বুল্লে শাহ’র কবিতা



ভূমিকা ও ভাষান্তর: সৈয়দ তারিক
অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পাঞ্জাবের সুফি ভাবুক ও কবি বুল্লে শাহ’র জীবনকাল ছিল মোগল আমলের শেষভাগে। তার আসল নাম সৈয়দ আবদুল্লাহ শাহ কাদরি, যদিও কর্ম ও রচনার মাধ্যমে তিনি যুগযুগান্ত ধরে বুল্লে শাহ নামেই খ্যাতিমান। তার আবির্ভাব ১৬৮০ সালে, ভাওয়ালপুরের উচ নামক স্থানে, যেটি এখন পাকিস্তানের পাঞ্জাবের অন্তর্ভুক্ত। তার পূর্বপুরুষেরা বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারা হতে এসেছিলেন। (হাফিজ তার কবিতায় প্রিয়ার গালের তিলের বিনিময়ে এই বুখারা ও তার সাথে সমরখন্দ বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, পাঠকের হয়তো সে কথা মনে পড়ে যাবে।) তাদের বংশ মহানবির সরাসরি উত্তরসূরী।

বুল্লে শাহ’র বাবার নাম ছিল শাহ মুহম্মদ দরবেশ। তিনি গ্রামের মসজিদে ধর্মপ্রচারক (হয়তো ইমাম বা খতিব) ছিলেন ও শিক্ষকতা করতেন। পরে তিনি পেশাকর্মের জন্য পান্ডোকে যান। বুল্লে শাহ তার প্রাথমিক পড়াশোনা সেখানেই করেন, পরে উচ্চতর বিদ্যার্জনের জন্য কাসুর যান। সেখানে মাওলানা মহিউদ্দিনের কাছে শিক্ষালাভ করেন। বুল্লে শাহের আধ্যাত্মিক গুরু বা পীর ছিলেন লাহোরের প্রখ্যাত সুফি দরবেশ শাহ ইনায়েত কাদরি। বুল্লে শাহ’র জীবনধারা সম্পর্কে বেশি একটা জানা যায় না। নানা লোকশ্রুতিতে বিভিন্ন বর্ণনা আছে।

পাঞ্জাবি সুফি কবিতার যে-ঐতিহ্য রয়েছে, যে-ধারায় কবিতা লিখেছেন শাহ হুসাইন (১৫৩৮-১৫৯৯), সুলতান বাহু (১৬২৯-১৬৯১), ও শাহ শরাফ (১৬৪০-১৭২৪) সেই ধারায় বুল্লে শাহ কবিতা চর্চা করেন। বুল্লে শাহ’র সমসাময়িক সিন্ধি কবি ছিলেন শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই (১৬৮৯-১৭৫২)। তার জীবনকালে খ্যাতনামা পাঞ্জাবি কবি ওয়ারিস শাহ (১৭২২-১৭৯৮)—যিনি ‘হির রানজা’ রচনায় খ্যাতিমান, ও সিন্ধি সুফি কবি সাচাল সারমাস্ত (১৭৩৯-১৮২৯) সৃজনশীল ছিলেন। তার সমকালে উর্দু কবিতার আরেক দিকপাল মির তকি মির (১৭২৩-১৮১০) ছিলেন ৪০০ মাইল দূরে আগ্রায়।

সাধারণত যে প্রকরণে বুল্লে শাহ কবিতা লিখতেন তার নাম কাফি। পাঞ্জাবি ও সিন্ধি কবিতার এটি একটি জনপ্রিয় ধারা। কাফি নামে সঙ্গীতের একটা রাগ যেমন আছে, তেমনি এটা গীতিকবিতার একটা ধরনও। বাবা ফরিদ, বুল্লে শাহ, শাহ হুসাইন, শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই, সাচাল সারমাস্ত, খাজা গোলাম ফরিদ প্রমুখ এই ধারায় কবিতা লিখেছেন। সুরারোপিত হয়ে এই রচনাগুলো গীত হয়ে আসছে দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে। এই ধারার কবিতায় একটা প্রধান ও কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে মানবাত্মা ও স্রষ্টার মধ্যে, বা ভক্ত (মুরিদ) ও গুরু (মুরশিদ, পীর), বা আশেক (ভক্ত) ও মাশুক (প্রেমাস্পদ, প্রিয়)-এর মধ্যে আলাপ বা কথোপকথন।

এইসব কাফির সুরারোপিত রূপটি রাস্তার গায়ক থেকে শুরু করে উঁচু-অভিজাত-বিখ্যাত গায়কেরা, যেমন : নুসরাত ফতেহ আলি খান বা আবিদা পারভিন এখনো গেয়ে চলেছেন। বিখ্যাত কাওয়ালি গান ‘দমাদম মাস্ত কালান্দার’-এর কথাই ধরা যাক। বুল্লে শাহ’র রচনা এটা। যদিও ত্রয়োদশ শতকে শাহবাজ কালান্দারের প্রয়াণের পর আমির খসরু প্রথমে ওটি লিখেছিলেন, পরবর্তীতে বুল্লে শাহ গানটিকে পরিমার্জিত ও বিস্তৃত করেন। তার লেখা রূপটিতেই গানটি প্রচলিত, যদিও বিভিন্ন শিল্পী আবার কিছু রকমফের করে গানটি উপস্থাপন করেন। নানাভাবে তাঁর কবিতা ও গান সরাসরি বা রূপান্তরিত হয়ে কিংবা অনুপ্রেরণা হয়ে পরবর্তী কালের শিল্প-সাহিত্যে প্রবহমাণ রয়েছে। পাকিস্তান ও ভারতের অনেক সিনেমায় তার গান ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, বলিউডের ‘দিল সে’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত সাম্প্রতিক কালের বিখ্যাত গান ‘ছাইয়া ছাইয়া’ বুল্লে শাহ’র রচনার প্রেরণাতেই রচিত হয়েছে। গানটির দৃশ্যায়ন দেখে আপাতভাবে যেমনই মনে হোক, গানটির কথা (গুলজার এটি রচনা করেছেন) সুফিদর্শনেরই প্রকাশক :

‘যার মাথার উপর প্রেমের ছায়া পড়েছে
তার পায়ের নিচে বেহেশত রয়েছে
প্রেমের ছায়ায় ছায়ায় চলো।’

বুল্লে শাহ’র কবিতায় ও দর্শনে মুসলমানদের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও নিয়মতান্ত্রিকতার প্রবল সমালোচনা পাওয়া যায়। বুল্লে শাহ’র ভাবধারা মানবতাবাদী। আধ্যাত্মিক বিষয়ের পাশাপাশি জগতের সামাজিক বিষয়েও তাঁর প্রজ্ঞাময় দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। জীবন-জগতের জটিল বিষয়গুলোর সহজ-সরল উপস্থাপনা তার রচনাকে জনপ্রিয় করেছে।

কাফি রূপকল্পটি শুধু সুফিরাই নন, শিখ গুরুরাও ব্যবহার করতেন। বুল্লে শাহ’র জনপ্রিয়তা মুসলমানদের হতে হিন্দু ও শিখদের মধ্যে বিস্তৃত হয়েছিল। তার সম্পর্কে লিখিত তথ্যাদি হিন্দু ও শিখ লেখকদের রচনাতেই বেশি পাওয়া যায়। বুল্লে শাহ’র সময়টি মুসলমান ও শিখদের মধ্যে সঙ্ঘাতের কাল ছিল। কিন্তু সেই সময় বুল্লে শাহ ছিলেন পাঞ্জাবের অধিবাসীদের জন্য শান্তির আলোকবর্তিকা। একবার পূর্বঘটনার জের ধরে মুসলমানদের হাতে এক তরুণ শিখ নিহত হয়। বুল্লে শাহ এর প্রবল প্রতিবাদ করেন। এতে পাঞ্জাবের মোল্লা-মুফতিরা তার ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়। হত্যা-আঘাত-সঙ্ঘাতের ঘটনার জবাব প্রতি-আক্রমণ নয়, বুল্লে শাহ এই আদর্শই প্রতিষ্ঠা করতে চান। শিখ গুরু তেগ বাহাদুরকে তিনি গাজি বলে সংবর্ধনা জানান। এতে ধর্মান্ধ মুসলমানেরা তার ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।

তার তিরোধান ১৭৫৭ সালে, পলাশীর যুদ্ধের বছরে। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। মোল্লারা তাকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। তারা তাঁর জানাজা পড়তেও অস্বীকার করে। তখন কাসুরের প্রখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব কাজি হাফিজ সৈয়দ জাহিদ তার জানাজায় ইমামতি করেন।

কাসুরে তিনি সমাহিত হন। সেটি একটি দরগাহে পরিণত হয়। তার রওজায় যেতে বিশাল একটি পরিচ্ছন্ন বারান্দা পেরোতে হয়। সেই বারান্দার ছাদে চমৎকার ক্যালিগ্রাফিতে তার কবিতা খচিত রয়েছে।


তোমাকে চাই, আমি তোমাকে চাই;
ঘটনাই এই, আমি কী করি এখন?
বাঁচতে পারি না আমি, মরতেও নয়,
তোমাকে চাই, আমি তোমাকে চাই।

আমার মিনতিটুকু শোনো।
দিন বলো, রাত বলো, শান্তি কোনো নাই।
আর এক মুহূর্ত আমি তোমাকে না পেলে বাঁচব না।
তোমাকে চাই, আমি তোমাকে চাই;
ঘটনাই এই, আমি কী করি এখন?

বিরহ ব্যথার বুঝি কোনো শেষ নাই।
কেউ কি মিটিয়ে দিতে পারে এ বেদনা?
তাকে তো দেখি না আমি, বাঁচব কিভাবে?
তোমাকে চাই, আমি তোমাকে চাই;
ঘটনাই এই, আমি কী করি এখন?

বুল্লে শা বলে, আছি চরম বিপদে,
দয়া করে এনে দাও ত্রাণ।
কিভাবে সইব আমি বেদনা এমন?
তোমাকে চাই, আমি তোমাকে চাই;
ঘটনাই এই, আমি কী করি এখন?

***
রানজা রানজা ডেকে ডেকে
নিজে আমি রানজা হয়ে গেছি।
আমাকে সবাই ডাকো রানজা নাম ধরে,
হীর বলে ডেকো না গো কেউ।
রানজা আমার মাঝে, রানজার মাঝে আছি আমি,
আর কোনো ভাবনা নাই অন্তরে আমার।
আমি নাই, শুধু সে-ই আছে।
মজা করে একা-একা সে নিজের সাথে।

***
না আমি মসজিদের ইমানদার,
না আমি কাফেরদের আচার-অনুষ্ঠান,
না আমি ভেজালের অভ্যন্তরে খাঁটি।

না আমি বৈদিক,
না আমি হাজির আছি নেশালু জিনিসে,
না আমি হারানো, না আমি দূষিত।

না আমি মিলন, না আমি দুঃখ,
না আমি নিহিত আছি খাঁটি বা ভেজালে,
না আমি পানি, না মাটি।

না আমি আরবীয়, না আমি লাহোরি,
না আমি ভারতীয় শহর নাগুরির,
না আমি হিন্দি, না আমি পেশোয়ারের তুর্কি।

না আমি তৈরি করেছি বিশ্বাসের বিভাজন,
না আমি সৃষ্টি করেছি আদম ও হাওয়াকে,
না আমি রেখেছি নিজের নাম।

শুরু হোক বা শেষ হোক,
আমি কেবল নিজের সত্তা সম্পর্কে জানি,
দ্বৈততাকে স্বীকার করো না,
আমি ছাড়া আর কোনো জ্ঞানী নাই।

কে এই বুল্লে শাহ?
বুল্লে, আমি জানি না—কে আমি।

না আমি মুসা নবি, না আমি ফেরাউন,
না আমি আগুন, না আমি বাতাস,
না আমি বাস করি মাসুমদের নগরে।
বুল্লে শাহ, কে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে?

বুল্লে, আমি জানি না—কে আমি।
বুল্লে, আমি জানি না—কে আমি।

***
কেবল তুমিই আছো, আমি নাই, ওগো প্রিয়তম।
কেবল তুমিই আছো, আমি নাই।
ধ্বংস-হয়ে-যাওয়া বাড়ির ছায়ার মতো
আমার মনেই আমি ফিরে আসি ফের।
যদি আমি কথা বলি, তুমি বলো সাথে,
যদি আমি চুপ থাকি, তুমি জাগো মনে,
যদি-বা ঘুমিয়ে পড়ি, ঘুমাও আমার সাথে তুমি,
যদি হাঁটি, সাথী হও,
আহা, বুল্লে! আমার বাড়িতে স্বামী এসেছেন আজ।
জীবন আমার তার জন্যে নিবেদিত।
কেবল তুমিই আছো, আমি নাই, ওগো প্রিয়তম।

***
হাজিরা মক্কায় যায়।
প্রিয়তম রানজাই মক্কা আমার।
হ্যাঁ, আমি পাগলই হয়ে গেছি।

আমার হয়েছে বিয়ে রানজার সাথে।
আমার আব্বা তবু পিড়াপিড়ি করে বিয়ে দিতে।
হ্যাঁ, আমি পাগলই হয়ে গেছি।

হাজিরা মক্কায় যায়।
আমার অন্তরে থাকে স্বামী, সে-ই মক্কা আমার।
হ্যাঁ, আমি পাগলই হয়ে গেছি।

হাজি-গাজি সকলেই অন্তরে আছে,
চোর ও পকেটমার—তারাও রয়েছে।
হ্যাঁ, আমি পাগলই হয়ে গেছি।

হাজিরা মক্কায় যায়।
আমি যাই হাজেরার তখতের দিকে।
হ্যাঁ, আমি পাগলই হয়ে গেছি।

যেখানেই থাকে প্রিয়তম,
কাবা থাকে সেইখানে,
চারটি কেতাব তবু খুঁজে মরো তুমি।
হ্যাঁ, আমি পাগলই হয়ে গেছি।

***
আমাকে তোমার প্রেম নাচিয়েছে শুধু সারাক্ষণ।
তোমার প্রণয়ে পড়া মানে বিষ খাওয়া এক গ্লাস।
হেকিম আমার, এসো, এ আমার শেষের প্রহর।
আমাকে তোমার প্রেম নাচিয়েছে শুধু সারাক্ষণ।

***
প্রেমে যে মজেছে সেই জন
গান গায় নাচে সারাক্ষণ।

প্রেমিকের জামা যে পরেছে
তার উপর আশিস ঝরেছে।

পেয়ালায় সে দেয় চুমুক,
প্রশ্ন-জবাব নাই—আছে শুধু সুখ।

প্রেমে যে মজেছে সেই জন
গান গায় নাচে সারাক্ষণ।

প্রিয়তম আছে যে-হৃদয়ে,
পূর্ণ তা প্রণয়ে-প্রণয়ে।

নাই আর নিয়ম-আচার,
আছে শুধু উল্লাসে বাঁচা।

প্রেমে যে মজেছে সেই জন
গান গায় নাচে সারাক্ষণ।

***
ফেরাও তোমার মুখ এ-আমার দিকে, ওগো প্রিয়,
ফেরাও তোমার মুখ এ-আমার দিকে।

গেঁথেছো আমাকে তুমি—তুমিই—বড়শিতে,
টেনেছো আমাকে তুমি—তুমিই—সুতায়।
ফেরাও তোমার মুখ এ-আমার দিকে।

এসেছে আজান নেমে তোমারই আরশ হতে, আর
মক্কায় প্রতিধ্বনি।
ফেরাও তোমার মুখ এ-আমার দিকে।

বুল্লে বলছে, আমি কোনোদিনও মরব না, তবে
আর কেউ মরলে মরবে।
ফেরাও তোমার মুখ এ-আমার দিকে।

***
সে আমারে ছেড়ে গেছে, নিজেই বিদায় নিয়ে, হায়!
কী আমার দোষ ছিল? কী আমার অপরাধ ছিল?
না দিনে না রাতে আমি ঘুমাই শান্তিতে,
দুচোখ আমার শুধু পানি ফেলে যায়।
তলোয়ার-বল্লম তীক্ষ্ণ যতই
তারও চেয়ে বেশি ধার প্রেমের তীরের।
প্রেমের চাইতে বেশি নিষ্ঠুর নয় আর কেউ,
এ অসুখ সারাতে পারে না কোনো বৈদ্য-হেকিম,
বিরহের বেদনা প্রবল এত, গাঢ়।
বুল্লে, মালিক যদি ঝরাতেন করুণার ধারা,
রাতারাতি পাল্টে যেত আমার সময়।
সে আমারে ছেড়ে গেছে, নিজেই বিদায় নিয়ে, হায়!
কী আমার দোষ ছিল? কী আমার অপরাধ ছিল?

***
বহুত হয়েছে, বহুত;
কথা কও তুমি আমার সঙ্গে হেসে।

তুমি তো আমার হৃদয়েই করো বাস,
তবুও কেন যে আমাকে ছলনা করো!
আমার দু ঠোঁটে তোমার নামের জিকির,
তবু বারেবারে কেন তুমি সরে পড়ো!
বহুত হয়েছে, বহুত।

যে মরেই গেছে মারছো আবার তারে,
আমার মাথা কি তোমার ব্যাটের বল?
কণ্ঠে আমার কথাকে থামিয়ে দাও,
তোমার তীরের নিশানা বড় সফল।

পালাবে কোথায়? ফেলেছি তোমাকে ধরে,
বেঁধেছি তোমাকে আমার চুলের সাথে;
তবু দেখি তুমি পলায়নে তৎপর!
পাবে না সুযোগ এ দফায় অজুহাতে :
বহুত হয়েছে, বহুত!

বুল্লে বলছে, আমি দাস, ওগো প্রভু,
একটি পলক তোমাকে দেখতে চাই;
বারবার বলি, আমার হৃদয়টাকে
তোমার খোলসে আবৃত দেখতে চাই :
বহুত হয়েছে, বহুত।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;