অনুগমন



মশিউল আলম
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

‘না রে ইদ্রিস, গাঁওত আর থাকমু না, শহরত চলে যামু। শহরত যায়া ইশকা চালামু আর খালি ছিনামা দেখমু।’ জয়নাল ভাত খেতে বসে বকবক করছে।

ইদ্রিস পাত্তা দিচ্ছে না। সে আপন মনে খাচ্ছে: ধবধবে সাদা ভাত, নতুন আলুর ভর্তা, বাঁধাকপি ভাজি, খেসারি কলাইয়ের ডাল, কাঁচা মরিচ, মিছরির মতো সাদা নুন।

ইদ্রিস যে জয়নালের কথায় ভ্রুক্ষেপ করছে না জয়নাল তা দেখতেই পাচ্ছে, কিন্তু তাতে জয়নালের কথা বলায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কথা বলার জন্য তার শ্রোতার দরকার হয় না। শহরে গিয়ে সিনেমা দেখার স্বপ্নের কথা বলতে বলতেই সে বলছে অন্যের গৃহস্থালিতে আর কামলা খাটবে না, জমি আধি-পত্তন নিয়ে বর্গাচাষী হয়ে নিজের গৃহস্থালি গড়বে। আবার সঙ্গে সঙ্গেই বলছে যে অন্যের জমি আধি নিয়ে চাষাবাদ করতে গেলে নিজের হাল থাকতে হয়, নিজের গরু থাকতে হয়, কিন্তু তার এসবের কিছুই নাই। পত্তন নিয়ে চাষ করতে হলে আগে জমির মালিকের হাতে পত্তনির টাকা তুলে দিতে হয়, তার পরেই শুধু তার জমিতে নামা যায়।

‘মুই তো কিষান! গিরস্তবাড়িত কাম করে খাঁও। মুই ট্যাকা পামু কোন্টে জি জুমি পত্তন লিমু? হাল কিনমু, গরু কিনমু?’ জয়নাল বলল।

কিন্তু ইদ্রিসের দিক থেকে কোনো সাড়া এলো না। ইদ্রিস গোগ্রাসে ভাত খাচ্ছে।

‘আলু-পোটলের ব্যবসা করমু রে! ব্যাপারি হমু।’ জয়নাল বলল।

ইদ্রিস কাঁচা মরিচে কামড় দিয়ে কচমচ করে চিবুতে লাগল।

‘কিন্তুক ব্যবসা করতেও তো পুঞ্জি লাগবে। মুই ট্যাকা পামু কোন্টে?’ জয়নাল বলল।

ইদ্রিস এক ঢোক পানি খেয়ে বিরাট এক গ্রাস ভাত মুখে পুরল।

‘না রে, এইগুলা কেছু হোবে না। এইবার শিবগঞ্জের মেলাত যাত্রাপাটি অ্যালে ওরগে সাতে যোগ দিমু। দ্যাশ-বিদ্যাশ ঘুরে বেড়ামু। কী মজা হোবে রে! জিন্দেগি মোর ফাইন হয়া যাবে!’ জয়নাল বলে চলল। ইদ্রিস আপন মনে ভাত খেয়েই চলল।

জয়নাল চাচির ঘরে মানুষ। চাচার জমি-জিরাত না থাকায় জয়নাল গেরস্থদের গরু-ছাগল চরিয়ে, ঘাস কেটে আর বড় কিষানদের জন্য মাঠে পান্তা বহন করে বড় হয়েছে। এখন সে হেসে খেলে গেরস্থদের বাড়ি বাড়ি কামলা খেটে বেড়ায়। কিন্তু কাজেকর্মে তার মন খুব-একটা নাই, দরকারি কাজটা করার চেয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতেই তার আনন্দ বেশি। লোকে বলাবলি করে, ফুর্তিবাজ জয়নালটা কামকাজ করে কিসের ছাই, দিনমান খালি কুয়ারা-ফাজলামো লিয়ে আছে। খালি গপ্পগুজব করে আর গান গায় আর খালি গামলা গামলা ভাত খায়।

কিছুক্ষণ আগেও ধান কাটতে কাটতে গলা ছেড়ে গান গাইছিল, এখন ভাত খাচ্ছে। জমির আলের ওপর ল্যাটা মেরে বসে সঙ্গী ইদ্রিসের সঙ্গে ভাত খাচ্ছে আর গল্প করছে। গল্প হচ্ছে না, কারণ জয়নাল শুধু একাই বকবক করে চলেছে, ইদ্রিস তার কথায় কোনো সাড়া দিচ্ছে না, হুঁ-হাঁ কিছুই করছে না। কিন্তু জয়নাল বকতে বকতে যখন মুখে প্রায় ফেনা তুলে ফেলল, তখন আর সইতে না পেরে ইদ্রিস ঘেউ করে উঠল, ‘চুপ কর! ভাত খাবা দে।’

জয়নাল হে হে করে হাসতে হাসতে বলল, ‘মুখ বোন্দ করে খালি ভাত খায়াই যাবু? অ্যানা গপ্প-সপ্প করা লাগে না?’
‘ভাত খাওয়ার সমে কতা কওয়া হয় না। সুন্নতে মানা।’
‘তাই?’
‘হয়। খাওয়ার সমে কতা কলে গুনা হয়।’

জয়নাল চুপ করল। ইদ্রিসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাত খেতে লাগল। কিন্তু একটু পরেই সে বুঝতে পারল শুধু খাওয়ায় সুখ নাই। গল্প করা ভাত খাওয়ার মতোই জরুরি ব্যাপার। এবার সে ইদ্রিসের মনোযোগ আকর্ষণের মতলবে বলল, ‘ক্যা রে দোস্ত, বিয়া করবু না?’

ইদ্রিস হেসে বলল, ‘হঠাৎ বিয়ার কতা?’
‘হঠাৎ কী রে? হঠাৎ কী? বয়েস কতটি হলো সে খিয়াল আছে?’

২.
তার পর ধান কাটার মৌসুম শেষ হলে বিরান মাঠের একাকী শিমুল গাছটা যখন মাতাল সাঁওতালদের চোখের মতো শতসহস্র টকটকে লাল ফুল নিয়ে ঝকঝক করে উঠল তখন একদিন জয়নাল কোত্থেকে একটা বউ নিয়ে হাজির। গাঁয়ের সব মানুষকে ডেকে ডেকে সে বলতে লাগল, ‘দ্যাখো বারে, হামার বউ দেখে যাও। তামান দুনিয়া ঢুঁড়ে ইংকা বউ তোমরা আর অ্যাডাও পাবিন না!’

বউ দেখে গ্রামের লোকে বলে, ‘কথা মিথ্যা লয়। ইংকা সুন্দর বউ তুই কোন্টে পালু রে জয়লাল?’

জয়নাল গদগদ হয়ে বলে, ‘সে কথা কয়ো না বাপু, আল্লা এক্কিবারে লিজ হাতে তুলে দিছে। আল্লা দিলে ইংকাই হয়। তে শোনো কাহিনী...’

জয়নাল রঙ চড়িয়ে তার বিয়ের গল্প বলতে শুরু করল : ‘কী মনে করে গেনু শিবগঞ্জের হাটত। কোনো কাম নাই, সাথে ট্যাকা-পসাও কেচ্চু নাই। ইমনিই গেনু বাপু। হাটের মদ্যে ঘুরে বেড়ানু খানিক। তে, সন্ধ্যাসমে হাটত থ্যাকে ফিরে আসোছোঁ, দেখনু এক বুড়া ব্যাটা যায় ঠুকঠুক কোরে, আর তার পিছে পিছে এক বেটিছল। কী আর কমু বাপু, কলে কবিন মিছা কথা, সন্ধ্যার আন্ধার উজালা কোরে বুড়ার পিছে পিছে হাঁটে পরির লাকান এক বেটিছল। মুই মনে মনে কনু, এডা মানুষ লয়, আসলেই বুঝি আসমানের পরি। মুই জুয়ান মরদ বাপু, চোখোত্ তো অ্যানা র্ঘুকি লাগবেই। আর তোমরা তো জানিনই, মুই মানুষটা ক্যাংকা ফাজিল। তা হাউস হলো বুড়ার সাথে অ্যানা কুয়ারা করোঁ। কী আর হোবে, বুড়া তো আর মোক মারা পারবে না। আর যুদিল চিগড়াচিগড়ি আরম্ভ করেই দ্যায়, দিমু না হয় কষে এক দৌড়। তে, এই মনে করে বুড়াক কনু, বুড়া ব্যাটা কোন্টে যায়? বুড়া থামে না, মাটির দিকে চায়া ঠুকঠুক কোরে হাঁটতে হাঁটতে কয়, কোন্টে আবার, বাড়িত। মুই কনু, বাড়ি কোন গাঁও? বুড়া তাও মাথা তোলে না, কয় শিমুলিয়া। এইবার মুই সাহস কোরে কনু, বেটিছল কে হয়? বুড়া কয় লাতিন। আর অ্যানা সাহস কোরে কনু, লাতিন তো সেনা হোছে, বিয়া দিবিন না? বুড়া এবার থামল, চোখ দুডা তুলে মোর দিকে তাকাল। মুই মনে মনে কনু, লাঠিডা দিয়ে একখান বাড়িই হাঁকায় নাকি! না, বুড়া আর কেছু কলো না। আবার হাঁটা ধরল। মুই পিছে পিছে যাতে যাতে আবার কনু, লাতিনক বিয়া দিবিন না? বুড়া এবার কয়, বিয়া তো দেমো, কিন্তুক ঘড়ি সাইকেল ট্যান্ডিস্টার আর লগদ ট্যাকা পামো কোন্টে? মুই এবার ফুসলাবার ধরনু, বুঝিছিন? মুই বুড়াক কনু, কেচ্ছু যদি দেওয়া না লাগে? শুনে বুড়া এইবার খাঁড়া হলো, মোর মুখের দিকে চায়া কলো, ঘড়ি সাইকেল ট্যান্ডিস্টার আর লগদ ট্যাকা ছাড়া হামার লাতিনক্ বিয়া করবে কে? মুই কনু, ক্যা? হামি যদি করি? বুড়া মোক্ পুছ করে, কোন গাঁয়ের মানুষ তুমি? মুই কনু মধুপুর। বুড়া কয়, সত্যিই বিয়া করবিন, না ইয়ার্কি মারোছিন? মুই কনু ইয়ার্কি লয়, সত্যি। বাস! আল্লা কবুল কোরে লিলো, বুঝিছিন বারে? আল্লা লিজ হাতে মোক্ বেহেশতের পরি দান করল। বুড়া কলো, আজই বিয়া করবিন? মুই চরপটাত্ থাবা ম্যারে লাফ দিয়ে উঠে কনু, হয় আজই, অ্যাক্‌খোনি! বুড়া কয়, তালে আসো হামার সাথে। বাস, তোমাগেরে জয়নালের বিয়া হয়া গেল বারে, ওই রাতত্ই। দেনমোহর একশ এক ট্যাকা। আল্লা মেহেরবান!’

গ্রামের মানুষ বউ দেখে খুশি। কিন্তু জয়নালের চাচা-চাচির বড্ড আফসোস। গরীব হলে কী হয়, পুরুষ মানুষ বিয়ে করলে টাকা-পয়সা, দান-টান কিছু না কিছু তো পায়, কিন্তু জয়নাল খালি-হাতে শুধু বউটাকেই নিয়ে এসেছে, যে কিনা এখন বসে বসে সানকি সানকি ভাত গিলবে। চাচি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘হারামজাদাক খায়া-না-খায়া মানুষ করনু, আর বিয়া কোরে লিয়ে অ্যালো একলাই। অ্যাডা কথা কলোও না।’ চাচা আহাজারি করতে লাগল: ‘আহারে মোর আর কেউ নাই, লিয়ে-দিয়ে এক ভাস্তা। সেই নিমকহারামডাই বিয়া কোরে লিয়ে অ্যালো একলাই, ডিমান-ডুমান কেচ্চু পালো না। আহ্হারে মোর কপাল।’

জয়নাল চাচা-চাচির হাতে-পায়ে ধরে মাফ চেয়ে বলল, ‘তোমরা ব্যাজার হয়ো না বাপু, মাপ কোরে দ্যাও। যা হওয়ার হয়া গেছে।’

যা হবার হয়ে গেল বটে, কিন্তু বউকে নিয়ে জয়নালের নাচানাচির শেষ নাই। বউকে সে মাথায় করে রাখবে না কাঁধে নিয়ে নিয়ে নাচবে তার দিশা পায় না। সড়কের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকে, লোকজনকে ডেকে ডেকে বলে, ‘ও চাচা, ও ভাই, হামার বউ দেখে যাও। ইংকা বউ তোমরা তামান দুনিয়া ঢুঁড়ে আর অ্যাডাও পাবিন না!’

বউকে ঘরে রেখে মাঠে গিয়ে কাজ করতে ইচ্ছা করে না জয়নালের। কোনো কোনো দিন সে বউকে সঙ্গে নিয়েই মাঠে যায়। জমির আলের উপর তাকে বসিয়ে রেখে সে হাল বয় আর গলা ছেড়ে গান গায়। আর ঘুরে ফিরে বারবার বউয়ের কাছে এসে বসে গল্প জুড়ে দেয়। তার গল্পের শেষ নাই, মুখে তার সারাক্ষণ কথার খই ফোটে।

হঠাৎ হঠাৎ সে বলে ওঠে, ‘বউ, তুই কী চাস?’

বউ হেসে মাথা নেড়ে জানায় সে কিছু চায় না।

জয়নাল শিমুলের গাছ দেখিয়ে বউকে বলে, ‘ফুল চাস? ফুল লিবু?’

বউ হেসে মাথা দোলায়, আর জয়নাল নিতম্ব বের করে মালকোঁচা বেঁধে দৌড়ে চলে যায় শিমুল গাছের তলায়। গিয়ে দেখে, ওহ হো, শিমুল গাছে তো চড়া যায় না, কাঁটা! তখন সে পাগলের মতো গাছে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে। ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে হাপসে যায় আর লজ্জা পেয়ে হাসে, পড়ে থাকা ফুলগুলো চুপি চুপি কুড়িয়ে কাছা ভর্তি করে।

আমগাছের মগডালে পাখির বাসা দেখে সে বউকে শুধায়, ‘পক্কির বাচ্চা লিবু, বউ?’
বউ হেসে মাথা নাড়ে, আর জয়নাল পাছা বের করে মালকোঁচা বেঁধে দুই নিতম্বে দুই চাপড় মেরে দুহাতের তালুতে থুথু নিয়ে দুই তালু ঘষে তরতর করে গাছে উঠে যায়। কিন্তু পাখির বাসায় গোখরোর উদ্যত ফণা দেখে পড়ি-মরি নেমে আসে ছড় ছড় করে, তার দুই ঊরু আর বুকের ছাল-চামড়া ছড়ে গিয়ে দর দর করে রক্ত ছোটে, কিন্তু সে দাঁত বের করে হাসে।

সন্ধ্যায় সে বউকে নিয়ে খালের পাড়ে বসে গল্প জুড়ে দেয়। খালের অন্য পাড়ে মহুয়া গাছ। সেখানে অজস্র বাঁদুড়ের আনাগোনা। একটু দূরেই বাঁশঝাড়, সেখানে ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে থোকায় থোকায় জোনাকি জ্বলে। জয়নাল সেদিকে চেয়ে বউকে বলে, ‘জানিস, জোনাক পোকা জ্বলে ক্যান?’

অবোধ কিশোরী বউ অবাক হয়ে শুধায়, ‘ক্যান জ্বলে?’

জয়নাল বলে, ‘জোনাক পোকার গোয়াত এডিয়াম থাকে, এডিয়াম। এডিয়াম কী জিনিস? এডিয়াম হলো এক ধরনের জিনিস, আন্ধারের মদ্যে জ্বলে। তাই ঘড়ির মধ্যে এডিয়াম থাকে। আন্ধারের মধ্যে দেখা যায় কয়টা বাজল।’

আকাশের বেশুমার তারা দেখিয়ে সে বউকে বলে, ‘দেখিছু, কত তারা? তারাভরা আকাশের দিকে চায়া থাকতে তোর ক্যাংকা লাগে, বউ? মোর কলে খুবই ভালো লাগে। মনে হয় ওই তারার দ্যাশত্ উড়ে চলে যাঁও।’

বউ মিটি মিটি হাসে।

তার হাসি দেখে জয়নাল বলে, ‘তুই বুঝি মনে মনে কোস, মোর মাথার ঠিক নাই, লয়? মুই অ্যাডা পাগলা? হয় বউ, কওয়া পারিস তোক্ পায়া মুই পাগলাই হয়া গেছুঁ। আল্লা লিজ হাতে তোক মোক দান করিছে। মোর মাওডা বুঝি কোনো সওয়াব করিছেল।’

বউ বলে, ‘আম্মার কথা তোমার মনে আছে?’

জয়নাল মাথা নাড়ে: মায়ের কোনো স্মৃতি তার মনে পড়ে না। চাচিই তাকে মায়ের মতো বড় করে তুলেছে। চাচির এক মেয়ে মারা যাওয়ার পর আর কোনো সন্তান হয়নি। জয়নাল চাচির বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছে।

তার পরে আকাশ জুড়ে বড় সড় একটা চাঁদ ওঠে। খালের স্থির পানিতে চাঁদের ছবি দেখে জয়নাল বউকে বলে, ‘ওই দ্যাখ, খালের বিছনাত চাঁন শুতে আছে। দেখিস, এই ঘণ্টাখানেকের মদ্যেই ওই চাঁন লাফ দিয়ে উঠে চলে যাবে বাঁশের আগাত। বাঁশের আগা ঝুঁকে পড়বে, দেখে মনে হোবে বড়শির মাথাত ধরে আছে একখানা সোনার মাছ।’

তার পর সে এই গল্প ফাঁদে : ‘কাল পাছাআত্রিরে কী স্বপন দেখনু, জানিস? দেখনু, খালের পারত তুই আর মুই বসে আছোঁ, এই এখনকার মতন। খালের পানিত চাঁন দেখে তুই বায়না ধরলু, চাঁন চাই, চাঁন অ্যানে দ্যাও। মুই কনু চাঁদ ত ধরা যায় না। কিন্তুক তুই কোনো কতাই শুনিস না, তোর ওই একই বায়না। কী আর করা, মুই ঝাঁপ দিনু খালের পানিত। নিয়াশ বোন্দ কোরে দিনু এক ডুব। কিন্তুক কোন্টে তোর চাঁন? চাঁন নাই। মুই চাঁন ঢুঁড়তে ঢুঁড়তে পাতালপুরিত নামবার লাগ্নু। ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে মুই এক্কিবারে হয়রান, তাও চান্দের দ্যাখা নাই। শ্যাষম্যাষ খালি হাতে মন ব্যাজার কোরে ফিরে আনু। খালের পানিত ভুশ্ করে মাথা তুলে দেখবার পানু কী, খালের পারত বসে আছো তুই, আর তোর কোল জুড়ে ঝলমল করে হাসোছে আকাশের চাঁন। চারদিকে এক্কিবারে ধবধবা হয়া গেছে চান্দের আলোত।’

বানোয়াট গপ্প শুনে বউ মৃদু মৃদু হাসে, আবছায়ায় জয়নাল তা দেখতে পায় না। বাঁশঝাড়ে একটা বক ডেকে ওঠে। রাতচোরা পাখিরা তার জবাবে নানা রকম শব্দ করতে থাকে। অনেক দূরে শিয়ালের ঝাঁক এক সঙ্গে হুক্কাহুয়া রবে চিৎকার শুরু করে আর তার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের অলিগলির ভিতরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুরু হয়।
জয়নাল বলে চলে, ‘শোনেক বউ, ওই পরিবার পরিকল্পনার মেয়ামানুষগুলা কিন্তুক কয়দিন পরেই অ্যাসে ঘুরঘুর করবা লাগবে। তুই কিন্তুক ওরগেরে কথা কানোতই লিবু না। ওরা ফুসলায়া ফাসলায়া তোক কিন্তুক হাসপাতালত লিয়ে যাবে, কেছু অ্যাডা করবে, তার পরে আর হামাগেরে ছলপলই হোবে না। খবরদার শুনবু না ওরগেরে কথা। কিসের জন্মনিয়ন্ত্রণ? শোনেক, হামরা কলে ওগলানের মদ্যে নাই। দশ-বারোটা ব্যাটাবেটি হোবে হামাগেরে। গাঁও ভরে ফালামু তুই আর মুই, বুঝলু? ভোটের আগে শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়া আসলে কমু, আইদা, মদুপুরের জয়নাল কথা কয়। তার বাড়িত বিশজন ভোটার, হুঁশ কোরে কথা কবেন। হাটেবাজারে যেটে সেটে মানুষ হামাগেরে ব্যাটাগরক পুছ করবে, কার ব্যাটা তুই? খালি শুনবা পাবে, জয়নালের, জয়নালের ব্যাটা হামি। বারোটা ভাই হামরা, হুঁশ কোরে কথা কয়ো।’ হা হা করে হেসে ওঠে জয়নাল। বউ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে হাসে।

৩.
জয়নালের চাচা মূরলীপুরের ইউনুস ফকিরের সঙ্গে চিল্লা দিতে গেছে। চাচিবুড়ি তালকুদারদের বাড়িতে ঝিগিরি করে। ভোরবেলা উঠে সে তালুকদারবাড়ি চলে যায়, সেখানেই সকালের পান্তা খেয়ে কাজ শুরু করে। দুপুরে ভাত খায়, রাতেও ওই বাড়িতেই খেয়ে-দেয়ে নিজের বাড়ি ফিরে আসে। জয়নাল কাজ করে মন্ডলদের বাড়িতে, তারও সেখানেই খাওয়া-দাওয়া। জয়নালের বউ একা একা কী রাঁধে কী খায় তার কোনো ঠিক নাই। গেরস্থদের বাড়িতে তাকেও ঝিগিরি করতে হবে, এ ছাড়া কোনো উপায় নাই। কিন্তু জয়নাল বলেছে সে নতুন বউ, তাকে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে পাঠাতে সে পারবে না। কিন্তু বেচারি বউ কী খেয়ে সারাদিন কাটায় তার খোঁজ জয়নাল রাখে না। ইচ্ছা করে নয়, আসলে জয়নাল আলাভোলা লোক বলে এমনটা ঘটে। তা ছাড়া এমন নয় যে জয়নালের ঘরে চাল থাকে না। এই গ্রামে যার ঘরে এক বেলা ভাত রাঁধার চাল আছে তার আর কোনো অভাব আছে বলে মনে করা হয় না। জয়নালের বউটা বাড়ির পাশের জঙ্গল থেকে কচুঘেঁচু তুলে এনে দুপুরে রেঁধে খায়, রাতে জয়নাল মন্ডলদের বাড়ি থেকে ভাত নিয়ে আসে। দুজনে তাই ভাগ করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

হতদরিদ্র জয়নাল এই অবস্থার মধ্যেও বউকে যখন-তখন বলে, ‘বউ তুই কী চাস?’ এক রাতে বউ লজ্জার মাথা খেয়ে বলে ফেলে, ‘মুরগির গোশত দিয়ে ভাত খাবা মন চায়।’

পরদিন সকালে জয়নাল মন্ডলবাড়িতে গিয়ে মন্ডলকে বলল, ‘চাচা মিয়া, একশডা ট্যাকা দ্যাও বারে, খুবি দরকার।’

মন্ডল নিমের দাঁতন দিয়ে দাঁত ঘষছিল, দাঁতনটা মুখ থেকে বের করে বলল, ‘লিত্যি লিত্যি ট্যাকা চাস কিসক্? উদিনকা না ঘর ছাওয়ার কথা কয়া পাঁচশ ট্যাকা লিলু, তার পর কাম র্কলু কয়দিন রে?’

জয়নাল ছ্যাবলার মতো হাসতে হাসতে বলে, ‘সারা বছর পড়ে আছে চাচা, কাম কোরে ব্যাবাক শোধ দিমু।’
‘তা ত দিবু। কিন্তু আষাঢ়-শাওন চলে গেল, বিষ্টিটিষ্টি বোধহয় আর হোবে না। পাঁথারত্ পানি নাই, এখন তোর কামডা কী? গান গায়া আর বউয়ের সাতে পিরিতের গপ্প করে দিন কাটাবু আর কয়দিন পরপর ট্যাকা চাবু, তালে ক্যাংকা কোরে হয়?’

জয়নাল মনে মনে স্বীকার করে, মাঠে পানি নাই, জমি চাষ করা যাচ্ছে না, ধান রোপাও সম্ভব নয়। এখন আসলে মন্ডলবাড়িতে তার কোনো কাজ নাই। এই অবস্থায় গ্রামের গৃহস্থরা তাদের বাঁধা কিষানদের ছেড়ে দেয়। মন্ডল যে এখনো তাকে বিদায় করে দেয়নি সেটা তার একান্তই ভালোমানুষী।

জয়নাল চুপ করে রইল।

মন্ডল বলল, ‘এখন তোর কামডা কী তুইই ক?’

জয়নাল উত্তর দিতে পারল না।

‘কাল থে তুই আর আসিস না বাপু। বিষ্টিটিষ্টি হোক, তার পর আসিস।’

জয়নাল এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, বুকের কাছে দুটি হাত জড়ো করে বলল, ‘একশডা ট্যাকা দিলে বড়ই উপকার হলো হিনি চাচা।’

মন্ডল এবার বিরক্ত হয়ে উঠল, ‘এই অবস্থায় তুই ট্যাকা চাস কোন মুখে?’

জয়নালের দমে যাওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। কেউ তাকে নিজে ইচ্ছা করে কিছু না দিলে জীবনে কোনো দিন কারো কাছ থেকে সে কিছু আদায় করতে পারেনি। বরং নানা ছুঁতানাতায় অনেক ন্যায্য পাওনা থেকেই অনেকে তাকে বঞ্চিত করেছে।
কাল থেকে আর কাজে আসবে না। কিন্তু আজ সকালের পান্তাটা, দপুরের ও রাতের খোরাকিটুকু থেকে মন্ডল নিশ্চয়ই তাকে বঞ্চিত করবে না। জয়নাল এ রকম ভাবছে, আর পান্তার জন্যে মনে মনে অপেক্ষা করছে। কিন্তু মন্ডল তাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরো বিরক্ত হয়ে উঠল: ‘কাম না থাকলে খালি খালি মানুষ থোয় কোন গিরস্থ? খোঁজ লিয়ে দ্যাখ দিনি, এই গাঁওত্ এখন কোনো গিরস্থের বাড়িত্ তোর মতন জুয়ান কোনো মরদ বসে বসে তিন বেলা ভাত গিলোছে নাকি? কী রে? খাঁড়া হয়া থাকলু ক্যা?’

জয়নাল আর কোনো কথা না বলে মন্ডলবাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে গলিতে নেমে এল।

অভুক্ত অবস্থায় প্রায় বিতাড়িত হয়ে মন্ডলবাড়ি থেকে ফিরে আসার সময় জয়নালের মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিজের বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে বউয়ের মুখটা মনে পড়ায় তার বিষণ্নতা কেটে গিয়ে বরং একটা ফুর্তির ভাব জেগে উঠল। এখন সারাদিন বউয়ের সঙ্গে ইয়ার্কি-ফাজলামো আর গল্প-গুজব নিয়ে থাকা যাবে এই চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। অভাব-অনটন জয়নালের জীবনে নতুন কিছু নয়, কিন্তু তার স্বভাবটা এমন যে এ নিয়ে তার খুব-একটা দুশ্চিন্তা হয় না।

কিন্তু বউ মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছে এই কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় একটুখানি মুশকিল বোধ হলো। হাতে গোটা বিশেক টাকা আছে, কিন্তু তা দিয়ে তো একটা মুরগির বাচ্চাও কিনতে পাওয়া যাবে না। বউয়ের হাউসটা তাহলে সে মেটায় কী করে?

আচ্ছা ঠিক আছে, উপায় একটা বের হবেই—এ রকম ভাবতে ভাবতে জয়নাল বাড়ির পথে হেঁটে চলল।

বাড়ি পৌঁছ দেখতে পেল বউ নাই, ঘরে শিকল তোলা। জয়নাল মনে মনে বলল, এই সকাল বেলা নতুন বউটা তার কোথায় যেতে পারে? সে গলা খাঁকরে ডেকে উঠল, ‘ও বউ, কোন্টে গেলু তুই?’

কোনো সাড়া মিলল না।

জয়নাল এবার বলে উঠল, ‘ব্যাপার কী? অ্যাখোনি পাড়া বেড়াবা আরম্ভ কোরে দিলু নাকি?’

বউ কোথায় যেতে পারে তা ঠাহর করতে না পেরে সে ঘরের সামনে মাটির বারান্দায় বসে পড়ল। তার পেটে ক্ষুধা মোচড় দিয়ে উঠল। প্রতিদিন এই সময় তার পেট পান্তা হজমের কাজ করে অভ্যস্থ, এখন পান্তার অভাবে নাড়িভূড়িই যেন হজম করতে শুরু করে দিল। পেটের এই অন্যায় ব্যবহার জয়নালকে ক্রুদ্ধ করে তুলল। সে চিৎকার করে উঠল, ‘বউ, তুই গেলু কোন্টে?’

ঘরের পিছনে শুকনা লতাপাতায় শব্দ হলো, জয়নালের চোখ সেই দিকে ছুটে গেল। কাউকে দেখতে পেল না সে। তার মনে হলো কেউ যেন এইমাত্র ঘরের পিছনের ঝোপঝাড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। সে ঝট করে উঠে সেদিকে ধেয়ে গেল। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না।

জয়নালের স্বভাবে যা নাই, এবার তার মনের মধ্যে তাই জেগে উঠল। একটা ক্ষীণ সংশয় তার বুকের মধ্যে চিকন এক যন্ত্রণা এনে দিল : কেউ কি লুকিয়ে লুকিয়ে এ বাড়িকে লক্ষ করে? আরো সহজ করে প্রশ্নটা সে সাজাল : প্রতিদিন সকালে সে কাজে চলে যাওয়ার পর বউ যখন একা থাকে তখন কি কোনো পুরুষ চুপি চুপি এই বাড়িতে আসে? যে মেয়ে এমন সুন্দরী তার দিকে লোভী পুরুষদের কুনজর তো পড়তেই পারে। কিন্তু বউটা? সেও কি স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়? জয়নালের ক্ষুধার্ত পেটটা মোচড়াতে আরম্ভ করল, তার সহজ সরল মনটা বিষিয়ে উঠল সে পায়ের বুড়া আঙুল দিয়ে উঠানের মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে অপ্রীতিকর ও অশুভ চিন্তা করতে লাগল।

একটু পরে পায়ের শব্দে জয়নাল ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেল বউ বাড়ি ঢুকছে, তার এক হাতে ডাঁটাশুদ্ধ তিনটা কচু গাছ, অন্য হাতে কিছু বুনো শাক। মুহূর্তেই জয়নালের মন থেকে সব অশুভ চিন্তা দূর হয়ে গেল, একটা করুণ মমতা তার মনকে সিক্ত করে ফেলল : আহারে! বউটা মোর গরু-ছাগলের মতন খাস খায়া থাকে!

বউ অসময়ে স্বামীকে বারান্দায় অকর্মার মত বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘কী হলো? ফিরে আলিন ক্যা?’

জয়নাল ফের ছ্যাবলা হয়ে গেল, ইয়ার্কি মেরে বলল, ‘মোর চাকরিডা চলে গেছে বউ!’
‘চাকরি? কিসের চাকরি?’

গ্রামের সরল কিশোরী চাকরি বলতে বোঝে শহরের অফিস-আদালতে উচ্চ বেতনে কাজ করা। মন্ডলদের বাড়িতে খোরাকিসমেত মাসিক ছয়শ টাকা মজুরির কাজকেই যে তার স্বামী চাকরি বলছে এই রসিকতাটুকু বুঝতে তার সময় লাগবে। জয়নাল যখন বলতে আরম্ভ করল যে মাঠে পানি নাই, ক্ষেতে কাজ নাই, তাই মন্ডল আর অকাজে ভাত ধ্বংস করার লোক রাখতে চায় না বলে তাকে বিদায় করে দিল, তখন তার বউয়ের ছোট্ট সুন্দর মুখখানা চুপসে গিয়ে আরো ছোট ও মলিন হয়ে গেল। তা দেখে জয়নাল বলে উঠল, ‘তা এত চিন্তা করার কী আছে? মন্ডলের বাড়িত কাম নাই বলে কি দুনিয়াত আর কোনো কাম নাই?’

বউ কিছু না বলে রোদের মধ্যে চুলার পাড়ে বঁটি নিয়ে কচু কাটতে বসল। জয়নাল বউয়ের গা ঘেঁষে বসে বলল, ‘তুই দেখি কতা বোন্দ কোরে দিলু?’

বউ মাথা নিচু করে কচুর ডাঁটা কাটতে কাটতে বলল, ‘পন্তা খায়া আসিছিন?’
‘না না! চাকরি চলে গেল, পন্তা খামু কী? কাম না করলে কেউ খাবা দেয়?’
‘খিদা লাগেনি?’
‘লাগিছেল। কিন্তু এখন আর খিদা নাই।’

এটুকু বলেই জয়নাল উঠে দাঁড়াল। ‘তুই তরকারি কোট্, মুই অ্যানা ঘুরে আসোঁ’ বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো।

বউ বলল, ‘কোন্টে যাওছিন?’
‘তুই তরকারি কোটেক, আজ হামরা দুবরে সমে ভুল্কানি ভাত খামো। মুরগির গোশ্ত দিয়ে!’

বউকে পরের প্রশ্নটা করার সুযোগ না দিয়েই জয়নাল ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

৪.
জয়নাল তিন মাইল দূরে উপজেলা সদরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। তার ধারণা সেখানে গেলে নতুন কোনো বুদ্ধি পাওয়া যেতে পারে। যারা জমিতে কাজকর্ম করে তারা অফসিজনে উপজেলা সদরে ভ্যানগাড়ি আর রিকশা চালায়। জয়নাল সাইকেল চালাতে জানে না বলে রিকশা বা ভ্যান চালাবার কথা কখনো ভাবেনি, যদিও এখন তার মনে হচ্ছে দুই চাকার সাইকেলের চেয়ে তিন চাকার রিকশা বা ভ্যানগাড়ি চালানো নিশ্চয়ই সহজ। ইদ্রিস রিকশা চালাতে ঢাকা চলে গেছে। পনের দিন রিকশা চালিয়ে নগদ এক হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে চলে আসে। দিন কয়েক বসে বসে খায়, তার পর আবার চলে যায়। জয়নাল তো সাইকেলই চালাতে শেখেনি; ঢাকা শহরে অত লোকের ভিড় আর বাস-ট্রাকের মধ্যে সে রিকশা চালাতে পারবে না বলে ইদ্রিসের প্রলুব্ধকর কথাবার্তা শুনেও যেতে রাজি হয়নি। ইদ্রিস বুঝে নিয়েছে জয়নালের সমস্যাটা ঢাকার ভিড় বা রিকশা চালাতে না-জানা নয়। আসল কথাটা হলো, নতুন বউকে ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে একটানা পনের দিন থাকা জয়নালের পক্ষে সম্ভব হবে না।

উপজেলা সদরে ঢুকে মাইকের চিৎকারে জয়নালের কানে প্রায় তালা লেগে গেল। এক সঙ্গে যে কত মাইক বাজছে তার হিসাব নাই। মাইকে ভোট চাওয়া হচ্ছে। ধানের শিষ আর নৌকা মার্কার পক্ষে চিৎকার বেশি। লাঙ্গল মার্কায়ও ভোট চাওয়া হচ্ছে। মাইকগুলো পরস্পরকে চাপা দেওয়ার জন্যে চিৎকারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ভোটপ্রার্থী ক্যানভাসারদের গলা ভেঙে ফাটা বাঁশের মতো হয়ে গেছে, তবু তারা গলার রগ ফুলিয়ে অবিরাম চিৎকার করে চলেছে।

একটা বটগাছের তলায় কতকগুলি আদিবাসী নারীপুরুষ। ডালি-কোদাল নিয়ে কেউ বসে আছে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে। জয়নালের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তারা মজুর, কোথাও মাটি কাটার কাজ করছে। কিন্তু এই বেলা এগারোটায় তারা কিসের অপেক্ষা করছে তা সে বুঝতে পারল না। ইতস্তত পায়ে জয়নাল তাদের দিকে এগিয়ে গেল। একজনের কাছে গিয়ে বলল, ‘তোমরা কোন্টে কাম করোছিন?’

লোকটা শ্লেষাত্মক হেসে বলল, ‘কাম বারাওছে এবার। দুই দলে এইছা মারামারি লাগিছে..।’
‘কোন্টে মারামারি লাগিছে, ভাই?’ জয়নাল জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু লোকটা আর কিছু বলল না।

জয়নাল ফিরে এলো। রাস্তা থেকে একটু দূরে একটা ঘরের সামনে প্রচুর ভিড় দেখতে পেল। ঘরটার ছাদে বড়সড় একটা নৌকা, আগাগোড়াই সেটি ছবিওয়ালা কাগজে মোড়ানো। শেখ সাহেবের ছবি, তার বেটির ছবি এবং এই এলাকার যিনি নৌকা মার্কার টিকেট পেয়েছেন তাঁর ছবি। জয়নাল এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নৌকাটির দিকে নির্বোধের মতো চেয়ে রইল। সে ভোটার, কিন্তু কাকে ভোট দেবে এখনো জানে না। মন্ডল এখনো বলেনি কাকে ভোট দিতে হবে। কেউ জয়নালের কাছে ভোট চাইতেও যায়নি।

‘এই, কে রে তুই?’ এক যুবক ধমকের সুরে জিজ্ঞাসা করল জয়নালকে। জয়নাল কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না।

যুবক তাকে বলল, ‘বাড়ি কোন্টে?’

জয়নাল বলল, ‘মধুপুর, ভাই।’
‘কী দেখিস?’
‘কেছু লয় ভাই, ইমনি। নৌকাডা সুন্দর হোছে।’
‘কী করিস?’
‘মান্ষের বাড়িত কাজকাম করি। এখন কাম নাই, মাঠত পানি নাই তো!’
‘নৌকা মার্কার হয়া কাম কর, আয়।’
‘কী করা লাগবে, ভাই?’

যুবকটি জয়নালকে তাদের নির্বাচনী অফিস ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। একশটা পোস্টারের একটা বান্ডিল তার হাতে দিয়ে একটা মাটির ভাঁড় দেখিয়ে বলল, ‘এডা লে। মুকুর হুটাল চিনিস? মুকুর হুটালত যায়া এক কেজি ময়দা লিবু, পানি দিয়ে ময়দা আঠা আঠা করে গুল্বু। তার পর এই পোস্টারগুলা দেয়ালে দেয়ালে লাগাবু। লাগান শ্যাষ হলে ফিরে আসবু। একশ ট্যাকা পাবু। যা।’

জয়নালের হাতে তো পয়সা নাই। ময়দা কিনবে কী দিয়ে? কিন্তু সে কথা সে যুবককে বলতে পারল না। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল।

‘কী রে? বুঝিসনি?’

জয়নাল মাথা নেড়ে জানাল সে তার কর্তব্য বুঝেছে, কিন্তু তার পরও সে দাঁড়িয়েই রইল।

যুবক বলল, ‘সমস্যা কী? যা!’

জয়নাল এবার বলল, ‘মোর কাছে ট্যাকা নাই ভাই, ময়দা কিনমু কী দিয়ে?’

যুবক বলল, ‘আরে পাগলা, ময়দা কিনা লাগবে না। মুকুক্ যায়া কবু, তালেই দিয়ে দিবে। যা, তাড়াতাড়ি যা।’

৫.
একটা চিকন গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে পোস্টার সাঁটছে জয়নাল। তিন তরুণ তার দুপাশে এসে দাঁড়াল। এক তরুণ তাকে বলল, ‘থাম থাম। এত কষ্ট করা লাগবে না। কয় ট্যাকা দিছে?’
জয়নাল ভয়ে ভয়ে বলল, ‘ট্যাকা অ্যাখোনো দ্যায়নি, ভাই। কাম শ্যাষ হলে দিবে।’
‘কয় ট্যাকা দিবে?’
‘একশ ট্যাকা, ভাই।’
‘পোস্টার কতগুলা?’
‘একশডা।’
‘পোস্টারগুলা এদিকে দে। আর তুই বাড়িত চলে যা। খবরদার, কাক্কো কবু না। সোজা বাড়িত চলে যাবু।’

মানি ব্যাগ থেকে দুটি একশ টাকার নোট বের করে তরুণ বলল, ‘এই লে, একশ লয়, দুই শ ট্যাকা।’

জয়নাল কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘না ভাই, অরা মোক্ মারবে।’
‘ভয় নাই। কেউ জানা পাবে না। ধর, ট্যাকা লে। লিয়ে সোজা বাড়িত চলে যা। এই তল্লাটে তোক যান আর না দেখি।’ তরুণটি তার সঙ্গীদের ইঙ্গিত করল, তাদের একজন পোস্টারের গোলাকার বান্ডিলটা তুলে নিয়ে বগলদাবা করল।

জয়নাল কাঁপা কাঁপা ডান হাতটা বাড়িয়ে নোট দুটো খামচে ধরে মুঠির মধ্যে নিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে এমনভাবে দৌড়ে গলির ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো, যেন তাকে কোনো হিংস্র জন্তু তাড়া করছে।

দুপুরের একটু পরে লাল টকটকে ঝুঁটিওয়ালা একটা মোরগ নিয়ে জয়নাল বত্রিশটা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বাড়িতে ঢুকল।

৬.
এই দরিদ্র অঞ্চলে গরীব ভূমিহীন স্বপ্নহীন ক্ষেতমজুদের বউরা খুব তাড়াতাড়ি পুরোনো ও কুশ্রী হয়ে যায়। তাদের স্বামীরা অচিরেই তাদেরকে গৃহস্থদের বাড়িতে ঝিগিরি করতে পাঠায়, কারণে-অকারণে প্রহার করতে শুরু করে। কিন্তু দুই মাস পেরিয়ে গেছে, জয়নাল তার বউয়ের গায়ে হাত তুলেছে এমন কথা কেউ একদিনও শুনতে পায়নি। আর পরের বাড়িতে কাজ করতে পাঠানো? জয়নাল মনে হয় সেটা জীবনেও করবে না। গ্রামের লোকেরা বলে জয়নাল বিয়ে করে আরো ফূর্তিবাজ হয়েছে। তারা বলে যে জয়নালের মতো বউপাগলা পুরুষ এ গাঁয়ে কখনো জন্মায়নি।

সত্যি। দারিদ্র্য আর উদয়াস্ত হাড়ভাঙা খাটুনির মধ্যেও জয়নালের চোখের সামনের পৃথিবীটা যেন এক ঘোরলাগা রঙিন জগৎ। চাঁদের আলোয় সে দেখতে পায় উঠানের ডালিম গাছে মুক্তা ঝুলে আছে। সকালে চোখ মেলে সে দেখে, এক অদ্ভুত রাঙা আলোয় ভরে আছে সমস্ত পৃথিবী। জীবনের ঘোর তার কিছুতেই কাটে না, তার চারপাশের রঙিন পর্দাটি কিছুতেই সরে না।

৭.
শুক্রবার দুপুরবেলা জুম্মাঘরের সামনের চত্বরে সরকারি টিউবঅয়েলটি ঘিরে এক দঙ্গল ছেলে বুড়া ইচ্চিপিচ্চির ভিড়। গোসল করার ধুম চলছে। দুই-একজন গোসল করছে আর অপেক্ষমাণ অন্যরা নিজেদের পালা না আসা পর্যন্ত বসে বসে গল্প করছে। তাদের কারো কাঁধে, কারো কোমরে গামছা, মাথায় পাগড়ির মতো গোল করে বাঁধা লুঙ্গি। কেউ এসেছে বালতি নিয়ে, কেউ বদনা।

এখন এক সঙ্গে গোসল করছে জয়নাল, আমজাদ আর সলিমুদ্দি। সলিমুদ্দির ছোট্ট ছেলেটা বাপের কোমর চেপে ধরে তার নাভির সঙ্গে গাল পেতে আছে, সলিমুদ্দি বালতিভর্তি পানি ঢালছে নিজের মাথায়—বাপ-বেটার গোসল হয়ে যাচ্ছে এক সঙ্গে। আমজাদ দুই বালতি পানি ইতিমধ্যে নিজের গায়ে ঢেলেছে, এখন বালতি ভরে নিয়ে একটু দুরে এসে গা কচলাচ্ছে। এই ফাঁকে তিন-চারটা শিশু হামলে পড়ল টিউবঅয়েলের হাতলের ওপর। তাদের একজন হাতল ধরে দোল খাচ্ছে আর অন্যগুলি টিউবঅয়েলের মুখের পানির ধারার নিচে বসার যুদ্ধে তুমুল ঠেলাঠেলি করছে। জয়নাল হাতলটা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল, ‘এই চ্যাংরাপ্যাংরাগুলার অত্যাচারে আর শান্তিমতন ডুব পারা গেল না বারে। এই, যাও যাও, সরো।’

আমজাদ দুষ্ট শিশুর দলকে বলল, ‘এই পকর যাও, পকর যাও।’

জয়নাল আমজাদকে সমর্থন করে শিশুদের ভর্ৎসনা করতে লাগল, ‘এই উকরি-পুকরির দল, তোরাই কি ভদ্রলোক হছিন নাকি রে? পকর গেলে হয়?’

এক দুষ্ট ছেলে প্রতিবাদে চটাং করে লাফ দিয়ে উঠল : ‘ক্যা, পকর যামো ক্যা? কল থাকতে পকরত্ ডুব দিয়ে চুলকানি-পচারি ধরামো নাকি? তোমরাই পকর যাওয়া পারিন না?’

এত ছোট ছেলের মুখে এমন প্রতিবাদ শুনে জয়নাল হতবাক। সে সলিমুদ্দির দিকে চেয়ে বলল: ‘শুনিছু সলিমদ্দি ভাই, খাতুর ব্যাটা কয় কী শুনিছু?’

খাতু নামক পিতার প্রতিবাদী পুত্রটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে আবার জয়নালকে মুখঝামটা মারল: ‘ক্যা? কমো না ক্যা? কল কি তোর বাপের নাকি?’

জয়নাল রেগে গিয়ে চটে গিয়ে ধমক দিয়ে উঠল, ‘খাতুর ব্যাটা, লল্লিত টিপা দিয়ে এক্কিবারে ম্যারে ফালামু।’

খাতুর বেটা আর একটু সরে গিয়ে কোমরে দুহাত রেখে বাহাদুর মরদের মতো জয়নালকে যুদ্ধে আহ্বান করল, ‘আয় দিনি?’

জয়নাল বালতিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে খাতুর বেটার দিকে ধেয়ে গেল। খাতুর ব্যাটা উল্টা দিকে ঘুরে পিছনের পথটা দেখে নিল, তার পর মুখ ফিরিয়ে জয়নালের দিকে চেয়ে বলল, ‘তোর বউয়ের গোয়া!’ বলেই লাগাল ভোঁ দৌড়। জয়নালের কানদুটোতে ঝাঁ করে আগুন ধরে গেল, তার উপর আমজাদ যখন দাঁত বের করে ‘এক্কিরে জয়নাল, তোর লতুন বউডার মান-ইজ্জত থুলো না’ ইত্যাদি বলতে বলতে উপস্থিত লোকজনদের মুখের দিকে তাকাতে লাগল, তখন ভেজা গায়ে ভেজা লুঙ্গিতে ফটাস ফটাস শব্দ তুলে জয়নাল খাতুর বাড়ির দিকে ছুটে গেল।

খাতুর বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাটিতে গুঁড়ি মারতে মারতে জয়নাল চিৎকার ছাড়ল, ‘খাতু ভাই, খাতু ভাই, তোর ব্যাটাক্ যদি তুই শাসন না করিস মোর শাসন কিন্তুক সহ্য করা পারবে না।’

খাতু বেরিয়ে এসে জানতে চাইল কী হয়েছে, জয়নালের এমন উত্তেজনার কারণ কী।

কিন্তু জয়নালের মুখ থেকে আর কথা বেরোল না। সে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘খুব ব্যাদ্দপ হয়া গেছে তোর ব্যাটা।’

খাতু বুঝতে পারল না কী এমন বেয়াদপি করেছে তার ছেলে যার জন্য জয়নালকে গোসল ছেড়ে এমন ভেজা কাপড়ে দৌড়ে তার বাড়ির দরজা পর্যন্ত আসতে হয়েছে। খাতু এবার স্পষ্ট করে জানতে চায়, ‘তা কী করিছে মোর ব্যাটা?’
‘খুব ব্যাদ্দপ হয়া গেছে!’
‘তা কী ব্যাদ্দপি করিছে সিডা কস না ক্যা?’

খাতুর বেটা যে কথা বলে জয়নালের বউয়ের ইজ্জত মেরে দিয়েছে সে কথা জয়নাল নিজমুখে কিভাবে উচ্চারণ করতে পারে? সে একটা দম ফেলে আবার দম নিয়ে রাগে মাটিতে গুঁড়ি মারতে মারতে বাড়ি ফিরে গেল।

৮.
জয়নাল বাড়ি ফিরে দেখতে পেল বউ বিছানায় পড়ে ছটফট করছে। বউয়ের ছটফটানি আর লালচে মুখ দেখে জয়নাল ভয় পেয়ে ছুটে গিয়ে তার কপালে হাত রেখে চিৎকার করে উঠল, ‘ক্যা চাচি, বউয়ের গাও জ্বরে পুড়ে যায়, আর তোর হুশজ্ঞান নাই?’

কিন্তু চাচা-চাচির কোনো সাড়াশব্দ এলো না। চাচা হয়তো জুম্মাঘরে নামাজ পড়তে গেছে, আর চাচি, যে এখন আর তালুকদার বাড়িতে কাজে যায় না, সে যে কোথায় গেছে কে জানে। বউ জ্বরে কাতরাচ্ছে, যন্ত্রণায় ছটফট করছে—এই দৃশ্য দেখে জয়নালের বুকের ভিতরটা যন্ত্রণায় মোচড় খেতে শুরু করল। সে বারবার ‘চাচি হারামজাদিটা গেল কোন্টে’ বলতে বলতে দাঁত কামড়ায়। বউয়ের কপালে হাত রেখে তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে ‘বউ, ও বউ, কী হলো তোর’ বলে ঝাঁকায়, সারা ঘর দাপিয়ে বেড়ায়, ঘর থেকে বেরিয়ে চিৎকার ছাড়ে, ‘চাচি, ওই চাচিবুড়ি, গেলু কোন্টে তুই?’

জয়নাল বউয়ের মাথায় পানি ঢালে, তার শিয়রের কাছে বসে থাকে সারারাত। এক চুলও নড়ে না। তার এই অবস্থা দেখে চাচা-চাচি বিরক্ত হয়। চাচি বলে, ‘আহ্লাদের আর শ্যাষ নাই।’ চাচা বলে, ‘জ্বরজারি কি মানষের হয় না?’

জয়নাল তাদের কোনো কথাই মানে না। সে সারাঘর শুধু পায়চারি করে আর ফিরে ফিরে এসে বউয়ের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলে, ‘কী হলো! ও বউ, তোর কী হলো!’

শেষ রাতে বউ বলল, ‘তুমি নিন যাও। কাল সকালেই হামার জ্বর ভালো হয়া যাবে।’

জয়নাল অবুঝ বালকের মতো উদগ্রীব হয়ে বলল, ‘সত্যিই ভালো হয়া যাবে তো?’
‘হয়, তুমি নিন যাও।’

বউ এমন নিশ্চিত সুরে কথাটা বলল যে জয়নালের স্বস্তি বোধ হলো। সে বউয়ের পাশে আস্তে করে শুয়ে পড়ল, তার কপালে স্নেহভরা হাত রেখে বলল, ‘ভাল হয়া যাবু। কাল সকালেই আল্লা তোক ভাল করে দিবে, দেখিস।’

বউ লক্ষ্মী মেয়ের মতো বলল, ‘আচ্ছা।’

জয়নাল আবার কাল সন্ধ্যায় সুস্থ বউকে নিয়ে খালের পাড়ে বসে জোনাকি জ্বলা দেখবে, তার সঙ্গে মজার মজার সব গল্প করবে—এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।

কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙার পরে সে দেখতে পেল বউ আবার যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তার ফর্সা মুখটা পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। কপালে হাত রেখে সে টের পেল, প্রচণ্ড জ্বরে গা সত্যিই পুড়ে যাচ্ছে। জয়নাল চৌকিতে মাথা ঠুকতে লাগল: ‘ও বউ, কী হলো তোর! ও আল্লা, কী পাপ করনু মুই, মাপ কোরে দে।’

চাচি বলল, ‘কপালত জলপট্টি দেওয়া লাগবে।’

জয়নাল চিৎকার করে উঠল, ‘দেওয়া লাগবে তে আগে কসনি ক্যা?’ তার পর সে গামলা ভরে পানি এনে গামছা ভিজিয়ে বউয়ের কপালে চেপে ধরে বিড়বিড় করে আল্লাহকে ডাকতে লাগল: ‘ও আল্লা, মাপ করে দে। মাপ কার দে মাবুদ। দরগাতলিত্ শিন্নি দিমু, মাপ কেরে দে। মোর বউক্ ভাল কোরে দে।’ তার পর সে তার বউকে ধরে ঝাঁকায় আর বলে, ‘ও বউ, আল্লা আল্লা কর, আল্লা আল্লা কর।

বউ কাতরায়, মাকে ডাকে, আল্লাকে ডাকে। জয়নাল বলে, ‘হয় হয়, বেশি করে আল্লা আল্লা কর। ভাল হয়া যাবু, আল্লামাবুদ তোক্ ভাল কোরে দিবে। আল্লা, রহম করিস মাবুদ!’

৯.
দুপুরের দিকে জ্বর একটু পড়ে এলো। বউ ইশারায় জয়নালকে ডাকল। জয়নাল কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে বউয়ের মুখের দিকে চেয়ে বলল, ‘কী কস, বউ?’ বউ নিস্তেজ কণ্ঠে বলল, ‘ট্যাংরা মাছ দিয়ে চারটা ভাত খাবার মন চায়।’

জয়নাল লাফ দিয়ে উঠে তৌরা জালটা কাঁধে নিয়ে বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে মনে মনে বলল, দুনিয়ার ব্যাবাক ট্যাংরা মাছ আজ ধরে লিয়ে আসমু।
জয়নাল ঝপাৎ শব্দে খালের পানিতে জাল ছুড়ে দিল, দিয়ে হাঁপাতে থাকল, কোমর হেলিয়ে সামনে ঝুঁকে দুই হাঁটুতে দুহাতে ভর দিয়ে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বড় বড় চোখে খালের পানির দিকে চেয়ে রইল। খালের পানি কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে এলো। এবার সে জাল টানতে শুরু করল।

জালে মাছ উঠল না। শামুক ঝিনুক গুগলি ব্যাঙ কাঁকড়া রাজ্যের আবর্জনা উঠে এলো। জয়নাল জাল ঝেড়ে আবর্জনা পরিষ্কার করে আবার ছুড়ে দিল। আবার টেনে তুলল। মাছ উঠল না। আবার জাল ঝাড়ল, আবার ছুড়ে দিল, আবার টেনে তুলল। কিন্তু নিষ্ফল। এই নিষ্ফলতার চক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে জয়নাল বিড়বিড় করে বলল, ‘মাছ গ্যালো কোন্টে? কোন্টে গ্যালো দুনিয়ার ব্যাবাক মাছ?’

ভেজা জালটা কাঁধে নিয়ে এবার সে খালের পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করল। তার মনে হলো, খালটা বাড়ির এত কাছে বলেই কোনো মাছ নাই, লোকজন সব মাছ ধরে খেয়ে ফেলেছে। দূরে গেলে নিশ্চয়ই কিছু মাছ পাওয়া যাবে। দূরে গিয়ে সে জাল ফেলল। কিন্তু দূরেও মাছ নাই। সে বেকুব বনে গেল। জাল রেখে মালকোঁচা বেঁধে খালের পানিতে নেমে পড়ল। জালেই যেখানে মাছ আটকা পড়ছে না, সেখানে সে শুধু দুই হাত দিয়ে মাছ ধরতে চায়। সে খালের তলার কাদামাটি হাড়তে বেড়াল। হাতে শামুক ঠেকল, কাঁকড়ার সুচালো ঠ্যাং ফুটে গেল।

‘ঘটনা কী? কোন্টে গ্যালো দুনিয়ার ব্যাবাক মাছ?’

জয়নালের মনে হলো, সে এক অলীক জগতে ঢুকে পড়েছে, এখানে যা-কিছু ঘটছে তার কিছুই সত্য নয়। দুনিয়ার সব মাছ উধাও হয়ে গেছে এটা হতে পারে না, তার সারা জিন্দেগিতে কখনো এরকম হয়নি।

সে শূন্য হাতে খালের পাড়ে উঠে দাঁড়াল। মালকোঁচা খুলে লুঙ্গি চিপে পানি নিংড়াতে নিংড়াতে ভাবল, এখন খালি হাতে ক্যাংকা করে বাড়িত ফিরে যাই? আহারে, বউডা মোর ট্যাংরা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাবা চায়। সে হঠাৎ চিৎকার উঠল: ‘ও ট্যাংরা মাছের গ্যাতিগুষ্টি, কোন্টে গেলিন তোমরা সকলে? ইংকা নিমকহারামি কোরো না হামার সাথে।’

খালপাড়ের সড়ক ধরে কাঁধে লাঠি জাল খালুই নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে খয়বর জেলে।

জয়নাল হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠল, ‘খয়বর ভাই, কোন্টে যাস? মাছ মারবা?’

খয়বর সাড়া দিল না। মাথা নিচু করে আপন মনে দুলকি চালে হেঁটে চলল।

জয়নাল বলে উঠল, ‘মাছ ত নাই। উধাও হয়া গেছে শুয়োরের বাচ্চারা।’
‘মাছ ধরবা জানা লাগে।’ ফুটানি প্রকাশের সুরে বলল খয়বর জেলে। নিজের পথে নাচতে নাচতে হেঁটে চলল হাটের পথে।

জয়নাল দৌড়ে তার দিকে যেতে যেতে বলল, ‘থাম থাম! মিচ্চি অ্যানা থাম রে ভাই।’

খয়বর একটুও থামল না।

তার পিছু পিছু যেতে যেতে জয়নাল বলল, ‘তালে তোর খলইত্ মাছ আছে?’

খয়বর বলল, ‘মাছার খলইত মাছ থাকবে না তে কার কাছে থাকবে?’
‘এনা থাম রে, ভাই।’
‘ক্যা?’
‘মুই মাছ কিনমু।’
‘মৎস্য বেন্নাগেরে খাদ্য লয়।’ খয়বর একই তালে এগিয়ে চলল।

এবার জয়নাল চিৎকার করে উঠল, ‘থাম কনু, থামেক!’

খয়বর থমকে দাঁড়াল। সে অবাক।

জয়নাল বলল, ‘কয় ট্যাকার মাছ আছে তোর খলইত্?’
‘ক্যা? তোর আবার ট্যাকার গরম হলো কোন্টে থিনি?’
‘বেশি কতা কস না। খলই নামা।’
‘লে দ্যাখ। দেখেই হাউস মিটা। কিনার মুরাদ হোবে না।’

জয়নাল দেখল, তেলাপিয়া, সিলভার কার্প, কই, পুঁটি এবং বড় বড় ট্যাংরায় খয়বরের খলুইটি রীতিমতো ধনী।

‘ট্যাংরা কত্টি আছে?’ জয়নাল জানতে চাইল।
‘স্যারখানেক হোবে, ক্যা?’
‘দাম কত?’
‘ক্যা? কিনবু নাকি?’
‘দাম কত তাই ক।’
‘আশি ট্যাকা।’

জয়নাল তার জালটা দেখিয়ে বলল, ‘মোর এই জালের দাম কটিৎ হোবে?’
‘ক্যা?’
‘আগে ক কত হোবে? লতুন জাল।’
‘শত্খানেক হবার পারে।’
‘গুলতানি মারিস না। খালি সুতার দামই আছে দ্যাড়শ ট্যাকা! তার উপর আছে কাঁটির দাম, আছে বুনানির খরচ।’
‘এই হিসাব দিয়ে মুই কী করমু?’
‘মোর এই জালডা তুই লিয়ে লে। আর ট্যাংরা মাছ যতগুলা আছে ঢাল মোর খলইত্। পনচাশ ট্যাকা পরে ফেরত দেস।’
‘না, জাল মুই নিমু না। মোর জাল আছে।’
‘ঠিক আছে লে, ট্যাকা ফেরত দেওয়া লাগবে না। লে লে, তাড়াতাড়ি কর।’

খয়বর জেলে বেছে বেছে শুধু ট্যাংরা মাছগুলো নিজের খলুই থেকে জয়নালের খলুইতে পার করে দিল। তার পর জয়নালের জালটা নিজের লাঠির এক মাথায় বেঁধে নিয়ে নিজের খালুইটি অন্য মাথায় নিজের জালের পাশে ঝুলিয়ে লাঠিটা কাঁধে ফেলে নাচতে নাচতে চলে গেল হাটের পথে।

জয়নাল ট্যাংরা মাছসুদ্ধ ছোট্ট খালুইটা হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করল। ইতোমধ্যে বেলা পড়ে গেছে, জয়নালের মনটা ছট ফট করে উঠল : ‘আহারে, বউটার বুঝি কত খিদা লাগিছে!’

১০.
জয়নাল দূর থেকে দেখতে পেল তাদের বাড়ির সামনে লোকজনের ভিড়। সে একটু থেমে দাঁড়াল, তার পর আবার হাঁটতে থাকল। বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছলে লোকজন সরে গিয়ে তাকে পথ করে দিল। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নাই। ভিড়ের পেছনের দিকে দুয়েকজন চাপা স্বরে ফিস ফিস করে কিছু বলল।

জয়নাল বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখতে পেল, উঠানের মাঝখানে খা খা রোদে একটা চৌকি পাতা হয়েছে। চৌকির উপর একটা লাশ, মাথা থেকে পা পর্যন্ত ময়লা কাঁথায় ঢাকা। চৌকির এক কোণে থুতনি রেখে চুপ করে আছে চাচি। কাঁদছে না, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।

জয়নাল হাতের খলুইটা মাটিতে রেখে আঙিনা থেকে সামান্য উঁচু মাটির বারান্দার কিনারে বসল। দুই হাঁটুতে কনুই ঠেস দিয়ে গলাটা লম্বা করে ছেড়ে দিল, তার মাথাটা ঝুলে পড়ল। লোকজন গোল হয়ে ঘিরে ধরল তাকে, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলল না। তাদের কারো কারো মনে হলো, জয়নাল এক্ষুনি ডুকরে কেঁদে উঠবে, তার কান্নার শব্দে আসমানটা ফালা ফালা হয়ে যাবে।

কিন্তু জয়নাল কাঁদল না, চোখ বন্ধ করে বসে রইল। তার মাথাটা দুই বাহুর মাঝখানের ফাঁকে ঝুলে রইল।

চাচা কাছে এসে বলে, ‘কী জয়নাল, বসে থাকলু ক্যান, বাপ? দাফন-কাফনের জোগাড়পাতি করা লাগে ত!’

জয়নাল মাথা তুলল না। চুপচাপ ঝিম মেরে বসেই রইল।

চাচা তাড়া দিল, ‘ওঠ্ বাপ, মউতা বেশিক্ষণ থোওয়া ঠিক লয়, আজাব হয়।’

জয়নাল এবার মাথা তুলল। সবাই তার মুখের দিকে উৎসুক চোখে তাকাল। তারা দেখতে পেল: কিছু হয় নাই জয়নালের। মরদ শক্ত আছে!

বাঁশ কেটে খাটিয়া বানানো হলো, মউতাকে গোসল করানো হলো, গোলাপজল ছিটানো হলো, ধূপকাঠি জ্বালানো হলো, খুব তাড়াতাড়ি সব বন্দোবস্ত হয়ে গেল। মধুপুরের কোথাও কোনো বিকার দেখা গেল না। জয়নালের বউয়ের মরে যাওয়া কারো কান্নার উদ্রেক করল না: মেয়েটি এখনো এ গাঁয়ে নতুন। শুধু জয়নালের চাচির বুঝি মেয়েটির জন্যে মায়া পড়ে গিয়েছিল, শুধু সে বুড়িই মাঝেমাঝে নাকি স্বরে কেঁদে উঠছে। শুধু তখনই মনে হচ্ছে যে বাড়িটা একটা মরাবাড়ি।

খাটিয়া গোরস্থানের পথে রওয়ানা দেওয়ার আগমুহূর্তে দোস্ত ইদ্রিস জয়নালকে বলল, ‘জয়লাল, দোস্ত, বউয়ের মুখটা একবার দেখবু না?’

জয়নাল অবশেষে মুখ খুলল: ‘মুখ দেখে আর কী হোবে? এমন বেয়াক্কালা মেয়ামানুষ আর দুনিয়াত নাই। মরেই যদি যাবু, তালে কলু ক্যান যাও মাছ ধরে আনো! ক্যান কলু না কাছে থাকো!’

বউকে কবরে রেখে এসে জয়নাল আবার বারান্দার কিনারে বসে ঘাড় শিথিল করে মাথাটা ঝুলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। তার পর ঝপ করে রাত নেমে এলো। পাড়াপ্রতিবেশীরা একে একে চলে যেতে লাগল, যাওয়ার সময় নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল :
‘হামাগেরে জয়নাল শক্ত মরদ আছে।’
‘আরে বাপু, বউ মরা কোনো ব্যাপার হলো? এক বউ মলে দশটা বউ পাওয়া যায়।’
‘হয় হয়, দ্যাশ জুড়ে কত মেয়া, আর হামাগেরে জয়নাল যে তাগড়া জুয়ান, আজই হয় করলে কালই কত মেয়ার বাপ ঘড়ি সাইকেল ট্যান্ডিস্টার লিয়ে দৌড়ে আসপে...!’

অনেকক্ষণ পর জয়নাল মাথা তুলে বিড় বিড় করে বলল, ‘মরেই যদি যাবু, তালে মোক্ মাছ ধরবা পাঠালু ক্যান? ক্যান কলু না কাছে থাকো?’

গলির মোড়ে কুকুর কেঁদে উঠল। দূরে শিয়ালের ঝাঁক হুক্কাহুয়া শুরু করল। বাঁশঝাড়ে একটা পেঁচা ডেকে উঠল।

চাচি জয়নালকে ভাত খেতে ডাকল। জয়নাল আবার মাথা ঝুলিয়ে অন্ধকার মাটির দিকে চেয়ে বলল, ‘খিদা নাই।’

অনেকক্ষণ সে নীরব অন্ধকারে একা একা বসে রইল। তার পর কোমরে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়াল, আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদ নাই, একটা তারা পর্যন্ত নাই। আকাশ ভাতরাঁধা মাটির পাতিলের তলার মতো কালো। কোথাও কোনো আলো নাই।

জয়নাল নিজের ঘরে গেল। দরজায় খিল না এঁটেই শুয়ে পড়ল।

জয়নাল ঘুমিয়ে পড়ল। আর জাগল না। সে আর কোনো দিন জেগে ওঠেনি।

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;