অনুবাদক জাভেদ হুসেনের সাক্ষাৎকার

উর্দুসাহিত্যের আহমেদ ইলিয়াস বাংলাদেশের একজন বড় কবি



মিলু হাসান, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

জাভেদ হুসেন একজন স্বনামধন্য অনুবাদক ও গবেষক। জন্ম ১লা আগস্ট ১৯৭৬। কুমিল্লায়। সোভিয়েত পরবর্তীত সক্রিয় মার্ক্সীয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি। মার্ক্সের লেখা এবং মার্ক্সীয় দর্শন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন। এছাড়াও তিনি একজন গালিব-গবেষক। উর্দু-ফার্সি সাহিত্য বিষয়ে রয়েছে তাঁর বিস্তৃত জানাশোনা। সাদত হাসান মান্টোর কালো সীমানা ছাড়াও মূল উর্দু ও ফার্সি থেকে অনূদিত বেশ কয়েকটি কবিতার বইয়ের অনুবাদ করেছেন তিনি। এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ প্রথমা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর দুটি অনুবাদ গ্রন্থ—মির্জা গালিবের কবিতা, ও আরেকটি আহমেদ ইলিয়াসের কবিতা। বার্তা২৪-এর পক্ষ থেকে অনুবাদক ও গবেষক জাভেদ হুসেনের সাথে আলাপ করতে গিয়েছিলেন কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট মিলু হাসান—তাঁর মোহাম্মদপুরের বাসায়।


বার্তা২৪: এবারের মেলায় আপনার নতুন কী কী বই আসছে?
জাভেদ হুসেন: মেলায় এসে পড়েছে এর মধ্যে প্রথমা থেকে—মির্জা গালিবের গজল। উনার সাড়ে পাঁচশোর মতো, প্রধানত উর্দু গজল থেকে, কিছু ফার্সি থেকে অনুবাদ করা আছে। ফার্সি গজলের সংকলন আসলে এ প্রথম। গোটা ষাটেক শের বা পঙ্ক্তি আছে মির্জা গালিবের ফার্সি গজল থেকে। এটা এসে পড়েছে। আরেকটা আসবে, ওই বইটা নিয়ে আমি একটু কৌতূহল অনুভব করছি। ওটা হচ্ছে বাংলাদেশের একজন উর্দু কবি, নাম আহমেদ ইলিয়াস। উনি বড় একজন কবি। তাঁকে আমি বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব কবিরা যারা জীবিত আছেন—তারা যে ভাষাতেই লিখুন না কেন, সবার মধ্যে অন্যতম কবি বলে মনে করি, যৌক্তিক কারণও আছে। যেটা হচ্ছে আমাদের এখানে বাঙলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষার কবিতা নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয় না। সেই জায়গা থেকে তাঁর পরিচয় বা পরিচিতি নেই আমাদের এখানে। তাঁর ছয়টা কাব্যগ্রন্থ আছে। সবগুলো বাঙলাদেশ থেকে ছেপে বেরিয়েছে—উর্দু কাব্য। লাহোর, করাচি, হায়দ্রাবাদ, লক্ষ্ণৌ থেকে যেসব উর্দু সাহিত্য পত্রিকাগুলি বের হয় ওখানে তাঁর লেখা বেশ সমাদর করে ছাপে। বর্তমানে তাঁর বয়স ৮৬, বয়স্ক মানুষ। তাঁর একটা কাব্যের সংকলন প্রথমা থেকে বেরুচ্ছে—‘আহমেদ ইলিয়াসের কবিতা’। অবশ্য বইয়ের নামটা পরিবর্তনও হতে পারে।

বার্তা২৪: মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙলাদেশি উর্দু কবি আহমেদ ইলিয়াসের কী ভূমিকা ছিল?
জাভেদ হুসেন: মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর ভূমিকা যেটা হতে পারত, উনি যদিও প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে তাকে পালিয়েই বেড়াতে হয়েছে। দুপক্ষ থেকেই আসলে তাদের মুখের ভাষা, তাদের অবস্থান এ জায়গা থেকে একটা সন্দেহের কারণ সৃষ্টি করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের আগের পর্যায়গুলোতে বাঙলাদেশের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার যেসব পর্যায় যেমন ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির পরপরই যেসব কবিতা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে লেখা ও ছাপা হয় এম আর ইলিয়াসের বয়োজ্যোষ্ঠ উর্দু কবি, উনার বন্ধু নওশাদ নূরির।

কবি শামসুর রাহমানের সাথে উর্দু কবি নওশাদ নূরী

যেমন ছয় দফা, তখন তাঁরা মানে উনার বন্ধু আরেক উর্দু কবি নওশাদ নূরীসহ ছয় দফার উর্দু অনুবাদ করে ছাপিয়ে সেটার প্রচার করতেন। মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত এরকম ভূমিকা ছিল তাঁর। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকৃত অর্থেই তাদের কোনোরূপ ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু তারা বরাবরই প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। যেহেতু তারা অন্য কোনো জায়গা থেকে মানুষকে বিচার করতেন না। মানুষ হওয়ার জায়গা থেকে তার অধিকার পাওয়া, অধিকার নিজে রক্ষা করবার যে লড়াই তা করতেন। ফলে বাঙালি জাতি হিসেবে, রাষ্ট্র গড়ে তোলার ক্ষমতা, নিজের অধিকার নিজে গড়ার তোলার যে লড়াই ও সংগ্রামের সঙ্গে তারা বরাবরই ছিলেন, সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। যেহেতু তারা তৎকালীন সময়ে প্রগতিশীল রাজনীতি করতেন, এর ফলে এটা সম্ভব হয়েছে।

বার্তা২৪: কবিতা অনুবাদের জন্য কবি হওয়ার দরকার আছে কিনা বা কবি হলেই সে কবিতার অনুবাদ ভালো করতে পারে এমন কোনো কথা আছে কিনা—আপনি কী মনে করেন?
জাভেদ হুসেন: এটা অবশম্ভাবী না। কবিতা অনুবাদের জন্য কবি হওয়াটা একেবারেই অনিবার্য না। কবির অনেক ছাড় আছে, তার রেফারেন্সের প্রয়োজন নাই এবং কবি হিসেবে ভালো কবিতা লেখার যে দায় সেটা কবি অবশ্যই বহন করেন। একজন অনুবাদকের আসলে এর বাইরেও আরো বহুকিছুর প্রয়োজন আছে। যেহেতু তিনি এক ভাষা থেকে আরেক ভাষার মাঝখানে একটা যোগসূত্র গড়ে তোলেন ফলে অনুবাদকের প্রথম যেটা হওয়া উচিত সেটা হচ্ছে দুই ভাষা শুধুমাত্র জানা নয়, দুই সংস্কৃতির সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা তার দরকার। এটা অনিবার্য। কারণ অনুবাদ তো শুধুমাত্র কবিতার হয় না, আপনি যখন এক ভাষা থেকে আরেক ভাষার অনুবাদ করেন তখন অনুবাদ সংস্কৃতিরও হয় এবং পৃথিবীকে দেখার দুটো চোখ, দুটো দৃষ্টিকে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছেন। প্রত্যেকটা ভাষা পৃথিবীকে যেভাবে দেখে থাকে, অনুবাদক ওই অনুবাদ ভাষার মাঝখানে সম্মিলন ঘটান। এ সম্মিলন ঘটানোর জন্য অনুবাদককে দুই ভাষার দৃষ্টি থেকে দেখবার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। তবে কবি হওয়াটা কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে একটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করে যদি সে অনুবাদকের যোগ্যতা পূরণ করে তারপরে, তা হচ্ছে কবির নিজের স্বরে একটা কাব্যিক রস প্রতিস্থাপন করতে পারেন। একটা টেক্সট বহুভাবে অনুবাদ হওয়া উচিত। একভাবে অনুবাদ একটা টেক্সটকে তুলে ধরতে যথেষ্ট না।

বার্তা২৪: আপনি উর্দু ভাষা থেকে অনুবাদ করেন। তো, ভাষা হিসেবে উর্দু বেছে নেওয়ার করার কারণ কী? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে উর্দু ভাষার প্রতি এক ধরনের নেগলেটেট দৃষ্টিভঙ্গি আছে কি?
জাভেদ হুসেন: আমি ইংরেজি থেকেও করি। ঘটনাচক্রে উর্দু ভাষা নয় কবিতা থেকে একটা স্বাদ পেয়ে গেছি—যে কোনো কারণেই হোক। ঠিক যে কারণে কেউ রবীন্দ্র সংগীত গায়, নজরুল না গেয়ে, ঠিক যে কারণে কেউ সেতার বাজায়, বাঁশি না বাজিয়ে। ঠিক এরকম কোনো একটা কারণে উর্দু থেকে কবিতা করা শুরু।

উর্দু কবি আহমেদ ইলিয়াস

হ্যাঁ, ঐতিহাসিকভাবে উর্দু ভাষা সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা আমাদের এখানে আছে—ওটা নির্দিষ্ট একটা রাষ্ট্রের ভাষা। লক্ষণীয় বিষয় যে, ওই রাষ্ট্রে এ ভাষায় যতজন কথা বলেন তার চাইতে অনেক বেশি মানুষ কথা বলেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশে। বিশেষ করে ভারতে এ-ভাষী জনগোষ্ঠী সব চাইতে বেশি। এ ভাষাটা আসলে কোনো রাষ্ট্রের ভাষা হওয়ার কথা ছিল না। সাধারণত প্রত্যেকটা ভাষার সাথে একটা জাতি জড়িত। বাঙালি জাতি বাঙলা ভাষার সাথে।

বার্তা২৪: এবারের বইমেলায় আপনে তো একজন বাঙলাদেশি বিহারী উর্দু ভাষার কবির কবিতার বই আপনার অনুবাদে বের হচ্ছে। তো, প্রকাশকদের কাছ থেকে কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছে কিনা?
জাভেদ হুসেন: আমার কথা হচ্ছে কি, এ বিষয়টাকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। গুরুত্ব দেওয়া উচিত তার গ্রহণের ক্ষেত্রে। বর্জন করবার জন্য কোনো ছুতোর দরকার হয় না। আপনি চাইলেই বর্জন করতে পারেন। গ্রহণের জন্য সক্ষমতা দরকার। না খাওয়ার জন্য আপনার ভালো পেটের দরকার নেই, স্বাস্থ্যবান মানুষ হয়ে টিকে থাকার জন্য আপনার ভালো হজমশক্তির দরকার আছে। ফলে, আলোচনাটা হওয়া উচিত আমরা কত গ্রহণ করতে পারব। কত বেশি গ্রহণ করতে পারব, কতটা হজম করতে পারব। সেই দিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত। ওই জায়গা থেকে আমার মনে হয় যে, আমাদের গ্রহণ করার সক্ষমতা বাড়ছে। কোনো ভাষার সঙ্গে, কোনো সংস্কৃতির সঙ্গে বৈরিতার সুযোগ নেই। কারণ ভাষাগুলো তো সাধারণজনের, খেটে খাওয়া মানুষের। যারা না থাকলে কোনো ভাষা টেকে না। যে কোনো ভাষা মরে যায়। ফলে মৈত্রিতাটা, সংযোগটা হওয়া দরকার মানুষের সঙ্গে মানুষের। ভাষা তো আসলে মানুষহীন অবস্থায় মৃত। তার তো কোনো অস্তিত্ব নেই মানুষ না থাকলে। ফলে সংযোগটা মানুষের সঙ্গে মানুষের। কোন মানুষের? যারা আসলে চিরকাল বেঁচে থাকার লড়াই করতেই জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে, ফলে ভাষার মুক্তি, গল্পের মুক্তি, সাহিত্যের মুক্তি আসলে হচ্ছে ওই মানুষগুলোর মুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত, ভাষাকে টিকিয়ে রাখে যারা। ফলে আপনি যতভাবে সম্পৃক্ত হতে চাইবেন বিভিন্ন ভাষার সম্পদ আপনার ভাষায় নিয়ে এসে নিজের ভাষাকে, সংস্কৃতিকে আরো সম্পদশালী, ধনী করতে, সমৃদ্ধ করতে চাইবেন যখন তখন প্রকৃত অর্থে আসলে এটা মানুষের মুক্তির সম্ভবনার অনিবার্যতা এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে আমি বরাবরই ঠিক ওই বৈরিতা যে প্রসঙ্গটা উল্লেখ করলেন যে জায়গাটা আমি গুরুত্ব দিই না। কারণ বৈরিতাকে সরাসরি উদ্দেশ্য করে বৈরিতা কাটানোর সুযোগ নেই। আপনাকে দেখতে হবে সম্ভবনার জায়গায়। আপনাকে দেখতে হবে ভাষার মধ্যে মানুষের মুক্তি, মানুষের লড়াইয়ের সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা গড়ে তুলতে হবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততা গড়ে তুলতে হবে।

বার্তা২৪: আপনে তো মার্ক্সকে নিয়ে, মার্ক্সের মতদর্শন নিয়ে সম্পর্কিত বইয়ের অনুবাদ করছেন প্রচুর। আবার সুফী কবির কবিতার অনুবাদও করছেন। দুইটা জায়গা তো কনফিক্ট মানে একটা বস্তুবাদী আরেকটা ভাববাদী। তো এটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
জাভেদ হুসেন: দেখার যে কাঠামো এ জায়গা থেকে এ প্রশ্নটা বিবেচনা করা যায়। দেখবার তো অনেক দৃষ্টি আছে, সম্ভবনা আছে, সুযোগও আছে। আপনি যখন লিখতে যাবেন, যা বলার হয়ে গেছে তার থেকে নতুন কিছু বলার না থাকে, তখন লেখালেখি করবার কষ্টটা পোহানোর কোনো দরকার নেই। প্রকৃত অর্থে অনেকের কাছে এটা অস্তস্তিকর বলি, বা যেভাবে তারা ভাবতে অভ্যস্ত সে জায়গা থেকে আমি একই সঙ্গে মাক্স অনুবাদ করছি একই সঙ্গে আমি মনসুর হাল্লাজের কবিতা অনুবাদ করছি বা সুফী কবিদের কবিতা অনুবাদ করছি। এ জায়গা থেকে দুটো প্রসঙ্গ মনে রাখা উচিত যে আপনি যেভাবে শব্দটা ব্যবহার করলেন যে ‘ভাববাদী’, তার বিপরীতে যে ‘বস্তুবাদী’ শব্দটা এসেই পড়ে, ঠিক যে অর্থে আপনি ভাববাদী শব্দটা ব্যবহার করলেন, তার বিপরীতে যে বস্তুবাদ দাঁড়াবে—মার্ক্স সেরকম বস্তুবাদী নন। সেরকম বস্তুবাদীদের ইউরোপে একটা ধারা ছিল, মার্ক্সের আগের পর্যন্ত, যাদেরকে মার্ক্স বলতেন স্থূল বস্তুবাদী। খুব স্থূল অর্থে বস্তু আর ভাবকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলে দেখার প্রচলন আছে আমাদের মধ্যে। মার্ক্স সেরকম বস্তুবাদী নন। যেহেতু তিনি সেরকম বস্তুবাদী নন ফলে যাদেরকে আমরা ভাববাদী বলি ওই প্রচলিত কাঠামোর জায়গা থেকে ভাববাদী বস্তুবাদী বলি সেরকমভাবেও মার্ক্স ভাববাদীদের দেখতেন না। ফলে মার্ক্সের যখন আমি অনুবাদ করি আবার একই সঙ্গে মনসুর হাল্লাজ বা আপনে যাদেরকে বললেন ভাববাদী তাদেরকে অনুবাদ করি তখন আসলে একটা কথা মনে রাখি মার্ক্সের মূল শিক্ষা—মানুষ কিভাবে আসলে চিন্তা করবে সেটা সে একা সিদ্ধান্ত নেয় না। সে সিদ্ধান্তটা নেয় তার সমাজ, তার পরিপার্শ্ব, তার সংস্কৃতি যেভাবে যে অবস্থায় তার মধ্যে ক্রিয়া করেছে সে জায়গা থেকেই আসলে সে একটা দার্শনিক অবস্থানে পৌঁছায়। তবে সে দার্শনিক অবস্থানে পৌঁছানোটা তাকে পৃথিবীকে দেখতে একভাবে উদ্বুদ্ধ করে। সে জায়গা থেকে সে পৃথিবীকে দেখেও বটে। কিন্তু সে দেখার জায়গাটা সে যে দেখছে সেটা তো একটা বাস্তব পৃথিবী। সে বাস্তব পৃথিবীকে আমি যেভাবে মোকাবেলা করি তিনি ভাববাদী হয়ে গেছেন বলে তো শূন্যে হাঁটেন না তাকে এ রাস্তার উপরে হাঁটতে হয় এবং যে পাথরে হাঁটতে গেলে আমি ঠোকর খেলে পায়ে ব্যথা পাব সে পাথরে ঠোকর লেগে তিনিও ব্যথা পাবেন। ফলে যে পৃথিবীটাকে তিনি দেখছেন সে পৃথিবীটা তো বাস্তব।

প্রথমা থেকে প্রকাশিতব্য জাভেদ হুসেনের অনুবাদে ‘মির্জা গালিবের গজল’

বাস্তব পৃথিবীটাকে তিনি কেমন করে দেখছেন সেক্ষেত্রে আমাদের কারোই দ্বিধার অবকাশ নেই যে তিনি একটা বাস্তব পৃথিবীতেই বেঁচে ছিলেন। উনাদের একটা বড় সুযোগ আছে আমরা যখন প্রতিদিনকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসগুলাতে আটকা পড়ে যাই, সেগুলাকে উনারা অস্বীকার করতে গিয়ে বহু বিস্তৃত একটা সম্ভবনার কথা বলেন। সুফী কবিরা বলেন যে পরম সত্যের সঙ্গে মিলনের কথা। বাঙলার যে বিশাল ভাব সম্পদ সেখানে অনেক জায়গাটা বলা হচ্ছে একটা পরম সত্যের সঙ্গে মিলনের কথা। এটা প্রকৃত অর্থে মানুষের সামনে একটা বিশাল দ্বার উন্মোচন করে দেয়। মার্ক্সও এমন পৃথিবী চাইতেন যেখানে প্রতিদিনকার বেঁচে থাকার লড়াইতে নিজেকে আটক করে ফেলবার দরকার হবে না। যখন সে পুরাপুরিভাবে এ পুরা মহাবিশ্বের সঙ্গে নিজেকে অনুধাবন করবার সুযোগ পাবে, যাদেরকে আমরা ভাববাদী বলছি তারা আসলে বাস্তবিক লড়াইয়ের যে পর্বটা, সেই জায়গাটা মানসিকভাবে পার হয়ে যেতে চান। কিন্তু এটা মোকাবেলা করতে হয়ই বটে। ফলে যখন আমি মার্ক্স পাঠ করি এবং এ জগতটাকে বদলানোর জায়গা থেকে মার্ক্সকে যখন আমি অনিবার্য বলে মনে করি তখন মনসুর হাল্লাজের মতন সুফী কবিরা আমার কাছে অপ্রাসঙ্গিক থাকেন না। কারণ মার্ক্স প্রকৃত অর্থে যে জায়গায় মানুষকে দেখতে চান—প্রতিদিনকার বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নিজেকে আটকে ফেলবার দরকার পড়বে না, নিজেকে পুরো মহাবিশ্বের সাপেক্ষে নিজের অস্তিত্বকে যাচাই করে দেখবার সুযোগ পাবে। আমি যখন মার্ক্সের এ পরিচয় খুঁজে পাই তখন প্রকৃত অর্থে মনসুর হাল্লাজ বা গালিবের কবিতা অনুবাদ বা দুটোকে এক সঙ্গে চর্চার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা তো আমার হয়ই না বরং দুটোকে আমার একে অপরের পরিপূরক বলে মনে হয়।

বার্তা২৪: মেলায় তো প্রচুর অনুবাদের বই বের হয়। দেখা যাচ্ছে সেখানে ভালো অনুবাদের বই পাওয়া যাচ্ছে না। তো ভালো অনুবাদ করার জন্য আপনি উঠতি অনুবাদকদের কী পরামর্শ দেবেন?
জাভেদ হুসেন: শুধু ভালো অনুবাদ না, ভালো চা বানানোর ক্ষেত্রেও একই পরামর্শ দেব। আপনি যা করতে চাচ্ছেন ভালোভাবে করার জন্য সৎ হওয়া। চায়ের পানি চাপানোর পর নির্দিষ্ট পরিমাণ চুলো জ্বালিয়ে জ্বাল দেওয়া দরকার, ভালো চা পাতা দরকার, যেহেতু দুধ চা খাই তার জন্য ভালো দুধ দরকার, চিনি দরকার, তার জন্য চুলোও দরকার, তার জন্য ম্যাচের কাঠিও দরকার, চুলো জ্বালানোর জন্য জ্বালানিও দরকার, এসব জোগাড়ের পর কোনো একটা জায়গায় একটু ফাঁকি দেবেন, চা পাতা একটু কম দেবেন, দুধ একটু কম দেবেন এবং আপনে একটু জ্বালানি বাঁচাবেন—এ ফাঁকিবাজি দিয়ে এককাপ ভালো দুধচা সম্ভব নয়। ঠিক যখন আপনি অনুবাদ করছেন সেখানেও আপনার যা দরকার প্রধানত আপনি যে পাঠকের কাছে আপনি আপনার অনুবাদকর্ম তুলে ধরবেন, ধরে নিচ্ছি—আপনি যা যা জানেন তিনি তা জানেন না বলে আপনার অনুবাদ করা বই পড়বেন, ফলে আপনি যদি ভাবেন যে পাঠককে কেমন করে সন্তুষ্ট করা যায় তাহলে আপনার ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ আছে। ফলে আপনি ফাঁকি দিবেন, প্রথমত যাকে সন্তুষ্ট করা উচিত সেটা আপনি নিজে। এখানে আমি যেটা বলছিলাম দুটো ভাষার সংস্কৃতিকে জানার জন্য যে নিবিড় প্রয়াস দরকার, শ্রম দরকার, ক্লেশ দরকার, লেগে পড়ে থাকা দরকার সে জায়গায় বিন্দুমাত্র অবহেলা করেন, এ বিন্দুমাত্র অবহেলা শতগুণ ত্রুটি হয়ে ঘাটতি হয়ে দুর্বলতা হয়ে একটু খানি হেলা, একটু খানি ফাঁকি শতগুণ হয়ে প্রকাশিত হবে আপনার অনুবাদের কাজে। ফলে আমার অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে একটা পরামর্শই দিই সেটা নতুন কিছু না। পৃথিবীর যে কোনো কাজ একদম ভালো করে করতে হলে যা করা উচিত সে জায়গা থেকে অনুবাদের ক্ষেত্রেও লেগে পড়ে থাকা, লক্ষ্য আপনার পাঠক পরে, প্রথমে আপনি নিজে কারণ নিজেকেই সন্তুষ্ট করা সবচেয়ে কঠিন। প্রথমত অনুবাদ কাজের মধ্যে আপনি নিজে সন্তুষ্ট হওয়া দরকার। নিজে সন্তুষ্টির জন্য প্রয়োজন সৎ হওয়া ফাঁকি দেওয়ার একদমই রাস্তা নেই। লেগে থাকা ও সৎ হওয়া।

বার্তা২৪: এই যে একজন অনুবাদক লেগে থাকবেন, সৎ হবেন, শ্রম দেবেন তার জন্য তো তিনি তেমন আর্থিক মজুরি পাচ্ছেন না। সেক্ষেত্রে তিনি অনুবাদ করার জন্য কিভাবে সাহস পাবেন, যদি তাদের অন্য কোনো পেশা না থাকে?
জাভেদ হুসেন: লিখে টিকে থাকা এ মুহূর্তে সাধারণভাবে বাংলাদেশে সম্ভব নয়। লিখে যারা টিকে আছে তারা যা বলতে চায় সেটা বলার সুযোগ কম। সবাই যা শুনতে চায় সেটাই আপনাকে বলতে হবে।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;