মার্চ থেকে আগস্ট

১৯৭১: বিদেশি পত্রিকায় মার্চ থেকে ডিসেম্বর (পর্ব ১)



অনুবাদ ও গ্রন্থনা : আন্দালিব রাশদী
গ্রাফিক বার্তা২৪.কম

গ্রাফিক বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৭১-এ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে তথা সত্যের পক্ষে যুদ্ধে নেমেছিলেন সংবাদকর্মী সিডনি শনবার্গ, মাইকেল লরেন্ট, অ্যান্থনি ম্যসকারেনহাস, লেয়ার লেভিন, ড্যান কোগিন, সাইমন ড্রিঙ, নিকোলাস টোমালিন, মার্ক টালি, ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ, মার্টিন ওলাকট, জন পিলজার, ডেভিড লোশাক, পিটার হ্যাজেলহার্স্ট ও আরো অনেকে।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যখন হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠল, তার সাক্ষী হয়ে রইলেন কজন বিদেশি সাংবাদিক। ৩৫ জন বিদেশি গণমাধ্যম প্রতিনিধিকে ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময়ের জন্য আটকে রাখা হয় ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। ২৭ মার্চ বলপ্রয়োগ করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাঁদের বহিষ্কার করা হয়। উড়োজাহাজে তোলার আগে সাংবাদিকদের তল্লাশি করা হয়। তাঁদের নোটবই, ছবির ফিল্ম ও ফাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়। বহিষ্কৃত সাংবাদিকেরা যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান ও রাশিয়ার সংবাদপত্রসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে কর্মরত ছিলেন। বহিষ্কারের কারণ জানতে চাওয়া হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাখ্যা করার কিছু নেই, এটা আমাদের দেশ।

মার্চ থেকে ডিসেম্বর প্রতিমাসের একটি করে নমুনা অনূদিত ও সংকলিত হলো, কোনো পুরোপুরি, কোনোটা আংশিক, ডিসেম্বরে কেবল দুটো।

দ্য বাল্টিমোর সান
মার্চ: গোলাগুলি ও অগ্নিশিখার শহর ঢাকা


জন উডরাফের প্রতিবেদন: স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের অবিরাম গুলিবর্ষণের মাঝে কখনো কখনো কয়েকটা গুলির শব্দ স্পষ্টই জানিয়ে দেয় কেউ যেন সেনাবাহিনীর গুলির জবাব দিচ্ছে। দুদিনের অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের পর ঢাকা শহরকে গোলাগুলি ও অগ্নিশিখার শহরে পরিণত করে স্বাধীনতার দিকে পূর্ব পাকিস্তানের ঝুঁকে পড়াটা হঠাৎ যেন আটকে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট এএম ইয়াহিয়া খান যখন গতরাতে গণতন্ত্রের পথ উত্তরণে তার দু বছরের সতর্ক পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবসানের ঘোষণা দিলেন, সেনাবাহিনী ততক্ষণে গুলি করতে করতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে নিল—সব দিকে রেখে গেল গোলাগুলির দৃশ্যমান চিহ্ন, পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে আটকে ফেলল কারাগারে।

সংবাদকর্মীরা সৈনিকদের ভারি মেশিনগানের সাহায্যে কোনো ধরনের সতর্ক সংকেত না দিয়ে নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালাতে দেখেছেন। মৃত্যু ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি নিশ্চিত করা যায়নি। যখন জানা গেল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে ব্যাপক সুরক্ষিত ঢাকার প্রেসিডেন্টস হাউস ছেড়ে গেছেন তখনই প্রথম বোঝা গেল আলোচনা ভেঙে যাওয়ার চেয়েও বড় কোনো ঘটনা ঘটেছে। দু ঘণ্টা পর যখন প্রেসিডেন্ট হাউসের কঠোর সেনাপ্রহরার অনেকটাই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে, অবশিষ্টদের একজন বেসামরিক গার্ডের কাছে খবর দিতে গেলে তিনি যে জবাব দেন তা হচ্ছে: “কোনো প্রশ্ন করার জন্য (প্রেসিডেন্ট কোথায় আছেন) এটা বড় দুঃসময়।”

রাত এগারটার দিকে সৈন্যরা সাংবাদিকদের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে জড়ো করল, হোটেলের ভেতরে না ঢুকলে গুলি করা হবে এই হুমকি দিয়ে তাদের ভেতরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। নগরীর বিভিন্ন অংশে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। রাত ১২-২০ মিনিটে শেখ মুজিবের বাসায় টেলিফোন করা হলে এক শান্ত স্বরের জবাব শোনা গেল—“শেখ বিছানায়।”

আজ সকালেই করাচি বেতার প্রথমবারের মতো বিশেষ করে শেখ মুজিবের অবস্থান নিয়ে মুখ খুলেছে—পাঁচজন সহযোগীসহ তাকে সেই ফোন কলের এক ঘণ্টা দশ মিনিট পর গ্রেফতার করা হয়েছে। সেই ফোন কলের দশ মিনিট পরই হোটেলের সব ফোন ডেড হয়ে যায়। ততক্ষণে হোটেলের সৈন্যরা পাশেই উড়তে থাকা সবুজ, লাল ও সোনালি রঙের বাংলাদেশের পতাকা ছিঁড়ে ফেলে এবং স্তূপীকৃত পতাকা হোটেলের লনে পুড়িয়ে ফেলে। শুক্রবার দিবাগত রাত একটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে প্রথম কামান আক্রমণের শব্দ শোনা যায়—ছাত্রনেতারা সেখানে সক্রিয়।

২৫ থেকে ৩০ ট্রাক ভর্তি সৈন্য হোটেল ডিঙিয়ে দেড় মাইল দূরে ক্যাম্পাসের দিকে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গোলাগুলির প্রতিধ্বনি আসতে থাকে। রাত দুটোর দিকে একই গন্তব্যে কামানের গোলার শব্দ আসতে থাকে আর আড়াইটার দিকে দুটো বড় ভবন অগ্নিশিখায় ঢাকা পড়ে—সে রাতের প্রথম ভয়াবহ অগ্নিসংযোগ। দশ তলার জানালা দিয়ে দেখে বাঙালি সাংবাদিকরা জানালেন ভবন দুটোর একটি ইকবাল হল ও একটি মহসিন হল—আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় আশ্রয়।

 

এক্সপ্রেসেন
এপ্রিল: বাংলায় গণহত্যা


শেখ মুজিবুর রহমানকে যে বন্দী করা হয়েছে তা প্রমাণ করতে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ একটি আলোকচিত্র অবমুক্ত করেছে। তাঁর বন্দীদশার ছবিটি দেখিয়ে সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনোবল ভেঙে দিতে চায়। প্রশ্ন, ছবিটি আগে ছাড়া হলো না কেন? কোন তারিখের ছবি তা-ই বা উল্লেখ করা হয়নি কেন? তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন দেখাচ্ছে না?

তবে এটা স্পষ্ট, ইয়াহিয়া খানের শাসন যে কোনো মূল্যে তাঁর (শেখ মুজিব) শহীদ হওয়ার সুযোগ প্রতিহত করতে চাইবে। প্রশ্ন হচ্ছে কারাবন্দী শেখ মুজিবকে দেখার যে অনুভূতি পূর্ব পাকিস্তানে জন্মাবে, তা কি পরিস্থিতি পাল্টে দেবে? তাঁকে নিয়ে কিংবা তাঁকে ছাড়া (বন্দীদশায় রেখে) যে অবস্থায়ই হোক না কেন, পূর্ব পাকিস্তানের আর পিছু হটার পথ নেই।

সত্য গোপন করার জন্য সামরিক সরকারের সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমরা এখন জানি পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে। শরণার্থীরা ব্যাপক গোলাবর্ষণ, বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞ এবং গণহত্যার সাক্ষ্য দিয়েছে। শত সহস্র মানুষ তাদের ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে। ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ হানা দিয়েছে। পাকিস্তানের ঐক্য অটুট রাখতেই হবে—এই প্রণোদনার নামে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতি শক্রতার অস্ত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে। দেশের প্রথম সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফল ভণ্ডুল করে দেওয়ার পর জন্য সামরিকজান্তা সহিংস শক্তি প্রয়োগ করে চলেছে। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল হজম করার প্রস্তুতি পাকিস্তানি শাসকদের ছিল না, উলটো সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছে। এটা স্পষ্ট, এই পদ্ধতিতে কখনোই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের পুনর্মিলন ঘটানো সম্ভব হবে না। নির্মমভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠা অথবা যুদ্ধ—এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

 

ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন
মে: একটি সেন্সর করা সংবাদ
ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন-এর ৮ ও ৯ মে, ১৯৭১ সংখ্যায় প্রকাশিত সংবাদের শুরুতে বলা হয়েছে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাওয়া সেন্সর করা সংবাদ


ঢাকা, পূর্ব পাকিস্তান, ৭ মে : পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান আজ বলেছেন, ২৫ মার্চ রাতে সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। তাতে ঢাকায় ১৫০ জন নিহত হয়েছে। একটি সংবর্ধনায় বক্তব্য দিতে গিয়ে টিক্কা খান বলেন, প্রায় ১০ হাজার নিহত হওয়ার হিসাবে বেপরোয়া অতিরঞ্জন রয়েছে। এই সংবাদদাতাসহ যে ছয়জনের সঙ্গে জেনারেল খান দেখা করেছেন তাঁরা হচ্ছেন অ্যাসোসিয়েট প্রেস, রয়টার্স, টাইম, দ্য ফিনানশিয়াল টাইমস্ অব লন্ডন এবং চায়নিজ কমিউনিস্ট প্রেস এজেন্সি জিনহুয়ার সংবাদদাতা।

গাঙ্গেয় বদ্বীপে নদ-নদীর জাল ঢাকা শহর পর্যন্ত বিস্তৃত মনে হলো। যদিও প্রায় সব দোকানপাটই বন্ধ, কিন্তু রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা ভালোই ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, লড়াই যখন শুরু হয়, তখন শহরের অর্ধেক মানুষ গ্রামাঞ্চলে ও বনজঙ্গলের দিকে পালিয়ে গেছে। এমনকি ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল স্বাভাবিকের ২০ ভাগ কর্মচারী দিয়ে চালানো হচ্ছে। কিছুসংখ্যক বাঙালি বাসিন্দা সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন, এখানকার ‘হত্যাযজ্ঞের’ খবর বহির্বিশ্বকে জানানো হয়নি।

পরিচয় যার লৌহমানব
জেনারেল টিক্কা খান একজন কঠোর সেনা কমান্ডার হিসেবে পরিচিত। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে নির্বিচারে গণহত্যার আদেশ তিনিই দিয়েছেন বলে বিরোধীদের অভিযোগ।

টিক্কা খান বলেছেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে ছাত্রহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু আমরা ছাত্র কিংবা কোনো একক দলকে আক্রমণ করিনি। যখন আমাদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে, আমরা পালটা গুলি চালিয়েছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় তো বন্ধ ছিল। সেখানে যারা ছিল তাদের থাকার কোনো কারণ ছিল না। যারা ভেতরে ছিল, তাদের বেরিয়ে আসতে বলেছি, তখন তারা গুলি চালায়। আমাদের তখন পাল্টা গুলি চালাতে হয়েছে।

‘আমি সবসময়ই বিশ্বাস করেছি, তাৎক্ষণিকভাবে শক্ত ব্যবস্থা নিলে পরের ক্ষয়ক্ষতি, যা সাধারণত ঘটে থাকে, এড়ানো সম্ভব হয়—দাবি টিক্কা খানের। সামরিক গভর্নর দাবি করেন, পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ এখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তিনি এখন ঢাকায় সান্ধ্য আইন তুলে নেওয়ার কথা ভাবছেন।

তবে টিক্কা খান স্বীকার করেন, বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভেতরের দিকে আসা গুরুত্বপূর্ণ রেলপথের সেতু ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ায় কিংবা অন্য কোনো বাধার কারণে তা এখনো চালু করা যায়নি। তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের প্রধান কাজ অতীত ভুলে যাওয়া এবং পূর্ব পাকিস্তানের পুনর্গঠন করা। যদি দেশের সব মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে, তাহলে আমরা আশা করি, এক বছরেই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।...পূর্ব পাকিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বহুসংখ্যক আত্মসমর্পণ করেছে কিংবা রাস্তার পাশে অস্ত্র ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে, যদিও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা সমস্যাকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এখানে গেরিলাযুদ্ধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না।

 

দ্য হংকং স্ট্যান্ডার্ড
জুন: আরেক চেঙ্গিস [সম্পাদকীয়]


নির্মমতা ও কসাইবৃত্তির প্রতিশব্দ হিসেবে ৪০০ বছর ধরে চেঙ্গিস খানের নাম উচ্চারিত হয়ে আসছে। বিংশ শতকে তার নামের সঙ্গে মিল রয়েছে এমন একজন পাকিস্তানিকে মনে হচ্ছে, এই বীভৎস পূর্বসূরি খুনিকে হারিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তিনি। তিনি টিক্কা খান। পাকিস্তানিদের কাছে এই জেনারেল শান্তিদাতা, পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহীদের শান্ত করতে এসেছেন। তিনি কমান্ড করছেন ভয়ংকর পাঞ্জাবি ও পাঠান বাহিনীর, যারা মরিয়া হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ রক্তস্রোত বইয়ে দিচ্ছে।

তাদের নির্মম খুন, কাণ্ডজ্ঞানহীন শিশুহত্যা, ধর্ষণ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘পতিতা’ সরবরাহ এবং সর্বাত্মক উন্মত্ততা, খামখেয়ালিপনা ও রক্তলোলুপতার পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে।

চেঙ্গিস খান তার ভয়ংকর নির্মমতায় জীবনে অন্তত একটা সাম্রাজ্য গড়তে পেরেছিলেন। আর টিক্কা খান ও তার উর্দিপরা কসাই সাঙ্গপাঙ্গদের ইতিহাস তাদের মনে রাখবে একটি জাতির বৃহদংশের ধ্বংসকারী হিসেবে।

 

দ্য ওয়াশিংটন স্টার
জুলাই: অস্ত্রবোঝাই পাকিস্তানি জাহাজে মাল তুলতে ডক ইউনিয়নের অস্বীকৃতি


বাল্টিমোর (এসোসিয়েটেড প্রেস) পাকিস্তানি পণ্যবাহী জাহাজ পদ্মাকে ডকে পণ্য ওঠাতে বাধা দিতে আজও বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে। অভিযোগ রয়েছে, এই পাকিস্তানি জাহাজ যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বদেশে অস্ত্র ও অন্যান্য মালামাল নিয়ে যাচ্ছে।

পুলিশ গত রাতে ছয়জন বিক্ষোভকারীকে জাহাজ ডকে আসতে বাধা দেওয়ার কারণে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছে ছিল তিনটি ক্যানু ও একটি কায়াক। একজন কর্মকর্তা জানান, জাহাজের অবাধ চলাচলে বাধা দেওয়ার জন্য তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের নিজেদের নিরাপত্তা বিবেচনা করেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক লং শোরম্যান অ্যাসোসিয়েশন তাদের বাল্টিমোর শাখাকে নির্দেশ দিয়েছে, যেন জাহাজে মাল তোলা না হয়। কারণ প্রতিবাদকারীরা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও এই জাহাজে করে পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো হচ্ছে। পাকিস্তানি জাহাজের যুক্তরাষ্ট্রীয় এজেন্ট জানিয়েছে, এই মালবাহী জাহাজে কোনো সামরিক সরঞ্জাম নেই। ১৩ জন বিক্ষোভকারীর একজন কেবল পাকিস্তানি। শহরের অফিসপাড়ায় জমায়েত হয়েছে—জাহাজযোগে পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর প্রতিবাদ জানাতে। ১৫ জুলাই, ১৯৭১ বাল্টিমোর শহরে ক্যালভার্ট অ্যান্ড রেডউড স্ট্রিটে কেয়সার ভবনের সামনে এই বিক্ষোভ—ইস্ট ওয়েস্ট শিপিং এজেন্সির বিরুদ্ধে হলেও মূলত বিক্ষোভ গোটা আমেরিকান সরকারের বিরুদ্ধে। এই এজেন্সি আসলে হ্যান্ডলিং এজেন্ট। ১৭ জুলাই বিকেলে পাকিস্তানি মালবাহী জাহাজ পদ্মা কভিংটন বন্দর টার্মিনালে আসছে, তারই ব্যবস্থাপনার ভার এই এজেন্সির।

স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, জাহাজে ৯ লাখ ২৪ হার ৩২৯ ডলার মূল্যের জাহাজের যন্ত্রাংশ; এক লাখ ৮৪ হাজার ১৮৭ ডলার মূল্যের সামরিকযান যন্ত্রাংশ; ২৫ হাজার ৪১৭ ডলার মূল্যের ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রাংশ; ৪৫ হাজার ১১৭ ডলার মূল্যের যানবাহন যন্ত্রাংশ এবং দুই হাজার ৮৩০ ডলার মূল্যের গোলন্দাজ যন্ত্রাংশ রয়েছে। নিউইয়র্ক থেকে এতে দুই হাজার ২০০ রাউন্ড ২২ ক্যালিবার গোলাবারুদ বোঝাই করা হয়েছে। এই মালবাহী জাহাজটি মন্ট্রিয়েল থেকে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ স্যাবর জেটের ৪৬ বাক্স খুচরা যন্ত্রাংশ ওঠাবে। তবে কানাডা সরকার এই মাল উত্তোলনে বাধা দিয়েছে। ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল নামের ফিলাডেলফিয়া-ভিত্তিক একটি সংস্থার ৩০ জন সদস্য তাঁদের বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন।

জাহাজ আটকানোর অপরাধে গ্রেফতার অভিযুক্তরা ছাড়া পেয়েছেন। দ্য ইভনিং বুলেটিন ফিলাডেলফিয়া জানিয়েছে, ক্যানু ও ক্যায়াকযোগে পানিতে নেমে জাহাজ আটকানোর চেষ্টা করার অপরাধে গ্রেপ্তারকৃত ছয়জন কারামুক্তি লাভ করেছেন।

দলনেতা চার্লস খান বলেছেন, অস্ত্রবাহী জাহাজটিকে তারা পুনরায় ফিলাডেলফিয়ায় আটকাতে চেষ্টা করবেন। নিউইয়র্ক বন্দর থেকে ছেড়ে আসা এই জাহাজের গন্তব্য পাকিস্তানের করাচি বন্দর—কয়েক সপ্তাহ ধরে এই জাহাজ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। অভিযোগ উঠেছে, এই জাহাজে পাকিস্তানে অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো হচ্ছে, সিনেটে এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। একজন সিনেটর এই মালবাহী জাহাজের মালামাল প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ জানিয়েছেন।

 

লা ন্যাশিয়ন
আগস্ট: জাতিসংঘ মহাসচিবের মতামত


জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট পূর্ব পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সমর্থিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার গোপন বিচার নিয়ে পাকিস্তান সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, নভেম্বরে পূর্ব বাংলায় হারিকেনের ধ্বংসযজ্ঞ এবং পরবর্তী কলেরা মহামারির চেয়ে ভয়াবহ হবে এই বিচারের পরিণতি।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা উ থান্টের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। আওয়ামী লীগের জন্য ৯৮ ভাগ জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে তারা এই মন্তব্য করেন।... ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন কোথায় মুজিবুর রহমানের বিচার হচ্ছে তা প্রকাশ করতেও অস্বীকার করছে। তাদের সরবরাহকৃত তথ্যে বলা হয়েছে ‘পাকিস্তানের কোথাও’ তার বিচার হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাঙালিরা কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেবে তা যেখানে উদ্বেগের বিষয়, যেখানে তারা পশ্চিমাপন্থী, কিন্তু তারা রেড চীনের প্রতিবেশি, মুজিবুর রহমান যেখানে মধ্যস্থতার চেয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে বেশি ঝুঁকে আছেন—তিনি ভোটারের মতামত ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর চাওয়ার তফাতটা ভালো করে জানেন তার গোপন বিচারের পরিণতি ভালো হওয়ার নয়। [চলবে]


পর্ব ২ ● সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পড়তে ক্লিক করুন এখানে

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;