ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের স্মৃতি ১

জয়দেবপুরের গণ বিক্ষোভ



সার্জেন্ট (অব.) সৈয়দ জহিরুল হক
গ্রাফিক : বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

গ্রাফিক : বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

পাকিস্তান আমলে, ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে সাধারণ সৈনিক পদে ভর্তি হই। ছয় মাস ট্রেনিং শেষে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে ব্যাটালিয়ানে জয়দেবপুরে বদলি। সেখানে আমাকে আলফা কোম্পানির ১নং প্লাটুনে পাঠানো হয়। তখন আমার ব্যাটেলিয়ান কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল (বাঙালি) মাসুদুল হাসান খান। এবং আমার কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন (পাকিস্তানি) মেজর কাজিম কামাল খান। কোম্পানি অফিসার ছিলেন (ক্যাপ্টেন) জেনারেল এ এস এম নাসিম। তিনি ব্যাটেলিয়ান অ্যাডজুটেন্ট পদেও নিয়োজিত ছিলেন। আরেকজন অফিসার ছিলেন জেনারেল (সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট) (বাঙালি) গোলাম হেলাল মুরশেদ খান। তখন ব্যাটেলিয়ান উপঅধিনায়ক ছিলেন (মেজর) জেনারেল জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে তিনি চট্রগ্রাম বদলি হয়ে গেলে (মেজর) জেনারেল কে. এম. শফিউল্লাহ উপঅধিনায়ক পদের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। যুদ্ধকালীন তিনি ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। আমি এ সেক্টরের অধীনেই যুদ্ধ করি।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকা গড়ে উঠে ১৯৭০ এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। সেই নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাক ভোটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচিত হন। কিন্তু পাক সামরিক সরকার তার নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতির মনোভাব প্রকাশ করে। তারা চেয়েছিল ভুট্টোকে ক্ষমতায় বসাতে। এ নিয়ে তখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ জেগে উঠে। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর গোটাদেশের আপামর জনগণ বিদ্রাহী হয়ে ওঠে। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাথে বাঙালি সৈনিকদের ছিল সুসম্পর্ক। কেননা আমরা সবাই বাঙালি।

পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর বিশেষ দৃষ্টি রাখা শুরু করে। ১৯ মার্চ ১৯৭১ দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার লক্ষ্যে পাক সামরিক জান্তা সুপরিকল্পিত নীল নকশা তৈরি করে। ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবের সাথে প্রায় ৬০/৭০ জন পাকিস্তানি সেনা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে জয়দেবপুরে আসে। সেকেন্ড বেঙ্গল কী অবস্থায় আছে তা পরিদর্শনের জন্য। কিন্তু তাদের বাস্তব লক্ষ্য ছিল সেকেন্ড বেঙ্গলকে নিরস্ত্র করা। জয়দেবপুরের জনগণ এ সংবাদ জানতে পেরে গণমিছিলের ডাক দেয়। অল্প সমেয়র ভিতর জয়দেবপুর রেল ক্রসিং থেকে শুরু করে চৌরাস্তা পর্যন্ত হাজার হাজার লোক সমবেত হলো। ঐ দিন আবার আমাদের কোম্পানির রেশন আনার জন্য আমরা ৪/৫ জন সৈনিক একটি গাড়িতে করে টাঙ্গাইল থেকে জয়দেবপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। আমি নিজেও সেই গাড়িতে ছিলাম। চৌরাস্তার মোড়ে পৌঁছলে জনগণ আমাদের বিস্তারিত ঘটনা জানাল। বলল, আপনারা জয়দেবপুর পৌঁছতে পরবেন না। আপনারা টাঙ্গাইল ফিরে যান। আপনাদের রেশন এবং ফ্রেশের ব্যবস্থা আওয়ামী লীগের নেতারা করে দেবে। পরিস্থিতি উপলব্ধি করার জন্য একজন বাদে আমরা বাকি সেনারা শার্ট লুঙ্গি পরে জনগণের সাথে মিশে যাই। সেদিন চৌরাস্তা থেকে জয়দেবপুর বাজার পর্যন্ত ছিল জনতার ঢল। যাতে দ্বিতীয় বেঙ্গল থেকে পাকিস্তানিরা অস্ত্র নিয়ে যেতে না পারে। তারা জয়দেবপুর স্টেশন থেকে দুটি রেলে বগি এনে রাজবাড়ি রেল ক্রসিংয়ের ওপর রেখে দিল। যাতে কোনো পাক সেনা দল জয়দেবপুর থেকে ঢাকায় যেতে না পারে বা ঢাকা থেকে জয়দেপুর প্রবেশ করতে না পারে। অপর দিকে দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকরা পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল। তারাও কিছুটা উগ্র ভাবে ছিল। ব্রিগেড কমান্ডার এসে যখন দেখল পরিস্থিতি ভয়াবহ খারাপের দিকে তখন তারা অস্ত্র নেওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিল।

গণ বিক্ষোভ দেখে ব্রিগেড কমান্ডার প্রথম গাড়িতে দ্বিতীয় বেঙ্গলের বাঙালি সেনাদের এবং পেছনে দ্বিতীয় গাড়িতে পাক সৈনিকদের নিয়ে জয়দেবপুর থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ফেরত যাবার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রেল ক্রসিংয়ে এসে বাঁধার সম্মুখীন হয়। বিদ্রোহী জনগণ পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু যখন দেখল দ্বিতীয় বেঙ্গলের বাঙালি সৈনিকগণ প্রথম গাড়িতে আছে তখন তারা এক কঠিন পরীক্ষায় পড়ে যায়। এদিকে ব্রিগেড কমান্ডার দ্বিতীয় বেঙ্গল অধিনায়ককে আদেশ করল ফায়ার করার জন্য। কিন্তু আমাদের লোকেরা তখন সাইডে কচুরি পানাতে এবং গাছের আগায় ফায়ার করে। এ দেখে ব্রিগেড কমান্ডার গর্জে উঠে বললেন, “তোমার লোকেরা কী গুলি করছে? এখন পর্যন্ত ১০/১২টা লাশ ফেলতে পারল না! হাজার হাজার জনতার সামনে গুলি করলে লাশ পড়ে না এ কেমন কথা? ওদেরকে বলো, সরাসরি মানুষের উপর গুলি করতে।” কিন্তু আমাদের বাঙালি অফিসার ব্রিগেড কমান্ডারকে বুঝিয়ে দিল নিরস্ত্র মানুষের ওপর আমরা গুলি করতে পারি না। অপর দিকে জনতার ভিড়ের মধ্য থেকে দেশি অস্ত্র ও দুটি চাইনিজ রাইফেল দ্বারা পাকিস্তানিদের লক্ষ্য করে গুলি করে। এ দেখে ব্রিগেডিয়ার আরো রাগান্বিত হয়ে যায়। তখন পাকিস্তানিরা জনগণের ওপর গোলা বর্ষণ করে। এভাবে জনতার ভিড় কমতে থাকে। পরে রেল ক্রসিং থেকে রেলগাড়ির বগিও সরিয়ে ফেলা হয়। ব্রিগেড কমান্ডারও বুঝতে পারে বাঙালি জনতার পাশাপাশি বাঙালি সৈনিকরাও পাকিস্তানিদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে। তখন দ্বিতীয় বেঙ্গল কমান্ডার লে. কর্ণেল মাসুদুল হাসান খানকে আদেশ দিয়ে বললেন, যে কোনো উপয়ে হোক আমাদের ঢাকা ক্যান্টেনমেন্টে পৌঁছার ব্যাবস্থা করে দাও। যাবার সময় ব্রিগেড কমান্ডার লে. কর্নেল মাসুদুল হাসানকে ঢাকায় চলে আসতে হুকুম দিয়ে যান। ২১ মার্চ লে. কর্নেল মাসুদুল হাসান ঢাকায় চলে যান। তার স্থলে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট থেকে (বাঙালি) লে. কর্নেল রাকিবকে সেকেন্ড বেঙ্গলের অধিনায়কের দায়িত্বে পাঠায়।

এর পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাগণ সেকেন্ড বেঙ্গলকে সর্বদিক দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করত। যেভাবে এদেশের সাধারণ মানুষের মনে আন্দোলনে সাড়া দিয়ে ছিল ঠিক সেভাবেই আমরা যারা বাঙালি সৈনিক ছিলাম তাদের মনেও আন্দোলন সাড়া দিয়ে ছিল। পার্থক্য ছিল আন্দলনের প্রারম্ভিক পর্বে ও প্রস্ততি পর্বে আমরা প্রকাশ্যে আন্দেলনের মাঠে নামি নাই। আমরা সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। ১৯৭১ সালে মার্চের প্রথম থেকেই আমরা সিগন্যাল প্লাটুনের গোপন কোড নম্বরের মাধ্যমে আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতাম ও সংবাদ আদান প্রদান করতাম।

১৯৭১ সালে আই এস ডিউটির জন্য আমাদের আলফা কোম্পানিকে টাঙ্গাইলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন আমার কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন মেজর কাজিম কামাল খান এবং (ক্যাপ্টেন) জেনারেল এ এস এম নাসিম সাহেব তখন আমার কোম্পানির অফিসার এবং ব্যাটালিয়ান অ্যাডজুন্টেন্ট পদে নিযুক্ত ছিলেন। টাঙ্গাইলে আসার পর যখন গোটা দেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আন্দোলন শুরু করে তখন সম্ভবত ২০ মার্চ আমরা (ক্যাপ্টেন) জেনারেল নাসিম সাহেবের সাথে পরামর্শ করলাম। “দেশের এ পরিস্থিতি আমাদের করণীয় কী?” নাসিম সাহেব আমাদের বললেন, “তোমরা একটু ধৈর্য ধরো। আমরা যারা বাঙালি অফিসাররা আছি সকলের সম্মতিতে একত্রে একসাথে পাক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে।” ২৫ মার্চ রাতে আমাদের সেই সুযোগ এসে যায়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভিতর যতগুলো বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল সবগুলোই একত্রে বিদ্রোহ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। (ক্যাপ্টেন) জেনারেল নাসিম সাহেব আমাদেরকে অস্ত্রাগার থেকে নিজ নিজ গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে বললেন। আমি অস্ত্রাগার থেকে চায়না ৭.৬২ এম এম এল এম জি এবং ১২ বাক্স এল এম জির গুলি নিয়ে নিই। মহান মুক্তিযুদ্ধে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এল এমজির মাধ্যমেই আমি যুদ্ধ করেছি। আমাদের সঙ্গে যে সকল পাঞ্জাবি, পাঠান ও বিহারী সৈনিক ছিল তাদের কাছ থেকে আগেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা নিয়ে নেওয়া হয়। ঐ রাত্রেই আনুমানিক ১২টার দিকে মেজর কাজিম কামাল খানসহ যতগুলো পাঞ্জাবি, পাঠান ও বিহারী অফিসার ও সৈনিক ছিল—তাদের সবাইকে হত্যা করা হলো।

ক্যাপ্টেন নাসিম সাহেব আমাদেরকে গাড়িতে উঠতে বললেন। অতিদ্রুত আমাদের কোম্পানির যাবতীয় সামানা ও রেশনসহ গাড়ি লোড করা হলো। সম্ভবত রাত ২টার দিকে আমরা ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কেননা, তখন আমরা শুনেছিলাম, ময়মনসিংহ বিডিয়ার ক্যাম্পে বাঙালি ও পাকিস্তানিদের মধ্যে গোলাগুলি চলছে। বাঙালি বিডিয়ারদের সাহয্যার্থে আমরা ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। সকালে আমরা মুক্তাগাছা জমিদার বাড়িতে কিছুক্ষণের জন্য নাস্তার করার উদ্দেশ্যে বিশ্রাম নিই। ঐ সময় (ক্যাপ্টেন) জেনারেল নাসিম সাহেব আমাকে বললেন, “তোমার বাড়ি নাকি এখান থেকে খুব কাছে, তুমি বাড়িতে গিয়ে তোমার আত্মীয় স্বজনদের সাথে সাক্ষাত করে ময়মনসিংহে এসে আমাদের সাথে যোগ দেবে।” জবাবে আমি বললাম, “স্যার, আমার পক্ষে বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। কেননা, বিশেষ করে আমার নানি আমাকে যুদ্ধের ময়দানে না-ও আসতে দিতে পারে। তাই আমি যেতে চাচ্ছি না।”

নাস্তা পর্ব শেষ হওয়ার পরপরই আমরা খবর পাই বিডিআরদের সাথে পাক বাহিনীর গোলাগুলি বন্ধ হয়েছে এবং সমস্ত বাঙালি বিডিআররা আমাদের সাথে যোগ দিতে চাচ্ছে। আমরা এ সংবাদ শোনার পর পুনরায় ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ময়মনসিংহে পৌঁছে আমাদের কোম্পানিকে ময়মনসিংহ সার্কিট হাইজ ও ডাক বাংলাসহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিতে বলা হয়।

আমার কোম্পানির এস জেসিও ছিল সুবেদার নূরল আজিম চৌধুরি এবং প্লাটুন অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার মনির আহমেদ এবং প্লাটুনসহ অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন নায়েব সুবেদার জনাব আলী। আমরা ময়মনসিংহে দুদিন থাকার পর পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান আমাদের ক্যাম্পের উপর দিয়ে চক্কর দিতে থকে। আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের অবস্থান সম্পর্কে তাদেরকে সংবাদ দেওয়া হয়েছে। আমরা ঐ দিন ট্রেন যোগে ভৈরবের দিকে রওনা হই। ঐ সময় রাস্তার দুপাশ থেকে হাজার হাজার জনতা আমাদেরকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানায়। এবং বিভিন্ন রকম ফলমূল খাদ্য, সিগারেট, ম্যাচ ইত্যাদি আমাদের ট্রেনে দিয়ে যায়। সকলেই আমাদের জয়যুক্ত হওয়ার জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করছিল।

সেখানে পৌঁছে নাসিম সাহেব আমাদেরকে একটি স্কুল বিল্ডিংয়ে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেন। ঐ দিন পাকিস্তান থেকে হঠাৎ করে ক্যাপ্টেন সেলিম সাহেব আমাদের মাঝে উপস্থিত হন। তিনি ইতিপূর্বে আমাদের ব্যাটালিয়ানের অ্যাডজুটেন্ট পদে দায়িত্বে ছিলেন। পরে তাকে পাকিস্তানে বদলি করা হয়। জেনারেল নাসিম সাহেব ও আমরা ক্যাপ্টেন সেলিম সাহেবকে কাছে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলাম। তার কিছুক্ষণ পর দেখা গেল পাকিস্তানি একটি জঙ্গি বিমান ভৈরব শহরের উপর দিয়ে চক্কর চালায়। জঙ্গি বিমানটি চলে যাওয়ার পরপরই আমরা ভৈরব থেকে আশুগঞ্জ চলে যাই। [চলবে…]


ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের স্মৃতি ২ আশুগঞ্জের বিমান হামলা

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;