাম আর তারা যে দেশটা নাই তার নাম দিল—আমেরিকা।

রাজামশাই বলল—এখন তুই বড় মানুষ হইছস্ আর এখন থেকে তোর নাম—কলম্বাস। কলম্বাস নামজাদা হয়ে গেল, সবাই তার দিকে হা করে চেয়ে থাকত আর পরস্পর ফিশফিশ্ করে বলত—বুঝলা, হে-ই আমেরিকা আবিষ্কার করছে। প্রত্যেকে আমেরিকা বলে যে একটা দেশ আছে এটা বিশ্বাস করল, শুধু কলম্বাস এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না, সারাটা জীবন তার সন্দেহে কাটল আর তার সাহসে কুলালো না নাবিককে জিজ্ঞাসা করতে যে সত্যিটা কী তা যেন তাকে বলে।

তারপর অন্যান্য লোকেরা পাল খাটিয়ে আমেরিকার উদ্দেশ্য রওনা করল, ফিরেও আসলো অনেকে আর তারা ফিরে এসে বলল যে—আমেরিকা বইলা একটা দ্যাশ আছে।
যে লোকটা আমাকে গল্পটা বলেছিল সে বলল—আমার কথাই যদি ধরো, এই আমি কখনো আমেরিকা যাইনি।
জানিও না এ আমেরিকা নামে কোনো দেশ আছে কিনা। সম্ভবত লোকজন ভান করে যে এরকম দেশ আছে যাতে করে কলম্বাসের দিলে কষ্ট না লাগে। যখন দুজন লোক আমেরিকার ব্যাপারে কথা বলে তারা খুব কম ‘আমেরিকা’ বলে, সচরাচর তারা ধোঁয়াশা করে বলে—একটা দেশ বা ওই দেশ অথবা ওইরকম একটা কিছু—আকার ইঙ্গিতে কথা বলে।

সম্ভবত যারা আমেরিকা যেতে চায় তাদের প্লেনে অথবা জাহাজে কোলুম্বিনের গল্পটা শোনানো হয়, পরে তারা কোথাও লুকিয়ে থাকে এবং ফিরে এসে বলে—কাউবয়, স্কাইস্ক্র্যাপার, নয়াগ্রা জলপ্রপাত, মিশিসিপি, নিউ ইয়র্ক, সান ফ্রান্সসিককো সম্পর্কে খোশগল্প ফাঁদে আর বলে।

যাই হোক তারা সকলে একই গল্প বলে, এমন গল্প বলে যা তারা আমেরিকা যাওয়ার আগেই জানত, এটা তুমি মঞ্জুর করে নিবে যে এটা একটা সন্দেহ জাগানো ব্যাপার। কিন্তু লোকজন এখনো তর্কাতর্কি করে এ নিয়ে যে কলম্বাস আসলে কে ছিল।
আমি জানি সে আসলে কে ছিল।

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;