মহামারি প্লেগ যেভাবে শেক্সপিয়ারকে প্রভাবিত করেছিল



পল ইয়ানেন
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

“মহামারি প্লেগের মধ্য দিয়ে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ভাবতে চেয়েছেন এমন একটা পৃথিবীর কথা, যেখানে বিষ-পয়জন নেই, মিথ্যা অপবাদ নেই, এবং নেই অশুভ দৃষ্টি।”

মহামারি প্লেগের সময়ে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার পৃথিবীতে ছিলেন। শেক্সপিয়ারের জন্ম ১৫৬৪ সালের এপ্রিল মাসে। তার জন্মের কয়েক মাস পরেই সমস্ত ইংল্যান্ডে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে, এবং শেক্সপিয়ারের নিজের বসবাসকৃত শহরের এক চতুর্থাংশ লোক তাতে মৃত্যুবরণ করে।

প্লেগে আক্রান্ত মৃত্যু ছিল দুঃসহ যন্ত্রণার। আর সেটা সচক্ষে দেখা ছিল আরো ভয়াবহ ব্যাপার। প্লেগ মহামারি নিয়ে তখন মানুষের মাঝে যথেষ্ট অজ্ঞতা থাকার কারণে সংক্রমণটি এরকমভাবে ছড়িয়েছিল যেন এটি একজন রাগত ঈশ্বরের কাছ থেকে আসা কোনো শাস্তি। প্রতীয়মান হয়েছিল, পৃথিবী হয়তো এর মধ্যদিয়েই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

শেক্সপিয়ারের লেখক-নাট্যকার হিসেবে জীবন শুরুর পরে প্লেগ বারবার ইংল্যান্ডে আঘাত হেনেছে, বিশেষত ইংল্যান্ডের রাজধানীতে—একবার ১৫৯২ সালে, তারপরে ১৬০৩ সালে, তারপরে আবারও ১৬০৯ সালে। ওই সময়ে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা যখনই সপ্তাহে তিরিশের ঊর্ধ্বে চলে যেত, লন্ডন-কর্তৃপক্ষ তখনই শহরের সব রঙমহল বন্ধ করে দিত। ১৬ শতকের প্রথম দশকে লন্ডনের রঙমহলগুলো যতদিন না খোলা ছিল, তারচেয়ে বেশি সময় সেগুলোকে বন্ধই রাখতে হয়েছে।

শিল্পীর তুলিতে ১৫৯২ সালের প্লেগ মহামারি

মহামারি প্লেগ শেক্সপিয়ারের জীবনে একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। প্লেগের ভয়াবহ সংক্রমণ এবং এর ফলে উদ্ভূত সামাজিক অচলতার মুখে মানুষের জীবন কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, এবিষয়টি সতর্কতা তৈরির ভঙ্গিতে শেক্সপিয়ারের বেশ কয়েকটি নাটকে উঠে এসেছে।

জুলিয়েটের বার্তাবাহক কোয়ারেন্টিনে
‘রোমিও জুলিয়েট’ নাটকের কথা বাদ দিলে শেক্সপিয়ারের কাজে কিভাবে প্লেগের উপস্তিতি আছে, তা বোঝা একটু মুশকিল। কেননা ‘রোমিও জুলিয়েট’-এর সম্পূর্ণ আদল বা ভাষার মধ্যেই, এর পুরো চিত্রনাট্য জুড়েই জীবন-সম্বন্ধীয় গভীর চিন্তাভাবনাগুলো প্রোথিত হয়েছে। ‘টুয়েল্ফথ নাইট’ নাটকটিতে অলিভিয়ার একদা মনে হয়েছে, ভালোবাসা তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটা যেন প্লেগের সংক্রমণের মতোই। এক জায়গায় সে বলেছে, “এরকম দ্রুতই হয়তো কেউ প্লেগে আক্রান্ত হয়।”

‘রোমিও জুলিয়েট’ নাটকে জুলিয়েটের ভুয়া মৃত্যুর যে চিঠি রোমিওর কাছে পাঠানো হয়েছিল, সেই চিঠি রোমিওর কাছে গিয়ে পৌঁছায়নি, কারণ চিঠিটি যথাস্থানে পৌঁছাবার আগেই প্লেগ সন্দেহে বার্তাবাহককে কোয়ারেন্টিনে চলে যেতে হয়েছিল। ফলস্বরূপ, ‘রোমিও জুলয়েট’ নাটকটিও শেষ হয়েছিল একটি মারাত্মক পটপরিবর্তনের মধ্যদিয়ে। জুলিয়েট যে জায়গায় মরার মতো পড়েছিল, সেখানে পৌঁছানোর পরে রোমিও তার প্রেমিকাকে মৃত দেখে আত্মহত্যা করল। আর জুলিয়েট যখন উঠল, সেও তার প্রেমিককে মৃত দেখতে পেল, তখন সেও আত্মহত্যা করল।

শেক্সপিয়ারের সবচাইতে কঠিনতম ট্রাজেডি ‘কিং লেয়ার’ নাটকের শেষ দিনগুলোতে এক চূড়ান্ত অসুস্থ পৃথিবীর চিত্রায়ণ করা হয়েছিল। সেখানে লেয়ার তার মেয়ে গনেরিলকে গালি দিয়েছিল “তুই একটা ফোঁড়া” বলে (ফোঁড়া প্লেগের সিন্ড্রম)। সে বলেছিল, “শেষ পর্যন্ত আমার দূষিত রক্তেও প্লেগ পৌঁছে গেছে!”

‘কিং লেয়ার’ নাটকের শেষদিকে একটি ভগ্নদশা পৃথিবীতে অল্প কিছু মানুষ টিকে ছিল। করোনাভাইরাসের এই মহামারির সময়ে আমরা টিকে-থাকারা যেরকমটা ভাবছি, অনেকটা সেরকমই সেই অবস্থা। আমাদের এই তুলনা এমন ভুল কোনো কিছু না।

এটা জানা থাকা ভালো যে, সময়ের হাত ধরে পেছনে ফিরে গেলে আমরা মানুষেরা নিজেদেরকে উদ্ধার করব কখনো “গভীর কাদার মধ্যে, যেখানে দাঁড়াবার কোনো অবস্থা ছিল না”, অথবা কখনো “গভীর জলে, যেখানে বন্যা আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল।” বাইবেলের প্রার্থনাগীতে মানুষের এই দুটি করুণ অবস্থার উল্লেখ রয়েছে।

দূষিত দৃষ্টি
তবে, শেক্সপিয়ার আমাদেরকে অন্য একটি ইতিবাচক পন্থাতেও বিষয়গুলো দেখিয়েছেন। ১৬০৯ সালের প্লেগের পরবর্তীকালে শেক্সপিয়ার তার দর্শকদেরকে সঞ্জীবনীমূলক একটি বিস্ময়কর সুন্দর নাটক উপহার দিয়েছিলেন। নাটকটির নাম ‘সিমবেলিন’। ইউনিভার্সিটি অব নিউ ব্রাউন্সিক-এ রেন্ডাল মার্টিন পরিচালিত ‘সিমবেলিন এন্থ্রপসিন প্রজেক্ট’সহ, অস্ট্রেলিয়া থেকে কাজাখিস্তান পর্যন্ত পৃথিবীর সব থিয়েটার কোম্পানিই মনে করে ‘সিমবেলিন’ নাটকটি আমাদের এই বর্তমান সময়কে কার্যকরী দৃষ্টিতে দেখবার পক্ষে একটি বিবেচনাযোগ্য পন্থা হতে পারে।

‘সিমবেলিন’ শেক্সপিয়ারের দর্শকদেরকে একটি প্লেগমুক্ত পৃথিবীতে নিয়ে গিয়েছিল বটে, তবে সেটাও, ‘সংক্রমণ’ বা দূষণের বিপদগুলোকে নিয়েই গঠিত একটি নাটক। ‘সিমবেলিন’-এর প্রধান অসৎ চরিত্র, অর্থাৎ রাজপ্রাসাদের রানী, সে কুকুর-বিড়ালদের ওপর বিষের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাত। এমনকি, তার সৎ মেয়ে আইমোজেনকে সে বিষ দিয়ে হত্যা করবার পরিকল্পনা করেছিল।

এইভাবে সরাসরি দূষিত করে হত্যার বিষয়টি এক পর্যায়ে মিথ্যা-অপবাদে রূপ নেয়। যা কিনা ভাইরাসের মতোই মুখ থেকে মুখে ছড়িয়ে যেতে পারে। এই অপবাদের টার্গেটও ছিল ওই আইমোজেন। আইকামো নামের এক লোক আইমোজোনের সতীত্ব নষ্ট হওয়ার একটা দুর্বল মিথ্যা গল্প ফাঁদে। যা আইমোজেনের দেশান্তরিত স্বামী পসথুমাসও শুনতে পায়। পসথুমাস ইতালি থেকে চিঠি মারফত এক ভৃত্যকে নির্দেশ দেয় তার স্ত্রী আইমোজেনকে হত্যা করতে।

এই নাটকের পুরো জগৎটাই অশুভ-দৃষ্টির দ্বারা কলুষিত হয়ে যায়। যেখানে একথাও পরিষ্কার হয় যে, ন্যাক্কারজনক কিছুর চর্চা মানুষকে অসুস্থ করে দিতে পারে। কল্যাণকামী ডাক্তার করনিলিয়াস রানীকে বলে, “এই বিষ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আপনার অন্তরজগতকে কঠিন করে তুলবে। এই বিষের পীড়া ও সংক্রমণ—দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই।”

আরো একটি বিষয় এই নাটক অবহিত করে। তা হলো, শত্রুভাবাপন্ন লোকেদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকাও বিষে আক্রান্ত হওয়ার যন্ত্রণা দিতে পারে। আইমোজেন যখন তার স্বামীকে বিদায় জানাচ্ছিল, তখন সে চারিপার্শ্বের লোকেদের অশুভ দৃষ্টিকে নির্দেশ করে বলেছিল—“তোমাকে অবশ্যই যেতে হবে, আর আমাকে এখানে প্রতিটি মূহূর্ত উপেক্ষা করতে হবে—ওইসব অশুভ রক্তচক্ষু!”

যাত্রীদল এবং কল্যাণকামী চিকিৎসকেরা
শেক্সপিয়ার আমাদেরকে এই ভগ্নদশা পৃথিবী থেকে একটি সুন্দর পৃথিবীর দিকে পথ দেখিয়েছেন। তবে এটা একটা কঠিনতম যাত্রা। আইমোজেন রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যায়, এবং ওয়েলসের সুপ্রাচীন পাহাড়গুলোর দিকে যাত্রা করে। ব্রিটেনের উল্লেখযোগ্য পৌরাণিক চরিত্র আর্থার কিং এই ওয়েলসেরই বাসিন্দা ছিলেন। তো, আইমোজেন সেই প্রকৃতির কাছে ফিরে যায়, যেখানে তার পরিবার, এমনকি তার জাতিসত্তারও গোড়াপত্তন হয়েছিল।

বিষয় হলো, আইমোজেনের হারিয়ে যাওয়া দুই ভাই ওয়েলসের ওই জঙ্গলের থাকত। আইমোজেন তাদের সঙ্গে গিয়ে পুনর্মিলিত হলো। যদিও তারা তিনজনের কেউই জানত না, এই দুই ভাই রাজপ্রাসাদ থেকে হারিয়ে যাওয়া দুই রাজপুত্র।

নাটকটি এই পর্যন্ত আসবার পরে সকল সংকটের অবসান হয়ে যেতে লাগল বৈকি, কিন্তু ঘটনা তখনও অনেকখানি বাকি ছিল। আইমোজেনকে প্রথমে বেঁচে থাকতে হলো, এবং বেঁচে থাকার ফলেই সে কথা বলতে পারল তার নিজের এবং তার স্বামীর [সম্ভাব্য] মৃত্যু নিয়ে।

সে একদিন ওষুধের শিশিটা খুলে ওষুধটা খেয়ে নিল। না জেনে যে, এটা আসলে ছিল রানীর দেওয়া বিষের শিশি। দুই ভাই বাইরে থেকে এসে আইমোজেনকে মৃত অবস্থায় পেল। এবং তারা তাকে নাটকের ভিলেন চরিত্র ক্লোটেনের মুণ্ডুহীন মৃতদেহের পাশে শুইয়ে দিল।

ডাক্তারের প্রতি কৃতজ্ঞতা, সে রানীর বিষের শিশিকে একটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে বদলে দিয়েছিল। ফলে আইমোজেন মারা গেল না। সে ঘুম থেকে উঠে তার পাশে একটি মুণ্ডুহীন মৃতদেহ দেখতে পেল, এবং ভেবে নিল এটা তার স্বামী পসথুমাসের দেহ।

অর্থহীন জীবনকে আলিঙ্গন
এই ঘটনার পরে, বেঁচে থাকার আর কোনো অর্থ না থাকা সত্ত্বেও আইমোজেন বেঁচে রইল, এবং সামনের দিকে এগিয়ে গেল। আদতে, তার এই ‘অর্থহীন’ জীবনটাকে আলিঙ্গন করে নেওয়াই ছিল বিজ্ঞতা। যার ফলশ্রুতিতেই মূলত আইমোজেন তার নিজের এবং নাটকের অন্যান্য চরিত্রদের একটি সুখিজীবনের পুনঃসূচনা করতে পেরেছিল।

নাটকের শেষে, আইমোজেনসহ সব চরিত্ররা একস্থানে মিলিত হলো। মিথ্যাবাদী আইকামো স্বীকার করল, সে আইমোজেনের ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল। একে একে সবগুলো সত্য বের হয়ে আসলো। এই সত্যরা মিথ্যার পুরো জগৎটাকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দিল।

আইমোজেনের স্বামী পসথুমাস, যে জানত তার নির্দেশে আইমোজেনকে হত্যা করা হয়েছে, সে তার ভুল বুঝতে পেরে নিজের মৃত্যুকামনা করল। আইমোজেন দৌড়ে গিয়ে তাকে আলিঙ্গন করল, কিন্তু হতাশায় বিদ্ধ হয়ে পসথুমাস আইমোজেনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। আবারও সেরকম অবস্থা, যখন আইমোজেনের বেঁচে থাকবার কোনো অর্থ হয় না, কিন্তু পরক্ষণেই সে সম্বিৎ ফিরে পেল, এবং বুঝতে পারল—না, এবার সে বেঁচে থাকতে পারবে। তারা স্বামী-স্ত্রী পুনর্মিলিত হলো। আইমোজেন তখন বলল, “তোমার বিবাহিত স্ত্রীকে তুমি কেন ছুঁড়ে ফেলছো? তুমি ভাবো, যে তুমি একটা টিলার উপরে দাঁড়িয়ে আছো, এবং পুনরায় আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দাও!”
পসথুমাস উত্তর দিল, “ফলের ঝুলে থাকার মতো তুমি ঝুলে থাকো যতক্ষণ না গাছটি নিজেই মারা যায়।”

পৃথিবী রক্ষা পেল
আইমোজেন আর পসথুমাস উপলব্ধি করল, একটি সুন্দর জীবনে আমরা তখনই মিলিত হতে পারি, যখন সত্যিকারের প্রাকৃতিক পৃথিবীর গভীরে আমাদের শেকড় প্রোথিত হয়, এবং যখন আমরা বুঝে উঠতে পারি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই মারা যাব।

এই বিষ-পয়জন, মিথ্যা অপবাদ আর অশুভ দৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়া এক পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে তখন সব চরিত্ররা মুক্তভাবে দৃষ্টিবিনিময় করল। আইমোজেন এখন কী দেখছে, এবং কিভাবে তাকে দেখা হচ্ছে, এই বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাজা স্বয়ং বলল, “পসথুমাস আইমোজেনের নিকট নোঙর ভিড়িয়েছে। এবং আইমোজেন, অনুজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে পসথুমাসের দিকে, তার ভাইদের দিকে, আমার দিকে, তার শিক্ষকের দিকে, আর সে উদ্ধার করে আনছে—প্রতিটি আনন্দের বিষয়!”

বর্তমানের অনিষ্ট থেকে বাঁচতে আমাদের প্রতিনিয়ত ‘কল্যাণকামী চিকিৎসক’দেরই প্রয়োজন হবে। কিন্তু সেইসঙ্গে আমরা আইমোজেনকেও অনুসরণ করতে পারি। তার সবকিছু হারাবার অভিজ্ঞতা আমাদেরকে এই প্রচণ্ড ভয়ের অবস্থা থেকে সারিয়ে তুলতে পারে। আমরা আইমোজেনের কাছ থেকে শিখতে পারি—কিভাবে আবার একটি সুন্দর পৃথিবীর দিকে যাত্রা করতে হয়।


পল ইয়ানেন
অধ্যাপক, শেক্সপিয়ার স্টাডিজ, ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি

অনুবাদ : যাকওয়ান সাঈদ

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;