বুক রিভিউ

কেন পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়!



আশরাফুল আলম শাওন
গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

এখন সময় যত যাচ্ছে, ভবিষ্যত কমে আসছে, অতীত বাড়ছে, এবং জীবন ক্রমশ আরো জটিল হয়ে উঠছে, মাঝে মাঝে খুব ভালো ফিকশনও বিরক্তিকর ও অর্থহীন লাগে। মনে হয় এই বানানো জিনিস, মনগড়া চরিত্রদের কাহিনী পড়ে আমার বা দুনিয়ার কী আসবে যাবে! আমার বিনোদনের উদ্দেশ্যও তো সেভাবে হচ্ছে না। তখন হয়তো একটু-আধটু ইতিহাস, কিছুটা রিলিজিয়াস টেক্সট, ম্যাথ-সায়েন্স-টেকনোলজি রিলেটেড কিছু পড়া যায়।

তবে যে বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য এই লেখাটা শুরু করেছি, সেই বিষয়—কবিতা, আমি পড়ি ঘটনাক্রমে। খুব একটা ইচ্ছাকৃতভাবে না। তবে আমি মনে করি আমি কবিতা বুঝি।

কবিতার একটা নতুন বই—‘পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়’ বইটা, বলা ভালো বইটার বেশিরভাগ কবিতা আমাকে নাড়া দিতে পেরেছে। আমার সংবেদনশীলতা যে জায়গা থেকে কাজ করে ও প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেই জায়গাটা স্পর্শ করতে পেরেছে, সঠিক বোতামে চাপ দিতে পেরেছে। তা না হলে আমি এটা নিয়ে কেনই বা কথা বলছি!

কবিতা হচ্ছে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ধরনের আর্ট! এই কথাটার পেছনে আমার যুক্তি বা আমার দৃষ্টিভঙ্গি আগে ক্লিয়ার করি। আমাদের মানুষদের এই জগত, এই মহাবিশ্ব, এই মহাবিশ্বের সবকিছু মৌলিকভাবে যে জিনিস দিয়ে তৈরি সেটা হচ্ছে ভাষা। আমরা যা কিছু করি, যা কিছু দেখি, যা কিছু ভাবি, আমাদের সকল স্মৃতি সবকিছুই আমাদের মস্তিষ্কে ভাষার মাধ্যমে প্রসেস হয়। মানুষের মস্তিষ্ক বা কগনিটিভ সিস্টেম ইনপুট হিসাবে ভাষাকেই গ্রহণ করে এবং প্রসেস করে ভাষাকেই আউটপুট হিসাবে বের করে। আমরা যখন কিছু দেখি, আমাদের মস্তিষ্কে ভাষা প্রসেস হয়ে সেই দৃশ্য তৈরি হয়। আমাদের মস্তিষ্ক যখন কোনো স্মৃতি তৈরি করে, সেই স্মৃতিকে সে ভাষা দিয়েই সংরক্ষণ করে রাখে।

আর এই ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো এর নিয়ম বা সিনট্যাক্স। মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, মস্তিষ্ক—আমাদের কগনিটিভ সিস্টেম কাজ করে এই সিনট্যাক্সের যুক্তিতে। একজন মানুষ যখন একদম ছোট থেকে বড় হতে থাকে, সে যখন ভাষা শিখতে থাকে তখন সেই ভাষার মাধ্যমে তার মস্তিষ্কের প্রোগ্রামিং হয়। সিনট্যাক্স, অর্থাৎ কোন শব্দের পর কোন শব্দ কিভাবে বসে অর্থ তৈরি করবে—সেই লজিক দিয়েই আমাদের মস্তিষ্ক পরবর্তীতে কাজ করতে থাকে। দেখবেন, একজন পাগলও যখন কথা বলে, সে সিনট্যাক্সের বাইরে কিছু বলে না। হয়তো তার কথার কনটেক্সট ঠিক নাই, কিন্তু সিনট্যাক্স ঠিক আছে। বলা হয়, সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর সেদিন স্থাপিত হয়নি যেদিন মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখেছিল, যেদিন মানুষ প্রথম ভাষা ব্যবহার করেছিল, সেদিন সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল।

তো, কবিতার সাথে ভাষার সিনট্যাক্সের ক্ষমতার কী সম্পর্ক?—কবিতা এই সিনট্যাক্সের ক্ষমতা ও কার্যকারিতাকে সবচেয়ে যথাযথভাবে ব্যবহার করে। সিনট্যাক্সকে একটু অন্যভাবে ব্যবহার করে, খুব সামান্য আয়োজন করে, খুব অল্প চেষ্টায় অনেক বিরাট অর্থ বা মেসেজ বা কথা বলে দেয়। অন্য কোনো আর্ট ফর্ম ব্যবহার করলে যেটা করতে বিরাট আয়োজনের দরকার হতো। এবং সিনট্যাক্সের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে সেই আর্টফর্ম এত ভালোভাবে বা এত যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারত না। এবং এইভাবে কবিতা ভাষার নতুন নিয়ম বা নতুন সিনট্যাক্সও তৈরি করে।
যে বইয়ের কবিতাগুলি নিয়ে কথা বলার জন্য আমি এই লেখা লিখছি—সেখান থেকেই উদাহারণ দিই:

অ্যালেক্সা, যুদ্ধ কি বাস্তবেই হয়েছিল,
বাস্তবেই অগ্নিশালায় কুশাসনের ওরা
কথা বলছিল ক্রুজার ডেস্ট্রয়ার নিয়ে?
তুমি সেই নদীর নামটুকুই জানো
কপোতাক্ষ সেটা,
দেখি ক্রুজারের নাম কী ছিল বলো,
সেই সাবমেরিন সেই টর্পেডো-বুলেট...
তোমার কথামেশিনও কি ওদেরকে ডাকে ‘কমরেড’?
ওকে!
দেখি বলো তাহলে তোমার ওই একঘেয়ে সুরে একটানে
এই জীবনের মানে

অ্যামাজনের অ্যালেক্সা যন্ত্রটিকে এখানে প্রশ্ন করা হয়েছে কোনো একটা ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে। ঐতিহাসিক সেই যুদ্ধের ঘটনা এখানে তৈরি করা হয়েছে জাস্ট কয়েকটা নৌ-যুদ্ধযানের কথা বলে। মজার ব্যাপার হলো, সেই যুদ্ধাস্ত্রগুলির মধ্যে হঠাৎ করে কী এক উদ্দেশ্যে কপোতাক্ষ নদীর নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথায় অ্যালেক্সা, কোথায় ক্রুজার আর সাবমেরিন আর কোথায় যশোরের কপোতাক্ষ! কিন্তু এই সবকিছু দিয়ে একটা ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে অ্যালেক্সাকে। চরম ক্ষমতাবান মেশিনের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে—মেশিন মানে যে কোনো যন্ত্র—সেটা অ্যালেক্সাই হোক বা বা ‘সাবমেরিন-টর্পেডো-বুলেট’; “তোমার কথামেশিনও কি ওদেরকে ডাকে ‘কমরেড’?”

কিন্তু পরের লাইনেই এসে পুরো সিনারিও বদলে গেছে, কারণ অ্যালেক্সা এখানে কোনো বিষয়ই না, সম্বোধন করার জন্য একটা সাবজেক্ট মাত্র। বরং এখানে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন—অ্যালেক্সাকে জিজ্ঞাসার ভান করে, মানবজাতিকে বা নিজেকেই বিদ্রুপের সাথে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে:

ওকে!
দেখি বলো তাহলে তোমার ওই একঘেয়ে সুরে একটানে
এই জীবনের মানে

মানে, এই জীবনের মালিক, যে আমি কথা বলছে, সে নিজেই তার জীবন ও বহুকাল ধরে ঘটতে থাকা এতসব ঘটনার অর্থ ও উদ্দেশ্য জানে না, আর অ্যালেক্সা তুমি আসছো বাহাদুরি দেখাতে! কতটা মারাত্মক বোকা তুমি অ্যালেক্সা!

থার্ড পারসন অ্যালেক্সাকে উদ্দেশ্য করে বলার ভান করে, যে বলছে সে নিজেই একটা সাবজেক্ট হয়ে গেল—একই পঙক্তির মধ্যে মাত্র একটা লাইনের ব্যবধানে, শুধু সিনট্যাক্সকে একটু অন্যভাবে ব্যবহার করে, বলার ভঙ্গির মধ্যে একটা ধাঁধা বা হেঁয়ালি তৈরি করে।

বাংলা বা যে কোনো কবিতার যে প্রচলিত ভাষা, এই বইয়ের কবিতা সেটা থেকে আলাদা। আর এই ২০২০-১৯ সালে এসে সময়ের যে স্বাদ ও গন্ধ, এই বইয়ে সেটা আছে; ২০২০-১৯ সালে, আশির বা নব্বইয়ের দশকের বাতিল হয়ে যাওয়া স্বাদ এই বইতে অন্তত পাওয়া যাবে না।

এই বইয়ের বেশিরভাগ কবিতা আমাকে কেন নাড়া দিল! আমার কাছে কেন অসাধারণ মনে হলো! অ্যালেক্সা বা এআই-এর মতো আধুনিক ও সময়োপযোগী জিনিস এসেছে এই কারণে? সিনট্যাক্সের ধাঁধা আছে, এই কারণে?—না। সরল উত্তর—এই কবিতাগুলির বিষয় ও কবিতার সাটেলটি বা সূক্ষ্মতার কারণে। কবিতা বা যে কোনো আর্টের অসাধারণ হয়ে ওঠার পেছনে দুটি জিনিসের গুরুত্ব অনেক বেশি—উইট বা বুদ্ধিমত্তা ও সাটেলটি বা সূক্ষ্মতা। উইট তো আছেই, যে বিষয়গুলি নিয়ে এই বইয়ে কথা বলা হয়েছে, সেই বিষয়গুলি নিয়ে এত সূক্ষ্মভাবে কথা বলা, প্রশ্ন করা, চ্যালেঞ্জ করা এবং সবচেয়ে বড় কথা, বিদ্রুপ করা—জেনারেলি কোথাও পাওয়া যায় না।

এই বইয়ের দুই-একটা বাদে, সব কবিতাকে বলা যায় দুইটা ধরনের মধ্যে—দার্শনিক ও রাজনৈতিক; ফিলোসফিক্যাল ও পলিটিক্যাল। এবং যে কবিতাগুলি রাজনৈতিক সেগুলিও কোনো একটা পর্যায়ে গিয়ে একটা দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে আসছে; আবার যে কবিতাগুলি দার্শনিক কোনো একটা ধারণাকে প্রশ্ন করছে সেটাও কোনো এক পর্যায়ে রাজনৈতিক বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। যেমন, ‘জীবনের মানে’ নামে যে কবিতা আছে, এখানে এই বিষয়টাই একটা দার্শনিক চেতনা থেকে আসা। ‘জীবনের মানে’ নিয়ে যদি কবিতা লেখা হয়, সেটা নিশ্চিতভাবেই একটা দার্শনিক চেষ্টা হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে কবিতাটার জার্নি মূলত একটা রাজনৈতিক বোঝাপড়া, দার্শনিক ভূমিতে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। অনেক দীর্ঘ সময়ের মাপকাঠি দিয়ে ইতিহাসকে দেখলে, অনেক উপর থেকে দেখলে, কোনো একক ব্যক্তির জীবনের মানে বলে কিছু হয় না, কারণ একজন ব্যক্তিসত্তা বলে কিছু আর আলাদা করা যায় না। একটা কম্যুনিটির বা জনগোষ্ঠীর সংগ্রামের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই সামগ্রিকভাবে তাদের জীবনের মানে হয়ে ওঠে। এখানে বলা হয়েছে, হিটলারের আমলে নাৎসিদের জীবনের মানে ছিল হিটলারের নাৎসিবাদ, মুসলমানদের ক্ষেত্রে সেটা হয়তো হতে পারে ইমাম মাহদীর জন্য অপেক্ষা। কিন্তু পরে এই কবিতাটা আরো বড় একটা রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে নিয়ে গেল—এক বর্ণবাদী জার্মান জেনারেল, যার এশিয়ান, আফ্রিকান ও মুসলিমদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা—তার বক্তব্যের মাধ্যমে। কিন্তু, মজার ব্যাপার হলো, এই জার্মান জেনারেলের এই ঘৃণাটাও কোনো একজন ব্যক্তির একক অনুভূতি না, বরং তা পুরো ওয়েস্টের, পুরো পাশ্চাত্যের এই এশিয়া, আফ্রিকা ও মুসলিমদের প্রতি সামগ্রিক একটা অনুভূতি। কখনো মোলায়েমভাবে চাপা দেওয়া, কখনো খুব কুৎসিতভাবে প্রকাশিত।

একইরকম ঘটনা ঘটছে ‘সম্ভবত আক্রোশ থেকে’ নামের এই কবিতাটাতেও। ‘আমি কে’ এই দার্শনিকভাবে ক্লিশে অথবা ক্লাসিক প্রশ্ন নিয়ে কথা বলা হয়েছে—কিন্তু দার্শনিক কোনো রাস্তার ধারেকাছে যাওয়া হয় নাই। অসাধারণ এই জিনিসটা হয়ে উঠেছে ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’ নিয়ে একটা সূক্ষ্ম বিদ্রূপ—একজন মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক, শ্রেণীগত, পারিবারিক, পলিটিক্যাল, জাতিগত এত এত পরিচয়ের কারণে পৃথিবীতে এত বিশৃংখলা তৈরি হচ্ছে, কেউ এই পরিচয় ব্যবহার করে আক্রমণ করছে, কেউ বা এই পরিচয়ের কারণেই আক্রমণের শিকার হচ্ছে।

এই বইয়ের বেশিরভাগ বা বলা ভালো সবগুলি কবিতাই একটা কাজ করছে—রাজনৈতিক ও দার্শনিক বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। সবগুলি কবিতায়ই রাজনৈতিক বক্তব্য ও ফিলোসফিক্যাল বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করার মিশ্রণ ঘটেছে। আর সেই কাজ করতে গিয়ে মাসরুর আরেফিন, কোনো নির্দিষ্ট ডিসকোর্সের বা বক্তব্যের ভিতর দাঁড়িয়ে নেই, বা কোনো একটা কনটেক্সটের মধ্যে আবদ্ধ থাকেননি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে বইয়ের প্রথমদিকের কবিতাগুলিতে, শেষের দিকের কবিতাগুলিতে তিনি একটা কসমিক, একক ভয়েসে, অনেক উপর থেকে, অনেক বড় একটা টাইম ফ্রেমে দেখছেন এমন টোনে কথা বলছেন। কোনো একটা নির্দিষ্ট ঘটনা বা উদাহারণ নিয়ে আসলেও তিনি সেটাও একটা মহাকালের, মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছেন। অনেকটা এরকম—মানবজাতি তোমরা তো অনেক কথাই বলছো, অনেক সিরিয়াস ভাব দেখাচ্ছো, কিন্তু তোমার এই সবকিছুই তো একটা আত্মপ্রবঞ্চনা। তুমি যতই পাশ কাটাও, তোমার এই সবকিছুর যে কোনো মানে নেই, এই সবকিছু যে তোমাকে কোথাও নিয়ে যাবে না—এর চেয়ে বড় সত্য তো আর নেই। সরাসরি বললে, উনি স্ক্রিপচারের টোনে কথা বলছেন। স্ক্রিপচারের টোনটা কেমন? বাইবেল—ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্ট বা ধর্মগ্রন্থের যে টোন, সেই টোন। ধর্মগ্রন্থের এই টোন এই বইয়ের কবিতার একটা ইউনিক বৈশিষ্ট্য, এবং সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। বাংলা ভাষায়, ধর্মগ্রন্থের এই কসমিক টোনে এত সাবলীল বা স্বচ্ছন্দভাবে লেখার উদাহারণ আর নাই। আমি আর সব বাদ দিয়ে, শুধু এই একটা কারণ, শুধু এই স্ক্রিপচারের কসমিক টোনের জন্য এই বইটা বেছে নিতে রাজি আছি। এটা পুরোপুরিভাবে ইউনিক এবং মুগ্ধ করার মতো।

যেমন এই বইয়ের ‘রিক্ততা’ কবিতাটা—এটা যে কী শক্তিশালী কবিতা! এখানে যে চরিত্ররা আসছে তাদের নাম, যেসব ঘটনা ও ভৌগোলিক বর্ণনা এসেছে মনে হয় এখানে বিপরীত বা উলটা-এক্সোডাসের মতো কিছু একটা তৈরি হয়েছে। মুসা নবীর নেতৃত্বে হিব্রু জনগোষ্ঠী লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে যে মহিমান্বিত এক্সোডাস ঘটিয়েছিল, এখনকার দুনিয়ার এই অর্থহীন রাজনৈতিক বাস্তবতা কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে—হয়তো তাদেরই কারণে, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে একদল উদ্বাস্তু মানুষের ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা—কত অবর্ণনীয়, কিন্তু বাস্তব:

যখন আর্মার্ড বক্সার ভেহিকলগুলো লাইম পাড়তে আসে,
কেমন হুম হুম শব্দ আসছে দূরের ওই
কাণ্ডারী-হারানো জাহাজের থেকে,
রানিম আবুদকে ডেকে ডেকে বলছিল,
আমাকে নিয়ে যেয়ো, বাবু, আমাকে নিয়ে যেয়ো সাথে,
কেমন খ ধ্বনির হাসি চাপছিল ফটো সাংবাদিক মেয়েটা নিজেই পানিতে পড়ে গিয়ে,
তখনই বাঁশি—আমাদেরকে বলা হলো পন্টুনের থেকে দূরে সরে যেতে।
আমিও এই ফাঁকে কবিতা লেখার অবকাশ পেয়ে
বুঝলাম পৃথিবী শূন্য পৃথিবী ফক্কা পৃথিবী ফোঁপরা বটে;

এরকম অসংখ্য উদাহারণ পাওয়া যাবে এই বইয়ের অনেক কবিতায়, অনেক লাইনে। যেমন ভোরের গল্প কবিতাটা, এটা পুরাই একটা কেয়ামত:

তো, সেইখানে দেখি মেঘের একপাশে কী গাঢ়
লাল আভা, অগ্নিগিরি যেন, অন্য পাশ কালো,
পৃথিবী তবু শান্ত বটে, জাগছে দূরে
বনশ্রী-রামপুরা দিগন্তরেখা ধরে—
মনে হলো ব্যাপারটা এমনই কি হবে মহাপ্রলয়ের দিনে?
এরকম বিভ্রান্তকরই হবে তবে, যেভাবে আগুন
লেগেছে বলে মনে হচ্ছে প্রথম সারির মেঘেদের পেছনের দিকে?—
হাহ্ আজকেই কি সেই মহাপ্রলয়ের দিন না-কি?

এরকম বহু বহু উদাহারণ আছে। যেমন:

এটাও বিশ্বাস করো, ওইটাও করো, এই তো চেহারা!
আর জীবনে যা যা করেছো খোকা তুমি,
তার দাম দিতে হবে না বলো?

এখানে এসে—এই কসমিক স্বরের কারণে আমার একটা স্প্যানিশ প্রবাদের কথা মনে পড়েছে—“Take what you want and pay for it, says God.”
“আর জীবনে যা যা করেছো খোকা তুমি,
তার দাম দিতে হবে না বলো?”

জীবনে সবকিছুই করা যাবে, যা খুশি তাই, শুধু তার উপযুক্ত দামটা পরিশোধ করতে হবে। এর চাইতে বেশি সরল এবং অনিবার্য আর কী হতে পারে?

এই বইয়ের অনেক কবিতাতে প্রকৃতি খুব বড়ভাবে আসছে, খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে ‘এতগুলি ব যেহেতু আছে’ কবিতাতে পাখিদের নিয়ে যে অবজার্ভেশন আছে সেটা চমৎকার। আমার মনে হয়েছে পাখিদের নিয়ে ওই দেখার ভঙ্গিটাও কসমিক দেখার ভঙ্গি:

এসব ভাবছি এলোমেলো আর দেখছি যে
বড় ডানার ছোট ও সুতীক্ষ্ণ কিছু পাখি
জোর চিৎকার তুলে সাঁ-সাঁ উড়ে এসে
আছড়ে পড়ছে মেহগনি জাম জারুলের গাছে,
এমন যে মনে হয় এ-পৃথিবীতে
মানবপ্রজাতি নিয়ে শেষ ভাবনাটুকু
মানুষ নয় পাখিদেরই ভাবা হয়ে গেছে।

অথবা

ভোরে চোখ খুললেই না জানি মহাপ্রলয় দেখা হয়,
এমন যেন সামনে এক নিঃসীম শূন্য মাঠ
যেখানে থাকবে সাদা বালির পরে বালি
যেমন এখানে রয়েছে এই বালু নদীর পাড়ে—
সেখানে সন্ধ্যায় পাখি ওড়ে
পাখিরা উদ্ধত আস্ফালিত ওড়ে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের নিয়ে করা ওয়ের্নার হেরজগের একটা বিখ্যাত ডকুমেন্টারি আছে, নাম—Into the abyss; সেই ডকুমেন্টারির শেষে একজন যাজক বলে—“once you feel good about your life, you do start watching what the birds do. what the doves are doing. like the hummingbirds. why there are so many of them!”

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের কনফেশন করাতে করাতে যে যাজক জীবনের অর্থহীনতা বা অসাড়তার কথা বুঝে গেছে, তারপর পাখিদেরকে কৌতূহল নিয়ে দেখছে, তার সাথে এখানে পাখিদের উদ্ধত আস্ফালিত উড়াউড়ি দেখতে থাকা কবির কী সুন্দর মিল!

প্রকৃতি আরো ব্যাপকভাবে এসেছে জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু নিয়ে যে কবিতা লেখা হয়েছে সেটাতেও। থাক, এটা নিয়ে আর না বলি, যত বলব ততই কম হয়ে যাবে। জীবনানন্দকে নিয়ে লেখা বাংলা ভাষার সবচেয়ে সেরা লেখা এই ‘ছাতু’ কবিতা—কোনোভাবেই এটা আমার অত্যুক্তি নয়।

এই বইয়ে দুটি কবিতা আছে যেটা খুব একটা বিশুদ্ধ ভয়ের মুখোমুখি ফেলে দেয়। ‘কেন চিনতে পারছি না কোনোকিছু’ ও ‘কোনো এক বনের কিনারে’।

এই বইয়ের বেশিরভাগ কবিতা নিয়েই আক্ষরিক অর্থেই অনেক অনেক কথা বলা যায়। এগুলি শক্তিশালী এবং এতটা আলাদা যে তারা সেটা ডিজার্ভ করে। ব্যক্তিগত কথাবার্তা ও ক্যাজুয়াল স্বরের যে গতানুগতিক ও নিজস্ব অভিজ্ঞতা কবিতার ক্ষেত্রে পাওয়া যায় সেটা এখানে পাওয়া যাবে না।

এই বই আপনাকে অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবে। একটা ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক-দার্শনিক-বিদ্রুপাত্মক এক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা দেবে, আর সেই ভ্রমণ যদি পুরোপুরি শেষ করা যায় তাহলে হয়তো মনে হবে—যেটা এই বইয়ের সবগুলি কবিতাই কোনো না কোনোভাবে প্রমাণ করেছে—মানুষের জীবন এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় ঘটনা, তবুও এটা অর্থহীন একটা ব্যাপার, সম্ভবত!—লাইফ ইজ দ্য মোস্ট মিস্টিরিয়াস ফেনোমেনন ইন দিস ইউনিভার্স, ইয়েট মিনিংলেস, মেবি!

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;