জিপার



আন্দালিব রাশদী
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

জায়গাটা ঠিক ধানমন্ডিতে নয়, কিন্তু ধানমন্ডি দাবি করতে করতে একসময় সিটি কর্পোরেশন মেনে নিয়েছে, ঠিক আছে, পশ্চিম ধানমন্ডি। সাতমসজিদ রোডের পশ্চিমে, শঙ্কর প্লাজা ঘেঁষে সামনে কিছুটা এগিয়ে খুশবু রেস্তোরাঁ আর একাধিক বিরিয়ানি হাউস ডিঙ্গিয়ে বামদিকে অন্তত পঞ্চাশ গজ এগিয়ে আবার বামে। হোসেন আলী গার্লস স্কুল পেরিয়ে পশ্চিম ধানমন্ডি ইউসুফ হাইস্কুল লাগোয়া বাড়িটা পাকিস্তান আমলের। ভাইবোনদের গোলযোগের কারণে ডেপেলাপার এসেও ফিরে গেছে। পরিবারের মধ্যে এর বিরুদ্ধে ওর প্যাঁচ লাগিয়ে যে বোনটি সমস্যা জিইয়ে রাখত ক’দিন আগে একটি ভয়াবহ স্ট্রোক তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে, আর কথা এতটাই অস্পষ্ট হয়ে গেছে যে ভাইবোনেদের কেউই বুঝতে পারছে না, ফলে নিজেদের মধ্যকার বিরোধের তীব্রতা কমে এসেছে, সবাই ডেভেলাপার ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছে। আলাপ-আলোচনা—বিশেষ করে সাইনিং মানি কত হবে, অ্যাপার্টমেন্ট ভাগাভাগির অনুপাত ষাট চল্লিশ নাকি পঞ্চাশ পঞ্চাশ তাও অনেকটাই চূড়ান্ত হয়ে গেছে। হস্তান্তর দেরি হচ্ছে কারণ মন্টুর বিয়েটা ভাড়া বাড়িতে হোক এটা বাবা চাচ্ছেন না।

মন্টু দেড়মাসের ছুটিতে নিউজিল্যান্ড থেকে এসেছে। খুকুর ছবি দেখেই বলেছিল, দারুণ তো।

মন্টু গত দশবছরে সাতবার দেশে ফিরেছে, অনুপস্থিতির সময় তার নিচতলার রুমটা হাতছাড়া হয়ে গেলেও ফেরার তারিখ সাব্যস্ত হলে বাবা রুমটাতে ঝাড়পোছ করাতেন, বিয়ে সামনে রেখে এবার ভালোরকম চুনকামও করিয়ে দিয়েছেন।

মন্টুর বড়বোন ঝর্ণা আপু এবার সতর্ক—মন্টুকে পাত্রীর সাথে কথা বলতে দেবেন না। কথাবার্তা বললেই মন্টু সব গুলিয়ে ফেলবে যেমনটা করেছে আগেরবার, প্রায় দেড় বছর আগে। বাবার কলিগের মেয়ে মাফরুহাকে প্রায় সবাই পছন্দ করেছিল, মন্টুও নিজেও। গায়ে হলুদের ঠিক আগের দিন ঝর্ণা আপুকে বলল, আমি মিথ্যে দিয়ে জীবনটা শুরু করতে চাই না। মাফরুহাকে দশ মিনিটের জন্য হলেও আমার সাথে ওয়ান টু ওয়ান কথা বলার একটা স্কোপ করিয়ে দাও। আমি কথাটা বলি।

ঝর্ণা বলল, তুই আমাদের আয়োজনটা নষ্ট করে দিবি। একটা ভালো মেয়ে হাতছাড়া হয়ে যাবে।

মন্টু বলল, ভেবো না আমি খুব সামলে বলব।

ধানমন্ডির পুরনো ২৭ নম্বর, নতুন ১৬ নম্বর রোডে কফি ওয়ার্ল্ডে দুজনের মোলাকাত সাব্যস্ত হয়। দুজন এক টেবিলে বসবে, খানিকটা দূরে অন্য একটি টেবিলে মাফরুহার ছোট মামী ও ঝর্ণা বসে কফি খাবে, একটুখানি গপসপ করবে।

দুজনই পূর্ব পরিচিত। বিসিএস পরীক্ষা দেবার জন্য দুজন একই জায়গায় কোচিং করেছে এবং দুজনের কেউই প্রিলিমিনারি পর্বও ডিঙাতে পারেনি। দুজনের কেউই অন্য কোনো চাকরিরও চেষ্টা করেনি। মাফরুহার ছোট মামী আমেরিকায় মাইগ্রেট করবে, কাগজপত্র পাকাপাকি করছে আর ঝর্ণার স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে, এখন স্টেজ টু-তে, নিজেই বলেছে পুরোপুরি সেরে যাবার নিশ্চয়তা না পেলে কোনো চাকরিতেই যাবে না বাসায় থাকবে, খাবে ঘুমাবে, তারপর মারা যাবে; ক্যান্সার আর জায়গা পেল না—একেবারে ব্রেস্টে ধরেছে!

ঝর্ণা ও মাফরুহার ছোট মামী কেবল কফিতে চুমুক দিয়েছে, মাফরুহা হঠাত্ চিত্কার করে মন্টুকে চিট, ফ্রড, ইমপোস্টার—এসব গাল দিতে শুরু করল এবং আরো বলল সাধু সেজে বিয়ের প্রস্তাব দেবার জন্য তাকে এখনই পুলিশে সোপর্দ করা উচিত।

মন্টু কিছু বলতে চাইছিল, মাফরুহা বলল, ইউ শাট আপ।

এমন খোলামেলা কাফেতে মন্টু মাফরুহার গায়ে হাত দিয়েছে এমন মনে করার কারণ নেই, কিন্তু কাফের লোকজন যেভাবে যেভাবে মন্টুর ওপর দৃষ্টি ফেলছে যে কারোরই মনে হবে তারা জীবনে প্রথম একজন ধর্ষণকারীকে এত কাছ থেকে দেখছে।

ওহ্ মাই গড, রেইপিস্ট।

মাফরুহা হাইহিলের খট খট শব্দ তুলে বলল, চললাম।

তার ছোট মামী দুশো টাকা দামের কাপোচিনোতে আর একটি কেবল চুমুক দিয়ে তার পেছন পেছন ছুটল।

ঝর্ণা মন্টুকে জিজ্ঞেস করল, কী রে কি ঘটল?

মন্টু বলল, আল্লাহ বড় বাঁচা বাঁচিয়ে দিয়েছেন। শি ইজ অ্যা ক্র্যাজি ওমেন। থ্যাঙ্ক ইউ আপু, ভাগ্যিস এই সিটিংটা অ্যারেঞ্জ করেছিলে, নতুবা আমার লাইফটা হেল হয়ে যেত।

কিন্তু এবার কী হবে?

মন্টু রাজি হলো পাত্রীর সাথে কথা বলে পরিস্থিতি জটিল করে তুলবে না, কিন্তু পাত্রীকে একটি ব্যক্তিগত চিঠি দেবে যা কেবল পাত্রীই দেখবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে খামবন্ধ সেই চিঠি পাত্রীর হাতে দেবার দায়িত্ব ঝর্ণাই নিল।

খুকুর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান থেকে মধ্যরাতে পাত্রপক্ষের যেসব বন্ধু ও স্বজন ফিরে এলো তাদের চোখেমুখে আনন্দ। গায়ে হলুদ দেবার সময় মেয়েটাকে একটু হলেও ছুঁয়ে দেখা যায়। যারা তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছে এবং হলুদ দেবার নাম করে আলতো করে ছুঁয়েছে, তাদের সবাই বলেছে, দারুণ দেখতে, এ ডাবল প্লাস। খুকুর গায়ে হলুদেই যে জাঁকালো অনুষ্ঠান করা হয়েছে পাত্রপক্ষ বৌভাতেও এত বড় আয়োজন করতে পারবে না। ধনী পরিবারের মেয়ে, তার উপর সুন্দরী। খুকুর গালে ও কপালে এক চিমটি হলুদের ছোঁয়া দিয়েছে মন্টুর সবচেয়ে বড় বোনের মেয়ে টুশি।

টুশি আগে পাশের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছে, মামী কি সত্যিই এত সুন্দর!
একটু মেকআপ তো আছেই, কিন্তু গালটা এমন তুলতুলে করল কিভাবে?

যারা ভিডিও করেছে, ক্যামেরায় স্থিরচিত্র ধারণ করেছে, সেলফোনের ক্যামেরায় যারা খুকুকে টার্গেট করেছে সকলেই যার যার ছবির সংগ্রহ মন্টুর ডেস্কটপ কম্পিউটারে ডাউনলোড করে দিয়ে গেল। চলমান ছবি আর স্থির ছবি দেখে দেখে মন্টু বাকি রাতটা অবলীলায় পার করে দিতে পারবে। সকালের নাস্তা সেরে একটা ঠান্ডা ঘুম দেবে।

একজন পুরুষ মানুষের জন্য সুন্দরী স্ত্রীর অধিকারী হবার মতো গৌরবের আর কিছু নেই। রুমের দরজা বন্ধ করে কম্পিউটারের স্ক্রিনে খুকুকে দেখে মুগ্ধ হয় এবং একসময় স্বগতোক্তি করতে থাকে: তুমি কত সুন্দর!

মন্টু তার দেখা সুন্দরী তরুণীদের চেহারা মনে করতে থাকে। বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিত, অপরিচিতজনের স্ত্রীদের কাল্পনিক ছবি একে একে খুকুর পাশে পেস্ট করে এবং বলে, ধারে কাছে আসার মতোও নয়, একজনও না।

জুম করে খুকুর মুখমণ্ডলের প্রতিটি অংশ বর্ধিত আকারে কম্পিউটারের পুরো পর্দায় দেখে খুঁত বের করতে চেষ্টা করে। সকাল নাগাদ নিশ্চিত হয় খুকুর বাম চোখ একটু ট্যারা। যারা খুকুর গালে ও কপালে হলুদ লাগিয়েছে তাদের কেউ এ কথাটি বলেনি।

একটুখানি ট্যারা চোখ, এক গালে টোল, একপাশে গেজ দাঁত এমনিতেই নারীর চেহারায় ভিন্নমাত্রা যোগ করে। আর সে নারী যদি দেখতে সুন্দর হয়, তার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দেয়।

নির্ঘুম রাতটি পেরিয়ে যায়, সূর্য উঠি উঠি করছে—তার মনে হলো কোথায় সে খুকুর সৌন্দর্যে বুদ হয়ে থাকবে—তা না করে চেহারার খুঁত আছে কিনা তা বের করতে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। মন্টুর ছিদ্রান্বেষী স্বভাবটা পুরনো। সামনাসামনি একজন সিনেমার নায়িকাকে দেখে এসে বাসায় বলেছে, চেহারা ঠিকই আছে, কিন্তু নাকের ভেতর একটা চুল দেখতে পেয়েছি।

কলিং বেলটা তখনই বাজল।

এত সকালে তো কারো আসার কথা নয়। গ্রামের আত্মীয়দের কেউ হতে পারে, বাবা হয়তো তাদের দাওয়াত দিয়েছেন—মন্টুর বিয়েতে তোরা আসিস কিন্তু।

দরজার কাছে গিয়ে অভ্যাসবশত বলে উঠল, কে?
ভাই আমি, দরজাটা খুলুন।

অবশ্যই নারীকন্ঠ। আশি কি নব্বই হাজার জনে নারীকণ্ঠী দু’একজন পুরুষেরও দেখা মেলে।

আবারও সেই কণ্ঠ শোনে। মন্টু নিশ্চিত, এটা অবশ্যই নারীকণ্ঠ। নারীকণ্ঠের কিছু তাত্ক্ষণিক সতর্কীকরণ প্রতিক্রিয়া রয়েছে: মন্টু তুমি খালি গায়ে পরনে লুঙ্গি, মন্টু তোমার বিছানা ভীষণ অগোছালো, মন্টু টেবিলের ওপর তোমার মোজা ও আন্ডারওয়্যার কেন? মন্টু কমোডে সিগারেটের বাট ও ছাই ভাসছে—এখনই ফ্ল্যাশ করো, লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পরো, মোজা আন্ডারওয়্যার লুকোও, খালি গায়ে থেকো না, অশ্লীল দেখায়। পুরুষ কেউ হলে খালি গায়ে সমস্যা হতো না। যা কিছু করার তাড়াতাড়ি করো।

একটু কালক্ষেপণ করার জন্য মন্টু আবার জিজ্ঞেস করে, কে?
ভাই আমি, বলছি। খুলুন, আমি।
আমি! আমি আবার কে?
প্লিজ দরজাটা খুলুন।

কিছু কথা মন্টু বোকার মতোই বলে। এটা না বললেও চলত, তবুও বলল, একটু অপেক্ষা করুন, আমি খালি গায়ে, আগে শার্ট পরে নিই।

দরজার ওপাশ থেকে তাত্ক্ষণিক জবাব, আমি খুকু, আপনি যদি মন্টু হয়ে থাকেন, আপনাকে খালি গায়ে দেখলে অসুবিধা নেই।

তার মানে, সে যদি মন্টু না হয়, তাহলেই কেবল তার খালি গা ঢাকার ব্যাপার আসবে। কিন্তু মন্টু হলে তাকে যে কোনো অবস্থায় দেখার ওজিএল—ওপেন জেনারেল লাইসেন্স তাকে দেওয়া হচ্ছে। কাজেই একটু আগাম সে দেখতেই পারে।

দুই.
দরজায় অপেক্ষমাণ খুকু কে হতে পারে তা সে আঁচ করতে পারবে না মনে করার কারণ নেই।
মন্টু চারজন খুকুকে কমবেশি চেনে। দুজনকে ভালো করে। দুজনকে কম কম—একজনকে লাইভ দেখেছে, একজনকে ছবিতে। মেয়েহীন পরিবারের ছোটছেলে হুমায়ুন আজিজ মুস্তাকিমকে তার বাবা আদর করে ডাকত—খুকু। ফ্রক পরাত। ঘটিহাতা হাফ প্যান্ট পরত, মাথায় ফিতে বাঁধত, একবার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আবার তাকে শাড়িও পরানো হয়েছিল। তার চমত্কার দাড়ি গোঁফ গজিয়েছে, পৌরুষেয় অঙ্গও জেগে উঠেছে তবু সে খুকুই রয়ে গেছে। তার বন্ধুরা তো খুকু ছাড়া অন্য কোনো নামে কখনো ডাকেনি। তার নববিবাহিত স্ত্রী মাইশাও বলে, খুকু সিগারেটটা ছেড়ে দাও না প্লিজ। কিংবা খুকু তোমার তো হেভি পারফোর্মেন্স!

দ্বিতীয় খুকু তার ফ্রি প্রাইমারি স্কুলজীবনের সবচেয়ে মোটাসোটা ক্লাসমেট খুকুরাণী সমাদ্দার। তাদের ক্লাস টিচার বলেছেন সবাই নিরাপদ দূরত্বে থেকো—খুকু যদি কারো উপরে গড়িয়ে পড়ে সে কিন্তু চিড়ের মতো চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।

খুকু তার একটা না একটা দোষ ধরে চড় থাপ্পর মারত, কান ধরে উঠবস করাত। মন্টুর হাতের লেখা খারাপ, এজন্য শাস্তি দিত; নিচু হয়ে তাকালে তার নাকে ভেতর সর্দি দেখা যায় কেন এই অপরাধেও খুকুর মার তার অবশ্যপ্রাপ্য হয়ে উঠত। তবে সে তার বিরুদ্ধে টিচারের কাছে বিচার দিতে পারে এই ভয়ে টিফিন টাইমে স্কুলের গেটে কুলিং ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আইস্ক্রিমওয়ালার কাছ থেকে মিল্ক আইস্ক্রিম কিনেও খাওয়াত। দু-চারটা চড় খেলেও আইস্ক্রিম পাবার পর মারটা পুষিয়ে যেত। খুকু অকারণে, কারণে কেন তাকে মারত, সে-ই ভালো জানে।

তৃতীয় খুকুর বাম চোখটা ট্যারা হতে পারে। সম্ভবত এই সেই খুকু।

চতুর্থ খুকুর নাম সচিবালয়ের খুকু। খবরের কাগজ তার ছবি ছেপেছে, শিরোনামে লিখেছে: মক্ষীরাণী খুকুর সাম্রাজ্য। মন্ত্রী, সচিব, চিফ ইঞ্জিনিয়ার, এমডি প্রায় সবাই তার উষ্ণ শরীরের ছোঁয়া পেয়েছিল। বিনিময়ে তার হাতে তুলে দিয়েছেন রাষ্ট্রের অনেক মেগাপ্রজেক্টের ওয়ার্ক অর্ডার। সেই খুকুর সাথে মন্টু কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়। সেই খুকুর তালিকায় আঠার হাজার নাম ও ফোন নম্বর থাকতে পারে, তারা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মন্টু নামের কেউ নেই।

মন্টু দ্রুত লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পরে, সাদা টি-শার্টে গা ঢাকে, কমোড চেক করে, আবার দরজার পাশে এসে দাঁড়ায়, পুরনো আমলের দরজায় স্পাইহোল না থাকায় দরজায় চোখ লাগিয়ে দেখে যে খোলা না খোলার সিদ্ধান্ত নেবে তার উপায় নেই। দরজা খুলতে দেরি হওয়ায় কলিং বেল আবার বেজে ওঠে।

খুলছি।
নারীকন্ঠ এবার ধমকে ওঠে। দরজা খুলতে কতক্ষণ লাগে?

ছিটকিনি খুলতেই প্রায় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে সম্পূর্ণ বোরকাঢাকা এক নারী। চেহারা না দেখা পর্যন্ত তার বয়স ঊনিশ না ঊনআশি তা বলা সম্ভব নয়।

কে, কি, কেন—এসব প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়ে খুকু বলল, আগে দরজা বন্ধ করুন। পাঁচ মিনিট বসে কথা বলে চলে যাব, আপনাকে অস্থির হতে হবে না। আমিই খুকু। গতকাল আমার গায়ে হলুদ হয়েছে। যদি সব ঠিকঠাক থাকে আগামীকাল আপনার সাথে আমার বিয়ে। অবশ্যই যদি সব ঠিকঠাক থাকে।

পরস্পরকে তুমি বলার মতো কথোপকথন তাদের হয়নি—এ নিয়ে মন্টু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নয়। বিয়ের রাতেই আপনি ও তুমির ফয়সালা হয়ে যাবে। বিয়ের রাতে মন্টুর মা আলেয়া বেগম তার বাবাকে তুমি সম্বোধন করেছিলেন, এতে নসরুল্লাহ সাহেব ঈষত্ ক্ষিপ্ত হন এবং বলেন, বয়সে আমি তোমার চেয়ে এগার বছরের বড় এটা মাথায় রেখে কথা বলো। অবশ্য দিন বদলে গেছে। একুশ বছরের বড় স্বামীকে স্ত্রী অবলীলায় তুমি বলতে থাকে।

বোরকার পর্দা পুরোটা সরাতে মন্টু থ হয়ে গেল। এত কাছে থেকে তো আগে দেখেনি। তরতাজা রক্তমাংসের এ সুন্দর তরুণী, রাতভর বিশ্লেষণ করে যে খুঁতটি বের করেছিল সেই বাম চোখটিকে আর ট্যারা মনে হচ্ছে না।

হঠাত্ মন্টু আনমনা হয়ে পড়ে—প্যান্ট পরেছে ঠিকই, কিন্তু জিপার কি টেনেছিল—মনে করতে পারছে না। তাড়াতাড়ি একটা পুরনো খবরের কাগজ কোলের উপর রাখে—এ জায়গাটা অন্তত ঢাকা পড়ুক।

একটু প্রকৃতিস্থ হবার পর মন্টুই বলল, কষ্ট করে আপনাকে এতদূর আসতে হলো। একটা ফোন করলেই হতো। সব যে ঠিকঠাক নেই সেটা তো বেশ অনুমান করতেই পারছি। আমি আসলে কোনো কিছু লুকোতে চাইনি। সে জন্যই সত্যটা চিঠিতে লিখেছি।

খুকু বলল, ঠিকই করেছেন।

মন্টু বলল, আমি বুঝতে পেরেছি পারিবারিক চাপে আপনাকে সম্মতি দিতে হয়েছে। আপনি এ নিয়ে ভাববেন না; রিজেক্ট করাটাই স্বাভাবিক। ঘটনা যাই হোক আমাকে বলতেই হবে, এটা আমার প্রথম বিয়ে না, দ্বিতীয় বিয়ে। লন্ডনে আসার পর যখন ইলল্যিগাল ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে ধরা পড়লাম, ডিপোর্ট করবেই, সে সময় এক ইমিগ্রেশন লইয়ার বললেন টাকা খরচ করতে পারলে ডিপোর্টেশন ঠেকিয়ে দিতে পারবেন। তখন আমার মায়ের বয়সের কাছাকাছি এক বিধবা গ্যাব্রিয়েলা আন্ডারউডকে বিয়ে করলাম। আমি পরের ১২০ দিন গ্যাব্রিয়েলার অ্যাপার্টমেন্টেই ছিলাম; উকিল আর গ্যাব্রিয়েলা মিলে বাকি কাজটা করেছে। অনেকগুলো কাগজে সই করতে হয়েছে। এর মধ্যে বিয়ের কাগজ রয়েছে। কাজেই আমার অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে গ্যাব্রিয়েলা আন্ডাউডকে আমি বিয়ে করিনি এবং তিনি আমার প্রথম স্ত্রী নন। তার অনুরোধে আমি তাকে গ্যাবি ডাকতাম।

একটু দম নিয়ে মন্টু বলল, গ্যাব্রিয়েলা যদি সবটাই টাকার জন্য করত তাহলে ভয়ঙ্কর অসুস্থ হবার পর আমাকে সস্তা হাসপাতালের বিছানায় রেখে পালিয়ে যেত। কিন্তু তার যতটা সম্ভব দেখাশোনা করেছেন। আমার কাগজপত্র বৈধ হবার পর ডিভোর্স করেছেন। আপনার দিক থেকে আমি বলব ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অসুবিধে নেই। আমি ঝর্ণা আপুকে বলে দিচ্ছি, সামলে নেবে। তাছাড়া আমাদের পক্ষে গেস্ট সংখ্যা খুব বেশি নয়। ফোনেই বলে দেওয়া যাবে।

এতক্ষণ শুনে খুকু বলল, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?

মন্টু বলল, হ্যাঁ মূল কথাটা, মানে যে কথাটা আমি লুকোতে চাইনি তা বলা হয়ে গেছে। তার মানে প্রকৃতপক্ষে আপনার সাথে আমার বিয়েটা কোনোভাবেই আমার প্রথম নয়, দ্বিতীয় বিয়ে। আপনি কিছুটা দেরিতে হলেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনাকে আমার যথেষ্ট সুন্দরী মনে হয়েছে, আপনি অবশ্যই একজন ফ্রেশ হাজব্যান্ড, আগে যে ভাবেই হোক বিয়ে করেনি—এমন একজনের দাবি জানিয়ে আমাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। আমিও মিথ্যে দিয়ে জীবন শুরু করতে চাই না।

খুকু বলল, আপনার কথার রিপিটেশন হচ্ছে। আমি মহিলাদের মতো এক কথা বারবার বলা পছন্দ করি না।

মন্টু একটুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে বলল, সরি।

খুকু বলল, আপনি যে বিষয়গুলো বলেছেন আমি সাত বছর বয়সেই এসব শুনেছি। আমার সবচেয়ে বড়ভাই লন্ডনের হ্যাম্পস্টিড এলাকায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, আর একটু হলে ডিপার্টেড হতে যাচ্ছিল। তখন আইরিশ এক উকিল এক হাজার পাউন্ড চুক্তিতে অ্যানাবেল সুইনবার্গ নামের প্রায় পয়ষট্টি বছর বয়সী এক ইংলিশ ইহুদি নারীর সাথে আমার পচিঁশ বছর বয়সী ভাইয়ার বিয়ের আয়োজন করে। বিয়ের কাগজপত্র সই হয়। এগুলো ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে দাখিল করা হয়। কথা ছিল ছয়মাস পর কাগজে কলমে আমার ভাইকে ছেড়ে নতুন কোনো ক্লায়েন্টকে খুঁজবে।

যদিও আমার ভাইয়ার বলতে গেলে কোনো উপার্জনই ছিল না অ্যানাবেল প্রতিমাসে দেড়শ পাউন্ড করে একটা অ্যালাউন্স দিতে শুরু করল। তারপর একসময় তার রুমভাড়াই বাঁচিয়ে দেবার জন্য তার বাড়িতে তুলে আনল এবং তারা সত্যি সত্যিই স্বামী-স্ত্রীর জীবন যাপন শুরু করল। তার ভয় ছিল ইয়ং হবার কারণে কখন না আমার ভাই তাকে ডাম্প করে চলে যায়। ভাইয়া তা করেনি। আরো তিন বছর পর অ্যানাবেল সুইনবার্গ মারা গেলে ভাইয়া এতটাই কষ্ট পায় যে বাকি জীবন বিয়ে না করে থাকার প্রতীজ্ঞা করে বসে। মাত্র গত বছর তার প্রতীজ্ঞা ভেঙে একটি বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করেছে। আপনার ব্যাপারটা আমার কাছে কোনো বিষয়ই নয়। আমার কথাটা শোনার পর আপনার সিদ্ধান্ত যত দ্রুত আমাকে জানাবেন তত দ্রুত আমি বাড়ি ফিরে যেতে পারব। দেখতে পাচ্ছেন বোরকা পরে এসেছি। বোরকাটা বুয়ার। সে-ই বেরোতে সাহায্য করেছে। এখন সে আমার রুম ভেতর থেকে বন্ধ করে শুয়ে বা বসে আছে। আমার তিন টোকার সিগন্যাল শুনলে দরজা খুলবে, আমি ভেতরে চলে যাব, সে বোরকা নিয়ে বেরিয়ে আসবে।

বলুন, কী বলতে চাচ্ছেন?

গতকাল সকালে হলে নিশ্চিতভাবে বলতে পারতাম না। আজ পারছি কারণ মধ্যরাতে লুকোনো প্রেগন্যান্সি কিট দিয়ে ইউরিন টেস্ট করেছি। পজেটিভ। মানে আমি প্রেগন্যান্ট। আপনি প্রেগনেন্সির সাথে জড়িত কোনো প্রশ্ন যেমন কাজটা কে করল, তার সাথে কতদিনের সম্পর্ক এমন কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবেন না। আপনাকে সিদ্ধান্তটা পাঁচমিনিটের মধ্যেই জানাতে হবে—আমার পেটের সন্তান আপনার নয় জেনেও আমাকে বিয়ে করবেন না করবেন না? আপনার উত্তরও আমি জানি। উত্তরটা না। তবুও আপনার নিজের মুখ থেকে শুনলে আমার সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে—কিংবা আমি যে সিদ্ধান্ত নেব সে জন্য কোনো গিল্ট ফিলিং থাকবে না।

তার কথাটা মন্টুর কানে কতটা ঢুকেছে সে-ই জানে। তা অনেকক্ষণ ধরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি আসলেই অনেক সুন্দর।

খুকু বলল, ধ্যাত্ পিতলা আলাপ ছাড়েন। যা জিজ্ঞেস করেছিলাম তার জবাব দেন। সময় আছে আর সাড়ে তিন মিনিট। আপনি আমাকে তুমি বলতে শুরু করলেন নাকি? বয়সে বড় হলেই তুমি বলার অধিকার জন্মায় না। শুনুন আমার প্রেগন্যান্সি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না, আমি বলেছি। কিন্তু আপনার মনে প্রশ্ন থাকলে আছে, থাকারই কথা। আপনার সিদ্ধান্তের সুবিধের জন্য আপনি জিজ্ঞেস করার আগেই কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিচ্ছি: প্রথমত: এই সন্তানটির বাবা যে আমি তাকে একটুও ভালোবাসি না—কাজেই তাকে বিয়ে করার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাহলে এমআর-এর নামে একটা গর্ভপাত করিয়ে নিলেই তো হয় সব ঝামেলা মিটে যাবে। আমি এমআর চাই না, আমি বেবিটাকে চাই। আপনাদের পক্ষ থেকে যখন আমাকে দেখতে আসে তখনও আমার একই অবস্থা। কিন্তু ভেতরের দিকটা তো দেখা যায় না। এটা জানলে যারা আমাকে সুন্দর বলেছে সবাই ছিঃ ছিঃ করতে থাকবে। আর একটা কথা শুনুন প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছি বলে আমি অথৈ সাগরে পড়েছি এটা যদি মনে করেন তবে ভুল করবেন। আমি যে অবস্থায় আছি সব জেনেশুনে একজন আমাকে বিয়ে করার জন্য একজন অপেক্ষায় আছে। শুধু আমার মুখের হা শুনতে চায়। বলতে পারেন তাহলে আমি তাকে এখনই বিয়ে করছি না কেন? এখানেও একটি বাস্তব সমস্যা আছে। তার ভালোবাসার কারণে আমি তাকে বিয়ে করতে রাজি কিন্তু আমার সন্তানটিকে ভরণপোষণ করার মতো সামর্থ্যও তার নেই। অথচ আমার বেবি আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি। এই বেবির বাবা কে সে প্রশ্ন আমার কাছে অবান্তর। আপাতত বাকি রইলেন আপনি। এখন পর্যন্ত আমার মনে হচ্ছে আমাদের দুজনের—মানে আমার আর আমার বেবির ভরণপোষণের সামর্থ্য আপনার আছে। আর ভালোবাসার কথা—কাছাকাছি থাকলে আমাদের জন্য আপনার ভালোবাসা সৃষ্টি হবে, আপনার জন্যও আমার হবে। আপনি রিজেক্ট করে দিলে সমস্যা মোটেও নেই, কারণ আমাকে যারা ভালোবাসতেই চেয়েছে তাদের কেউ না কেউ বেবিসহ আমার সাথে সংসার করতে রাজি হয়েও যেতে পারে, হয়তো সে আপনার চেয়েও যোগ্য পাত্র। এমন কাউকে যে পাবই সে আত্মবিশ্বাস আমার কোত্থেকে এলো—এটা জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমার জবাবটা আত্মম্ভরী মনে হলেও সত্যটা তো বলতেই হবে—এটা সুন্দর হবার অ্যাডভান্টেজ। আমি জানি আমি আর দশটা মেয়ের চেয়ে দেখতে বেশি সুন্দর।

মন্টু মুখ খুলল, সাড়ে তিন মিনিটের পুরোটা তো আপনিই নিয়ে নিলেন। আমার জন্য কি তার তিরিশ সেকেন্ডও থাকবে না?

সময় দিয়ে লাভ নেই। উত্তর আমি জানি। তবুও আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। আমারও গিল্ট ফিলিংসটা যাতে না হয় সে জন্যই বোরকা পরে হাজির হয়েছি। আমার কথা শোনার জন্য ধন্যবাদ। চললাম। আপনি প্যান্টের জিপার টানুন।

মন্টুর যতটা বিব্রত হবার কথা হলো না। উঠে দাঁড়িয়ে খুকুর কাঁধে হাত রেখে প্রত্যয়ী কণ্ঠে তুমি সম্বোধন করেই বলল, তোমার সামনে আমার প্যান্টের জিপার খোলা কি বন্ধ তাতে কিছু এসে যায় না। কারণ আমি রাজি। আর জেনে রেখো ঐ বেবিটা আমারই। মানে তোমার আর আমার।

এবার খুকু আবেগবিহ্বল হলে বলল, মানে?

মন্টু বলল, বেবিটা হিসেবের একটু আগে হবে এই তো? চিন্তা নেই আমিই রটিয়ে দেব তোমার সাথে আমার আগে থেকেই ওরকম শোওয়াশুয়ির একটা সম্পর্ক ছিল।

মন্টু দু’হাত বাড়াতে খুকু তার হাতের বেস্টনির মধ্যে এসে বোতাম উলট-পালটের কারণে বুকের কাছের বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গায় মুখ রেখে কামড়াতে শুরু করল। মুখ তুলে বলল, তুমি মিথ্যে বলছো না তো?

মন্টু বলল, সেটা পরীক্ষা করার জন্য কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করার কী দরকার। তুমি থেকে যাও। তোমাকে আর বুয়ার বেশে ফেরার দরকার নেই।

খুকু বলল, না, কাল রাত থেকে তো তোমার সাথেই থাকব।

মন্টু খুকুকে রিকশায় তুলে দেয়। বলে, খুকু হ্যাভ অ্যা সেইফ জার্নি।

খুকুও মুখ ঘুরিয়ে আড় চোখের ইশারায় দেখায়, জিপার টানো মন্টু। বাইরে অন্য মানুষ।

পাদটীকা
মন্টু খুকুকে মিথ্যে কথা বলেছে। লন্ডনের গ্যাব্রিয়েলা অ্যান্ডারউড মোটেও বিধবা ছিল না, তার মায়ের বয়সীও নয়। গ্যাব্রিয়েলা তখন তারই সমবয়সী মোটামুটি সুন্দরী ইংলিশ তরুণী। কোনো উকিল তাকে যোগাড় করে দেয়নি। মায়ের বয়ফ্রেন্ডের হাত থেকে বাঁচার জন্য এসেক্স থেকে লন্ডনে চলে এসেছে। হাই, হ্যালো করতে করতে মন্টুর সাথে একটা মিষ্টি সম্পর্ক হয়েছে। মন্টুকে ধরে রাখার জন্য বিয়ের আয়োজন সে-ই করে। তারা একসাথে সাড়ে চার বছর স্বামী-স্ত্রীর জীবনও যাপন করে। গ্যাব্রিয়েলা যখন একটা বাচ্চার জন্য উতলা হয়ে উঠে মন্টু তাকে বলে তুমি যদি কনসিভ করতে না পারো সেটা কি আমার দোষ? তোমার প্রবলেম আছে, চেক করাও।

এবার গ্যাবি বলে চেক করানোর দরকার নেই। আমার মার বয়ফ্রেন্ড আমাকে প্রেগন্যান্ট বানিয়ে দিয়েছিল। আমার মা-ই অ্যাবর্ট করানোর ব্যবস্থা করে দেয়। আর তুমি বাস্টার্ড বলছো আমি কনসিভ করতে পারি না।

ভাঙন ধরে যায়। মাস তিনেকের মধ্যে গ্যাবিই মন্টুকে ডিভোর্স করে। মন্টু তার দুর্বলতা জানে বলেই যথেষ্ট আস্থার সাথে খুকুকে বলে, অবশ্যই তোমাকে বিয়ে করব।

মন্টু জিপার টানতে টানতে খুকুর দিকে আবার তাকায়। খুকুর রিকশা ততক্ষণে আরো এক ঝাঁক রিকশার মধ্যে হারিয়ে গেছে।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;