পারভিন শাকিরের কবিতা



রূপান্তর: সৈয়দ তারিক
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

[উর্দু কবিতার উজ্জ্বল ঐতিহ্য কয়েক শতাব্দীর। কিন্তু মির তকি মির, মির্জা গালিব, ইকবাল, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, আহমেদ ফারাজ—উর্দু ভাষার মহিমান্বিত কবিরা সবাই পুরুষ। সব ভাষাতেই অবশ্য কবিতায়, সাহিত্যে, শিল্পে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সাধারণত পুরুষেরই আধিপত্য ছিল, তবে অনেক ভাষাতেই প্রাচীন আমল থেকেই দু-চারজন বিখ্যাত নারী কবির সন্ধান মেলে। উর্দু ভাষায় উল্লেখযোগ্য নারী কবিদের পাওয়া যায় বিংশ শতাব্দীতে এসে।

আদা জাফরি, জেহরা নিগাহ, কিশওয়ার নাহিদ, ফাহমিদা নিয়াজ প্রমুখ নারী উর্দু ভাষার কবি হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাব্যসাফল্য অর্জন করেছেন পারভিন শাকির। তার কবিতা অনবদ্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।

উর্দুভাষার এই অনন্য আধুনিক কবি পারভিন শাকির পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫২ সালে। অল্প বয়স থেকেই তিনি লিখতে শুরু করেন। কবিতা ও গদ্য দুটোই লেখেন তিনি। পত্রিকায় কলাম লিখতেন। ‘বীণা’ এই কলমি নামে আগে লিখতেন তিনি। পেশায় প্রথমে শিক্ষকতা করতেন, পরে পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন।

পারভিন শাকিরের প্রথম কবিতার বই ‘খুশবু’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। বেশ সুনাম অর্জন করে এটি। এরপর ক্রমে তার অন্যান্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয় : ‘সদ-বার্গ’ [জলাভূমির ফুল] (১৯৮০), ‘খুদ কালামি’ [ নিজের সাথে আলাপ] (১৯৯০), ‘ইনকার’ [ অস্বীকার] (১৯৯০) ও ‘কাফ-ই-আয়না’ [আয়নার কিনারা]। সব রচনাই প্রশংসিত হয়। তার কলামগুলো সংকলিত হয় ‘গোশা-ই-চাশম’ [চোখের কোণা] নামে। সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৭৬ সালে তিনি পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পদক ‘দ্য প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ লাভ করেন। তার কবিতাসমগ্র প্রকাশিত হয় ‘মাহ-ই-তামাম’ [পূর্ণ চাঁদ] নামে।

উর্দু কবিতার ঐতিহ্যশীল রচনা প্রকরণ গজল লেখেন তিনি। তার লেখা গজল মেহদি হাসান, নুসরাত ফতেহ আলি খান প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পী গেয়েছেন। তার গজলে ঐতিহ্যিক বিষয় ও ভঙ্গির সাথে আধুনিকতাকে মিশিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া তিনি আজাদ নজম অর্থাৎ মুক্তছন্দের কবিতা রচনা করেন। তার বিষয়বস্তুতে রোমান্টিক ভাবধারা যেমন আছে তেমনি সমকালীন বিভিন্ন বিষয়, নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঘটনার বয়ান, সামাজিক বিষয়-আশয় ইত্যাদি রয়েছে। কবিতায়, একজন নারী হিসেবে, তার ব্যক্তিত্ব বড় চমৎকার ফুটিয়ে তোলেন তিনি। ‘আমি’ কথাটি তিনি উর্দু ভাষায় স্ত্রী-লিঙ্গেই লেখেন, যা উর্দু কবিতার ঐতিহ্যে ছিল না। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, ইঙ্গিতময়তা, বাকসংক্ষেপ ইত্যাদির বিশিষ্ট প্রয়োগ আছে তার কবিতায়।

‘সে তো সৌরভ, হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে
ঝামেলা ফুলটি নিয়ে, ও কোথায় যাবে?’

এখানে অবিশ্বস্ত প্রেমিককে সুরভির সাথে আর প্রেমিকাকে ফুলের সাথে উপমিত করা হয়েছে। এরকম অজস্র প্রয়োগ আছে তার কবিতায়। প্রচলিত ইংরেজি শব্দ (যেমন, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর) অনায়াসে প্রয়োগ করেন তার কবিতায়। উর্দু কবিতায় তার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। এখন অবধি তিনি উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ নারী কবি।

পারভিন উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছিলেন। ইংরেজি ভাষাতত্ত্ব ও ইংরেজি সাহিত্যে তিনি দুইটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি পিএইচডি করেন। আবার পরে ব্যাংকিংয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসে উত্তীর্ণ হন ও তারপর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে লোকপ্রশাসনে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।

তিনি এক ডাক্তারকে বিয়ে করেছিলেন ও তাদের একটি পুত্রসন্তান হয়। কিন্তু বিয়েটা টেকেনি। বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছিল।

১৯৯৪ সালে তার মৃত্যু ঘটে দুর্ঘটনায়। ইসলামাবাদে অফিসে যাবার পথে তার গাড়ি একটি বাসের সাথে সংঘর্ষে পড়ে। এই ঘটনার পরিণতিতেই তিনি মারা যান। যেই রাস্তায় দুর্ঘটনাটি ঘটে পরে তার নামকরণ হয় পারভিন শাকির রোড। ইসলামাবাদেই তার সমাধি অবস্থিত।


গলন্ত সন্ধ্যায়

এই গলন্ত সন্ধ্যায়
সবকিছু মিলিয়ে যায়
তোমার পোশাকের ঘ্রাণ
আমার স্বপ্নের কুঁড়িগুলো
সবকিছু মিলিয়ে যায়

দৃষ্টি স্থগিত...

কিছুক্ষণের মধ্যে
দিগন্তে জাগবে একটি তারা
তোমার দিকে তাকাতে
অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে...

তোমার হৃদয় স্মরণ করবে তখন
একটি স্মৃতির প্রতিধ্বনি
একটি বিচ্ছেদের কাহিনী
একটি অসমাপ্ত মুহূর্তের কথা
না ফোটা স্বপ্নের, না বলা কথার...

আমাদের দেখা হওয়া দরকার ছিল
অন্য কোনো সময়ে
যখন স্বপ্নপূরণ হতে পারত
ভিন্ন আকাশের নিচে
ভিন্ন পৃথিবীতে
আমাদের দেখা হওয়া দরকার ছিল...

তোমার ভাবধারা

আমার প্রতি তোমার ভাবধারা যেন-বা তেমন
যেমন থাকে তূখোড় কূটনীতিকের
কোনো তরুণ সাংবাদিকের প্রতি
—প্রত্যেকটা কথায় আশার ইঙ্গিত,
সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে রাখা,
প্রতিটা শব্দ সাবধানে সুপরিমিত,
(উদ্ধৃতির তোড়ে বিষয়টাই হারিয়ে গেছে)।
তার কোনো কথাই তীরের মতন
ফিরে গিয়ে বিদ্ধ করবে না তাকে,
(যেন তাকে অনুতাপ করতে হয়)।

প্রত্যাবর্তন

চোখদুটো নমিত
কণ্ঠস্বর ক্লান্ত
কথা বলছে ভেঙে ভেঙে
চোখের পাপড়িতে জমে আছে ধুলো
রোদে পোড়া চেহারা।

আলুঝালু মাথাটি নত করে
এসেছে অনেক আগে হারিয়ে যাওয়া বন্ধু।
হৃদয় প্রলুব্ধ হয়ে উঠল তার হাতটি ধরতে,
একছুটে গিয়ে তার মুখে চুমু খেতে,
আর কখনো তাকে একা চলে যেতে না দিতে।

কিন্তু আমার গভীর হতে কেউ বলে উঠল :
এই সবকিছুই ছলনা, মিথ্যা ভান,
কখনো বিশ্বাস করো না
কখনো বিশ্বাস করো না।

ভাগ্য

আমি সেই বধূ যাকে বাসররাত্রিতে
ঘোমটা উঠিয়ে কেউ বলেছিল,
‘আমার যা কিছু আছে সবই তোমার,
শুধু আমার হৃদয়টা বাদ দিও।’

বিমোক্ষণ

আমার কাঁধে তার মাথাটি রেখে আজ
সে কারো জন্য তার মনভরে কেঁদেছে।

সৌন্দর্য

পুরো একটি জীবন দরকার
সৌন্দর্য কী তা বুঝতে,
কারণ মেয়েরা নিজেদের মেলে দেয় না
ক্ষণিক দেখায়।

আরোগ্য

আর কোনো ফুল নাই
আমার কামনার জ্বলন্ত বাগানে,
এটা তো পাতা ঝরবার ঋতু।
তবু একান্ত ইচ্ছার একফোঁটা শিশির
এখনো আমার দুচোখ ভরে রয়েছে,
ঝিকমিকে তারার মতন,
যে ছড়ায় আলো
তোমার হাঁটবার অন্ধকার অলি-গলিতে;
নিঃশব্দে তোমার কানে-কানে সে
তোমার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছে।
যে তুমি ভালোবাসো
সদ্যফোটা ফুলের সুরভি,
আর মৃদুমন্দ বাতাস,
নীরব নদীতে ধীরে প্রবহমাণ স্বচ্ছ পানি,
আর জীবনের উজ্জ্বল বর্ণমালা,
সু্স্থ হয়ে উঠবে তুমি—
রয়েছে ওরা প্রতীক্ষায়,
বসন্তের নতুন সকাল
তোমার হাসিমাখা দৃষ্টি দেখবার অপেক্ষায় আছে।

বিদায় চিহ্ন

সে গিয়েছে চলে,
কিন্তু যখন সে এখানে ছিল
তখনকার একটি তরতাজা মুহূর্ত
লটকে রয়েছে
আমার হাতের পিঠে,
আমার জীবনে,
বাঁকা চাঁদের মতন।

তোমার নাচের সাথী

নাচের সময়
যার কাঁধের উপর
রেখেছ তোমার মাথা
আমিও একদা তার আশ্রয়ে ছিলাম।
পার্থক্য কেবল এই,
সন্ধ্যা হবার আগেই আমি পরিত্যক্ত হয়েছি,
আর তুমি এই মিথ্যা নিরাপত্তায় রইবে
ভোর পর্যন্ত।

পিকনিক

আমার বন্ধুরা সৈকতের অন্য কোথাও হাসছে,
আর আমি বসে আছি এখানে, গুনে যাচ্ছি ঢেউ,
লিখছি—তার উপরে আবার লিখছি—তোমার নাম এই বালুকাবেলায়...

স্বীকারোক্তি

তোমার চিত্রটি আমার দৃষ্টিকে উদ্বেলিত করল।
দীর্ঘ রজনী পার হলো, আমি
আবিষ্ট হয়ে পড়লাম তোমার প্রতিকৃতিতে।
তারপর সেই মুহূর্ত এলো, যখন আমি
ধীরে ধীরে রাখলাম আমার ঠোঁট
তোমার ছবিতে...

বৃষ্টি

বৃষ্টিতে কেন তুমি একা একা শিহরিত হচ্ছো,
ও মেয়ে?
আলিঙ্গন করো তাকে যার উষ্ণতা জাগানো প্রেমে
তোমার শরীর ও মন হবে সিক্ত।
আর কোনো বৃষ্টি নাই যেটি
প্রেমের বৃষ্টির চেয়ে বড়,
যার পর বিচ্ছেদের উজ্জ্বল রঙধনু
বর্ণের রহস্য নিয়ে ঝলমল করে উঠবে।

আমার শরীরের ভাবসাব

আমি সেই দিনের জন্য আকাঙ্ক্ষা করি যেদিন তুমি
আমার প্রতি আবিষ্ট হবে,
যখন দুনিয়া ভুলে গিয়ে তুমি
গভীর আবেগে আমার অভাব অনুভব করবে,
আর আমার স্বল্পভাষিতা নিয়ে অভিযোগ করবে না।
তখন হয়তো আমি ভুলে যাব অন্য সব
লেনদেন আর দায়দায়িত্ব
যেন আমি তোমার বাহুতে আমার জগতকে অনুভব করতে পারি,
আমার শরীরের ভাবকেই আমাকে পরিচালনা করতে দিতে পারি।
সেই মুহূর্তে সব সীমাপরিধির বাইরে
যখন আমরা নেকাব ও পাগড়ির প্রথা প্রত্যাখ্যান করি,
আসো আমরা আমাদের ভাগ্য পরীক্ষা করি,
আর নিষিদ্ধ ফলের স্বাদ চুরি করি।

চাঁদ

আমাদের সকলে যাত্রী,
একই ভাগ্য নিয়ে আছি আমরা সবাই।
তবু আমি একা আছি এই পৃথিবীতে
আর সে রয়েছে একা ওই আসমানে।

অসারতা

তার জগৎ বড়ই সরল, বড় বেশি
আলাদা আমার থেকে
খুবই স্পষ্ট তার স্বপ্ন
আর ইচ্ছাগুলো।
কথা বলে সে খুব কম।
আজ ভোরে লিখেছে সে,
“আমি দেখলাম
চমৎকার কিছু ফুল আর
তোমার কথা মনে পড়ল।”
হাহ! আমি জানি
আমার বুড়িয়ে যাওয়া মুখ
কোনো অর্কিড পুষ্প নয়...
কিন্তু আমি কিভাবে এই ইচ্ছা করি,
যে আমি বিশ্বাস করব
যা কিছুই বলুক সে,
অন্তত ক্ষণিকের জন্য।

অভিযোগ

বরাবর অভিযোগ করত সে,
‘আমাদের চারপাশে এত-এত মানুষ
আমাদের নিজেদের জন্য সময়ই নাই।
মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিতে,
বছরের প্রথম তুষারপাতে,
পূর্ণিমা রাতে,
সন্ধ্যার সৌরভে,
ভোরের মিষ্টি ঠান্ডায়,
আমি তোমার সাথে একা থাকতে চাই,
কিন্তু মনে আমার বেদনা কেবল।’

আজ আমাদের দুজনার মাঝে আর কেউ নাই,
হাত একটু নাড়ালেই সে আমাকে ছুঁতে পারে।
কিন্তু কত-কত মৌসুম এলো আর গেল,
কিন্তু অমন কথা আর বলে না সে।
তার কাছে যাওয়া আমার জন্য কঠিন কিছু না,
কিন্তু সত্যি ব্যাপার হলো,
তার কণ্ঠস্বরে ভাবাবেগ গেছে কমে
কথার ধরনটাও আগের মতন নাই আর;
যদিও সে একই গান গায়,
কিন্তু তার হৃদয় শীতল হয়ে গেছে।

আমরা সবাই ড. ফস্টাস

কোনো না কোনোভাবে আমরা সবাই ড. ফস্টাস,
কেউ তাদের আত্মাকে বেচে
আবেগ-অনুভূতির জন্য,
আবার পরিস্থিতি যখন তাদের ধোঁকা দেয়
কেউ-বা তাদের চোখ বন্ধক রাখে
স্বপ্ন বেচার জন্য,
কেউ-বা পুরো মনটাই বিনিময় করে।
আসলে নির্ধারণ করা দরকার
যুগের মুদ্রাটা কী।
কিছু বিশ্লেষণ হতে জানা যায়
জীবনের বাণিজ্যিক এলাকায়
আজকের ক্রেতারা
সর্বোচ্চ মূল্য দিচ্ছে
আত্মসম্মানের জন্য।

দ্বিপদীগুচ্ছ


সে তো সৌরভ, হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে
ঝামেলা ফুলটি নিয়ে, ও কোথায় যাবে?


তারা জেদ ধরেছে, দিনের আলোয় জোনাকি পোকা ধরে দিতে হবে,
একালের ছেলেমেয়েরা অনেক বুদ্ধিমান হয়ে গেছে।


ঘুম থেকে জেগে উঠলাম আমি, এতে কি তোমার কিছু আসে-যায়?
হাওয়া আমার দরজা ধাক্কাচ্ছে, এতে কি তোমার কিছু আসে-যায়?


আমি মরে গেলে লোকে কখনো কি ভুলে যাবে?
আমার শব্দগুলো আমার অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেবে।


বাতাসের মতো তার যাযাবর জীবনযাপন
ঝঞ্ঝার মতো সে চলে যাবে উড়িয়ে নিয়ে।


সত্যি কথা বলব আমি, আর যাব হেরে;
মিথ্যা বলে সে নির্বাক করবে আমারে।


আমার কাঙ্ক্ষিত ছিল শুধু একজনই, যখন তাকে পেলাম না
প্রার্থনা হতে আমার হাত নেমে গেল, এমনকি কী যে চাইছিলাম তাও ভুলে গেলাম।


হাঁটার কোনো শক্তি নাই, থামাও অসম্ভব
প্রেমের সফর আমাকে নির্জীব করে দিয়েছে।


তরতাজা প্রেমের নেশা আমার শরীরে ও মনে,
আবার ফুলের মৌসুম এসেছে আমার বাগানে।

১০
আরো কিছুক্ষণ তাকে দেখতাম,
হায়, চোখের পানিতে সেই সুখ সইল না।

১১
সে এখন অন্য কারো তাতে কী?
আমার সাথে তো তার শুরুই হয় নাই।

১২
যেখানে তোমার খুশি বাতাসের মতো ঘুরে বেড়াও,
আমার কল্পনার ডানা কাটা গেলে তোমার কী আসে যায়?

১৩
মেয়েদের দুঃখ আজব, আরো আজব তাদের সুখ;
হাসতে থাকে তারা অথচ কাজল ভিজে যায়।

১৪
প্রিয় হে, তোমার সাথে একশর্তে প্রেমের খেলা খেলব,
যদি আমি জিতি আমি তোমাকে পাব, যদি হেরে যাই তবে আমি তোমার হব।

১৫
রাতে আমার হৃদয়ে এমন ব্যথা জাগল,
ভোর পর্যন্ত আমি অস্থির হয়ে থাকলাম।

১৬
মিলন—পুনর্মিলনের প্রতিশ্রুতি—বিচ্ছেদ;
হঠাৎই কত কিছু ঘটে গেল!

১৭
আমি জানি বাতাসের দিকে তুমি চোখ রাখো,
কিন্তু এ কেমন কথা যে একটু দেরিও করলে না!

১৮
আমার মতোই চাঁদ গলে যাচ্ছিল
ঘুমের ঘোরে চলছিল সারারাতভর।

১৯
অনেককাল ধরে আমার আমার দুঃখ একা,
খোদা, আমার অশ্রু ঝরাচ্ছে কে?

২০
তার সব ইচ্ছা আমি পূরণ করতে চাই, শুনতে চাই তার সব কথা;
আমি তাকে শিশুর মতো হাসতে দেখতে চাই।

২১
তোমার কথা ভাবলে আমি আলো দেখতে পাই,
মনে হয় স্মৃতিগুলো চাঁদে পরিণত হয়েছে।

কু-বা-কু ফেইল গেয়ি

সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের প্রেমকাহিনী,
ফুলের সুরভি ছড়ানোর মতো সে আমাকে ভালোবেসেছিল।

কী করে বলি যে সে আমাকে ছেড়ে গিয়েছে,
সত্য হলেও সে তো বড়ই লজ্জার কথা।

যখনই সে গেছে কোথাও, ফিরেছে আমার কাছে ফের,
এটুকু ভালোই মনে সান্ত্বনা জাগায়।

তোমার হৃদয়ের মতো তোমার সাথীও ঋদ্ধ থাকুক,
বিরহের রাত কখনো তোমাকে ধ্বংস না করুক।

যখনই সে আমার তপ্ত কপালে তার হাত রাখত,
আরোগ্যের অনুভূতি জাগত আমার আত্মার গভীরে।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;