দূরত্ব-বিচ্ছিন্নতার ছবি এঁকে বিখ্যাত যিনি



ফারহানা আজিম শিউলী
আত্মপ্রতিকৃতি: এডওয়ার্ড হপার / অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

আত্মপ্রতিকৃতি: এডওয়ার্ড হপার / অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

করোনা-বাস্তবতার কারণে দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা—এ বিষয়গুলো এখন মেনে চলার চেষ্টা করছেন সবাই। এডওয়ার্ড হপার নামে বিখ্যাত মার্কিন চিত্রশিল্পী বিশ শতকে দূরত্ব আর বিচ্ছিন্নতাকে উপজীব্য করে রাঙিয়ে তুলেছিলেন তাঁর ক্যানভাস। কেন তিনি এ ধরনের ছবি এঁকেছিলেন? ঘরবন্দী থাকার সময়ে এই প্রশ্নের তত্ত্ব-তালাশ।

করোনা-পরিস্থিতির কারণে আজ ‘স্যোশাল-ফিজিক্যাল ডিসটেন্সিং’ বা ‘সামাজিক-শারীরিক দূরত্ব’, ‘আইসোলেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতা’—শব্দগুলো খুবই পরিচিত আমাদের কাছে। আজ থেকে বহু বছর আগেই মার্কিন চিত্রশিল্পী এডওয়ার্ড হপার (২২ জুলাই ১৮৮২-১৫ মে ১৯৬৭) বিখ্যাত ছিলেন সামাজিক-শারীরিক দূরত্ব-বিচ্ছিন্নতার ছবি আঁকার জন্য। বাস্তববাদী ধারার এই চিত্রকর বিশশতকের প্রথমার্ধে পরিত্যক্ত-ধ্বংসোন্মুখ-পতিত-বেওয়ারিশ নাগরিক জীবন ও সামাজিক-শারীরিক দূরত্ব-বিচ্ছিন্নতার ছবি কেন এঁকেছিলেন, তার তত্ত্ব তালাশ করতে বসলে শিল্প সমালোচকেরা বহুবিধ কারণ হয়তো বের করতে পারবেন। তবে বর্তমানের এই করোনা-উদ্ভূত বাস্তবতার কারণে এই শিল্পী আবারও মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। প্রবলভাবে পুনরুত্থিত হয়েছে তাঁর চিত্রকর্ম। ইন্সটাগ্রাম ও টুইটারে তাঁর চিত্রকর্মগুলো শেয়ার হয়েছে, হচ্ছে অসংখ্যবার। যদিও তিনি অর্ধ শতক আগেই মর্ত্যলোক ছেড়েছেন এবং ইতিহাসের একদম ভিন্ন সময়ে জন্মেছিলেন।

হপার পরিত্যক্ত শহুরে ল্যান্ডস্কেপ এবং আইসোলেটেড ফিগারে, একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাকে ধরেছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের এই অতিমারি তাঁর শিল্পকর্মকে দিয়েছে অন্য এক দ্যোতনা, অন্য মাত্রা, অন্যরকম প্রাসঙ্গিকতা। বলা হচ্ছে, ‘আমরা সবাই এখন এডওয়ার্ড হপারের পেইন্টিং’। তিনি এখন হয়ে উঠেছেন কোয়ারেন্টাইন কালচারের ‘পোস্টার বয়’।

এই সময়ে এসে জনপরিসরে হপারের এই সাম্প্রতিক পুনরুত্থান আমাদের বর্তমান দুর্ভাগ্যজনক অবস্থার দিকেই চোখ ফেরায়। আমরা যখন অবাঞ্ছিত অতিথি ‘করোনাভাইরাস’ আমাদের বাড়ি ছেড়ে যাক এমন অপেক্ষায় দিন গুনছি, ঠিক তখনই আমরা দেখছি যে, পৃথিবীটাকে অদ্ভুতুড়েভাবে তাঁর কিছু চিত্রকর্ম—যেমন ‘হাউস বাই দ্য রেইলরোড’ (১৯২৫), ‘অটোম্যাট’ (১৯২৭), ‘রুম ইন নিউইয়র্ক’ (১৯৩২), ‘নাইটহকস’ (১৯৪২), ‘কেইপ কড মর্নিং’ (১৯৫০), ‘অফিস ইন আ স্মল সিটি’ (১৯৫৩), ‘সান ইন অ্যান এম্পটি রুম’ (১৯৬৩), ‘মর্নিং সান’ (১৯৫২) কিংবা ‘ইন্টারমিশন’ (১৯৬৩)—এসব চিত্রকর্মের মতো দেখাচ্ছে। হপারের অনেক ছবিতেই যেন এখনকার আমরা; ফাঁকা সিনেমা হলে বসে থাকা একাকী এক নারী দর্শক, বেদনাবিধুর এক মানুষ তার আধুনিক অ্যাপার্টমেন্টে, একাকী এক দোকানদার, এক ডিনার টেবিলে একে অপরের থেকে দূরত্বে বসে থাকা মানুষ—এ তো আমাদের বর্তমানেরই প্রতিচ্ছবি।

ইন্টারমিশন, ১৯৬৩

হপারের সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘নাইটহকস’-এ দেখা যায়, রাতে আলোকিত এক ডিনারে চার খাবারক্রেতা ও একজন ওয়েটার। এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে আঁকা। ওয়েটার এবং বাইরের জগতের সঙ্গে মানুষগুলোর বিচ্ছিন্নতা-সংযোগহীনতা ওই যুদ্ধকালীন সময়ে সৃষ্ট মানুষের অন্তর্গত বোধেরই এক বহিঃপ্রকাশ। করোনাকালীন সময়ে মানুষের অনুভূতির সঙ্গে ‘নাইটহকস’ যেন তাই একীভূত হয়ে গেছে। একীভূত হয়ে গেছে কফি হাতে একাকী বসে থাকা নারীর ‘অটোম্যাট’ চিত্রকর্মটিও।

নাইটহকস, ১৯৪২

হপারের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন বিশ্বনন্দিত ইংরেজ চলচ্চিত্রকার আলফ্রেড হিচকক। ১৯২৫ সালে হপারের আঁকা ‘দ্য হাউস বাই দ্য রেইলরোড’ ছবিটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হন তিনি। হপার এ ছবিতে রেলের রাস্তা দিয়ে বিচ্ছিন্ন এক অদ্ভুত পুরনো বাড়ি এঁকেছেন। এতে তখনকার প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হতে যাওয়া আমেরিকা প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানে পুরনো বাড়িগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যাচ্ছে, আর প্রবেশ করছে রেললাইন। উন্নয়ন নাটকীয়ভাবে বদলে দিচ্ছে আশপাশ। ছবিতে দেখা যায়, আঁকা বাড়িটি বিচ্ছিন্ন ও নির্জন।

অটোম্যাট, ১৯২৭

এই ছবির অনুপ্রেরণায় হিচকক তাঁর ১৯৬০ সালের পৃথিবীবিখ্যাত হরর ক্ল্যাসিক ‘সাইকো’ চলচ্চিত্রে স্থান দেন ‘বেইটস ম্যানসন’কে। বলা দরকার, হপারের ছবিটি আঁকার সময়ের যে ধারণা—উন্নয়ন আসলে বিচ্ছিন্নতার একটি উপাদান—সেটি হিচককের ‘সাইকো’র সময়েও প্রাসঙ্গিক ছিল, যেখানে বিচ্ছিন্ন-নিঃসঙ্গ-নিভৃত নির্জনতায় একজন মানুষের উন্মাদনা সুতীব্র হয়ে ওঠে। আর এখন এই অতিমারির স্বেচ্ছা কিংবা মেনে নেওয়া বন্দীত্বে বিষয়টি তো আরো বেশি মূর্তমান।

হাউস বাই দ্য রেইলরোড, ১৯২৫

হপারের এই মনস্তাত্ত্বিক চিত্রকর্মগুলোর সময়কাল ১৯২০-৫০ এর দশক জুড়ে। ছবিগুলো একরকম অস্বস্তির শিহরণ জাগায় এবং ‘একটি জাতির আর্ট তখনই মহত্তম হয়ে ওঠে যখন তাতে তার মানুষের চরিত্রের প্রতিফলন থাকে’—শিল্পীর এই দর্শনকে মূর্তমান করে তোলে।

হপার তাঁর সময়ের সামষ্টিক বোধকে ধারণ করার পাশাপাশি কিন্তু নিজের অজান্তেই বর্তমানের বৈশ্বিক অতিমারির অন্তর্নিহিত বোধকেও ধারণ করেছেন।

কিছুদিন আগেও আমরা অনেকেই অত্যন্ত দ্রুতগতির এক খ্যাপাটে পৃথিবীতে কাজকর্ম করেছি, দিনযাপন করেছি, যেখানে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল অত্যধিক ক্যাফেইন, অনিঃশেষ সুযোগসুবিধা, জনসমাগম, গণপরিবহন ইত্যাদি। আর আজ আমরা অনেকেই হয়তো একাকী, সোফায়-বিছানায় শুয়ে-বসে অফিস করছি। এটি আক্ষরিক অর্থেই হপারের ৭০ বছর বয়সে আঁকা ছবি ‘মর্নিং সান’-এর নারীটির মতো। করোনাকালের সময়টা আমরা যে কতটা নগণ্য ও ক্ষুদ্র, পদে পদে তা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এখন দুনিয়াজুড়ে শুধু পরিসংখ্যানিক বিশ্লেষণ এবং ‘বিগ ড্যাটা’র রমরমা, মানুষের জীবনকে যা কিছু সংখ্যায় রূপান্তরিত করেছে। বৈশ্বিক মহামারিতে ‘মর্নিং সান’ ছবির বিছানায় স্থির হয়ে বসে থাকা নারীটির মতো কিংবা ‘কেইপ কড মর্নিং’-এর বে-উইন্ডো দিয়ে সকালের সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় বাইরে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকা নারীর মতোই আমরা যেন জালে আটকা পড়েছি ছোট্ট এক মাছের মতো, প্রকৃতির দাক্ষিণ্যে, যাতে আমাদের ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ নেই।

মর্নিং সান, ১৯৫২

হপারের ছবিতে পাই প্রশান্তি, কোলাহলশূন্যতা ও স্তব্ধতা। বিষণ্ণতার জন্য তাঁর অধিকাংশ আলোচিত চিত্রকর্ম মানসিক রোগাক্রান্তদের অন্তর্জগতের কথাও বলে। আর এই মানসিক অসুস্থতা এই করোনাকালের অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটা বিষয়। আমরা এখন ভীত, আতঙ্কিত, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় মানসিকভাবে অনেকটা পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো দিন পার করছি। এমন এক সময়ে বাস করছি, যাকে বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা ‘বার্ন আউট’ সংস্কৃতি নাম দিয়েছে এবং এই সংস্থাটি গত বছর দাবি করেছিল, এটি বৈশ্বিক মহামারির জন্ম দেবে, এবং সেটিই সত্যি হয়েছে। অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই আমরা অতি আগ্রাসী এবং গোপনে অনিষ্টকর এক অতি ছোঁয়াচে ভাইরাসের কারণে ঘরে ঠাঁই নিতে বাধ্য হয়েছি, বাধ্য হয়েছি নিজেদেরকে শান্ত ও স্থিত করতে।

কেইপ কড মর্নিং, ১৯৫০

কাকতালীয়ভাবে আমাদের ইতিহাসের যুগ শিল্পী হপারের পার করা সময়ের প্রতিধ্বনি তুলতে শুরু করেছে। তিনি পেয়েছিলেন ১৯১৮-এর স্প্যানিশ ফ্লু, ১৯৩০-এর ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’জনিত তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা, আর দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ। হপার একটা ভয়ের ও অনিশ্চিত পৃথিবীতে বাস করছিলেন, যা তাঁকে বাধ্য করেছিল অশান্ত পরিবেশে একাকী চরিত্র আঁকতে। আমরাও এখন প্রতিনিয়ত এক ভীতিকর-আতঙ্কিত সময় পার করছি। ইতিহাসের এক বিপজ্জনক সংকটের সাক্ষী হতে চলেছি আমরা।

হপারের কাছে আধুনিক জীবন অবন্ধুজনোচিতের চূড়ান্ত। তাঁর চরিত্রগুলোর দূরত্ব-বিচ্ছিন্নতা-একাকিত্বের জন্য কোনো অতিমারির দরকার পড়েনি। কাচের বড় জানালা ঘেরা, উঁচু নাগরিক দালানের স্বয়ংসম্পূর্ণ অ্যাপার্টমেন্টে বাস করা মানুষজন, নির্জন এলাকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা গ্যাস-স্টেশন—মোটকথা, আধুনিক নগর ও ল্যান্ডস্কেপের নির্মাণই তাঁর কাছে অসম্ভব নিঃসঙ্গতা তৈরির যন্ত্রের মতো। তাঁর চরিত্রগুলোর নিজেদের মধ্যে বিনিময়ের যেন তেমন কিছু নেই। বিচ্ছিন্ন, একাকী, স্বপছন্দের-স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষদের নিয়ে হপারের যে ভয়ংকর কল্পনা-দর্শন, তা আমরা সবাই হয়তো একরকম এড়িয়ে যেতে পারি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তা এখন আমাদের করতে হবে একে-অন্যের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে। এবং আমরা এও জানি, সবাই নিজ বাড়িতে একদম ঠিকঠাক আছে—এটি বর্তমান ভাইরাস অতিমারির একদম শূন্যগর্ভ এক প্রোপাগান্ডা।

সেই অনেক আগে থেকেই ছবিতে ছবিতে হপার যে বার্তা দিয়েছেন তা হলো আধুনিক জীবন হতে পারে ভীষণরকম একাকিত্বের। তাঁর চরিত্রগুলো ডিনার টেবিলে কিংবা রেস্টুরেন্টে যেমন বিচ্ছিন্ন, তেমনি তাদের অ্যাপার্টমেন্টের জানালায়ও। এই ব্যাপারে তিনি আধুনিকতাবাদী শিল্পকলার প্রতিনিধিত্ব করেন। বিশ্বখ্যাত নরওয়ের এক্সপ্রেশনিস্ট বা অভিব্যক্তিবাদী চিত্রশিল্পী এডওয়ার্ড মুঙ্কও তাঁর বিকট নিশাস্বপ্নের মতো ‘ইভিনিং অন কার্ল জোহান স্ট্রিট’ নামে ১৮৯২ সালে আঁকা ছবিতে দেখিয়েছেন, একটা জটলাও কী ভীষণরকম নিঃসঙ্গ জায়গা হতে পারে।

ইভিনিং অন কার্ল জোহান স্ট্রিট, ১৮৯২

সত্যি বলতে, একাকিত্ব সমসাময়িক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, বিশেষত ব্যক্তি যখন বড় শহরের বাসিন্দা। এই কারণেই আমাদের সবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি এত আসক্তি। এটি অন্যের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ স্থাপনের একটা মাধ্যম যেমন, তেমনি ভেতরের আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ মুখোশে লুকিয়ে রাখবার অন্তর্জালিক আবরণও বটে।

আমরা এখন নিজেদের বিচ্ছিন্নতা আড়াল করে একরকম ভালোই আছি। হপারের মতো শিল্পীরা এই বিচ্ছিন্নতাকেই আধুনিক অবস্থার নির্ণায়ক বলেছেন। স্বাভাবিক সময়ে আমরা ক্যাফেতেও একা বসি, পার্থক্য এটুকুই; যদিও এখন হাতে থাকে আমাদের ‘সামাজিক’ সত্তার প্রতীক সেলফোন। বাস্তবতা হলো, আধুনিকতা জনসাধারণকে নাগরিক জীবনযাত্রার দিকে ঠেলে দিয়েছে, যা একসময়কার প্রথা ‘যূথবদ্ধতা’কে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা মুক্তি-স্বাধীনতা চেয়েছি বলেই নিঃসঙ্গতাকে বেছে নিয়েছি। কিন্তু হপারের চিত্রকর্ম একটা কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে আমাদের—আধুনিক জীবনের স্বাধীনতাই যদি চলে যায় তবে একাকিত্ব ছাড়া আর কী বাকি রইল?

করোনা-বাস্তবতায় আশঙ্কা-উদ্বেগের প্রতীক হয়ে ওঠা হপারের চিত্রকর্ম আবার একইসঙ্গে কিছুটা হয়তো স্বস্তির বাতাসও বইয়ে দিতে পারছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যত বেশি তাঁর ছবিগুলো ভাগাভাগি হচ্ছে, ততই আমরা মনে করতে পারছি, এই করোনাকালে আমরা সবাই একই তরণীর যাত্রী, সবাই ফেসবুক-টুইটার ঘেঁটে চলছি, মানব অস্তিত্বের ভবিতব্য নিয়ে আলোড়িত হচ্ছি সবাই আমরা কমবেশি।

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;